শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশী
(কোনো ভূমিতে জিহাদি আন্দোলনের প্রাক্কালে নের্তৃবর্গের অনুসৃতব্য আবশ্যকীয় বিষয়াদির আলোচনা। লেখাটি ২০০৩ সালে লেখা হলেও স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ আবেদন রাখে।)
ইরাকের জনগনের উপর মার্কিন বাহিনীর হামলার সময় হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ। জোর দিয়ে বলছি এই যুদ্ধ ১৯৯১ সালের মত হবে না। মনে হচ্ছে এই যুদ্ধ সেই তুলনায় অনেক বেশী ভয়ানক হবে।
এবার আমেরিকার উদ্দেশ্য হলো আরব বিশ্বের বুকের উপর চেপে বসা এবং এই অঞ্চলের মানচিত্র পরিবর্তন করা। ওরা শুরু করবে ইরাক ও জাযিরাতুল আরবের মাধ্যমে। আর শেষ করবে ‘ফিলিস্তিন’ নাটকের মাধ্যমে।
তাদের আশা হলো কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করা। এই কথাগুলো কিন্তু নিছক অনুমানভিত্তিক ধারণা নয়।
বরং গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন গবেষণা, আমেরিকার সিদ্ধান্তসমূহের বিভিন্ন দিকের বিস্তারিত বিশ্লেষণ থেকে এগুলো জানা গেছে। অনেকের কাছেই এ বিষয়গুলো গ্রহনযোগ্যতা লাভ করছে। তাছাড়া বর্তমানে আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের দ্বারাও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
এসমস্ত বিষয় প্রমাণ করে, হোয়াইট হাউজের টেবিলে বসে আমেরিকা সবকিছুর পরিকল্পনা বহু আগ থেকেই করেছে।
আরব রাষ্ট্রগুলোর পূর্ণ আনুগত্য পাবার পর এখন আমেরিকা তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তারা এমন অনেক ইসলামিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে, যারা অনেক আগেই আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে গিয়েছে। জিহাদ পরিত্যাগ করেছে।
অতএব, সামনের মারহালার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। একা একা বা জামাতবদ্ধভাবে যেভাবেই সম্ভব হয়। যেন এই যুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর যে সম্মান এখনো অবশিষ্ট আছে, আমরা তা ধরে রাখতে পারি।
এই যুদ্ধে যে পরাজিত হবে সে ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। আর যে বিজয় লাভ করবে সে স্থায়ীভাবে টিকে থাকবে।
শত্রু সম্পর্কে যতবেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তাদের পরিকল্পনা কী কী তা জানতে হবে। তারপর, দ্রুত এবং দৃঢ়তার সাথে আমাদের নিজেদের পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ সামনের ঘটনাগুলো হঠাৎ করেই ঘটে যাবে। আর আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী ও তাওফিকদাতা।
১-শত্রু চেনা
আমেরিকার যুদ্ধ পদ্ধতি
এ বিষয়ে আমরা বেশি কথা বলব না। কারণ একথা কারো কাছেই অস্পষ্ট নয় যে, বর্তমানের তাগুত আমেরিকা যুদ্ধের ক্ষেত্রে চুড়ান্ত নৃশংস পন্থা অবলম্বন করে। শত্রুকে প্রভাবিত করার জন্য নিরস্ত্র জনতার উপর ‘ব্যাপক হামলা’র নীতিতে চলবে। এটাই সেই যুদ্ধ কৌশল যাকে ‘ব্যাপক আক্রমণ’ বা ‘Total war’ বলে।
‘Total war’ বা ‘ব্যাপক আক্রমণ’ হলো যুদ্ধের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট এলাকায় সব ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করে কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই আক্রমণ চালনো হয়। এক্ষেত্রে সশস্ত্র-নিরস্ত্র (সামরিক-বেসামরিক) লোকের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয় না।
সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের জন্য একান্ত জরুরী- এমন বিষয়গুলোও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রেহায় পায় না। আক্রমণের মূল উদ্দেশ্যই থাকে – শত্রু সমাজকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি ব্যবস্থাপনা, চলাচলের রাস্তাঘাট সবকিছুর উপর হামলা চালানো হয়।
