উত্তর দিয়েছেন শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনি হাফিযাহুল্লাহ
প্রশ্নকারীঃ সম্মানিত শায়খ আবু কাতাদা, আল্লাহ আপনাকে সত্যের উপর অবিচল রাখুন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ,
আমার প্রশ্নটি এমন একটি বিষয় নিয়ে, যা নিয়ে আমি বিভ্রান্তিতে আছি এবং আমার বিশ্বাস অন্য আরো অনেকেই এই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত।
বিষয়টি হল একজন মুরজিয়া আর একজন ব্যক্তি যার মাঝে ইরজা রয়েছে – এই দুজনের মধ্যে পার্থক্য কি?
আসলে আমার মনে প্রথম এ প্রশ্নের উদয় হয় যখন শায়খ আলবানীর মধ্যে ইরজা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে এমন এক যুবক একজন শায়খকে টেলিফোন করলো, যিনি সঠিক আক্বিদার সাক্ষ্য দেন এবং তিনি সর্বদা সাহিহ আক্বিদার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন।
তো যুবকটি সেই শায়খকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো শায়খ আলবানি (আল্লাহ তার উপর রহম করেন এবং তার ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করে দিন ) কি একজন মুরজিয়া ছিলেন?
জবাবে শায়খ বললেন শায়খ আলবানির রাহিমাহুল্লাহ আক্বিদা সাহিহ ছিল তবে তার কথা মুরজিয়াদের কথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।
শায়খ এ কথার মাধ্যমে কি বোঝালেন, আমি বুঝতে পারলাম না।
দ্বিতীয়ত, আমার কাছে একটি ক্যাসেট টেপ আছে, যেখানে শায়খ আলবানি রাহিমাহুল্লাহ ঈমানের বিষয়ে তার একজন ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলেন। আর তিনি এখানে বলেছেন আমল হল ঈমান পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য নিছক শর্তমাত্র (শার্তকামাল)।
এই টেপে তিনি আরো বলেছেন যে, তার এই অবস্থানের কারনে কিছু মানুষ তাকে যে নাম দেয় (মুরজিয়া) তার ব্যাপারে তিনি সচেতন কিন্তু এটাই আমল ও ইমানের ব্যাপারে সঠিক অবস্থান।
আমার বিশ্বাস সম্মানিত শায়খ (শায়খ আবু ক্বাতাদা) আপনি নিজেও এই টেপটি শুনেছেন।
তাই আমার প্রশ্ন হলঃ
শায়খ আলবানি রাহিমাহুল্লাহ এবং তার অনুসারীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কি, যারা তাদের দাবি দ্বারা পৃথিবী ভরে ফেলছে। আমি অতিরিক্ত সময় নিয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী এবং জাযাকাল্লাহ খাইর।
উত্তরঃ বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম এবং আল্লাহর কাছেই আমরা সাহায্য চাই
একজন ব্যক্তিকে খারেজি বলা আর একজন ব্যক্তির মাঝে খুরুজ আছে বলা, এবং একজন ব্যক্তিকে মুরজিয়া বলা আর একজন ব্যক্তির মাঝে ইরজা আছে বলার মধ্যে পার্থক্যটা নির্ভর করে দুই ব্যক্তির অবস্থার উপর।
তাই যে ব্যক্তি এই বিদাতের উসুল মেনে চলে এবং এর দিকেই ডাকে, তার উপর এই (মুরজিয়া)হুকুম আরোপিত হবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি মুরজিয়াদের বিদাতী উসুল বা মূলনীতিসমূহ মেনে চলে এবং এই উসুলের প্রতি আহবান করে যে তাকে এই বিদাতের সাথে সংযুক্ত করা হবে এবং মুরজি বলা হবে।
কিন্তু যে ব্যক্তি মুরজিয়াদের বিদাতী উসুল বা মূলনীতিসমূহ মেনে চলে না, এবং এই বিদাতি উসুল গ্রহন না করা সত্ত্বেও সে ইরজার কোন শাখায় পতিত হয় সে ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে মুরজি বলার পরিবর্তে তাকে ইরজাগ্রস্থ বলা হবে।[1]
এটাই হল একজন মুরজি এবং একজন ইরজাগ্রস্থ ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য। কিন্তু যিনি শায়খ আলবানির রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার উত্তর অস্পষ্ট।
কারন তিনি বলেছেন শায়খ আলবানির আক্বিদা সাহিহ ছিল। আর তিনি শুধুমাত্র শায়খের বক্তব্য ও উপস্থাপনা মুরজিয়াদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবার কথা উল্লেখ করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন এ ছিল নিছক বলার ভুল কিংবা উপস্থাপনার ভুল। কিন্তু তার এই কথা (পুরোপুরি) সঠিক না।
যদিও শায়খ আলবানির আক্বিদার মূলনীতি সুন্নাহ থেকে, তথাপি তিনি তার আক্বিদায় ইরজার কিছু বৈশিষ্ট্য ধারন করেছিলেন।
তাই শায়খ আলবানি বলতেন ঈমান হল কথা এবং কাজ; কিন্তু তিনি এমনভাবে একে ব্যাখ্যা করতেন যার সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আর ব্যাখ্যার অমিল থাকতো। আর এখানেই তিনি ইরজায় পতিত হয়েছেন, যখন তিনি বলেছেন আমল ঈমানের অস্তিত্বের আবশ্যক শর্ত (শার্ত সিহ্হা) হতে পারে না।
