শায়খ আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসি
বুদ্ধিমান সেই যে তাঁর দুর্বলতা ঢেকে রাখে, যে সবর করতে জানে যখন তার লোকবল বা সাজ সরঞ্জামে ঘাটতি থাকে। নিঃশব্দে যে শত্রুর দূর্বলতা পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহন করে যাতে তার পরিকল্পনাগুলো সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকে এবং এতে সে শত্রুর জন্য মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারে।
অপরিপক্ব উত্তেজনা ও হুমকি কেবল শত্রুকে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে সতর্কই করে দেয়, যা তার শত্রুকে প্রস্তুতি গ্রহনের সুযোগ করে দেয়।
এর ফলে মুসলিমদের অবস্থা দাঁড়ায় ওই ব্যক্তির মত, যে সময় হবার আগেই তীর চালনা করে কিংবা তীর চালনার আগেই তার শিকারকে সতর্ক করে দেয়।
যে শত্রুকে অতিমাত্রায় হুমকি বা ভয় দেখায় সে আসলে তাঁর শত্রুকে অবমূল্যায়ন করল কারণ হুমকি বা ভয় দেখানোতে শত্রুর কোন ক্ষতি সাধিত হয় না। এবং এই ব্যাপারে প্রান্তিকতা পরিহার করতে না পারলে এগুলো শুধু শত্রুদের মধ্যে তার ভয় ও নিজের কথার মূল্য দুইই কমায়। কেউ যদি বুদ্ধিমানের মত কাজ করতে চায় তার উচিত শত্রুকে বুঝতে না দেয়া যে সে কৌশলী, তা না হলে শত্রু তাঁর বিরুদ্ধে সব সময় সতর্ক থাকবে ফলস্বরুপ সে শত্রুদের মধ্যে দূর্বলদেরই স্পর্শ করতে পারবে না, রাঘব বোয়ালের কথাতো বাদই।
যে যুদ্ধ দূর্বল বা শোষিতদের দ্বারা সংগঠিত হয় তা কখনো সংখ্যা বা সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে হয় না বরং তা হয় শত্রুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, তার উদাসীনতা ও বেখেলায়ীপনার সৎব্যবহার করে এবং সঠিক সময়ে বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে। কিন্তু কখনো কখনো এই বাস্তবতাগুলো মানুষ উপলব্ধি করে না এবং নিজের পেখম মেলে দিয়ে নিজের সত্যিকার শক্তি থেকে নিজেকে বড় করে জাহির করে। ফলে শত্রুরা তার প্রতি হাজার গুণ বেশি গুরুত্ব দেয় যা অন্যথায় তারা দিত না এবং তারা কেবলমাত্র দক্ষ প্রযুক্তির সাহায্যে পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ করার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং দুনিয়াব্যাপী তাদের সহযোগী ও দোসরদের সাহায্যও কামনা করে। তাদের ভয়কে লুকিয়ে রাখার জন্য তারা একে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে এবং শেষে তা সার্বজনীন রুপ লাভ করে।
যদি আমাদের এই বন্ধু বিচক্ষণ হত, তবে শত্রুর এহেন বাড়াবাড়িতে সে কখনোই খুশি হতে পারত না কারণ এটা খুবই শিশুসুলভ যে কেউ নিজের উপর আসন্ন নিপীড়ন দেখে আনন্দিত হচ্ছে।
একইভাবে এটা নির্বোধের কাজ যে সে তার ব্যাপারে শত্রুর প্রচার করা প্রপাগান্ডা যা তারা সারা বিশ্বের কাছে ফলাও করে প্রচার করেছে তার উপর ভিত্তি করে বসে থাকে এবং সারা দুনিয়ার সব শত্রুকে একসাথে তার বিরুদ্ধে জড়ো হতে দেয় যাতে তারা সঙ্গবদ্ধ হয়ে তাকে নির্মূল করতে পারে।
ফলশ্রুতিতে বেচারা তার কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে এবং প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়। শত্রুর মিথ্যা প্রচারনাকে সে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং শত্রুরা যেভাবে তার ব্যাপারে বর্ণনা করে, সে একই মোতাবেক বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়।
তখন সে কিছু আগুনঝরা বিবৃতি প্রদান করে এবং তার কার্যাবলীকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জিত করে যেন আল-কাকা ইবনু আমর রহঃ কিংবা কুতাইবাহ ইবনু মুসলিম রহঃ তার বাহিনী সমেত বাগদাদে অবস্থান করছেন, যার শেষভাগ চীনের প্রাচীর ছাড়িয়ে গেছে! কিন্তু মানুষ শোনা কথায় বিশ্বাসী না বরং চোখের দেখায় বিশ্বাসী এবং শেষপর্যন্ত সেখানে আগুন, ধোঁয়া, বিশৃঙ্খলা ও কালিঝুলি ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। এগুলো তার অনুসারীদেরও বিপদে ফেলে দেয় এবং তারা মনে করে যে, তারা একটি বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে আর সেভাবে অগ্রসর হয়।
