উস্তাদ মুয়াফফাক আফগান হাফিযাহুল্লাহ
এই প্রবন্ধটি তালিবান মুজাহিদদের অফিসিয়াল ফার্সি (আফগানিস্তানে ফার্সি ভাষার এই ধারাটি ‘দারি’ নামে পরিচিত ও কথিত) ম্যাগাজিন ‘মাজাল্লাহ হাকিকত’ (৮ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জুমাদাল উলা ও জুমাদাল উখরা ১৪৪২ হিজরি, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি ২০২১ ইংরেজি) এর ৪৫ নাম্বার সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
এটির সম্পাদক হলেন মৌলবি নাঈমুল হক হক্কানি হাফিযাহুল্লাহ, যিনি ‘আহমাদ তানভির’ নামে ম্যাগাজিনের পাঠকদের কাছে সুপরিচিত।
মুহতারাম উস্তাদ মুয়াফফাক আফগান হাফিযাহুল্লাহ’র লিখিত نقاب مادر دموکراسی به زمین افتاد প্রবন্ধটির বাংলা শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘গণতন্ত্রের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে গেছে’।
এই প্রবন্ধে অত্যান্ত বলিষ্ঠভাবে গণতন্ত্রের চালাকি, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা তুলে ধরা হয়েছে। এতে রয়েছে সকল মুসলিম বিশেষ করে ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক দলগুলোর ব্যাপারে শিক্ষা ও উপদেশ, যেন তারা কোন পথে চলছেন, তা বুঝতে পারেন।
আশা করছি গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইমারতে ইসলামী আফগানিস্তানের অবস্থানের নিয়ে যাদের সংশয় ছিল, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা তা দূরীভূত করতে পেরেছি।
আল্লাহ আপনাদেরকে, আমাদেরকে ও আমাদের এই ছোট্ট কাজকে কবুল ও মকবুল করে নিন। আমিন।
সম্পাদক
০১ মুহাররাম ১৪৪৩ হিজরি
১০ আগস্ট ২০২১ ইংরেজি
গণতন্ত্র তার অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকেই ধূর্ত রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করে আসছে। বছরের পর বছর ধরে, এই প্রতারনাকে বিভিন্ন রূপ এবং রঙ দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষের মূর্খতাকে যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত করা যায়, এবং এই গণতন্ত্রের ব্যবসাকে দেউলিয়াপনা থেকে রক্ষা করা যায়। যদিও এর কারণে সাধারণ মানুষের প্রাণ ও জীবন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছিলো।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে গণতন্ত্রের কলঙ্ক আরো বহু আগ থেকেই শুরু হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রগুলো স্বৈরাচারী নিপীড়নের মধ্য দিয়ে শাসিত হচ্ছিলো। জ্ঞানীরা এই সত্য বহু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।
পশ্চিমা দেশগুলো অন্য রাষ্ট্রগুলোতে এই গণতন্ত্র রপ্তানি করে এর কুৎসিত ও বিবর্ণ চেহারার মুখোশ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ তারা ধারাবাহিকভাবে এ কথা প্রচার করে আসছিলো যে, এই দেশগুলো ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা কয়েক দশক ধরে এই মিথ্যা দাবি করে আসছে এবং সত্যিকারার্থে ন্যায় ও সমতার বুকে আঘাত করে যাচ্ছে।
বিগত কয়েক যুগ ধরে জাতিগত বৈষম্য, ধর্মের সাথে সংঘর্ষ, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম, ক্রুসেড এবং ধর্মীয় যুদ্ধের ভয়াবহতা, নিরীহ ও নিপীড়িত মানুষের হত্যার জন্য স্পষ্ট এবং ব্যাপক সমর্থন আদায়, চোর, লুটেরা শাসকদের পক্ষে সমর্থন আদায়, বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত লাভের জন্য জনস্বার্থ লঙ্ঘন, গৃহযুদ্ধকে প্ররোচিত করা, দুর্বল ও নিপীড়িত দেশের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা, দরিদ্র ও অভাবী দেশের সম্পদ চুরি করা ছিলো এই ব্যবস্থার অন্যতম অর্জন। অথচ এরাই ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার দাবি করে থাকে। অন্তত তিন-চার দশক ধরে বিশ্ব তা প্রত্যক্ষ করছে।
গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচার ও সমতার দাবিদার এ বিশাল ও জীর্ণ ব্যবস্থার রপ্তানিকারকগণ উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সাথে নিজেদের দাবি ও কর্মের দ্বন্দ্ব নিয়ে কোন ধরণের দু:খবোধ করেনি। বরং তাদের নিজেদের দেশেও, (যাকে তারা গণতন্ত্রের শৃঙ্খলা বলে মনে করেন) গণতন্ত্রের অন্তরালে চুরি ও লুণ্ঠন করেছে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে অস্বীকার করে এর বিধাবলীকেও লঙ্ঘন করতে শরু করেছে।
যে দেশে (আমেরিকায়) লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ বাস করে, সেখানে শুধু সরকার ব্যবস্থায় তাদের কোন অংশ নেই তা নয়, বরং তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। যে গণতন্ত্র সকলকে আইনের সামনে সমান মনে করে তারা এই কৃষ্ণাঙ্গদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দিতে পারে না। আবার গণতান্ত্রিকরা যে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করে তাদের দ্বারাই তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এর ফলাফল হেরফের হয় এবং এতে অংশগ্রহণকারীও খোদ এ ব্যবস্থা নিয়ে উপহাস করে।
নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা গণতান্ত্রিক সিস্টেমের জন্য বিষের মতো। আবার এই প্রতারণামুলক নির্বাচনের উপর ভিত্তি করেই এই ব্যবস্থা তার বৈধতা অর্জন করে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর জনগণ একে বিভ্রান্তিকর ঘোষণা করে বাকবিতণ্ডতায় লিপ্ত হয়। শেষে চরম উপহাসের মধ্য দিয়ে এর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে এবং ঘোষণা করে যে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা রাখে না।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি সিনেট এবং মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের একটি যৌথ অধিবেশনে যা ঘটেছিল এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিবাদী সমর্থকরা, কংগ্রেসদের বাড়িঘরে যে হামলা করেছিলো; তা কোন ছোট ঘটনা নয়। বরং এর মাঝে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং এটি সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তনের খুব শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্মভূমিখ্যাত এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাস্ট্রে গণতন্ত্র রপ্তানীর গৌরব! অর্জনকারী রাষ্ট্রে কংগ্রেসদের দখলদারিত্ব এবং প্রতিবাদী বন্দুকধারীদের সংসদ ভবন দখল করা, গণতন্ত্রের প্রতীক ও প্রতিনিধিদের হেনস্থা, অফিসের সরঞ্জাম লুটপাট করা আজ বিশ্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মানুষ এখন আর গণতন্ত্রের মিথ্যা দাবী এবং স্বঘোষিত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্বাস করতে চায় না, যার জন্য তাদের শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে।
তারা এখন জানে যে গণতন্ত্র অলঙ্কৃত রঙিন পর্দার আড়ালে লুকানো রয়েছে নৃশংস কিছু দল যারা তাদের ইচ্ছামতো ক্ষমতা দখল করতে পারে এবং তারা কয়েক বছর পর পর চেহারা পরিবর্তন করে মানুষের সামনে হাজির হয়, মানুষকে আগামীর স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু সত্য হলো তাদের চেহারার এই পরিবর্তন টিভির পর্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের সব গুরুতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সেই পর্দার আড়ালে করা হয়। আবার তাদের এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তকে কথিত গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের ফলাফল কোনভাবেই প্রভাবিত করতে পারে না।