জুলুম!

হাকিমুল উম্মাহ শায়খ আইমান

আজ আমি একটি উপদেশ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যে উপদেশটি আমি প্রথমে নিজেকে, তারপর আমার সকল মুসলিম ও মুজাহিদ ভাইদেরকে করতে চাই। তা হলো: আমি নিজেকে ও তাদেরকে জুলুমের ব্যাপারে সতর্ক করছি।

এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-

 

وَإِذِ ابْتَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ ﴿البقرة: ١٢٤﴾ 

“যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি বললেন আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না”।(সূরা বাকারাহ-১২৪)

এই মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা আরো ইরশাদ করেছেন-

وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ﴿آلعمران: ٥٧﴾ 

“আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না”। (সূরা আলে ‘ইমরান-৫৭)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরো ইরশাদ করেছেন-

 

وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ﴿الشورى: ٤٠﴾

“আর মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। যে ক্ষমা করে ও আপোষ করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে; নিশ্চয় তিনি অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না”।(সূরা শুরা-৪০)

এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা জুলুমের কথা স্বীকার করত: তা থেকে তাওবা করাকে নাজাতের কারণ সাব্যস্ত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও তার স্ত্রীর ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন-

 

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ ﴿الأعراف: ٢٣﴾

“তারা উভয়ে বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব”।(সূরা আ‘রাফ-২৩)

অনুরূপ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

 

قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ﴿القصص: ١٦﴾

“তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু”।(সূরা কাসাস-১৬)

 

তদ্রুপ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইউনুস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-

 

وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَىٰ فِي الظُّلُمَاتِ أَن لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ﴿الأنبياء: ٨٧﴾

“এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন! তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেনঃ তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ, আমি গুনাহগার”।(সূরা আম্বিয়া-৮৭)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অন্য আয়াতে জান্নাতবাসীদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন-

 

قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ ﴿القلم: ٢٨﴾ قَالُوا سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ ﴿القلم: ٢٩﴾ فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ يَتَلَاوَمُونَ ﴿القلم: ٣٠﴾ قَالُوا يَا وَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا طَاغِينَ ﴿القلم: ٣١﴾ عَسَىٰ رَبُّنَا أَن يُبْدِلَنَا خَيْرًا مِّنْهَا إِنَّا إِلَىٰ رَبِّنَا رَاغِبُونَ ﴿القلم: ٣٢﴾

“তাদের উত্তম ব্যক্তি বললঃ আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? এখনও তোমরা আল্লাহ তা’আলার পবিত্রতা বর্ণনা করছো না কেন? তারা বললঃ আমরা আমাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, নিশ্চিতই আমরা সীমালংঘনকারী ছিলাম। অতঃপর তারা একে অপরকে ভৎর্সনা করতে লাগল। তারা বললঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের আমরা ছিলাম সীমাতিক্রমকারী। সম্ভবতঃ আমাদের পালনকর্তা পরিবর্তে এর চাইতে উত্তম বাগান আমাদেরকে দিবেন। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে আশাবাদী”।(সূরা কালাম:২৮-৩২)

এবার আসুন! এ মর্মে পবিত্র হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন, তা অবলোকন করি।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَمَلَهُمْ عَلَى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ ».[صحيح مسلم ٢٥٧٨]

হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার হবে। (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণে জালিমরা পথ চলতে পারবে না।) এমনিভাবে তোমরা কৃপণতা থেকেও বেঁচে থাকো। কেননা, কৃপণতার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে। আর এ কৃপণতাই তাদেরকে লোকদের হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং এজন্যই তারা হারামকে হালাল করেছে।”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৭৮)

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন-

فَوَاللَّهِ لَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ وَلَكِنْ أَخَشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمْ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ[صحيح البخاري ٣١٥٨].

“আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্রের আশঙ্কা করি না। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের ‍উপর দুনিয়া এরূপ প্রসারিত হয়ে পড়বে, যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩১৫৮)

এমনিভাবে আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ. [صحيح البخاري ٢٤٤٨ ].

হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হযরত মু‘আয (রাযি.)-কে ইয়ামানে পাঠান, তখন তাকে বলেছেন: “মাজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তা‘আলার মাঝে কোন পর্দা থাকে না।”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২৪৪৮)

অনুরূপভাবে অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন-

عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ قَالَ ثُمَّ قَرَأَ { وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ[هود:102] }[صحيح البخاري ٤٦٨٦ ]

[হযরত আবূ মূসা আশ‘আরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তা‘আলা জালিমদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন, তখন আর ছাড়েন না। (বর্ণনাকারী বলেন) এরপর তিনি(নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আয়াত পাঠ করেন-

“আর তোমার পরওয়ারদেগার যখন কোন পাপপূর্ণ জনপদকে ধরেন, তখন এমনিভাবেই ধরে থাকেন। নিশ্চয় তাঁর পাকড়াও খুবই মারাত্নক, বড়ই কঠোর।” (সূরা হুদ-১০২)]

(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৬৮৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন-

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا خَلَصَ الْمُؤْمِنُونَ مِنْ النَّارِ حُبِسُوا بِقَنْطَرَةٍ بَيْنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ فَيَتَقَاصُّونَ مَظَالِمَ كَانَتْ بَيْنَهُمْ فِي الدُّنْيَا حَتَّى إِذَا نُقُّوا وَهُذِّبُوا أُذِنَ لَهُمْ بِدُخُولِ الْجَنَّةِ. [صحيح البخاري ٢٤٤٠]

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “মুমিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের উপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ও অন্যায় ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে”।(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২৪৪০)

অনুরূপভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে কুদসীতে বলেছেন-

عَنْ أَبِى ذَرٍّ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فِيمَا رَوَى عَنِ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَّهُ قَالَ « يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا. [صحيح مسلم ٢٥٧٧]

হযরত আবূ যার খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ তা‘আলা থেকে বর্ণনা করেছেন:“আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: হে আমার বান্দাগণ, আমি নিজের উপর জুলুম করাকে হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও এ কাজটিকে হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবে না।”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৭৭)

 

অন্য হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-

قَالَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ} مَا مِنْ أَمِيرِ عَشَرَةٍ إِلَّا يُؤْتَى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَغْلُولًا لَا يَفُكُّهُ إِلَّا الْعَدْلُ أَوْ يُوبِقُهُ الْجَوْرُ.{ [تخريج المسند ٩٥٧٣].

“কিয়ামতের দিন মাত্র দশজন লোকের আমিরকেও শৃংখলিত অবস্থায় উপস্থিত করা হবে। তখন ইনসাফ ব্যতিত অন্য কোন কিছু তাকে (শাস্তি থেকে) বিরত রাখতে পারবে না, নতুবা জুলুম তাকে ধ্বংস করে ছাড়বে”।(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৯৫৭৩)

শরীয়ত প্রণেতা আমাদেরকে জুলুম দূরকরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-

وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنتَصِرُونَ ﴿الشورى: ٣٩﴾ وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ﴿الشورى: ٤٠﴾ وَلَمَنِ انتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهِ فَأُولَٰئِكَ مَا عَلَيْهِم مِّن سَبِيلٍ ﴿الشورى: ٤١﴾ إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَظْلِمُونَ النَّاسَ وَيَبْغُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿الشورى: ٤٢﴾ وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ﴿الشورى: ٤٣﴾

“যারা আক্রান্ত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। আর মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। যে ক্ষমা করে ও আপোষ করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে; নিশ্চয় তিনি অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন নাই। নিশ্চয় যে অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে, তাদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। অবশ্যই যে সবর করে ও ক্ষমা করে নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।” (সূরা শুরা: ৩৯-৪৩)

অনুরূপভাবে এ ব্যাপারে নবীজি সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে বলেছেন-

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا،قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَذَا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا فَكَيْفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا قَالَ تَأْخُذُ فَوْقَ يَدَيْهِ. [صحيح البخاري: 2444].

