পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
আত-তাওকিদ
শায়খ সুলাইমান আল উলওয়ান
তাওহিদ ও তাওহিদের সঠিক দাওয়াত নিয়ে শায়খ আল-আল্লামা সুলাইমান বিন নাসির আল-উলওয়ানের অনবদ্য একটি রচনা হল আত-তাওকিদ। সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর অর্থবোধক এ লেখাটি ইন শা আল্লাহ সকল মনযোগী পাঠকের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।
লেখক পরিচিতি
সুলাইমান ইবন নাসির ইবন আবদুল্লাহ আল-‘উলওয়ানের জন্মে বিলাদুল হারামাইনের আল-ক্বাসিম প্রদেশের বুরাইদা শহরে। ১৩৮৯ হিজরিতে। শায়খ সুলাইমান ‘ইলম শিক্ষা শুরু করেন ১৫ বছর বয়সে। শুরু থেকেই শায়খ সুলাইমান শারীয়াহর বিভিন্ন ব্যাপারে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও তার বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির কারনে প্রশংসিত ছিলেন।
প্রথম দিকে শায়খ সুলাইমানে মনোনিবেশ করেন শায়খ আল-ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, ইবন আল –ক্বায়্যিম, ওলামায়ে নাজদ এবং ইবন রজব আল-হানবলীর রচনাবলী, ইবন হিশামের রচিত সীরাহ এবং ইবন কাসিরের আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার অধ্যায়নে। ফজর, যুহর, মাগরিব ও ইশা – প্রতি ওয়াক্তের সালাতের পর একজন করে মোট চারজন আলিমের নিকট তিনি প্রতিদিন গমন করতেন।
দিনে কতো ঘন্টা তিনি পড়াশোনা করেন, এ প্রশ্নের জবাবে শায়খ সুলাইমান বলেন – ১৫ ঘন্টার চাইতে সামান্য বেশি।
মদীনাতে তিনি শায়খ হাম্মাদ আল-আনসারির অধীনে ‘ইলম শিকাহ করেন। শায়খ হাম্মাদের কাছ থেকে তিনি সিহাহ সিত্তাহ সহ, মুসনাদ আহমদ, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সাহিহ ইবন খুযায়মাহ, সাহিহ ইবন হিব্বান, মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক ও মুসান্নাফ আবি শায়বাহ শেখানোর ইজাযাহ প্রদান করেন।
শায়খ হাম্মাদের কাছ থেকে শায়খ সুলাইমান তাফসির ইবন কাসির, তাফসির ইবন জারির, ইবন মালিকের আল-আলফিয়্যাহ, এবং ফিক্বহের বিভিন্ন কিতাবের উপরও ইজাযাহ লাভ করেন। এছাড়া মক্কা থেকেও তিনি একই ধরনে ইজাযাহ অর্জন করেন। শায়খ সুলাইমান আল-আল্লামা শায়খ হামুদ বিন উক্বলা আশ শু’আইবিরও ছাত্র।
শায়খ সুলাইমান সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সহিস সনদ অনুযায়ী হাদিস বর্ননাকারীদের সিলসিলার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তিনি এমন ব্যক্তির কাছ থেকে নিজ হাদিস শুনেছেন যে ব্যক্তি এমন ব্যকির কাছ থেকে শুনেছে, যে ব্যক্তি এমন ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছে…যা শেষ পর্যন রাসুলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে।
শায়খ নিয়মিত নিজ অঞ্চলের মাসজিদে দারস দিতেন। বুখারি, মুসলিম, তিরমিযী, মুয়াত্তা মালিক, সুনান আবি দাউদ, বুলাগ আল মারাম, উমদাত আল আহকাম, ইমাম নাওয়ায়ির চল্লিশ হাদিস – এই কিতাব গুলো ছাত্রদের শেখাতেন। এছাড়া তিনি ছাত্রদের শেখাতেন মুসতালাহ আল-হাদিস, ‘ইলাল, ফিক্বহ, তাফসির এবং আরবী ব্যাকরন। এছাড়া আক্বিদাহর নিম্নোক্ত বইগুলোর উপর তিনি শিক্ষাদান করতেন –
আল-আক্বিদাহ আল তাদমুরিয়্যাহ, আল আক্বিদাহ আল হামাউইয়াহ, আল আক্বিদাহ আল ওয়াসিতিয়্যাহ, কিতাব আত তাওহিদ (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ), আশ শারীয়াহ (আল-আজুররি), আস সুন্নাহ (আবদুল্লাহ ইবন আহমাদ), আল-ইবানাহ (ইবন বাত্তাহ), আস সাওয়াইক্ব এবং আন ন্যূনইয়্যাহ (ইবন আল-ক্বায়্যিম)
শায়খ সুলাইমান ১৮ বছর বয়সে কুরআন হিফয সম্পন্ন করেন। আর বিষের কোঠায় থাকা অবস্থাতেই তিনি মুখস্ত করেন ছয়টি হাদিস গ্রন্থের পাশাপাশি নিম্নোক্ত বইগুলো এবং এগুলোর ব্যাখ্যা (শার’হ) –
কিতাব আত তাওহিদ, আল ওয়াসিতিয়্যাহ, আল হামাউইয়্যাহ, আল বায়ক্বুনিয়্যাহ, উমদাত আল-আহকাম, আল আরজুমিয়্যাহ, নুকবাত আল ফিক্বর, আর রাহবিয়্যাহ, বুলুগ আল মারাম, উসুল আস-সালাসা, আল ওরাক্বাত, মূলহাত আল-ই’রাব, আল-আলফিয়্যাহ, কাশফ আশ-শুবুহাত।
শায়খ সুলাইমান আল ‘উলওয়ান বিবাহসূত্রে শায়খ ইউসুফ আল-উয়ায়রির রাহিমাহুল্লাহ আত্মীয় এবং তারা ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। বর্তমানে সাউদি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা করার কারনে মিথ্যা অভীযোগে শায়খ সুলাইমানকে দ্বিতীয়বারের মতো কারাবন্দী করা হয়েছে। আল্লাহ শায়খের সময়, হায়াত ও ইলমে বরকত দান করুন, এবং শায়খের কল্যানময় মুক্তি ত্বরান্বিত করুন।
**********
إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ هَادِىَ لَهُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
বাদ হামদ ও সালাত:
তাওহিদ হচ্ছে বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার। একারণেই তাকে সামর্থ্য প্রদান করা হয়েছে। সময়ের উত্তম অংশ এজন্যেই দেওয়া হয়েছে। এটাই একজন মুসলিমের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আর তাওহিদ না জানা এবং ত্যাগ করা তার জন্যে দুর্ভাগ্য। আল্লাহ তায়ালা যে তাওহিদ বান্দাহের জন্যে আবশ্যক করেছেন, প্রত্যেক বান্দার এ সম্পর্কে জানাশোনা আবশ্যক। এমনিভাবে তাওহিদের বিপরীত বিষয়াবলিও জানা আবশ্যক। নতুবা মানুষ নিজের অজ্ঞাতসারেই শিরকে লিপ্ত হবে। অনেক বিষয় তার বিপরীত বিষয় দ্বারা চেনা যায়, ভালোর বিপরীতটাই ভালোকে প্রকাশ করে।
যে শিরককে চিনবে না, অবশ্যই সে শিরকে পতিত হবে। যেমন অনেক দেশেই এমন বহু লোক আছে, যারা নিজেদেরকে ইসলামের অনুসারী দাবি করে অথচ কবরের চতুর্পাশে তাওয়াফ করে, কবরবাসির জন্যে নযর-নেয়ায নিয়ে যায়, এদের জন্যে মান্নত করে, এদের জন্যে পশু কুরবানি করে, এদের কাছে সাহায্য চায়, এদের কাছে আশ্রয় চায়, বিভিন্ন বিপদ আপদ থেকে মুক্তির জন্যে, রোগ-ব্যধি থেকে মুক্তির জন্যে এবং হতাশা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এদের কাছে প্রার্থনা করে (নাউযুবিল্লাহ)। এতকিছুর পরও সে নিজেকে ইসলামের অনুসারী দাবি করে। এত অজ্ঞতা, পথভ্রষ্টতা এবং দ্বীন সম্পর্কে বিমুখতা সত্ত্বেও সে নিজেকে ইসলামের ধারক-বাহক ও সাহায্যকারী দাবি করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট ও উত্তম অভিভাবক।
অবস্থা যখন এমন― যার বিবরণ ও আলোচনা আমরা করলাম, তখন আমাদের জন্য আবশ্যক হলো এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিক সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা। অনেক মানুষ আছে যারা এত্থেকে গাফেল ও বিমুখ। তাই আমাদের উচিৎ, তাওহিদের প্রচার ও এর বাণী সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া, যেমনিভাবে নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে বিশেষভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত আর তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ তথা এটা বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে, আল্লাহই হচ্ছেন খালিক (স্রষ্টা), রাযিক (রিযিকদাতা), মূল নিয়ন্ত্রক― এগুলোতো মক্কার কাফিররাও স্বীকার করতো। অথচ তাদের শিরক ছিলো কী ভয়াবহ! আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾
আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, সকল প্রশংসা আল্লাহরই। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না। (সূরা লুকমান: ২৫)
অথচ এই যুগে এমনও লোক পাওয়া যায় যারা ওই যুগের মুশরিকদের স্বীকার করা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহও স্বীকার করে না।[1] কিন্তু যে তাওহিদ সহকারে রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন, তা হলো তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, অর্থাৎ প্রতিটি ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক মানা। অবশ্য এর ভেতরেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।[2]
