উস্তাদ হাসান আব্দুস সালাম
ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক সমমনাদের সমন্বয়ে সংগঠিত থিঙ্কট্যাঙ্কের মাধ্যমে সূত্রপাত হয়েছিল “নতুন মার্কিন শতাব্দী প্রকল্প” (Project for the New American Century-PNAC) এর।
এই প্রকল্পনুযায়ী “আফগানিস্থান পরাভূতকারী “ক্ষমতার মোহে অন্ধ মার্কিনীরা প্রস্তাব করে- একুশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক সাম্রাজ্য সৃষ্টির কথা বলা হয়। ঐ সাম্রাজ্যে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র যুক্তরাষ্ট।
অর্থাৎ, শুধু যুক্তরাষ্টই হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী। অর্থাৎ, কোনো উন্নত শিল্পায়িত জাতিরও আঞ্চলিক অথবা বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকবে না।
এই PNAC’র কর্তাব্যক্তিদের অন্যতম জর্জ বুশ আমলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেন্ড, রিচার্ড পার্ল, পল উলফোউইজ, জর্জ বুশের ভাই জেব বুশ প্রমুখ।
২০০৩ এর ২১ মার্চে (ইরাক আক্রমণের পর দিন) রিচার্ড পার্ল আমেরিকার Enterprise Institude এ এক ব্রিফিং সেশনে বলে,
“ইরাক দখলের পর যুদ্ধোত্তর সল্পকালীন কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, জাতিসংঘের বৈপ্লবিক সংস্কার (যেমন, নিরাপত্তা পরিষদের বাকি রাষ্টের ভেটো ক্ষমতা কেড়ে নেয়া বা অপসারণ), ইরান ও সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন (regime Change) এবং ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিবাদী জালগুলি ছেটে ফেলা।”
নিঃসন্দেহেই এ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো বৈধতা অথবা নীতিনৈতিকতার কোনো জটিলতাকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা মোটেই আমলে আনার কথা চিন্তাও করেনি। PNAC তে তার কোনো নমুনাই উপস্থিত ছিল না। বরাবরের মতো মেকিয়াভেলিই হয়েছিল তাদের প্রধান গুরু।
আফগানিস্তান দখল করার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক Terror Risk Country হিসেবে সন্দেহজনক যে ২৪টি রাষ্ট্রের তালিকা তৈরী হয়, তন্মধ্যে উত্তর কোরিয়া ব্যতীত বাকী ২৩টিই ছিল মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র।
যদি ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন না হতো, (যার ফলাফল ছিল আমেরিকার অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়া এবং বিশ্বের সম্মুখে লাঞ্ছিত হওয়া) তবে গোটা বিশ্ব, বিশেষত মুসলিমবিশ্বের চিত্র কী হতো তা সহজেই অনুমেয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আর প্রথাগত রাজনীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক সংকট নিরসনের অলীক স্বপ্নদ্রষ্টাদের ব্যর্থতা নিঃসন্দেহেই প্রমানিত হয়েছে, যখন বিলিয়নসংখ্যক সদস্য বিশিষ্ট উম্মাহর সামনে আমেরিকা হাসতে হাসতে একের পর এক মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং তদ্রুপ আচরনের পুনরাবৃত্তির ঘোষনা দিয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে।
দাওয়াতী, রাজনৈতিক ও চিন্তার ময়দানে স্থবিরতায় আক্রান্ত এসকল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনা যে সম্ভব নয়, তা উম্মাহ দেড় যুগ আগেই প্রমাণ পেয়েছে।
এবিষয়টি কেবল ঐসকল ব্যক্তির বোধগম্য নয়, যার আকল ছিনতাই হয়ে গিয়েছে অথবা ব্যক্তিস্বার্থ বা দুনিয়াপূজার বাইরে যাদের কোনো চিন্তাই নেই।
কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইমান ও কুফরের মধ্যকার সংঘাতের সূত্র আত্মস্থকারী কোনো মুসলিমের কাছেই আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের বাস্তবতা উপলব্ধি করা কঠিন কোনো বিষয় নয়।
বরং আরও অগ্রসর হয়ে একথাও নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব, ন্যূনতম বোধশক্তি রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির জন্যও আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নির্মম বাস্তবতা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমাদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও নীতিনির্ধারকদের মানসিকতা এডলফ হিটলারের মতো উল্লেখ করে উদ্ধৃত করেছেন Mein Kampf বইয়ের (যা Adolf Hitler এর আত্মজীবনী) ৫৩তম পৃষ্ঠা থেকে নিম্নোক্ত বাক্যটি-
“ত্রাস ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল যুক্তির উপর বিজয়ী হওয়া যায়।”
(The one means that wins the easiest victory over reason- Terror and force!)
কতই না দুঃখজনক, একজন সেক্যুলার যা বুঝতে পেরেছেন, উম্মাহর বহু আন্তরিক সদস্য তা বুঝতে অক্ষম।
উম্মাহকে অবশ্যই বুঝতে হবে, মুসলিমদের উপর আমেরিকা ইসরায়েল বা ভারতের আগ্রাসন কখনই সভা-সমিতি প্রথাগত রাজনীতি বা পত্রিকায় মাধুর্য্যমন্ডিত কলাম লেখার মাধ্যমে বন্ধ হবে না।
জনপ্রিয়তা, ভাষার সৌন্দর্য, কল্পনাপ্রসূত “বাস্তবতার দাবী” কিংবা অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকা উম্মাহর জন্য অপরিহার্য। হতে পারে আপনার অনুসরনীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী “ইলম বা দাওয়াতের” পথের মহীরুহ কিংবা মঞ্চকাপানো বক্তা।
বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকা, ইসরায়েল বা ভারতের মতো বিশ্ব অপরাধীরা বিবেক বা যুক্তির ভাষা গ্রহন করবে বা তাদের মদদপুষ্ট মুরতাদ শাসকগোষ্ঠী যুক্তির ভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হবে, এমন কল্পনা কেবল ইতিহাসবিস্মৃত, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবঞ্চিত, মোহগ্রস্থ অথবা আত্মপ্রবঞ্চিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারাই সম্ভব।
এবং আমেরিকা ইসরায়েল বা ভারতের মতো চিহ্নিত অপরাধী মোড়লদের সম্ভাব্য সকল উপায়ে সর্বত্র প্রতিরোধ, অবরোধ ও আক্রান্ত করার মাধ্যমেই ইসলাম ও মুসলিমদের নিরাপত্তা ও সম্মান ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই উপেক্ষিত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা এখন প্রতিটি সচেতন, বিবেকবান ঈমানদারের প্রাথমিক কর্তব্য।
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিপূর্বক, প্রতিরোধ ও আঘাতের মাধ্যমেই উম্মাহর হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করার মানহাজই হোক উম্মাহর প্রত্যেক সদস্যের এবং প্রত্যেক রাজনীতি সচেতন নেতার চিন্তার মৌলিক সূত্র।