শায়খ আলী আল-খুদাইর

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

শায়খের রচনাবলী

আলী বিন খুদাইর বিন ফাহাদ আল-খুদাইর। তিনি ১৩৭৪ হিজরীতে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। কাসীমে অবস্থিত জামিয়াতুল ইমাম থেকে ১৪০৩ হিজরীতে উসূলুদ – দ্বীনে ডিগ্রী নিয়ে বের হন। Continue reading

শায়খ ফারিস আয-যাহরানি

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

শায়খের রচনাবলী

শায়খ ফারিস আহমাদ জামান আল-শুহাইল আয-যাহরানি। কুনিয়া আবু জান্দাল আল আযদি। জন্ম ১৩৯৭ হিজরি (১৯৭৭ ইং)। জন্মস্থান যাহরানের ভূমির আল-জাওফা গ্রামে।

শায়খ ফারিস আয-যাহরানির পড়াশুনার প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয় গ্রামের স্কুলে। হাই স্কুলে পড়ার সময় শায়খ কুরআন হিফয করেন এবং হিফযের উপর ইজাযাহ লাভ করেন। হাইস্কুল শেষ হবার সাথে সাথেই শায়খ ফারিস ভর্তি হন মদিনার উলুম আল-কুরআন কলেজে। কিন্তু এক সেমিস্টার শেষ করেই তিনি ভর্তি হন ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। Continue reading

শায়খ আহমাদ মুসা জিবরিল

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

শায়খের সকল লেখা/অডিও বয়ান পেতে ভিজিট করুন

শায়খ আহমেদ মুসা জিবরীলের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। তার পিতা শায়খ মুসা জিবরীল রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন মদীনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সুবাদে আহমেদ মুসা জিবরীল শৈশবের বেশ কিছু সময় কাটান মদীনায় । সেখানেই ১১ বছর বয়সে তিনি হিফয সম্পন্ন করেন। হাইস্কুল পাশ করার আগেই তিনি বুখারী ও মুসলিম শরীফ মুখস্ত করেন। কৈশোরের বাকী সময়টুকু তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই কাটান এবং সেখানেই ১৯৮৯ সালে হাইস্কুল থেকে পাশ করেন।

পরবর্তিতে তিনি বুখারী ও মুসলিম শরিফের সনদ সমূহ মুখস্ত করেন আর এরপরে হাদিসের ৬টি কিতাব (কুতুব সিত্তাহ) মুখস্ত করেন। এরপর তিনিও তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরন করে মদীনার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরীয়াহর উপর ডিগ্রী নেন। Continue reading

সংশয়ঃ মুফতি তাকি উসমানির দারুল হারব-দারুল ইসলাম সংক্রান্ত সংশয়

মুফতি আব্দুল ওয়াহহাব (দা বা)

ডাউনলোড

দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের মাসআলা ইসলামী শরীয়তের একটি বুনিয়াদি মাসআলা যার উপর আরো অসংখ্য মাসআলার ভিত্তি। ‘ফিকহ’ তথা ইসলামী আইন শাস্ত্রের সকল কিতাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর আলোচনা রয়েছে এবং এর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য অগণিত মাসআলা বর্ণিত হয়েছে।

Continue reading

শাসনকর্তৃত্ব

শাসনকর্তৃত্ব

পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ও বিশ্লেষণ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

শাসনকর্তৃত্ব

পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা…গবেষণা ও বর্ণনা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম তার বিশ্বস্ত রাসূলের উপর।

আম্মাবাদ:

আমি ১২/১/১৪২৪ হিজরীতে এ বিষয়ে লিখেছিলাম এবং তা প্রকাশও করেছিলাম। কিন্তু তাতে আমার উপর কিছু প্রশ্ন আরোপিত হয়। বিরোধীদের থেকেও অনেক অভিযোগ আসে। কিন্তু তাদের প্রশ্ন ও আপত্তি আমাকে আরও দৃঢ় করেছে।

যখনই কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে এসেছে, তার কথার পূর্বে চেহারায়ই দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। তাই আমি যুক্তি ও বর্ণনার মাধ্যমে মাসআলাটিকে পর্যালোচনা করেছি। তাতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের উক্তি সংযোজন করেছি এবং পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার মাধ্যমে মাসআলাটিকে স্পষ্ট করেছি।

আমি মনে করি, এটা ইবনে আব্বাস রা: এর বর্ণনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ। আমি তা থেকে এই সারনির্ধাস বের করেছি যে, ইবনে আব্বাস রা: এর বর্ণনাটি ইজমার বিপরীত নয়। বরং তিনিও কুফরের প্রবক্তাদেরই একজন।

এখানে কেউ চমকে উঠতে পারে এবং বিরোধীগণ হতবাক হয়ে যেতে পারেন, যখন দেখবেন, ইবনে আব্বাস রা: তাদের বিরুদ্ধে! কিন্তু কে পারে সৃষ্টির উপর হককে প্রাধান্য দিতে??

কে পারে অন্ধ অনুকরণ পরিত্যাগ করে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সা: এর বিশুদ্ধ সুনাহকে আকড়ে ধরতে??

কে পারে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্থীয় প্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে??

উত্তর হচ্ছে, যাকে আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন কেবল সে ই।

উপক্রমণিকা

আমরা যে বিষয়টির অবতারণা করেছি, আল্লাহর সৃষ্টিতে এমন কিছু নেই, যা তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা কতিপয় সুস্পষ্ট কারণে ও সমুজ্জল প্রমাণের ভিত্তিতে। এটি সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর এবং চূড়ান্ত ভয়াবহ বিষয়।

এর মাধ্যমেই অনেক জাতির উত্থান হয় এবং অনেক জাতির হয় পতন। এর মাধ্যমেই অনেক জাতি উন্নতির শিখরে আরোহন করে আর অনেক জাতি হয় লাঞ্ছিত ও অপদস্ত।

সময়ের দাবি, কালের প্রতিকূলতা ও যুগের ফিতনার কথা বলে কত মানুষ এতে দিকভ্রান্ত হয়েছে, কত মানুষ ফিতনায় পড়েছে আর কত মানুষ হয়েছে মুরজিয়া! তার পরিসংখ্যান আল্লাহই ভাল জানেন।

সে বিষয়টি আর কিছু নয়; শাসনকর্তৃত্ব

এ ধরণের বিষয় প্রবৃত্তির তাড়না, দুনিয়ার সম্পৃক্ততা, স্বল্প ইলম বা কম বুঝের দ্বারা সমাধান করা যায় না। কারণ, এর কারণে সম্মুখীন হতে হয় ভয়াবহ পরিণতির, কঠিন অবস্থার।

একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন, এ বিষয়টি আমার কত সময় নিয়েছে! আমি এর গভীরতা ও চুড়ান্ত ফলাফলের ব্যাপারে কত চিন্তা করেছি! হয়ত তা দশ বছরেরও অধিককাল হবে।

এটা আমার অন্তরকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, আমার হৃদয়কে চুর্ণ-বিচূর্ণ করছিল আমি এর অনেক ব্যতিক্রমী বিষয়, উপকারী কথাবার্তা, দুর্লভ জ্ঞান ও বিভিন্ন মূলনীতি সম্পর্কে অবগত হয়েছি।

আর আমি সর্বান্ত আল্লাহর কিতাবকে আকড়ে থেকেছি। আমার অবস্থা এমন ছিল যেন, আমি রক্ত দিয়ে তা অঙ্কন করেছি এবং সেই অমূল্য কালি দিয়ে তা লিখেছি, যা মহা পেরেশানী ও কঠিন চিন্তার দিন আল্লাহর দরবারে আমার জন্য সুপারিশ করবে৷

এই কথাটির কারণে আমি আমার অনেক এমন বন্ধুকে পরিত্যাগ করেছি, যারা এখন আমার শক্র হয়ে গেছে। এমন অনেক সহপাঠিদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি, যারা আমার জীবনের সঙ্গী ছিল।

শুধু তাদের এমন কতিপয় কথার কারণে, যা অন্ধ অনুকরণ ও নিছক অনুসরণের সৃষ্ট। কিন্তু আল্লাহই আমার লক্ষ্য। তিনিই আমার অভিভাবক ও আমাকে সরল পথের দিশা দানকারী।

দৃষ্টি আকর্ষণ:

আমি যে তথ্যসূত্র ও দলিল-প্রমাণ নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব, তা কেবল তার কিতাব ও তার নবী সা: এর সুন্নাহয় যা পেয়েছি তা ই।

যা ধর্মচ্যুত রাফেযীদের বুঝের মত নয়, নাস্তিক জাহমিয়াদের মত নয়, অগ্নিদগ্ধ মুরজিয়াদের মত নয় এবং না বিচ্ছিন্নতাবাদী খারিজীদের মত।

বরং উম্মাহর সেই সকল নেককার পূর্বসূরীদের বুঝের আলোকে, যারা স্বীয় প্রভুর নূর দ্বারা স্পষ্ট দলিল আকড়ে থেকেছেন।

সাহাবা ও তাবেয়ীগণের নিদর্শনাবলী থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত অন্বেষণ করেছি এবং অশুদ্ধ বিষয়কে শুদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত থেকেছি।

আর প্রত্যেকটিই করেছি সর্বাধিক স্পষ্ট বর্ণনা ও শক্তিশালী প্রমাণের আলোকে।

আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি:

নামায, রোজা, জবাই, দু’আ, মান্নত ইত্যাদি ইবাদতসমূহের মত শাসনকতৃত্বও একটি ইবাদত। এগুলোর মাঝে কোন ব্যবধান নেই।

এর দলিল হল আল্লাহর কিতাব। আল্লাহ তা”আলা বলেন:

{إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ أَمَرَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ}

শাসন একমাত্র আল্লাহরই জন্য, তিনি আদেশ করেছেন, তোমরা একমাত্র তারই ইবাদত কর। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।সুরা ইউসুফ ১২:৪০ ]

পবিত্র সত্ত্বা আরও বলেন:

{وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ}

“তিনিই আল্লাহ। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। ইহলোকে ও পরলোকে প্রশংসা শুধু তারই জন্য।

শাসনের অধিকারও শুধু তারই আর তোমাদেরকে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করানো হবে।” [ সুরা কাসাস ২৮:৭০ ]

পবিত্র সত্ত্বা আরও বলেন:

{إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ}

“শাসন শুরু আল্লাহরই জন্য। আমি তার উপরই ভরসা করেছি আর ভরসাকারীদের তার উপরই ভরসা করা উচিত।”[ সুরা ইউসুফ ১২:৬৭ ]

পবিত্র সত্ত্বা আরও বলেন:

(أَلاَ لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ)

“জেনে রেখ শাসন শুধু তারই অ্ধিকার। তিনি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।”

 [ সুরা আন’য়াম ৬:৬২ ]

পবিত্র সত্ত্বা আরও বলেন:

(وَكَذَلِكَ أَنزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم بَعْدَ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللّهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ وَاقٍ)

“এভাবে আমি কুরআন অবতরণ করেছি শাসন-বিধান রূপে, আরবী ভাষায়। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পরও তুমি যদি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর, তবে আল্লাহর বিরুদ্ধে তোমার কোন অভিভাবক ও রক্ষক থাকবে না।”[ সুরা রা’দ ১৩:৩৭ ]

পবিত্র সত্ত্বা আরও বলেন:

(وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا)

“আর তিনি তার শাসন কর্তৃত্বে কাউকে শরীক করেন না।”[ সুরা কা’হফ ১৮:১১০ ]

অতএব এককভাবে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করাই দাবি করে, হালাল ও হারাম করার ক্ষেত্রেও তিনি একক হবেন।

যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

(اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهًا وَاحِدًا لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ)

“তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় গুরু ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামকেও। অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য। যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। যিনি তাদের শিরক থেকে পবিত্র।”[ সুরা তাওবা ৯:৩১ ]

এ সকল আয়াতগুলো প্রমাণ করে: শাসন-কর্তৃত্বও ইবাদতে একত্বের অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ এটা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা উপাসনার একত্ব।

যে শাসনের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে, সে ঐ ব্যক্তির মতই, যে অন্য যেকোন প্রকার ইবাদতে শরীক করে।

আল্লামা শানকিতী রহ: বলেন:

আল্লাহর শাসন কতৃত্বে কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করা আর তার ইবাদতে কাউকে তার সাথে শরীক করা- উভয়টার একই অর্থ। এ দু’টোর মাঝে আদৌ কোন পার্থক্য নেই।

সুতরাং যে আল্লাহর শাসন ব্যবস্থা ব্যতীত অন্য কারো শাসনব্যবস্থার অনুসরণ করে এবং আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কারো বিধান মানে, সে ঐ ব্যক্তির মতই যে, বিতর্কর ইবাদত করে, বিতর্কর জন্য সিজদা করে।

এদু’টির মাঝে কোন দিক থেকে কোন পার্থক্য নেই। তাই উভয়টি একই। উভয়েই আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্তকারী।

(দেখুন, আযওয়াউল বয়ান লিশ-শানকিতী: ৭/১৬২)

শায়খ রহ: আরও বলেন:

“তিনি নিজ শাসনে কাউকে অংশীদার বানান না” এ আয়াত থেকে বুঝা যায়: যারা আল্লাহর বিধানের বাহিরে ভিন্ন বিধান রচনাকরীদের আনুগত্য করে, তারা আল্লাহর সাথে শরীককারী।

এ বিষয়টি অন্য আয়াতে স্পষ্টভাবেই এসেছে: যেমন শয়তান, মৃত প্রাণীকে আল্লাহর জবাইকৃত বলে দাবি করে তা হালাল হওয়ার যে বিধান প্রণয়ন করেছিল, তাতে যারা তার অনুসরণ করেছে, তাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে:

(وَلاَ تَأْكُلُواْ مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ      )

“যাতে আল্লাহ্‌র নাম উল্লেখ করা হয়নি, তোমরা তা থেকে খেয়ো না! নিশ্চয়ই এটা ফিসক (পাপাচার)। শয়তান তার বন্ধুদের নিকট ওহী প্রেরণ করে, যেন তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করতে পারে। তোমরা যদি তাদের অনুসরণ কর তাহলে তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে।” [ সুরা আন’য়াম ৬:১২১ ]

এখানে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট করলেন যে, তারা তাদের আনুগত্যের কারণে মুশরিক।

এটা হচ্ছে আনুগত্যের ক্ষেত্রে এবং আল্লাহ্‌র বিধানের বিপরীত বিধান মানার ক্ষেত্রে শরীক করা।

আর নিম্নোক্ত আয়াতে শয়তানের ইবাদত বলে এটাই উদ্দেশ্য-

(أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ وَأَنْ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ)

“হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেই নি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করবে না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর তোমরা আমারই ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ।”[ সুরা ইয়া-সীন ৩৬:৬০-61 ]

অনুরূপ নবী ইবরাহীম আ: সম্পর্কে আল্লাহর বাণী-

(يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا)

“হে আমার পিতা! আপনি শয়তানের ইবাদত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য।”[ সুরা মারঈয়াম ১৯:৪৩ ]

(আযওয়াউল বয়ান: ৪/৮৩, ৩/৪৪)

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম বলেন,

এককভাবে আল্লাহর বিধানের শাসন মানা, এটাই আল্লাহর রাসূলের প্রতি সাক্ষ্যদানের অর্থ। তিনি বলেন: “এককভাবে আল্লাহর বিধানের শাসন মানা; অন্য কারো শাসন না মানা, এটাই এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ও অন্য কারো ইবাদত না করার হুবহু অর্থ।

কারণ উভয় শাহাদাতের মূল কথা হচ্ছে: আল্লাহ একমাত্র উপাস্য; তার সাথে কোন শরীক নেই আর আল্লাহর রাসূল (সা) ই একমাত্র অনুসরণীয়, তার আনিত বিধানই একমাত্র শাসন-বিধান।

জিহাদের তরবারীগুলো তো শুধু এর জন্যই, এটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কোষমুক্ত হয়েছিল। তথা এটাই মানতে হবে; অন্য সব কিছু বর্জন করতে হবে এবং বিবাদকালে এর ফায়সালাই কার্যকর হবে।

(ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম: ১২/২৫২)

এমনিভাবে আল্লাহর কিতাব থেকে জানা যায়, শাসন-কর্তৃত্ব তাওহীদুর রুবুবিয়াহ তথা বিশ্বাসগত একত্বেরও অন্তর্ভূক্ত।

আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা দ্বারা শাসন করা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ (তথা একক রব হিসাবে মানা) এর অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহর শাসন কার্যকরাটা তার প্রভূত্বেরই দাবি এবং তার রাজত্ব ও ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গতা।

একারণেই আল্লাহ, তার অবতীর্ণ বিধানের বাইরে যাদেরকে অনুসরণ করা হয়, তাদেরকে তাদের অনুসারীদের জন্য রব বলে উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন:

(اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهًا وَاحِدًا لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ)

“তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় গুরু ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামকেও।

অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য। যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। যিনি তাদের শিরক থেকে পবিত্র।” [ সুরা তাওবা ৯:৩১ ]

আল্লামা ইবনে হাযাম রহ: আল্লাহ তা’আলার এই বাণী সম্পর্কে বলেন:

“যেহেতু ইহুদী ও নাসারারা, তাদের ধর্মীয় গুরু ও সংবিরাগীরা যা হারাম করত, তাকে হারাম বলে মেনে নিত এবং তারা যা হালাল করত, তাকে হালাল বলে মেনে নিত, একারণে এটা যথার্থই প্রভূত্ব ও ইবাদত, যা তারা দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

আর আল্লাহ তা’আলা এই আমলটিকে, আল্লাহকে ছেড়ে অন্যদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করা ও তাদের ইবাদত করা বলে উল্লেখ করেছেন। আর এটা শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোনও মতবিরোধ নেই।”

(ফসল: ৩/২৬৬)

ইবনে তাইমিয়া রহ: এ ব্যাপারে বলেন: আল্লাহ বলেছেন:

“তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় গুরু ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামকেও। অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য। যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। যিনি তাদের শিরক থেকে পবিত্র।”

আর আদি ইবনে হাতিমের দীর্ঘ ‘হাসান’ হাদিসে এসেছে: আদি ইবনে হাতিম রা: রাসূলুল্লাহ সা: এর নিকট আসলেন। তিনি তখন খৃষ্টান ছিলেন। তিনি রাসূল সা: কে এই আয়াত পড়তে শুনলেন। (তিনি বলেন:) তখন আমি বললাম: আমরা তো তাদের ইবাদত করি না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন: তারা কি আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তাকে হারাম করে না? আর তোমরাও সেটা হারাম বলে মান না? এবং তারা কি আল্লাহ যা হারাম করেছেন সেটাকে হালাল করে না? আর তোমরাও তাকে হালাল বলে মেনে নাও না? (তিনি বলেন, আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি বললেন: এটাই তাদের ইবাদত”

এমনিভাবে আবুল বুখতারী বলেন:

“আসলে তারা তাদের জন্য সালাত আদায় করত না এবং তারা যদি তারা তা মানত না। কিন্তু তারা তাদেরকে হালাল-হারামের ব্যাপারে আদেশ করেছে৷

উম্মাহর উপর যেটা হলাল ছিল, সেটাকে হারাম করেছে আর যেটা হারাম ছিল সেটাকে হালাল করেছে। আর এক্ষেত্রে তারা তাদের অনুসরণ করেছে। আর এটাই তাদের প্রভূত্ব।

কারণ রাসূলুল্লাহ সা: স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তাদের জন্য তাদের ইবাদত ছিল হারামকে হালাল করার ক্ষেত্রে এবং হালালকে হালাল করার ক্ষেত্রে আনুগত্য করা। এমন নয় যে, তারা তাদের জন্য নামায পড়ত, বা রোজা রাখত বা আল্লাহকে ছেড়ে তাদেরকে ডাকত। তাই এগুলোই মানুষের জন্য ইবাদত। আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, এগুলোই শিরক।

আল্লাহ বলেন: (لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ)

“তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যে শিরক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।”

ইমাম ইজ্জ ইবনে আব্দুস সালাম রহ: বলেন:

“আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহ একক হওয়ার কারণ হল, যেহেতু সৃষ্টি করা, বাচিয়ে রাখা, খাদ্য দেওয়া এবং দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল ব্যবস্থাপনা একমাত্র আল্লাহরই দান। প্রতিটি কল্যাণ তিনিই দানকারী। প্রতিটি অকল্যাণ তিনিই দূরকারী। এজন্য শাসনই একমাত্র তারই হবে।”

(কাওয়ায়িদূল আহকাম: ২/১৩৪-১৩৫)

আব্দুর রহমান আস-সা’দী বলেন:

রব ও ইলাহ তিনিই, যিনি তাকদিরী, শরয়ী ও প্রতিদান দেওয়া সহ- সর্বপ্রকার শাসনের মালিক, একমাত্র তারই উপাসনা ও ইবাদত করা হয়, তার সাথে কাউকে শরীক করা হয় না, তার নি:শর্ত আনুগত্য করা হয়; কোন প্রকার অবাধ্যতা করা যায় না।

ফলে অন্য সকল আনুগত্যও শুধু তার আনুগত্যের জন্যই হয়।

(আলকাওলুস সাদীদ: ১-২)

উপরের আলোচনা থেকে আমাদের সামনে একথা স্পষ্ট হয় যে, শাসন-কর্তৃত্বও, প্রভূত্বে একক সাব্যস্ত করারই অন্তর্ভূক্ত।

এবার আপনি এই দলিল নিন যে, এটা নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে একক সাব্যস্ত

করা’’রও অন্তর্ভূক্ত:

আল্লাহ তা’আলা বলেন: (أَفَغَيْرَ اللّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا)

তাহলে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে শাসক (বা ফায়সালাকারী) হিসাবে চাবো?” [ সুরা আন’য়াম ৬:১১৪ ]

মহান আল্লাহ আরও বলেন: (فَاصْبِرُواْ حَتَّى يَحْكُمَ اللّهُ بَيْنَنَا وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ)

“তাই সবর কর, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মাঝে ফায়সালা করে দেন। আর তিনিই সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” [ সুরা আরাফ ৭:৮৭ ]

মহান আল্লাহ আরও বলেন: (أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ)

“আল্লাহ কি সর্বোত্তম ফায়সালাকারী (শাসনকারী) নন?” [ সুরা তীন ৯৫:৮ ]

এখানে আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের উদ্ধৃতিসমূহ থেকে স্পষ্ট হয় যে, শাসন-কর্তৃত্বও, উপাসনায় একক সাব্যস্ত করা,

প্রভৃত্বে একক সাব্যস্ত করা এবং নাম ও গুণাবলীতে একক সাব্যস্ত করার অন্তর্ভূক্ত এবং আরও স্পষ্ট করে যে, যে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারো জন্য এটা নিবেদন করল, সে মহান আল্লার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করল।

শাসন-কতৃত্ব ঈমানের শর্তঃ

অজ্ঞতা ও হঠকারিতা যাদেরকে লাগামহীন করে দিয়েছে তারাই কেবল বলতে পারে, এটা ঈমানের শর্ত নয়। আপনার সামনে দলিল পেশ করা হল:

আল্লাহ তা’আলা বলছেন:

(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً)

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য থেকে উলূল আমর (আদেশদাতা) দেরকে।

 আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের পরস্পরে বিরোধ হয়, তাহলে তা আল্লাহ্‌র ও তার রাসূলের দিকে ফিরাও, যাদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। [ সুরা নিসা ৪:৫৯ ]

শরীয়ত প্রণেতা এই শাসনকর্তৃত্ব দেওয়াকে ঈমান হিসাবে গণ্য করলেন।

যেমন অন্য আয়াতে বলেনঃ

(فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا)

