নের্তৃবৃন্দের প্রতি নাসিহা

শায়খ আতিয়াতুল্লাহ আল লিবি

আমি নিজেকে এবং আমার ভাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, কারণ তিনি আমাদেরকে তার ইবাদতে নিয়োজিত করেছেন এবং আমাদেরকে বানিয়েছেন তার পথের মুজাহিদ, তাঁর দ্বীনের সাহায্যকারী ও তাঁর কালিমা বুলন্দকারী। এমন কঠিন সময়ে, যখন অধিকাংশ মানুষের উপর দুনিয়া ও তার ফিৎনাসমূহ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। Continue reading

মুসলিম রক্তের নিষিদ্ধতা!

শায়খ আতিয়াতুল্লাহ আল লিবি

আমরা এবং অন্যরা প্রায় সময় আমাদের শক্র ও তাদের দ্বারা মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে দেখি যে, জিহাদি আন্দোলনগুলোকে মুসলমানদেরকে টার্গেট করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

তারা এমনভাবে চিত্রিত করে যেন মুজাহিদিনরা অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত খুনিদের একটি গ্রুপ, যাদের কাজ কোন কারণ ছাড়াই রক্ত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এবং সম্পদের লুটতরাজ করা এবং তাদের কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই , নেই কোন লক্ষ্য অথবা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং এ জাতীয় আরও অনেক অভিযোগ আরোপ করে। প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যা বলে। Continue reading

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা – শায়খ আতিয়াতুল্লাহ রহঃ

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা

শায়খ আতিয়াতুল্লাহ রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

বন্ধুত্ব

শত্রুতা

শায়খ আতয়িাতুল্লাহ রহঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের উপর এবং তার পরিবারবর্গ, সাহাবা ও যারা তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে তাদের উপর। তারপর:

এই আসরে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। এর সম্পর্ক রয়েছে কুফর, ঈমান ও রিদ্দার মাসআলার সাথে এবং পূর্বে যে তাওহিদ ও তার বিপরীত বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করেছি তার সাথেও। তা হচ্ছে মুওয়ালাত (বন্ধুত্ব) ও মুআদাত’র (শত্রুতার) বিষয়। এটাকে ‘আলওয়ালা ওয়ালবারা’ বলেও ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ একই জিনিসের দুই রকম প্রকাশ।

সবার জানা আছে, আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে একক ও শরীকহীনভাবে তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। এই দুনিয়াতে অস্তিত্ত্ব দান করেছেন। ইবাদতের স্থানে। যাতে আমরা তার ইবাদত করি। তিনি এই ইবাদাতসমূহের মাধ্যমে ও অন্যান্য পরীক্ষাসমূহের মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করছেন-আমরা কি তার ইবাদত ও আনুগত্যে কৃতকার্য হই, তার সঠিক পথে চলি, না অকৃতকার্য হই। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, আল্লাহ আমাদেরকে ও আপনাদেরকে কৃতকার্যদের অন্তর্ভূক্ত করুন!

আল্লাহ সুবহানাহুর একটি রহমত ও অনুগ্রহ হল, তিনি আমাদের নিকট রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন কিতাব, যা আমাদের নিকট আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে আর রাসূলগণ আমাদের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যাবলী বর্ণনা করে দেন- তথা আমরা কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করব? আমাদের প্রতি তো আল্লাহর নির্দেশ একমাত্র তাঁর ইবাদত করার, যার সাথে কোনও শরীক নেই- এখন আমরা কিভাবে তার ইবাদত করব? তারা আমাদেরকে ইবাদতের বিশদ বিবরণ, আদেশ, নিষেধ ও দায়িত্বসমূহ বলে দিয়েছেন।

রাসূলগণ সব পৌঁছে দিয়েছেন (আল্লাহ তাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!), তারা আমানত পৌঁছে দিয়েছেন, রিসালাতের দায়িত্ব আদায় করেছেন। আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন!

যখনই আল্লাহ রাসূল ও নবী পাঠালেন, তখনই মানুষ বিভক্ত হয়ে গেছে এবং পরস্পরে মতবিরোধ করেছে, যেমন আল্লাহ সুবহানাহু বলছেন:

﴿فَمِنْهُمْ مَنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾

“ফলে তাদের কতক ঈমান আনল আর কতক কুফর অবলম্বন করল। আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

এমনটা হয়েছে, যখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলদেরকে প্রেরণ করলেন, যা আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন। এই আয়াত সূরায়ে বাকারায়, আর ওটাও সুরায়ে বাকারায়ই তার পূর্বে। উক্ত আয়াতটি হল:

﴿كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً﴾

“(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই জাতি ছিল”

এক জাতি কি কুফরের উপর, না তাওহীদের উপর? মুফাসসিরীনের দুই মত রয়েছে। বিশুদ্ধ মত হল, যেটা হাদিসেও বর্ণিত আছে এবং ইবনে আব্বাস রা: এর তাফসীরে এসেছে: একজাতি ছিল তাওহীদের উপর। আদম আ: থেকে সব মানুষ একজাতি ছিল তাওহীদের উপর। তারপর নূহ আ: এর কওমে সর্বপ্রথম শিরকের উদ্ভব হয়েছে- যার বর্ণনা আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন এবং কুরআনে তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তখন শিরকের উদ্ভব হয়েছে এবং মূর্তিপূজার সূচনা হয়েছে।

তারা কিভাবে মূর্তিপূজা শুরু করল, তার রূপটা প্রসিদ্ধ। শয়তানের প্ররোচনায় তারা তাদের নেককার লোকদের চিত্রাংকন করল এবং তাদের ফটো বানালো। কেউ বলল, তোমাদের তো এই সকল নেককারদেরকে সম্মান করা উচিত। শয়তান বুদ্ধি দিল: তাদের চিত্রাংকন করে এবং তাদের মূর্তি বানিয়ে তাদেরকে সম্মান কর। তাহলে তোমরা তাদেরকে স্মরণ করতে পারবে, এতে তাদের নসীহত ও উপদেশগুলো স্মরণ হবে, তারা যে জীবনাদর্শের উপর চলেছেন, তা স্মরণ হবে। এতে তোমরা আরো সংশোধিত হবে। শয়তান তাদের মাঝে প্রবেশ করল এই দরজা দিয়ে। তাই তারা ঐ সকল লোকের চিত্রাংকন করল এবং তাদের মূর্তি বানালো।

প্রথম প্রজন্ম বুঝত, হয়ত তৃতীয় চতুর্থ প্রজন্মও বুঝত, কিন্তু যখন সময় দীর্ঘ হল, তখন অজ্ঞতা নেমে আসল, যেমন ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন: অত:পর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করতে শুরু করল। তাদের কথাই আল্লাহ তা’আলা সূরা নূহে উল্লেখ করেছেন:

﴿وَقالُوا لا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلا سُواعًا وَلا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا﴾

“এবং তারা (নিজেদের লোকদেরকে) বলেছে, তোমরা নিজেদের উপাস্যদেরকে কিছুতেই পরিত্যাগ করো না। কিছুতেই পরিত্যাগ করো না ‘ওয়াদ্দ’, ও ‘সুওয়া’কে এবং না ‘ইয়াগুছ’, ‘ইয়াউক’ ও ‘নাসর’কে”।

