আল্লাহ ও তাঁর রসূলের (সা) দিকে ফিরে আসা।

শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি

ডাউনলোড

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

{فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا}

অর্থ: কোন বিষয়ে তোমাদের মাঝে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস কর। এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা – ৫৯)

যদি তোমরা আল্লাহ তা’আলা এবং পরকালকে বিশ্বাস কর, তাহলে যে সমস্ত বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য হয় তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর।

এটি ইমানেরই একটি শর্ত এবং দলিল। যখন তোমাদের মাঝে ঝগড়া সৃষ্টি হবে তখন আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে, অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন –

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ

অর্থ: তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে সোপর্দ। (সূরা আশ-শুরা – ১০)

হুকমুহু ইলাল্লাহ অর্থাৎ ওহী বা কুরআন ও সুন্নাহ।

উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল-আ’দম বলেন – হে জিহাদ থেকে পলায়নকারী! জেনে রাখ – তুমি তোমার রবের সন্তুষ্টির আশা করছ। নিশ্চয়ই মতভেদ-পূর্ণ বিষয় আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে ন্যস্ত করা ইমানের অপরিহার্য একটি বিষয়। এটা তাওহীদের দাবী ও ঈমানের নিদর্শন। এর বিপরীত হল কুফরি, নিফাকী ও পথভ্রষ্টতা।

তিনি আরও বলেন, মানুষের মাঝে আল্লাহ এবং তার রসূলের আদেশের সবচেয়ে বেশি হকদার হল মুজাহিদগণ। যারা আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছে লোকদেরকে দ্বীনের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য, তাদের মাঝে আল্লাহর স্বীকৃত শরিয়ত বাস্তবায়ন করার জন্য। তারা আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছে ঐ সমস্ত জাহেলী নিয়মাবলী মিটানোর জন্য যেগুলো শয়তানের দোসররা বানিয়েছে। যাতে তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের ব্যাপারে দায়িত্ববান ফয়সালাকারী হতে পারে।

সুতরাং মুজাহিদগণ আল্লাহর রাহে জিহাদের জন্য বের হন ঐ সমস্ত হক্ব উদ্ধার করার জন্য, যা কিছু মুতাআল্লিহুন(কু-প্রবৃত্তির অনুসারী) মানুষ ছিনিয়ে নিয়েছে। অথচ এর প্রকৃত হক্বদার একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই। মুজাহিদগণের আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া এই জন্য যাতে আল্লাহর একত্ববাদী বান্দাগণ তাকে সন্তুষ্ট-কারী হুকুম বাস্তবায়ন করতে পারে।

অতএব মুজাহিদীন এবং সকল মুমিনদের জন্য আবশ্যক হল, কোন বিতর্ক কিংবা মতভেদ-পূর্ণ বিষয় সামনে আসলে তা আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া। বান্দার জন্য আবশ্যক হল, সে যেন নিজ প্রবৃত্তি ও তার অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকে। যদি তার কর্তৃত্ব থাকে তবে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ দ্বারা বিচার

করার চেষ্টা করবে। আর যদি তার কর্তৃত্ব না থাকে তাহলে তো এটা তার জন্য অনেক কঠিন ও জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও সে অনুযায়ী ফয়সালা না করা, এটা মুনাফিকেরই বৈশিষ্ট্য। যদি তার

কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সে আল্লাহর হুকুমের দিকে প্রত্যাবর্তন করার চেষ্টা করবে। আর যদি কর্তৃত্ব না থাকে, তবে সেটা ভিন্ন কথা…. !

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

وَيِقُولُونَ آمَنّا بِاللّهِ وَبِالرّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمّ يَتَوَلّىَ فَرِيقٌ مّنْهُمْ مّن بَعْدِ ذَلِكَ وَمَآ أُوْلَـَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ * وَإِذَا دُعُوَاْ إِلَى اللّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مّنْهُمْ مّعْرِضُونَ * وَإِن يَكُنْ لّهُمُ الْحَقّ يَأْتُوَاْ إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ

অর্থ: তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনলাম এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করলাম” কিন্তু তার পর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়; বস্তুত তারা মুমিন নয়। এবং যখন তাদেরকে আহ্বান করা হয় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর যদি তাদের কোন প্রাপ্য থাকে তাহলে তারা বিনীতভাবে রসূলের নিকট ছুটে আসে। (সূরা নূর – ৪৭-৪৯)

যদি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাদের কোন হক্ব বা পাওনা থাকে, তখন তারা বিনীতভাবে দৌড়ে আসে। আবার যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোন পাওনা থাকেনা তখন কেন বিনীতভাবে আসেনা? কেন তাদের এই পরিবর্তন? তাদের বিপক্ষে যাবে এই জন্য……?

