দ্বীন ইসলামের ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ আগে শিখবো।
আগে মূলধন রক্ষা, পরে লাভ করার চেষ্টা – ইসলামের এই মূলনীতির আলোকে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পারছিঃ
- A) কিছু কিছু মানুষ চিরজাহান্নামী হবে।
- B) কিছু কিছু মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য জাহান্নামে যাবে।
- C) বাকীরা সরাসরি জান্নাতে যাবে। কেউ কেউ জান্নাতের উচ্চস্তরে যাবে, কেউবা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে।
তাই সবচেয়ে আগে আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে যাতে,
A] আমরা চিরজাহান্নামী না হই, তারপর,
B] আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদেরকে বিন্দুমাত্র সময়ের জন্যও জাহান্নামে না যেতে হয়,
C] তারপর চেষ্টা করতে হবে যাতে জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যাওয়া যায়।
তাহলে স্টেপ বাই স্টেপ সিস্টেমেটিক্যালি কাজ শুরু করা যাক…
A- চিরস্থায়ী ভাবে জাহান্নামে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলে, আমাদেরকে মুসলিম হতে হবে আর মুসলিম অবস্থায় মরতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনঃ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ এই সাক্ষ্য দেয়া যা ইসলামের বেসিক ফাউন্ডেশন। অর্থাৎ আমি সকল প্রকার মিথ্যা ইলাহ-উপাস্য(যা কুরআনের পরিভাষায় তাগুত, Al-Quran 16:36), মিথ্যা মাবুদ, ইবাদাতের মিথ্যা দাবীদার, অনুসরণের মিথ্যা দাবীদার, অনুকরণের মিথ্যা দাবীদারকে অস্বীকার করে, পরিত্যাগ করে, সেসব মিথ্যা ইলাহদের সাথে বিরোধ-বিদ্বেষ পোষন করে, তাদেরকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করছি।
আর আল্লাহর সকল নাম ও গুনাবলী, তাঁর কাজসমূহ, তাঁর ইবাদাত, তাঁর হুকুম-আহকামে তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে অন্তরে, কথায় ও কাজে মেনে নিচ্ছি।
এখন লা ইলাহা অর্থ কি? কি এবং কারা সেই মিথ্যা ইলাহ – এটা না জানলে কি এসব মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার করা যাবে?
এই মিথ্যা ইলাহদেরকে কিভাবে অস্বীকার করতে হবে? শুধু মুখের মাধ্যমে অস্বীকার করাই কি যথেষ্ট? সবগুলি মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার করে, শুধুমাত্র যে কোন একটি মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার না করলে, পরিত্যাগ না করলে কি মুসলমান হওয়া যাবে?
এই ব্যাপারগুলি প্রথমেই আমাদেরকে জানতে হবে। তা না হলে তো আমাদের ঈমানই প্রশ্নের সম্মুখীন।
আবার ইল্লাল্লাহ অর্থ কি? আল্লাহ কোন কোন ক্ষেত্রে এক ও অদ্বিতীয়?
রব হিসেবে আল্লাহর কাজ, যেগুলিতে তিনি এক ও অদ্বিতীয় যেমনঃ সৃষ্টি করা, রিযিক দান, বিপদ থেকে উদ্ধার করা, আইন-প্রণয়ন, বিচার-ফায়সালা, মৃত্যু দান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনে কিভাবে আল্লাহর একত্ববাদ বজায় রাখতে হয়?
বাস্তব জীবনে মানুষ কিভাবে আল্লাহর কাজ, তাঁর নাম ও গুনাবলীতে, তাঁর ইবাদাতে একত্ববাদ বিরোধী কাজ করছে বা শিরক করছে?
ইবাদাতের ক্ষেত্রে কিভাবে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় মানতে হয়?
ইবাদাত’ কাকে বলে? শুধু কি নামাজ-রোযা এগুলিই ইবাদাত? এই ব্যাপারগুলিও আমাদেরকে জানতে হবে।
মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বলতে কি বুঝায়? রসুল কাকে বলে? রসুলের দায়িত্ব কি ছিলো?
তিনি কি কিছু জ্ঞান প্রকাশ্য জানিয়ে, বাকীটুকু গোপন রাখতে পারেন?