পাঁচটি। ‘ওয়াদ’, আরেক কেরাতে ‘ওয়িদ’। এবং তোমরা পরিত্যাগ করো না ‘ওয়াদ’কে, পরিত্যাগ করো না ‘সওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর’কে। পাঁচটি। তারা ছিল নূহ সম্প্রদায়ের নেককার লোক। অত:পর তাদের কওম তাদের মূর্তি অংকন করে। এভাবে পরবর্তীতে তাদের ইবাদত করা হতে থাকে। যখন অজ্ঞতা নেমে আসল, তখন থেকে তাদের ইবাদত করা শুরু হল। ফলে শিরক ও কুফরের আবির্ভাব হল।

এটাই এই আয়াতের অর্থ- “(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই জাতি ছিল”। অত:পর উম্মতের মধ্যে- মানবজাতির মধ্যে- মানুষের মধ্যে- শিরকের উদ্ভব হয় এবং কুফর সৃষ্টি হয়।

অত:পর আল্লাহ নবীদেরকে পাঠান সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে। যে আল্লাহর আনুগত্য করে তার জন্য সওয়াবের ও কল্যাণের সুসংবাদাদতারূপে আর যে কুফরী করে, অবাধ্যতা করে এবং শিরক করে তার জন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ক্রোধ ও আযাব সম্পর্কে সতর্ককারীরূপে-

﴿فبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلَّا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ العلم..

“তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল, তখন) আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তাদের সাথে সত্য সম্বলিত কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মাঝে সে সব বিষয়ে ফায়সালা করে দেন, যাতে তারা মতবিরোধ করছিল। আর যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারাই তাদের নিকট সমুজ্জল নিদর্শনাবলী আসার পরও তাতে মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছিল”।

অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলদেরকে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করলেন তখন মানুষ বিভক্ত হয়ে গেল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ﴾

“এসকল রাসূলগণ, যাদের কতককে আমি কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে, যার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি বহু উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর আমি মারয়ামের পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দিয়েছি ও রূহুল-কুদসের মাধ্যমে তার সাহায্য করেছি। আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও আত্মকলহে লিপ্ত হত না।

অর্থাৎ তাদের রিসালাতের পর তাদের পরবর্তীরা-

﴿وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِن بَعْدِهِم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَٰكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُم مَّنْ آمَنَ وَمِنْهُم مَّن كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾

“আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু তারা নিজেরাই বিরোধ সৃষ্টি করল। ফলে তাদের কতক ঈমান আনল আর কতক কুফর অবলম্বন করল। আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

তাহলে সূরা বাকারার এই পবিত্র আয়াতটি বুঝালো যে, রাসূলদের প্রেরণের পর মানুষ মুমিন ও কাফের দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যারা রাসূলদের অনুসরণ করল, তাদেরকে বিশ্বাস করল এবং আল্লাহ সুবহানাহুর আনুগত্য করল, তারাই হল মুমিন, যারা একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত করে। আর যারা রাসূলদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তাদেরকে অবিশ্বাস করল, তাদের সাথে ঠাট্টা করল, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করল, অস্বীকার করল, তাদের অনুসরণ করল না, বরং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করল, তারাই কাফের, যারা আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লার ইবাদত করে না অথবা তার ইবাদত করে, কিন্তু তার সাথে অন্যেরও ইবাদত করে। তারা মূলত: আল্লাহর ইবাদতই করে না, কেননা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ইবাদত হল একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। আর এর বিপরীতে যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহরও ইবাদত করে এবং অন্যেরও ইবাদত করে, সে যেন আল্লাহর ইবাদতই করল না। প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর ইবাদত করে নি; কেননা সে তার ইবাদতের যে অংশটা আল্লাহর জন্য নিবেদন করেছে, শরীয়তে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর নিকট এটা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য হচ্ছে তাওহীদ তথা এককভাবে করা। অর্থাৎ শুধুই আল্লাহর জন্য ইবাদত করা, তার সাথে কাউকে শরীক না করা।

ফলে মানুষ মুমিন ও কাফেরে বিভক্ত হয়ে পড়ল, ফলে তাদের মাঝে পরস্পরে যুদ্ধের সূত্রপাত হল, যেমন আল্লাহ তা’আলা বলছেন: “আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

তাই আয়াতটি প্রমাণ করল, মুমিন ও কাফেরদের মাঝে যুদ্ধ, এটি আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা, আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্য, আল্লাহ সুবহানাহুই এটা চান। এ বিষয়টি আরো অনেক আয়াত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অনেক আয়াত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে যে, আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টিজীবের কতকের দ্বারা কতককে পরীক্ষা করেন এবং এক পক্ষকে অপর পক্ষের উপর চাপিয়ে দেন, উভয় পক্ষকে পরীক্ষা করার জন্য, যাচাই করার জন্য, নিরীক্ষা করার জন্য, ফেৎনার সম্মুখীন করার জন্য। এছাড়া আরো অনেক উদ্দেশ্যের জন্য: যেমন: আল্লাহ সুবহানাহু এর মাধ্যমে তার বন্ধু, একনিষ্ঠ, ও প্রিয়দেরকে বেছে নেন, শহীদদেরকে বেছে নেন এবং ঐ সকল লোকদেরকে বাছাই করেন ,যারা তাকেই অবলম্বন করেছে, তাকে প্রাধান্য দিয়েছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করেছে, তাকে ভালবেসেছে, তার ভালবাসাকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বেছে নেন এবং তাদের মর্যাদা সুউচ্চ করেন। তাই এটা আল্লাহ সুবহানাহুরই ইচ্ছা।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

﴿وَكَذَٰلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لِّيَقُولُوا أَهَٰؤُلَاءِ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ﴾

“এভাবেই আমি তাদের কতক লোক দ্বারা কতক লোককে পরীক্ষায় ফেলেছি, যাতে তারা (তাদের সম্পর্কে) বলে, এরাই কি সেই লোক, আমাদের সকলকে রেখে আল্লাহ যাদেরকে অনুগ্রহ করার জন্য বেঁছে নিয়েছেন? আল্লাহ কি তার কৃতজ্ঞ বান্দাদের সম্পর্কে অন্যদের থেকে বেশি জানেন না?” (সূরা আল আনআম)

আল্লাহ তা’আলা সূরা ফুরকানে বলেন:

﴿وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا﴾

“আমি তোমাদের কতককে কতকের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ বানিয়েছি। বল, তোমরা কি সবর করবে? তোমাদের প্রতিপালক সবকিছুই দেখছেন”।

তাই আল্লাহ তা’আলাই মানুষের একদলকে আরেক দলের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের একদলকে আরেক দলের দ্বারা পরীক্ষা করছেন।

এটা আল্লাহ তা’আলারই অভিপ্রায়।  আল্লাহ তা’আলা এটা চান। এটাই আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা। সুউচ্চ, মহান, মর্যাদাময়, পূত-পবিত্র ইলাহী ইচ্ছা। তিনি পবিত্র ও মহান। তিনিই এই জিনিসটা চান। এজন্যই তিনি রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন, এজন্যই আমাদেরকে এত দায়িত্বাবলী দিয়েছেন। যাতে আল্লাহ সুবহানাহু তার বন্ধুদেরকে বাছাই করে নিতে পারেন এবং যাতে ঐ সকল উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত হয়, যার কয়েকটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করলাম।

আল্লাহ তা’আলা সূরা মুহাম্মদে বলেন:

