শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি
ডাউনলোড
আল্লাহ তা’আলা (তার দ্বীন রক্ষার জন্য) দ্বীনের মধ্যে দুটি মাধ্যম স্থির করেছেন,
প্রথম মাধ্যম হল- তথ্য আদান-প্রদানে যত্নবান হওয়ার বিষয়টি। আল্লাহ তা’আলা তথ্য আদান-প্রদানে যত্নবান হওয়ার বিষয়ে কিছু নিয়ম স্থির করেছেন।
কোন জিনিস গুজব ছড়ায়? কোন জিনিস প্রোপাগান্ডা ছড়ায়? যবান, লোকজন এবং ব্যক্তি নিজেই কি?
আল্লাহ তা’আলা এ বিষয়ে একটি নিয়ম স্থির করেছেন – যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হাদিসে বলেছেন। হাদিসটি আবু দাউদ শরীফে এসেছে। তা হল,
بئس مطية الرجل زعموا”
“ব্যক্তির নিকৃষ্ট বাহন হল তার ধারণা নির্ভর কথা”।
অর্থাৎ তুমি কোন সংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত বা সুদৃঢ় না হয়ে তা প্রচার করো না। সাধারণত মানুষজন একটি বিষয়ে ধারণা করে যে, বিষয়টি এভাবে ঘটে থাকতে পারে। তারপর বলে – এমনটিই ঘটেছে। আর এটাই ব্যক্তির সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাহন যা ব্যক্তি প্রথমে গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে প্রচার করে।
সুতরাং প্রথম নীতি হল- তথ্য আদান-প্রদানে দৃঢ়তা অবলম্বন করা। ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কোন সংবাদ প্রচার করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার সংবাদটি সঠিক হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়তা অর্জন করতে না পারো। সংবাদটির বিষয়ে কোন সন্দেহ-সংশয় আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। সংবাদ সম্পর্কে অবগত না হয়ে প্রচার করা যাবে না। আর নিজেকে মানুষের মাঝে মিথ্যা প্রচলনের মাধ্যম বানানো যাবে না। এই হল প্রথম বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয় (বা নীতি) হল- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – “বলা হয়েছে” এবং “বলেছেন” -এমন কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
অনর্থক বিষয়ে বেশি কথা বলা এবং যে কথাটি সঠিক হওয়াটা সুনিশ্চিত নয় এমন বিষয়ে- “বলা হয়েছে” এবং “অমুক এমন বলেছে” – এ জাতীয় কথা বলা নিষেধ। কোন সংবাদ ও কথা যা সঠিক হওয়াটা সুনিশ্চিত নয় তা বেশি পরিমাণে বলা মাকরুহ। অনির্ভরযোগ্য তথ্য ও সংবাদ বর্ণনা খোদ বর্ণনাকারীকেই দোষী সাব্যস্ত করে।
তা ছাড়া সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
كفى بالمرأ كذبا أن يحدث بكل ماسمع
“কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়”।
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি অন্যের থেকে যে তথ্যই জানতে পায়- অতঃপর (যাচাই বাছাই ছাড়া) তাই যদি বলে বেড়ায়, তাহলে তার কথায় যথেষ্ট পরিমাণ মিথ্যা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সে যা বর্ণনা করেছে তাতে সে সত্যবাদী এবং যেভাবে সে সংবাদ শুনেছে ঠিক সেভাবেই প্রচার করে থাকে। তারপরও সে মানুষের সামনে তা প্রচার করার সম্ভাবনা থাকে যাতে অধিক হারে মিথ্যা থাকে। হাদিসে তাই বলা হয়েছে:
كفى بالمرأ كذبا أن يحدث بكل ماسمع
“কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলতে থাকে”।
মানুষ বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে থাকে। তার সে তথ্যের উৎস হতে পারে – ইলেকট্রিক মিডিয়া, মানুষ বা প্রিন্ট মিডিয়া। এ ছাড়া আরো যত উৎস আছে এমন বহু উৎস থেকেও তথ্য সরবরাহ করে থাকে।
যখন সে এ সব উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রচার করতে থাকে, স্বভাবতই তাতে অনেক মিথ্যা থাকে। যখন সে এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করে প্রচার করছে, তখন সে স্বীকার করুক বা না করুক, সে- মিথ্যাকেই প্রচার করছে। কারো জন্য অন্যের তথ্য প্রচারের মাধ্যম অথবা মুখপাত্র হওয়া অনুচিত। অনেকে অন্যের মুখপাত্র হয়ে কাজ করে অথচ সে জানেও না যে, সে অন্যের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে। সে না জেনেই এমন বিষয় প্রচার করতে থাকে যার দ্বারা সে মিথ্যা সংবাদের উৎসে পরিণত হয়। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
كفى بالمرأ كذبا أن يحدث بكل ماسمع
কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইমাম নববী রহ. তার মুসলিম শরীফ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, এ অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট যত হাদিস ও আছার আছে সবগুলোতে – মানুষ যা শুনে তাই বলার ব্যাপারে ধমকি এসেছে। কারণ স্বভাবতই সে সত্য-মিথ্যা সবই শুনে থাকে। সুতরাং যদি সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়, তাহলে তো সে এমন সংবাদ প্রদানের ক্ষেত্রেও মিথ্যা বলল, যা মূলত সংঘটিতই হয়নি।