না, তোমার রবের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের বিবাদমান বিষয়ে তোমাকে ফায়সালাকারী বানায়, অতঃপর তাদের অন্তরে কোন সংকোচ না থাকে এবং পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে। [ সুরা নিসা ৪:৬৫ ]

ইবনে হাযাম রহ: বলেন:

“এখানে আল্লাহ নবী সা: কে শাসনকর্তৃত্ব দেওয়াকে ঈমান বললেন।

আল্লাহ তা’আলা আরও জানালেন: এটা ছাড়া কোন ঈমান নেই। উপরন্তু তিনি যে ফায়সালা করেন, তার ব্যাপারে অন্তরে কোন সংকোচ থাকতে পারবে না।

সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, ঈমান- আমল, আকীদা ও কথার নাম। কেননা শাসন কর্তৃত্ব দেওয়া একটি আমল। আর তা কথা ছাড়া বাস্তবায়িত হয় না। আর অন্তরের সংকোচ ছাড়া হতে হবে, তা হচ্ছে বিশ্বাস।”

(আদ্দুররাহ: ২৩৮)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেন:

“একারণেই শরীয়ত তার বিধানের শাসন মেনে নেওয়াকে আবশ্য করেছে এবং এটাকে ঈমানের জন্য শর্ত বানিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

(فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ)

“আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের পরস্পরে বিরোধ হয়, তাহলে তা আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে ফিরাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক।”

আল্লাহ সুবহানাহু অন্য আয়াতে বলেন:

(وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ)

“তোমরা যেকোন বিষয়ে মতবিরোধ করলে, তার ফায়সালার ভার আল্লাহর উপর।”[ সুরা শূরা ৪২:১০ ]

শায়খ রহ: আরও বলেন: সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিধান তথা কুরআন ও সুন্নাহ, যা দিয়ে আল্লাহ তার নবী সা: কে প্রেরণ করেছেন, তার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারো অধিকার নেই; একমাত্র কাফেরই তার থেকে বের হয়ে যেতে পারে।”

(মাজমূউল ফাতাওয়া: ১১/২৬২)

ইবনে তাইমিয়া রহ: আরও বলেন:

“যে রাসূলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ ও তার আনিত শরীয়ত থেকে বেরিয়ে যায়, তার ব্যাপারে আল্লাহ স্বীয় পবিত্র সত্ত্বার শপথ করে বলেছেন:

সে কিছুতেই মুমিন হবে না, যতক্ষণ না নিজেদের মাঝে বিবাদমান সকল

দ্বীনী ও দুনিয়াবী বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা: কে ফায়সালাকারী না মানে এবং তার ফায়সালার ব্যাপারে তাদের মনে কোন সংকোচ না থাকে।”

(আলফাতাওয়া: ২৮/৪৭১)

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন:

“(فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ) এর মধ্যে শর্তের পরে নাকিরাহ (অনির্দিষ্ট জ্ঞাপক শব্দ) এসেছে। যা ব্যাপকতা বুঝায়। তথা মুমিনগণ দ্বীনের ছোট-বড়, স্পষ্ট-অস্পষ্ট যত বিষয়ে মতবিরোধ করে সব অন্তর্ভূক্ত।

এখানে লক্ষণীয়, যদি আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাহয় বিবাদমান বিষয়ের সমাধান না থাকত এবং তা ই যথেষ্ট না হত, তাহলে আল্লাহ তার প্রতি ফিরানোর আদেশ দিতেন না।

কারণ এটা অসম্ভব যে, আল্লাহ এমন বিষয়ের দিকে বিবাদকে ফিরানের আদেশ করবেন, যাতে বিবাদমান বিষয়ের মীমাংসা নেই।

এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা এই ফিরানোকে ঈমানের দাবি ও তার অপরিহার্য বিষয় সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং যখন উল্লেখিত ফিরানো না পাওয়া যাবে, তখন ঈমানও থাকবে না।

যেহেতু কোন জিনিসের অপরিহার্য বিষয়টি না পাওয়া গেলে উক্ত বিষয়টিও পাওয়া যায় না। উপরন্তু এখানে আবশ্যিকীয়তা উভয় দিক থেকে। কোন একটি না থাকলে অপরটি থাকবে না।

তারপর আল্লাহ তা’আলা জানালেন যে, এই ফিরানো তাদের জন্য উত্তম এবং তার পরিণাম উৎকৃষ্ট”

(ইলামুল মুআকিয়ীন:১/৪৯-৫০)

ইমাম ইবনে কাসীর রহ: বলেন:

“সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূল যে ফায়সালা করেন ও যাকে সঠিক বলেন, সেটাই হক। আর হকের পরে পথভ্রষ্টতা ছাড়া কি আছে?

এজন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেন: (إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ)

অর্থাৎ বিবাদমান ও অজানা বিষয়কে আল্লাহর কিতাব ও তার রাসুলের সুন্নাহ প্রতি ফিরাও। অত:পর তোমাদের বিবাদমান বিষয়ে তাকে শাসনকারী বা ফায়সালাদানকারী মান।

তাই এটা প্রমাণ করে, যে বিবাদমান বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহকে ফায়সালাকারী না বানায়, এক্ষেত্রে তার দিকে প্রত্যাবর্তন না করে, সে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমানদার নয়।”

(তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৩/২৯)

শায়খ সা’দী এ প্রসঙ্গে বলেন:

“কিতাব ও সুন্নাহর প্রতি ফিরানো ঈমানের শর্ত। তাই এটা প্রমাণ করে, যে মতবিরোধপূর্ণ মাসআলাগুলোকে এদুটির দিকে না ফিরায়, সে প্রকৃতপক্ষে মুমিন নয়; বরং সে তাগুতের প্রতি ঈমানদার।

যেমনটা আয়াতে এসেছে- (أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ….الآية)

কেননা ঈমান, প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর শরীয়তের প্রতি আনুগত্য ও তাঁর শাসনকর্তৃত্ব মেনে নেওয়াকে দাবি করে।

সুতরাং যে নিজেকে মুমিন দাবি করে, আবার আল্লাহর শাসনের বিপরীতে তাগুতের শাসনকে অবলম্বন করে সে এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী।”

(তাফসীরে সা”দী: ২/৯০)

সালাফদের উদ্ধৃতিসমূহ:

১। ইমাম বুখারী রহ: মাসরুক থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেছেন:

“সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই! আল্লাহর কিতাবের প্রতিটি সূরা কোথায় কোথায় নাযিল হয়েছে, তা আমি জানি এবং কোরআনের প্রতিটি আয়াত কোন্‌ কোন্‌ ব্যাপারে নাযিল হয়েছে

তাও আমি জানি।

আমি যদি আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে আমার থেকে অধিক জ্ঞাত কাউকে জানতাম, যার নিকট উট পৌঁছবে, তাহলে আমি অবশ্যই তার কাছে যেতাম।”

সালিম ইবনে আবুল জা’দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: কে বলা হল, সুহত কি? তিনি বললেন: ঘুষ। তারা বলল, ফায়সালা করার ক্ষেত্রে? তিনি বললেন: এটা তো কুফর।

তারপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেন- (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসন করে না, এ সকল লোক কাফের।সুরা মায়েদা ৫:৪৪ ]

ঘটনাটি ইমাম তাবারী, আবু ইয়ালা ও অন্যান্যরাও বর্ণনা করেন। তার থেকে বিশুদ্ধভাবে এটা বর্ণিত হওয়ার ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই।

২। ইবনে তাউস থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন:

ইবনে আব্বাস রা:কে আল্লাহ তা’আলার এই বাণীটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস

করা হল: ((وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ))

তিনি বলেন: “এটা কুফর’।

কোন বর্ণনায় এসেছে- “এটা তার প্রতি কুফর’।

আর কোন বর্ণনায় এসেছে- “এটাই তার কুফরের জন্য যথেষ্ট ।

(বর্ণনা করেছেন ইমাম আব্দুর রাজ্জাক স্বীয় তাফসীরের ১/১৯১ এ, ইবনে জারির ৬/২৫৬ এ, ওয়াকি আখবারুল কুযাতের ১/৪১ এ এবং অন্যান্যরাও বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন।)

৩। ইবনে আব্দুল বার রহ: ইসহাক ইবনে রাহওয়াই থেকে বর্ণনা করেন:

“এ ব্যাপারে আলেমগণের ইজমা হয়েছে যে, যে আল্লাহর অবতীর্ণ কোন বিষয় প্রত্যাখ্যান করে বা কোন নবীকে হত্যা করে আর এমতাবস্থায় সে আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়কে মৌখিকভাবে স্বীকারও করে, তাহলে সে কাফের।”

(আত্তামহীদ:৪/২২৬)

যেহেতু আমরা জানি, এই ইসহাকই নামায পরিত্যাগকারীর কাফের হওয়ার ব্যাপারে ইজমা বর্ণনা করেছেন, তাহলে কিভাবে তার থেকে নামাযের বিষয়ে বর্ণনা গ্রহণ করা হবে আর শাসনের বিষয়ে গ্রহণ করা হবে না?

ভাই! এই কথাটি চিন্তা করুন, ওখানে বলা হয়েছে: যদিও এমতাবস্থায় সে আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়কে মৌখিকভাবে স্বীকার করে।

৪। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা:৪/৪৪৩- মাসরুক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

কাযী যখন হাদিয়া গ্রহণ করল, তখন সে ঘুষ গ্রহণ করল। আর যখন ঘুষ গ্রহণ করল, তখন ঘুষ তাকে কুফরীতে পৌঁছে দিল।

৫। ইমাম শা’বী রহ: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

প্রথমটি মুসলিমদের জন্য, দ্বিতীয়টি ইহুদীদের জন্য এবং তৃতীয়টি

খৃষ্টানদের জন্য। অর্থাৎ কুফর।

(কুরআনে কারীমে যারা আল্লাহর বিধান দিয়ে শাসন করে না, তাদের ব্যাপারে তিনটি বিশ্লেষণ এসেছে। তা হল যথাক্রমে: কাফিরুন, জালিমুন ও ফাসিকুন। তার প্রতি লক্ষ্য করেই এ কথাটি বলা হয়েছে-অনুবাদক)

৬। তাফসীরে তাবারী: ৬/৫৭- আসবাত ইমাম সুদ্দি থেকে বর্ণনা করেন: তিনি (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ) এর তাফসীর করেন:

“যে আমার অবতীর্ণ বিধানকে শাসন বিধান হিসাবে মানল না; তাকে ইচ্ছাকৃত পরিত্যাগ করল এবং জেনে শুনে অন্য দিকে ঝুকলো, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।”

উল্লেখ্য; আসবাত যাদিও অনেক বেশি ভুল করেন, কিন্তু তার সততা রয়েছে।

এছাড়া এ বর্ণনাটি ইবনে মাসউদ রা; ও মাসরকের বণনা এবং ইবনে রাহওয়াই

এর ইজমারও অনুকূল।

৭। ইবনে হাযাম রহ: বলেন:

“যে ব্যক্তি ইঞ্জিলের এমন কোন বিধান দ্বারা শাসন করে, যে বিধানের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে কোন ওহী অবতীর্ণ হয়নি, সে কাফের, শিরককারী এবং ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত।”

(আলইহকাম ফি উসুলিল আহকাম:৫/১৫৩)

৮। ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেন:

আল্লাহ মুহাম্মদ সা: এর উপর যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা শাসন করাই হল ইনসাফ। এটাই ইনসাফের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বোত্তম প্রকার।

এর দ্বারা শাসন করা রাসূল সা: এর উপর এবং যারা তার অনুসরণ করে তাদের উপর ওয়াজিব। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানকে শিরোধার্য করে না, সে কাফের।

(মিনহাজুস সুন্নাহ: ৫/১৩১)

শায়খ রহ: আরও বলেন:

এটা সর্বজন বিদিত যে, আল্লাহ তার রাসূলকে যে আদেশ-নিষেধ দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যে তার কোনটা অকার্যকর করে, সে মুসলিম, ইহুদী, নাসারা-সকল জাতির ঐক্যমত্যে কাফের।

(মাজমুউল ফাতাওয়া: ৮/১০৬)

তিনি আরও বলেন: কখনো তারা এরূপ বলে থাকে:

“শরীয়তের বিধি-বিধানগুলো তো হচ্ছে কতগুলো ভারসাম্যপূর্ণ আইন মাত্র, যা মানুষের দুনিয়াবী সুবিধার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।”

পক্ষান্তরে গভীর জ্ঞান, মূলতত্ত্ব, এবং ইহকালীন ও পরকালীন উন্নত স্তরের ক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে নবীদের উপর এবং নিজেদের পথকে নবীদের পথের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাভাবিকভাবেই জানা যায়: এটা ভয়ংকর কুফর ও পথভ্রষ্টতা।

তিনি আরও বলেন: দ্বীনে ইসলাম থেকে এবং সমস্ত মুসলিমদের ঐক্যমত্য থেকে অনিবার্যভাবে এটা জানা যায় যে, যে দ্বীনে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীনের অথবা মুহাম্মাদ সা: এর শরীয়ত ছাড়া অন্য কোন শরীয়তের অনুসরণ করাকে জায়েয মনে করে, সে কাফের।

এটা হচ্ছে ঐ ব্যক্তির কুফরের ন্যায়, যে আল্লাহর কিতাবের আংশিকের প্রতি ঈমান আনে আর আংশিকের প্রতি ঈমান আনে না।

(মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৫২৪)

৯। ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন:

“অত:পর আল্লাহ সুবহানাহু জানালেন যে, যে রাসূলের আনিত বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা বিচার করল বা অন্য কিছুর নিকট বিচার প্রার্থনা করল, সে তাগুতকে শাসক বানালো বা তাগুতের নিকট বিচার প্রার্থনা

করল।

আর তাগুত হল, যার ব্যাপারে বান্দা সীমালজ্ঘন করে, চাই সে উপাস্য হোক বা অনুসৃত হোক বা মান্যবর হোক।

সুতরাং প্রত্যেক কওমের তাগুত হল, তারা আল্লাহ ও তার রাসূল ব্যতীত যাদের নিকট বিচার প্রার্থনা করে, অথবা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ইবাদত করে, অথবা যাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণ ব্যতীত অনুসরণ করে, অথবা এমন বিষয়ে আনুগত্য করে, যে বিষয়ে সে জানে না যে, এতে আল্লাহর আনুগত্য হচ্ছে কি না।”

(ইলামুল মুআক্কিয়ীন:১/৮৫)

১০। ইবনে কাসীর রহ:- (أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ) “তারা কি জাহিলিয়াতের শাসন কামনা করে? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর শাসন অপেক্ষা উত্তম শাসন আর কি আছে?-এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন:

“যে, সকল কল্যাণের ধারক ও অকল্যাণের অপসারক আল্লাহর সুদৃঢ় বিধান থেকে বের হয়ে যায় এবং মানুষের গড়া ও শরীয়ত থেকে সম্পর্কমুক্ত মতামত ও খেয়াল-খুশির প্রতি প্রত্যাবর্তন করে,

 যেমন বর্ববরতার যুগের লোকেরা পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার বিষয়াবলী দ্বারা শাসন করত, সে কাফের; তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না সে আল্লাহর শরীয়তের শাসনের প্রতি ফিরে আসে; অত:পর কম/বেশি কোন ক্ষেত্রে অন্য কিছুর শাসন না মানে।

তাতার জাতি যে ‘ইয়াসিক’ বা “ইয়াসা’ নামক সংবিধান দ্বারা শাসন করত, তার কিছু অংশ ইমাম জুওয়াইনীর সুত্রে বর্ণনা করার পর ইবনে কাসীর রহ: বলেন:

“তাই যখন, যে শেষ নবী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর প্রতি অবতীর্ণ সুদৃঢ় শরীয়তকে পরিত্যাগ করে অন্য কোন রহিত শরীয়তের বিধান দ্বারা শাসন করে, সে কাফের হয়ে যায়,

 তখন যে ইয়াসাক দ্বারা শাসন করে এবং তাকে মুহাম্মাদ সা:এর শরীয়তের উপর প্রাধ্যন্য দেয় তার অবস্থা কি হবে?

অতএব যে এমনটা করবে সে মুসলমানদের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের হয়ে যাবে।”

(আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৩/১২৮)

১১। রিসালাতুত তাওহীদ লিদ দিহলবী:১/১২৯ তে উল্লেখিত,

“আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা শাসন করা এক প্রকার শিরক, আল্লাহ তা’আলার রাজ্য ও রাজত্বে অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত করণ এবং নিজেদের প্রণীত শরীয়ত দ্বারা আল্লাহর শরীয়তের মোকাবেলা করণ।”

১২। আব্দুল লতীফ ইবনে আব্দুর রহমান আলুশ শায়খ রহ: বলেন:

যে জানা সত্বেও আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুনাহ ছাড়া অন্য কিছুর শাসন চায়, সে কাফের।

(আদ্দুরারুস সানিয়্যাহ:২/২৪১)

১৩। শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে হামিদ রহ: বলেন:

যে এমন ব্যাপক ও অবশ্যপালনীয় বিধান পাশ করে, যা আল্লার বিধানের প্রতিদ্বন্ধী, এমন ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাবে।

(আহমিয়াতুল জিহাদ: ১৯৬)

১৪। শায়খ সুলাইমান আল উলওয়ান হাফিজাহুল্লাহ বলেন:

ইমাম ইসহাক, ইবনে হাযাম ও ইবনে কাসীর রহ: আলবিদায়া ওয়ান নিহায়ার ১৩ তম খন্ডে চেঙ্গিস খানের জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে এ ব্যাপারে উম্মাহর ঐক্যমত্য বর্ণনা করেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন: (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) “যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারা শাসন করে না, ঐ সকল লোক কাফের”

আর ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত “ছোট কুফর” এর বর্ণনাটি সঠিক নয়। এটা বিশুদ্ধভাবে তার থেকে প্রমাণিত নয়।

ইমাম হাকিম রহ: মুস্তাদরাকে হাকিমে হিশাম ইবনে হুজাইর এর সুত্রে এটি বর্ণনা করেন। আর হিশাম ইবনে হুজাইর হাদিস রেওয়ায়াতের ক্ষেত্রে যয়ীফ বা দুর্বল। ইমাম আহমাদ, ইয়াহইয়া ও আরো একদল মুহাদ্দিস তাকে যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন। আর উল্লেখিত হাদিসের সূত্র পরস্পরা বর্ণনার ক্ষেত্রে তার বিরোধিতাও করা হয়েছে।

যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে তাউস তার পিতা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন, যা হিশামের বর্ণনার বিরোধী।

আর আব্দুল্লাহ ইবনে তাউস হিশাম থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য। সুতরাং হিশামের বর্ণনাটি মুনকার, দলিলের উপযুক্ত নয়।

কিছু আপত্তি ও তার জবাব:

প্রথম আপত্তি

তারা বলে থাকে, অবশ্যই হালাল মনে করতে হবে এটা খুব আশঙ্কাজনক কথা। কারণ আমলের দ্বারাই মানুষকে কাফের আখ্যায়িত করা হয়; বিশ্বাস পোষণ করা শর্ত নয়। ইবলিশ তো শুধু অহংকারবশত সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আর এটা তো আমল।

অনুরূপ নামাযও একটি আমল; যে অস্বীকার করা ছাড়াও তা পরিত্যাগ করে তাকে কাফের আখ্যায়িত করা হয়, যার উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমাও রয়েছে। বিশেষত: যদি স্পষ্ট বর্ণনা আসে যে এই আমলটি পরিত্যাগ করা কুফর, তখন তার মাঝে কোন দ্ব্যার্থতা নেই।

যেমন নামায ও শাসন, এ দুটির ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। তাই চিন্তা করে দেখুন। উপরন্তু ইসহাক (রহ:) থেকে শাসনের ক্ষেত্রে কাফের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ইজমাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন নামাযের ব্যাপারে বর্ণিত আছে।

প্রকৃতপক্ষে এ কথাটি মুরজিয়াদের কথা।

আপনার সামনে সালাফের বক্তব্য থেকে দলিল পেশ করা হল:

ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলেন: মুরজিয়ারা সীমালজ্ঘন করেছে, ফলে তারা একথা বলতে শুরু করেছে যে,

“যে ফরজ নামায, রমযানের রোজা, যাকাত, হজ্জ ও অন্যান্য ফরজগুলো পরিত্যাগ করে, তবে তা অস্বীকার করে না, আমরা তাকে কাফের বলি না; বরং তার বিষয়টা আল্লাহর দিকে সঁপে দিতে হবে। শর্ত হল, যদি সে স্বীকারকারী হয়”- এ সকল লোকের মুরজিয়া হওয়ার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।” (ফাতহুল বারী লিইবনে রজব:১/২৩)

‘আস-সুন্নাহ লি আব্দিল্লাহ ইবনে আহমাদ’ এ সুওয়াইদ ইবনে সাঈদ আলহারাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

“আমরা সুফয়ান ইবনে ‍উয়াইনাকে মুরজিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন: মুরজিয়া হল, যারা এমন ব্যক্তির জন্যও জান্নাত সাব্যস্ত করে, যে মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সাক্ষ্য দেয়; অথচ অন্তরে শরীয়তের ফরজগুলো তরক করার ব্যাপারে অনড় থাকে।

 তারা ফরজগুলো পরিত্যাগ করাকে শুধু গুনাহ বলে। যেমন হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া গুনাহ। অথচ উভয়টি সমান নয়। কেননা হালাল মনে না করে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া হল গুনাহ। আর কোন ওযর বা অজ্ঞতা ছাড়া ইচ্ছাকৃত ফরজগুলো পরিত্যাগ করা হল কুফর।”

(আস-সুনাহ:১/৩৪৭)

দ্বিতীয় আপত্তি

তা হল ইবনে আব্বাস রা: এর বর্ণনাটি: তিনি বলেন: “এটা হচ্ছে ছোট কুফর”।

আরেক বর্ণনায় এসেছে, “এটা এমন কুফর নয়, যার বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করবে’। আরেক বর্ণনায় এসেছে, “এটা এ ব্যক্তির কুফরের মত নয়, যে আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ ও তার কিতাবসমূহের প্রতি কুফরী করে।

একাধিক বর্ণনায় এরূপ এসেছে। এর কয়েকটি জবাব:

প্রথমত: সাহাবায়ে কেরামের মাঝেই এর বিপরীত মতের প্রবক্তা পাওয়া যায়। (এ উত্তরটি হচ্ছে যদি তার থেকে এ বর্ণনাটি সঠিক বলে মেনে নেওয়া হয়। আর নিশ্চিতভাবেই বর্ণনাটি সঠিক নয়। যার আলোচনা সামনে আসবে।)

তিনি হলেন ইবনে মাসউদ রা: আর রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন: উম্মে আবদের পুত্র (অথার্ৎ ইবনে মাসউদ) আমার উম্মতের জন্য যে বিষয়ে সন্তুষ্ট, আমিও তাতে সন্তুষ্ট।

ইবনে মাসউদ রা: বলেছেন: সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আল্লাহর কিতাবের প্রতিটি সুরা কোথায় নাযিল হয়েছে, আমি তা জানি এবং প্রতিটি আয়াত কোন্ ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, তাও আমি জানি।

আমি যদি কাউকে আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে আমার থেকে অধিক অবগত জানতাম, যার নিকট উট পৌঁছবে, তাহলে আমি অবশ্যই সেখানে পৌঁছে যেতাম।

তিনি আল্লাহর শপথ করে বললেন, আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে তার থেকে অধিক অবগত কাউকে তিনি জানেন না।

দ্বিতীয়ত: ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণিত ইজমা, যা এই রেওয়ায়াতের বক্তব্যের বিপরীত।