সমর ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুদ্ধকৌশল আমেরিকার সামরিক চিন্তা চেতনার অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। Total war এর দিকে তারা ঝুঁকেছে ‘মার্কিন গৃহযুদ্ধের’ পর থেকে। ১৮৬১-১৮৬৫ সালের এই গৃহযুদ্ধে আমেরিকার বিভিন্ন গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছিল। গৃহযুদ্ধের সময় একজন জেনারেল একটি মতাদর্শ প্রচার করল- আমেরিকানরা, যুদ্ধে রেডক্রসের নীতিতে বিশ্বাসী নয়। তাই, আমেরিকার উপর রেডক্রসের নীতি চাপিয়ে দেয়া যায় না।[1]
অমানবিক আচরণের অনুমতি পেয়ে উত্তরের সৈন্যরা দক্ষিণের সৈন্যদের উপর বিজয়ী হয়েছিল। তারা শত্রুর সমস্ত সম্পদের উপর হস্তক্ষেপ করেছিল। উত্তরের সৈন্যদের প্রধান যে জেনারেল, সে যুদ্ধ শেষে অহংকার করে বলেছিল – ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির পুরোটাই শত্রুর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরের সৈন্যদের যুদ্ধে রাজি করাতে খরচ হয়েছে ২০ মিলিয়ন। আর বাকি ৮০ মিলিয়ন ডলারের পুরোটাই খরচ হয়েছে ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞ চালাতে।
এলোপাতাড়ি বোমাবর্ষণ, ব্যাপকভাবে স্থাপনা ও ফসলের উৎসগুলো ধ্বংস করার কারণে সৃষ্ট দূর্ভিক্ষ ও মহামারিতে আমেরিকার পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলছি, এই নৃশংস ঘটনা একই জাতির মাঝে যুদ্ধের ক্ষেত্রে হয়েছিল। তারা একই ভাষা, একই দেশ, একই ধর্মের লোক ছিলো। অল্প কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবিরোধ ছিলো।
একটু চিন্তা করে দেখুন, কীভাবে এক দেশের মানুষ হয়েও তারা একে ওপরের সাথে এমন আচরণ করতে পারল? অথচ ওরাই দাবী করে যে, তারা স্বাধীনতা ও সভ্যতার ধারক-বাহক। এ থেকেই বুঝা যায় পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে তাগুত আমেরিকা কীভাবে এই নৃশংসতা চালিয়েছে এবং বর্তমানে চালাচ্ছে।
এখান থেকে যে শিক্ষা নেয়া উচিৎ তা হলো:-
১. ‘নিরস্ত্র শহরবাসীদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা;
২. অবকাঠামো (পানির ট্যাঙ্ক, পাওয়ার হাউজ, ফসলি জমি, খাদ্যগুদাম) পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবার পর কঠিন জীবন-যাপন করার মানসিক প্রস্তুতি থাকা;
৩. এই ব্যাপক কুরবানী পেশ করার উপর ধৈর্য ধারণ করাই হলো এই বিশাল শত্রুকে পরাজিত করা ও দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করার একমাত্র মাধ্যম- এই বিষয়টি অনুধাবন করা।
বর্তমান মার্কিন সমর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যঃ
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা তার আসল পরিকল্পনা গোপন করতে মরণপন চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে পরিকল্পনার ধারণাপ্রসূত কোনো কথা প্রকাশ পেয়ে যায়। তবে কিছু তথ্য এমন যা গোপন করা যায় না। রেখে যাওয়া পদচিহ্নের মত থেকে যায়। যা থেকে বিচক্ষণ ব্যক্তিদের একটি দল এর ভেতরে লুকোনো সূক্ষ্ম রহস্য বের করে আনে।
সর্ব প্রথম যিনি আমেরিকার গোপন সামরিক পরিকল্পনাগুলোর বের করে আনেন, তিনি হলেন সা’আদ উদ্দিন আশ-শাযেলি। যিনি ১৯৭৩ এর অক্টোবরে মিশর যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর লিডার ছিলেন।
এই সা’আদ উদ্দিন আশ-শাযেলির দলই ‘আমেরিকার যুদ্ধের জন্য পছন্দনীয় মূলনীতির’ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ শুরু করেছে।
আমেরিকার মূলনীতি হল- যথাসম্ভব স্বল্প হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে (নিজ বাহিনীর ক্ষেত্রে), যথাসম্ভব কম সম্পদ ব্যয়, যথাসম্ভব অল্প সময়, এবং যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক ও আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন অর্জনের মাধ্যমে কাজ সমাধা করা।
প্রত্যেকটি মূলনীতির সাথে সম্পৃক্ত অনেক তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণের পর শাযেলির দল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, ইসরাইলই হলো সেই স্থান যেখান থেকে ক্রুসেডার ইহুদীবাদী সেনারা যাত্রা শুরু করবে।