তারপর তিনি বলেন, ইতিপূর্বেই এ বিষয়টি আলোচনা হয়েছে যে, সত্যপন্থীদের মাযহাব হল – ‘কোন বিষয়ে বাস্তব বিরোধী সংবাদ দেয়াকে’ মিথ্যা বলা হয়। এতে ইচ্ছা শর্ত নয়। তবে ইচ্ছাটা গুনাহ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য শর্ত(আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন)। এই হল ইমাম নববী রহ. এর কথা।
এটাই (যাচাই বাছায় না করে সত্য-মিথ্যা যে কোন) তথ্য প্রচার বন্ধ করার প্রথম উৎস বা প্রথম অসিলা ও মাধ্যম। তাই সংবাদ গ্রহণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা আবশ্যক।
দ্বিতীয় মাধ্যম হল: যে কোন বিষয়কে সে বিষয়ের পারদর্শী ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করা। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. বলেন, “তুমি নিজেকে সংশোধন কর, জবানকে হেফাজত কর এবং তুমি তোমার ও তোমার রবের মাঝের সম্পর্ককে সংশোধন কর। হতে পারে তুমি যা দেখছো তা সত্য নয়। বরং এক্ষেত্রে এমন বিদ্যাও থাকতে পারে যা তোমাদের জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয় আবশ্যক এমন ব্যক্তিদের থেকে, যারা এবিষয়ে পারদর্শী। আর যুদ্ধের ময়দানে (যেমন আমরা বলে থাকি)-গুজব খুব বেশিই রটে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وَإِذَا جَاءهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُواْ بِهِ
“আর যখন তাদের কাছে কোন সংবাদ পৌঁছে – শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়”। [সূরা নিসা ৪:৮৩]
অর্থাৎ, তাদের কাছে যখন কোন সংবাদ আসে তা শান্তির হোক বা ভীতির, তারা তা (যাচাই না করে) প্রচার শুরু করে দেয়। কেন অমুক ব্যক্তি এমনটা করেছে? কেন অমুক ব্যক্তি তেমনটা করছে? ইত্যাদি।
আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُوْلِي الأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ
তারা যদি তা রাসূল বা যারা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদের কাছে নিয়ে যেত , তবে তাদের মধ্যে যারা তার তথ্য অনুসন্ধানী তারা তার বাস্তবতা জেনে নিত। [সূরা নিসা ৪:৮৩]
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন আমরা কিভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে গুজবের মোকাবেলা করব। আর যারা দায়িত্বশীল তাদের কাছে প্রশ্ন করে জানার জন্যও বলেছেন – যে অমুক ঘটনাটি কি?
সুতরাং তোমরা তোমাদের এবং আল্লাহর মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ককে সংশোধন কর যাতে তোমরা তোমাদের নেকীগুলো হেফাযত করতে পার।
(শাইখ আবদুল্লাহ আযযাম রহ. এর কথা এখানে শেষ হল)
সুতরাং শেষ কথা হল প্রত্যেক বিষয়কে সে বিষয়ের পারদর্শীর নিকট হস্তান্তর করা এবং জানার ক্ষেত্রে তা গুরত্ব সহকারে জানা।
আর গুজবের ক্ষতি হল-
গুজব বিচ্ছিন্নতা এবং অন্তরে ক্রোধের সৃষ্টি করে। শত্রুরা সাধারাণ সৈনিক এবং আমিরদের মাঝে নিজেদেরকে মধ্যস্থতাকারী বানাতে বেশী পছন্দ করে। কারণ এর দ্বারা তারা আমিরের কথা বিকৃত করে মামুরদের কাছে বলবে আর মামুরদের কথা রদবদল করে আমিরদেরকে শুনাবে। এটা করতে পারলে সাধারণ সৈনিকদেরকে আমির থেকে দুরে সরানো যাবে, এটাই মূলত শত্রুদের চাহিদা। এটা একটি প্রসিদ্ধ এবং জানা কথা- তাই এরজন্য কথা বাড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই।
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল-আ’দম বলেন, জিহাদ ও মুজাহিদদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হল, সে সব বাতিল প্রোপাগান্ডা যা জিহাদে গমনকারীদের বিশেষ করে তাদের আমিরদের সম্মানের সাথে সম্পৃক্ত। এ ধরণের প্রোপাগান্ডা নেতৃত্বকে ধ্বংস করে এবং আমির ও সৈন্যদের মাঝে দীর্ঘ ব্যবধান তৈরি করে। সুতরাং তারা দুর্বল অন্তরসমূহে বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুতা ঢেলে দেয় এবং এর অনিষ্টতাকে বৃদ্ধি করে তোলে, এরপর এর থেকে কেউই মুক্তি পায়না।
নিঃসন্দেহে এটা জিহাদি কাফেলার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষয়। তাই প্রত্যেক মুজাহিদের জন্য এব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিৎ এবং এমন সব দল থেকে বেঁচে থাকা উচিৎ, যাদের জিহাদে নেতৃত্ব লাভ এবং শ্রুতবিষয়কে বিকৃত করা ব্যতীত আর কোন কাজ নেই। চাই এ বিকৃতিকারী জিহাদের কাতারের ভিতরের লোক হোক বা বাহিরের। শত্রু কখনো কাতারের বাহিরের হতে পারে আবার কখনো কাতারের ভিতর থেকে। কখনো দ্বীনের দিক থেকে, বিবেকের দিক থেকে অথবা মানবিক দিক থেকে দুর্বল এমন কেউও হতে পারে – যিনি শত্রুদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে, না জেনেই তাদের চক্রান্তে পড়ে যায়। দুর্বল চিন্তার অধিকারী ব্যক্তি – সংবাদ শুনে তা প্রচার করতে থাকেন, যদিও তার জানা নেই, তাতে কত বড় ফাসাদ রয়েছে।
আমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে আমাদের নফসের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন। আমীন
والحمد لله رب العالمين، والسلام عليكم ورحمة الله وبركاته