তৃতীয়ত: আল্লাহর কিতাবের ইঙ্গিতসমূহ। যা প্রমাণ করে, তাতে কুফর দ্বারা বড় কুফর উদ্দেশ্য। ছোট কুফর নয়; কারণ এটা এমন একটি ইবাদত, যা মুল তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত। আর কুফর শব্দের ক্ষেত্রে মূলনীতি হল, তা যখন ‘আলিফ লাম’ সহ আসে, তখন বড় কুফর উদ্দেশ্য হয়।

যেমনটা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: আলইকতিযায় বলেছেন। তবে যদি তা শর্তযুক্ত থাকে বা তাতে এমন কোন আলামত থাকে, যা তাকে উক্ত অর্থ গ্রহণ করতে বাঁধা দেয় তবে ভিন্ন কথা।

শায়খ রহ: আরও বলেন: আরবি ভাষায় আলিফ লাম” যুক্ত হয় নির্দিষ্ট করণের জন্য। অতএব যেটা বক্তা ও সম্ভোধিত ব্যক্তি- উভয়ের জানা, সেই অর্থই উদ্দেশ্য হবে।

অর্থাৎ বক্তা ও সম্ভোধিত ব্যক্তির জানা ও পরিচিত সব বিষয় এর অন্তর্ভুক্তি হবে। তাই কোন কথার মধ্যে লামব্যাপকতা ও সামগ্রীকতা বুঝায়। কিন্ত শুধু জানা বিষয়গলোরই ব্যাপকতা! তথা বক্তা ও সম্ভোধিত ব্যক্তির জানা ও পরিচিত কথাটি উদ্দেশ্য হবে। আল ইতিকামা:১/২২২)

চতুর্থত: এটা হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান ও মুলকথা এবং ইবনে আব্বাস রা: থেকে বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত রেওয়ায়াত (বর্ণনা) গুলোর ব্যাপারে সব জঞ্জালমুক্ত সারকথা। তাই শীর্ণকায় থেকে পুষ্টকে এবং ঘোলাটে থেকে স্বচ্ছকে পৃথক করার জন্য এটাই উপযুক্ত।

সুতরাং আমরা এর সনদগুলোর ব্যাপারে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের নীতির আলোকে নির্ভরযোগ্য ইলমী পর্যালোচনা করব।

এতে আমরা আমাদের পক্ষের-বিপক্ষের উভয় দিকের রিওয়ায়াতগুলো আনবো। আর তাওফীক আল্লাহর পক্ষ থেকেই।

প্রথম রেওয়ায়াত: যে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানকে অস্বীকার করে সে কাফের। আর যে তা বহাল রাখে, তবে তার দ্বারা শাসন বা বিচার করে না সে জালিম ও পাপিষ্ঠ।

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন: “যে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানকে অস্বীকার করে, সে কাফের। আর যে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানকে স্বীকার করে, তবে তা দ্বারা শাসন করে না, সে জালিম ও পাপিষ্ঠ।”

আমরা বলবো: এই বর্ণনাটি ইমাম তাবারী রহ: জামিউল বয়ানের ৬/১৬৬ এ এবং ইবনে আবি হাতিম তার তাফসীরের ৪/১১৪২ এ উল্লেখ করেছেন।

হাদিসটির সূত্র হচ্ছে: ইবনে জারির আত তাবারি আল মুসান্না হতে, আল মুসান্না আব্দুল্লাহ বিন সালিহ হতে, তিনি মুয়াবিয়া ইবনে সালিহ হতে,মুয়াবিয়া বিন সালিহ ইবনে আবি তালহা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে।

এই সনদটি দু্টি দোষে দোষযুক্ত:

প্রথম দোষ: আব্দুল্লাহ ইবনে সালিহ যয়ীফ। আলেমগণ তার ব্যাপারে যা বলেছেন তার বিবরণ:

আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ বলেন: আমি আমার পিতাকে লাইস ইবনে সা’দের কাতিব আব্দুল্লাহ ইবনে সালিহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি বললেন: তিনি প্রথম দিকে দৃঢ় ছিলেন, পরে নষ্ট হয়ে যান। আর এখন তার কোন নির্ভরযোগ্যতাই নেই। আলী ইবনুল মাদিনী বলেন: আমি তার থেকে কিছু বর্ণনা করি না। ইমাম নাসায়ী রহ: বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য নন।

আহমাদ ইবনে সালিহ বলেন: তিনি অভিযুক্ত; তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

সালিহ জাযরাহ বলেন: ইবনে মায়ীন তাকে ছিকা (নির্ভরযোগ্য) বলতেন, কিন্তু আমার মতে সে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে।

আবু যুরআ বলেন: তিনি আমার নিকট এ সকল লোকদের অন্তর্ভূক্ত নন, যারা ইচ্ছকৃত মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে। তার হাদিস উত্তম।

আবু হাতিম বলেন: আমি তাকে যতটুকু জানি, তিনি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত।

আমরা দেখতে পেলাম, ইমাম আহমাদ, আলী ইবনুল মাদিনী, নাসায়ী, আহমাদ ইবনে সালিহ ও সালিহ আলজাযরাহ এর মত বড় বড় ইমামগণ তাকে যয়ীফ বলেছেন।

দ্বিতীয় দোষ: ইবনে আবি তালহা ও ইবনে আব্বাসের মাঝে ইনকিতা বা বিচ্ছেদ। তাই ইবনে আবি তালহা তার থেকে শুনেনি। ইবনে মায়ীন, দুহাইম, ইবনে হিব্বান ও অন্যান্য ইমামগণ এমনটাই বলেছেন।

আর কেউ কেউ যেটা বলে- “তাদের মধ্যস্ত হলেন মুজাহিদ ও ইকরিমা”, এটা দু’টি কারণে সঠিক নয়:

প্রথম কারণ: মুজাহিদ ও ইকরিমা থেকে তার শ্রবণ সাব্যস্তকারী মাজহুল বা অজ্ঞাতপরিচয়। ইমাম মিয্যী রহ: তাহযীবুল কামালে এ সনদটি উল্লেখ করে বলেন: “তাদের মধ্যস্ত হলেন মুজাহিদ।”

কিন্তু তিনি এ কথাটিকে ইবনে আবি তালহার সমকালীন কোন আলিমের দিকে বা সনদ সমালোচক কোন ইমামের দিকে সম্পৃক্ত করেননি।

আর ইমাম তাহাবী রহ: থেকে মুশকিলুল আসারে যা এসেছে, তাতে আদৌ খুশি হওয়ার কিছু নেই, কারণ তিনি এটাকে কতক আলেমের দিকে সম্পৃক্ত করেন, কিন্তু তাদের কারো নাম উল্লেখ করেন নি।

বরং তিনি নিজেই এ ধরণের বর্ণনার সমালোচনা করেছেন। দেখুন, তার বক্তব্য: “ইবনে আব্বাস রা:এর যে বর্ণনাটি আমরা এ কিতাবের শুরুতে উল্লেখ করলাম তার সূত্র যদিও মুনকাতি (মাঝে কাটা), যা প্রমাণযোগ্য নয়, কিন্তু হাদিস বিশেষজ্ঞদের একদল এটাকে সহীহ বলেছেন। আর আলী ইবনে আবি তালহা যদিও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:কে দেখেননি, কিন্তু তিনি ইবনে আব্বাসের আযাদ করা গোলাম ইকরিমা ও মুজাহিদ থেকে তা গ্রহণ করেছেন।”

(শরহে মাআনিল আসার: ৩/২৭)

আমি বলবো: তিনি কি হাদিস বিশেষজ্ঞদের এমন কারো নাম উল্লেখ করেছেন, যিনি ইবনে আবি তালহার সমকালীন এবং যিনি তাকে ভালভাবে চিনতেন। অজ্ঞতপরিচয় ব্যক্তির দিকে শুধু সম্পৃক্ত করাই কি দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য?

আমরা জানতে পারলাম, উপরুক্ত বর্ণনায় তাহাবী রহ: বলেছেন: “তার সূত্র যদিও মুনকাতি, যা প্রমাণযোগ্য নয়”।

এর দ্বারা তার ইবনে আবি তালহা ও ইবনে আব্বাসের মধ্যকার ইনকিতা (বিচ্ছেদ)ই উদ্দেশ্য। অতএব নিশ্চিত নিশ্চতই তার থেকে তার শ্রবণ সাব্যস্ত হয়নি।

মধ্যস্থতার কথা সঠিক না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ: দৃঢ়চিত্ত ইমামদের বক্তব্য থেকে শ্রবণ সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট অস্বীকৃতি পাওয়া যায়। যেমন: সালিহ ইবনে মুহাম্মদ যখন ইয়াকুব ইবনে ইসহাককে জিজ্ঞেস করলেন: ইবনে আবি তালহা কার থেকে তাফসীর শ্রবণ করেছে?

তখন তিনি সহীফা (তথা তাফসীরে ইবনে আব্বাস) শ্রবণ না করার ব্যাপারে  এভাবে খাস করে বলেন: “কারো থেকে নয়”।

(দেখুন, তাহযীবুল কামাল: ২/৯৭৪)

সুতরাং কোন নিশ্চিত দলিল ছাড়া এর বিপরীত হবে না। কারণ এটা স্বীকৃত কথা যে, নিশ্চিত বিষয় সন্দেহপূর্ণ বিষয় দ্বারা রহিত হয় না।

আর কেউ কেউ যা বলে: এটা “ওয়িজাদাহ’ (কারো থেকে লিখিত পাওয়া সুত্রে বর্ণনা)। এটা মাকড়সার বাসা থেকেও দুর্বল কথা; কেননা ওয়িজাদাহ এর শর্তসমূহ তাতে আদৌ পাওয়া যায় না।

এটা পর্যালোচনারও যোগ্য নয়; কারণ এটা হল নিজ খুশিমত একটি কথা বলে দেওয়া। সুতরাং এর উপযুক্ত পাওনা হল, এটাকে ফেলে দেওয়া।

এছাড়া এই আলী ইবনে আবি তালহা মুনকার হাদিসসমূহও বর্ণনা করে থাকেন। তিনি এই সহীফায়ই অনেক মুনকার হাদিস বর্ণনা করেছেন।

তিনি ইবনে আব্বাস রা: এর সকল ছাত্রদের থেকেই এমন হাদিস বর্ণনা করতেন, যেগুলোর উপর তার প্রতিবাদ করা হত এবং যেগুলো তিনি একাই বর্ণনা করতেন। আপনার সামনে কয়েকটি দলিল পেশ করছি:

ইমাম বাইহাকী রহ: আল-আসমা ওয়াস সিফাতের ৮১ নং পৃষ্টায় এবং ইমাম লালিকায়ি ইতিকাদু আহলিস সুন্নার ২/২০১ এ আব্দুল্লাহ ইবনে সালিহ এর সূত্রে,তিনি মুয়াবিয়ার (রাঃ) সূত্রে, তিনি আলী ইবনে আবি তালহার সূত্রে, তিনি ইবনে আব্বাস(রাঃ) থেকে (اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ) আয়াতটির ব্যাপারে বর্ণনা করেন:

“এখানে বলা হচ্ছে: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আসমান ও যমীনবাসীদের পথপ্রদর্শনকারী। (مَثَلُ نُورِهِ) অর্থাৎ মুমিনের অন্তরে তার হেদায়াতের দৃষ্টান্ত এমন, যেমন স্বচ্ছ তেল এ আগুনের স্পর্শ লাগার পূর্বেই তা আলোকিত করে তুলে। অত:পর যখন আগুনের স্পর্শ লাগে, তখন আলো আরও বহুগুণে বেড়ে যায়।

আরেকটি বর্ণনা, যা ইমাম তাবারী রহ: তার তাফসীরে (৮/১১৫) একাধিক জায়গায় এবং ইমাম বাইহাকী রহ: তার ‘আলআসমা ওয়াস সিফাত” এর ৯৪ পৃষ্ঠায় একই সনদে মারফুসুত্রে উল্লেখ করেছেন, নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর ব্যাপারে:

{المص}, {كهيعص}, {طه}, {يس}, {ص}, {طس}, {حم}, {ق}, {ن}

“এগুলো কসম, আল্লাহ তা’আলা এগুলোর শপথ করেছেন। এগুলো আল্লাহ তা’আলার একেকটি নাম।”

এটি একটি মুনকার হাদিস। সুবহানাল্লাহ! কোন জ্ঞানী মানুষের নিকট কিভাবে এগুলোকে সঠিক মনে হতে পারে? কোন মানুষ কি শুনেছে কাফ, সা’দ, নূন- এগুলো আল্লাহর নাম?

অর্থাৎ যখন আপনি আল্লাহকে ডাকবেন, তখন বলবেন হে ক্বাফ! হে সাদ!

আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি।

অনুরূপ ইবনুল হাকাম বর্ণনা করেছেন, যেটা ইমাম সুযৃতী রহ: আল ইতকানে [২/১৮৯] তার থেকে বর্ণনা করেছেন।

তা হচ্ছে: “ইমাম শাফেয়ী রহ: বলেছেন: ইবনে আব্বাস রা: থেকে তাফসীরের ব্যাপারে মাত্র ১০০ হাদিস প্রমাণিত”। আমি বলবো: এটা কিভাবে? শুধু সহীফা (সহীফায়ে ইবনে আব্বাস) এ ই তো ১৪০০ এর অধিক রিওয়ায়াত?

তাই মোটকথা হল, হাদিস সমালোচক মুহাদ্দিসদের নীতির আলোকে এই রেওয়ায়াতটি কোনভাবেই প্রমাণিত হয় না। যা এখন প্রত্যেক সত্যন্বেষী ও সঠিক পথের অনুসারীর নিকট স্পষ্ট।

দ্বিতীয় রেওয়ায়াত: এ ব্যক্তির কুফরীর ন্যায় নয়, যে আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ ও তার রাসূলগণের সাথে কুফরী করে।

এটাকে একটি সংকটপূর্ণ রেওয়ায়াত হিসাবে গণ্য করা যায়। এটা ইবনে তাউস থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ তা’আলার বাণী- (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) এর ব্যাপারে তিনি বলেন: এটা তার সাথে কুফরী। তবে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ ও তাঁর নবীদের সাথে কুফরীর মত নয়।

ইমাম তাবারী রহ: এর তাফসীরেও যেখানে প্রয়োজন মনে হয়েছে, সেখানে ইবনে আব্বাসরা: এর এ কথাটি আনা হয়েছে। কারণ তার নিকট এর দোষ প্রকাশিত ছিল না। তার সূত্র হচ্ছে: সুফিয়ান, মা’মার ইবনে রাশেদ থেকে, তিনি ইবনে তাউস থেকে, তিনি তার পিতা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস রা: থেকে।

এই বর্ণনায় এটা আব্দুল্লাহ ইবনে তাউস রহ: এর কথা হিসাবে এসেছে। কিন্তু উলুমে হাদিসের নীতি অনুসারে তার ব্যাপারে আমরা বলবো: এটা তো ইবনে তাউসে বক্তব্য; ইবনে আব্বাস রা: এর বক্তব্য নয়। তাই এটা মুদরাজ (তথা মাঝে সংযুক্ত)। আর এর দলিল কয়েকটি:

প্রথম দলিল: ইবনে আব্বাস রা: এর কথার সাথে এই অতিরিক্ত কথাটি যিনি বর্ণনা করেছেন, তিনি হচ্ছেন সুফিয়ান। তিনি বর্ণনা করেছেন মা’মার ইবনে রাশেদ থেকে। আর ইমাম আব্দুর রাজ্জাক এক্ষেত্রে তার থেকে ব্যতিক্রম করেছেন। তিনি এর ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলেছেন: “এটা ইবনে তাউসের বক্তব্য” ।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন: “আমাদের নিকট মা’মার, ইবনে তাউস থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: ইবনে আব্বাস রা: কে আল্লাহর এই আয়াতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হল: (فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) তিনি বলেন: “এটা আল্লাহর সাথে কুফরী”

ইবনে তাউস বলেন: তবে এ ব্যক্তির কুফরীর ন্যায় নয়, যে আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ ও তার রাসূলগনের সাথে কুফরী করে”। সুতরাং স্পষ্ট হল, এটা ইবনে তাউসের বক্তব্য; ইবনে আব্বাস রা: এর বক্তব্য নয়।

দ্বিতীয় দলিল: হাদিসের ইমামগণ বলেছেন: যখন মা’মারের ছাত্রদের মধ্যে ইখতিলাফ (মতবিরোধ) হয়, তখন আব্দুর রাজ্জাকের কথা গ্রহণযোগ্য হবে। এটা বলেছেন আব্দুর রাজ্জাকের সমকালীন ও তার ব্যাপারে সম্যক অবগত, হাদিস ও রাবি সমালোচক ইমাম সানআনী রহ:।

 তখন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সাহল ইবনে আসকার বললেন: আমি আহমাদ ইবনে হাম্বলকে বলতে শুনেছি: যখন মা”মারের ছাত্রদের মাঝে মতবিরোধ হয়, তখন আব্দুর রাজ্জাকের হাদিসটি গ্রহণযোগ্য হবে। (তারীখু আসমাউস সিকাত: ১/১৮০০)

এমনিভাবে হাফেজ ইবনে হাজার রহ:ও মা’মার থেকে আব্দুর রাজ্জাকের রেওয়ায়াতকে, মামার থেকে আব্দুল আলার রেওয়ায়াতের উপর প্রাধ্যান্য দিয়েছেন।

আর আপনি কি জানেন আব্দুল আলা কে? তিনি এমন নির্ভরযোগ্য, যে, মুহাদ্দিসদের ব্যাপক সংখ্যক লোক তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এবার আপনি আমাদের কথার দলিল নিন:

হাফেজ রহ: বলেন: “ইমাম নাসায়ীর নিকটও মা’মার থেকে আব্দুল আলার সূত্রে বর্ণিত যুহরীর হাদিসের মধ্যে বকরী ও মুরগীর মাঝে হাঁসের বর্ধনের মত মনে হয়েছে। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক এর থেকে ভিন্ন রকম বর্ণনা করেছেন।

আর মা’মার থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে আব্দুল আলার তুলনায় তিনিই অধিক দৃঢ়। এ কারণে তিনি তা (আব্দুল আলার বর্ণনা) উল্লেখ করেননি”। (ফাতহুল বারী: ২/৩৬৮)

একারণে ইবনে আব্দুল বার রহ: এটাকে আরো দৃঢ় করে বলেন: ‘আবান’ গ্রহণযোগ্য নয়৷ আব্দুর রাজ্জাকের বর্ণনার উপর তার সংযোজন গ্রহণ করা হবে না। কারণ মামার থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে আব্দুর রাজ্জাকই সর্বাধিক দৃঢ়। (আত্তামহীদ: ৬/৪১০)

যদিও আমরা জানি, আবান নির্ভরযোগ্য; তাকে সত্যায়নকারীও অনেক আছে এবং তিনি সহীহাইনের রাবী।

আব্বাস আদ্দাওরী ইবনে মায়ীন থেকে বর্ণনা করেন: “মা’মারের হাদিস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আব্দুর রাজ্জাকই সবার্ধিক মজবুত”/ (তাহযীবুত তাহ্যীব: ৬/২৭৯)

ইয়াকুব ইবনে শুআইব বলেন: “মা’মারের হাদিসের ক্ষেত্রে আব্দুর রাজ্জাকই অধিক মজবুত ও উত্তম সংরক্ষণকারী।

তাই সুহৃদ পাঠকগণ! দেখুন, ইমাম আহমাদ, ইবনে মায়ীন, ইবনে আব্দুল বার, ইয়াকুব ও ইবনে হাজারের মত বড় বড় ইমামগণ আব্দুর রাজ্জাকের রেওয়ায়াতকে অন্যদের তুলনায় কিরূপ প্রাধান্য দিলেন! আর দেখুন, মুরজিয়াদের মাযহাব সমর্থনকারীরা কিভাবে ইমামদের বিরোধিতায় মরণপণ লেগেছে! তাই আল্লাহই আশ্রয়।

তৃতীয় দলিল: বিশুদ্ধ ও সুপ্রমাণিত রেওয়ায়াত হল আব্দুর রাজ্জাকের রেওয়ায়াত। যাতে নি:শর্তভাবে বলা হয়েছে “এটা আল্লাহর সাথে কুফরী”। যাতে সুফিয়ানের রেওয়ায়াতের অতিরিক্ত কথাটি নেই। এটাই ইমাম আহমাদ, ইবনে মায়ীন, ইয়াকুব, ইবনে আব্দুল বার ও ইবনে হাজার রহ: দের বক্তব্যের দাবি।

চতুর্থ দলিল: মুদরাজ (সংযুক্তিপূর্ণ হাদিস) প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসগণ যে বিবরণ পেশ করেছেন, তা এই রেওয়ায়াতে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। ইমাম যাহাবী রহ: বলেন: মুদরাজ হল এমন শব্দাবলী, যা কোন বর্ণনাকারীর পক্ষ থেকে মূল হাদিসের মাঝে যুক্ত হয়, শ্রোতার নিকট মনে হবে, এটা মূল হাদিসেরই অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু কোন প্রমাণ দ্বারা বোঝা যাবে, এটা বর্ণনাকারীর শব্দ এবং হাদিসটির কোন সনদে একথা স্পষ্ট করে দেওয়া হবে যে, এতটুকু হাদিসের শব্দ আর এতটুকু বর্ণনাকারীর শব্দ।

আর এই রেওয়ায়াতের এমন সনদ রয়েছে, যা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে এবং উক্ত সনদটি অপর রেওয়ায়াতের সনদ থেকে অধিক মজবুত ও শক্তিশালীও। উক্ত রেওয়ায়াতের সারকথা হল: এটা ইবনে তাউসের বক্তব্য, যা সংযুক্ত করা হয়েছে; ইবনে আব্বাস রা: এর থেকে মুক্ত।

তৃতীয় রেওয়ায়াত: মূল কুফরের চেয়ে ছোট কুফর।

ইমাম মারওয়াষী রহ: “তাযিযু কাদরিস সালাহ” এর ২/৫২১ এ ইবনে আব্বাস রা: থেকে এটি বর্ণনা করেন। ইমাম হাকিম রহ: মুস্তাদরাক এর ২/৩১৩ এ হিশাম ইবনে হুযায়র থেকে, তিনি তাউস থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন: “এটা এমন কুফর নয়, যার বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করবে।

এটা এমন কুফর নয়, যা ধর্ম থেকে বের করে দেয়। (আরবি) এটা মূল কুফরের চেয়ে ছোট কুফর। আর কেউ আরও বৃদ্ধি করে বলেছে: এটা মূল জুলুমের চেয়ে ছোট জুলুম, মূল ফিসক থেকে ছোট ফিসক।”

এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ নয়। এর সনদের মাঝে হিশাম ইবনে হুজাইর রয়েছে, যাকে ইমাম আহমাদ, ইবনে মায়ীন ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন। আর তিনি একাই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আর কেউ বর্ণনা করেনি।

তাই এ বর্ণনাটি দুই কারণে মুনকার (প্রত্যাখ্যাত):

প্রথম কারণ: হিশাম এককভাবে এটা বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয় কারণ: তার থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণ তার বিরোধিতা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে তাউস, যিনি তার থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য- তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। আর ইবনে তাউসের বর্ণনা বিভিন্ন শব্দে এসেছে।

যেমন: “এটা কুফর”, কোথাও এসেছে, “এটা তার সাথে কুফরী”, কোথাও এসেছে, “এটাই তার কুফরীর জন্য যথেষ্ট।

আব্দুর রাজ্জাক তার তাফসীরের ১/১৯১ এ, ইবনে জারীর তার তাফসীরের ৬/২৫৬ এ, ওয়াকি ‘আখবারুল কুযাতের ১/৪১ এ এবং অন্যান্য ইমামগণ সহীহ সনদে এটা বর্ণনা করেছেন।

আর সেগুলো নি:শর্ত ও স্পষ্ট; ইবনে হুজাইর যে বৃদ্ধি করেছে, সেগুলোতে তা নেই। অতএব স্পষ্ট হল যে, এ বর্ণনাটিও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। তাই এটা প্রত্যাখ্যাত, প্রমাণের যোগ্য নয়।

চতুর্থ রেওয়ায়াত: এমন কুফর নয়, যার বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করবে।

এমন কুফর নয়, যার বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করবে। এটাও হিশাম ইবনে হুজাইর এর সুত্রে। অনেক ইমামগণ তাকে যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন। আলী ইবনুল মাদিনী বলেন: আমি ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আলকাত্তানের নিকট পাঠ করতে লাগলাম: জুরাইজ আমাদের নিকট হিশাম ইবনে হুজাইর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন… তখন ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ বললেন: এটা ফেলে দেওয়াই উপযুক্ত। আমি বললাম, তার হাদিস ছুড়ে মারবো? তিনি বললেন: হ্যাঁ।

ইবনে আদি বলেন: মুহাম্মদ ইবনুল হাসানের বরাবর লিখা হয়েছে: আমাদের নিকট আমর ইবনে আলি বর্ণনা করেন, আমি ইয়াহইয়াকে শুনেছি, তাকে হিশাম ইবনে হুজাইর এর হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি তার থেকে হাদিস বর্ণনা করতে নিষেধ করলেন এবং তাকে সমর্থন করলেন না।

আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ বলেন: আমি ইয়াহইয়াকে হিশাম ইবনে হুজাইর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি তাকে খুব যয়ীফ সাব্যস্ত করলেন। তিনি আরও বললেন: আমি আমার বাবাকে বলতে শুনেছি: হিশাম ইবনে হুজাইর মক্কী, হাদিসের ক্ষেত্রে সে দুর্বল!

