তোমরা প্রস্তুত করো!

শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি

ডাউনলোড

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:

“(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনী প্রস্তুত কর। যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের (বর্তমান) শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে এবং তাদের ছাড়া সেই সব লোককেও যাদেরকে তোমরা এখনও জান না কিন্তু আল্লাহ জানেন।

তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে তা তোমাদেরকে পরিপূণরূপে দেওয়া হবে এবং তোমাদেরকে কিছু কম দেওয়া হবে না।”

(সূরা আনফাল)

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা শরয়ী ওয়াজিব, আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলার এই আদেশের কারণে-“তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনী প্রস্তুত কর”।

এছাড়াও আরেকটি মূলনীতি আছে: যা ছাড়া ওয়াজিব সম্পূর্ণ হয় না তাও ওয়াজিব। সুতরাং ই’দাদ (প্রস্তুতি গ্রহণ করা) ওয়াজিব। যার উপর ই’দাদ ফরজে আইন হয়েছে তার জন্য এর মধ্যে শেথিল্য করা গুনাহ।

সুতরাং মানুষ গুনাহগার হবে, যখন তার উপর ই’দাদ ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও সে ইদাদ গ্রহণ করবে না। আর গুনাহের জন্য তাওবা ও ইস্তেগফার করতে হয়। তাওবা ইস্তেগফার ও আমল।

অর্থাৎ গুনাহ থেকে তাওবা করা মানে হচ্ছে ইস্তেগফার করা, অনুশোচিত হওয়া ও উক্ত গুনাহে আর লিপ্ত না হওয়া, তা থেকে দূরে থাকা। পক্ষান্তরে ইস্তেগফার করা, অনুশোচিত হওয়া ও আবার উক্ত গুনাহের উপরই চলতে থাকা, এটা তো তাওবা আন্তরিক না হওয়ার দলিল। অর্থাৎ তাওবাটি সত্য নয়।

সুতরাং ই’দাদ একটি শরয়ী ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা এর আদেশ করেছেন। আদেশ করেছেন নবী সা: এর উম্মতকে- “তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনী প্রস্তুত কর। যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের (বর্তমান) শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে”।

কতটুকু ই’দাদ গ্রহণ করতে হবে? এই পরিমাণ ই’দাদ গ্রহণ করতে হবে, যাতে শত্রুদের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়। এমন যে, আমাদের কাছে প্রতিরোধের অস্ত্র থাকবে, ফলে শত্রুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জমায়েত হতে ভয় পাবে।

ফলে তারা নতজানুমূলক কাজ করতে বাধ্য হবে। নতজানুমূলক কাজ মানে কি? অর্থাৎ যখন তারা যুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, তখন যুদ্ধের পরিবর্তে পরাজয়মূলক সন্ধির দিকে যেতে বাধ্য হবে।

মোটকথা যতক্ষণ না শত্রুদের মাঝে মুসলমানদের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ সুবহানাহু বলেন: “তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনী প্রস্তুত কর। যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের (বর্তমান) শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে”।

যখন অক্ষমতার কারণে জিহাদ মওকুফ হয়ে যায়, অর্থাৎ জিহাদ ওয়াজিব ছিল, কিন্তু অক্ষমতার কারণে জিহাদ করতে পারছে না, তখন ইদাদ বা প্রস্তুতি গ্রহণ বাকি থাকে।

অর্থাৎ যখন অক্ষমতার কারণে জিহাদ রহিত হয়ে যায়, তখন জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের আবশ্যকীয়তা বাকি থেকে যায়।

ইবনে তাইমিয়া রহ: তার ফাতাওয়ায় বলেন,

“যখন অক্ষমতার কারণে জিহাদ রহিত হয়, তখন শক্তি অর্জন ও ঘোড়ার পাল প্রস্তুত করার মাধ্যমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা যা ছাড়া ওয়াজিব আদায় হয় না তাও ওয়াজিব।”

এছাড়াও আরেকটি বিষয় হল, ইদাদ বা প্রস্তুত গ্রহণ করা হল জিহাদের ইচ্ছা থাকার ব্যাপারে আল্লাহর সাথে সত্যবাদীতার দলিল।

আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:

“তারা যদি বের হওয়ার ইচ্ছা রাখত, তাহলে অবশ্যই এর জন্য কোন কিছু প্রস্তুত করত।”

যখন প্রস্তুত করল না, এর অর্থ হল, তারা বের হওয়ার ইচ্ছা করল না। তাই বিষয়টি কঠিন!!!