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাস্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে, বিচার-ফায়সালার ক্ষেত্রে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো আইন-নিয়ম-শিক্ষা থেকে অন্য কোন মহাপুরুষ-বুদ্ধিজীবি-দার্শনিকের যেমনঃ এরিস্টেটল-প্লেটো-মাও-সেতুং-লেলিন-স্টেলিন-আব্রাহাম লিংকন কিংবা এ জাতীয় আরো অনেকের শিখানো আইন-নিয়ম-শিক্ষা-মতাদর্শ বা আইডিওলজিকে উত্তম মনে করলে, সেগুলির প্রচার-প্রসার বা প্রতিষ্ঠা-প্রয়োগ করলে, সেগুলি দিয়ে নিজ দেশ-সমাজ-পরিবারকে পরিচালিত করতে চাইলে কি নবীকে উত্তম আদর্শ মানা হয়? সে ক্ষেত্রে কি মুসলমান থাকা যায়?
ইবাদাতের ক্ষেত্রে নবীর সুন্নাতের বাইরে গিয়ে বিদয়াতে লিপ্ত হলে কিভাবে সেটা স্ববিরোধিতা হয়? এই ব্যাপারগুলিও আমাদেরকে জানতে হবে।
ইসলামের ২য় স্তম্ভ,নামাজের যেভাবে কিছু পূর্বশর্ত আছে, যেগুলির যেকোন একটি পালন না করলেও নামাজ আদায় হয়না, যেমনঃ ওযু করা কিংবা শরীর পবিত্র থাকা; সেভাবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর কোন পূর্বশর্ত কি আছে? সেগুলি কি কি?
ঠিক যেভাবে কোন কোন কাজ করলে ওযু নষ্ট হয়, নামাজ নষ্ট হয়, পুনরায় নতুনভাবে ওযু করতে হয়, নামাজ আদায় করতে হয়; সেভাবে কি কি কাজ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়(জ্বি, এটা হয়, যদি কোনো ক্ষেত্রে আপনি না জেনে থাকেন, সমস্যা নাই, এখন আপনি জানেন, আল্লাহ কবুল ও সহজ করুন)?
ঈমান নষ্টকারী কাজের মধ্যে বড় শিরক, বড় কুফর, বড় নিফাকী কি কি কাজে হয়?
কিভাবে আমাদের সমাজে মানুষ না জেনেই এসব কাজে জড়িত হচ্ছে?
এছাড়া রিদ্দা বা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণসমূহ আমাদেরকে জানতে হবে যাতে আমরা ইসলাম গ্রহন করার পর আবার কাফির-মুরতাদে পরিণত না হই।
এরকম যেসব জ্ঞানের উপর নির্ভর করে আমাদের মুসলমান থাকা কিংবা না থাকা – এসব জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক জ্ঞান। এই ব্যাপারগুলি আমাদেরকে সবচেয়ে আগে, সবচেয়ে গুরুত্ব সহকারে, সবচেয়ে বেশী সময় নিয়ে অধ্যয়ন করা উচিত, আলেমদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয়া ইসলামের প্রথম ফরজ, কারণ পরিষ্কার, এগুলা না জানলে আমরা কখন আমাদের জাহান্নামে যাওয়ার কনফারমেশন কনফারম করলাম তা নিজেও জানব না, আর আমাদের সারা জীবনে করা সালাত, সাওম, হালাল জীবিকা, পিতা-মাতা ও পরিবার-পরিজনের সাথে উত্তম ব্যাবহার সবই একটা রেসাল্টহীন আউটপুট দিবে।
এখন কোন আলেম সারা-জীবনে কখনো এসব মৌলিক ব্যাপারে আলোচনা না করে থাকলে, তাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ – কেন তিনি আমাদেরকে এসব গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান থেকে এতদিন দূরে রেখেছেন?
আমাদেরকে এসব বিষয় না জানিয়ে আমাদেরকে বিপদ-সীমায় ফেলে রেখেছেন?