অধ্যায় : ০১
তাওহিদের এত মর্যাদার কারণেই নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে এত গুরুত্ব দিয়ছেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও তিনি তাওহিদের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন,
لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
ইহুদি-খৃস্টানদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক, তারা তাদের নাবিদের কবরসমূহকে সিজদার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।[3]
নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, যদি আমরা তাদের মতো করি তাহলে আমাদের উপরও তাদের মতো অভিশাপ বর্ষিত হবে, যেভাবে তাদের উপর বর্ষিত হয়েছে, কেননা কবরকে সিজদার জায়গা বানানো মারাত্মক পর্যায়ের শিরক।
যখন নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কষ্ট বেড়ে গেলো তখন তিনি বললেন,
ائْتُونِي بِكِتَابٍ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَا تَضِلُّوا بَعْدَهُ
তোমরা খাতা কলম নিয়ে এসো, আমি তোমাদেরকে এমন ওসিয়ত লিখে দিবো, যার ফলে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট হবে না।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন নাবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথা বেড়ে গেলো। আমাদের সামনে আল্লাহর কিতাব আছে, এটাই যথেষ্ট। এমতাবস্থায় উপস্থিত লোকদের মধ্যে উচ্চবাক্য শুরু হয়ে যায়। তখন নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা আমার সামনে থেকে চলে যাও, আমার সামনে ঝগড়া করা উচিৎ নয়।[4]
নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওসিয়ত করা ব্যতীতই ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তিনি যদি ওসিয়ত করতেন তাহলে অবশ্যই তাওহিদকে বাদ দিতেন না। এ কথা প্রমাণ করে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে হাসান সনদে তিরমিযিতে বর্ণিত হাদিসটি। তিনি বলেন,
من سرَّه أَنْ ينظُرَ إلى الصحيفة التي عليها خاتَمُ مُحمَّدٍ صلى الله عليه وسلم ، فليقرأ هؤلاء الآيات : ﴿قُلْ تَعالَوْا أَتْلُ ما حَرَّمَ ربُّكُمْ عليْكم أَلاَّ تُشْرِكوا به شيئا وبالوَالِدَيْنِ إحْسَانا ، ولا تَقْتُلوا أَوْلادَكم مِنْ إِملاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وإِيَّاهم ، ولا تَقْربُوا الفَوَاحِشَ ما ظَهَرَ مِنْها ومَا بَطَنَ ، ولا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتي حَرَّمَ اللّه إلا بالحقِّ ، ذَلِكمْ وصَّاكمْ بِهِ لَعَلَّكم تَعْقِلونَ ،ولا تَقْرَبُوا مَالَ اليَتِيم إلا بالتي هي أَحْسنُ حتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ، وأوْفُوا الكَيْلَ ، والمِيزَانَ بالقِسْطِ ، لا نُكَلِّفُ نفْسا إلا وُسعَها ، وإذا قُلْتُم فاعْدِلوا ، ولَوْ كان ذَا قُرْبَى ، وبِعَهْدِ اللّه أوْفُوا ، ذلكم وصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكم تَذكَّرُونَ ، وأنَّ هذا صِراطِي مُسْتَقيما ، فاتَّبِعُوهُ ولا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيِلهِ ، ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُون﴾
যে ব্যক্তি নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ ওসিয়ত পড়তে চায় সে যেনো আল্লাহর এই আয়াত পড়ে :
আপনি বলুন, এসো! আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাই, যেগুলো তোমাদের রব তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তা এই যে,
১. আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না,
২. পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করবে না।
৩. স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করবে না, কেননা আমিই তোমাদেরকে এবং তাদেরকে আহার দেই,
৪. নির্লজ্জতার ধারেকাছেও যাবে না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য;
৫. ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করবে না। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝতে পার (সূরা আনয়াম: ১৫১) [5]।
সূরা আনআমের যে আয়াতটি ইবনে মাসউদ উল্লেখ করেছেন এতে প্রথমেই তাওহিদের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে এবং তাওহিদের বিপরীত বিষয়াদি থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ইবনু মাসউদের মতো মহান সাহাবি থেকে এরকম আলোচনা তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্বের প্রতি নির্দেশ করে। মানুষ ইলম ও দ্বীনের যে পর্যায়েই পৌঁছুক না কেনো, সর্বদা সে তাওহিদেরই মুখাপেক্ষী। তাওহিদ থেকে সে কখনো মুক্ত হতে পারবে না।
এ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ভুল করে। আর বলে, এ যুগের মানুষের জন্যে তাওহিদের আলোচনা দরকার নেই, কেননা তারা শিরক মুক্ত ইসলামি দেশে বাস করছে ইত্যাদি। অথচ এ ধরনের কথাবার্তা সুস্পষ্ট মূর্খতা। যদি কিছুক্ষণের জন্যে মেনেও নেয়া হয়, তারপরেও এ কথার কোনো বাস্তবতা নেই। বরং আজ সর্বত্র শিরক ছড়িয়ে পড়ছে, বিদয়াত ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে। অথচ এর অস্বীকারকারী ও অপছন্দকারী নেই। আল্লাহর কাছেই অভিযোগ করি, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি।
তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব বোঝার জন্য এটাও সহায়ক যে, নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য হুকুম ফরয হওয়ার পূর্বে ধারাবাহিক দশ বছর শুধু তাওহিদেরই দাওয়াহ দিয়েছেন। এটাও তাওহিদের গুরুত্ব প্রমাণ করে। কেননা তাওহিদ ব্যতীত আল্লাহ তায়ালা কোনো আমলই গ্রহণ করেন না। নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়ায ইবনু জাবালকে ইয়ামানে পাঠানোর প্রাক্কালে তাকে বলেছিলেন,
إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللَّهَ تَعَالَى
তোমাকে আহলে কিতাবের কাছে পাঠানো হচ্ছে, সুতরাং প্রথমেই তুমি তাদেরকে আল্লাহর তাওহিদের দাওয়াহ দিবে।[6]
এজন্য নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াহ কার্যক্রমের শুরুতেই বলেছিলেন,
قُولُوا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ تُفْلِحُوا
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো সফল হয়ে যাবে।[7]
নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,
لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
তোমরা মৃত্যু উপকন্ঠে উপস্থিত ব্যক্তিকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্মরণ করিয়ে দাও।[8]
এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একজন মুসলিমকে পরিষ্কার ও স্পষ্ট করে দেয় যে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলিম তাওহিদের মুখাপেক্ষী। কেননা তার জীবন তাওহিদ দ্বারাই ঘটিত, আর তাওহিদ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ, অতীব প্রয়োজনীয়। আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো নাবি-রাসুলকে পাঠান নি, যিনি তাঁর জাতিকে তাওহিদের দিকে আহবান করেন নি। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে রাসুলদের সম্পর্কে বলেন, তারা নিজেদের জাতিকে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন এই বলে যে,
﴿اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾
তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।[9]
অন্য আয়াতে বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ﴾
