শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশী
ভূমিকা: জনকল্যাণ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামি আন্দোলন এবং এর শত্রুদের মাঝে বেশ কয়েকটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয় বিংশ শতাব্দীতে।
এই যুদ্ধে ইসলামের শত্রুরা তাত্ত্বিক, প্রয়োগিকসহ শক্তির সমস্ত উৎস ব্যবহার করে যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
শত্রুরা সমস্ত শক্তি দিয়ে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছে যেন মুসলিম যুবকদের মাঝে নতুন কোনো সামরিক চেতনার বিকাশ না ঘটে। ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কোনো সমরকৌশল, যুদ্ধপদ্ধতি উদ্ভাবন করে শত্রুকে চমকে দিতে না পারে।
এই কারণে, আমরা ইসলামী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর মাঝে সামরিক সংস্কৃতির প্রসার-প্রচারের লক্ষ্যে কিছু ধারাবাহিক নিবন্ধ লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ধারাবাহিক নিবন্ধের প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে বেছে নিয়েছি ‘বিপ্লবী যুদ্ধ’কে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
এর মধ্যে একটি কারণ হলো এই পদ্ধতির যুদ্ধ সবলদের বিরুদ্ধে দুর্বলদের লড়াইয়ের জন্য একটি আদর্শ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দুর্বলদের জয়ী হবার ভালো সম্ভাবনা থাকে। তাত্ত্বিক দিক থেকেও এই ধরণের যুদ্ধপদ্ধতি দুর্বল দলের জন্য বেশ কার্যকর।
জিহাদী আন্দোলনগুলো প্রায়ই এই বৈপ্লবিক যুদ্ধপদ্ধতির মূলভিত্তি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিশদভাবে না জেনেই এ যুদ্ধরীতি থেকে কিছু কৌশল নিয়ে তা প্রয়োগ করে থাকে। এই কারণে আমরা ‘বিপ্লবীযুদ্ধ’ পদ্ধতিকে কৌশলগত দিক থেকে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করার জন্য এই পদ্ধতিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাই, আলোচনায় পূর্বে এই পদ্ধতি যারা গ্রহণ করেছিল তাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর সমন্বয় করা হয়েছে।
১. বিপ্লব এবং বিপ্লবী যুদ্ধের সংজ্ঞা-
বিপ্লব বলতে বোঝায় – চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক মালিকানা এবং প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার এক বিস্তৃত এবং মৌলিক পরিবর্তন।
অন্যভাবে ‘সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরের কোনো একটা দলের দ্বারা একটি নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাকেও বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। এই নিবন্ধে, আমরা “বিদ্রোহ” এবং “বিপ্লবী যুদ্ধ” এর মতো কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহার করব।
এই পরিভাষাগুলো একটি বিশেষ ধরণের বিপ্লবী আন্দোলনকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।। এই ধরণের বিপ্লবী আন্দোলনগুলো প্রচলিত সামরিক কৌশলের বাইরে যেয়ে নতুন ধরণের কৌশল গ্রহণ করেছে। এই বিপ্লবীরা অগতানুগতিক সামরিক কৌশল, রাজনৈতিক আক্রমণ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সমন্বয়ে এক নতুন আদর্শ বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের সামনে তুলে ধরে। অন্যদিকে, ‘গেরিলা যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহারিক দিক থেকে খুব সংকীর্ণ অর্থ বহন করে।
‘গেরিলা যুদ্ধ’ দ্বারা একটি বৈপ্লবিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য স্থানীয় অগতানুগতিক বাহিনী (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তবে সবসময় নয়) দ্বারা পরিচালিত বিশেষ ধরণের সামরিক অভিযান বা আধা-সামরিক অভিযানকে বোঝায়। একটি প্রচলিত সেনাবাহিনীর চালানো আক্রমণ এবং বিপ্লবীদের আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য হল – প্রচলিত সেনাবাহিনী স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথ নিয়ন্ত্রণের দিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, বিপ্লবীরা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের দিকে গুরুত্ব দেয়। যুদ্ধে বিজয় লাভের ক্ষেত্রে এটি ভূমি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশি কার্যকর।
২. বিপ্লবের রাজনৈতিক মাত্রা-
বিশিষ্ট সমরবিদ ক্লাউসেভিতস বহু শতাব্দী আগে যা বলেছিল তা পুনারাবৃত্তি করে মাও সে-তুং, যুদ্ধ ও রাজনীতির মধ্যে মৌলিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ‘বিপ্লবী যুদ্ধ’কে ব্যাখ্যা করেছে। তার মতে, যুদ্ধ ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক হলো, যে কোনো ধরণের সামরিক অভিযান অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে হতে হবে। মাও বলেছিল,”যুদ্ধকে একমুহূর্তের জন্যেও রাজনীতি থেকে আলাদা করা যাবে না”। সে আরো বলেছিল, “রাজনীতিও এক প্রকার রক্তপাতহীন যুদ্ধ।”
তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, বিপ্লবী দলগুলো, জনগণকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে আসার জন্য – জনগণের সাথে মিশে তাদেরকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে জোরপূর্বক বিপ্লবে অংশগ্রহণ করানোর চেষ্টা করছে। এই ধরণের প্রচেষ্টাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হয় ব্যাপকভাবে। বিপ্লবী যুদ্ধের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধরণের আচরণ/পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, এটা শত্রুপক্ষকে বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা চালানোর সুযোগ করে দেয়। তবে, সন্ত্রাসবাদের এই পদ্ধতি প্রায়ই জনগণের মাঝে কোনো একটি বিপ্লবী দলের মর্যাদা বাড়ানো এবং ক্ষমতাশীল সরকারকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেইসাথে, সমাজে মেরুকরণ তৈরি হয়। সরকারী বাহিনীগুলো যারা এখনো বিপ্লবীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়নি তাদেরকে বিপ্লবীদের দলে ভেড়ানোর বেশ কার্যকর পদ্ধতিও এটি। বিপ্লবী দলগুলো এর মাধ্যমে সরকারী বাহিনীকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সরকার তাদের রক্ষা করতে সক্ষম নয়।
কিন্তু ‘সন্ত্রাসবাদ’ চরম হয়ে উঠলে এর বিপরীত প্রভাব পড়ে। ১৯৪৭ সালে গ্রিসে ঠিক এটাই ঘটেছিল। সেসময় গ্রিসের বিপ্লবী নেতারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। বিশেষ করে গ্রিসের গ্রামগুলোতে। বিপ্লবীদের ভয়ে ১৫ লক্ষ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। এর ফলে বিপ্লবীরা সেই এলাকাগুলোতে একা হয়ে পড়ে। জনগণের মাঝে মিশে থেকে তারা যে নিরাপত্তার সুবিধা পেয়েছিল তা থেকে বঞ্চিত হয়। শত্রু বাহিনীর জন্য তাদেরকে টার্গেট বানানো সহজ হয়ে পড়ে। আর এটি সেসময় তাদের পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ ছিল।
তাই তাত্ত্বিকেরা বলে থাকে – বিপ্লবীদের, সন্ত্রাসবাদকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে, জনগণের চোখে তারা হবে এমন একদল যারা বহুল আকাঙ্ক্ষিত ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালাচ্ছে। জন সাধারণ বিশ্বাস করবে যে, ক্ষমতাশীল সরকারের শোষণ–নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বিপ্লবীরা যে পথ অবলম্বন করছেন এটাই একমাত্র পথ। এটা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এই বিষয়ে মাও সেতুং আরো বলেছে, “বিপ্লবী বাহিনীর যে কোনো ধরণের অভিযান, বিশেষ করে সামরিক অভিযানগুলো অবশ্যই রাজনৈতিক লক্ষ্যেকে সামনে রেখে করতে হবে”। রাজনৈতিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে মাওয়ের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হল – এর ফলে ক্ষমতার লাগাম সবসময় রাজনৈতিক নেতাদের হাতেই থাকবে। মাও তার লেখাগুলোতে সবসময় এই নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি বিপ্লব পরিচালনার প্রধান মৌলিক বিষয়। বাস্তবেও, আমরা দেখতে পাই, পূর্বে যে সকল বিপ্লব সফল হয়েছে সেখানে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রত্যক্ষ সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক সংগঠন, মূল বিপ্লবী দলের চেইন অফ কমান্ডের বাইরে ছিল। তবে, তারা রাজনৈতিক সংগঠন বিপ্লবের মূল লক্ষ্যের প্রতি অনুগত ছিল।
গ্রামীণ অঞ্চলের বিপ্লবগুলোতে এই ধারা দেখা যায়। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম দিকে বিপ্লবীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশে শহরগুলোতে শাখা খুলত। এই শাখাগুলো থেকে তারা লজিস্টিক সরবরাহ করা, রাজনৈতিক কার্যক্রম, জনসাধারণের তথ্যসংগ্রহ করা, বন্দীদের আইনি কার্যক্রমের ব্যাপারে সাহায্য করা ও তাদের পরিবারকে সহায়তা করা ইত্যাদি কার্যক্রম চালাত। কিন্তু এই ধরণের সংগঠন যেখানে রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা আলাদা- তা মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হবে কিনা তা নিয়ে বিপ্লবের তাত্ত্বিকরা একমত হতে পারেনি। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার তাত্ত্বিকদের মতে বিপ্লব সফল করতে হলে রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা একসঙ্গে থাকতে হবে।
রেজিস ডিইব্রে ও চে গুয়েভারার অনুসারীরা মূলত রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা এক নেতৃত্বে রাখতে চায়। তারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে চায় মূলত কিউবা বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে। কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রো রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডকে এক নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে এসেছিল। বিপ্লবী যুদ্ধ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ও পূর্বে যারা এ ধরণের আন্দোলন পরিচালনা করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে – যে কোনো বিপ্লবী দলের প্রথম রাজনৈতিক লক্ষ্য হবে জনসমর্থন অর্জন করা। কারণ, পুরো বিপ্লব প্রক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি হল জনগণ। জনসমর্থন এবং সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বিপ্লবী দল ও বিপ্লবীরা একটা সন্ত্রাসীর দল/ ডাকাতের দল ছাড়া আর কিছুই না। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো বিপ্লব ও বিপ্লবীরা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