কারণ এই অঞ্চলে ইসরাইলই আমেরিকার প্রধান মিত্র। তাছাড়া ইসরাইল, সৈন্য সমাবেশের উত্তম জায়গা। ইরাক যুদ্ধে তারা ন্যাটোকে যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্য সরবরাহ করেছে।
এছাড়া, তারা খুব অল্প সময়ে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম। সেনাবাহিনীতে যোগদাদের এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রিক্রুটদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতেও সক্ষম ইসরাইল।
একারণে শাযেলি চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভবিষ্যতের ক্রুসেডে ইসরাইলই সৈন্য সমাবেশের প্রধান ঘাঁটি হবে। কুয়েত ও তুরষ্ক দ্বিতীয় স্তরের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।
সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় এমন অনেক খবরাখবর এসেছে যা শাযেলির এই মতবাদকে আরো দৃঢ় করে। একটি পত্রিকার সংবাদ ছিল এমন – ‘আমেরিকা ও ইসরাইল বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও খাদ্য মজুত করছে’।
আরেক জায়গায় এসেছে ‘আমেরিকা ও ইসরাইলের সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে’। এটা তাদের যৌথ হামলার পূর্ব প্রস্তুতি।
এছাড়া, জর্ডানে ইসলামি কার্যক্রমের উপর তারা খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। ইসরাইলের স্বার্থবিরোধী যে কোনো কাজের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। আর মা’আন শহরের অধিবাসীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। গোত্র/দলগুলোর অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এছাড়া, প্রস্তুতি স্বরূপ কুদস-ওমান সড়ক পূণঃনির্মাণ করা হয়েছে। অথচ, এই সড়ক ১৯৬৭ সাল থেকে বন্ধ ছিল। এখন সূর্যের মতো স্পষ্ট যে, ইরাক ধ্বংসের পরিকল্পনাকারীরা জর্ডানের সদর দরজা ব্যবহারের জন্যই জর্ডান সরকারকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
এই বিশ্লেষণের ফলাফল হলো- মুসলিম ভূমিগুলোকে কেন্দ্র করে আমরা একটি বড় ধরণের ইহুদীবাদী যুদ্ধের সম্মুখীন। এক্ষেত্রে মুসলিম ভূমিগুলোর আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদই ক্রুসেডারদের একমাত্র লক্ষ্য নয় (যদিও এই সম্পদের প্রতি ইসরাইল দীর্ঘকাল যাবত লালায়িত হয়ে আছে)। বরং ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে সিনাই অথবা জর্ডানের দিকে তাড়িয়ে দেয়াই তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিনকে মুসলিমশূন্য করতে চায়। এটাই ইহুদীদের আসল চাওয়া। এর থেকে জঘন্য বিষয় হচ্ছে- তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে চুড়ান্তভাবে আঘাত হানা ও মুসলিমদের পবিত্র জায়গাসমূহকে অপবিত্র করতে চায়।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে বড় এক ধাক্কার মুখোমুখি হতে হবে। বিশেষ করে জর্ডান, ইরাক ও কুর্দিস্তানে। আর সর্বশেষে জাযিরাতুল আরবে।
২.আগত মারহালার প্রস্তুতি
আরব সৈন্যরা হিসেবের বাইরে…
কেউ কেউ বলতে পারেন, মাঝে মাঝে তো এই আরব সৈন্যরা নানা পদক্ষেপ নিয়ে ক্রুসেডারদের পরিকল্পনায় বাঁধা দানকারীর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আফসোস! এ বিষয়টি এখন সবাই জানে যে, দীর্ঘদিন যাবত তারা সংঘাতের সমতার বাইরে চলে গেছে। এটা সম্ভবত বর্তমান তাগুত আমেরিকা ও তার চেলা চামুন্ডাদের আরব রাষ্ট্রে তাদের নব্য ক্রুসেড ও উপনিবেশের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণেই হয়েছে।
আরব সৈন্যরা শুধু মুসলিমদের সমূলে উৎপাটন করার জন্যই ট্রেনিং নিয়েছে ও অস্ত্র ধারণ করেছে। দীর্ঘকাল থেকে তারা অন্য কোনো কাজের যোগ্যতা হারিয়েছে। আর প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের যৌথ যে প্রশিক্ষণগুলো হয় তা শুধু এই সেনা কমান্ডারদের মুসলিম জাতিকে সমূলে উৎপাটনের জন্য প্রশিক্ষিত করানোর জন্যই হয়। সেইসাথে সাদা চামড়ার ইহুদীবাদী নেতাদের প্রতি কোমল ও অনুগত থাকার শিক্ষাও এই প্রশিক্ষণগুলোতে দেয়া হয়।
এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়ি-ঘরের জন্য কাঁদার সময় নয়। কারণ এতে কোন লাভ নেই। বরং বাস্তব কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা জরুরী। যাতে আমরা কল্পনা ও আকাশ-কুসুম স্বপ্নমুক্ত তথ্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারি।
এই চিন্তা অবান্তর যে, “এই আত্মমর্যাদাহীন, ইসলামী মূল্যবোধহীন সেনাবাহিনী সময়মতো ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে”। এটা এমন একটা ধারণা, যার উপর কোন ভরসা করা যায় না।
সান্ত্বনার কথা হলো, বর্তমানে মুসলিমরা সরকারী সেনাবাহিনী ছাড়াই, নিজেরা কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ইতিহাসে এটাই প্রথম নয়। পূর্বেও ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমরা নিয়মিত সেনাবহিনী ছাড়াই যুদ্ধ করেছে। কারণ, তখন সেনাবাহিনী সাংগঠনিক দুর্বলতা ও গাদ্দারীসহ বিভিন্ন কারণে ক্রুসেডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত ছিলো। এরপর আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের উপর দয়া করে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি ও সালাহুদ্দিন আয়্যুবী রহিমাহুল্লাহর মতো ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা এই যুদ্ধের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়েছেন। এ বিষয়ে উসামা বিন মুনকিযের লেখাগুলোর উপর দৃষ্টি বুলালেই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
বিগত দুই দশক সাক্ষী যে, মুসলিম উম্মাহ কোন রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য ছাড়াই দ্বীন ও উম্মতকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছে এবং সফলও হয়েছে। যেমনঃ আফগান, চেচনিয়া, সোমালিয়া।
মুজাহিদরা উম্মতের আশা
আমরা দেখতে পাই – পূর্ব-পশ্চিমে যখনই ইসলাম ও মুসলমানের উপর কোন আঘাত আসে তখনই মুজাহিদরা (তাদের সর্বাগ্রে আল-কায়েদার মুজাহিদরা) দ্বীন ও উম্মতের হেফাযতের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আফগানিস্তানের উপর হামলার পুরো সময়টাতে মুজাহিদরা অটল ছিলেন এবং দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছেন। তাঁরা খুব ভালোভাবেই শত্রুকে পরাজিত করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, এখন তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করতেও সক্ষম। এর দ্বারা বুঝা যায় ভবিষ্যতের যুদ্ধে তাঁরা বড় অবদান রাখতে পারবেন। আর ইহুদীদের নৃশংস হিংস্রতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের মুজাহিদরা যেভাবে দৃঢ়তার সাথে লেগে আছেন, তাতে বুঝা যাচ্ছে ভবিষ্যতে এরাই ইহুদীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।
এসব কিছু প্রমাণ করে যে, মুজাহিদরা তাঁদের প্রচেষ্টাকে শুধুমাত্র আরব বিশ্বকে রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি। ইনশা আল্লাহ তাঁরা খুব শীঘ্রই আমেরিকার ইহুদীবাদী পরিকল্পনার সামনে মজবুত দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন। আল্লাহর পরে তাঁরাই মুমিনদের আশার স্থল।
বসে থাকা দলসমূহ
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ আরবই ক্রুসেড যুদ্ধের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায়নি। বরং তাঁরা দূর থেকে ‘দেখি কী হয়?’ বলে নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। এই অবস্থান পরিবর্তনের সময় এসেছে।
এখন এক তীব্র ‘ব্যাপক যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। সব থেকে উত্তম হলো– প্রস্তুতির কাজটি কিছু নিয়মকানুন মেনে করা। এ জন্য সামনের পরিকল্পনাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন-
- দল
