উস্তাদ হাসান আব্দুস সালাম
কাফির-মুরতাদ চক্রকে হটিয়ে তালিবানদের রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শান্তিপূর্ণ ও আপসকামী পন্থার অসারতা প্রমাণের পরও, কিছু মহল থেকে অজ্ঞতাবশত বারবার প্রশ্ন উঠছে-
শক্তিক্ষয়ের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের মাধ্যমে রাস্ট্রপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও, রাস্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা তালিবানদের দ্বারা সম্ভব নাও হতে পারে!!
আসলে, এটা বহুপ্রাচীন ও বহুল আলোচিত একটি সংশয়, যার জন্ম হয়েছে ইখওয়ানি চিন্তার জঠরে।
আমাদের শায়খ আবু বকর নাজি ‘ইদারাতুত তাওয়াহহুশ’ কিতাবে এ নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন দেড় যুগ আগেই। আলহামদুলিল্লাহ।
শরয়ী ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার মূলনীতির আলোকে শায়খ আলোকপাত করেছেন, কীভাবে মুজাহিদিনরা দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদেরদের অপসারণের পর প্রতিষ্ঠিত রাস্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস ও নিয়ন্ত্রণ করবেন।
শায়খ আবু বকর নাজি বলেন,
“যখন মুরতাদ গোষ্ঠীকে অপসারণ করে আমরা কোন অঞ্চল বা ভূমি আয়ত্তে আনতে পারব, আমরা দেখতে পাবো প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের মত লোকের যথেষ্ট অভাব আমাদের রয়েছে।
যদিও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার ফলে ব্যবস্থাপনা/Management এর দক্ষতা অনেকেরই থাকবে, তবুও তা প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট হবে না। বিশেষত, বিজিত অঞ্চলের মানুষদের কাছে আমরা আগন্তুক হিসেবে থাকবো।
যেহেতু, আমরা সংখ্যায় অপ্রতুল থাকবো তাই আমাদেরকে সদ্য প্রশাসনশূণ্য অরাজক অঞ্চলের বাসিন্দাদের দিয়েই প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতে হবে, এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই অনেকেরই অস্পষ্টতা রয়েছে।
তাই, আমরা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলবো ইনশা’আল্লাহ।
বাস্তবিক অর্থে, আমরা এমন এক সমাজ বাস্তবতার বসবাস করছি যে, নৈরাশ্যবোধ আর সংশয় খুব সহজেই আমাদের জেঁকে ধরে। যার ফলে নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তিপ্রিয় এবং কোন প্রকার বালা-মুসিবত মুক্ত বিষয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। যা থেকে কেউই মুক্ত নয়।
এক ভাই একবার আমাকে বলেন,
“এভাবে (জিহাদের মাধ্যমে) আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। যদি আমরা এই মুহূর্তে শাসনব্যবস্থা অপসারণ করেও ফেলি, কে বা কারা কৃষি, বাণিজ্য বা অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবে?”
আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম, “আবু সুফিয়ান, ইকরিমা এবং তাদের মত অন্যরা।”
কিন্তু পরিপূর্ণ উত্তর হচ্ছে — এই প্রশ্ন বা এজাতীয় প্রশ্ন আসলে কি এই ধারণা থেকে উদ্ভূত হয় যে, ‘আমাদের জিহাদে রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে।’
জিহাদ বা যুদ্ধের প্রকৃতির ব্যাপারে ত্রুটিপূর্ণ বুঝ থেকেই মূলতঃ এই জাতীয় প্রশ্নের জন্ম হয়। কিংবা জিহাদে অংশগ্রহণের মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঘোলাটে ধারণা থাকার কারণেও এমনটা হয়ে থাকে।
নিঃসন্দেহে নেতৃত্ব হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়ার মত বিষয় না। ঘাম, রক্ত আর মৃতদেহের কঠিন ও দীর্ঘ সফরের সাথে সাথেই নেতাদের আবির্ভাব ঘটে।
দ্বিতীয়ত, মুজাহিদিনদের জামাতের জন্য কৃষি, বাণিজ্য না অর্থনীতির উপর বিশেষ জ্ঞান দক্ষতা থাকা কোন পূর্বশর্ত নয়।
কেউ যদি বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসা বিপ্লবী বা রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে মনোযোগের সাথে মনোনিবেশ করে, তবে দেখতে পাবে – তারা রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব নিজ দলের লোকদের দিয়ে থাকে।
যারা দলের সামগ্রিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মৌলিক কিছু নীতিমালা/Policy প্রয়োগ করে থাকে আর মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক খুঁটিনাটি কাজের জন্য বেতনভুক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী বা আমলা/গোমস্তা নিয়োজিত থাকে। যাদের নীতি বা Policy নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। যারা দলীয় সদস্যও না।
(যেমন, ১৯৭১ এ দেশভাগের পরেও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের নিয়োগপ্রাপ্তরাই (যাদের ‘সিএসপি’ বলা হয় সচিবালয়ে) বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে, সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন চিন্তাধারার আওয়ামী সরকারের অধীনেই বিদ্যুৎ, কৃষি বা জনপ্রশাসনের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ আঞ্জাম দিয়েছিল। এমনকি পরবর্তীতে ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানকারী, মেজর জেনারল জিয়া ও এরশাদের সময়ও তারা প্রশাসনের হাল ধরেছিল!)