পক্ষান্তরে ইবনে হিব্বান, ইবনে সা”দ, ইবনে শাহীন ও আজালীর ন্যায় ইমামদের পক্ষ থেকে তাকে যে সমর্থন করা হয়েছে, তা ইমাম আহমাদ, ইবনুল মাদিনী ও ইবনে সায়ীদ এর ন্যায় হাদিস সমালোচক ইমামদের সামনে কিছুই না, কারণ এ ধরনের মতবিরোধের ক্ষেত্রে তাদের কথার উপর নির্ভর করা হয়৷ তাই তারা হলেন, এই শাস্ত্রে পুরো দুনিয়ার ইমাম। বিশেষত: যেহেতু হিশাম এটি এককভাবে বর্ণনা করেছে। আর এক্ষেত্রে কেউ তার অনুসরণ করেনি।

এ কারণেই সুফিয়ান রহ: হিশাম থেকে বর্ণনা করার ব্যাপারে ওযর পেশ করে বলেন: “আমরা তার থেকে শুধু এমন হাদিসই গ্রহণ করেছি, যেটা অন্য কারো থেকে পাইনি”। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুফিয়ান হিশাম থেকে যত হাদিস বর্ণনা করেছেন, সবগুলোই এধরণের। তাহলে কিভাবে তার মুতাবাআত (অনুসরণ কে রেওয়ায়াত করা) এর দাবি করা যায়?

পঞ্চম রেওয়ায়াত: এমন কুফর, যা ধর্ম থেকে বের করে না৷

এটি একটি দুর্বল বর্ণনা। এটা মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়ার সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন: “আমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করেন আব্দুর রাজ্জাক, সুফিয়ান থেকে, তিনি এক ব্যক্তি থেকে, উক্ত ব্যক্তি তাউস থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে.. আল্লাহর এই বাণীর ব্যাপারে- (فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) তিনি বলেন: “এটা এমন কুফর, যা ধর্ম থেকে বের করে না”।” এখানে অস্পষ্টতা প্রকাশ্য।

তাহলে স্থির হল, ইবনে আব্বাস থেকে যেটা কোন সন্দেহ ছাড়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং যাতে কোন আপত্তির অবকাশ নেই তা হল: “এটা তার সাথে কুফরী”। যা আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্য ইমামগণ সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন, যাতে কোন সন্দেহের স্পর্শ নেই। সুতরাং এটাই হল মূল ও নিখুত। এর দ্বারাই থেকে ইবনে আব্বাস রা: এর অবস্থান সুনির্ধারিত হয়। আর তাউস থেকে এর বিপরীত যা বর্ণিত হয়েছে তা পূর্ববর্তী ইজমা ভাঙ্গতে পারবে না।

পঞ্চমত: যেহেতু এই বর্ণনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব বহন করে, সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়, শরীয়তের নীতি বর্ণনা করে এবং বাহ্যিকের বিপরীত ব্যাখ্যা কও, তাহলে তো বহু সংখ্যক ইমাম এবং সুনান, মুসনাদ ও মু’জামের মুসান্নিফগণ তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বেন এবং এর চূড়ান্ত গুরুত্বের কারণে কোন একটি তাফসীর থেকে এটা বাদ পড়বে না। কিন্তু তা তো দেখা যায় না।

বরং ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই এর বিপরীত ইজমা বর্ণনা করেছেন। তাহলে তাদের সকলের এর থেকে বিমৃখীতা খুবই আশ্চর্জনক। যদিও ইমাম আহমাদ রহ: তার কিতাবুল ঈমানে হিশামের সূত্রে এটা বর্ণনা করেছেন, যাকে তিনি নিজেই যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন।

এমনিভাবে সায়ীদ ইবনে মানসুর, ইবনে বাত্তা, হাকিম, বাইহাকী, মারওয়ায়ী ও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সহীহ এর মুসানিফদের এর থেকে বিমূখীতা খুবই আশ্চর্যজনক ও সন্দেহপূর্ণ। যা এর দুর্বলতা নিশ্চিত করে।

আর এই জবাব নিজের জন্য বা নিজের মাযহাবের জন্য বা নিজস্ব চিন্তাধারা বাস্তবায়নের স্বার্থে দেওয়া হচ্ছে না। কেননা বান্দা ও তার সৃষ্টিকর্তার মাঝে ভুল বোঝা পড়ার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন মাযহাবের পক্ষে জবাব দেওয়া আদৌ দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।

তৃতীয় আপত্তি:

খতীব বাগদাদী রহ: তারিখে বাগদাদে ১০/১৮৬ এ বর্ণনা করেন, হাসান ইবনে খিজির বলেন: আমি ইবনে আবি দাউদকে বলতে শুনেছি:

জনৈক খারিজী লোককে খলীফা মামুনের সামনে উপস্থিত করা হল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি কারণে আমাদের বিরোধিতা কর? সে বলল: আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতের কারণে । তিনি বললেন: কোন আয়াত? সে বলল: এই আয়াত (وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ) তখন মামুন তাকে বললেন: তুমি কি এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে জান?

 সে বলল: হ্যা। মামুন বললেন: এর পক্ষে তোমার দলিল কি? সে বলল:

উম্মাহর ইজমা। মামুন বললেন: তাহলে যেমনিভাবে তুমি এর অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে ইজমা মেনে নিয়েছ, তেমনিভাবে এর তাবিলের (ব্যাখ্যার) ব্যাপারেও ইজমা মেনে নাও।

তখন সে বলল: আপনি সত্য বলেছেন। আপনার প্রতি সালাম হে আমীরুল মুমিনীন!

আমরা বলবো: এটা প্রমাণিত নয়। এর সনদের এক স্তরে মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে দুরাইদ ইবনে আতাহিয়া আবু বকর আযদী রয়েছে।

 আবু বকর আলআযহারী আল লাগবী বলেন: আমি ইবনে দুরাইদের নিকট গিয়ে তাকে মাতাল অবস্থায় দেখেছি। (লিসানুল মিযান: ৫/১৩৩)

আমি বলবো: সুদৃঢ় ইমামদের থেকে বর্ণিত সালাফের ইজমার বিপরীতে এই ইজমা বর্ণনা করার দ্বারা তার কি উদ্দেশ্য! তা আল্লাহই ভাল জানে।

আবু বকর আলহারাবী বলেন: আমি ইবনে শাহীনকে বলতে শুনেছি: “আমরা ইবনে দুরাইদের নিকট গিয়ে তার অবস্থা দেখে লজ্জাবোধ করতাম। সেখানে কতগুলো কাঠ ঝুলানো থাকত আর তাতে থাকত স্বচ্ছ মদ।

অথচ তার বয়স নব্বই ছাড়িয়েছে”। মুসলিমা ইবনে কাসিম বলেন: তিনি ইতিহাস, ঘটনাবলী ও বংশ নিয়ে বেশি বর্ণনা করতেন। তবে তিনি মুহাদ্দিসীনের নিকট নির্ভরযোগ্য ছিলেন না। আর তিনি ছিলেন চরিত্রহীন। (উপরের সূত্র)

 

চতুর্থ আপত্তি:

কেউ কেউ দলিল দেয়, নাজ্জাশী মুসলিম ছিলেন, রাসূল সা: তার মৃত্যুর পর তার জানাযা পড়েছেন। আর তিনি ছিলেন একজন বাদশা ও শাসক; জনগণকে খৃষ্টীয় ধর্মমত দ্বারা শাসন করতেন!

আল্লাহর শপথ! এটা সবচেয়ে ভয়ংকর দলিল। কারণ এর আবশ্যকীয় অর্থ হচ্ছে: খৃ্ষ্টধর্ম বা অন্যান্য ধর্ম দ্বারা শাসন করা জায়েয আছে এবং এর তার দ্বারা শাসনকারী ব্যক্তি নেককারও।

কারণ রাসূল সা: নাজ্জাশী সম্পর্কে বলেছেন: সে একজন নেককার লোক।

আল্লাহ মুরজিয়াবাদকে ধ্বংস করুন! তা মুরজিয়াদেরকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে! এদের জবাব কয়েকভাবে দেওয়া যায়:

প্রথম জবাব: এই দলিলের অনিবার্ধ ফলাফল হল: খৃষ্টীয় ধর্মমত দ্বারা শাসন পরিচালনা করা জায়েয আছে। যদি মেনে নেই যে, নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণের পরও তার দ্বারা শাসন করেছেন। এ তো এমন ধূর্ত লোকের কারবার, যার পষ্টি লাগানোর কিছু নেই। এ তো আল্লাহর বিধানের শাসন আবশ্যককারী সকল মূলনীতিগুলোকেই চুরমার করে দেওয়ার ঘোষণা।

অথচ এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে যে, আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান বহির্ভূত যেকোন শাসনব্যবস্থা শরীয়তে নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা তো তার প্রকাশ্য বিরোধিতা, যা কোন আলেম তো নয়ই, কোন সাধারণ জ্ঞানী লোকও কখনো বলেনি।

দ্বিতীয় জবাব: নাজ্জাশী সূরা মায়িদা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেই মারা গেছেন। আর সুরা মায়িদায়ই শাসন ও দ্বীন পরিপূর্ণ করে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি তা অবতীর্ণ হওয়ার দুবছরের কিছু আগে তিনি মারা গেছেন।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ: ‘আল-ইসাবা”য় বলেন: ইমাম তাবারী ও একদল আলেম বলেন: তিনি নবম হিজরীর রজব মাসে মারা গেছেন। আর আরেক দল বলেছেন: তিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বে মারা গেছেন। (ফাতহুল বারী, ১/২০৬)

সুতরাং স্পষ্ট হয় যে, তার মৃত্যু এর পূর্বেই হয়েছিল। আর আমরা জানি, নামায ফরজ হয়েছে মিরাজের ঘটনায়। যখন এখনো দ্বীন পরিপূর্ণ হয়নি। তখন তারা মুসলিম ছিলেন; অথচ নামায পড়তেন না।

অতএব শরীয়ত আপনার উপর সেটাই আবশ্যক করে, যেটা আপনার নিকট এসেছে, যা অতি স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। এরপর যখন নামায ফরজ করে দেওয়া হল, তখন এটা পরিত্যাগ করা হয়ে গেল ইসলাম ভঙ্গের কারণ।

এমনিভাবে শাসনের ব্যাপারটিও। সুবহানাল্লাহ! প্রবৃত্তি পূজারীদেরকে প্রবৃত্তি কোন দিকে নিয়ে গেছে!

তৃতীয় জবাব: এ সকল লোকের নিকট এটা কিভাবে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হল যে, নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণের পরও খৃষ্টীয় ধর্মমত দ্বারা শাসন করেছেন? তারা যদি বলে: এটাই মূল অবস্থা। আমরা বলবো: বরং মূল অবস্থা তো হল, “ইসলাম পূর্বেও সব কিছুকে মিটিয়ে দেয়” ।

তাই তার প্রতি উত্তম ধারণা হল: ইসলামের যা কিছু তার নিকট পৌঁছেছে, তিনি তার দ্বারাই শাসন করেছেন।

চতুর্থ জবাব: এ কথার অনিবার্য ফল দাড়ায় যে, যদি কোন শাসক স্বীয় প্রবৃত্তি কারণে, বা রাজ্যের ব্যাপারে আশঙ্কা হেতু জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন আইন রচনা করে, যাতে সে সকল হালালকে হারাম করে এবং সকল হারামকে হালাল করে, তাহলে তার জানাযা নামায পড়া যাবে এবং রাসূল সা: যেমন নাজ্জাশীকে “নেককার লোক” বলেছেন, তাকেও সেরূপ বলা যাবে।

পঞ্চম জবাব: আয়াতটি নাযিল হয়েছে রাসূল সা: কে একথা জানানোর জন্য যে, তিনি যখন আহলে কিতাবদের মাঝে ফায়সালা করেন, তখন যেন আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান দ্বারাই শাসন করেন। তখন সংকটপূর্ণ বিষয়টির ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়: (وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ وَلاَ تَتَّبِعْ أَهْوَاءهُمْ)

এতটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হলাম। অন্যথায় এই খড়কুটোর জবাব দেওয়া একেবারে সহজ। এটা ভ্রুক্ষেপেরও যোগ্য নয়।

সালাফগণ এটাকে কোন প্রশ্ন হিসাবেই বিবেচনা করেননি। এটা হল পরবর্তীদের সৃষ্ট। বেঁচে থাকলে সামনে আরোও ঘৃণ্য আরও গুরুতর এবং আরও বেশি পরিমাণে এধরণের প্রশ্ন দেখতে পাবেন।

মোটকথা: কিতাব-সুন্নাহ থেকে আহরিত মূলনীতি স্থির হওয়ার পরও অনেকে ইবনে আব্বাস রা: এর উদ্ধৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অনেকে এর কারণে পরস্পর বিরোধী কথা বলেছেন।

শুধু তাই নয়; একদল মুরজিয়া এ কথাও বলেছে যে, শরীয়ত পরিবর্তনকারী, যতক্ষণ সেটাকে হালাল মনে না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কিছুতেই কাফের আখ্যায়িত করা যাবে না। আল্লাহই আশ্রয়।

আমাদের যা করণীয়, তা হল, কিতাব-সুন্নাহর দিকে ফিরা এবং সালাফদের সকল উদ্ধৃতিরসমূহের প্রতি লক্ষ্য করা, তার থেকেই মূলতত্ব বের করো।

অন্ধ অনুসরণ ও প্রবৃত্তি বশত: ইবনে আব্বাস রা: এর মুনকার বর্ণনাটিকে আকড়ে ধরা আর তার থেকে বর্ণিত বাকী সকল বিশুদ্ধ বর্ণনাগ্ডলোকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়।

সারকথা;

যে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ব্যতীত অন্য কিছুর দ্বারা শাসন করল, সে কুফরীতে লিপ্ত হল। তখন তার উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

তথা তাকফীরের সকল শর্তগুলো পূরণ করা হবে এবং সকল বাঁধাগুলো নিশ্চিতভাবে দূর করা হবে; সন্দেহপূর্ণভাবে নয়। এভাবে যদি সে তাওবা করে তাহলে আলহামদু লিল্লাহ।

আর যদি প্রমাণ ও দলিল পেশ করা সত্ত্বেও তাতে অটল থাকে ও অহংকার করে তাহলে তার উপর আল্লাহ প্রদত্ত কুফরের হুকুম কার্যকর করা হবে।

 একমাত্র আল্লাহই সঠিক পথপ্রদর্শনকারী।

যেমন ছিলেন সালফে সালেহিনগণ

যেমন ছিলেন সালফে সালেহিনগণ

শায়খ খালিদ আল হুসাইনান রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

যেমন ছিলেন

সালফে সালিহিনগণ

খ্যাতনামা শাইখ ও আলেম

শাইখ খালিদ আল হুসাইনান (রহিমাহুল্লাহ্)

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। অজস্র দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ, তার সাহাবীগণ ও তার পরিবারবর্গের উপর।

আম্মাবা‘দ;

সালিহীন, আবিদীন ও আলেমে রাব্বানীদের অবস্থা, ঘটনাবলী ও জীবন চরিত জানা এই যামানায় আমাদের বড় প্রয়োজন। কারণ তাদের গুণাবলীর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, তাদের ঘটনাবলী জানা এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার মাঝে অনেক উপকারীতা রয়েছে। যেমন:

১. এই সকল মহাপুরুষগণ যে স্তরে পৌঁছেছেন, সে স্তরে পৌঁছার জন্য দৃঢ় সংকল্প করা এবং মনোবল সতেজ করা।

২. নিজের ত্রুটি ও হীনতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।

৩. অন্তর ও বিবেককে সেই উন্নত চরিত্র, মহৎ গুণাবলী ও অনুপম ইবাদতের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করানো, আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যার থেকে ব্যাপক উদাস হয়ে পড়েছি।

তাই আমি পাঠকদের সামনে এই আলোচনাটি নিয়ে হাজির হলাম, যাতে শুধু সংকলন, সংক্ষেপণ, পরিমার্জন ও বিন্যাস ব্যতীত আমার কোন কাজ নেই। সবটাই আমি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলিম ও মুজতাহিদদের বাণী ও উক্তিসমগ্র থেকে সংকলন করেছি। আল্লাহ তাদের প্রতি ভরপুর রহমত বর্ষণ করুন আর আমাদের ও তাদের সকলকে তার সুবিস্তৃত জান্নাতে ও সন্তুষ্টিময় স্থানে আবাস দান করুন। তিনিই একমাত্র আশ্রয় এবং ভরসা তারই উপর।

 আমি এ বিষয়টি সংকলন করেছি যাতে এটা আমার জন্য নেককারদের গুণাবলী ও চরিত্র সম্পর্কে জানতে সহায়ক হয় আর দায়ী , খতীব ও মসজিদের ইমামগণসহ সকল মানুষ এর থেকে উপকৃত হয়।

فاعبده واصطبر لعبادته

অতএব তারই ইবাদত কর এবং তারই ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখ

  • ইমাম সা’দী রহ: বলেন: অর্থাৎ নিজেকে তাতে আবদ্ধ রাখ, তাতে পরিশ্রম কর এবং তোমার সাধ্যমত পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গরূপে তা পালন কর। আর একজন আবেদের জন্য আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত থাকা যেকোন সম্পর্ক ও যেকোন কামনা বাসনা থেকে অধিক আরামদায়ক ও শান্তিদায়ক।
  • সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হল; বান্দার অন্তর ইবাদতের আগ্রহে পরিপূর্ণ থাকা। এভাবে যখন অন্তর ইবাদতের আগ্রহে পরিপূর্ণ থাকবে, তখন অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী অঙ্গ – প্রত্যঙ্গও আমল করতে থাকবে। ফলে কখনো অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ ইবাদত করতে থাকবে, কিন্তু অন্তর নিস্কর্ম থাকবে।
  • যে ইবাদতগুলোতে সালফে সালিহীনের অনেকে উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন:

– আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে উদাসীনতা প্রদর্শন করো। তা হচ্ছে ‘ তাওয়াযু ‘ (বিনয়)।

– হাসান বসরী রহ: বলেন, সর্বোত্তম ইবাদত হল, মধ্য রাতে নামায পড়া। তিনি আরও বলেন: এটা বান্দার জন্য আল্লাহর নৈকট্যলাভের সবচেয়ে সহজ পথ। অতঃপর তিনি বলেন: আমি এর চেয়ে কঠিন ইবাদত আর কিছু দেখিনি।

– ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ: বলেন: সর্বোত্তম ইবাদত হল, ফরজসমূহ আদায় করা, হারামসমূহ থেকে বেঁচে থাকা।

– ইবনুস সাম্মাক তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে লিখেন: সর্বোত্তম ইবাদত হল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং কামনা বাসনা নিয়ন্ত্রণ করা। আর সর্বনিকৃষ্ট লোভ হল আখিরাতের কাজের মাধ্যমে দুনিয়া অন্বেষণ করা।

-জনৈক বুযুর্গ বলেন: মূল ইবাদত হল: তুমি আল্লাহ ব্যতিত কারো কাছে চাইবে না।

* কিভাবে আল্লাহর দিকে এগুবে? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: বান্দা কষ্ট সহ্য করা ও নিজের ত্রুটি – বিচ্যুতি দেখার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে এগুতে থাকে।

* আল্লাহ থেকে লজ্জা করা বান্দা আল্লাহ থেকে লজ্জা করবে যেভাবে: ভয় ও বিনয়হীন নামায নিয়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে লজ্জা করবে। ফলে আল্লাহ থেকে লজ্জার অনুভূতি একজন মুসলিমকে ভালোভাবে ইবাদত করতে এবং এমন বিনয়ী নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে উদ্বুদু করে, যাতে ভয় ও শংকার তাৎপর্য বিদ্যমান থাকবে।

* তুমি কিভাবে নিজের মাঝে আল্লাহর নৈকট্য উপলব্ধি করতে পারবে? ইবনুল কায়্যিম রহ; বলেন: আল্লাহর নৈকট্যের পরিমাণ অনুযায়ী বান্দার ইবাদতে ব্যস্ততা সৃষ্টি হয়।

* ফকীহ কে! ইমাম আওযায়ী রহ: বলেন: আমাকে জানানো হল, এটা কথিত আছে যে; ধ্বংস সে সকল ফকীহদের জন্য, যারা ইবাদত সঠিকভাবে করে না আর সন্দেহ সংশয় দ্বারা হারামকে হালাল করে।

– জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন: তাকওয়াহীন ফকীহ এমন প্রদীপের ন্যায়, যা ঘর আলোকিত করে, কিন্তু নিজেকে দগ্ধ করে।

– ইমাম শা’বী রহ: বলেন; আমরা আলেম বা ফকীহ নই। আমরা হলাম এমন কিছু লোক, যারা একটি হাদিস শ্রবণ করেছি, অত:পর তোমাদের নিকট বর্ণনা করছি। আমরা শুনেছি: ফকীহ হল সে, যে আল্লাহর হারামসমূহ থেকে বেঁচে থাকে। আর আলিম হল সে, যে মহান আল্লাহকে ভয় করে।

  • কখন ইবাদতের স্বাদ লাভ করবে:

– বিশর ইবনুল হারিছ বলেন: তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ইবাদতের স্বাদ লাভ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার মাঝে ও কামনা বাসনার মাঝে একটি লোহার দেয়াল তৈরী না হবে।

– ইয়াহইয়া ইবনে মাআয বলেন: দেহের অসুস্থতা ক্ষুধার কারণে আর অন্তরের অসুস্থতা গুনাহের কারণে। তাই যেমনিভাবে দেহ অসুস্থতার সময় খাবার স্বাদ পায় না, তেমনিভাবে অন্তর গুনাহের সাথে ইবাদতের স্বাদ পায় না।

– ওহাইব ইবনুল ওয়ারদ কে বলা হল: যে গুনাহ করে সে কি ইবাদতের স্বাদ পায়? তিনি বললেন: না, এমনকি যে গুনাহের ইচ্ছা করে সেও না।

  • আমাদের উপর আল্লাহর হক কি?