দেশে বিদ্যমান কোনো জিহাদি দলের সাথে যুক্ত হওয়া যুদ্ধের মারহালা বা স্তরগুলো অতিক্রম করার জন্য জরুরী। এটা জিহাদি প্রচেষ্টায় সাহায্য করে এবং জিহাদি অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে শত্রুকে হতাহত করার মাধ্যমে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ বৃদ্ধি করবে। একটি জিহাদি দলের সাথে যুক্ত থাকলে সহজেই জিহাদে লেগে থাকা যায়।
কিন্তু যদি দেশে এরকম কোনো দল না থাকে অথবা নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁদের সাথে যোগ দেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে এটা – বসে থাকার কোন ওজর বলে বিবেচিত হবে না। বরং এমন ব্যক্তির করণীয় হলো নিজেই একটি ক্ষুদ্র পরিসরে দল গঠন করা। যারা নির্দিষ্ট কিছু বিষয় প্রতিরোধ করার টার্গেট করবে।
এই নতুন দলটি নিজের ঘরের লোক দ্বারাও হতে পারে। আবার আত্মীয়স্বজন, পাড়া-মহল্লার সাথীদের নিয়েও করা যেতে পারে। অর্থাৎ সমাজের যে কোনো স্তরের লোকজন দ্বারাই হতে পারে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো যারা প্রতিষ্ঠাতা থাকবেন, তাঁদেরকে সবচেয়ে বেশি সাহসী হতে হবে এবং মারহালাগুলো অতিক্রম করার জন্য কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। দলের সদস্যদের যোগাযোগ খুব মজবুত থাকতে হবে, যাতে যুদ্ধের সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়।
নতুন এই দল গঠন ‘কাট অফ’ পদ্ধতিতে করলে ভালো হবে। অর্থাৎ একজন সাথী বেশি সদস্যকে চিনবেন না। এটাই দল গঠনের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাছাড়া, জিহাদি কাজের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যও এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর। এই প্রকারের দল চেইন সিস্টেমে সংযুক্ত বিভিন্ন ছোট ছোট দলের সমষ্টি নিয়ে গঠিত হয়। আর প্রত্যেক দল শুধু অন্য দুই একটি দলের সাথে মিলিত হয়।
এই ধরণের দলীয় রূপরেখার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো- নিরাপত্তাজনিত আঘাত বা সমষ্টিগত বন্দিত্বের কারণে দল ভেঙ্গে যায় না।
- নিরাপত্তা
নতুন মুজাহিদদের জন্য সব থেকে বেশি জরুরী হলো- নিরাপত্তার নিয়ম-কানুনের প্রতি যত্নবান হওয়া। সাধারণ জনগণের মত থাকা। পেশাগত পরিচয়ে থাকা। এই দুইভাবে নিরাপত্তা বজায় রাখাই হলো এই মারহালার মূল শিরোনাম। নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে হালকা মনে করা, অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা, কাজের ক্ষেত্রে উদাসীনতা- এগুলো এই মারহালার কিছু নেতিবাচক বিষয়। দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এসকল নেতিবাচক বিষয় দূর করতে হবে।
নতুন দলে দুই প্রকার নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা জরুরী। এক. অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও দুই. বাহ্যিক নিরাপত্তা।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা : দলের অভ্যন্তরীণ তথ্যসমূহকে সংরক্ষণ করা। সংগঠনে নতুন যোগদানকারীদের কাছ থেকে তথ্য গোপন রাখা। বিশেষ করে যখন দল বড় হয়ে যায়। অন্যভাবে বললে, কাজের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই তথ্য দেয়া (Need to know basis)। নিরাপত্তার বিষয়াবলীকে খুব শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। যাতে ভিতরের তথ্য প্রকাশ না হয়ে যায়। এর ফলে ওৎ পেতে থাকা শত্রু জিহাদি দল সম্পর্কে কোনো তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হবে।
(এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যুদ্ধক্ষেত্রে আরব সৈন্যবাহিনীর অনুপস্থিতি ইসলামের কল্যাণের জন্য নয়। বরং কুফফার বাহিনীকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করার জন্যই তারা অনুপস্থিত। তাই তারা দ্বীন কায়েমের পথে আসবে, সাহায্য করবে এমন আশা করা যায় না। সুতারং সাবধান!)