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক বা মাজলুম। তিনি (আনাস (রাযি.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালিমকে কি করে সাহায্য করব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে।” (অর্থাৎ তাকে জুলুম করতে দিবে না।) (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২৪৪৪)

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন-

عَنْ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ أَمَرَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِسَبْعٍ وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ أَمَرَنَا بِاتِّبَاعِ الْجَنَائِزِ وَعِيَادَةِ الْمَرِيضِ وَإِجَابَةِ الدَّاعِي وَنَصْرِ الْمَظْلُومِ وَإِبْرَارِ الْقَسَمِ وَرَدِّ السَّلَامِ وَتَشْمِيتِ الْعَاطِسِ وَنَهَانَا عَنْ آنِيَةِ الْفِضَّةِ وَخَاتَمِ الذَّهَبِ وَالْحَرِيرِ وَالدِّيبَاجِ وَالْقَسِّيِّ وَالْإِسْتَبْرَقِ. [صحيح البخاري ١٢٣٩]

হযরত বারাআ ইবনে আযিব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি বিষয়ে আমাদের আদেশ করেছেন এবং সাতটি বিষয়ে আমাদের নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদের আদেশ করেছেন-১.জানাযার অনুগমন করতে,২. অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নিতে, ৩. দাওয়াত দাতার দাওয়াত কবুল করতে, ৪. মাজলুমকে সাহায্য করতে, ৫. কসম থেকে দায়মুক্ত করতে, ৬. সালামের জওয়াব দিতে এবং ৭. হাঁচিদাতাকে (ইয়ারহামুকাল্লাহু বলে) খুশী করতে। আর তিনি নিষেধ করেছেন- ১. রূপার পাত্র, ২. সোনার আংটি, ৩. রেশম, ৪. দীবাজ, ৫. কাসসী (কেস রেশম), ৬. ইসতিবরাক (তসর জাতীয় রেশম) ব্যবহার করতে।”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১২৩৯)

আর জিহাদ কোন জালিমকে, তার জুলুমের পরিণতি (ভোগ করা থেকে) বিরত রাখতে পারবে না। কেননা, তার জিহাদ তো মূলত: কবুল-ই হয় নাই।

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنَّهُ قَالَ : « الْغَزْوُ غَزْوَانِ فَأَمَّا مَنِ ابْتَغَى وَجْهَ اللَّهِ وَأَطَاعَ الإِمَامَ وَأَنْفَقَ الْكَرِيمَةَ وَيَاسَرَ الشَّرِيكَ وَاجْتَنَبَ الْفَسَادَ فَإِنَّ نَوْمَهُ وَنَبْهَهُ أَجْرٌ كُلُّهُ وَأَمَّا مَنْ غَزَا فَخْرًا وَرِيَاءً وَسُمْعَةً وَعَصَى الإِمَامَ وَأَفْسَدَ فِى الأَرْضِ فَإِنَّهُ لَمْ يَرْجِعْ بِالْكَفَافِ ».[أبو داود:٢٥١٥].

হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যুদ্ধ দুই প্রকার। ১. যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করে এবং ইমামের অনুগত থাকে, নিজের উৎকৃষ্ট সম্পদ যুদ্ধে ব্যয় করে, সঙ্গীকে সহায়তা করে, ঝগড়া ফাসাদ ও অপকর্ম হতে বেঁচে থাকে। তার নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থায় সব কিছুই পুণ্যে পরিণত হয়। ২. যে গর্বভরে লোক দেখানো ও সুনামের জন্য যুদ্ধ করে এবং ইমামের (নেতার) অবাধ্য থাকে ও পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করে, সে সামান্য কিছু পুণ্য নিয়েও বাড়ি ফিরে না।”(সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং-২৫১৫)

এমনিভাবে জিহাদ হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত গোনাহকেও দূরীভূত করতে পারবে না।

এ মর্মে হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

 

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ كَانَ عَلَى ثَقَلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ كِرْكِرَةُ فَمَاتَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ فِي النَّارِ فَذَهَبُوا يَنْظُرُونَ إِلَيْهِ فَوَجَدُوا عَبَاءَةً قَدْ غَلَّهَا. [صحيح البخاري ٣٠٧٤ ]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাহারা দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তি নিযুক্ত ছিল। তাকে কারকারা নামে ডাকা হত। সে মারা গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী! লোকেরা তার অবস্থা দেখতে গেল, অতঃপর তারা একটি আবা (ঢিলাঢালা জুব্বা বিশেষ) পেল, যা সে আত্মসাত করেছিল।”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩০৭৪)