একারণে যে কোনো বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য থাকবে জনগণকে সরকারের শাসন থেকে বের করে এনে জনগণের মন জয় করা। এর ফলে জনগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিপ্লবীদের পাশে চলে আসবে। এই লক্ষ্য অর্জিত হবার পরে গেরিলা যোদ্ধাদের খাদ্য, তথ্য, বাসস্থান ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে বিপ্লব সফল করার পরিবেশ তৈরির হবে। মাও সেতুং তার “The [Three] Rules of Discipline” এবং “The Eight Factors for Attention” এর মতো লেখাগুলোতে বারবার জনসাধারণের সাথে বিপ্লবীদের সুসম্পর্ক রাখার বিষয়ে জোর দিয়েছে। মাও বারবার বলত,“পানির মাঝে মাছ যেমন মিশে থাকে, গেরিলা যোদ্ধাদের তেমনিভাবে জনগণের মাঝে মিশে থাকতে হবে”। বাহিনীর প্রতি মাও এর কতগুলো নির্দেশ দেখলে বোঝা যাবে মাও এ বিষয়টাকে কতোটা গুরুত্ব দিত। মাও’এর বাহিনীর প্রতি নির্দেশ ছিল স্থানীয় বাজার থেকে যে কোনো কিছু কেনার পর যেন তার মূল্য পরিশোধ করা হয়। স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সেখানকার অধিবাসীদের যেন সাহায্য করা হয়। শস্যক্ষেত্রগুলো যেন যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। এবং সে অঞ্চলের নারীদের সাথে কোনো অবৈধ সম্পর্ক যেন না করা হয়। এভাবে, জনগণের সমর্থন ও আনুগত্য অর্জন করতে হবে। কারণ জনগণের আনুগত্যই যে কোনো প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের মূল চালিকাশক্তি।
এই ধরণের বিপ্লবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা। বেশিরভাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিপ্লবীরা স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমান্তরালে বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে সময় ব্যয় করে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের সমান্তরাল সংস্থাগুলো, জনগণের আনুগত্যে ও সমর্থন অর্জনের ক্ষেত্রে একটি মূল বিষয় হিসাবে কাজ করে। সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন এই বিপ্লবী বাহিনীকে তার কাজের ব্যাপারে বৈধতা দেয়। একই সঙ্গে বৈধ-অবৈধ বিষয়ের ওপর সরকারের একক কর্তৃত্বের অবসান ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ চায়নার কমিউনিস্ট বাহিনীর ঘটনা দেখতে পারি। এখানে কমিউনিস্ট বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে তারা নিজেদের নিয়ম কানুন দিয়ে শাসন করত। এক রাষ্ট্রের মধ্যে এ যেন অন্য আরেক রাষ্ট্র।
৩. বিপ্লবের সামরিক মাত্রা-
বিপ্লবে,সামরিক বাহিনী গৌন ভূমিকা পালন করে। আসলে, জনসমর্থন অর্জন করাই যেকোনো বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য থাকে। তাই, সামরিক বাহিনীকে এমন ভাবে সাজানো হয় যাতে এটি জনসমর্থন আদায় করতে পারে।
তথ্য আদান-প্রদান, স্থানপরিবর্তনের সক্ষমতা, রসদ সরবরাহের স্বাধীনতা এবং শত্রুদের চমকে দিয়ে হামলা (Element of Surprise) করার মতো বিষয়গুলো যেকোনো গেরিলা যুদ্ধের ভিত্তি। এসবগুলো বিষয় জনসমর্থন ও সহযোগিতার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। তাই, বিপ্লবী দলের ক্ষেত্রে জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখা, শত্রুর পরিকল্পনা এবং চলাফেরা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে সাহায্য করে। এই তথ্য, শত্রু বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এবং শত্রুর আঘাত এড়ানোর জন্য অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার সর্বাধিক উপযুক্ত সময় বেছে নিতে গেরিলা বাহিনীকে সাহায্য করে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রাতের বেলা চলাচলের অসুবিধার কারণে ফরাসি বাহিনীর সমস্ত গতিবিধি ভিয়েতনামীরা আগে থেকে জানতে পারত। একই ঘটনা কিউবার ক্ষেত্রেও। কাস্ত্রো বলেছিল, “আমরা সর্বদা সরকারের সৈন্যদের চলাফেরার বিষয়ে জানতে পারতাম, তবে তারা আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানত না।”
খাদ্য, আশ্রয়, পরিবহণ এবং আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা – বিপ্লবীদের জন্য এই বিষয়গুলোর প্রাপ্তি সহজ করে তোলে জনসমর্থন। জনসমর্থন গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রাপ্তিতে সহায়তা করে গেরিলাদের। আর তা হচ্ছে স্থান পরিবর্তনের সক্ষমতা। সেইসাথে যদি সেই ভূখণ্ড সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকে, তাহলে বিপ্লবীরা হালকা অস্ত্র এবং সরঞ্জাম দিয়েই শত্রুদের নিয়ে খেলা করতে পারে। জনগণের সহায়তা থাকলে বিপ্লবীরা হঠাৎ আক্রমণের জন্য সময় এবং স্থান বেছে নিয়ে শত্রুর পরিকল্পনাগুলো ধূলিসাৎ করতে পারে। শত্রুরা পুনরায় শক্তিবৃদ্ধি করার পূর্বেই সহজেই দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে আসতে পারে।