কবি যেন তাদের উদ্দেশ্য করেই বলছেন,
“যখন ময়নাপাখির দল উড়ে যায়,
আমি তাদের বাজপাখি ভেবে ভুল করি”।
এরপর ধুলা মিলিয়ে গেলে আসল অবস্থা দৃষ্টিগোচর হয় যেভাবে বাচ্চারা সাবানের বুদবুদ ওড়ায় আর তা বাড়তে বাড়তে একসময় আকাশে ওঠে যায় কিন্তু সেগুলো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বরং নিমেষেই চুপসে যায়।
এই লোকরা যদি দাওয়াহ্ ও জিহাদের প্রতি সম্মান রাখত, তাহলে তারা চুপ থাকত। বরং তারা এই নীরবতা থেকে সুবিধা গ্রহণ করত এবং একে কাজে লাগিয়ে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তৎপর হত।
একজন নেতার মান মর্যাদা ও আস্থার প্রতীক হচ্ছে, সে এমন হুমকি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে যা কখনোই বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাই সে কখনো হুমকি প্রদান করলে, সাবানের বুদবুদের ন্যায় মেকি হয় না।
এটা বিজয় ও সফলতার নিদর্শন যে, সে নিজেকে প্রকৃত অবস্থার চেয়ে বড় হিসেবে জাহির করে না। যদি কেউ তার কাজের ব্যাপারে আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হয় তাহলে সে তার সক্ষমতাকে আড়াল করে এবং এমনভাবে নিজেকে তুলে ধরে যেন সে কিছুই না।
ফলে শত্রুরা তার ব্যাপারে উদাসীন হয়, তার ক্ষমতাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং তার আক্রমণের জন্য অপ্রস্তুত থাকে। বলা হয় যে, “কারো শত্রু যদি তার ব্যাপারে গাফেল থাকে তবে সে তাদের ধোঁকা দিবে, আর যে ধোকায় পতিত হয় সে কখনই নিরাপদ থাকে না।
যখন সে তার শত্রুকে ধরে সে এমনভাবে ধরে যেভাবে শিকারী জন্তু তার শিকারকে ধরে”।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বদর যুদ্ধের আগের অবস্থাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন,
وَيُقَلِّلُكُمْ فِي أَعْيُنِهِمْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا
“এবং তিনি তোমাদেরকে তাদের দৃষ্টিতে স্বল্প-সংখ্যক দেখিয়েছিলেন, যাতে যা ঘটার ছিল তা তিনি সম্পন্ন করেন”। {সুরা আনফাল, ৮ : ৪৪}
বদর যুদ্ধ শুরুর পূর্বে আবু জাহেল মুসলিমদের লক্ষ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “তাদেরকে (সংখ্যায়) [উটের জাবের] মত মনে হচ্ছে। কাজেই তাদেরকে ভীষণভাবে আক্রমণ করবে এবং দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধবে”।
যখন যুদ্ধের ময়দানে দুই সৈন্যদল পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়াল, মুসলিম বাহিনী তাদের শক্তিসামর্থ্য ও দৃঢ়তার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটাল; শত্রুদের চোখে তারা প্রবল এবং সংখ্যায় প্রচুর হয়ে দেখা দিল।
[উটের জাব- উটের শুষ্ক খড় বা ঘাস জাতীয় খাবার এই উদাহরণ আরব রীতি থেকে এসেছে এর মানে সংখ্যায় কম]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
يَرَوْنَهُمْ مِثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ ۚ
“তারা অবিশ্বাসীরা ওদেরকে বিশ্বাসীদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল”। {সুরা আল-ইমরান, ৩ : ১৩}
হে আল্লাহ্! আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান কর ও বাস্তবতা নিরীক্ষণের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান কর এবং আমাদের শত্রুদের ধ্বংস কর।
—
আত তিবইয়ান পাবলিকেশন “জিহাদের ফসলসমূহ” থেকে অনুদিত।
পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করুন –
https://archive.org/details/olposonkhok
http://www.mediafire.com/file/4kl271amyvk2m9s/olposonkhok.pdf
https://archive.org/download/olposonkhok/olposonkhok.pdf