আমি প্রত্যেক জাতির কাছে একেকজন রাসুল প্রেরণ করেছি (এই মর্মে যে), তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে কাউকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং কারো উপর পথভ্রষ্টতা সত্যায়িত হয়েছে। (সূরা নাহল: ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾
আমি আপনার পূর্বেও সমস্ত রাসুল পাঠিয়েছি এই প্রত্যাদেশ সহকারে যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদাত করো। (সূরা-আম্বিয়া: ২৫)
সুতরাং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমার দাবি হচ্ছে― সম্মানের ক্ষেত্রে, ভয় ও আশার ক্ষেত্রে এবং ইবাদতের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রে আল্লাহ একক। এমন কোনো রাসুলকে পাঠানো হয় নি, যারা এই মূল ভিত্তির স্বীকৃতি দেন নি। কারণ এটাই দ্বীনের মূল ভিত্তি।
মুসনাদে আহমাদে এসেছে। ইবনু উমর রাযি থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
بُعِثْتُ بِالسَّيْفِ حَتَّى يُعْبَدَ اللَّهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَجُعِلَ رِزْقِي تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِي وَجُعِلَ الذِّلَّةُ وَالصَّغَارُ عَلَى مَنْ خَالَفَ أَمْرِي وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
আমি তরবারি সহকারে প্রেরিত হয়েছি, যাতে একক আল্লাহর ইবাদত করা হয়, আমার রিযিক আমার বর্শার ছায়াতলে রাখা হয়েছে। আর লাঞ্ছনা ও অপমান রাখা হয়েছে তাদের জন্যে, যে আমার নির্দেশের বিরোধিতা করবে, যে অন্যদলের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।[10]
এর দ্বারাও তাওহিদের গুরুত্ব ও মহত্ব বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিন শুরু হয় তাওহিদের দ্বারা, শেষও হয় তাওহিদের দ্বারা। তিনি ফজরের উভয় রাকায়াতে (তাওহিদের বিবরণ সম্বলিত) সূরা কাফিরুন এবং সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতেন।[11]
এমনিভাবে মাগরিবের প্রথম দুরাকায়াতে উপরোক্ত সূরাদ্বয় তিলাওয়াত করতেন। আমরা এ সূরা দুটিতে তাওহিদের বিবরণ পাই। সূরা কাফিরুনে গায়রুল্লার ইবাদত থেকে বৈরিতা ঘোষণা করা হয়েছে, আর সূরা ইখলাস হচ্ছে তাওহিদুল ইলুহিয়্যাহ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত সম্পর্কিত।
অধ্যায় : ০২
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবা কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁর অনুসৃত পথেই চললেন। তারা তাওহিদের সুস্পষ্ট আলোচনার দায়িত্ব নিলেন। এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করলেন। আর এ বিষয়ে তারা এজন্য মনোযোগী হলেন যে, তারা ভালোভাবে বুঝতেন― তাওহিদ ব্যতীত রাষ্ট্র ও জনগণের ভিত্তি শক্তশালী হবে না। তারা বিনিদ্র রজনি কাটিয়েছেন, দিনে পিপাসার্ত থেকেছেন তাওহিদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কেনো এমন হবে না? অথচ তারা পরিতৃপ্তিদায়ক পানীয় পান করেছেন, ইলমুশ শারিয়াহ শিখেছেন, তাদের ব্যাপারে ওহিও নাযিল হয়েছে। আর নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সামনে ছিলেন সকাল-সন্ধ্যা।
তারা পূর্ব-পশ্চিমে বিভিন্ন দেশ জয় করেছেন। এসব জায়গায় তারা তাওহিদ ও ইখলাসের কালিমাহ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ঝাণ্ডা সমুন্নত করেছেন। এরপর দেশ সুসংসত হয়েছে এবং শিরক ও ইলহাদের শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে।
এরপর এই মানহাজেই অতিক্রম করেছেন তাবিয়িন, তাবি-তাবিয়িন। তারা সকলেই তাওহিদকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবেই প্রথম তিন যুগের মানুষ কথা ও কাজে সর্বশ্রেষ্ঠরূপে পরিণত হয়েছিলো।
এরপর এমন যুগ আসলো যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদয়াত ও কুকর্ম প্রকাশিত হওয়া শুরু হলো। এভাবেই তারা মন্দকে ভালোর বিনিময়ে পরিবর্তন করা শুরু করে দিলো। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর যুগ পর্যন্ত এভাবেই চললো। এরপর যখন প্রাজ্ঞ শায়খ, মহান আলেম, অভিজ্ঞ ফকিহ ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ স্বীয় যুগে তাওহিদের ব্যাপারে অত্যধিক গোমরাহি ও মূর্খতার ছড়াছড়ি দেখলেন, তখন তিনি দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তাওহিদের সুস্পষ্ট আলোচনা শুরু করলেন, যার প্রভাব প্রায় নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিলো, যার চিহ্নটুকুও মুছে গিয়েছিল, গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কারো কাছে তা স্পষ্ট ছিলো না।
তিনি আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণভাবে জিহাদ শুরু করলেন। দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে-গোপনে, কলমে, যবানে, অস্ত্র ও তলোয়ারের সাহায্যে আহবান করা শুরু করলেন। তাওহিদকে উম্মাহর সামনে সুস্পষ্ট করলেন। এভাবেই তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে ছুটলো অশ্বারোহী দল। চারিদিকে হকের আওয়াজ সমুন্নত হলো। তাঁর দাওয়াত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদেরকে উপকৃত করলেন, পথভ্রষ্ট ও বিদয়াতিরা পথের দিশা পেলো।
এরপর এই দাওয়াত নিয়ে আলিমদের একটি দল দাঁড়ালেন এবং আর মানুষের সামনে তাওহিদের সুস্পষ্ট বিবরণ তুলে ধরলেন। এভাবে দিনকাল অতিবাহিত হতে লাগলো।
কালক্রমে আবার শুরু হলো অন্যায়-অবিচার, ধ্বংসাত্মক বিদয়াত, বিদয়াতি ওসিলা ইত্যাদি। তখন আল্লাহ তায়ালা শাইখুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহর আবির্ভাব ঘটান। আল্লাহ তাঁকে অফুরন্ত প্রতিদান দিন, বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করান। তিনি তাওহিদের দাওয়াহ দেওয়া শুরু করেন। বান্দাদেরকে নিষেধ করেন তাদের রবের সাথে কাউকে সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ না করতে। এ ব্যাপারে তিনি একটি গ্রন্থ লিখেন, কিতাবুত তাওহিদ হাক্কুল্লাহি আলাল আবিদ (তাওহিদ বান্দার উপর আল্লাহর হক)। এ গ্রন্থেই তিনি একজন মুসলিমের প্রয়োজনীয় তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ এবং তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত নিয়ে আলোচনা করেন। এই গ্রন্থ দ্বারা ছোট-বড় সর্বশ্রেণির মানুষই উপকৃত হয়।
এরপর এ দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাদের হিদায়াতপ্রাপ্ত মহান অনুসারীরা ও ছাত্ররা, যারা জ্ঞানে-গুণে অতুলনীয়। তারা বান্দাদেরকে তাদের রবের দিকে আহবান করা শুরু করেন। বিপদে সাহায্যের জন্যে, দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্যে এবং হতাশা থেকে উত্তরণের জন্যে তারা প্রকৃত মাবুদের দিকেই ফিরে যেতেন। এভাবে তারা নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অমিয় সুধা থেকে পান করেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর রহম করুন।
এরপর এ যুগে এমন কিছু উত্তরসূরী তৈরি হলো― তারা যা করে না তাই বলে, যার ব্যাপারে নির্দেশিত হয় নি তাই করে। অথচ তারা দাবি করে এ যুগের মুসলমান তাওহিদ সম্পর্কে আলোচনার মুখাপেক্ষী নয়। বর্তমান যুগের মানুষের সামনে এর বয়ান জরুরি নয়। এটা চেনার জন্যে বিস্তারিত আলোচনারও প্রয়োজন নেই…। এভাবে তারা নিজেরাও গোমরাহ হলো, অন্যদেরকেও গোমরাহ করলো। কত কঠিন তাদের মুখের কথা। তারা যা বলে, তা তো সবই মিথ্যা।
মনে হয় এদের কাছে তাওহিদ হচ্ছে শুধুমাত্র আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। যদি তাই হয়, তবে যার কারণে রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন, যার আলোচনার জন্যে কিতাব নাযিল হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের মূর্খতাই প্রকাশিত হয়।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