জেনারেল জ্যাপ[1](Giap) গেরিলা যুদ্ধের মূলনীতির সংজ্ঞা দিয়েছিল। তার মতে, ‘এটি এমন এক ধরণের যুদ্ধপদ্ধতি, যেখানে দুর্বলপক্ষ, অল্প কিছু সরঞ্জাম নিয়ে জনগণের মাঝে আশ্রয় নেয়(জনগণের মাঝে মিশে থাকে)। এবং উন্নত সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তির শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। এপদ্ধতিতেই বিপ্লবীরা সংঘর্ষে জড়ায়। গেরিলা যুদ্ধ মূলত পরিচালিত হয় কোনো বীরোচিত মনোবল ধারণ করে। এ যুদ্ধের কিছু মূলনীতি এমন – শত্রু যখন শক্তিশালী অবস্থায় থাকে তখন তাকে এড়িয়ে যাওয়া এবং দুর্বল অবস্থায় তাদের উপর আক্রমণ করা। বিভিন্ন অবস্থান থেকে গেরিলা যোদ্ধাদের একত্রিত করা আবার কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া।
গেরিলা যোদ্ধারা সচরাচর শত্রুদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তারা সবসময় শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। তাই গেরিলা যোদ্ধাদের যুদ্ধ পদ্ধতি এমন যে, যেখানেই তারা সুযোগ পাবে সেখানেই শত্রুর উপর হামলা চালাবে। এরপর দ্রুত, পরিস্থিতি সাপেক্ষে সরে যাওয়ার যে রাস্তা থাকবে সে রাস্তা ব্যবহার করে অবস্থান পরিবর্তন করবে। এটি শত্রুদের মনোবলকে দুর্বল করে দেয় এবং শত্রুবাহিনীকে ক্লান্ত করে তোলে।
যেহেতু, গেরিলা যুদ্ধ শক্তিশালীদের বিরুদ্ধে দুর্বলদের যুদ্ধ, তাই এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এটি সমস্ত বিপ্লবী যুদ্ধের নিয়ম, কারণ এই যুদ্ধগুলো হল ক্রমান্বয়ে শক্তিক্ষয় মূলক যুদ্ধ। বিপ্লবের বীজ থেকে ফল পাবার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। তবে, ফল হঠাৎ করেও এসে পড়তে পারে। আর তখন জনসাধারণের বিপ্লবে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক গুন বেড়ে যায়।
বিজয়ের স্বার্থে, গেরিলা যোদ্ধাদের সব ধরণের সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে হবে। তার চাইতে শক্তি সংরক্ষনের জন্য আচমকা আঘাত ও তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যাওয়ার মানে অস্তিত্বের লড়াই এই মূলনীতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।। এই পদ্ধতি অনুসরণের উদ্দেশ্য হল – গেরিলা যোদ্ধারা যেন নিয়মিত বিরতিতে বার বার শত্রুপক্ষের ওপর আঘাত হানতে পারে। সুতরাং, এটি জেনে রাখতে হবে যে, গেরিলা যুদ্ধের মূললক্ষ্য – দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা নয়; বরং যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করা।
মাও, চীনের বিপ্লব পরিচালনার সময় যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটা হচ্ছে – যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কীভাবে যুদ্ধাঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়? এজন্য মাও চীনের বিপ্লবী যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে – প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঘাঁটি স্থাপনের জন্য ব্যবহার করেছিল। তারপরে, সময়ের সাথে সাথে, যখন তার বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল, তখন সে তার আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ আরও বৃদ্ধি করে। বিশেষত, শহরের আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করে।
কিউবাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। তবে দ্বীপটির ছোট আকার এবং ভূমির পার্থক্য থাকার কারণে, কিউবা বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীরা ‘গতিশীলতা’/ সহজে অবস্থান পরিবর্তনের সামর্থ্য থাকা” কে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের উপর প্রাধান্য দিয়েছিল। যুদ্ধে কৌশলের এই পরিবর্তন আনার মূল কারণ ছিল – ১৯৫৭ সালে বিপ্লব শুরু হওয়ার প্রথম পর্যায়েই বিপ্লবীদের স্থায়ী ক্যাম্পগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। একারণে কিউবান বিপ্লবী বাহিনী, শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করত এবং সুযোগ পেলেই অতর্কিত হামলা চালিয়ে শত্রুদের বিপর্যস্ত করে দিত। কিউবার বিপ্লবীরা ক্ষমতাশীলদের উপর চূড়ান্ত আঘাত না করা পর্যন্ত স্থায়ী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেনি।
ক্ষমতাসীনদের সাথে বিপ্লবীদের সংঘর্ষের ধরণ এবং এটিকে বিকশিত করার জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করাই হোক না কেন, অধিকাংশ বিপ্লবী তাত্ত্বিকরা কৌশলগত দিক থেকে বিপ্লবী যুদ্ধগুলোকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছে।
প্রথম পর্যায় হচ্ছে – পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পর্যালোচনা। এ পর্যায়ে বিপ্লবীরা জনগণের সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশে একটি রাজনৈতিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিপ্লবী সংগঠনের মূলভিত্তি তৈরি করে। আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এসময় তারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে। এবং ছোট ছোট আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে সাম্যাবস্থা তৈরির পর্যায়। এ পর্যায়ে বিপ্লবীরা শত্রুকে দুর্বল করার জন্য গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে। বিপ্লবীরা ছোট ছোট সেল তৈরি করার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায় – যেখানে বিপ্লবী দল কৌশলগতভাবে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তারা প্রয়োজনে শত্রু বাহিনীর বিপক্ষে সংঘবদ্ধ পাল্টা আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়ে উঠে। এ পর্যায়ে তারা শত্রুবাহিনীর উপর প্রচলিত সেনাবাহিনীর মতই বড় ধরণের আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়ে উঠে। বিপ্লবীরা প্রচলিত সেনাবাহিনীর সমস্ত অস্ত্রের ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্ব করে ফেলে এবং সম্মুখ লড়ায়ের সক্ষমতা অর্জন করে।
কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, উপরোক্ত তত্ত্বটি থেকে বাস্তবতা ভিন্ন। বিপ্লবী যুদ্ধের তিনটি পর্যায় রয়েছে বলে যে তত্ত্বটি রয়েছে – কেবল তিনটি ক্ষেত্রেই এই তত্ত্ব বাস্তবের সাথে মিলেছিল।
ক) চীনের গৃহযুদ্ধ;
খ) দ্বিতীয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ (যা ১৯৭৫ সালে শেষ হয়েছিল) এবং
গ) নিকারাগুয়ার[2] যুদ্ধ, যার মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল।
প্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধে অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে ‘দিয়েন দিয়েন ফু’এর যুদ্ধে জেনারেল জ্যাপ গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছিল। সেখানেও উপরোক্ত তত্ত্বের বাস্তব রূপ পাওয়া যায়নি। এটি একটি বড় ধরণের মনস্তাত্বিক বিজয় ছিল। কিন্তু এ বিজয় ফরাসী সেনাবাহিনীকে ভিয়েতনাম থেকে অপসারণ করতে পারেনি। এবং বিপ্লবী যুদ্ধ যে কারণে শুরু হয়েছিল তারও তেমন কোনো সমাধান হয়নি।
আলজেরিয় মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। সাইপ্রাসের বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিপ্লবীরা সামরিক শক্তি দ্বারা জয়লাভ করতে পারেনি। বিপ্লবীরা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষকে চড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য করেছিল। আর এভাবেই জয়ী হয়েছিল।
সংক্ষেপে বলা যায় : সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে সাধারণত কিছু সামরিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। যেমন অস্ত্র সংগ্রহ করা বা শত্রুর জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো। তবে সামগ্রিকভাবে সামরিক পদক্ষেপ, বৈপ্লবিক যুদ্ধগুলিতে রাজনৈতিক লক্ষ্যের অধীনস্থ এবং পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। তাই, বেশিরভাগ বিপ্লবী তাত্ত্বিকরা একথা মেনে নিয়েছে যে – সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সামরিক বিজয়ের কোনও মূল্য নেই যতক্ষণ না সেটি ক্ষমতাসীনদের শাসনব্যবস্থা দুর্বল করতে পারে। তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারে। শাসনব্যবস্থা দুর্বল করার জন্য সরাসরি আঘাত হানতে পারে অথবা যুদ্ধ চলাকালীন সময়টাতে জনগনের অসন্তুষ্টি বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীনদের উপর রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে পারে।
৪. বিপ্লবের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মাত্রাঃ
বিপ্লবের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলা এবং বিপ্লবকে গতিশীল করার জন্য কার্লোস মারিঘেলা[3] (Carlos Marighella) এর একটা তত্ত্ব/প্রস্তাবনা আছে- the climate of collapse। তার মতে বিপ্লবীদের, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে লড়াই করতে হবে। এটি করার উপায় হচ্ছে – প্রথমত ক্ষমতাসীনদের জুলুম ও দুর্নীতিগ্রস্থ শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তারপরে, বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ফ্রন্টের লড়াইকে নেতিবাচক দুর্নীতিগ্রস্থ অবস্থা থেকে ইতিবাচক অবস্থায় উত্তরণের উপায় হিসেবে চিত্রায়িত করতে হবে।
ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক দিকগুলো যেমন বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতিগ্রস্থ অবস্থার কারণে বিপ্লবীরা বাড়তি কিছু সুবিধা পায়। তারা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। এ কারণে বেশিরভাগ বিপ্লবী তাত্ত্বিকরা একমত যে বিপ্লব সফল হওয়ার জন্য শাসকদের থেকে অবশ্যই অবিচার/জুলুমের উপস্থিতি থাকতে হবে। তবে, এই অবিচার বা জুলুম বিপ্লব শুরু হওয়ার ও সফল হওয়ার পূর্বশর্ত কিনা সেব্যাপারে একমত নয় তাত্ত্বিকরা। মাও এর মতে – বিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বেই সমাজে অবিচার বা জুলুমের উপস্থিতি থাকতে হবে। চে গুয়েভারার মতে – বিপ্লব চলাকালীন সময়ে এটা তৈরি হবে। তবে, যারা চে গুয়েভারার কথাকে সমর্থন করে তারাও এটা মনে করে যে, একটা বিপ্লব শুরু হওয়া, গতিশীল হওয়া ও সর্বশেষ সফল হওয়ার জন্য শাসকদের পক্ষ থেকে জনগণের উপর নূন্যতম মাত্রার অন্যায়, নির্যাতন, নিষ্পেষণ থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট দেশে বিপ্লব প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যূনতম কী কী শর্তের অস্তিত্ব থাকতে হবে এই ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতে পারে। যে সমাজে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে সেই সমাজের সার্বিক বিষয়াদি না জেনে এ প্রশ্নের চূড়ান্ত কোনও উত্তর দেয়া যাবে না। একারণে, মাও এবং জ্যাপ তাদের লেখাগুলোতে সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করতে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেন বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাজে লাগিয়ে একটি নতুন বিকল্প ব্যবস্থা বিপ্লবীরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। এবং এর ফলে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়। সেই সাথে তারা এটাও বলেছে যে, এভাবে কোনো একটা দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করলে বিপ্লবীরা বুঝতে পারবে বিপ্লব জারি রাখার জন্য কোন অঞ্চল থেকে অর্থের জোগান পাওয়া সম্ভব।