﴿الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَن سَبِيلِ اللَّهِ أَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ* وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَهُوَ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ* ذَٰلِكَ بِأَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا اتَّبَعُوا الْبَاطِلَ وَأَنَّ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّبَعُوا الْحَقَّ مِن رَّبِّهِمْ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ لِلنَّاسِ أَمْثَالَهُمْ﴾

“যারা কুফর অবলম্বন করেছে এবং অন্যদেরকে আল্লাহর পথে বাঁধা দান করেছে, আল্লাহ তাদের কর্ম নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র প্রতি যা-কিছু অবতীর্ণ হয়েছে- আর সেটাই তো তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্য- তা আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে, আল্লাহ তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদের অবস্থা সংশোধন করে দিয়েছেন। এটা এজন্য যে, যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা মিথ্যার অনুগামী হয়েছে এবং যারা ঈমান এনেছে, তারা সত্যের অনুসরণ করেছে, যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। এভাবেই আল্লাহ মানুষকে তাদের অবস্থাদী সম্পর্কে অবহিত করেন”।

‘এভাবেই আল্লাহ…’ অর্থাৎ এর মত এবং পূর্বের  বর্ণনার মত। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের গুণাবলী ও তাদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেন এবং কাফেরদেরও গুণাবলী ও তাদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন- “এভাবেই আল্লাহ মানুষকে তাদের অবস্থাদী সম্পর্কে অবহিত করেন”।

অত:পর আল্লাহ বলেন:

﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ﴾

“যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তাদের সাথে যখন তোমদের মোকাবেলা হয়, তখন তাদের গর্দানে আঘাত করবে”।

তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার এবং তাদের সাথে যুদ্ধ ও জিহাদ করার আদেশ করলেন। {فضرب الرقاب} এখানে فعل (ক্রিয়া)র স্থলাভিষিক্ত مصدر (ক্রিয়ামূল) দ্বারা আদেশ করা হয়েছে-

﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ﴾

অর্থাৎ যখন তাদেরকে অধিক হারে হত্যা ও আহত করে ফেলতে পারবে-

﴿حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ﴾

“অবশেষে তোমরা যখন তাদের শক্তি চূর্ণ করবে, তখন তাদেরকে শক্তভাবে গ্রেফতার করবে”। অর্থাৎ বন্দী করবে-

﴿فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّىٰ تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ﴾

“তারপর (চাইলে) তাদেরকে মুক্তি দিবে অনুকম্পা দেখিয়ে অথবা মুক্তিপণ নিয়ে। তোমাদের প্রতি এটাই নির্দেশ, যাবৎ না যুদ্ধ তার অস্ত্র রেখে দেয় (অর্থাৎ শেষ হয়ে যায়)। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান”।

এটা হচ্ছে দলিলের পর্যায়ে। আর এর পূর্বে প্রথম অংশটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর দলিলের অংশটুকু হচ্ছে-

﴿ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ﴾

“এটাই নির্দেশ। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান”।

অর্থাৎ তোমাদের একদলের দ্বারা সৃষ্টিজীবকে। তোমাদের মুমিন অংশের দ্বারা তোমাদের কাফের অংশকে। আল্লাহ তা’আলা চাইলে কাফেরদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। আল্লাহ পারেন, তার ক্ষমতা আছে, তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি পবিত্র মহান সত্তা। তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারতেন-

﴿كن فيكون﴾

“হও, অমনি তা হয়ে যায়”।

কিন্তু তিনি তাদেরকে বাচিয়ে রেখেছেন এবং আমাদেরকে তাদের দ্বারা পরীক্ষা করছেন। আমাদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, যেমনিভাবে তাদেরকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহুর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ, আমাদেরকে ও তাদেরকে তথা কাফেরদেরকে-

﴿وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ﴾

“কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তিনি কখনো তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না”।

তাই এসকল আয়াতগুলোতে আমাদের উল্লেখিত ও আলোচিত বিষয়গুলোর বর্ণনা পাওয়া গেল। হায় যদি ভাইয়েরা তাফসীরের কিতাবসমূহে এগুলো নিয়ে চিন্তা করত, যাতে বিষয়গুলো ভালভাবে বুঝতে পারত।

এখানে আমরা কয়েকটি পয়েন্ট লিপিবদ্ধ করতে পারি, যাতে ভাইয়েরা রাসূল প্রেরণ বিষয়ক ইলমগুলোর একটি ধারাবাহিকতা তৈরী করতে পারে:

মানুষ দু’দলে বিভক্ত হল: মুমিনের দল ও কাফেরের দল। আল্লাহ তা’আলা তাদের একদলকে আরেক দলের উপর চাপিয়ে দিলেন। আমরা বলতে পরি আল্লাহ তা’আলা তাদের একদলকে আরেক দলের মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেললেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে উভয় দলকে পরীক্ষা করার জন্য এবং আল্লাহর উদ্দিষ্ট কয়েকটি হিকমত বাস্তবায়নের জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহর রয়েছে উন্নত প্রমাণ ও পরিপূর্ণ হিকমত।

অধিক পরীক্ষা, অধিক যাচাই, অধিক সুযোগ আল্লাহ সুবহানাহু তাদেরকে দিলেন, হয়ত তাদের কতক ফিরে আসবে, সতর্ক হবে, মৃত্যু আসার পূর্বে, নিশ্চিত বিষয় আসার পূর্বে। এটা তাদের জন্য পরীক্ষা।

এখন এসকল আমেরিকানরা আমাদের উপর চেপে আছে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে পরীক্ষা। আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করছেন। এটাই পরীক্ষা করার অর্থ। তাদেরকে দেখছেন, অধিক পরীক্ষা নিচ্ছেন, অধিক যাচাই করছেন এবং অধিক ফিৎনায় নিপতিত করছেন।

এটা তার পক্ষ থেকে অনুগ্রহই বটে যে, তিনি তাদেরকে অধিক সুযোগ দিচ্ছেন। হয়ত তারা চিন্তা করবে, হয়ত ভেবে দেখবে, হয়ত ফিরে আসবে।

তাই আল্লাহ পবিত্র, তিনি মহান। কাফেররা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে দলিল প্রতিষ্ঠা করছে আর আল্লাহ তাদেরকে তাদের সকল প্রকার ওযরের জন্য সুযোগ দিচ্ছেন। এভাবে আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও উচ্চ গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটছে। তার নামের মধ্যে রয়েছে: তিনি ‘সাব্বার’ (অধিক ধৈর্য্যশীল), সাবুর (চির ধৈর্য্যশীল), ‘হালীম’ (সহনশীল)। আর তার সহনশীল নামের কারণেই তিনি তাদেরকে নগদ শাস্তি দিচ্ছেন না, তাদেরকে সুযোগের পর সুযোগ দিচ্ছেন।

তাই এটা উভয়দলের জন্যই পরীক্ষা। এর ফলে হক ও বাতিলের মাঝে, ঈমান ও কুফরের মাঝে দ্বন্ধের সূত্রপাত হয়। দ্বন্ধ, তথা হক ও বাতিলের মাঝে লড়াই, যুদ্ধ। কেননা এই দুই দল, মুমিন ও কাফের কখনোই সমঝোতায় আসা সম্ভব নয়, পরস্পরে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। কখনোই সম্ভব নয়।