যে তাওহিদ নিয়ে রাসুলগণ এসেছেন তার একটি হলো, আল্লাহর উলুহিয়্যাহ। অর্থাৎ মানুষ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, একমাত্র তারই ইবাদত করা হবে, একমাত্র তারই উপর ভরসা করা হবে, একমাত্র তার জন্যেই বন্ধুত্ব স্থাপন করা হবে, একমাত্র তার জন্যেই শত্রুতা করা হবে, একমাত্র তাঁর জন্যেই সমস্ত আমল করা হবে। আর এগুলো তার আসমা ওয়াস সিফাতেরও প্রমাণ।
এরপর শাইখ কুরআনের কিছু আয়াত উল্লেখপূর্বক বলেন,
তাওহিদ দ্বারা শুধুমাত্র তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ অর্থাৎ এই বিশ্বাস রাখা যে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সমগ্র পৃথিবীর স্রষ্টা এটা উদ্দেশ্য নয়। এই ধরনের ধারণা পোষণ করে কিছু কালামি ও সুফিরা। তারা মনে করে, যদি রুবুবিয়্যাহ দলিলাদি দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যায় তাহলেই তাওহিদের মূল লক্ষ্য প্রমাণিত হয়ে যায়, যদি এটার সাক্ষ্য দেয়, এরই মাঝে নিজেকে মগ্ন করে দেয়, সে যেনো নিজেকে পুরো তাওহিদেই মগ্ন করলো। আল্লাহ তায়ালা যেসব গুণের অধিকারী বান্দা যদি এগুলো স্বীকার করে নেয়, আর তার অন্তরকে নিষিদ্ধ সব বিষয় থেকে বিরত রাখে, এ কথা স্বীকার করে যে, একমাত্র আল্লাহই সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা; এরপরও একজন মানুষ মুওয়াহহিদ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, একমাত্র তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত, নিজেকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করে নেয়। আর ইলাহ হচ্ছেন মাবুদ, যিনি একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত। ইলাহ অর্থ এই নয় যে, যিনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন; সিফাতের ক্ষেত্রে মুতাকাল্লিমরা যেমনটা মনে করে থাকেন। এটাই আবুল হাসান আল-আশয়ারি এবং তার অনুসারীরা দাবি করেন, অথচ তারা তাওহিদের প্রকৃত অবস্থাই বুঝেন নি, যা সহকারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন। কেননা আরবের মুশরিকরা স্বীকার করতো যে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। এরপরেও তারা মুশরিক ছিলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ﴾
তাদের অনেকেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে। (সূরা ইউসুফ: ১০৬)
সালাফদের একদল বলেন,
تسألهم: من خلق السموات والأرض ؟ فيقولون: الله، وهم مع هذا يعبدون غيره
তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, কে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন? তারা বলে, আল্লাহ! অথচ তারা এরপরও তারা অন্যের ইবাদত করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿قُلْ لِمَنِ الْأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ – سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ – قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ – سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ – قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ – سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ ﴾
(হে নবী!) ওদের জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের মালিক কে? যদি জানো তবে উত্তর দাও। ওরা উত্তর দেবে, আল্লাহ! ওদের বলো, তবে কেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? ওদের জিজ্ঞেস করো, সপ্তাকাশ ও সুমহান আরশের অধিপতি কে? ওরা বলবে, আল্লাহ! বলো, তারপরও কি তোমরা সতর্ক হবে না? ওদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তবে বলো, মহাবিশ্বের সবকিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে, যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যাঁর মোকাবেলায় কোনো আশ্রয়দাতা নেই? ওরা বলবে, আল্লাহ! ওদের জিজ্ঞেস করো, এরপরও তোমরা মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে রাখবে কেন? (সূরা মুমিনুন: ৮৪-৮৯)
আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টির স্রষ্টা ও পরিচালক এ কথা স্বীকার করলেই কেউ আবিদ বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা বাদ না দিবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না পাবে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব করা বাদ না দিবে, যতক্ষণ না আল্লাহর জন্যে শত্রুতা না করবে, তাঁর রাসুলগণের আনুগত্য না করবে, তিনি যা নির্দেশ দেন তা পালন না করবে, যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত না থাকবে। কারণ মুশরিকরাও স্বীকার করতো যে, আল্লাহ প্রত্যেক সৃষ্টিরই স্রষ্টা। তবে তারা শিরক করতো, কাউকে সুপারিশকারী হিসেবে মানতো এবং তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাতো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ – قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন, তাদের কোন অধিকার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই কর্তৃত্বাধীন, আসমান ও যমীন তারই সাম্রাজ্য। সবশেষে তারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা-যুমার: ৪৩-৪৪)
অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমনসব বস্তুর উপাসনা করে, যা না তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে, না কোনো উপকার। ওরা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। তুমি বলো, তোমরা কি আসমান ও জমিনের এমন বিষয়ে আল্লাহকে অবহিত করছ, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন? তিনি পুতঃপবিত্র ও মহান সে সমস্ত থেকে যাকে তোমরা শরিক করছ। (সূরা ইউনুস: ১৮)
﴿وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ وَمَا نَرَى مَعَكُمْ شُفَعَاءَكُمُ الَّذِينَ زَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيكُمْ شُرَكَاءُ لَقَدْ تَقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَا كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ﴾
তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ, আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের দেখছি না। যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবি ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে সুপারিশকারী। বাস্তবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের ধারণাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেছে। (সূরা আনয়াম: ৯৪)
﴿وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾
আর ব্যয় করো আল্লাহর পথে, নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর অনুগ্রহ করো। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা-বাকারাহ: ১৯৫)
আজকের দিনে এদের অনুসারী তারাই, যারা চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রকে সিজদা করে, এদের কাছে প্রার্থনা করে, এদের উদ্দেশ্যে উপবাস থাকে, এদের পূজা করে এবং এদের নৈকট্য কামনা করে। এরপর বলে, এগুলো শিরক নয়! শিরক তখন হবে যখন সে বিশ্বাস করবে এগুলোই প্রধান নিয়ন্ত্রক। যদি এদেরকে মাধ্যম বানায়, এদের মাধ্যমে সাহায্য চায় এরপরেও বলে, সে মুশরিক নয়। জেনে রাখা উচিৎ, এগুলোও শিরক।
যদি তারা মানে যে, তাওহিদ হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। এটাই হচ্ছে সেই তাওহিদ, যা সহকারে রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছেন, এক প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে― তাহলে আমাদের যুগে যে কবরকে তাওয়াফ করা হয়, কবরকে চুম্বন করা হয় এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত?