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

أَفِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ

অর্থ: তাদের অন্তরে কি ব্যাধি রয়েছে? (সূরা নুর ২৪ : ৫০ )

কুরআনে مرض বা রোগ দ্বারা উদ্দেশ্য হল অন্তরের রোগ। কখনো ব্যাধি দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে কু-প্রবৃত্তি।

فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ

অর্থ: ফলে যার অন্তরে ব্যাধি (কু-প্রবৃত্তি) রয়েছে, সে প্রলুব্ধ হয়। (সূরা আহ-যাব ৩৩ : ৩২)

এই আয়াতে مرض বা রোগ দ্বারা কু-প্রবৃত্তি উদ্দেশ্য। আবার কখনো এই مرض বা রোগ দ্বারা সন্দেহের ব্যাধিও উদ্দেশ্য হয়। আবার কখনো এর দ্বারা নেফাকের ব্যাধিও উদ্দেশ্য হয়। এখানে ব্যাধি দ্বারা নেফাকের ব্যাধিই উদ্দেশ্য। বাকি আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন।

তাই তো আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

أَفِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا

অর্থ: তাদের অন্তরে কি নেফাকের ব্যাধি রয়েছে নাকি তারা সন্দেহ করে। (সূরা নুর ২৪ : ৫০)

তারা দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ করে। যারা এ ধরণের সন্দেহ করে তাদের মাঝে কি নেফাক রয়েছ? নাকি দ্বীনের ব্যাপারেই তাদের সন্দেহ রয়েছে?

أَمْ يَخَافُونَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُ

অর্থ: তারা কি ভয় করে যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল তাদের উপর জুলুম করবেন? (সূরা নুর ২৪ : ৫০)

এসকল বিষয় কুফরি যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এগুলো নেফাক, শিরক ও আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কু-ধারণা পোষণ করা।

أَفِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا أَمْ يَخَافُونَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُ بَلْ أُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ * إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ * وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ

অর্থ: তাদের অন্তরে কি নেফাকের ব্যাধি রয়েছে? নাকি তারা সন্দেহ করে। তারা কি ভয় করে যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল তাদের উপর জুলুম করবেন? বরং তারাই যালিম। মুমিনদের উক্তি তো এই যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ এবং তার রসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তারা বলে আমরা শ্রবণ করলাম ও আনুগত্য করলাম। আর এরাই তো সফলকাম। যারা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। (সূরা নূর ৫০-৫২)

আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের সুন্নাহ হল ফয়সালা-কারী। কিন্তু কীভাবে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাহ ফয়সালা করবে? এজন্য অবশ্যই বিচারক প্রয়োজন আর তারা হলেন “আলেমগণ”। সুতরাং উলামাদের সম্মান করা, তাদের মর্যাদা সম্পর্কে জানা এবং তারা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর আলোকে যা বলেন তা গ্রহণ করা একান্ত কাম্য।

উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল-আ’দম বলেন: এ অধ্যায় থেকে যা বুঝা যায় তা হল – উলামাদের অনুসরণ করা ওয়াজিব। বরং তা মুসলিমদের জন্য তাদের পিতা-মাতার আনুগত্য থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পিতা মাতার আনুগত্য করা ওয়াজিব, উলামাদের আনুগত্য করাও ওয়াজিব। যেমনটি ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. বলেছেন। ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. এভাবে বলেন যে, “নিশ্চয়ই উলামাদের আনুগত্য করা পিতা মাতার আনুগত্যের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ”। আল্লাহ তায়ালার বানী –

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

হে ইমান-দারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলুল আমর তাদেরও আনুগত্য কর। (সূরা নিসা ৪:৫৯)

অধিকাংশ আহলে ইলমের মতে এখানে “উলুল আমর” দ্বারা “উলামা ও ফুকাহা”দের উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, মুজাহিদ, আত্বা, হাসান বসরী, আবু ইয়ালা রহ. এমনটাই বলেছেন। তাছাড়া ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম মালিক এবং ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. এর কথাও এটাই।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন: আল্লাহ তা’আলা আদেশ করেছেন যে, কোন বিষয়ে মতানৈক্য হলে, সে বিষয়ে আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করার জন্য। আর নিষ্পাপ (রসূল) তো সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলেন না। যে এটা বিশ্বাস করে যে, রসূল সত্য বলেছেন তার জন্য আবশ্যক হল মতভেদের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনুগত্য করা। বাস্তব সত্য হল – এখানে কোন প্রবঞ্চনা নেই। এটা আল্লাহ তা’আলার কালাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম। এতে কোন প্রবঞ্চনা নেই, পক্ষপাতিত্ব নেই এবং কৃত্রিমতা নেই, বরং তাতে রয়েছে ইনসাফ।

সুতরাং আমাদের নিকট যখন আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের কথা আসবে অথবা আল্লাহ ও তার রসূলের কোন হুকুম আসবে তখন তা আমাদের উপর মানা, তার সামনে আত্মসমর্পণ করা এবং নিজেকে নিবেদন করা আবশ্যক। আর এটা ঈমানেরও শর্ত যে, কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে ইমানদারদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আমাদেরকে তার আনুগত্য করার তাওফিক দান করেন। আমীন।

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

(Visited 206 times, 1 visits today)