অবশ্যই দু’দল পরস্পরের শত্রু হবে। একদল আরেক দলের শত্রু। সম্ভব নয় দুই দলের মাঝে ভালবাসা ও সম্প্রীতি হওয়া, সহবস্থান ও দীর্ঘ সমঝোতা হওয়া।

সাময়িক সন্ধি, আমি সন্ধি বলে সাময়িক সন্ধির কথা বুঝাইনি। এব্যাপারে শরীয়তের বিধান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সমঝোতা, সহবস্থান, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি সম্ভব নয়। এই বিভক্তির দাবির কারণে এটা কখনোই সম্ভব নয়। এই ঈমান ও এই কুফরের দাবির কারণে এটা সম্ভব নয়। আর আল্লাহও এমনটাই (না হওয়াকেই) চান, এটাই আদেশ করেন।

অবশ্যই তারা পরস্পরের শত্রু, প্রতিপক্ষ ও পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইকারী হবে। এটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার কাম্য, তার উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা। আল্লাহই চান, আমরা পরস্পরের শত্রু হই, তবে স্বভাবতই তারা আমাদের সাথে শত্রুতা করুক এটা তিনি চান না। বরং এটা আল্লাহ তা’আলার নিকট ঘৃণিত, অপছন্দনীয়। কিন্তু এটা আল্লাহর তাকদীর হিসাবে হয়েই যাবে। এখানেই তাকদিরী ইচ্ছা ও শরয়ী ইচ্ছার মাঝে ভিন্নতা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে, আমরা তাদেরকে ঘৃণা করব, তাদের সাথে শত্রুতা করব, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এটা আল্লাহ চান, তিনি ভালবাসেন। তাকদিরীভাবেও চান, শরয়ীভাবেও চান এবং আমাদেরকে এরই নির্দেশ দেন।

এছাড়া এর মাঝে অনেক বড় কল্যাণও রয়েছে। এটা পৃথিবী সুশৃংখল থাকার জন্য শর্ত। পৃথিবী বলে উদ্দেশ্য হল, পৃথিবী ও তার মধ্যে যত মানুষ আছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الْأَرْضُ﴾

“যদি আল্লাহ তাদের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত”।

এই আয়াতটি বর্ণনা করছে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলার একটি হিকমত ও একটি ইচ্ছা হল একজনকে আরেকজন দ্বারা প্রতিহত করা, যার দ্বারা পৃথিবী সুসংহত থাকবে। কেননা আল্লাহ যদি মুমিনদের দ্বারা কাফেরদেরকে এবং তাদের কুফর, অবাধ্যতা ও জুলুমকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত- “যদি আল্লাহ তাদের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন”, যদি এই লড়াই না থাকত এবং বহু অনিষ্ট কল্যাণের দ্বারা প্রতিহত না হয়ে যেত, জিহাদ ও কিতালের দ্বারা, এ সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লড়াইয়ের দ্বারা প্রতিহত না হত, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত।

পৃথিবী কিভাবে বিপর্যস্ত হবে? কাফেরদের আধিপত্যের মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হল, পৃথিবীতে কাফেরদের আধিপত্য বিস্তার করা। যখন পৃথিবীতে কাফেররা প্রতাপশালী হয়ে যায়, তারা তাতে শাসন করে- আল্লাহ হেফাজত করুনÑ ব্যাস, তখনই পৃথিবীময় মহা বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। কুফর, শিরক, অন্যায়, পাপাচার, আল্লাহর অবাধ্যতা, শয়তানদের প্রভাব, শয়তানদের দাওয়াত, শয়তান-প্রেমী ও প্রবৃত্তি-প্রেমীদের প্রভাব। পৃথিবীতে কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াই মহা বিপর্যয়। এর চেয়ে বড় ফ্যাসাদ আর কিছু নেই।

এর দ্বারা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়: মুমিনদের বন্ধুত্ব কেবল আল্লাহর সাথে, তার দ্বীনের সাথে, তার রাসূলদের সাথে এবং এক মুমিনের আরেক মুমিনের সাথে। এই বন্ধুত্বই আল্লাহ তা’আলার কাম্য, আল্লাহর উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি আমাদেরকে এর প্রতিই আদেশ করেন এবং এটা অবশ্যই থাকতে হবে, ঈমান ও কুফরের দাবির কারণে এবং এই দাবির কারণে যে, আমরা আল্লাহর নগন্য বান্দা।

সুতরাং ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য। তার সাথে কাউকে শরীক করা হবে না। তাওহিদ, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে আত্মসমর্পণই দাবি করে, অনিবার্যভাবে চায়- যা একেবারে নিকটবর্তী দাবি- যেটাকে ভাষাবিদগণ, এমনকি মানতিক শাস্ত্রেও ‘নিকটবর্তী দাবি ও দূরবর্তী দাবি বলে নামকরণ করা হয়- এটাই দাবি করে, মুমিনগণ বন্ধুত্ব করবে কেবল আল্লাহর সাথে, তার রাসূলের সাথে, তার দ্বীনের সাথে এবং মুমিনদের সাথে আর কুফর, কুফ্ফার ও তৎসংশ্লিষ্ট যা কিছু আছে-অর্থাৎ কুফরের যত ফলাফল রয়েছে- যেমন: গুনাহ, পাপাচার, হঠকারীতা ও আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা- ইত্যাদির সাথে এবং শয়তান, তার দল, তার নিকটজন ও যারা তার দলভূক্ত তাদের সাথে শত্রুতা ও সম্পর্কোচ্ছেদ করবে। তাই তারা হচ্ছে দু’টি দল।

অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্ব, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আল্লাহকে একক সাব্যস্থ করাই এটা দাবি করে এবং তাকে স্পষ্ট ও নিকটবর্তী ফলাফল হিসাবে আবশ্যক করে। অর্থাৎ মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহ, তার রাসূল, তার দ্বীন ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং কুফ্ফার, কুফর, শয়তান, তার দল ও তৎসংশ্লিষ্ট সবকিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, দূরত্ব ও কাঠিন্য বজায় রাখতে হবে, শত্রুতা ও বিদ্বেষ রাখতে হবে, তাদের থেকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ মুক্ত।

আমরা এটাকে সংক্ষেপে বলতে পারি: ঈমান, ইসলাম, তাওহিদ তথা একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর দাসত্ব করাই দাবি করে ও আবশ্যক করে যে, মুমিনগণ আল্লাহ, তার রাসূল ও তার দ্বীনের সাথে এবং অন্যান্য মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। তাদের বন্ধু হবে মুমিনগণ। আর আল্লাহর শত্রু তথা কাফের ও তাদের কুফরী থেকে সম্পর্কমুক্ত হবে, তাদের সাথে শত্রুতা করবে।