আজকে বিভিন্ন দেশে যা চলছে― ওলি-আউলিয়া, সালিহিনের জন্যে মান্নত করা, জিন-শয়তানের জন্যে পশু উৎসর্গ করা এগুলোও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, মুশরিকদেরকে ভালবাসা হবে আর মুমিনদেরকে ত্যাগ করা হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও জনবল দিয়ে সাহায্য করা হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, মানবরচিত আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা হবে আর আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হবে?[12]
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, ব্যক্তির মতকে আমাদের রব ও তাঁর প্রিয় বন্ধুর মত থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, বিভিন্ন ব্যাংকে সুদী নিয়ম চালু করা হবে, যারা এর বিরোধিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে, আর অন্যদিকে প্রচুর অর্থকড়ি দিয়ে ব্যাংককে এই অজুহাতে সাহায্য করা হবে, যাতে ব্যাংক দেউলিয়া না হয়ে যায়?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, শিক্ষার নামে মুশরিকদের দেশে সফর করা হবে এবং তাদের আদর্শ গ্রহণ করা হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, কাফিরদের প্রতীক মুসলিম দেশে উত্তোলন করা হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তভুক্ত যে, আল্লাহর সিফাতের বিকৃতি করা হবে?
এটাও কি তাওহিদের অন্তর্ভুক্ত যে, কবরপূজার প্রচারকদেরকে আশ্রয় দেওয়া হবে?
এগুলো হচ্ছে ওইসব কুকর্মের সামান্য বর্ণনা, যা আমাদের সমাজে ব্যাপক হারে প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো প্রকৃত অবস্থার সামান্য বিবরণ। অথচ খুব কম লোকই পাওয়া যাবে যারা এ ব্যাপারে সতর্ক করেন। এ কারণে নিত্যদিন এমনসব শিরকি ও বিদয়াতি কাজের জন্ম হয়েছে যেগুলোর মধ্যে আমাদের আগামি প্রজন্ম লালিত পালিত হচ্ছে, আর আজকের বয়স্করাও এসবের মাঝেই বৃদ্ধ হয়েছেন।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ إِذَا تُرِكَ مِنْهَا شَيْءٌ قِيلَ تُرِكَتْ السُّنَّةُ قَالُوا وَمَتَى ذَاكَ قَالَ إِذَا ذَهَبَتْ عُلَمَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ جُهَلَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ وَالْتُمِسَتْ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الْآخِرَةِ وَتُفُقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ
ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমাদের অবস্থা তখন কী হবে, যখন তোমাদেরকে এমন ফিতনা পেয়ে বসবে, যার মধ্যে বয়স্করা বৃদ্ধ হবে, আর বাচ্চারা লালিত পালিত হবে, মানুষ এটাকে সুন্নাহ (রীতি) হিসেবে গ্রহণ করবে। যদি কেউ এটা ত্যাগ করে তখন তাকে বলা হবে, সুন্নাহ ত্যাগ করেছো। প্রশ্ন করা হলো, এমনটা কখন হবে? তিনি বলেন, যখন তোমাদের আলিমরা মারা যাবে, কারিদের সংখ্যা বেশি হবে; ফকিহের সংখ্যা কমে যাবে, আমির বা ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে; তোমাদের সন্তানরা কমে যাবে, আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া তালাশ করা হবে, পার্থিব স্বার্থে দীন শিখা হবে।[13]
আজকে এই আসারের প্রতিটি বাক্য বাস্তবায়িত হচ্ছে। মূর্খতা ব্যাপক আকার ধারণ করছে, পরিস্থিতি দিনকে দিন ভয়াবহ হচ্ছে, অথচ অনেক জাহিল দাবি করছে, মানুষ তাওহিদ বুঝে, তাওহিদের আলোচনা প্রয়োজন নেই! এটা একটা ভয়ঙ্কর কথা, ভয়াবহ পদস্খলন। আমরা আল্লাহর কাছে এত্থেকে মুক্তি চাই।
অধ্যায়: ৩
হে ঈমানদার ভাইগণ! বর্তমানে মানুষ অনেক বিষয়ে অপরিচিত। আবার অনেক মানুষ এই অপরিচিতিটাও বুঝে না। তাই পিপাসার্ত অবস্থায় ঠাণ্ডা পানি যতটুকু প্রয়োজন তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন তাওহিদের ইলম অর্জন করা। কেননা বহু মানুষ আজ শিরকে লিপ্ত, অথচ তারা তা বুঝতেও পারছে না। আর শাসকরা মন্দকে ভালোর বিনিময়ে ক্রয় করেছে। শরিয়াহ বহির্ভূত বিষয় দ্বারা শাসন করা শুরু করেছে। এমনকি মানবরচিত আইনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। শিরকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে, এটাকে আপন করছে এবং দুনিয়াবি কিছু স্বার্থে একে সম্মান দেওয়া শুরু করছে, তাদের ব্যাপারেই বর্ণিত হয়েছে নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিস –
يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنْ الدُّنْيَا
একজন ব্যক্তি সকালে মুমিন হিসেবে অতিবাহিত করবে, বিকেলে কাফির হয়ে যাবে, বিকেলে মুমিন হিসেবে অতিবাহিত করবে তো সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামান্য বস্তুর বিনিময়ে দীন বিক্রি করে ফেলবে। (সহিহ মুসলিম, ২/১৩৩; মুসনাদু আহমাদ, ২/৩০৩-৩০৪; তিরমিযি, ৪/৪২২; সহিহ ইবনু হিব্বান, ১৫/৯৬)
যারা বলে, এখন আর মানুষের সামনে তাওহিদের আলোচনার তেমন প্রয়োজন নেই, তাদের অধিকাংশ হচ্ছে মূর্খ, যারা তাওহিদের প্রকৃতরূপ ভালভাবে চিনতে পারে নি। বরং তারা বাপ-দাদার পক্ষ থেকে যা পায় এর উপর সন্তুষ্ট থাকে, বিশেষকরে যখন নিরাপদভাবে পানাহার করতে পারে।
এইসব ব্যক্তিদেরকে ঘুম থেকে এবার জাগ্রত হওয়া উচিৎ। তাদের জন্যে আবশ্যক দৃষ্টি প্রসারিত করে ডানে বামে তাকানো, তাহলে তারা বুঝতে পারবে এই ভূ-পৃষ্ঠের উপর কত রকমের অপকর্ম চলছে।
অধিকাংশরা দীন বদলে ফেলেছে। আর সুন্নাহর দৃপ্তি বেশির ভাগ শহর ও গ্রামে নিভে গেছে। অধিকাংশ বান্দাদের ভেতরে সুন্নাহর স্থলে বিদয়াত দখল করে নিয়েছে, আল্লাহর আইন মানবরচিত আইন দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
আজ ইসলামের দাবিদার অনেক দেশে খৃস্টানদের উপাসনালয় বিদ্যমান, ইসলামি দেশসমূহে মূর্তিপূজকদের উপাসনালয় স্বীকার করার চেয়ে বড় কুফর আর কী হতে পারে? অথচ এ ব্যাপারে নীরব থাকা হচ্ছে, তাদেরকে তোষামোদ করা হচ্ছে। বরং অনেকে এর পক্ষে আল্লাহর এই কথা দ্বারা দলিল দিচ্ছে যে,
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
তোমাদের জন্যে তোমাদের দীন, আমার জন্যে আমার দীন।
তারা এই আয়াতের ব্যাখ্যা সালাফদের ব্যাখ্যার বাইরে অন্যটা করেন, এটা হচ্ছে আল্লাহর উপর সুস্পষ্ট অপবাদ, আল্লাহর আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা এবং এক আয়াতের জায়গায় অন্য আয়াত বসানো…।