মোটকথা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে দলের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় তথ্য যেন গোপন থাকে। দলের শাখাগত সব বিষয় যেমন গোপন রাখতে হয়, তদ্রুপ অভ্যন্তরীণ যে বিষয়গুলো শত্রুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ যেমন: সদস্যদের ঠিকানা, পরিচয়, সামরিক ঘাঁটি ইত্যাদিও গোপন রাখতে হবে।
বাহ্যিক নিরাপত্তা: শত্রুর তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিশেষ করে মার্কিন যোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার নীতিমালাগুলো পূর্ণাঙ্গরুপে মেনে চলা।
- বাছাই ও বিন্যাসকরণ
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গুরুত্বপূর্ণ নির্দিষ্ট কিছু বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির উপর দিয়ে দেয়া। (দল বড় হয়ে গেলে কয়েকজনকে এক বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট করণ)। কিছু ভাইকে নিরাপত্তা বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে। কিছু ভাইকে লজিস্টিকস (অস্ত্র, গুদাম, যোগান ইত্যদি) এর জন্য রাখতে হবে। কিছু ভাইকে সাহায্য বিভাগে রাখতে হবে (আশ্রয়, চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য)। কিছু ভাইকে রাখতে হবে বিশেষ অপারেশনের জন্য।
আর সৈন্য সংগ্রহ করার জন্য – সবচেয়ে ভালো হয় যদি দলের মূল ব্যক্তিরা বাদে বহির্বিভাগের কোন গ্রুপ এই দায়িত্ব পালন করে। এতে করে কোন প্রকার তথ্য ফাঁস হওয়া বা গুপ্তচর অনুপ্রেবেশের সম্ভাবনা ছাড়াই নতুন সাথীদের খুব ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে নেয়া যাবে।
- নেতৃত্ব গুণ অর্জন করা
উঁচু মনোবল ও দৃঢ়তা
এ দুটি এমন গুণ যা প্রত্যেক মুজাহিদের জন্য আগত মারহালার মাঝেই অর্জন করতে হবে। কারণ এই ময়দানে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। কঠিন মানসিক ধাক্কা খেতে হয়।
এই ধাক্কা তারাই সামলাতে পারে যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা এই দুটি গুণ দান করেছেন। এই ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের অভিজ্ঞতা সামনে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
তাঁরা জিহাদ শুরু করেছিলেন একদম সাধারণ মাধ্যম দ্বারা। কিন্তু তাঁদের অবিচলতা ও উঁচু মনোবলের কারণে আস্তে আস্তে তারা জিহাদের ময়দানে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। অথচ তাঁদেরকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এমন এক হিংস্র শত্রুর – যারা হামলার ক্ষেত্রে নির্দয়। রক্তপাত ঘটাতে কোনো কার্পণ্য করেনা।
- উদ্ভাবনী শক্তির অর্জন ও প্রয়োগ
এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা নবগঠিত দলের জন্য খুব জরুরী। সব সমস্যারই সমাধান আছে। আল্লাহ সব রোগেরই ওষুধ তৈরী করেছেন। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের পর জরুরী হলো- মেধার বিকাশ ঘটানো ও অন্যদের থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
শুরু থেকেই প্রত্যেকটি কাজ ও কর্মপদ্ধতির উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। যাতে একবার এক পদ্ধতি ব্যবহারের পর শত্রু আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে।
এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, আরব ভূখন্ড এক কঠিন মারহালার অপেক্ষায়। এর জন্য প্রয়োজন বড় ধরণের কুরবানী। মালহামাতুল কুবরার বাস্তব প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আর এভাবে চলতে থাকবে।
তাই এই মারহালার কৌশল এমন হওয়া উচিৎ যা নিজ দলের মুজাহিদরা ছাড়া ইহুদী-নাসারাসহ অন্য কেউই বুঝবে না। এমন কৌশল রসূল সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর -ওহুদে গ্রহণ করেছিলেন। আমরা সেখান থেকে শিক্ষা নিব ইনশা আল্লাহ।
সুত্র- পাক্ষিক অনলাইন ম্যাগাজিন আল-আনসার, বাইশতম সংখ্যা, ১লা শাওয়াল ১৪২৩ হিজরি, ৫ ডিসেম্বর ২০০২ইং, পৃষ্ঠা: ৯-১৬
[1] Russell frank weigley. the american way of war: a history of united states military strategy and policy (paperbac 1978)