 

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন-

عَنْ أَبِى قَتَادَةَ أَنَّهُ سَمِعَهُ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنَّهُ قَامَ فِيهِمْ فَذَكَرَ لَهُمْ « أَنَّ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَالإِيمَانَ بِاللَّهِ أَفْضَلُ الأَعْمَالِ ». فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ تُكَفَّرُ عَنِّى خَطَايَاىَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « نَعَمْ إِنْ قُتِلْتَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ ». ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « كَيْفَ قُلْتَ ». قَالَ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ أَتُكَفَّرُ عَنِّى خَطَايَاىَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « نَعَمْ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ إِلاَّ الدَّيْنَ فَإِنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ قَالَ لِى ذَلِكَ ».[صحيح مسلم ١٨٨٥]

হযরত আবু কাতাদাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের (সাহাবীদের) মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করা সবচেয়ে উত্তম কাজ। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি মনে করেন, যদি আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হই, তাতে কি আমার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: হ্যাঁ, তুমি যদি আল্লাহর রাস্তায় ধৈর্যধারণ কর, সওয়াবের আশা রাখ, পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে অবিচল থাকো, অগ্রগামী হয়ে যুদ্ধ করে নিহত হও ( তাহলে তোমার সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: তুমি কি কথা বলেছিলে? সে বলল, যদি আমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে নিহত হই, তাহলে কি আমার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হ্যাঁ, তুমি যদি অবিচল থেকে, সওয়াবের আশায়, অগ্রগামী হয়ে, পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে (যুদ্ধ করে) নিহত হও। (তাহলে তোমার সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে) কিন্তু ঋণ মার্জনা হবে না, কেননা, জিবরাইল আলাইহিস সালাম (এই মাত্র) আমাকে এ কথাটি বলে গেছেন।”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৮৫)

ইমাম নববী রহ. বলেন- আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি “কিন্তু ঋণ মার্জনা হবে না” এই বাণীর মাঝে সকল মানুষের সব ধরনের হকের ব্যাপারে সতর্কীকরণ করা রয়েছে। এমনিভাবে জিহাদ, শাহাদাত ও অন্যান্য নেক আমলসমূহ মানুষের হকের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহকে দূরীভূত করতে পারবে না। বরং এ সমস্ত আমল শুধুমাত্র আল্লাহর হকের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহকে দূরীভূত করতে পারবে।

সাইয়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালিব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- (আরবি কবিতার অর্থ)-

তোমার ক্ষমতা থাকলেই কারো উপর কখনো জুলুম করো না,

কেননা, জুলুমের শেষ পরিণতি অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু না।

তোমার চোখ নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে, কিন্তু মাজলুমের চোখ থাকে জাগ্রত,

সে তোমার নামে যার কাছে নালিশ করে, সেই আল্লাহও থাকেন সদা জাগ্রত।  

হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. তাঁর জনৈক কর্মকর্তার নামে প্রেরিত একটি চিঠিতে লিখেন যে, “হামদ ও সালাতের পর- যখন তোমার ক্ষমতা তোমাকে মানুষের উপর জুলুম করতে প্ররোচিত করবে, তখন তুমি তোমার উপর আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতার কথা স্মরণ করবে। এমনিভাবে আরো স্মরণ করবে যে, মানুষের উপর (তোমার পক্ষ থেকে) যা (জুলুম) আসবে, তা তো অচিরেই ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু তোমার উপর যা (জুলুমের যে পরিণতি) আসবে, তা তো বিদ্যমান থাকবে।”

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন- এ কারণেই বর্ণনা করা হয় যে, “আল্লাহ তা’আলা ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন, যদিও তা কাফের রাষ্ট্র হয়। কিন্তু তিনি জালিম রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন না, যদিও তা মুসলিম রাষ্ট্র হোক না কেন।”

আল্লাহর নিকট সকাতর প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে জুলুম থেকে দূরে রাখেন এবং জালিমদের অনিষ্টতা থেকে তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। (আল্লাহুম্মা আমীন)

وآخر دعوانا أن الحمد له رب العالمين، وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه وسلم.

(Visited 257 times, 1 visits today)