আল্লাহর কসম, এরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে ইহুদি ও খৃস্টান থেকেও ভয়ঙ্কর। ইসলামের উপর বিপদাপদ তাদের পক্ষ থেকেই বেশি আপতিত হয়। যদি তাদের পানাহারের ব্যাপারটা নিরাপদ হয়ে যায় তাহলে ইসলামের উপর যে কোনো আঘাত আসলেও তাদের কিছু যায় আসে না।
তাছাড়া অনেককে পাবেন, যারা ইসলামের নামে এদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তারা এদের সাথে এমন সম্পর্ক তৈরি করে, যার দ্বারা এদের ঘৃণিত কর্মের প্রতি তাদের সমর্থন ও ভালোবাসা দৃঢ় হয়। অথচ তাদের উপর আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ওয়াজিব―
﴿وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ﴾
ফিতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। (সূরা বাকারা: ১৯৩)
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরো দুনিয়া শিরক মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ দীন আল্লাহর জন্যে হবে, তাঁর জন্যে সব ইবাদত হবে, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও।
কিন্তু এ যুগে আল-ওয়ালা ওয়াল বারা (আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও শত্রুতা) হারিয়ে গেছে। এর চিহ্নটুকুও মিটে গেছে এবং এর উপর ধুলো নিক্ষেপকারীরা ধুলি উড়িয়েছে। আল-ওয়ালা ওয়াল বারা হচ্ছে আকিদার অন্যতম একটি ভিত্তি। আল-ওয়ালা ওয়াল বারা ছাড়া দীনের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।
এতকিছুর পরও এ যুগের অনেক আলিম ও তালিব এত্থেকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আলিমদেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে জনসাধারণের কী অবস্থা হবে, যাদের কাছে দীনের সঠিক জ্ঞান নেই?
যে ব্যক্তি আজ মানুষের অবস্থা গভীরভাবে তলিয়ে দেখবে, আল-ওয়ালা ওয়াল বারা নিয়ে তাদের অবহেলা এবং একে পাশ কাটিয়ে চলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করবে, সে অত্যন্ত আশ্চর্য হবে।
মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস পায় না। আল-ওয়ালা ওয়াল বারার ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত আয়াত ও সুস্পষ্ট হাদিসসমূহের ব্যাখ্যা নিয়ে অহেতুক কষ্ট করে। কোনো দলিল ছাড়াই এর সুস্পষ্ট অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থের দিকে মোড় ঘুরায়! আর প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে দূরবর্তী কোনো অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে। এটা এজন্যই যে আল ওয়ালা ওয়াল বারা নফসের জন্য কষ্টকর, যা শাসন ক্ষমতা ও সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির জন্যে উপযুক্ত না।
জনৈক ব্যক্তি সুন্দর বলেছেন, “যদি তুমি যুগের ইসলামের ধারকদের ক্ষেত্র দেখতে চাও, জামে মসজিদসমূহের দরোজায় তাদের ভীড় আর লাব্বাইক বলার দ্বারা তাদের অবস্থান জানানো দেখো না, বরং দেখো শরিয়াহর শত্রুদের সাথে তার কী সম্পর্ক।”
এমনিভাবে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ বা আমর বিল-মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারও আল-ওয়ালা ওয়াল বারা ছাড়া সম্পন্ন হবে না। এ বিষয়ে এ যুগের অনেক দাঈ শিথিলতা অবলম্বন করেছেন। তাদেরকে দেখবেন যে, তারা বিদয়াতিদের সাথে সুসম্পর্ক রাখছে, তাদেরকে সম্মান করছে, তাদের প্রশংসা করছে এবং ন্যায় ও সমতার শিরোনামে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। এতে করে সাধারণ জনগণ ও জাহিলদের অন্তরগুলো তাদের প্রতি ঝুঁকে গেছে। তাদের অপকর্মগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের অনেকের কাছে ঝাপসা হয়ে গেছে।
অথচ তাদের উপর ওয়াজিব ছিলো এদের ভ্রষ্টতা প্রকাশ করা, তাদের ভ্রষ্ট মানহাজ সুস্পষ্ট করা। সালাফদের পথ থেকে তাদের দূরত্ব, তাদের বিদয়াত ও পথভ্রষ্টতা চাকচিক্যরূপে দেখানো তাদের দায়িত্ব ছিল না। কেননা এগুলোই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের কারণ ও তাদের সান্নিধ্য অর্জনের দরোজা খুলে দেয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সালাফদেরকে রহম করুন। কেননা তারা বিদয়াতিদের পাশে বসা থেকে, তাদের কথা শোনা থেকে এবং তাদের বই পড়া থেকেও নিষেধ করতেন। যে তাদের পথ ও মানহায থেকে সরে যাবে, সে ব্যর্থ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যে নিজের মতের উপর একগুঁয়েমি করবে এটা হবে তার জন্যে সুস্পষ্ট গোমরাহি।
অধ্যায়: ৪
এরপর যদি সুন্নাহর অনুসারী কোনো মুওয়াহহিদ বর্তমান যুগে তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ক্ষেত্রে মানুষদের অবস্থা তলিয়ে দেখে তাহলে সে আরও বেশি আশ্চর্যান্বিত হবে― যখন দেখবে আশয়ারি, জাহমিয়া, মুতাযিলা এবং ইবাযিয়্যাহর সংখ্যাই বেশি। গোমরাহ মাযহাবদের মধ্যে অধিক প্রসারিত মাযহাব হচ্ছে আশয়ারি মাযহাব। এরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের পর্দায় আশ্রয় নিয়েছে।
তাদের ধূম্রজালে আটকা পড়েছেন অনেক আলিম ও তালিবুল ইলম। অন্যদের কথা বাদই দিলাম। যারা মুতাআখখিরিনের কিতাবাদিতে দৃষ্টি দিয়েছে, বিশেষ করে সহিহাইনের বিভিন্ন শরাহগ্রন্থে, যাদের কাছে সালাফের মাযহাবের ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই, তারা এদের কথা দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, তাদের বিষমিশ্রিত কথা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, এটা তাদেরকে পিছলে দিয়ে অধঃপতনের দিকে নিয়ে গেছে। কেননা সিফাতের ব্যাপারে সেখানে এমনসব বিষয় এসেছে যেগুলোর ব্যাখ্যা জায়িয নেই। এটা হচ্ছে সালাফদের মাযহাব থেকে বিমুখতার নাম। আশয়ারিদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রবণতাটা বেশি।
এজন্য তাওহিদের ইলম অর্জনের বিকল্প নেই। আর আসমা ওয়াস সিফাতের ক্ষেত্রেও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মাযহাব জানা জরুরি।
সুন্নাহপন্থী ও সালাফদের অনুগামী প্রত্যেকেরই জানা আছে― যাকে শয়তান ফিতরাত থেকে সরাতে পারে নি, আসমা ও সিফাতের ক্ষেত্রে সালাফের মাযহাব হচ্ছে, তারা আল্লাহর জন্যে ঐ সিফাত ও ইসম সাব্যস্ত করেন, যা আল্লাহ কুরআনে নিজের সাব্যস্ত করেছেন, অথবা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাব্যস্ত করেছেন কোনো ধরনের তাহরিফ, তাতিল, তাকয়িফ ও তামসিল ছাড়াই। তারা বিশ্বাস করেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ ﴿الشورى: ١١﴾
আল্লাহর মতো কেউ নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা ৪২: ১১)