এ বিষয়ে অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। বিস্তারিত আলোচনার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এর চেয়েও উত্তম সমাধান রয়েছে আমাদের কাছে। আর তা হচ্ছে, আমরা মানুষের সাথে মিশবো। তাদের কাছাকাছি যাবো। এবং তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণের মাধ্যমে কাজে লাগাবো আর
পাশাপাশি তাদের সাথে আমাদের লোকেরাও বিঘ্ন সৃষ্টি না করে কাজ করলো ও শিখলো।
আমাদেরকে অবশ্যই আয়ত্ত করতে হবে ধৈর্য ও সহনশীলতা, আত্মত্যাগ, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, কুরবানী, ন্যায়বিচার, সদাচরণের গুণাবলী। যা এসময়ে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর, যদি উম্মতকে সাথে নিয়ে আমরা চলতে চাই এবং তাদের দ্বারা উপকৃত হতে চাই।
যে কোন সমাজে মজলুম বা দুর্বলরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের কাছে আমরা এ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো যে, আমরা পূর্ববর্তী সমস্যাগুলো দূর করব।
আমরা প্রত্যেক প্রমাণসহ আগমনকারীর দুর্বলের হয়ে হক আদায় করে দিব, একই সাথে তাকে ও ক্ষমাশীল হওয়ার ব্যাপারে নসিহত করবো যদিও তার হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আমরা মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করব এবং দুর্বলকে রক্ষা করব। আমরা তাদের বলব, “আমাদের আদর্শ হচ্ছে আপনাদের অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদীর (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্য যথাসম্ভব কুরবানী করা।”
আমরা শক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা দ্বারা মহানুভবতাকে আকড়ে ধরব। এটা ঠিক যে, আমারা ভয়াবহ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বো। আল্লাহর শত্রুদের পক্ষ হতে, মুনাফিকদের পক্ষ হতে। যারা আমাদের কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালাবে।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আশ্চর্যজনক বিষয় আমরা দেখতে পাবো। যখন ঈমানের বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে তখন তা অবিশ্বাস্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে। যখন মানুষ সাহসিকতা, নিশ্চয়তা, উত্তম গুণাবলী, বিশ্বস্ততা, ইকরাম, সহযোগিতা এবং নমনীয়তা ও বিনয়ের মত মহান বিষয়গুলো চোখে দেখবে তখন উপস্থিত কঠিন চ্যালেঞ্জ ও আতঙ্ক তাদের চোখে ক্ষুদ্র হয়ে দেখা দিবে।
ওয়াল্লাহি!! যখন এমন পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে আশপাশের অঞ্চল থেকে বহু যুবক আমরা আস্তে দেখব; যারা নিজ মেধা দক্ষতা আর শ্রম দ্বারা আমাদের সাহায্য করবে।
আমাদের অবশ্যই সকল শ্রেণীর মানুষের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। কীভাবে কার সাথে চলতে হবে তার উপর সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
যদি তারা “যাত আনওয়াত” এর দাবি করে আমরা কি করব?
তাদের কোনো পাপের শাস্তি বা প্রতিবিধান কি হবে; যেমন- মদ পান।
কখন আমরা শাস্তি দিব, কিংবা কতটুকু? কখন আমরা ছাড় দিব? কখন আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করব? ইত্যাদি বিষয়ে অবশ্যই সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।
শায়খ আব্দুল্লাহ আজ্জম (রাহিঃ) বলেন, “যুদ্ধ এই ইসলামের সন্তানদের জন্য সহজ করে দিয়েছে সকল স্তরের মানুষের সাথে উঠাবসা করার বিষয়টি।”
(ইদারাতুত তাওয়াহহুশ, ৪র্থ অধ্যায়ের ২য় পরিচ্ছেদ)
আলহামদুলিল্লাহ আমরা বারবারই নিরপেক্ষ ও সচ্ছ বিশ্লেষণ দ্বারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে,
আমাদের প্রস্তাবিত মানহাজ তথা দাওয়াহ, ইদাদ, সংগঠন ও সামরিকায়নের সমন্বয়ে শত্রুকে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরাস্ত করার মাধ্যমে তামকিন অর্জন করার মানহাজ শরয়ী ও ঐতিহাসিক দৃস্টিকোণ থেকে সঠিক ও স্বতঃসিদ্ধ।
এবং এই প্রস্তাবনা কোনো অগভীর চিন্তার ফসলও নয়।
আলহামদুলিল্লাহ।
সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ তা আলার ওয়াদা বাস্তবায়নের পরও যারা ফিতনার ছিদ্র তালাশে ব্যস্ত, যারা মনে করে আল্লাহ তা আলা তার একনিষ্ঠ বান্দা মুজাহিদিনদের সাহায্য করবেন না,
তাদের উচিত একটু এই আয়াতটি নিয়ে একটু তাদাব্বুর করা-
مَنۡ کَانَ یَظُنُّ اَنۡ لَّنۡ یَّنۡصُرَہُ اللّٰہُ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ فَلۡیَمۡدُدۡ بِسَبَبٍ اِلَی السَّمَآءِ ثُمَّ لۡیَقۡطَعۡ فَلۡیَنۡظُرۡ ہَلۡ یُذۡہِبَنَّ کَیۡدُہٗ مَا یَغِیۡظُ
(সূরা হাজ্জ, ২২ঃ১৫)