এখান থেকে আমরা বলতে পারি, সম্পর্ক জোড়া ও সম্পর্ক ছাড়া এবং বন্ধুত্ব ও শত্রুতা এটা আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের দাবি, তাওহিদের দাবি, ইসলামের দাবি, ঈমানের দাবি। ঈমান এটা দাবি করে, ঈমানের জন্য এটা আবশ্যক এক’শতে এক’শ। ঈমান থেকে এটা আলাদা হতে পারে না। তাই এটা অসম্ভব যে, একজন মানুষ মুসলিম হবে, মুমিন হবে, তাওহীদবাদী হবে- যে শুধু আল্লাহরই ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, আল্লাহকে ভালবাসবে, তার আনুগত্য করবে আবার একই সময়ে শয়তানকে ভালবাসবে, কুফরীকে ও কাফেরদের ভালবাসবে বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তাদের নৈকট্য অর্জন করবে, তাদের সাথে প্রশান্ত ও স্বস্তিময় জীবন যাপন করবে, যাতে কোন পেরেশানী নেই, এটা সম্ভব নয়। এটা অকল্পনীয়। কেননা দাসত্বের ভিত্তিটিই হচ্ছে ভালবাসার উপর। উলামাগণ বলেন: ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে ভালবাসা ও আনুগত্যের মধ্যে। সুতরাং কোন আবিদ পরিপূর্ণ আল্লাহর ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য আনুগত্যকে সপে দেওয়া- যার দাবি হচ্ছে আল্লাহর জন্য বিনীত হওয়া, আল্লাহর আদেশের জন্য নিবেদিত হওয়া এবং আল্লাহর অনুগত হওয়া- ব্যতীত আল্লাহর ইবাদতকারী হতে পারে না। দাসত্বের প্রকৃত ভিত্তিই হচ্ছে ভালবাসা ও বিনীত হওয়ার উপর। সুতরাং বান্দা এটা ব্যতীত আবিদ হতে পারবে না। আর আল্লাহকেও ভালবাসা, তার শত্রুদেরকেও ভালবাসা এটা সম্ভব নয়। এটা অসম্ভব।

এমনকি মানুষের মাঝে চিরাচরিত ভালবাসার মাঝেও এটা সম্ভব নয় যে, আপনি কাউকে ভালবাসবেন আবার তার শত্রুকেও ভালবাসবেন। এটা সম্ভব নয়। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ তার শত্রুকে ভালবাসা তার ভালবাসার সম্পূর্ণ বিরোধী ও বিপরীত।

আর কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের আল্লাহর দাসত্বও আমাদের থেকে দাবি করে: আমরা আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লাহকে ভালবাসব এবং তার রাসূল, তার দ্বীন, তার বন্ধু ও যারা তার কাতারে থাকে তাদেরকে ভালবাসব আর যারাই তার সাথে শত্রুতা রাখে তাদেরকে ঘৃণা করব, তাদের সাথে বিদ্বেষ রাখব এবং তাদের সাথে শত্রুতা করব। যদি এটা আল্লাহ আমাদেরকে নাও বলতেন আমাদের উপর ওয়াজিব নাও করে দিতেন, তথাপি এটা ইসলাম, ঈমান, তাওহিদ ও দাসত্বের দাবিতে ওয়াজিব হত। আর বস্তবতা তো হচ্ছে শরীয়তই আল্লাহ, তার রাসূল ও তার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করেছে এবং কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে, তাদের নিকটবর্তী হতে ও তাদের সাথে অবস্থান করতে নিষেধ করেছে, যা সামনে উল্লেখ করব ইংশাআল্লাহ।

এতদসত্তেও আল্লাহ সুবহানাহু স্বীয় অনুগ্রহ ও দয়ায় আমাদেরকে আরো স্পষ্ট ও পরিস্কারভাবে বলে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমলতার অধিকারী, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আল্লাহ প্রেমময়, মহানুভব-

﴿يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ﴾

“আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সহজটাই চান, তিনি তোমাদের ব্যাপারে কঠিনটা চান না”

আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের উপর সহজকরণের একটি দিক হল, তিনি আমাদের জন্য অধিক স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তার কুরআনের আয়াতসমূহে বর্ণনা করেছেন, তার নবী তার পবিত্র হাদিসসমূহে পরিস্কার করে গেছেন যে, আমাদের উপর ওয়াজিব হল, আমরা মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করব, আল্লাহর সাথে, তার রাসূলের সাথে ও তার দ্বীনের সাথে বন্ধুত্ব করব। আমরা মুমিনদের সাথে পরস্পরে বন্ধু হিসাবে থাকব, তাদেরকে ভালবাসব, তাদের সাথে থাকব, তাদের কাতারে থাকব, তাদের নৈকট্য অর্জন করব, তাদের সাথে জীবন যাপন করব এবং সর্বদা তাদের সাথেই থাকব।

আমরা মুমিনদের সাথে একে অপরের বন্ধু বা সাহায্যকারী রূপে থাকব আর কাফেরদেরকে ঘৃণা করব, তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব, তাদের থেকে দূরে থাকব ও বেঁচে থাকব, তাদের সাথে বসবাস করব না, এক আবাসস্থলে বা এক শহরে তাদের সাথে থাকব না- “তারা যেন একে অপরের আগুন না দেখে”  নবী সা: বলেছেন তাদের থেকে দূরে থাক, এমনকি যাতে দূর থেকে তাদের আগুনও দেখতে না পাও এবং তারাও তোমাদের আগুন দেখতে না পায়। তাদের থেকে দূরে থাক, পৃথক থাক, বেচে থাক, এক দেশে তাদের সাথে থেকো না, তাদের মাঝে বসবাস করো না, তাদের সাথে মেলামেশা করো না….তাদের সাথে কিছুই করো না…।

এসগুলোই কাফেরদের থেকে দূরে থাকা ও বেচে থাকা, সম্পর্ক ছিন্ন করা, শত্রুতা করা ও বিদ্বেষ পোষণ করার নির্দেশ। আল্লাহ আমাদের মাঝে তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছেন, বলেছেন: কিভাবে এদেরকে ভালবাসবে? এদেরকে ঘৃণা করবে, কারণ এরা আল্লাহর দুশমন, এরা আল্লাহর প্রতি কুফরী করেছে, আল্লাহর রাসূলদের প্রতি কুফরী করেছে, আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে, আল্লাহর আনুগত্যের উপর সীমালঙ্ঘন করেছে। এরা তোমাদের শত্রু।

এগুলো আমাদের জন্য কুরআন ও সুন্নায় বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, আমাদেরকে অবশ্যই মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে, আমাদের একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হবে এবং অবশ্যই আমাদেরকে কাফেরদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, তাদের সাথে শত্রুতা করতে হবে, তাদেরকে ঘৃণা করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে হবে, জিহাদ করতে হবে এবং আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে হবে।

এটা কুরআনে স্পষ্টভাবে সর্বোত্তমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করছি একটু পরেই সেগুলো তিলাওয়াত করব ইংশাআল্লাহ। এখানে এখন কিছু আয়াত তিলাওয়াত করব; কারণ সবগুলো উল্লেখ করলে এবং তার ব্যাখ্যা ও তাফসীর করলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাই আমরা কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হব।

আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লাহও আমাদের মাঝে তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছেন এবং অনেক আয়াতে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের উপর ওয়াজিব তাদেরকে ঘৃণা করা, কারণ তারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছে, আল্লাহর আনুগত্যের উপর সীমালঙ্ঘন করেছে। তাই এটা কুরআনে সর্বোত্তমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

অনেক আয়াতে কাফেরদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দু’চারটি উল্লেখ করা হল:

﴿هَا أَنتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ﴾

“দেখ, এই তোমরা তাদেরকে মহব্বত করছ, অথচ তারা তোমাদেরকে মহব্বত করে না। আর তোমরা তো সমস্ত (আসমানী) কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান রাখ, কিন্তু (তাদের অবস্থা এই যে,) তারা যখন তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা (কুরআনের উপর) ঈমান এনেছি আর যখন নিভৃতে চলে যায়, তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে নিজেদের আঙ্গুল কামড়ায়”।