যদি তারা বের হওয়ার ইচ্ছা করত, তাহলে তার জন্য কিছু না কিছু প্রস্তুত করত। তাই যখন কিছুই প্রস্তুত করল না, তখন প্রমাণিত হল তারা ইচ্ছা করেনি। তাদের ইচ্ছাটি সঠিক নয়। তাদের ইচ্ছাটি দৃঢ় সংকল্প ছিল না।

এমতাবস্থায় তাদের ইচ্ছাটি হল কল্পনা। যেমন বলে থাকে জিহাদ আমার সপ্ন, আমার সপ্ন শাহাদাহ। কল্পনাতো কল্পনাই। কল্পনা তো বহু হয়। একারণে বলা হয়ে থাকা সপ্ন ও কল্পনা হল পথভ্রষ্টকারী।

মোটকথা, ইদাদ হল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ইচ্ছা সত্য হওয়ার দলিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন: তারা যদি বের হওয়ার ইচ্ছা করত, তাহলে অবশ্যই এর জন্য কিছু না কিছু প্রস্তুত করত।

“তোমরা তোমাদের সাধ্যমত শক্তি প্রস্তুত কর”

রাসূল সা: বলেন, শক্তি হল নিক্ষেপ করা। অর্থাৎ শক্তি অনেক-ই আছে, কিন্তু তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বপ্রধান ও সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ হল নিক্ষেপ করা।

সালামা ইবনুল আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূল আসলাম গোত্রের একদল লোকের নিকট গমন করলেন। তারা তীর প্রতিযোগীতা করছিল। রাসূল সা: বললেন,

হে বনী ইসমাঈল! তোমরা নিক্ষেপ কর। তোমাদের পিতাও নিক্ষেপকারী (বা তীরন্দায) ছিলেন।

সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানুল্লাহ আলাইমি আযমাঈনকে নিক্ষেপণ, ই’দাদ ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হল।

ইবনে বাত্তাল রহ: শরহে সহীহুল বুখারীতে বলেন,

মুহাল্লাব বলেছেন, এই হাদিসের মধ্যে এই ফিকহ রয়েছে, যে শাসক তার লোকদেরকে নিক্ষেপণ ও সর্বপ্রকার যুদ্ধ কৌশল শিখার ব্যাপারে আদেশ করবে ও উৎসাহ দিবে।

বোঝা গেল কি? এমনটা নয় যে, শাসক নিজেই এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।

ইসলামে অনেক হাদিসে নিক্ষেপ শিখার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন একটি হাদীস, বর্ণনা করেছেন ইমাম নাসায়ী, আবু দাউদ ও তিরমিযী রহ: আবু নুযাইহ আসসুলামী রা: থেকে তিনি বলেন, আমি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছি,

“যে একটি তীর লক্ষ্যে পৌঁছালো, তার জন্য জান্নাতে একটি মর্যাদা রয়েছে।” তিনি বলেন, অত:পর আমি সেই দিন ষোলটি তীর লক্ষ্যে পৌঁছিয়েছি।

অর্থাৎ যে একটি তীর শত্রুদের পর্যন্ত পৌঁছলো তার জন্য একটি মর্যাদা। তিনি বলেন, আলহামদু লিল্লাহ আমি নিক্ষেপ করেছি ও লক্ষ্যে পৌঁছিয়েছি ষোলটি তীর। তিনি বলেন: আমি রাসূল সা: কে আরো বলতে শুনেছি:

“যে আল্লাহর রাস্তায় একটি তীর নিক্ষেপ করল, এটা তার জন্য একটি গোলাম আযাদ করার সমপরিমাণ। অর্থাৎ লক্ষ্য ভেদ করুক বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হোক।

যেমন আরেক হাদিসে এসেছে, ইমাম ইবনে মাযাহ রহ: বর্ণনা করেছেন আমর ইবনে আবাসা রা: থেকে-

“যে শত্রুর প্রতি একটি তীর নিক্ষেপ করল, অত:পর তীর শত্রুদের পর্যন্ত পৌঁছলো, কোনটা লক্ষ্যভেদ করল, কোনটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, তার জন্য গোলাম আযাদ করা পরিমাণ সওয়াব।”

অর্থাৎ কোন একটি তীর নিক্ষেপ করল বা কোন নিক্ষেপণ বস্তু নিক্ষেপ করল এবং শত্রুদের পর্যন্ত পৌঁছলো, চাই শত্রুদের গায়ে বিদ্ধ হোক বা না হোক, কিন্তু তাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে,

রাসূল সা: বলেন, তাহলে এটা একটি গোলাম আযাদ করার সমপরিমাণ। যেন সে একটি গোলাম আযাদ করল।

স্বয়ং সাহাবা রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আযমাঈন তাদের বার্ধক্য সত্তেও নিক্ষেপণ ও প্রশিক্ষণ ছেড়ে দেননি।

ইমাম মুসলিম রহ: আব্দুর রহমান ইবনে শিনাছ আল মাহরি রা: থেকে বর্ণনা করেন,

“এক ব্যক্তি উকবাহ ইবনে আমের রা: কে বলল, আপনি এই দুই প্রান্তের দিকে ছোটাছুটি করছেন। (অর্থাৎ তীরের দু’টি লক্ষ্যস্থল বানিয়ে একেকবার একেকটির দিকে ছুটছেন।) অথচ আপনি বয়োবৃদ্ধ, আপনার কষ্ট হচ্ছে? (অর্থাৎ সে একাজের কারণে তিরস্কার করছে!!) তখন তিনি বললেন, আমি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছি: যে নিক্ষেপণ শিখল, অত:পর তা ছেড়ে দিল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে, হযরত খালেদ ইবনে যায়দ থেকে, তিনি বলেন, উকবাহ ইবনে আমের আমার নিকট আসতেন, (অর্থাৎ উকবাহ রা: তার সাক্ষাতে যেতেন।) তখন বলতেন, চল, আমরা তীরন্দাযী করি।