B- সাময়িক সময়ের জন্যও জাহান্নামে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে, উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করার পর (এতক্ষণে আপনার কমনসেন্স আপনাকে সেগুলা জানার গুরুত্ব কত বেশি তা হয়ত বেশ ভালোভাবেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটা স্বাভাবিক, তাই যতদ্রুত সম্ভব সেগুলার ব্যাপারে আপনার যা জানার দরকার তা জেনে নিন আর বাস্তবায়ন করুন) আমাদেরকেঃ
(1) অন্যান্য সকল হারাম এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। যেমনঃ সুদ দেয়া নেয়া, সুদের লেখক হওয়া বা সাক্ষী হওয়া ইত্যাদি।
এখন এ রকম কবিরা গুনাহগুলো কি কি? – তা আমাদেরকে জানতে হবে? বাস্তবে কিভাবে মানুষ এসব গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে? তা জানতে হবে। যেমনঃ সুদের ক্ষেত্রে সুদ ভিত্তিক লোন নেয়া, লোন দেয়া, ফিক্সড ডিপোজিট রাখা, সুদ ভিত্তিক ব্যাংকে চাকুরী করা ইত্যাদি ব্যাপারসমূহ।
(2) সকল ফরজ-ওয়াজিবসমূহ পালন করতে হবে। তাই কি কি কাজ একজন মুসলিমের উপর ব্যক্তিগতভাবে ফরজ আর কি কি কাজ সামষ্টিকভাবে ফরজ, তা জানতে হবে। যেমনঃ ইলম অর্জন, নামাজ প্রতিষ্ঠা, যাকাত প্রদান, রোযা সাধনা, দাওয়াত, অন্যকে ও নিজেকে ইসলামের স্ট্যান্ডারডে সঠিক কাজের আদেশ আর ইসলামের স্ট্যান্ডার্ডে ভুল কাজে নিষেধ, জিহাদ কিংবা পারিবারিক-সামাজিক যে সব দায়িত্ব আমাদের উপর ফরজ ইত্যাদি।
তো এই পর্যায়ে কোন কোন বিষয়ে ইলম অর্জন ফরজ? তা হলোঃ
فإنه يجب على كل مسلم معرفة ما يحتاج إليه في دينه، كالطهارة، والصلاة، والصيام. ويجب على من له مال معرفة ما يجب عليه في ماله من زكاة ونفقة، وحج وجهاد. وكذلك يجب على كل من يبيع ويشتري أن يتعلم ما يحل ويحرم من البيوع (انظر رسالة ورثة الأنبياء،- شرح حديث أبي الدرداء للحافظ بن رجب، ضمن مجموع رسائله)
নিশ্চয়ই প্রত্যকে মুসলিমের উপর দ্বীনের ঐ সকল ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন ফরজ – যেগুলি তার প্রয়োজন। যেমনঃ পবিত্রতা, নামাজ, রোযা।
আর যার সম্পদ আছে তার জন্য ঐ জ্ঞান অর্জন ফরজ যা ঐ সম্পদের কারণে তার উপর দায়িত্ব বর্তায় যেমনঃ যাকাত, সদকা, হজ্জ্ব এবং জিহাদ।
এ কারণে যারা বেচা-কেনা করেন, তাদের জন্য ক্রয়-বিক্রয়ে হালাল-হারাম শিক্ষা করা ফরজ। … (দেখুন মাজমুউর রাসাইল, পৃঃ ২২-২৩, অধ্যায়ঃ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া, শারহু হাদিস আবি দারদা)
এসব ক্ষেত্রে কতটুকু ইলম অর্জন ফরজ, সে ব্যাপারে বিখ্যাত তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
“কোন ব্যক্তির সম্পদ না থাকলে তার উপর যাকাত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন ফরজ নয়। অতঃপর তিনি বলেন, যখন তার একশত দিরহাম হবে তখন তার জন্য এর হিসাব রাখা ফরজ যাতে যাকাতের হিসাব করতে পারে।” (দেখুন মাজমুউর রাসাইল, পৃঃ ২২-২৩, অধ্যায়ঃ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া, শারহু হাদিস আবি দারদা)
C- জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যেতে হলেঃ
উপরে উল্লেখিত উভয় বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করার পর – আমাদেরকে অন্যান্য নফল ইবাদাত সমূহ যেমনঃ কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, নফল রোযা, নফল নামাজসমূহ আদায়, দান-সদকা ইত্যাদি ব্যাপারে অনেক বেশী মনযোগী হতে হবে।
বাস্তবে দেখা যায়, আমরা সবাই “সাময়িক সময়ের জন্যও জাহান্নামে না যাওয়া” এবং “জান্নাতের উচ্চতর স্তরে যাওয়ার” জন্য প্রয়োজনীয় ইলম নিয়ে মহাব্যস্ত কিন্তু “চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া থেকে বাঁচার ইলম” নিয়ে কোন চিন্তা নেই।
পুরো ব্যাপারটি সাধারণ মুসলমানদের নিছক অবহেলা আর কারো কারো ইমামতি হারানোর ভয়, কারো সত্য গোপন করা এবং আরো অনেকের দুনিয়ার সম্পদের লোভ – ছাড়া আর কিছু না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই ভালো জানেন।
আর আমাদের এই দুরাবস্থাটা অবশ্যই আমাদেরই বদলাতে হবে, শুধু দরকার আল্লাহর সাথে সততা।