শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি
ডাউনলোড
পরামর্শ দ্বীনেরই একটি অংশ। এটি এমন এক ইবাদত যা দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি। শূরা কি? এটাকে ওয়াজিব কিংবা মোস্তাহাব যাই বলি না কেন, সর্বশেষ কথা হচ্ছে এর দ্বারা আল্লাহর মোহাব্বত পয়দা হয়। তাছাড়া ‘পরামর্শ’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ ।
পরামর্শ করা একটি ইবাদত এবং তা আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের মাধ্যম। এতে অনেক বড় বড় উপকার রয়েছে। ইবনুল আরাবী কয়েকটি উপকারের কথা ‘আহকামুল কুরআনে’ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘পরামর্শ জামাতের মাঝে মোহাব্বত পয়দা করে। ‘পরামর্শ’ জ্ঞানীদের জন্য পরীক্ষা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যম। যে জাতি পরামর্শ করবে তারা সঠিক পথের দিশা পাবে। কোন হুকুমত, রাজত্ব, প্রতিষ্ঠান বা ইমারাহ পরামর্শ ছাড়া চলতে পারেনা। যদি পরামর্শ থেকে উপেক্ষা করা হয়, তবে প্রতিষ্ঠান, ইমারাহ, রাজ্য ও হুকুমত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। পরামর্শ ব্যতীত কোন কাজ সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করা যায় না এবং মানুষের কাঙ্ক্ষিত শাসনও পাওয়া যায় না।
পরামর্শের সবচে বড় ফায়দা হল – নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুদের সাথে পরামর্শ করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন নিষ্পাপ, তারপরও তিনি সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেছেন!
তিনি বদর, উহুদ সহ অন্যান্য যুদ্ধের ব্যাপারেও সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেছেন। আর সাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করে চলতেন।
ইমাম বুখারী রহ. বলেন “নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরবর্তী ইমামগণ (খলিফাগণ) বৈধ বিষয়াবলীতে আহলে ইলেম আলেমদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করতেন। যাতে তাদের থেকে এগুলোর সব বিবরণ (মাসআলা সমূহ) জেনে নিতে পারেন।
ইমাম সূফিয়ান সাওরী রহ. বলেন: “তোমার পরামর্শদাতা যেন আমানতদার ও তাকওয়া সম্পন্ন হয়। যারা আল্লাহকে ভয় করে।
আহলুশ-শূরা তথা পরামর্শদাতা কারা?
এর উত্তর হল – পরামর্শদাতা এমন ব্যক্তি যাদের নিকট মানুষ পরামর্শ চাইলে সঠিক পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ তারা হচ্ছে আসহাবুর-রায়, দ্বীনদার, আমানতদার ও মুত্তাকী ব্যক্তি। তারা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে, কাউকে ধোঁকা দেয়না এবং মানুষের বিপক্ষে পরামর্শ দেয় না। যেহেতু আহলুশ-শূরার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে, আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে – তাই তার ভয় ও তাকওয়া তাকে সত্য বলা ও আমানত রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। যদি তার কোন বিষয় জানা না থাকে, তাহলে অবশ্যই সে বলবে বিষয়টি আমার আমার জানা নেই। কেননা সে তো আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকেও ভয় করে। সে এমন কোন বিষয়ের পরামর্শ দেয় না, যাতে ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। কারণ সে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে এবং পরকালের কল্যাণ আশা করে।
সুতরাং আহলুশ শূরা তথা পরামর্শদানকারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল – সে আমানতদার, খোদা-ভীরু এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং সিদ্ধান্ত প্রদানের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিগণ পরামর্শ করেই কাজ করে থাকেন। তবে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নয় এবং সিদ্ধান্ত প্রদানের যোগ্যতাও রাখেনা, তাদের থেকে কেউ কি পরামর্শ নিবে? তারা কি পরামর্শ দিবে?
পরামর্শ বা শূরার নিয়মাবলী আমি ‘আহকামূল ইমারাহ’ (রাজ্যের বিধানাবলী)তে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রায় পরিপূর্ণ দরস আহকামুশ শূরাতে এসে গেছে। আমির, আমিরুল মুমিনিন, খলিফা অথবা জামাতের নেতৃস্থানীয় লোকজন সকলের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী সেখানে বিস্তারিত বলা আছে।
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল আ’দম বলেন: “সাবধান! কম বয়সী লোকদেরকে যেন পরামর্শ প্রদান করার ক্ষেত্রে বারণ করা না হয়। অর্থাৎ যারা বয়সে ছোট কিংবা যৌবনে মাত্র পদার্পণ করেছে তাদেরকে যেন পরামর্শ থেকে বারণ করা না হয়। কেননা ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ সব ধরণের আলেম-উলামা দ্বারা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মজলিস ভরপুর ছিল। তবে হ্যাঁ, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ব্যাপারে এটা প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করতেন। এমনিভাবে তিনি দ্বীনদার, আমানতদারদের সাথেও পরামর্শ করতেন। চাই তারা ছোট হউক কিংবা যুবক হউক।
তিনি আরও বলেন, “হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মজলিস উলামায়ে কেরামের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তারা বয়স্ক বা যুবক যাই হোক, তিনি সকলের সাথেই পরামর্শ করতেন। যেমনটি ইমাম যুহরী রহ. থেকে বর্ণিত যে, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন – কম বয়সী হওয়ার কারণে তোমাদের কাউকে যেন মতামত বা রায় প্রকাশে বারণ করা না হয়। কেননা মতামত বা রায় প্রদান কম বয়স বা বেশি বয়সের ভিত্তিতে হয়না। বরং তা এমন বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা যেখান থেকে ইচ্ছা প্রকাশ করাবেন”।
ইমাম বুখারী রহ. বলেন: ক্বারিগণ চাই যুবক হউক কিংবা বৃদ্ধ, তারা ছিলেন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পরামর্শদাতাদের অন্তর্ভুক্ত। তারা ছিলেন আল্লাহ তা’আলার কিতাব সম্পর্কে অভিজ্ঞ। ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই গুণের ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. এভাবেই বলেছেন।
মোটকথা পরামর্শ হল উম্মতে মুসলিমার উত্তম একটি নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রশংসা করেছেন যে, মু’মিনরা তাদের যাবতীয় বিষয়ে পরামর্শ করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
অর্থ: (মু’মিনগণ) যারা পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে।[সূরা শূরা ৪২:৩৮]
পরামর্শের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ
অর্থ: (নবীকে সম্বোধন করে আল্লাহ তা’আলা আদেশ করেছেন যে,) কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। [সূরা আল -ইমরান ৩:১৫৯]
এই আদেশ ওয়াজিব বা মোস্তাহাব সকল কাজের জন্যই। তাছাড়া এটি রাজ্য পরিচালনার বিধানও। যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
সুতরাং পরামর্শ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ এবং ইসলামের আদব। যখন পরামর্শ ছেড়ে দেয়া হয় তখন মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। যা পরামর্শ ছাড়া সংশোধন হয়না। এমনিভাবে রাজত্ব, শাসন, হুকুমত ও ইমারাহ ইত্যাদি পরামর্শ ব্যতীত যথাযথভাবে চলেনা। সুতরাং আমির ও নেতার জন্য আবশ্যক হল দ্বীনদার, আমানতদার ও কল্যাণকামীদের সাথে পরামর্শ করা।
আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে তার আনুগত্য করার তাওফিক দান করেন এবং তার অবাধ্যতা থেকে হেফাজত করেন। আমীন।
ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।