এটা পূরোটাই কাফেরদের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতা সৃষ্টির ব্যাপারে।

﴿أَلَا تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نَّكَثُوا أَيْمَانَهُمْ وَهَمُّوا بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُم بَدَءُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ

“তোমরা কি এমন কওমের সাথে যুদ্ধ করবে না, যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রাসূলকে বহিস্কারের ইচ্ছা করেছে আর তারাই তো প্রথমবার তোমাদের বিরুদ্ধে (উস্কানীমূলক কর্মকান্ড) শুরু করেছে। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? তাহলে (জেনে রেখ,) আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত”।

এরূপ আরো আয়াত রয়েছে।

তাহলে কুরআনের মধ্যে অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদেরকে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করে এবং তাতে আল্লাহ সুবহানাহু আমাদেরকে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে ও তাদেরকে সাহায্যকারী রূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন।  সূরা মুমতাহিনা, যার অধিকাংশটা এবং বড় অংশটাই এব্যাপারে, তার মধ্যে রয়েছে-

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُم مِّنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَن تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِن كُنتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنتُمْ وَمَن يَفْعَلْهُ مِنكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ* إِن يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً

“হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমার পথে জিহাদের জন্য (ঘর থেকে) বের হয়ে থাক, তবে আমার শত্রু ও তোমাদের নিজেদের শত্রুকে এমন বন্ধু বানিও না যে, তাদের কাছে ভালবাসার বার্তা পৌঁছাতে শুরু করবে, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে, তারা তা এমনই প্রত্যাখ্যান করেছে যে, তারা রাসূলকে এবং তোমাদেরকেও কেবল এই কারণে (মক্কা হতে) বের করে দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব কর, অথচ তোমরা যা-কিছু গোপনে কর ও যা-কিছু প্রকাশ্যে কর, আমি তা ভালভাবে জানি। তোমাদের মধ্যে কেউ এমন করলে সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হল। তোমাদেরকে ভাগে পেলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের হাত ও মুখ বিস্তার করে তোমাদেরকে কষ্ট দিবে। তাদের কামনা এটাই যে, তোমরা কাফের হয়ে যাও”।

তাহলে কিভাবে তাদেরকে ভালবাসবে? এখানেও তাদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। إِن يَثْقَفُوكُمْ অর্থাৎ যদি তারা তোমাদেরকে কোনস্থানে পায়-

﴿إِن يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً وَيَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ وَأَلْسِنَتَهُم بِالسُّوءِ وَوَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ﴾

“তোমাদেরকে ভাগে পেলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের হাত ও মুখ বিস্তার করে তোমাদেরকে কষ্ট দিবে। তাদের কামনা এটাই যে, তোমরা কাফের হয়ে যাও”।

অর্থাৎ তারা তোমাদের থেকে কুফরী কামনা করে এবং চায়, তোমরাও আল্লাহর সাথে কুফরী কর।

অত:পর আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য  ইবরাহীম আ:  এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন-

﴿قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ

“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাদের সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ আছে, যখন সে নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা করছ, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকীদা-বিশ্বাস) অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে গেছে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।

এখানে স্পষ্টভাবে শত্রুতা ও বিদ্বেষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ﴿وَبَدَا﴾ ‘এবং স্পষ্ট হয়েছে, প্রকাশ হয়েছে’-

﴿وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে গেছে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”

তবে তোমরা যদি একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আন, তবেই কেবল তোমাদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ শেষ হবে। এর পূর্বে কখনোই না-

﴿أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“চিরকাল চলবে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”।

এখানে একেবারে স্পষ্ট, পরিপূর্ণ স্পষ্ট বর্ণনা। তাই পুরো কুরআন এর দ্বারা পরিপূর্ণ। সূরা আলে ইমরানে রয়েছে, মায়েদায় রয়েছে, বাকারায় রয়েছে। এছাড়াও কুরআনের অনেক সূরায় এটা স্পষ্টভাবে রয়েছে, সর্বোত্তমভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তাহলে সারসংক্ষেপে কথাটি বলি, যাতে ভাইয়েরা বুঝতে পারে:

এ সত্তেও, অর্থাৎ দাসত্ব, ইসলাম, ঈমান ও তাওহিদ স্বত্তাগতভাবেই এটা দাবি করা সত্তেও- যা পূর্বে আমরা উল্লেখ করলাম, এটা মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব ও কাফেরদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষের দাবি করে- তা সত্তেও আল্লাহ সুবহানাহু তার কিতাবে এবং তার নবীর সুন্নায় আরো স্পষ্ট ও আরো পরিস্কারভাবে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার আবশ্যকীয়তা ও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার নিষেধাজজ্ঞা বর্ণনা করে দিয়েছেন। এ বিষয়টিই আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, কিন্তু এখন আপনাদের জন্য সংক্ষেপে এককথায় বলার প্রয়াস পেলাম।

এখন আমরা ইংশাআল্লাহ কিছু আয়াত উল্লেখ করব, যা কুরআনে এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলো উল্লেখ করব, যেগুলোতে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের ব্যাপারে কঠিন হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলো উল্লেখ করব।

আমরা পূর্বে সূরা মুমতাহিনার আয়াতটি উল্লেখ করেছি-

﴿يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ

“হে ঈমানদারগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না”

এ ধরণের আয়াত কুরআনের মধ্যে আরো অনেক রয়েছে। এখন বিভিন্ন সূরার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আয়াত উল্লেখ করব। একটি সূরা আলে ইমরানে, দু’টি সুরা মায়িদায়। এই তিনটি হল কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের হুকুমের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত।

আমরা বলেছি, কুরআন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করে এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করে আর কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে শক্ত গুনাহ ও পাপ বলে উল্লেখ করে, বরং কোন কোন আয়াতে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, এটা এর থেকেও আরো কঠিন ও জঘন্য। যা আমরা সামনের আয়াতগুলোতে দেখব:

আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে ইমরানে বলেন:

﴿لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ﴾

“মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন কর, সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন। আর তারই দিকে (সকলের) প্রত্যাবর্তন”।

আরেকটি আয়াত হল-

﴿وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ﴾

“আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন। আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি দয়াশীল”।

এই আয়াতটি হল সূরা আলে ইমরানে। আল্লাহ তা’আলা বলছেন: “মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়”।

বর্ণনা ভঙ্গিটি সংবাদমূলক, কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন করে বলা, আদেশ করা।

“মুমিনগণ যেন না বানায়”, অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা বানিও না। এটা হচ্ছে তার অর্থ। “মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়” এতে মুমিনদেরকে নিষেধ করা হচ্ছে, মুমিনদের ছাড়া কাফেরদের সাথে সাথে বন্ধুত্ব করতে।

এটা পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট বয়ান। আপনি শুধু মুমিনদেরকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করবেন, কাফেরদেরকে বন্ধু বানাবেন না।

এরপর বলেন: ‘যে এটা করে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’। এরকম ভাবপ্রকাশ আরবী ভাষায় কোন ব্যক্তি বা বস্তু থেকে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলে থাকে- ‘যে এমনটা করে সে আমার থেকে  নয়; আমি তার থেকে নই’ ‘অথবা সে কোন বিষয়ে আমার থেকে নয়’।