তারা আল্লাহর জন্য এমন কোনো সিফাত অস্বীকার করেন না যা আল্লাহ নিজের জন্যে স্থির করেছেন অথবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্থির করছেন। বরং যখন তাদের কাছে নস দ্বারা প্রমাণিত হয় তখন তারা বলেন, سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا আমরা শুনলাম আর মেনে নিলাম।
তারা বিশ্বাস করেন যে, নিশ্চয় আল্লাহর আসমা হচ্ছে প্রশংসাযোগ্য গুণ যা অর্থের দিকে নিদর্শন করে, আর এটা বিদয়াতিদের মতের উল্টো। যেমন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর মতে, আল্লাহর সামি (السَّمِيعُ) নামটি আল্লাহর জন্যে শ্রবণ সাব্যস্ত করার জন্যে। এমনিভাবে আল্লাহর উত্তম নামসমূহের ক্ষেত্রেও। কিন্তু তারা এটা স্বীকার করে না। সুতরাং এ ব্যাপারে অজ্ঞাত থেকো না, কেননা এটা হচ্ছে এমন এক ভিত্তি, যার ব্যাপারে তারা ভুল করে বসে, যারা ইলমের নুর দ্বারা আলোকিত হয় নি এবং সুস্পষ্ট কোনো নসের দিকে আশ্রয় নেন নি।
বর্তমান যুগে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহকে বিদয়াতি ও পথভ্রষ্টদের থেকে পৃথক করার ব্যাপারে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বরং অনেক মানুষের অন্তর বিরক্ত হয় যখন কিছু উলামা পথভ্রষ্ট আশয়ারিদের নিয়ে আলোচনা করেন। এটার কারণ হচ্ছে এব্যাপারে সালাফদের মাযহাব না জানা।
আবার অনেক আলিম সহিহ ও যয়িফ হাদিসের তাহকিকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না, অপছন্দ করা যাবে না কারণ এটাও শরিয়ার অন্যতম একটি দিক। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এরা আকিদার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। দেখবেন যে, এরা আসমা ও সিফাতের ক্ষেত্রে সালাফের মাযহাবকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছে। এরমধ্যে আশয়ারি এবং অন্যান্য আহলুত তাহরিফরা অন্তর্ভূক্ত।[14]
বরং মনে হয়, তারা কিছু আশয়ারিদের কথাবার্তা আল্লাহ তাআলার কোনো আয়াতের তাফসির ও হাদিসের ব্যাখ্যায় দলিল হিসেবে নকল করে আর ধারণা করে যে, এটাই হচ্ছে সালাফ আস-সালিহিনের কথা।
এজন্য অবশ্যই সালাফদের আকিদাকে ইলম ও আমলের দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। আর এটা অর্জিত হবে কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে আসার মাধ্যমে, এ দুটোকে ভালোভাবে বোঝার মাধ্যমে, আর প্রতিটি ক্ষেত্রে এর দুটোর কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার মাধ্যমে। আর এটা সুন্দরভাবে সম্ভব হবে মুহাক্কিক আহলুল ইলমদের কথায় দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে এবং শরয়ি নুসুসের আলোকে তাদের ইলম থেকে উপকৃত হওয়ার মাধ্যমে।
এ ব্যাপারে সালাফদের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির অন্যতম হচ্ছেঃ
১. আস-সুন্নাহ, ইমাম আবু বকর বিন খাল্লাল
২. আস-সুন্নাহ, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ
৩. আশ-শারিয়াহ, ইমাম আবু বকর আজুরি
৪. শারহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ, ইমাম আলকানি
৫. আর-রাদ্দু আলা বিশর আল-মারিসি, ইমাম দারিমি
৬. আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়াহ, ইমাম ইবনু মান্দাহ
৭. আল-ইবানাহ, ইমাম ইবনু বাত্তাহ
৮. কিতাবুত-তাওহিদ, ইমাম ইবনু খুযাইমাহ
৯. আল-হুজ্জাহ ফি বায়ানিল মাহাজ্জাহ, আবুল কাসিম ইস্পাহানি
১০. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ ও তাঁর ছাত্র ইবনুল কায়্যিমের রচিত কিতাবাদি, নাজদি আলিমদের রচনাসমূহ। রাহিমাহুমুল্লাহ জামিয়ান।
এ ছাড়াও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক উপকারী কিতাবাদি রয়েছে।
একমাত্র যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিয়েছেন, নফসের আনুগত্য থেকে হিফাযত করেছেন, যে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণ যার উপর ছিলেন তা আঁকড়ে ধরেছে তারা ছাড়া অন্যদের গোমরাহি ও পদস্খলনের অবশ্যম্ভাবী আশঙ্কা রয়েছে…।
উপসংহার
এতক্ষণের আলোচনা দ্বারা যা জানা গেলো, এহেন পরিস্থিতিতে উলামা, তালাবা ও দাঈ ইলাল্লাদের উপর কর্তব্য হলো, তাওহিদের আলোচনা এবং তাওহিদের বিপরীত বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করার ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টাকে অত্যন্ত জোরদার করা। তাদের দারসসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শরয়ি দলিলাদির আলোকে তাওহিদ এবং তাওহিদের জন্যে ক্ষতিকারক বিষয়ের জন্যে ব্যয় করা। এটা তাদের অন্যে আলোকবর্তিকা বানানো।
কেননা তাওহিদ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। এর দ্বারা জমিনে কর্তৃত্ব অর্জিত হবে। এর দ্বারা শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য ও বিজয় অর্জিত হবে, আর এটা হারিয়ে ফেলা, এক্ষেত্রে অবহেলা করা এবং তাঁর দাবিসমূহ আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিলতা দ্বারা যমিনে কর্তৃত্ব পাওয়া যাবে না। এমন কি বিজয় ও সাহায্যও পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
তোমাদের মধ্যে যারা ইমান আনবে এবং আমালুস সালিহ করবে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিচ্ছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে খিলাফাহ দান করবেন। যেমন তিনি দান করেছিলেন তাদের পূর্ববতীদেরকে। অবশ্যই তিনি সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতিকে নিরাপত্তার মাধ্যমে দূর করে দিবেন। তখন তারা কেবলই আমার ইবাদাত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য। (সূরা নূর: ৫৫)
একজন মানুষ মুমিন হতে পারবে না, নেক আমলকারী হতে পারবে না এবং আল্লাহর পরিপূর্ণভাবে ইবাদাত করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তাওহিদে আসবে এবং নিজেকে শিরক এবং মুশরিকদের থেকে মুক্ত করবে। আর তাও সম্ভব হবে না যতক্ষণ না নিজে শিরক-বিদআতমুক্ত নিষ্কলুষ তাওহিদকে আঁকড়ে ধরবে।
এতটুকুই, আল্লাহর কাছে দুয়া করি তিনি যেনো মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি করেন, তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশোধন করেন, তিনিই বান্দার যাচিত বিষয়ে সামর্থদাতা, তিনি যা দেন তা কেউ বাধা দিতে পারবে না, আর তিনি যা দেন না তা কেউ দিতে পারে না।