একদিন আমি একটু বিলম্ব করলাম বা একটু ভারি মনে করলাম, তখন তিনি বললেন, আমি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছি: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা একটি তীরের মাধ্যমে তিনজনকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ১. তার কারিগরকে, যে বানানোর সময় সওয়াবের নিয়ত করেছে। ২. তার নিক্ষেপকারীকে। ৩. তার দানকারীকে, অর্থাৎ যে নিক্ষেপের বস্তু কাউকে দান করে। অথবা এর অর্থ হল, যে তীরটিকে লক্ষ্যস্থল থেকে এনে দেয়।

অর্থাৎ নিক্ষেপকারী নিক্ষেপ করার পর সে লক্ষ্যস্থল থেকে তা এনে দেয়।

রাসূল সা: বলেন,

“তাই তোমরা তোমরা নিক্ষেপ কর ও আরোহন কর। আর আমার নিকট নিক্ষেপ করা আরোহন করা থেকে উত্তম। কোন খেলা বেধ নয়, কেবল মাত্র তিনটি খেলা ব্যতিত: এক. পুরুষের তার স্ত্রীর সাথে বিনোদন করা। দুই. স্বীয় ঘোড়াকে বশ করা বা শিক্ষা দেওয়া এবং তিন. স্বীয় তীর নিক্ষেপ করা। যে নিক্ষেপ করা শিখে তা ছেড়ে দিল, সে যেন একটি নেয়ামত পেয়ে তার অকৃতজ্ঞতা করল।”

এই হলেন উকবাহ ইবনে আমের রা:।

আনাস বিন মালেক রা: এরও এমন ঘটনা রয়েছে। ইবনে হাজার রহ: তালখিছু হাবীর কিতাবে বলেন, ইমাম তাবরানী রহ: কিতাবুর রমীতে বর্ণনা করেন (অর্থাৎ ইমাম তাবরানী রহ: রমীর (নিক্ষেপণের) ব্যাপারে ছোট একটি পুস্তিকা আছে।) তাতে তিনি সহীহ সনদে ছুমামা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আনাস রা: থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন,

আনাস রা: বসতেন, তার জন্য বিছানা পাতা হত। আর তার সামনে তার ছেলেরা তীরন্দাযী করত। (অর্থাৎ তিনি বিছানায় বসতেন, আর তার সন্তানগণ তীরন্দাযী করতেন, তিনি তাদেরকে তীরন্দাযীর দিকনেদের্শনা দিতেন।)

এভাবে একদিন তিনি আমাদের নিকট আসলেন, তখন আমরা তীরন্দাযী করছিলাম, তখন তিনি আমাদেরকে বললেন, হে আমার বৎসরা! তোমরা অতি মন্দ নিক্ষেপ করছো। অত:পর তিনি ধনুকটি নিয়ে নিক্ষেপ করলেন, তাতে সামান্যও লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। (অর্থাৎ সূক্ষ বস্তুকে টার্গেট করে ফেললেন।)

উস্তাদ আলআদহাম বলেন,

তাই যারা সামরিক জ্ঞান অর্জন করেছে তাদের উপর ওয়াজিব হল, তারা তার ব্যাপারে অমনোযোগী হতে পারবে না এবং এমন ভাবে তা ছেড়ে দিতে পারবে না যে, তা ভুলেই যায় এবং তার সন্তানদের মাঝে ও অন্যান্যদের মাঝে সবসময় তা চর্চা করার অভ্যাস জারি রাখার ব্যাপারে গাফলতি করতে পারবে না। যতক্ষণ না এই কঠিন বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।  আর আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কিছু চাপান না।

মোটকথা, ইদাদ ফরজ। চাই ব্যক্তিগত ইদাদ হোক, অথবা পুরো উম্মতের সম্মিলিত ইদাদ হোক। অর্থাৎ গোটা উম্মাহ উত্তম ইদাদ গ্রহণ করবে, অর্থাৎ সর্বপ্রকার অস্ত্রের ইদাদ ও সকল ধরণের ব্যাপক ইদাদ। এটাই কাম্য, চাই ব্যক্তির থেকে হোক, জামাতের থেকে হোক বা পুরো উম্মত থেকে হোক।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি আল্লাহ আমাদেরকে তার ইবাদত করার তাওফীক দান করুন ও তার অবাধ্যতার বিষয়গুলোকে আমাদের থেকে দূরে রাখুন! আমীন!

ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

(Visited 450 times, 2 visits today)