রাসূলুল্লাহ সা: এর কথায় অনেক স্থানে এরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

) من غشنا فليس منا(

যে আমাদেরকে (মুসলমানদেরকে) ধোঁকা দেয় সে আমাদের মধ্য থেকে নয়”। অর্থাৎ আমি অমুক জিনিস থেকে সম্পর্কমুক্ত।

‘যে এটা করে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’ অর্থাৎ আল্লাহ তার থেকে সম্পর্কমুক্ত, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, সে আল্লাহর নৈকট্য পাবে না এবং আল্লাহর সাথে সম্বন্ধিত হতে পারবে না। এটাই হচ্ছে- “আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই” এর অর্থ।

তারপর পূবের্র হুকুম থেকে পৃথক করে বলেন: ‘তবে…..’। সেই ভিন্ন অবস্থাটি হল আত্মরক্ষামূলক ব্যবহারের অবস্থা। অর্থাৎ যখন তোমরা তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত ও পরাজিত হও, তাদের থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা কর, ফলে বাহ্যিকভাবে তাদের সামনে প্রকাশ কর যে, তোমরা তাদের সাথে শত্রুতা কর না, তাদের থেকে বাচার উদ্দেশ্যে। এটা হল অপারগতার অবস্থা। অপরাগতা ও আশঙ্কার অবস্থাটি শুধু ভিন্ন। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এটা চলবে না। এটাই হল প্রকৃত হুকুম- কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা নিষেধ। আর এখানে এটি এত স্পষ্টভাবে রয়েছে, যা অন্যসব আয়াতে নেই। এখানে বলা হয়েছে, যে এমনটা করে এবং মুমিনদের ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, আল্লাহ তার থেকে মুক্ত- ‘আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’

এই সম্পর্কমুক্তির অর্থ কি, এটা কি কুফর? ‘আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’ এর অর্থ কি সে আল্লাহর দ্বীন থেকে একেবারেই বের হয়ে গেছে? এর অর্থ কি কুফর? না এর অর্থ পাপাচার ও গুনাহ? সবগুলোরই সম্ভাবনা রয়েছে, আল্লাহই ভাল জানেন এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কিন্তু এটা হচ্ছে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বকারীর কুফরের সম্ভাবনার ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিশালী আয়াত। এই বিষয়টিকে আরেকটু স্পষ্ট করব ইংশাআল্লাহ। এ হচ্ছে প্রথম আয়াত, যা সূরা আলে ইমরানের, যাতে আল্লাহ তা’আলা বললেন, তিনি ঐ সকল লোকদের থেকে সম্পর্কমুক্ত, যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে।

আর দ্বিতীয় আয়াত, যা সূরা মায়িদায় রয়েছে তা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্য থেকে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই দলভূক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না”।

আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে সম্ভোধন করছেন-‘হে ঈমানদারগণ!’ তাদেরকে ডেকে বলছেন, তোমরা এই কথাটি শোন- ‘তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না’। নিষেধ করা হল-

﴿لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ﴾

আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি, তোমারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।

এই বাক্যটি একটি মধ্যবর্তী বাক্যের (জুমলা মু’তারিযার) মত। যেন এটা কথার মাঝে ভিন্ন প্রসঙ্গ। জুমলা মু’তারিযা হল, যে বাক্য আনা হয়, উদ্দিষ্ট কথার পূর্বে ভিন্ন একটি বিষয় বুঝানোর জন্য।

অত:পর আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾

অর্থাৎ বাস্তব অবস্থা হল, ইহুদী-নাসারারা একে অন্যের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তাই তোমরা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। অত:পর বলেন: ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে’ অর্থাৎ আর যারা এই কাজ করবে, যা থেকে আমি নিষেধ করলাম এবং তাদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করবে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। তোমরা হে মুমিনগ!﴿وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ﴾  তোমাদের মধ্য হতে যে এটা করবে। অত:পর তার ফলাফল উল্লেখ করেন।

এখানে مَن (যে) শব্দটি শর্তমূলক। ফলাফলটি হল-‘সে তাদেরই দলভূক্ত’। যে কুফ্ফার তথা ইহুদী-নাসারা ও তাদের মত যেকোন প্রকার কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তার কুফরীর ব্যাপারে এটা সবচেয়ে স্পষ্ট আয়াত।

সবচেয়ে স্পষ্ট আয়াত, আল্লাহ তা’আলা এখানে পরিস্কারভাবে বলেছেন, যে ইহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করে সে তাদের মধ্য থেকে। অর্থাৎ সে তাদের মত, তাদের অন্তর্ভূক্ত, তাদের মধ্যে গণ্য এবং তাদের মত কাফের। অত:পর বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না”। এটা হচ্ছে বঞ্চনা, যার মধ্যে শাস্তিবাণী ও ধমকি রয়েছে। অর্থাৎ যখন তোমরা জুলুম করবে, তোমরা হয়ে যাবে জালেম, তখন জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দিবেন না। কারণ আল্লাহ তা’আলা জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না। এখানে নিষেধাজ্ঞা ও  হুকুম উল্লেখ করার পর কঠিন শাস্তিবাণী ও ধমকি শোনানো হল।

﴿فَإِنَّهُ مِنْهُمْ﴾ কতক উলামা স্পষ্টভাবে বলেছেন: এর অর্থ হল, সে তাদের মত কাফের। অন্য আলেমগণ বলেছেন, সে গুনাহের মধ্যে তাদের মত।

কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট ও পরিস্কার, যা বুঝে আসে এবং প্রথমেই মাথায় উদয় হয়, যা আরবী কথার অর্থের সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ, তা হচ্ছে সে কুফরীর মধ্যে তাদের মত, ‘সে তাদের মধ্য থেকে’ মানে তাদের মত কাফের। আল্লাহই ভাল জানেন। এটাই ব্যাখ্যা হিসাবে অগ্রগণ্য।

তৃতীয় আয়াতটিও সূরা মায়িদায় এবং তারপরের আয়াতও সূরা মায়িদার, পূর্বের আয়াতের কিছু পরে। তা হল:

﴿وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ

“তারা যদি আল্লাহ, নবী ও তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না”।

এই আয়াতের পূর্বের কয়েকটি আয়াত আমরা তিলাওয়াত করবো, যা দীর্ঘ, সবগুলোই বন্ধুত্বের ব্যাপারে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ* كَانُوا

“বনী ইসরাঈলের মধ্য হতে যারা কুফরী অবলম্বন করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে অভিশম্পাত বর্ষিত হয়েছিল। তা একারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং সীমালঙ্ঘন করেছিল”।

অর্থাৎ ইহুদীরা-

﴿كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ﴾

“তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ”।

একজন আরেকজনকে অন্যায় থেকে নিষেধ করত না-

﴿كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ* تَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾

“তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ। তুমি তাদের অনেককেই দেখবে, তারা কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে”।

ইহুদীরা। আল্লাহ সুবহানাহু তাদের নিন্দা করছেন এবং তাদের অপরাধ বর্ণনা করছেন যে, তারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখত, তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করত না-

﴿تَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ أَن سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونُ* وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَٰكِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ﴾

তুমি তাদের অনেককেই দেখবে, তারা কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা-(তার কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শস্তির ভেতর থাকবে। তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল,) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।