শায়খ আলবানি ঘোষণা করেছেন যে মৌখিক স্বীকৃতি ও অন্তরের বিশ্বাস ঈমানের অস্তিত্বের শর্ত (শার্ত সিহ্হা) – এর মাঝেও তার এই ধারণা উপস্থিত।
তিনি আমল ও মৌখিক স্বীকৃতির মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন যা সালাফদের বক্তব্যের বিপরীত। বস্তুত এই ধারণা থেকেই সর্বপ্রথম ইরজার মাযহাবের সূচনা হয়েছিল।
শায়খ আলবানির এই ভুল নিছক কথা বলা বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কোন ভুল না, বরং তিনি এক্ষেত্রে আক্বিদার ব্যাপারে ভুল করেছিলেন। আর এভাবে তিনি ইরজার কিছু শাখাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
যারা শায়খ আলবানির ব্যাপারে এই অভিযোগের রদ করতে চায় তাদের অনেকে সালাফদের কিছু উক্তি উপস্থপন করে। যেমন তারা ইমাম আহমদের রাহিমাহুল্লাহ কিছু বক্তব্য তুলে ধরেন, যিনি বলেছিলেন যে – ঈমান হল মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমল।
আর তারা শায়খ আলবানির সমর্থনে বলে যে তিনিও তো একই কথা বলেছেন যে – ঈমান হল মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমল।
এইভাবে তারা শায়খ আলবানিকে ইরজার অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে চায়। কিন্তু যারা বিভিন্ন বিভ্রান্ত ফিরকা ও তাদের মাযহাব সম্পর্কে অবগত তারা অনুধাবন করবেন যে এই কথা যৌক্তিক না।
আমি একটি উদাহরণ পেশ করছিঃ
আশারিরা বলে যে কুরআন হল আল্লাহ তা’আলার কালাম। কিন্তু তাদের এই কথা এটা প্রমানের জন্য যথেষ্ট যে তারা এই বিষয়ে নবীর ﷺ এবং সাহাবার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন আক্বিদার উপর আছে?
প্রত্যেক তলিবুল এই প্রশ্নের উত্তর জানে – না।
যদিও তাদের এই বক্তব্য সঠিক কিন্তু তারা একে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা সত্যের সীমানার বাইরে এবং আহলে হক্ব এই ব্যাপারে জ্ঞাত। আর তাই আশারীদের মতে এক্ষেত্রে আল্লাহ্র “বাণী” মানে আল-কাদিমের (শাব্দিক অর্থ, আদি। এর দ্বারা তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বোঝায়)সত্তা থেকে উৎসারিত কালামের অভিব্যক্তি মাত্র, স্বয়ং আল্লাহ্র বলা কথা নয়।]
কিন্তু কুরআনের যে অক্ষর ও শব্দগুলো আমরা তিলাওয়াত করি তারা এগুলোকে সরাসরি আল্লাহর বাণী হিসেবে স্বীকার করে না। কারন তারা উচ্চারন ও অর্থের মাঝে পার্থক্য করে। সুতরাং তারা একটি সঠিক কথা বলে [“কুরআন হল আল্লাহর বাণী”], কিন্তু তারা এটার এমন একটা ব্যাখ্যা করে যা এর প্রকৃত অর্থের থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ তারা একটিতে ঠিক থাকলেও অপরটিতে ভুল করে।
তেমনিভাবে শায়খ আলবানি ইমানের আলোচনায় একটি সঠিক কথা বলেছেন – “ঈমান হল মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমল।” কিন্তু তিনি এই সঠিক কথাটিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যা আহলে হক্বের ব্যাখ্যার সাথে মেলে না। কারন মৌখিক ও স্বীকৃতি ও আমলের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।
আর তাই তিনি সকল ধরণের কুফর ইতিক্বাদিকে (অন্তরের বিশ্বাস সংক্রান্ত) কুফর আকবর বলে গন্য করেছেন, এবং বলেছেন কোন আমলের কারনে কোন ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয় না।
আর সকল ধরনের কুফর আমালিকে তিনি কুফর আসগর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটি বাতিল ধারণা এবং আল্লাহ্ তা’আলার দ্বীনের ব্যাপারে ভুল ব্যাখ্যা।
আর শায়খ আলবানি বলেছেন আমল হল ঈমানের পূর্ণতার শর্ত, এই কথাটি সঠিক নয়, এবং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহর ﷺ হাজার হাজার লাইন এবং আহলুল ইলমের কথার দ্বারা এই কথাটি ভুল প্রমাণিত।
শুধুমাত্র এই বিষয়টির উপরই প্রথম যুগ থেকে পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত অসংখ্য বই লেখা হয়েছে আল্লাহ্ আমাদের এগুলোকে খুঁজে বের করার তৌফিক দান করুক। একমাত্র আল্লাহ্ই সমস্ত কিছু সম্ভব করার ক্ষমতা রাখেন।
———————————————–
[1] অর্থা যে ব্যক্তি মুরজিয়াদের মূলনীতিসমূহ মেনে চলে এবং এর প্রতি আহবান করে সে মুরজিয়া, কিন্তু যে ব্যক্তি ইরজার মূলনীতি মেনে চলে না ও গ্রহন করে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরজার কোন একটি শাখায় পতিত হয় তার ক্ষেত্রে বলা যায় যে সে ইরজা দ্বারা আক্রান্ত বা ইরজাগ্রস্থ।
সূত্রঃ https://www.kalamullah.com/sects04.html