যে কোনো বিপ্লব শুরু করা ও পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিপ্লবীরা কোন অঞ্চল বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বা সামনে কোন অঞ্চল সমৃদ্ধশালী হবে সেটা নির্বাচন করে সে অঞ্চল টার্গেট করে বিপ্লব শুরু করতে পারবে। কিউবার বিপ্লবকালে কাস্ত্রো এই ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কাস্ত্রো কফি উৎপাদনকারী অঞ্চলকে প্রথমে নিয়ন্ত্রণে নেয়, এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত এসকল প্রতিষ্ঠানের আয় এবং সম্পদশালী কৃষকদের উপর আরোপিত শুল্ক থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে বিপ্লব পরিচালনা করে।
একইভাবে, বিপ্লবীরা প্রায়শই তাদের শত্রুদের অর্থনৈতিক শক্তি হ্রাস করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে থাকে। একটি রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক উৎসগুলোর মধ্যে তেল উত্তোলন ও পরিশোধন কেন্দ্র, নদী ও সমুদ্র বন্দর অন্যতম। আর সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপাদানসমূহ (রাস্তাঘাট, বিমান,ট্রেন, পুল, ব্রিজ) ইত্যাদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক। বিপ্লবীরা রাষ্ট্রের পতন ত্বরান্বিত করা এবং বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসকল স্থানে হামলা চালিয়ে থাকে।
রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশে চালানো এই ধরণের হামলার মধ্যে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হামলা, জার্মান Badder Meinhof Group এর হামলা, ইতালিয়ান রেড ব্রিগেডস এর হামলা এবং Basque ETA group এর হামলা উল্লেখযোগ্য।
৫. বিপ্লবের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক মাত্রা –
রাজনৈতিক, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক সংঘাতের সাথে সাংস্কৃতিক সংঘাত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিপ্লবীদের সাথে ক্ষমতাসীনদের প্রবল সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এ দ্বন্দ্ব মূলত সমাজে বিরাজমান মূল্যবোধের সাথে বিপ্লবীরা তাদের সাথে নতুন যে মূল্যবোধ নিয়ে এসেছে সেটার লড়াই। বিদ্রোহীরা বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো জোর দিয়ে জনগণের সামনে উত্থাপন করে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনামের বিপ্লবীরা ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শোষণ, বর্বরতা, ব্যাপক নির্যাতন এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাথে অন্যান্যদের সমতার অভাবের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। এগুলোকে তারা জনগণের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিল। একই সাথে বিপ্লবীরা নিজেদেরকে জনগণের সামনে মহৎ, আদর্শবান, নিয়মানুবর্তী হিসেবে উপস্থাপন করে। জনগনকে বোঝানোর চেষ্টা করে তাদের দল এক মহৎ আদর্শ দ্বারা পরিচালিত আর এই দলের জন্য আত্মত্যাগে তারা সবসময় রাজি।
যখন বিপ্লবীরা তাদের এই দাবিগুলির সত্যতা প্রদর্শন করতে পেরেছিল তখন তারা অবিশ্বাস্য গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিউবার বিপ্লবীরাও একই কাজ করেছিল। তারা সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য হাতে থাকা সমস্ত মিডিয়া ব্যবহার করেছিল। তারা যে কোনো পরিস্থিতিকে নিজেদের মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করার সামর্থ্য অর্জন করেছিল। শত্রুপক্ষের কোন ইস্যু পেলেই তারা কঠোরভাবে সমালোচনা করত। এভাবেই তারা জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
৬. বিপ্লবের মনস্তাত্ত্বিক দিক –
বিপ্লবীদের এবং তাদের শত্রুদের মধ্যে যে সকল বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব কাজ করে এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। উভয় দলেরই লক্ষ্য থাকে নিজেদের কার্যাবলীর মাধ্যমে জনগণের মন জয় করে তাদের সমর্থন নিজেদের দিকে নেয়া। এই যুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য বিপ্লবীরা প্রধানত প্রোপাগান্ডা তত্ত্ব অনুসরণ করে থাকে। তারা প্রচলিত সিস্টেমের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালায় এবং এর মাধ্যমে জনসমর্থন নিজেদের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মাও তার লেখাতে মনস্তাত্ত্বিক লড়ায়ের ক্ষেত্রে সময়, স্থান, এবং ইচ্ছা- তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করে এদের গুরুত্ব আলোচনা করেছে। তার তত্ত্ব অনুসারে, বিপ্লবীরা সময় কেনার জন্য স্থান ব্যবহার করে এবং ইচ্ছা তৈরি করার জন্য সময়কে ব্যবহার করে।