আমাদের উপর আল্লাহর হক হল আমরা তারই ইবাদত করবো, তার সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং সামান্য ইবাদতও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নিবেদন করবো না। কারণ যে সত্ত্বা সকল প্রকার ইবাদতের হকদার, তিনি হচ্ছেন একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলা। একত্ব শুধু তারই, আনুগত্য শুধু তারই, জবাই ও মান্নত শুধু তারই নামে হবে, কসম শুধু তারই নামে হবে, তাওয়াফ কেবল তার ঘরকেই করতে হবে, শাসনকর্তৃত্ব একমাত্র তারই অধিকার। কারণ একমাত্র তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত।

  • হাসান বসরী রহ: মসজিদে প্রবেশ করে একটি মজলিসের পাশে বসলেন, যেখানে কথা চলছিল। তিনি তাদের কথা শোনার জন্য চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন: এই লোকগুলো ইবাদতে বিরক্ত হয়ে গেছে আর কথাবার্তা তাদের নিকট আরামদায়ক হয়ে গেছে। তাদের খোদাভীতি কমে যাওয়ার কারণে তারা কথাবার্তা বলছে।
  • ইবাদতের প্রাণ হল: আল্লাহর বড়ত্বের অনুভূতি ও তার প্রতি ভালবাসা। যখন দু’টির একটি অপরটি থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়।
  • কেন আমরা ইবাদত থেকে বঞ্চিত হই:

– ফুযাইল ইবনে ইয়া বলেন: যখন তুমি রাত্রি জাগরণ ও দিবসে রোযা পালন করতে পারবে না, তখন মনে করো, তুমি বঞ্চিত, বন্দী; তোমার গুনাহ তোমাকে বন্দী করে রেখেছে।

– আবু সুলাইমান আদ – দারানী বলেন: কারো গুনাহের কারণেই তার জামাতে নামায ছুটে যায়।

– জনৈক ব্যক্তি ইবরাহীম ইবনে আদহামকে বলল; আমি রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করতে পারি না, তাই আমার জন্য একটি চিকিৎসা বলুন। তিনি বললেন: তুমি দ্বীনের বেলা তার অবাধ্যতা করবে না। তাহলে তিনিই তোমাকে রাত্রি বেলা তার সামনে দাঁড় করাবেন। কারণ রাত্রি বেলা তার সামনে দন্ডায়মান হওয়া একটি মহা মর্যাদাকর বিষয়। আর গুনাহগার এই মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না।

  • কিভাবে তা ছেড়ে দিলো? আবু সুলাইমান আদ – দারানী বলেন; ঐ ব্যক্তির বিষয়টি আশ্চর্যের নয়, যে এখনো ইবাদতের স্বাদ পায়নি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, যে ইবাদতের স্বাদ পাওয়ার পরও তা ছেড়ে দিল। সে কিভাবে এখন তা না পেয়েও সবর করতে পারে?!

আল্লাহভীতি

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

আর যে স্বীয় রবের সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং মনকে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে বিরত রাখে, নিশ্চয়ই জান্নাতই তার ঠিকানা

ইমাম তাবারী রহ: বলেন; অর্থাৎ আর যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার সময় আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হওয়াকে ভয় করে, ফলে তার ফরজগুলো আদায় করা ও তার গুনাহগুলো পরিত্যাগ করার মাধ্যমে তাকে ভয় করে চলে।

 (وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى) অর্থাৎ যে বিষয় আল্লাহ অপছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট নন, এমন বিষয়ের কামনা বাসনা থেকে স্বীয় মনকে বাঁধা দেয়, সতর্ক করে এবং স্বীয় প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে আল্লাহ আদেশের দিকে চলে।

  • আল্লাহভীতির প্রকৃত অর্থ: হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকা।
  • ইবনুল কায়্যিম রহ: আল্লাহভীতির সংজ্ঞা দেন এভাবে: যার কারণে পরকালের ক্ষতির আশংকা থাকে তা বর্জন করা।
  • নবী কারীম ﷺ এর আল্লাহভীতি আনাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি পতিত খেজুরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। খেজুরটি দেখে তিনি বললেন: যদি এটা সদকার খেজুর না হত, তাহলে আমি অবশ্যই এটা খেতাম। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ:)
  • কিভাবে কারো আল্লাহভীতি বুঝতে পারবে? ইউনুস ইবনে উবায়দ বলেন: একজন লোক কথা বললে, তুমি তার কথার দ্বারা তার আল্লাহভীতি বুঝতে পারবে।
  • সবচেয়ে কঠিন আমল: বিশর ইবনুল হারিছ বলেন: সর্বাধিক কঠিন আমল তিনটি; স্বল্পতার মধ্যেও দান করা, নিভৃতে আল্লাহকে ভয় করা এবং এমন ব্যক্তির নিকট হক কথা বলা, যার থেকে আশংকা ও আশা করা হয়।
  • ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ বলেন; ইলম তিনটি জিনিসের নাম:

১. এমন আল্লাহভীতি, যা তাকে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখে।

২. এমন চরিত্র, যার মাধ্যমে সে মানুষের সাথে কোমল আচরণ করে।

৩. এমন সহনশীলতা, যার মাধ্যমে সে অজ্ঞদের অজ্ঞতার জবাব দেয়।

  • আল্লাহভীতির একটি নমুনা: এই উম্মাহর পূর্বসূরীদের জীবনীতে হারাম কাজে পড়ে যাওয়ার আশংকা সংক্রান্ত অনেক আল্লাহভীতির ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এর একটি ঘটনা: তিনি মার্ভ ‘ থেকে শামে ফিরে আসেন একটি কলম ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, যেটা তার জনৈক সাথী থেকে তিনি ধার নিয়েছিলেন।
  • গভীর আল্লাহভীতি: মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুরাব্বা বলেন: আমি আহমাদ ইবনে হাম্বলের নিকট ছিলাম। তার নিকট একটি দোওয়াত ছিল। ইত্যবসরে আবু আব্দুল্লাহ একটি হাদিস বর্ণনা করলে আমি তার নিকট তার দোওয়াত দিয়ে লেখার জন্য অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন: হে অমুক তুমি লিখতে পার! আর এটাই হচ্ছে গভীর আল্লাহভীতি।
  • আল্লাহভীতির ব্যাপারে একটি মূলনীতি: শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: এ বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন: ওয়াজিব বা মুস্তাহাব বিষয়ের মধ্যে যুহদ (দুনিয়া বিমুখীতা) ও তাকওয়া হয় না। যুহদ ও তাকওয়া হয় হারাম ও মাকরূহ বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে।

وكانوا لنا خاشعين

আর তারা আমার প্রতি বিনীত

ইমাম তবারী রহ. বলেন: অর্থাৎ তারা আমার প্রতি বিনয়ী ও অনুগত, আমার ইবাদত করতে ও আমাকে ডাকার ব্যাপারে অহংকার করে না।

 আবুদ দারদা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ  বলেন: এই উম্মত থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি উঠিয়ে নেওয়া হবে তা হচ্ছে ‘খুশু’ (বিনয়)। ফলে তাদের মাঝে আর বিনয়ী লোক দেখতে পাবে না। (ইমাম তবারী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আর ইমাম আলবানী তা সহীহ বলেছেন)

  • আমরা কেন বিনয়ী হই না? প্রকাশ্যভাবে সবার মাঝে যে অন্তরের কাঠিন্যতা, চক্ষুর শুস্কতা ও চিন্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে এটা আসলে দুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে। দুনিয়া আমাদের অন্তরে প্রবল হয়ে গেছে। ফলে আমাদের ইবাদতেও এটা আমাদের সাথে থাকে। অন্তর ততক্ষণ পর্যন্ত তার সঠিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না, যতক্ষণ তার সাথে যুক্ত সকল ময়লা থেকে পবিত্র হতে না পারবে।
  • সকল আরিফ বিল্লাহগণ (আল্লাহর পরিচয় লাভকারীগণ) এ ব্যাপারে একমত যে, বিনয়ের কেন্দ্রস্থল হল অন্তর। আর তার ফলাফল প্রকাশ পায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। তাই বিনয়ীরা হয় আল্লাহর প্রতি অনুগত ও ভীত।
  • নামাযের খুশু ‘ র তাফসীর করা হয়েছে এভাবে: তা হচ্ছে পূর্ণ মনোযোগ শুধু নামাযের জন্য নিয়োগ করা আর অন্য সকল কিছু থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে রাখা।
  • ‘খুশু’এর মূল কথা: খুশু হচ্ছে অন্তর নরম, কোমল, প্রশান্ত, অনুগত ও নৃত হওয়া। তাই যখন অন্তর ‘খুশুওয়ালা’ (বিনয়ী) হয়, তখন সকল অঙ্গ – প্রত্যঙ্গও বিনয়ী হয়। কারণ অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ তো অন্তরের অনুগামী।
  • পূর্বসূরীদের ‘খুশু’র কয়েকটি নমুনা: ইবনুয যুবায়র রা: যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন বিনয়ের কারণে এমন হয়ে যেতেন, যেন একটি কাঠ। তিনি যখন সিজদায় যেতেন, চড়ুই পাখি তাকে গাছের ডালা মনে করে তার পিঠে বসত।
  • খুশু না থাকার কারণে দু’টি মন্দ ফলাফল দেখা যায়;

প্রথমত: অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত না থাকা। কারণ নামাযই অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন:( إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ) “নিশ্চয়ই নামায অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে”।

– দ্বিতীয়ত: কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন না হওয়া। কারণ আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ সফলতাকে যুক্ত করেছেন খুশুর সাথে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:( الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ )“অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে। যারা স্বীয় নামাযে বিনয়ী – নম্র”।

  • নামাযের প্রাণ: খুশুই হল নামাযের প্রাণ এবং তার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। তাই খুশুহীন নামায হল প্রাণহীন দেহের ন্যায়।

সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রহ: দেখলেন জনৈক লোক নামাযে খেলা – ধুলা করছে, তখন তিনি তাকে বললেন: যদি এই লোকের অন্তর নম্র ও বিনয়ী হত তাহলে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোও নম্র ও বিনয়ী হত।

  • মুনাফেকী (কপটতাপূর্ণ) বিনয়; আবু ইয়াহইয়া থেকে বর্ণিত, তার নিকট পৌঁছেছে, আবুদ দারদা ও আবু হুরায়রা রা: বলেন: তোমরা কপটতাপূর্ণ বিনয় থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। বলা হল: এটা কি!? তিনি বললেন: দেহকে খুশুওয়ালা দেখানো, কিন্তু অন্তর খুশুওয়ালা তথা বিনয়ী নয়।
  • কিভাবে আমরা খুশু ওয়ালাদের অন্তর্ভূক্ত হবো?
  • প্রথমত: তুমি নামাযে তোমার নড়া – চড়া, স্থিরতা, কিরাত পাঠ, দাঁড়ানো, বসা ইত্যাদি সব কিছুতে ‘ আল্লাহ তোমাকে দেখছেন ‘ একথা মনে করবে। তাই খুশু শুধু নামাযের সাথে খাস নয়। এটি একটি অন্তরের ইবাদত, বান্দার প্রতিটি অবস্থায় তার অঙ্গ – প্রত্যঙ্গে এর ফলাফল প্রকাশ পায়।
  • দ্বিতীয়ত: স্বীয় রবকে পরিপূর্ণভাবে চিনবে, ফলে তা অন্তরে রবের মহত্ব সৃষ্টি করবে।
  • তৃতীয়ত: তুমি মনে করবে ও একথা ভাববে যে, তুমি জাহান্নামের উপর ‘পুলসিরাত’ এ আছো। যেন তুমি তোমার চোখের সামনে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখছো এবং হিসাবের স্থানে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছে।
  • ঈমানী খুশু ও কপটতাপূর্ণ খুশুর মাঝে পার্থক্য: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: ঈমানী খুশু হল আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব, গাম্ভীর্য, ভয় ও তার থেকে লজ্জায় অন্তর আল্লাহর প্রতি নম্র ও বিনয়ী হওয়া। তার অন্তর যখন ভয়, অনুতাপ, ভালবাসা, লজ্জা ও আল্লাহর নিয়ামতরাজীর স্মরণে এবং স্বীয় অপরাধসমূহের দর্শনে আল্লাহর জন্য ভেঙ্গে যাবে, তখন তা অবশ্যম্ভাবীরূপেই নম্র ও বিনয়ী হবে। আর এর ফলে অঙ্গ – প্রত্যঙ্গও বিনয়ী হবে। পক্ষান্তরে কপটতাপূর্ণ বিনয় কৃত্রিমভাবে অঙ্গ – প্রত্যঙ্গে প্রকাশ পাবে, কিন্তু অন্তর নম্র ও বিনয়ী হবে না।
  • নামাযের খুশু দুই প্রকার:

– বাহ্যিক খুশু: তা হচ্ছে নামাযী ব্যক্তি স্থির থাকবে। সিজদার দিকে তার দৃষ্টি রাখবে; ডানে বামে দৃষ্টি ফেরাবে না। নামাযে খেলা – ধূলা ও ইমামের আগে বেড়ে যাওয়া থেকে দূরে থাকবে।

– আভ্যন্তরীণ খুশু; তা হবে আল্লাহর বড়ত্ব মনে উপস্থিত করা, আয়াত ও আযকারসমূহের অর্থ চিন্তা করা এবং শয়তানের বিভিন্ন কুমন্ত্রণার প্রতি প্রক্ষেপ না করার মাধ্যমে।

( إن الله يحب المتقين )

নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন

ইমাম তাবারী রহ: বলেন: যে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে এবং তার ফরজগুলো পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করে, তাকে আল্লাহ ভালবাসেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:  وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ “জেনে রেখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।”

 ইবনে আব্বাস রা: বলেন; অর্থাৎ আল্লাহ তার ঐ সকল বন্ধুদের সাথে আছেন, যারা তাদের প্রতি অর্পিত আল্লাহর আদেশ – নিষেধের দয়িত্বের ব্যাপারে তাকে ভয় করে।

ইমাম তবারী বলেন: অর্থাৎ “এবং তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের যুদ্ধের সময় তোমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করো যে, আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন। তিনি তাদের বিরুদ্ধে  তোমাদেরকে সাহায্য করবেন। তোমরা যদি আল্লাহর ফরজসমূহ পালন ও গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে তাকে ভয় কর, তাহলে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: শোনো! শরীরের মাঝে একটি মাংসপি- আছে, যখন তা শুদ্ধ হয়ে যায়, তখন পুরো শরীর শুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায়, তখন পুরো দেহ নষ্ট হয়ে যায়।

  • তাকওয়ার স্থান: ইবনে রজব বলেন: তাকওয়া বা পাপাচারের মূল উৎস হল অন্তর। তাই যখন অন্তর নেক ও তাকওয়াবান হয়ে যায়, তখন অঙ্গ – প্রত্যঙ্গও নেককার হয়ে যায়। আর যখন অন্তর পাপাচারী হয়, তখন অঙ্গ – প্রত্যঙ্গও পাপাচারী হয়ে যায়।
  • আবু হুরায়রা রা: কে বলা হল; তাকওয়া কি? তিনি বললেন, তুমি কি কখনো কণ্টকময় ভূমি অতিক্রম করেছ? লোকটি বলল: হ্যাঁ। তিনি বললেন; তখন কী করতে? লোকটি বলল: আমি তার থেকে আত্মরক্ষা অবলম্বন করতাম। তখন তিনি বললেন: ঠিক এভাবে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হচ্ছে তাকওয়া।
  • বেশি আমল, আবার বেশি গুনাহ: জনৈক লোক ইবনে আব্বাস রা: কে বলল: কোন্ ব্যক্তি আপনার নিকট অধিক পছন্দনীয়; যে কম আমল করে এবং কম গুনাহ করে, সে; না যে বেশি গুনাহ করে, বেশি আমল করে? তিনি বললেন: আমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সমতুল্য কোন কিছুকে মনে করি না।
  • মুত্তাকীদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য:

– তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষী উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই হক স্বীকার করে নেয়, মেনে নেয় এবং তা আদায়ও করে। আর বাতিলকে প্রত্যাখ্যান করে, তা থেকে বেঁচে থাকে এবং সেই আল্লাহকে ভয় করে, যার নিকট কোন গোপন বিষয়ই গোপন থাকে না।

– মুত্তাকীগণ আল্লাহর কিতাবের ইলম রাখেন, অতঃপর তা যা হারাম করেছে, তাকে হারাম বলেন এবং তা যা হালাল করেছে, তাকে হালাল বলেন।

– আমানতের খেয়ানত করে না, পিতামাতার অবাধ্যতা করে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে না, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না, স্বীয় মুসলিম ভাইদেরকে মারে না, যারা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তারা তাদের সাথে সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করে।

– যারা তাদেরকে বঞ্চিত করে, তারা তাদেকে দান করে, যারা তাদের প্রতি জুলুম করে, তারা তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়। তাদের থেকে কল্যাণের প্রত্যাশা করা হয়, তাদের তরফ থেকে কোন প্রকার অকল্যাণ আসা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। তারা গীবত করে না, মিথ্যা বলে না, মুনাফেকী (কপটতা) করে না, চোগলখোরী করে না, হিংসা করে না।

– লোক দেখানো কোন কিছু করে না, মানুষকে সন্দেহে ফেলে না, মানুষের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে না।

– অদৃশ্যের ব্যাপারে তাদের রবকে ভয় করে এবং তারা কিয়মাত দিবসের ব্যাপারে থাকে ভীত।

  • তাকওয়ার মূলকথা: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকীদের স্তরে পৌঁছতে পারবে না, যতক্ষণ সে সমস্যাজনক বিষয়ে পতিত হওয়ার আশংকায় সমস্যাহীন জিনিস থেকেও বিরত থাকবে না। (বর্ণনা করেছেন তিরমিযী রহ:)
  • আল্লাহর নিকট মর্যাদার মানদন্ড হল তাকওয়া। আল্লাহ বলেন:( إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ َ) “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সে ই, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।” আল্লামা সা’দী রহ: বলেন; আল্লাহর নিকট মর্যাদা তাকওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়। তাই মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান সে ই, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান, তথা সর্বাধিক আনুগত্যকারী, গুনাহ থেকে দূরত্ব অবলম্বনকারী। সর্বাধিক আত্মীয় – স্বজন, লোকবল বা বংশ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি নয়। আর আল্লাহই ভাল জানেন এবং অধিক খবর রাখেন, কে গোপনে – প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে, আর কে শুধু প্রকাশ্যে ভয় করে, গোপনে ভয় করে না। অতঃপর তিনি প্রত্যেককেই আপন আপন প্রাপ্য অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন।
  • এটা বোঝার পর এটাও জানতে হবে যে, তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর আদেশসমূহ পালন করা এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকা। সুতরাং মুত্তাকী তারাই, যাদেকে আল্লাহ ঐ কাজে দেখতে পান, যে কাজের প্রতি তিনি তাদেরকে আদেশ করেছেন। আর যে কাজ থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেছেন, তারা তার দিকে অগ্রসর হয় না।
  • তাকওয়া এবং স্বপ্নে তার প্রতিক্রিয়া: হিশাম ইবনে হাস্সান বলেন: ইবনে সিরীন রহ: কে শত শত স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হত, তিনি তার কোনটারই দিতেন; শুধু একথা বলতেন: আল্লাহকে ভয়, উত্তমভাবে রাত্রি জাগরণ কর। কারণ তুমি স্বপ্নে যা দেখেছো, তা তোমার কোন ক্ষতি করবে না।
  • আল্লাহকে ভয় কর:

লোকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন: হে বৎস! আল্লাহকে ভয় কর, আর মানুষকে দেখাইওনা যে, তুমি আল্লাহকে ভয় কর। যাতে মানুষ তোমাকে সম্মান করে, অথচ তোমার অন্তর থাকে পাপিষ্ঠ।

  • জা’ফর বলেন: আল্লাহকে ভয় কর; দ্বীনের ব্যাপারে তোমার নিজস্ব খেয়ালমত যুক্তি খাটিও না। কারণ সর্বপ্রথম যুক্তি খাটিয়েছে ইবলিস। আল্লাহ যখন তাকে আদমকে সিজদা করতে আদেশ করলেন, তখন সে বলেছিল: “আমি তো তার থেকে উত্তম। আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে”।
  • ইমাম সুদ্দি রহ; আল্লাহর এই বাণীর ব্যাপারে বলেন: إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ (“নিশ্চয়ই মুমিন হল তারাই, যাদের নিকট আল্লাহর স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর কেঁপে উঠে।) তিনি বলেন: অর্থাৎ এমন ব্যক্তি, যে জুলুম করতে ইচ্ছা করে অথবা (বলেছেন,) গুনাহ করতে ইচ্ছা করে, তখন তাকে বলা হয়; আল্লাহকে ভয় কর। তখন তার অন্তর কেঁপে উঠে।
  • দুই ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের নিকট ক্রয় – বিক্রয় করছিল। তাদের একজন বেশি বেশি শপথ করছিল। ইত্যবসরে আরেক ব্যক্তি তাদের কথাবার্তা শুনে তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে অধিক শপথকারী ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলল: হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর; বেশি বেশি শপথ করো না। কারণ তুমি শপথ না করার কারণে তোমার রিযিক বাড়বে না বা কমবে না।
  • আবু হানিফা রহ: কে বলা হল: আল্লাহকে ভয় করুন! পরিবর্তন আনুন। মুক্তমনা হোন! নত হোন! তিনি বললেন: আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!