উক্ত “তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না” উদ্ধৃতিটি আয়াতের একটি অংশ। সূরার পূর্বাপর আয়াতসমূহের সাথে তার স্থান হল এটি, যা পড়ে শোনা হল।

আল্লাহ সুবহানাহু এই আয়াতে যারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে সে সকল ইহুদীদের ব্যাপারে বলেছেন। আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পূর্ণ আলোচনা ইহুদীদের ব্যাপারে।

আল্লাহ সুবহানাহু ইহুদীদের ব্যাপারে আলোচনা করছেন, তাদের নিন্দা করছেন, তাদের দোষ বর্ণনা করছেন যে, তারা যে অন্যায় করত, তাতে একে অপরকে বারণ করত না এবং তাদের অনেকে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখত। তারপর বলেন: “তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না”। এর অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহ, তার রাসূল ও তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনেনি।

উক্ত আয়াতে لو (যদি) শব্দটি শর্তবোধক অব্যয়। এটা বুঝায়, একটি জিনিস না থাকার কারণে আরেকটি জিনিসও থাকবে না। তাই তাদের আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি ও তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান নেই। এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটু ব্যাখ্যা করতে হয়, কারণ বাক্যটি নেতিবাচক বাক্য। এ হিসাবে উক্ত আয়াতের অর্থ হয়ে যায়, “তাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার কারণে তাদের ঈমান নেই”। কারণ বাক্যটি নেতিবাচক। তাই ‘না হওয়া’ বা ‘না থাকা’ শব্দ উহ্য মেনে ব্যাখ্যা করতে হবে।

তখন অর্থ হবে: আল্লাহ, নবী ও তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি তাদের ঈমান নেই, এই জিনিসটি না থাকার কারণে, না পাওয়া যাওয়ার কারণে। আর সেই জিনিসটি হল: কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা।

তাই এই ব্যাখ্যাটি করতে হয়।  কারণ বাক্যটি এসেছে না বোধক আলোচনার সাথে। অন্যথায় لو শব্দটি আরবী মূলনীতিতে প্রকৃতার্থে ‘কোন জিনিস না থাকার কারণে অন্য কোন জিনিস না থাকা’ বুঝায়। আপনি বললেন: ‘তুমি যদি আমার কাছে আসতে, তাহলে আমি তোমার একরাম করতাম’। কিন্তু তুমি না আসার কারণে আমার তোমাকে একরাম করা হয়নি। কিন্তু এই আয়াতে না বোধক শব্দ থাকার কারণে বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল, বাক্যটির অর্থ হচ্ছে: তারা যদি আল্লাহ ও তার নবীর প্রতি ঈমান আনত, তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। তাই যখন তারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করল, এটাই প্রমাণ করে, তারা মুমিন ছিল না।

“لو” বর্ণকে ভাষাবিদগণ নামকরণ করেন, ‘একটি না থাকার কারণে আরেকটি না থাকার অর্থজ্ঞাপক বর্ণ’ বলে। তার শর্তটি না পাওয়ার কারণে শর্তকৃত বস্তুটিও পাওয়া যাবে না।

আর এখানে দুই অংশের এক অংশ নেতিবাচক-﴿مَا اتَّخَذُوهُمْ﴾ “তারা তাদেরকে গ্রহণ করত না”। তাই তার মধ্যে ‘না থাকা’ বা না ‘হওয়া’ শব্দ উহ্য মানতে হবে। তখন মূল কথাটি এরূপ হবে: “আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি ও তার উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার প্রতি তাদের ঈমান নেই, তাদের থেকে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা না পাওয়া যাওয়ার কারণে”।

‘না করা’ না পাওয়া যাওয়া মানে হচ্ছে ‘না’ এর ‘না’। অর্থাৎ ‘হ্যা’। অর্থাৎ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা।  (এত বেশি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এককথাকে….)

তাই যে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তার হুকুমের ব্যাপারে এটা হল কুরআনের বর্ণিত তিনটি আয়াতের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ও পরিস্কার যে, আল্লাহ তার থেকে মুক্ত এবং সে ঈমানদার নয়; বরং সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।

একারণেই উলামায়ে কেরাম কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে এবং অন্যান্য সাধারণ আয়াতগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বন্ধুত্ব করার অনেকগুলো স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর হল কুফর। আর তার নিচে পাপ ও গুনাহের অনেক স্তর রয়েছে। অনেক স্তর, যা কেবল আল্লাহই জানেন।

কারণ আল্লাহ সুবহানাহু একস্থানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তিনি তার থেকে সম্পর্কহীন এবং আরেক স্থানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সে তাদের মধ্য থেকেই’, আরেক স্থানে বলেছেন, সে ঈমানদার নয়। তাই এসকল উদ্ধিৃতিগুলো থেকে তারা এ গবেষণা করেছেন যে, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার কোন স্তর রয়েছে, যা কুফর। আর নিশ্চয়ই এটিই হল সর্বোচ্চ স্তর। একারণে আলেমগণ বলেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার সর্বোচ্চ স্তর হল তা কুফর। এটা হল সর্বোচ্চ স্তর, সর্বাধিক স্পষ্ট। এটার সম্বন্ধেই এখন আমরা কথা বলছি। আর যে স্তরগুলো এ স্তরের নিচে, সেগুলো হচ্ছে গুনাহ। আর সেগুলো বিভিন্ন রকমের হয়: কিছু বড় গুনাহ, কিছু ছোট গুনাহ।

কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার সেই সর্বোচ্চ স্তর ও পর্যায় কোন্টি, যেটা আমরা কল্পনা করতে পারি, কে আমাদেরকে এর উত্তর বলবে?

আলেমগণ বলেন: কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার (অর্থাৎ মুসলমান তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে) সর্বোচ্চ স্তর হল: তাদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এই স্তরকে ‘মুযাহারাহ’ বলেন, অর্থাৎ লড়াই বা যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সাহায্য করা।

অর্থাৎ যখন এদিকে লড়াই, যুদ্ধ, রক্তপাত হচ্ছে, তখন সে কাফেরদের কাতারে থাকবে, তাদেরকে সাহায্য করবে, সহযোগীতা করবে, তাদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এটা হচ্ছে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তর। এই স্তর কুফর।

যে কাফেরদের সাথে তাদের কাতারে, তাদের পক্ষে, তাদের সীমানায়, তাদের পার্শ্বে ও তাদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদেরকে সহযোগীতা করে, মদদ দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে, এটা বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তর, সবচেয়ে পরিস্কার অবস্থা এবং এটা বন্ধুত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট অবস্থা, যার উপর আল্লাহ তাআলার একথাগুলো প্রযোজ্য: আল্লাহ তার থেকে সম্পর্কহীন’, ‘সে তাদের দলভূক্ত’, ‘সে ঈমানদার নয়এই ব্যক্তি কখনোই মুমিন নয়। এটা ঈমান ভঙ্গকারী জিনিসসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম ভঙ্গকারী। এর থেকে আল্লাহর পানাহ। আমরা এর থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও মুক্তি কামনা করছি।

তার নিচে অনেক স্তর রয়েছে, যার কোনটা কুফরের সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু এটার ব্যাপারে আমরা দৃঢ়ভাবে বলি, এটা কুফর।

পরিশেষে: শুরুতে-শেষে, প্রকাশ্যে-গোপনে সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।  রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক তার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সা: এর উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সমস্ত সাহাবাদের উপর।

************