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়ী হতে হলে অবশ্যই বিপ্লবীদের একটি কার্যকর কৌশল থাকতে হবে। গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বইগুলিতে এ বিষয়ের অনেক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, কার্লোস মারিঘেলার মতে সামরিক অভিযান চালানোর একটা মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে সে অঞ্ছলে বিদ্যমান সিস্টেম পতনের (climate of collapse) পরিস্থিতি তৈরি করা। এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সৈন্যদের ও জনসাধারণকে ক্ষমতাশীলদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এরপর এই সৈন্য ও ‘বেসামরিক নাগরিকদের’ সরকারের প্রতি আনুগত্য হ্রাস পায়। এমনকি এক সময় তা রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্থবির করে ফেলে এবং বিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
ভিয়েতনামে বিপ্লবীদের দ্বারা পরিচালিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ সফলভাবে কার্যকর হয়েছিল। সেখানে বিপ্লবীরা শত্রুর সৈন্য বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। বিপ্লবীরা জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হলে সেটা শাসকগোষ্ঠীর জন্য এক পা ভেঙ্গে দেয়ার মতো হয়। এরপরও শাসকগোষ্ঠী তাদের আরেক পা প্রশাসনের সাহায্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিপ্লবীরা শত্রুর প্রশাসনিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হলে সেটা শাসকগোষ্ঠীর জন্য দাঁড়াতে সক্ষম একমাত্র পা’টিও হারানোর মতো হয়।
তাই বিপ্লবীরা জনসমর্থন আদায়ের জন্য যা কিছু করবে তার একটা মনস্তাত্ত্বিক দিক থাকতে হবে। যার দ্বারা রাজনৈতিকভাবে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনগণের সমর্থন নিজেদের দিকে নেওয়া যায়। সামরিক অভিযান, মনস্তাত্ত্বিক লড়ায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। জনগণ ও ক্ষমতাসীনদের উপর এটার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও অনেক বেশি। এ কারণেই একজন তাত্ত্বিক এভাবে বলেছে – মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে বিপ্লবী বাহিনীর সৈন্যরা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চালানোর মূল হাতিয়ার। তারা যেখানেই যায় সেখানেই বিপ্লবের বীজ বপন করে। তারা তাদের অভিযানের মাধ্যমে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে।
সুতরাং, প্রতিটি বিপ্লবী অপারেশনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর দুর্বলতা জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। অভিযান ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে শাসকগোষ্ঠীর দেউলিয়াপনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাই, প্রতিটি যুদ্ধই/অভিযানই আসলে জনগণের প্রতি এক একটা বার্তা। জনগণের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা বৃদ্ধির বার্তা।
ক্ষমতাসীনদের উপর হামলা চালিয়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে – আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি কর্তৃক ব্রিটিশদের উপর চালানো হামলা। সেসময় আইরিশ আর্মি ব্রিটিশ বাহিনীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য প্রচুর আক্রমণ চালিয়ে ছিল। এসকল আক্রমণের মধ্যে ১৯৮৫ সালের Brighton Bombing উল্লেখযোগ্য। সে হামলায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে টার্গেট করা হয়েছিল। সেসময় আইরিশ বাহিনী তাদের হামলাগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণ বর্বরতা প্রদর্শন করত। তারা এটা এই জন্য করেছিল যেন এটা দেখে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দমে যায়। এসকল হামলা চলাকালীন সময়েও ব্রিটিশরা এই যুদ্ধে তাদের সাফল্য ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল।
৭. বিপ্লবের আন্তর্জাতিক মাত্রা –
জনগণের সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিপ্লবীরা তাদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এসময় বিপ্লবীরা, স্থানীয় ক্ষমতাসীন এবং তাদেরকে বহির্বিশ্বের যারা সমর্থন করে তাদের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে নিজেদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে। তারা, বহির্বিশ্বে নিজেদের বিপ্লবকে একটি মহৎ যুদ্ধ (noble war) হিসেবে উপস্থাপন করবে। দাউদ আলাইহিস সালাম জনসাধারণের উপর জুলুম ও নিষ্পেষণ বন্ধ করার জন্য জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। বিপ্লবীরা নিজেদের এই যুদ্ধকে জালুতের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের সাথে তুলনা করে উপস্থাপন করে। তারা দেখায় যে তাদের এই আন্দোলন বিশাল আকারের, শক্তিশালী এবং বিপুল দুর্নীতিগ্রস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে একটি মহৎ লড়াই। এভাবে মানুষের পক্ষ থেকে সহানুভূতি লাভ করে। ন্যায়বিচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।