الصدق منجاة

সত্যই মুক্তি

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো আর সত্যবাদীদের সাথে থাকো।

  • সততার নিদর্শন: কথা ও কাজে শুধু আল্লাহকেই উদ্দেশ্য করা, অড়ম্বরতা পরিহার করা, মাখলুকের প্রতিদান কামনা করা এবং সত্য কথা বলা। তোমার যবানকে সত্য ও কল্যাণকর কথা বলতে অভ্যস্ত কর: কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; মানুষের জিহ্বার ফসলই মানুষকে উল্টোমুখী করে জাহান্নামে ফেলে। তোমার যবানকে সত্য কথা বলতে অভ্যস্ত কর, তাহলে তুমি সৌভাগ্যবান হতে পারবে। নিশ্চয়ই যবানকে তুমি যাতে অভ্যস্ত করবে, সে তাতেই অভ্যস্ত হবে।
  • সত্য সর্বাবস্থায়ই কল্যাণকর; ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন; সত্য আমাকে নীচে নামিয়ে দেওয়া (যা খুব কমই হয়), আমার নিকট মিথ্যা আমাকে উপরে উঠিয়ে দেওয়া থেকে উত্তম (যা খুব কমই হয়)।

 জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন; সত্য তোমাকে মুক্তি দিবে, যদিও তুমি তাকে ভয় কর। আর মিথ্যা তোমাকে ধ্বংস করবে, যদিও তুমি তাকে নিরাপদ মনে কর। শায়খুল ইসলাম বলেন; তাই সত্য হল সকল কল্যাণের চাবি , অনুরূপ মিথ্যা হল। সকল অকল্যাণের চাবি।

  • কখন তুমি সততা থেকে বঞ্চিত হবে? সাহল আত – তাতারী বলেন: যে অনর্থক। কথাবার্তা বলে, সে ই সততা থেকে বঞ্চিত হয়।
  • সর্বনিম্ন সত্য: কুশায়রী বলেন, সর্বনিম্ন সত্য হল প্রকাশ্য ও গোপন একরকম হওয়া।
  • সত্যই শ্রেষ্ঠ সহায়ক: শায়খুল ইসলাম বলেন: যার থেকে আল্লাহ সততা পেয়েছেন, তাকে তিনি সাহায্য করবেন।
  • সততার কয়েকটি নিদর্শন : যেকোন মুসিবত বা ইবাদত গোপন রাখা এবং মানুষ তা জানুক, তা অপছন্দ করা।
  • সর্বাধিক উপকারী সততা; আল্লাহর নিকট নিজের দোষ – ক্রটি স্বীকার করা। আর সর্বাধিক উপকারী লজ্জা হল; তার নিকট এমন কিছু চাইতে লজ্জা করা, যা তুমি ভালবাস ; কিন্তু তুমি তার অপছন্দনীয় কাজ কর।
  • সূক্ষ হিসাব: আবেদা উম্মে রাবিয়া শামী বলেন; আমি আমার কথায় সততার কমতি থাকার কারণে আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করি, ক্ষমা প্রার্থনা করি।
  • সততা এবং স্বপ্নে তার প্রতিক্রিয়া:

– শায়খুল ইসলাম বলেন: নেককারদের স্বপ্ন বেশিরভাগ সত্য হয়। কখনো তাতে এমন কিছুও দেখা যায়, যা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না।

– ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; যে চায়, তার স্বপ্ন সত্য হোক, সে যেন সর্বদা সত্য বলে। এর সারকথা হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিস- “তোমাদের মধ্যে যে কথায় সর্বাধিক সত্যবাদী, তার স্বপ্ন ও সর্বাধিক সত্য”। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

– সত্য কথা কখনো কখনো কবীরা গুনাহকেও মিটিয়ে দেয়: শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেন; কখনো একটি নেক কাজের সাথে সততা ও দৃঢ় বিশ্বাস যুক্ত থাকার কারণে তা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা অনেক কবীরা গুনাহকে মিটিয়ে দেয়।

– কিভাবে তুমি তোমার নামাযে সত্যনিষ্ঠ হবে? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; সত্য নিষ্ঠতা ও কল্যাণকামীতার নিদর্শন হল, নামাযে অন্তর আল্লাহর জন্য মুক্ত হওয়া, আল্লাহর প্রতি মনোযোগ ফিরানোর জন্য পূর্ণ চেষ্টা  করা, স্বীয় অন্তরকে নামাযের মধ্যে জমানো এবং বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে সর্বোত্তম ও পূর্ণাঙ্গরূপে নামায আদায় করা। কারণ নামাযের একটি প্রকাশ্য ও একটি ভিতরগত দিক আছে।

– সততার বিভিন্ন প্রকার: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: তাই “যিনি সত্য নিয়ে এসেছেন “- আয়াতের অর্থ হল: ‘ কথা, কাজ বস্থায় সততাই যার বৈশিষ্ট্য ‘। সততা হয় এই তিনটি জিনিসের মধ্যে।

– কথায় সততা হল; শস্যের ছড়ার সাথে কান্ডের যেরূপ মিল থাকে, কথার সাথে যবানের সেরূপ মিল থাকা।

– কাজে সততা; দেহের সাথে মাথার যেরূপ মিল থাকে, কাজকর্ম ও বাস্তবতার সাথে অনুরূপ মিল থাকা।

– অবস্থায় সততা: অন্তর ও অঙ্গ – প্রত্যঙ্গের কার্যাবলী ইখলাসওয়ালা হওয়া এবং এর জন্য সর্বসাধ্য চেষ্টা করা।

এ সকল বিষয়গুলোর মাধ্যমে একজন বান্দা সত্য নিয়ে আগমন করেছে” অভিধার উপযুক্ত হবে। আর এসকল জিনিসগুলোর পূর্ণাঙ্গতা ও যথাযথ বাস্তবায়নের দ্বারা ‘ সিদ্দিক ‘ এর বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে।

আল্লাহর প্রতি সুধারণা

আল্লাহর প্রতি সুধারণার তাৎপর্য কি: তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি এমন ধারণা পোষণ  করা, যা তার জন্য উপযুক্ত এবং এমন বিশ্বাস রাখা, যা তার মহত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তার উত্তম নামসমূহ ও সুউচ্চ গুণাবলীর দাবি অনুযায়ী হয়। যা মুমিনের জীবনে এমন প্রভাব সৃষ্টি করবে, যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। আলী ইবনে আবি তালিব রা: বলেন: আল্লাহর প্রতি সুধারণা হল: তুমি কেবলমাত্র আল্লাহর থেকেই আশা করবে, আর শুধু মাত্র তোমার গুনাহের ভয় করবে।

আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না: তোমার এমন কোন গুনাহই হতে পারে না, যা তোমাকে আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখতে বাঁধা দিতে পারে এবং তার রহমত থেকে নিরাশায় ফেলতে পারে। কারণ যে স্বীয় রবকে এবং তার দয়া ও উদারতাকে জেনেছে , সে তার দয়া ও ক্ষমার সামনে নিজের গুনাহকে ছোটই মনে করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন;

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا

বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ আত্মার উপর জুলুম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন

  • মৃত্যুর সময় সুধারণা রাখা: ইমাম ইশবালী বলেন; মৃত্যুর সময় আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা তো ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণার অবস্থা ছাড়া মৃত্যুবরণ না করে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম রহ:)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন: যখন তোমরা দেখবে, কারো মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে, তখন তাকে সুসংবাদ দিবে, যাতে সে স্বীয় রবের প্রতি সুধারণা রাখা অবস্থায় তার সাথে সাক্ষাৎ করে। আর যখন সে জীবিত থাকে, তখন তাকে তার রবের ব্যাপারে ভয় দেখাবে এবং তার কঠিন শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।

  • আল্লাহর প্রতি সুধারণার একটি নিদর্শন; আল্লাহর ইবাদতে খুব বেশি পরিশ্রম করা।
  • অন্তরের স্বস্তি বলা হয়ে থাকে: নিরাশা নিরাশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। আর সুধারণা পোষণ করার মাঝে অন্তরের আরাম ও স্বস্তি আছে।
  • সুধারণার ফলাফলসমূহ:

– আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন: সেই সত্তার শপথ, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই! যে কেউ আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখবে, আল্লাহ তাকে উক্ত ধারণা অনুযায়ী দান করবেন। কারণ কল্যাণ তারই হাতে

– সুহাইল বলেন: আমি মালিক ইবনে দিনারকে তার মৃত্যুর পর স্বপ্নে দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম: হে আবু ইয়াহইয়া! আমি যদি জানতাম, তুমি আল্লাহর সামনে কি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে! তিনি বললেন; আমি অনেকগুলো গুনাহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছি, আল্লাহর প্রতি আমার সুধারণা যেগুলোকে মিটিয়ে দিয়েছে।

– ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যখনই বান্দা আল্লাহর প্রতি উত্তম ধারণা, ভাল আশা ও যথাযথ তাওয়াক্কুল করে, তখন আল্লাহ তা’আলা কখনোই তার আশা ভঙ্গ করেন না। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা কোন আশা পোষণকারীর আশা ব্যর্থ করেন না এবং কোন আমলকারীর আমলকে নষ্ট করেন না।

– আল্লাহর প্রতি সুধারণা অন্তরকে আমলের উপর শক্তিশালী করে। কারণ তখন তো আপনি বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ আপনার দুর্বলতাকে শক্তিতে পরিণত করবেন, তিনি স্বীয় বান্দার সব খবর রাখেন এবং তিনি দৃঢ় ও প্রচন্ড শক্তির অধিকারী।

– আল্লাহর প্রতি সুধারণা উত্তম পরিসমাপ্তির একটি মাধ্যম। আর মন্দ ধারণা মন্দ পরিসমাপ্তির কারণ। তাই বান্দার উচিত, একথার প্রতি বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ অনুপরিমাণ জুলুম করেন না, তিনি মানুষের প্রতি সামান্যতম জুলুম করবেন না। তিনি তার প্রতি বান্দার ধারণা অনুপাতে বান্দাকে দান করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা’আলা বলছেন; আমি আমার প্রতি আমার বান্দার ধারণা অনুপাতে ব্যাবহার করি। আর সে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমি তার সাথেই থাকিই। (বুখারী ও মুসলিম)

– জনৈক নেককার বলেছেন: তোমার যেকোন বিপদ দূর করার জন্য আল্লাহর প্রতি সুধারণার আমলটি কর। কারণ এটাই সমাধাণের সহজ পথ।

– মুমিন যতক্ষণ স্বীয় রবের প্রতি সুধারণা রাখে, ততক্ষণ তার অন্তর প্রশান্ত থাকে এবং তার মন স্বস্তিতে থাকে। আল্লাহর ফায়সালা ও তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্টি ও স্বীয় রবের প্রতি আনুগত্যের মহামূল্যবান চাদর তাকে ঢেকে নেয়।

– মুমিনের অন্তর তার রবের প্রতি সুধারণা রাখে, সর্বদা তার থেকে কল্যাণেরই আশা করে, সুখে – দুঃখে সর্বদা তার থেকে কল্যাণের আশা করে এবং আল্লাহর প্রতি এই বিশ্বাস রাখে যে, তিনি সর্বাবস্থায়ই তার কল্যাণ চান। কারণ তার অন্তর তো আল্লাহর সাথে মিলিত। আর আল্লাহ হতেই অবিরত কল্যাণের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়। তাই যখনই অন্তর তার সাথে মিলিত হবে, তখনই সে এই প্রকৃত বাস্তবতাকে স্পর্শ করতে পারবে, তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবং তার স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে।

– একটি মন্দ ভুল ও অবমাননাকর অজ্ঞতা:

সাফারিনী বলেন; অনেক জাহেলরা ধারণা করে, আল্লাহর আদেশ – নিষেধগুলো ছেড়ে দেওয়া সত্তেও শুধু আল্লাহর বিস্তৃত রহমত ও ক্ষমার উপর ভরস রাখা ও তার প্রতি সুধারণা পোষণ করাই সবকিছুর জন্য যথেষ্ট। এটা একটি মন্দ ভুল, অবমাননাকর অজ্ঞতা। কারণ তুমি যার আনুগত্য করো না, এমন কারো দয়ার আশা করা বোকামী ও আত্মপ্রবঞ্চনা। নিম্নোক্ত আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে

)فَخَلَفَ مِن بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُواْ الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَـذَا الأدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِن يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مُّثْلُهُ يَأْخُذُوهُ(

অতঃপর তাদের পর তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কিতাব (অর্থাৎ তাওরাত) এর উত্তরাধিকারী হল এমন সব উত্তরপুরুষ, যারা এই দুনিয়ার তুচ্ছ সামগ্রী (ঘুষরূপে) গ্রহণ করত এবং বলত, “আমাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু তার অনুরূপ সামগ্রী তাদের কাছে পুনরায় আসলে তারা (ঘুষরূপে) তাও নিয়ে নিত

  • বান্দার অন্তরে কিভাবে জমা হয়? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; একজন বান্দার অন্তরে কিভাবে এ দু’টি জিনিস একত্রিত হতে পারে যে, সে একথারও বিশ্বাস করবে যে, সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, আল্লাহ তার কথাবার্তা শোনেন, তার অবস্থান দেখেন, তার গোপন – প্রকাশ্য সব কিছু জানেন, তার কোন গোপন বিষয়ই তার নিকট গোপন নয়, সে তার সামনে দণ্ডায়মান হবে এবং তাকে তার প্রত্যেক কাজের জবাবদিহিতা করতে হবে, অথচ সে তার অসন্তুষ্টির মাঝে অবস্থান করছে, আদেশগুলো লঘন করছে, তার হকসমূহ নষ্ট করছে, আর এতদ্বসত্তেও আবার সে আল্লাহর প্রতি সুধারণা করছে। এটা কি আত্মপ্রবঞ্চনা ও অলীক স্বপ্ন ছাড়া কিছু?
  • তাওয়াক্কুলের নামই কি আল্লাহর প্রতি সুধারণা? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: কেউ কেউ তাওয়াক্কুলের ব্যাখ্যা করেছেন: “আল্লাহর প্রতি সুধারণা করা ‘। কিন্তু প্রকৃত কথা হল, আল্লাহর প্রতি সুধারণা তাওয়াক্কুলের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী। কারণ যার প্রতি তোমার খারাপ ধারণা বা যার থেকে তুমি আশা কর না, তার উপর তোমার তাওয়াক্কুল করা সম্ভব নয়।
  • কিভাবে আল্লাহর প্রতি সুধারণা আছে বলে বুঝতে পারবে?

তা এভাবে যে তোমার মধ্যে এ বিশ্বাস সৃষ্টি হবে যে, আল্লাহ তা’আলাই তোমার সমস্যা সমাধানকারী, তিনিই তোমার পেরেশানী দূরকারী। কারণ বান্দা যখন তার রবের প্রতি সুধারণা করে, তখন আল্লাহ তা’আলা তার বরকতের দরজাসমূহ এমনভাবে খুলে দেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। তাই হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করবে, তাহলে তুমি আল্লাহর থেকে এমন কিছু দেখতে পাবে, যা তোমাকে আনন্দিত করবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আমি আমার প্রতি আমার বান্দার ধারণা অনুসারে কাজ করি। সে যদি ভাল ধারণা করে, তাহলে তাকে তা ই দান করি, আর সে যদি খারাপ ধারণা করে, তাহলে তাকে খারাপই দেই। (বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ) তাই আল্লাহর প্রতি তোমার ধারণা সুন্দর কর এবং তোমার আশা – ভরসা শুধু তার সাথে সম্পৃক্ত কর আর আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক, কারণ এটা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ وَسَاءتْ مَصِيرًا

“যারা আল্লাহর সম্পর্কে কু – ধারণা করে। মন্দ পালাবর্তন তাদেরই উপর। আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তাদেরকে নিজ রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জাহান্নাম। তা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।

  • মুমিনের ধারণা ও মুনাফিকের ধারণার মাঝে পার্থক্য: হাসান বসরী রহ: বলেন: মুমিন আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা করে ভাল আমল করে। আর মুনাফিক খারাপ ধারণা করে খারাপ আমল করে।
  • কিসে তোমাকে ভাল আমলে উদ্বুদ্ধ করবে?

– আবু হুরায়রা রা: বলেন: আল্লাহর প্রতি সুধারণা আল্লাহর জন্য উত্তম ইবাদত করার মত।

– জেনে রেখ, আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা করা মানেই হচ্ছে ভাল আমল করা। কারণ যে বিষয়টি বান্দাকে ভাল আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি তার এই ধারণা যে, আল্লাহ তাকে তার আমলের প্রতিদান বা বিনিময় দান করবেন এবং তার থেকে তা কবুল করবেন। তাহলে যে জিনিসটি তাকে আমল করতে উদ্বুদ্ধ করল, তা হচ্ছে সুধারণা। তাই যখনই তার রবের প্রতি তার ধারণা সুন্দর হবে, তখনই তার আমলও সুন্দর হবে। অন্যথায় প্রবৃত্তির অনুসরণের সাথে আল্লাহর প্রতি সুধারণা অনর্থক।

– মোটকথা মুক্তির মাধ্যমগুলো অর্জন করার সাথেই সুধারণা হয়ে থাকে। ধ্বংসের কাজ করে সুধারণা করা যায় না।

– মন্দ আশা: ওয়াজিব বিষয়সমূহ ছেড়ে দিয়ে এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখাই হচ্ছে মন্দ আশা। এর মানে হচ্ছে আল্লাহর শাস্তি হতে ভাবনাহীন হয়ে যাওয়া।

– আল্লাহর প্রতি ধারণার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের অবস্থা: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: অধিকাংশ সৃষ্টিজীব, বরং আল্লাহ যাদেরকে চেয়েছেন, এমন কিছু লোক ব্যতীত সবাই আল্লাহর প্রতি নাহক মন্দ ধারণা করে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, তাকে তার হক দেওয়া হয়নি। তার অংশ কম দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন, সে তার থেকে অধিক হকদার ছিল।

তার অবস্থার ভাষা হল: আমার রব আমার প্রতি জুলুম করেছে এবং আমি যার হকদার ছিলাম আমাকে তা থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ এ ব্যাপারে তার মন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু মুখে সে তা স্বীকার করে না বা স্পষ্টভাবে বলার মত দু : সাহসিকতা দেখায় না।

  • আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা ভয়ংকর। কারণ আল্লাহর প্রতি সুধারণা তাওহীদের জন্য একটি আবশ্যকীয় বিষয়। যা আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ, পরাক্রম, হিকমত ও তার সমস্ত নাম ও গুণাবলীর প্রতি ঈমান রাখার কারণেই হয়ে থাকে। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার প্রতি মন্দ ধারণা তাওহীদের বিরোধী।
  • আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার কয়েকটি নমুনা:

– যে আল্লাহর প্রতি এই ধারণা করবে যে, আল্লাহ তার রাসূলকে সাহায্য করবেন, তার বিষয়কে পূর্ণতা দান করবেন না, তাকে শক্তিশালী করবেন না, তার দলকে শক্তিশালী করবেন না, তাদেরকে তাদের শত্রুদের উপর বিজয় ও পরাক্রম দান করবেন না, আল্লাহ তার দ্বীন ও কিতাবকে সাহায্য করবেন না, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা করল।

– যে আল্লাহর ব্যাপারে এমনটা সম্ভব মনে করল যে, তিনি তাঁর ওলীদেরকে তাদের নেক আমল ও ইখলাস সত্ত্বেও শাস্তি দেন বা তাদের সাথে ও তাদের শত্রুদের সাথে সমান আচরণ করেন, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা করল।

– যে আল্লাহর প্রতি ধারণা করল, আল্লাহ তার সৃষ্টিজীবকে আদেশ – নিষেধ ছাড়া এমনিতেই ছেড়ে দিবেন, তাদের প্রতি রাসূল প্রেরণ করা হবে না, তাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করা হবে না; বরং তাদেরকে চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় অনর্থক ছেড়ে দেওয়া হবে, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।

– যে ধারণা করল, সে আল্লাহর আদেশ পালন করত। শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য নেক আমল করা সত্ত্বেও আল্লাহ তার উক্ত নেক আমল নষ্ট করে দেন এবং বান্দার পক্ষ থেকে কোন কারণ ছাড়া সেগুলোকে নিস্ফল করে দেন অথবা তার দোষ ছাড়া তাকে শাস্তি দেন, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা করল।

– আল্লাহ আল্লাহর নিজের ব্যাপারে যা কিছু বর্ণনা করেছেন বা তার রাসূলগণ তার ব্যাপারে যা বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে তার বিপরিত ধারণা করল অথবা তার হাকিকতকে অকার্যকর করে দিল, সে আল্লাহর মন ধারণা করল।

– যে ধারণা করল, সে আল্লাহর জন্য কোন কিছু বর্জন করলে, আল্লাহ তাকে এর থেকে উত্তম বিনিময় দান করবেন না, অথবা কেউ আল্লাহর জন্য কোন কিছু করলে তিনি তাকে তার থেকে উত্তম কিছু দান করবেন না, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা করল।

– যে ধারণা করল, আল্লাহ কোন অপরাধ ছাড়া তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন, তাকে শাস্তি দিবেন বা তাকে বঞ্চিত করবেন, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা করল।

– যে ধারণা করল, সে যদি সত্যিকার অর্থেও আল্লাহকে ভালবাসে, ভয় করে, তার নিকট মিনতি করে, প্রার্থনা করে, সাহায্য চায় এবং ভরসা করে, তথাপি আল্লাহ তাকে ব্যর্থ করবেন, তার আবেদন পুরা করবেন না, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল এবং তার শানে যা উপযুক্ত নয়, তার প্রতি তা ধারণা করল।

  • এক হৃদয়বান বন্ধুর উপদেশ: তাই নিজের হিতকামনাকারী জ্ঞজ্ঞানীদের জন্য এই স্থানটি লক্ষণীয়! স্বীয় রবের প্রতি মন্দ ধারণার জন্য প্রতিটি সময় তাওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত। বস্তুত নিজের নফসের প্রতি মন্দ ধারণা করা উচিত, যেটা সকল মন্দের উৎস, সকল অনিষ্টের মূল এবং যা অজ্ঞতা ও আধার। তাই আহকামুল হাকিমীন, সর্বশ্রেষ্ঠ ইনসাফগার ও সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার চেয়ে নিজের নফসের প্রতি মন্দ ধারণা করাই অধিক উপযুক্ত।

( استعينوا بالله واصبروا )

আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও ও ধৈর্য্য ধারণ কর

আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার সঙ্গা: তা হচ্ছে বান্দা কর্তৃক আস্থা ও ভরসা সহ পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে স্বীয় রবের নিকট সাহায্য চাওয়া। আর এটা শুধু আল্লাহর জন্যই হতে পারে। আর এর মধ্যে তিনটি বিষয় অন্তর্ভূক্ত:

১. আল্লাহর নিকট বিনয়াবনত হওয়া।

২. মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা।

৩. আল্লাহর উপর ভরসা করা। এগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে পারে।

সুতরাং যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ব্যাপারে এই তিনটি বিষয়ের ধারণা করে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল, সে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করল।

  • বহু ফিৎনা ও প্রবৃত্তি পূজার যামানায় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার গুরুত্ব:

– সর্বোচ্চ সাহায্য কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকটই চাওয়া হবে: কারণ এটা ফেৎনার যামানা। প্রবৃত্তি পূজার যামানা। এমন যামানা, যখন মানুষ শয়তানরা যিন শয়তানদের থেকে বড় চক্রান্তকারী হয়ে গেছে এবং ইবলিশরা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, মানুষকে তাদের দ্বীনদারী, পবিত্রতা ও সচ্চরিত্র থেকে ফিরিয়ে রাখতে। তারা এমন এমন অশ্লীলতা ও হীনকাজ আবিস্কার করছে, যা আকলও কল্পনা করতে পারে না।

– সুতরাং মানুষের জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা  করা, বেশি বেশি দু’আ করা এবং আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক। যাতে নিজেকে আল্লাহর হারামসমূহ থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়, এসকল ফেনার মুকাবেলায় দৃঢ় সংকল্প করা যায় এবং স্বীয় আত্মরক্ষার বিষয়সমূহ অর্জন করা সহজ হয়। হাদীসের মধ্যে এসেছে: “তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন ফেৎনা থেকে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর”। (বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ ও মুসলিম রহ:)

  • আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার ফলাফলসমূহ:

– শায়খুল ইসলাম রহ: বলেন; যখন আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তার থেকে পথনির্দেশ কামনা করা হয়, তার নিকট দু’আ করা হয়, তার নিকট মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করা হয় এবং তিনি যে পথে চলার আদেশ করেছেন সে পথে চলা হয়, তখন আল্লাহ তা’আলা ঈমানদারদেরকে স্বীয় হুকুমে সেই হকের ব্যাপারে পথনির্দেশ করেন, যাতে তারা মতবিরোধে লিপ্ত ছিল। আর আল্লাহ যাকে চান, সরল পথের দিশা দেন।

– যখন একজন মুসিলম জানবে যে, যে অমুখাপেক্ষী ক্ষমতাবানের হাতে সকল কল্যাণ রয়েছে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা, তখন সে সৃষ্টিজীব থেকে ভ্রুক্ষেপহীনতা ও অমুখাপেক্ষীতার শিক্ষা লাভ করবে। সে জানতে পারবে যে, তা পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে তার সাথে সম্পর্ক গড়া, তার উপর ভরসা  করা, তার ইবাদত করা এবং তার আশ্রয় গ্রহণ করা। সাথে সাথে চেষ্টা ও আমলের উপাদানগুলোও গ্রহণ করবে। এভাবে একজন মুসলিম তার চেহারাকে লাঞ্ছনা ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে এবং যেকোন মানুষের নিকট হাত পাতা ও নত হওয়া থেকে হেফাজত করতে পারবে। ফলে তার সম্মান রক্ষা পাবে এবং তার মর্যাদা ও অবস্থান সুসংরক্ষিত থাকবে।

– ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: সর্বদা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা এবং তার সন্তুষ্টির কার্যাবলী সম্পাদন করা ব্যতীত শয়তানের ফাঁদ ও চক্রান্ত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথ নেই।

– কোন ইবাদত পালনের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা; যেমন আযানে حيَّ علي الصلاة‘ ও   حيَّ علي الفلاح (নামাযের দিকে আসো, সফলতার দিকে আসো’) বলার সময় لا حول ولا قوة إلا بالله‘ (তথা ‘আল্লাহর শক্তি ও সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি ও সাহায্য নেই’) বলা। কারণ এটা নামায আদায়ের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।

– আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার নিকট সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা পরকালে মুক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য বড় মাধ্যম হবে। কারণ দয়মায় আল্লাহর দানের কোন সীমা – পরিসীমা নেই। যেমন কবি বলেন:

যখন কোন যুবকের পক্ষে আল্লাহর সাহায্য থাকবে না,

তখন তার প্রচেষ্টাই সর্বপ্রথম তার সাথে শত্রুতা করবে।

– জনৈক সালাফ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন; যখন শয়তান তোমার নিকট গুনাহকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে দেখাবে, তখন তুমি কি করবে? সে বলল: আমি তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবো। তিনি বললেন, এটা তো। অনেক দীর্ঘ। আচ্ছা বল তো, তুমি যদি একটি বকরির পালের নিকট দিয়ে গমন কর আর তখন তার কুকুরটি তোমাকে ঘেউ ঘেউ করে, পথ অতিক্রম করতে বাঁধা দেয়, তখন তুমি কি করবে? সে বলল; আমি তার সাথে লড়াই করবো এবং সর্বসাধ্য দিয়ে তাকে ফিরাবো। তিনি বললেন; এটা দীর্ঘ হবে। কিন্তু তুমি যদি বকরীর রাখালের সাহায্য প্রার্থনা কর, তাহলে সে ই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। এমনিভাবে যখন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাইতে চাইবে, তখন তার সৃষ্টিকর্তার নিকট সাহায্য চাইবে। তাহলে তিনিই তোমার জন্য যথেষ্ট হবেন এবং তোমাকে সাহয্য করবেন।

– যে সকল বিষয় কষ্ট দূর করে: আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা, তার উপর ভরসা করা, তার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা এবং তার তাকদীরের প্রতি আত্মসমর্পণ করা।

– প্রতিটি সময় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার প্রয়োজনীয়তা: শায়খুল ইসলাম বলেন: বান্দা আল্লাহর ইবাদতের জন্য ও অন্তর স্থির রাখার জন্য সর্বদাই আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার মুখাপেক্ষী। ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

– বান্দার আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা, তাওয়াক্কুল করা ও আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক হওয়ার কারণ হল, যেহেতু আল্লাহই তাকে তার ইবাদতে নিয়োজিত করেন এবং তার অবাধ্যতার বিষয়াবলী থেকে দূরে রাখেন। আর আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য ব্যতিত নিজ শক্তিতে সে তা করতে পারত না। কারণ যে বিপদাপদের তিক্ততা আস্বাদন করেছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া ব্যতীত তা প্রতিহত করতে নিজের অক্ষমতা বুঝতে পেরেছে , তার অন্তরই অন্যদের তুলনায় একথার অধিক সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তার অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকতে আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন হয়।

  • তিনটি বিষয়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা আবশ্যক:

১. ইবাদতসমূহ সম্পদানের ব্যাপারে।

২. নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ বর্জনের ব্যাপারে।

৩. তাকদীরী বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সবর করার ব্যাপারে।

  • বান্দা অক্ষম; বান্দা নিজে নিজে এ বিষয়গুলো অর্জন করতে অক্ষম। নিজ প্রতপালকের নিকট সাহায্য চাওয়ার কোন বিকল্প নেই। আর বান্দাকে তার দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল কল্যণে সাহায্যকারী একমাত্র আল্লাহ।
  • গভীর প্রজ্ঞাবানী: যাকে আল্লাহ সাহায্য করেন, সে ই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। আর যে আল্লাহর হকের ব্যাপারে অবহেলা করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন না। সে হয়। বঞ্চিত।
  • একাটি মারাত্মক ভুল; অনেক মানুষ নেক আমল ও নেক নিয়্যতের ভরসায় আল্লাহ থেকে সাহায্য প্রার্থনা ও তার নিকট মুখাপেক্ষীতা ও দীনতা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। এটা একটি মারাত্মক ভুল। সকল আল্লাহওয়ালা বান্দাগণ এ ব্যাপারে একমত যে, বান্দার যত কল্যাণ সাধিত হয়, তা মূলত আল্লাহ তা’আলার তাওফীকেই হয়। আর বেশি বেশি দু’আ, প্রার্থনা, সাহায্য চাওয়া এবং বেশি বেশি মুখাপেক্ষীতা ও দুর্বলতা প্রকাশ করার দ্বারাই আল্লাহর তাওফীক লাভ হয়। আর এগুলোর ব্যাপারে অবহেলা করলে তাওফীক থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
  • কখন তোমার প্রতি আল্লাহর সাহায্য আসবে? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যখনই বান্দা পূর্ণাঙ্গ দাসত্ব করবে, তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে তার উপর সর্বোচ্চ সাহায্য আসবে।
  • আউযু বিল্লাহ পড়ার মধ্যেও আল্লাহর থেকে সাহায্য প্রার্থনা রয়েছে: কুরআন পাঠে চিন্তা অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়ার একটি নমুনা হল: কুরআন পাঠকারীর জন্য আউযু বিল্লাহ বলা এবং সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার বিধান দেওয়া হয়েছে। এতে কুরআন পাঠে- বিশেষত: যে সূরাটি এখন পড়ার ইচ্ছা করছে, তার মধ্যে- চিন্তা অর্জনের জন্য আল্লাহর থেকে সাহায্য প্রার্থনা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
  • দুআর মধ্যেও আল্লাহর থেকে সাহায্য প্রার্থনা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে: দু’আর মধ্যে আল্লাহ থেকে সাহায্য প্রার্থনাও অন্তর্ভুক্ত। এটা সর্ব বিষয়ে ও সব সময় কাম্য। এটার অধিক গুরুত্বের কারণেই আমরা নামাযের প্রতি রাকাতে তার পুনরাবৃত্তি করি- (إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ) আর বান্দার জন্য কোন কিছুই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া করা সম্ভব নয়। যে এর থেকে বঞ্চিত হয়, সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সুন্নাহর উপর আমল করার আগ্রহ

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً

“নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি আশা রাখে এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে।”

ইমাম সা’দী রহ: বলেন; আদর্শ দুই প্রকার: উত্তম আদর্শ, মন্দ আদর্শ।

উত্তম আদর্শ রয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাঝে। যে তার আদর্শ গ্রহণ করল, সে এমন পথে চলল , যা তাকে আল্লাহর নিকট সম্মান লাভের পথে নিয়ে যাবে। আর তা হচ্ছে সিরাতে মুস্তাকীম।

আর এই উত্তম আদর্শের পথে চলতে পারে এবং চলার তাওফীক দেওয়া হয় একমাত্র সেই ব্যক্তিকে, যে আল্লাহ ও পরকাল কামান করে। কারণ তার ঈমান, তার খোদাভীতি, তার প্রতিদান লাভের আশা ও তার শাস্তির ভয়ই তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ গ্রহণ করতে উদ্বুদু করে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ ব্যতীত অন্য কারো আদর্শ, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আদর্শের বিরোধী, তা মন্দ আদর্শ। যেমন রাসূলগণ যখন কাফেরদেরকে তাদের আদর্শ গ্রহণ করতে আহ্বান করতেন, তখন তারা বলত:

إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِم مُّهْتَدُونَ

“নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে একটি মতাদর্শের উপর পেয়েছি, আমরা তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করবো।”

  • সুন্নাহকে আকড়ে ধরা কিসের প্রমাণ? সুন্নাহর প্রতিপক্ষ অনেক হওয়া সত্ত্বেও সুন্নাহ আকড়ে ধরা মানেই ঈমানের সত্যতা, দৃঢ়তা এবং আল্লাহর ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় না করা। যার নিকট আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর পথ স্পষ্ট হয়ে যায়, তার জন্য মানুষের কারণে তা ছেড়ে দেওয়া বৈধ নয়।
  • নিশ্চয়ই সুন্নাহ আকড়ে ধরা মুক্তি ও সফলতার প্রমাণ, সৌভাগ্য ও কৃতকার্যতার নিদর্শন, আল্লাহ পাকের তাওফীক ও দিকনির্দেশনা লাভের ইঙ্গিত এবং বিজয় ও কল্যাণের আলামত। আল্লাহ তা’আলা বলেন:( وَمَن يُطِعْ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا) “আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে, সে নিশ্চয়ই মহা সফলতা লাভ করবে।”
  • সুন্নাহর উপর আমলই মুক্তি:

ইমাম যুহরী রহ: বলেন;পূর্ববর্তী আলেমগণ বলতেন: সুন্নাহ আকড়ে ধরাই মুক্তি।

ইমাম মালেক রহ: বলেন: সুন্নাহ হল নূহের তরী, যে তাতে আরোহন করবে, সে মুক্তি পাবে আর যে পিছনে থেকে যাবে সে ডুববে।

  • যে সুন্নাহর উপর আমল করে, তার পুরস্কার:

১- মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহর ভালবাসা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন হাদীসে কুদসীতে এসেছে, বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহঃ।” … বান্দা নাওয়াফেলের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, একপর্যায়ে আমি তাকে ভালবেসে ফেলি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে শুনে …।

২- সর্বদা নাওয়াফেলের ব্যাপারে যত্নবান হলে তা ফরজের ঘাটতিসমূহের ক্ষতিপূরণ করে।

৩- সুন্নাহর প্রতি আমলকারী তার অনুকরণকারীর সওয়াবও লাভ করে, যা উক্ত ব্যক্তির সওয়াবেও কোনরূপ ঘাটতি করে না। এটা বর্ণিত হয়েছে ইমাম মুসলিম রহ: এর একটি হাদিসে। তাতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন; যে ইসলামের মধ্যে একটি উত্তম সুন্নাহর প্রচলন ঘটায়, সে তার নিজের প্রতিদানও লাভ করে এবং যে তার উপর আমল করে, তার প্রতিদানও লাভ করে। আর এটা তাদের প্রতিদানেও কোনরূপ ঘাটতি করে না। (বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ ও মুসলিম রহ:)

  • সুন্নাহ বাস্তবায়নে উচু হিম্মত: ইমাম আহমাদ রহ: বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ থেকে যে হাদিসটিই বর্ণনা করতাম, তার উপর নিজে আমল করতাম।
  • ইমাম আহমাদ রহ: ফেৎনার সময় তিন দিন ইবরাহীম ইবনে হানীর ঘরে আত্মগোপন করে ছিলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আরেক স্থানে গিয়ে আত্মগোপন করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ হেরা গুহায় তিন দিন আত্মগোপন করেন, তারপর সেখান থেকে প্রস্থান করেন। তাই আমার জন্য শোভনীয় নয় যে, আমি সাচ্ছন্দের সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুসরণ করবো আর সংকটের সময় তার অনুসরণ ছেড়ে দিবো।
  • সুন্নাহর প্রতি যত্নশীলতার একটি উদাহরণ: আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা আলী ইবনে আবি তালিব রা: থেকে বর্ণনা করেন, আলী রা: বলেন: ফাতেমা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে একটি খাদেমের আবেদন করল। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: আমি কি তোমাকে এর থেকে উত্তম বিষয় বলে দিব? তুমি ঘুমের সময় তেত্রিশ বার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশ বার আলহামদু লিল্লাহ ও চৌত্রিশ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। (অতঃপর বর্ণনাকারী সুফিয়ান বলেন: একটি হল চৌত্রিশ বার ) (আলী রা: বলেন) এরপর কখনো আমি তা ছাড়িনি। বলা হল: সিফ্ফীনের যুদ্ধের রাতও না? তিনি বললেন: সিজীনের যুদ্ধের রাতও না। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ:)
  • সুন্নাহ অনুসরণের ফলসমূহ:

১- সুন্নাহর অনুসরণ ইবাদত কবুলের শর্ত।

সুফিয়ান রহ: বলেন: আমল ব্যতিত কথা গ্রহণযোগ্য নয়। আর নিয়্যত ব্যতীত কথা, আমল কোনটাই সঠিক নয়। আর কথা , আমল ও নিয়্যত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর অনুসরণ ব্যতীত সঠিক নয়।

২- সুন্নাহর অনুসরণ ইসলামের প্রধান দু’টি মূলনীতির একটি। মূলনীতি দু’টি হচ্ছে:

ইখলাস – ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য করাই হচ্ছে বান্দার ঈমান ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ‘ সাক্ষের মূলকথা।

 সুন্নাহর অনুসরণ – রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আদর্শের অনুসরণ করা হচ্ছে বান্দার ঈমান ও মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়ার মূলকথা।

৩- সুন্নাহর অনুসরণ জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম: এর প্রমাণ রাসূলুল্লাহ ﷺ           এর এই হাদীস- আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যারা অস্বীকার করে। সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! যারা অস্বীকার করে, তারা কারা? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: যারা আমার অনুসরণ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যারা আমার অবাধ্যতা করবে, তারাই অস্বীকার করল। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ:)

৪- সুন্নাহর অনুসরণ আল্লাহর ভালবাসার দলিল; এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী

(قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ)

“বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তবেই আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াশীল।”

৫- সুন্নাহর অনুসরণ তাকওয়ার নিদর্শন : আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)ذَلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ(

“এটাই নির্দেশ। আর যে আল্লাহর প্রতীকসমূহকে সম্মান করে, এটা ( তার ) অন্তরের তাকওয়ারই বহি : প্রকাশ।”

 ‘শাআইরুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রতীকসমূহ হল: আল্লাহর আদেশ – নিষেধ ও তার দ্বীনের প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ। আর এর সর্বোচ্চ ও সর্বপ্রধান হল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ ও তার আনিত শরীয়তের অনুসরণ করা।

(فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ)

তোমরা আমাকে স্মরণ করো, তাহলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো।

ইমাম তাবারী রহ: বলেন: অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা আমার আদেশ – নিষেধ মেনে চলার মাধমে আমাকে স্মরণ কর, তাহলে আমিও আমার রহমত ও ক্ষমার মাধ্যমে তোমাদেরকে স্মরণ করবো।

আল্লামা সা’দী রহ: বলেন: আল্লাহ তা’লা তার যিকিরের আদেশ করেছেন আর এর জন্য সর্বোত্তম প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন। তা হলো যে তাকে স্মরণ করবে, তিনিও তাকে স্মরণ করবেন। আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলের ভাষায় বলেন:

من ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي ، ومن ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم

“যে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি আর যে কোন মজলিসে আমাকে স্মরণ করে, আমি তাকে তাদের থেকে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি।”

  • আল্লাহর সর্বোত্তম যিকর হল, যাতে অন্তর ও যবান এক হয়; এমন যিকরের দ্বারাই আল্লাহর পরিচয়, ভালবাসা ও অধিক সওয়াব লাভ হয়। যিকরই শুকরের মূল। একারণেই আল্লাহ তা’আলা বিশেষভাবে এটার প্রতি আদেশ করেছেন আর তারপর সাধারণভাবে শুকরের আদেশ করেছেন: وَاشْكُرُواْ لِي “এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”
  • আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيراً

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো এবং সকাল – সন্ধা তার তাসবীহ পাঠ কর।”

  • নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি সময় আল্লাহকে স্মরণ করতেন।
  • ঈসা আ: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলো। কারণ তাতে অন্তর শক্ত হয়ে যায়।
  • তোমার ঘরকে আল্লাহর যিকরের স্থান বানাও। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ঘরে আল্লাহর যিকর করা হয়, আর যে ঘরে তার যিকর করা হয় না, উভয় ঘরের দৃষ্টান্ত হল জীবিত ও মৃতের ন্যায়। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম রহ:) সুতরাং ঘরকে অবশ্যই সর্বপ্রকার যিকরের স্থান বানানো উচিত। চাই অন্তরের যিকর হোক বা যবানের হোক, অথবা নামায, কুরআন তিলাওয়াত, ইলমে শরয়ীর আলোচনা, ধর্মীয় কিতাব পাঠ বা উপকারী ক্যাসেট শ্রবণ হোক।

আজ কত মুসলিমের ঘর আল্লাহর যিকর না থাকার কারণে মৃত । বরং সেগুলোর অবস্থা হল, সর্বদা শয়তানের বাশি, গান, বাজনা, গীবত, চোগলখোরী, অপবাদ ইত্যাদিই চলতে থাকে। আল্লাহই আশ্রয়! তিনিই ভরসা!

আর সর্বপ্রকার গুনাহ ও অন্যায়ের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়ার কথা আর কি বলবো! যেমন অবৈধ মেলামেশা, গাইরে মাহরাম নিকটত্মীয় বা প্রতিবেশদের মধ্যে যারা ঘরে ঢুকে যায় তাদের সামনে প্রকাশ হওয়া ইত্যাদি।

 যে ঘরের এ অবস্থা , তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করবে কিভাবে!? তাই আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুন! আপনারা নিজেরদের ঘরগুলোকে সর্বপ্রকার আল্লাহর যিকর দ্বারা আবাদ করুন।

  • সালামের মধ্যে আল্লাহর যিকর রয়েছে। মুজাহিদ রহ: বলেন: ইবনে ওমর রা: আমার হাত ধরে আমাকেসহ বাজারে যেতেন। তিনি বলতেন, আমি বাজারে যাই, কিন্তু আমার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু এ জন্য যাই, যাতে আমি অনেক লোককে সালাম দিতে পারি এবং আমাকেও অনেকে সালাম দেয়। এতে আমি একটি দিয়ে ১০ টি লাভ করি। হে মুজাহিদ! সালাম একটি আল্লাহর নাম। তাই যে বেশি বেশি সালাম দিল, সে বেশি বেশি আল্লাহর যিকর করল। তুমি কি অনুভব করেছে, যখন তুমি তোমার মুসলমান ভাইদেরকে সালাম দাও, তখন তুমি আল্লাহর যিকর করছো?
  • মহা উপকারী একটি জ্ঞাতব্য: জনৈক আলেম বলেন; কথা ও কাজের শুরুতে আল্লাহর যিকর করা হচ্ছে ঘৃণা থেকে ভালবাসা ও পথভ্রষ্টতা থেকে হেদায়াত লাভের ন্যায়।
  • আল্লাহর যিকরের মধ্যে রয়েছে ১০০ উপকারীতা; ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: আল্লাহর যিকরের মধ্যে একশ’রও অধিক উপকারীতা রয়েছে। যিকর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, শয়তানকে বিতাড়িত করে, পেরেশানী দূর করে, রিযিক বৃদ্ধি করে, আল্লাহর ভয় ও স্বাদ সৃষ্টি করে, আল্লাহর ভালবাসা সৃষ্টি করে, যা ইসলামের প্রাণ …।
  • জান্নাতের প্রাসাদসমূহ কিভাবে নির্মাণ করা হয়? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: জান্নাতের প্রাসাদসমূহ নির্মাণ করা হয় যিকরের দ্বারা। যিকরকারী যখন যিকর থামিয়ে দেয়, তখন ফেরেশতাগণ নির্মাণকাজও থামিয়ে দেন।
  • নিফাক থেকে নিরাপত্তা; ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: বেশি বেশি আল্লাহর যিকর নিফাক থেকে নিরাপত্তা দেয়। কারণ মুনাফিকরা আল্লাহর যিকর কম করে।

হৃদয়ের সচ্ছতা বা উদারতা

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَالَّذِينَ جَاؤُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

“এবং যারা তাদের পরে এসেছে, যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা কর আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইদেরকেও, যারা আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন হিংসা – বিদ্বেষ রেখো নাহে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।”

  • হৃদয়ের সচ্ছতার অর্থ: হৃদয়ের সচ্ছতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, অন্তরে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা না থাকা।
  • স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী কারা? রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হল, প্রত্যেক স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী ও সত্যভাষী লোক। সাহাবীগণ বললেন: সত্যভাষী তো আমরা বুঝি, কিন্তু স্বচ্ছ হৃদয় দ্বারা কি উদ্দেশ্য? তিনি বললেন: আল্লাহভীরু ও পূত – পবিত্র মন, যাদের মাঝে অবাধ্যতা, জুলুম, হিংসা – বিদ্বেষ ইত্যাদি নেই। (বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে মাজাহ)
  • জান্নাতের সর্বোত্তম রাস্তা: কাসিম আলজুয়ী বলেন; জান্নাতের সর্বোত্তম পথ হল হৃদয়ের স্বচ্ছতা।
  • হৃদয়ের সচ্ছতার জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করা: রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি দু’আ ছিল; হে আল্লাহ! আমার অন্তরের আক্রোশ দূর কওে দাও। আর তিরমিযী রহ: এর বর্ণনায় এসেছে এভাবে: “হে আল্লাহ আমার বুকের আক্রোশ দূর করে দাও এটি একটি অতি উন্নত বৈশিষ্ট্য , খুব কম লোকই এতে গুণান্বিত হতে পারে। কারণ মনের জন্য এটা বড় কঠিন যে, সে তার স্বার্থ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, তার অধিকার ছেড়ে দিবে। অপর দিকে বেশিরভাগ মানুষের মাঝেই জুলুম ও সীমালঙ্ঘন দেখা যাচ্ছে। তাই যে মানুষের জুলুম , অজ্ঞতা ও সীমালঙ্ঘনকে উদারতার দ্বারা মুকাবেলা করে, তার মন্দের মোকাবেলায় মন্দ প্রকাশ করে না, তার উপর হিংসা করে না, সে উন্নত ও মহান চরিত্রের উচ্চস্তর লাভ করে। এটা মানুষের মাঝে দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যাদের জন্য আল্লাহ সহজ করেছেন তাদের জন্য সহজ। ইহা একমাত্র তারাই লাভ করে, যারা ধৈর্যশীল। ইহা একমাত্র তারাই লাভ করে, যারা মহা সৌভাগ্যবান।
  • জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য: সুতরাং একজন মুসলিমকে অবশ্যই নিজেকে উদারতা ও ভিতরের সচ্ছতার শিক্ষা দিতে হবে। এটা হচ্ছে জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ(

“ তাদের অন্তরে যে হিংসা – বিদ্বেষ থাকবে, তা দূর করে দিব। তারা ভাই – ভাই রূপে মুখোমুখী হয়ে উচু আসনে আসীন হবে।”

  • যেসকল বিষয় হৃদয়ের সচ্ছতা আনয়নে সাহায্য করে:

১- ইখলাস – ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর নিকট যা আছে তার জন্য লালায়িত হওয়া আর দুনিয়া ও তার চাকচিক্য থেকে নিরাসক্ত হওয়া।