এটাই শেষ কথা, যা আমি এই পুস্তিকায় সংক্ষিতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা করেছিলাম। যাতে এর দ্বারা ওইসব ব্যক্তি উপকৃত হয় যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিতে এবং গোমরাহি থেকে মুক্ত করতে চান।
ওয়া সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামা আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলিহি ওয়া সাহবিহি…।
―সুলায়মান বিন নাসির আল-উলওয়ান
আল-কাসিম, বুরাইদাহ, জাযিরাতুল আরব।
২/১১/১৪১২ হিজরি।
***********
[1] দেখুন: ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ১/১১৫
[2] দেখুন: ফাতাওয়া শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ২৮৪/১০; আল-ফাহারিসুল আম্মাহ লি-ফাতাওয়াশ শায়খ, ৩/৩৬; মাদারিজুস সালিকিন, ১/৩৩
[3] সাহিহুল বুখারি: ১৩২৪, সাহিহ মুসলিম: ১২১২।
[4] সাহিহুল বুখারী: ১১৪,২৮৮৮।
[5] তিরমিযি: ৩০৭০, তাফসির অধ্যায়।
[6] সাহিহুল বুখারি: ৬৯৩৭, সাহিহ মুসলিম: ১৩২।
[7] মুসনাদু আহমাদ: ১৬০৬৬।
[8] সাহিহ মুসলিম: ২১২৬।
[9] সূরা আরাফ: ৫৯.৬৫,৭৩, ৮৫; সূরা হুদ: ৫০, ৬১, ৮৪; সূরা মুমিনুন: ২৩, ৩২।
[10] মুসনাদু আহমাদ: ৫১১৪।
[11] সাহিহ মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযিতে ইবনু উমর থেকে বর্ণিত।
[12] এটা সুস্পষ্ট যে, মানবরচিত আইন-কানুনের বিষক্রিয়া এ যুগে এমন এক সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়েছে, যা ব্যাপক ও বিস্তৃত। নস ও ইজমার আলোকে এটা সুস্পষ্ট এবং এ ব্যাপারে কেউই ভিন্ন মত পোষণ করেন নি যে, দীনের মূলনীতি হচ্ছে প্রতিটি মৌলিক ও শাখাগত বিষয়ে আল্লাহ একক কর্তৃত্ব মেনে নেয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা।
আল্লাহ তায়ালা হুকুমের ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّه﴿الأنعام: ٥٧﴾ِ
সব কর্তৃত্ব আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত আর কারও কোনো কর্তৃত্ব নেই। (সূরা আনআ‘ম ৬: ৫৭)
কেউ যদি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে, তাহলে সে যেনো আল্লাহর সাথে তাঁর জন্যে নির্ধারিত হুকুমের ক্ষেত্রে বিবাদ করলো।
আর যাকে কুরআন-সুন্নাহর দিকে আহবান করা হলো, অথবা তার কাছ থেকে এর তাহকীম (বিচারকার্য পরিচালনা) র জন্যে ডাকা হলো, অতঃপর সে অস্বীকার করলো, তাহলে সে নিফাকে নিমজ্জিত মুনাফিক। আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকের অবস্থা এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন-
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودًا ﴿النساء: ٦١﴾
আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে। (সূরা নিসা ৪: ৬১)
যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রায়কে প্রতিটি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বলে মনে না করে, তার ঈমানকে আল্লাহ অস্বীকার করেছেন। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ﴿النساء: ٦٥﴾
অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। (সূরা নিসা ৪: ৬৫)
আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা দ্বারা শাসন করা আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল নামক শাহাদাত বাক্যের মূল দাবিগুলোর একটি। কোনো ব্যক্তির ইসলাম সুসংহত হবে না, বরং তার ইসলামই গ্রহনযোগ্য হবে না; যতক্ষণ না সে নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুমের অনুসরণে পূর্ণরূপে সমর্পণ না করবে এবং যে শাসক আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা শাসন করবে না, এটাকে অস্বীকার করবে ও এ বিশ্বাস রাখবে যে, বর্তমান যুগে তা অচল, তাহলে তার কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের বাধা থাকবে না।
বরং এই তাহকিম না মানা এটা অস্বীকার করা এবং প্রতিষ্ঠা করতে বাধা দেয়া হচ্ছে সুস্পষ্ট কুফর এবং রিদ্দাহ। তবে বর্তমান যুগের কিছু লোক এ বিষয়ে মতানৈক্য করে। তারা বলে, তার বিশ্বাস যদি এমন না হয়, তাহলে তাকে তাকফির করা যাবে না।
ইবনু আব্দিল বার রাহিমাহুল্লাহ আত-তামহীদ নামক কিতাবে (৪/২২৬) ইসহাক বিন রাহাওয়াইহ থেকে উল্লেখ করেন, তিনি এ ব্যাপারে সালাফদের ইজমা নকল করেছেন যে,
من دفع شيئا انزله الله وهو مع ذلك مقر بما انزل الله أنه كافر
যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন এর মধ্যে কিছু অংশ পরিবর্তন করল, বাকি পুরো অংশ স্বীকার করা সত্ত্বেও সে কাফির।
(দেখুন: আল-ইহকাম ফী আহকামিল উসুল লিইবনি হাযম, ১/১৭; আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ লিইবনি কাসির, ১৩/১১৯; মাকতাবাতুল মাআরিফ, বৈরুত থেকে প্রকাশিত)
[13] দারিমি-১/৬৪, হাকিম-৪/৫১৪, ইবনু মাসউদ পর্যন্ত মাওকুফ। অনেকে এটাকে অন্যান্য বর্ণনার ভিত্তিতে মারফু বলেছেন।
[14] আমরা যে ব্যাধি সংক্রমণের আশংকা করেছিলাম আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে সালাফদের কিতাবাদি নিয়ে কাজ করা এ যুগের অনেক ব্যক্তিদের দ্বারা। তারা সালাফদের কিতাব তাহকিকের নামে অনেক অশুদ্ধ মতামত, বিকৃত ও সস্তা ব্যাখ্যা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এটা মূলত তাহকিক নয়, বরং তালফিক, খিয়ানত এবং ঈমানের মধ্যে ফসিদ আকিদা ছড়ানো। এখানে একটি উদাহরণ পেশ করছি-
বৈরুতের দারুল কলম থেকে প্রকাশিত সহিহুল বুখারিতে (১/৩৮৪) হাদিসুন নুযুলের তালিকে মুয়াল্লিক বলেন,
هذا النزول من المتشابه الذي يفوض علم حقيقته الى الله تعالى أو المراد ينزل أمره و رحمته و لطفه و مغفرته أو المراد تنزل الملائكته بأمر منه
এই নুযুলটা মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহর কাছেই অর্পণ করি, অথবা এর উদ্দেশ্য আল্লাহর আদেশের অবতরণ, তার রহমত, অনুগ্রহ, দয়া ও মাগফিরাত অথবা তাঁর আদেশে ফিরিশতাদের অবতরণ…।
তার কথা – এটা তাফওয়িদ (আল্লাহর কাছে অর্পণ), হচ্ছে তাওয়িল এবং তাহরিফ। এই ধরনের তাহরিফ সালাফদের কিতাবাদিতে বর্তমানে অনেকভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যদি আল্লাহ তাওফিক দেন তাহলে যারা সালাফদের কিতাবদি তাহকিকের নামে সালাফদের আদর্শ থেকে সরে তামাশায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে স্বতন্ত্র বই লিখবো।
আবার তারা এসব কিতাবের ভূমিকায় লিখে ‘ডক্টর অমুকের টীকা সম্বলিত‘ হায়! দি সালাফের কিতাব এসব গজিয়ে উঠা মূর্খতার পঙ্গু ভীমরুলদের থেকে মুক্ত থাকতো, আল্লাহুল মুস্তাআন…।