এই পদ্ধতির সর্বোত্তম উদাহরণ হল – ভিয়েতনামের বিপ্লবী আন্দোলন। জেনারেল জ্যাপ তার বই, ‘পিপলস ওয়ার পিপলস আর্মিতে’ এই বিষয়ে তথ্য প্রমাণ লিপিবদ্ধ করেছে। সে বলেছে, ‘বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আন্তর্জাতিক জনমতকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষত, বিদেশী শত্রু রাষ্ট্রের জনমত’। এখানে শত্রু রাষ্ট্র বলতে ঐ রাষ্ট্রকে বুঝানো হয়েছে যে রাষ্ট্রের বাহিনী আঞ্চলিক বিপ্লবীদের উপর হামলা চালাচ্ছে। অর্থাৎ আঞ্চলিক বিপ্লবীরা – যে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত – সে দেশের জনগণের সমর্থন নিজেদের দিকে নেয়ার জন্য চেষ্টা করবে। প্রকৃতপক্ষে, ভিয়েতনামের বিপ্লবীরা সরাসরি মার্কিন জনগণের সমর্থন পেতে সক্ষম হয় নি। তবে আমেরিকার জনগণ, ভিয়েতনামে যুদ্ধের প্রকৃতি এবং এর ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এটি উভয় সরকারের (আমেরিকান সরকার ও ক্ষমতাসীন ভিয়েতনাম সরকার) নেতৃত্ব এবং সৈন্যদের মনোবলের উপর প্রভাব ফেলেছিল। তাই, এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে ধরা হয়। তবে, শত্রু রাষ্ট্রের জনগণের সমর্থন সর্বদা বিপ্লব সফল হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না।
সেসময় ভিয়েতনামকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো, আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আন্দোলন বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। এই ধরণের আর্থিক সাহায্য বিপ্লবের ফলাফলে খুব বেশি প্রভাব ফেলে এমন নয়। উদাহরণস্বরূপ চীন ও কিউবার ক্ষেত্রে বিপ্লবীরা বিজয় ঘোষণা এবং নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত বাহ্যিক সাহায্য বা সমর্থন তেমন একটা পায় নি। অনেকক্ষেত্রে বিপ্লব শুরু করা ও পরিচালনার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন যদি হয় যে, বিপ্লবীরা পুরোপুরি বিদেশী সহায়তার উপর নির্ভর করে তখন হঠাৎ করে এটি বন্ধ হয়ে গেলে আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে গ্রিসে এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
৮. উপসংহার –
এই শতাব্দীতে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে বিপ্লবী যুদ্ধ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসাথে শাসকদের ব্যক্তিগত ও দলগত শোষণ-নির্যাতনের কারণে রাষ্ট্র ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
বিপ্লবী যুদ্ধের মিশ্র ফলাফল রয়েছে। কোথাও এটা বিজয়ী হয়েছে, কোথাওবা পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছে। চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দো-চীন, আলজেরিয়া, কিউবা এবং নিকারাগুয়ার ক্ষেত্রে বিপ্লবী যুদ্ধগুলো সফল হয়েছিল। অন্যদিকে গ্রিস, পেরু, গুয়াতেমালা, ভেনিজুয়েলা এবং বলিভিয়ায় বিপ্লবীদের পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল। এসকল বিপ্লবের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এসেছিল যে সকল কারণে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হল – বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, গেরিলা যুদ্ধের নিয়মকানুনগুলো বাস্তবে যুদ্ধের ভূমিতে বাস্তবায়ন করতে না পারা, শত্রুপক্ষের মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক আক্রমণ যথাসময়ে যথোপযুক্ত উপায়ে প্রতিহত করতে না পারা ইত্যাদি।
জিহাদি দলগুলো – কাফের ও মুরতাদ শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে ‘বিপ্লবী যুদ্ধের’ অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ময়দানে তাঁরা বিজয় পেয়েছেন, আবার কয়েকটি ময়দানে পরাজয় বরণ করেছেন। অবশ্যই সকল জয়-পরাজয় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। তবে, তাঁদের পরাজয়ের পিছনে দুনিয়াবি যে সকল কারণ লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে অন্যতম হল – সময় ও স্থানের কথা বিবেচনা না করে বিপ্লবী যুদ্ধের সামরিক তত্ত্ব অনুসরণ করার চেষ্টা, বিপ্লবী যুদ্ধের অন্যান্য মাত্রাগুলি (রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক) বিবেচনা না করা।
সামরিক অভিযান চালানোর পাশাপাশি এসকল ময়দানেও সমন্বিতভাবে কুফফার ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ যদি তাওফিক দেন তবে ভবিষ্যতে মুজাহিদদের জিহাদ এবং বিপ্লবী যুদ্ধের সাথে তুলনা করে একটি নিবন্ধ লিখব ইনশা আল্লাহ। যেন সামনের দিনের মুজাহিদিনরা পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নেন এবং ভুলের পুনরাবৃত্তি না করেন। কুফফার ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে চলমান এই জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে ইনশা আল্লাহ।
[1] দুর্ধর্ষ ভিয়েতনামী জেনারেল। ফ্রান্স এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান বিপ্লবী নেতা। রেড নেপোলিয়ান নামে পরিচিত
[2] মধ্য আমেরিকার একটি দেশ
[3] ব্রাজিলিয়ান রাজনীতিবিদ, লেখক, মার্ক্স-লেনিনবাদে অনুপ্রাণিত গেরিলা যোদ্ধা।