২- আল্লাহ যে বন্টন করেছেন তাতে সন্তুষ্ট হওয়া। ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: আল্লাহর বন্টনে সন্তুষ্টি হৃদয়ে সচ্ছতার দ্বার খুলে দেয়। তা অন্তরকে ধোঁকা, প্রতারণা ও হিংসা থেকে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ করে। আর কেউ আল্লাহর নিকট মুক্ত অন্তর নিয়ে আসা ব্যতীত আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাবে না। আর আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির সাথে হৃদয়ের সচ্ছতা অসম্ভব। যখনই বান্দা আল্লাহর বন্টনে সর্বাধিক সন্তুষ্ট থাকবে, তখন তার হৃদয়ও তত বেশি মুক্ত পরিশুদ্ধ হবে। তাই কেউ আল্লাহর কিতাবে চিন্তা করলে দেখতে পাবে, আল্লাহ তা’আলা পূত – পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী লোকদের জন্য কি প্রস্তুত করে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা যথাযথভাবে অনুসরণকারীদের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন যে, তাদের একটি দু’আ থাকবে, যেন আল্লাহ তাদের অন্তরে ঈমানদারদের ব্যাপারে বিদ্বেষ না রাখেন।

৩- কুরআন পাঠ ও তাতে চিন্তা করা; এটাই সকল রোগের চিকিৎসা। আর বঞ্চিত সেই, যে আল্লাহর কিতাবের চিকিৎসা গ্রহণ করে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন: (قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاء)”বল, ইহা ঈমানদারদের জন্য পথপ্রদর্শক ও চিকিৎসা।”

৪- হিসাব ও শান্তিকে স্মরণ করা:( مَا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ) “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে সদা প্রস্তুত।” সে যে কথাই বলে, প্রতিটি কথার সুতরাং যে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাকে প্রত্যেকটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে এবং হিসাব নেওয়া হবে, তার নিকট দুনিয়া তুচ্ছ হয়ে যাবে, দুনিয়ার সব বিষয় থেকে সে নিরাসক্ত হয়ে যাবে এবং ঐ সকল কাজ করতে থাকবে, যা তাকে আল্লাহর নিকট উপকৃত করবে।

৫- দুআ: মুসলিমের জন্য আবশ্যক, নিজের জন্যও এই দু’আ করা এবং তার মুসলিম ভাইদের জন্যও এই দু’আ করা-

وَالَّذِينَ جَاؤُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

“এবং যারা তাদের পরে এসেছে, যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা কর। আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইদেরকেও, যারা আগে ঈমান এনেছে। এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন হিংসা – বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।”

৬- সুধারণা করা এবং মানুষের কথা ও অবস্থাকে উত্তম ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ

“হে ঈমানদারগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কোন কোন অনুমান গুনাহ।”

ওমর রা: বলেন: যখন তুমি অসংখ্য ভাল প্রয়োগক্ষেত্র পাও, তখন কোমার মুসলিম ভাইয়ের কোন কথাকে মন্দ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবে না।

৭- সালামের প্রসার করা: আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ঈমান আনয়ন করবে, আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পরে পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন জিনিস বলে দিব না, যা তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি করবে? তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম) আমিরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: বলেন: তিনটি জিনিস তোমার প্রতি তোমার ভাইয়ের ভালবাসা সৃষ্টি করবে। সাক্ষাতে প্রথমে তাকে সালাম দিবে, মজলিসে তার জন্য জায়গা করে দিবে এবং তাকে তার সবচেয়ে পছন্দনীয় নামে ডাকবে।

৮- মুসলমানদের জন্য কল্যাণকে ভালবাসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: সেই সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রতিবেশীর জন্য অথবা (বলেছেন) তার ভাইয়ের জন্য ঐ জিনিসই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম রহ:)

  • মুসলমানদের জন্য কল্যাণকে ভালবাসার অন্যতম একটি কাজ হল তাদের জন্য দু’আ করা: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যেমনিভাবে সে পছন্দ করে, তার মুসলিম ভাই তার জন্য দু’আ করুক, তেমনিভাবে তারও উচিত তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য দু’আ করা। তাই সর্বদাই এই দু’আ করতে থাকবে- হে আল্লাহ! আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুসলিম, মুসলিমা ও মুমিন – মুমিনাকে ক্ষমা করে দাও। আমাদের জনৈক সালাফ প্রত্যেকের জন্য এই দু’আ সর্বদা করা পছন্দ করতেন।

 আমি আমাদের শায়খ ইবনে তাইমিয়াকে এই দু’আটি আলোচনা করতে শুনেছি এবং তিনি এর অনেক ফযীলত ও উপকারীতা বর্ণনা করেছেন, যা এখন আমার মনে নেই। তিনি প্রায়ই এটা বলতেন। আমি তাকে একথাও বলতে শুনেছি যে, দুই সিজদার মাঝখানেও এটা বলা জায়েয আছে।

  • নির্মল অন্তর: ইবনুল আরাবী বলেন: অন্তর বিদ্বেষী, হিংসুক, আত্মগর্বী বা অহংকারী হয়েও নির্মল বা নির্ভেজাল হতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের জন্য শর্ত করেছেন, তার ভাইয়ের জন্যও তাই ভালবাসতে হবে, যা নিজের জন্য ভালবাসে।

 ইবনে সিরীন রহ: কে জিজ্ঞেস করা হল: নির্মল অন্তর কি? তিনি বললেন: আল্লাহর জন্য তার সৃষ্টির ব্যাপারে কল্যাণ কামনা করা।

শায়খুল ইসলাম বলেন: স্বচ্ছ ও প্রশংসিত হৃদয়হল, যা শুধু ভাল চায়, মন্দ চায়। আর তার মধ্যে পূর্ণাঙ্গতা হল ভাল মন্দ বোঝা । যে মন্দটা বোঝে না, তার মাঝে ত্রুটি আছে। সে প্রশংসিত নয়।

  • গীবত – অপবাদ না শোনা এবং তাতে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতিবাদ করা। যাতে করে সকল মানুষ খাটি মনের হয়ে যায়।
  • হৃদয়ের সচ্ছতার কয়েকটি চিত্তাকর্ষক নমুনা: ফযল ইবনে আয়্যাশ বলেন: আমি ওহাব ইবনে মুনাব্বিহের নিকট বসা ছিলাম। ইত্যবসের তার নিকট এক ব্যক্ত আসলো। সে বলল: আমি অমুকের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম সে আপনাকে গালি দিচ্ছে। তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন: শয়তান কি তোমাকে ছাড়া কোন খবরদাতা পেল না? তারপর আমি সেখান থেকে না উঠতেই উক্ত গালিদানকারী লোকটি সেখানে আসল। সে ওহাবকে সালাম দিল। তিনি উত্তর দিয়ে হাত বাড়িয়ে মুসাফাহা করলেন এবং তাকে তার পাশে বসালেন।
  • সুফিয়ান ইবনে দিনার বলেন: আমি আলী রা: এর একজন শীষ্য আবু বশিরকে বললাম আমাকে আমাদের পূর্ববর্তীদের আমল সম্পর্কে কিছু বল তো। তিনি বললেন: তারা কম আমল করতেন, কিন্তু অধিক বিনিময় লাভ করতেন। আমি বললাম এটা কেন? তিনি বললেন: কারণ তাদের হৃদয় স্বচ্ছ ছিল।
  • যায়দ ইবনে আসলাম বলেন; আবু দুজানা রা: এর মুমূর্ষ অবস্থায় তার নিকট যাওয়া হল। তখন তার চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। তাকে বলা হল, ব্যাপার কি, আপনার চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করছে কেন? তিনি বললেন: আমি যত আমল করেছি, তার মধ্যে আমার দু’টি আমল অপেক্ষা ভারী আর কিছু পাইনি : – তার একটি হল, আমি অনর্থক কথাবার্তা বলতাম না।

– আরেকটি হল, আমার অন্তর মুসলমানদের জন্য নির্ভেজাল ও স্বচ্ছ ছিল।

حي على الجهاد

জিহাদের দিকে আস

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

 “হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটা তোমাদের পক্ষে শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো। এর ফলে আল্লাহ তোমাদের পাপরাশী ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন উদ্যানে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসগৃহে, যা স্থায়ী জান্নাতে অবস্থিত। এটাই মহা সাফল্য।”

জিহাদ হল জান্নাতের সংক্ষিপ্ত পথ। হাসান বসরী রহ: বলেন: প্রত্যেকটি পথেরই একটি সংক্ষিপ্ত পথ আছে। আর জান্নাতের সংক্ষিপ্ত পথ হল জিহাদ।

  • অত্যাবশ্যকীয় ভালবাসার আলামত: শায়খুল ইসলাম বলেন: যার মধ্য জিহাদের প্রেরণা নেই, নির্ঘাত সে আবশ্যকীয় ভালবাসার দাবি আদায় করল না। তার মধ্যে নিফাক রয়েছে। যেমনটা আল্লাহ তা’আলা বলেন:

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُوْلَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ

“মুমিন তো তারা, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অন্তর দিয়ে স্বীকার করেছে, তারপর কোনও সন্দেহে পড়েনি এবং তাদের জান – মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারাই তো সত্যবাদী।”

  • জিহাদের মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ: শায়খুল ইসলাম বলেন: জেনে রাখ, জিহাদের মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ। আর তা বর্জনের মধ্যে রয়েছে ধ্বংস। আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে বলেন: (قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلاَّ إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ)”বল, তোমরা তো আমাদের ব্যাপারে দু’টি কল্যাণের যেকোন একটির অপেক্ষায়ই আছো, বৈ কি?”

অর্থাৎ হয়ত বিজয় ও সফলতা নতুবা শাহাদাত ও জান্নাত। সুতরাং মুজাহিদদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকেন, তারা সম্মানিত হয়ে বেঁচে থাকেন। তাদের জন্য আছে দুনিয়াবী প্রতিদান এবং পরকালীন মহা কল্যাণ। আর যারা মারা যান বা নিহত হন তাদের গন্তব্য জান্নাত।

  • শহীদদের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যবলী: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: আল্লাহর নিকট শহীদের জন্য ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে: ১. তাকে তার রক্তের প্রথম ফোটা পতনের সাথে সাথে ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং জান্নাতে তার বাসস্থান দেখানো হয়। ২. কবরের আযাব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৩. কিয়ামতের মহা এাস থেকে নিরাপদ রাখা হয়। ৪. তার মাথায় গাম্ভীর্যের মুকুট পরানো হবে, যার একেকটি ইয়াকুতী পাথর দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছু থেকে উত্তম। ৫. তাকে ৭২ জন আনত নয়না হুরের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে। ৬. তার ৭০ জন নিকটত্মীয়ের ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করা হবে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী রহ:)
  • শহীদদের সর্ববৃহৎ মর্যাদা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: কেউ জান্নাতে প্রবেশ করে আর ফিরে আসতে চাইবে না, যদিও তাকে দুনিয়ার সব কিছু দেওয়া হয়। একমাত্র শহীদ ব্যতীত। সে কামনা করবে দুনিয়ায় ফিরে আসতে, অতঃপর দশবার আল্লাহর রাস্তায় নিহত হতে। আর তা কেবল শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা প্রত্যক্ষ করার কারণেই। (বুখারী মুসলিম)
  • জিহাদের মাঝে রয়েছে প্রকৃত জীবন: আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَجِيبُواْ لِلّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُم لِمَا يُحْيِيكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! যখন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তোমাদেরকে এমন বিষয়ের দিকে আহ্বান করে, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে, তখন তোমরা তাদের ডাকে সাড়া দাও।”

ইবনুল কাইয়্যিম রহ: বলেন; যে জিনিস মানুষকে দুনিয়া , কবর ও আখিরাতে জীবন দান করে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ হল জিহাদ।

দুনিয়ায় জীবন দান এভাবে যে; শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের শক্তি ও ক্ষমতা জিহাদের মাধ্যমেই লাভ হয়।

আর কবরে জীবন লাভের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা বলেন:

وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاء عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ

“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত ধারণা করো না, বরং তারা জীবিত। তাদের রবের নিকট তাদেরকে রিযিক দেওয়া হয়।”

আর আখিরাতে জীবন লাভের স্বরূপ হল; আখিরাতে মুজাহিদ ও শহীদগণের জীবন ও নেয়ামত অন্যদের থেকে বেশি পরিমাণে ও উন্নতমানের হবে।

  • মুজাহিদের মহা প্রতিদান: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: কারো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অবস্থান করা স্বীয় ঘরে ৭০ বছর নফল নামায পড়া থেকে উত্তম। তোমরা কি ভালবাসো না, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং জান্নাতে প্রবেশ করান? তাহলে আল্লাহর পথে জিহাদ কর। যে আল্লাহর পথে উদ্ভীর দুধ দোহন পরিমাণ সময় যুদ্ধ করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী রহ:)
  • জিহাদের সমতুল্য কোন ইবাদত নেই: বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! জিহাদের সমতুল্য কি আছে? তিনি উত্তর দিলেন, তোমরা সেটা পারবে না। লোকটি এভাবে দু’বার বা তিনবার প্রশ্ন করল। তিনিও প্রতিবারই বললেন; তোমরা সেটা পারবে না। তারপর তিনি বললেন: আল্লাহর পথে জিহাদকারীর উদাহরণ হল, ধারাবাহিকভাবে রোজা পালনকারী ও রাত্রিজাগরণ করে নামাযে কুরআন তিলাওয়াতকারীর ন্যায়, যে রোজা ও নামাযে একটুও বিরতি দেয় না, যতক্ষণ না আল্লাহর পথের মুজাহিদ গৃহে ফিরে আসে। (বুখারী ও মুসলিম)

তাওবা হল জীবনের নিয়মিত আমল

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তাওবা করো, হয়ত তোমরা কামিয়াব হতে পারবে।” [ সুরা নুর ২৪:৩১ ]

  • আল্লামা সা’দী বলেন; যেহেতু মুমিনের ঈমানই তাকে তাওবার প্রতি আহ্বান করে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এর উপর সফলতাকে সম্পৃক্ত করে বলেন: “হয়ত তোমরা কামিয়াব হতে পারবে।” সুতরাং তাওবা ব্যতীত সফলতার কোন পথ নেই। আর তাওবা হচ্ছে: প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে আল্লাহর অপছন্দনীয় বিষয় থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে ও ভ্রান্তরিকভাবে আল্লাহর পছন্দনীয় বিষয় করতে শুরু করা। এটা প্রমাণ করে, প্রতিটি মুমিনেরই তাওবার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু আল্লাহ তা’আলা সকল মুমিনকে সম্ভোধন করেছেন। আর এখানে তাওবায় ইখলাস রাখার প্রতিও উৎসাহ রয়েছে। যেহেতু বলা হয়েছে- “তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো ” অর্থাৎ অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়;

যেমন দুনিয়াবী বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভ করা, মানুষকে দেখানো, সুখ্যাতি অর্জন করা ইত্যাদি ভ্রান্তি উদ্দেশ্যসমূহ।

  • নবী ﷺ এর জীবনে তাওবার গুরুত্ব: আগর আল মুযানী রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: নিশ্চয়ই অনেক সময়ই আমার মনের ভুল হয়ে যেতে পারে, তাই আমি দিনে একশত বার আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করি। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম রহ:)
  • আমাদের তাওবা করার প্রয়োজনীয়তা; তাওবা হল জীবনে নিয়মিত আমল। এটা জীবনের শুরু ও শেষ। এটাই দাসত্বের নিম্নস্তর, মধ্যস্তর ও উচ্চস্তর। আমাদের তাওবার প্রয়োজন রয়েছে। বরং এর প্রয়োজন আমদের জীবেন অনেক বেশি। কারণ আমরা অনেক গুনাহ করি, আল্লাহর ব্যাপারে দিন – রাত অনেক সীমালঙ্ঘন করি। তাই আমাদের অন্তরকে গুনাহর মরিচা থেকে পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন করার জন্য তাওবা প্রয়োজন।
  • প্রতিটি আদম সন্তানই ভুলকারী, গুনাহকারী। তবে সর্বোত্তম ভুলকারী হল তাওবাকারী। আর শেষের পূর্ণাঙ্গতাই ধর্তব্য, শুরুর অসম্পূর্ণতা ধর্তব্য নয়।
  • সর্বাবস্থায় বেশি বেশি ইস্তেগফার করা: হাসান বসরী রহ: বলেন; তোমরা তোমাদের ঘরে, পানির ঘাটে, রাস্তায়, বাজারে, মজলিসসমূহে ও তোমরা যেখানেই থাক, সর্বদা বেশি বেশি আল্লাহর যিকর কর। কারণ তোমরা জান না, কখন আল্লাহর মাগফিরাত নাযিল হয়।
  • বেশি বেশি ইস্তেগফার করা: যে যিকরটি বেশি বেশি করা তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে ইস্তেগফার। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। এর বরকত অনেক ব্যাপক। আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে ইস্তেগফার করার আদেশ করে বলেন: (وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ) একদল লোক নিজেদের অন্যায় কর্ম থেকে ইস্তেগফার করার কারণে আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রশংসা করে বলেন:( وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُواْ أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُواْ اللّهَ فَاسْتَغْفَرُواْ لِذُنُوبِهِمْ)”এবং যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।”
  • তুমি কিভাবে গুনাহর কবল থেকে মুক্তি লাভ করবে? গুনাহরাশী গুনাহগারের ঘাড়ে শিকল হয়ে থাকে, সে তাওবা ব্যতীত তার থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে না।

 আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ(

 “এবং আল্লাহ এমন নন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকা অবস্থায় তাদেরকে আযাব দিবেন এবং তিনি এমনও নন যে, তারা ইস্তেগফারে রত অবস্থায় তাদেরকে আযাব দিবেন।”

  • ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যে ইস্তেগফার আযাবকে প্রতিহত করে, তা হচ্ছে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে ফিরে আসার মাধ্যমে ইস্তেগফার করা। পক্ষান্তরে যে গুনাহর মধ্যে লিপ্ত থেকেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তার ইস্তেগফার তাকে আযাব থেকে রক্ষা করবে না। কারণ মাগফিরাত বা ক্ষমার অর্থ হচ্ছে, গুনাহকে মিটিয়ে দেওয়া, তার চিহ্ন মুছে দেওয়া এবং তার অনিষ্ট দূর করা।
  • গীবত থেকে তাওবা করার ক্ষেত্রে, যার গীবত করা হয়েছে, তার জন্য ইস্তেগফার করাই কি যথেষ্ট, নাকি তাকে অবগত করানোও আবশ্যক? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; এই মাসআলাটির ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের দুই রকম মত রয়েছে। আর দু’টিই ইমাম আহমাদ রহ: থেকে বর্ণিত দুই মত। তা হচ্ছে গীবত থেকে তাওবা করার জন্য যার গীবত করা হয়েছে, তার জন্য ইস্তেগফার করাই কি যথেষ্ট, নাকি তাকে অবগত করানো ও তার থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক? তিনি বলেন: বিশুদ্ধ মত হল, তাকে অবগত করানো আবশ্যক নয়। তার জন্য ইস্তেগফার করা এবং যে সকল মজলিসে তার গীবত করেছে, সেসকল মজলিসে তার সুনাম করাই যথেষ্ট ।
  • দু’আ অনেক সমস্যার সমাধান: আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُم مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ

“এবং (কিতাব এই পথনির্দেশ দেয় যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তার অভিমুখী হও। তিনি তোমাদেরকে এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত উত্তম জীবন ভোগ করতে দিবেন এবং যে কেউ বেশি আমল করবে, তাকে নিজের পক্ষ থেকে বেশি প্রতিদান দিবেন। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও , তবে আমি তোমাদের জন্য এক মহা দিবসের শাস্তি আশঙ্কা করি।”

নূহ আলাইহিস সালামের যবানীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا

“আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন – সম্পদ ও সন্তান – সন্তুতি উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদ – নদীর ব্যবস্থা করে দিবেন।”

  • বিশর বলেন: আমি ইবনে উয়াইনাকে বলতে শুনলাম: আল্লাহ তা’আলা এমন রোগের প্রতি ক্রোধ পোষণ করেন, যে রোগের কোন চিকিৎসা নেই। তখন আমি বললাম; তার চিকিৎসা হল শেষ রাতে অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার করা এবং শিক্ষামূলক তাওবা করা।
  • শায়খুল ইসলাম বলেন, যে অস্থিরকারী বিপদে আক্রান্ত হয়, তার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হল, শক্তভাবে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করা, সর্বদা দু’আ ও মিনতি করা। হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন দু’আ শিখবে, অতঃপর কবুল হওয়ার সম্ভাব্য সময়গুলোতে, যেমন শেষ রাতে, আযান – ইকামতের সময়, সিজদার সময়, নামাযের পরে, ইত্যাদি সময়গুলোতে মনোযোগ সহকারে বেশি বেশি দু’আ করবে এবং তার সাথে ইস্তেগফারও যুক্ত করবে।
  • জাফর ইবনে মুহাম্মদ বলেন: হে সুফিয়ান! যখন আল্লাহ তোমাকে কোন নেয়ামত দান করেন, অতঃপর তুমি চাও , তা সর্বদা স্থায়ীভাবে তোমার জন্য থাকুক, তাহলে তুমি তার জন্য বেশি বেশি আল্লাহর প্রশংসা ও শুকর আদায় কর। কারণ আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে বলেন لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ ) “তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বাড়িয়ে দিব।”
  • যখন তুমি রিযিক আসতে বিলম্ব দেখছো, তখন বেশি বেশি ইস্তেগফার কর। কারণ আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে বলেছেন:

اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا

“নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান – সন্তুতি উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদ – নদীর ব্যবস্থা করে দিবেন।”

  • তাওবার শর্তাবলী : তাওবার কালিমা একটি মহান কালিমা। এর রয়েছে গভীর তাৎপর্য। অনেকে যেমনটা মনে করে শুধু মুখে কিছু শব্দ উচ্চারণ করে কার্যত উক্ত গুনাহই চালিয়ে যেতে থাকা- এমনটা নয়। কারণ মূল্যবান জিনিসের জন্য অনেক শর্ত থাকে। তাই উলামায়ে কেরাম তাওবার জন্য অনেকগুলো শর্ত উল্লেখ করেছেন, যেগুলো কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এখানে তার কিছু আলোচনা করা হল:

১. তৎক্ষণাৎ উক্ত গুনাহ থেকে ফিরে আসা।

২. পূর্বে যা হয়ে গেছে, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

৩. সামনে আর না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা।

৪. যাদের প্রতি জুলুম করেছে, তাদের হক ফিরিয়ে দেওয়া বা তাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।

কেউ আরেকটি বৃদ্ধি করেছেন: এ সবের মধ্যে ইখলাস রাখা।

  • ইবনে রজব বলেন: শুধু اللهمّ اغفرلي (হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা কর) বলাই ক্ষমা প্রার্থনা এবং দু’আও । এর হুকুম হবে অন্য সকল দু’আর মতই। এক্ষেত্রে আল্লাহ চাইলে তার দু’আ কবুল করবেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিবেন। বিশেষত; যদি স্বীয় গুনাহের জন্য ভগ্ন হৃদয়ের সাথে হয় এবং কবুলের সময়গুলোতে হয়, যেমন সাহরীর সময়, নামাযের পরে।
  • লোকমান আ: থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তার সন্তানকে বলেন: হে বৎস! তোমার যবানকে সর্বদা اللهم اغفر لي কথাটি বলতে অভ্যস্ত কর। কারণ আল্লাহর কিছু সময় রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহ কারো দু’আ ফিরিয়ে দেন না।
  • তাওবায় সহায়ক বিষয়সমূহ:

১. ইখলাস রাখা ও আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা: যখন মানুষ আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয় এবং সত্যিকার অর্থে তাওবা করে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে তাতে সাহায্য করেন এবং তার জন্য তা সহজ করে দেন।

২. আশা কম করা ও পরকালকে স্মরণ করা; যখন মানুষ দুনিয়ার সীমাবদ্ধতা ও দ্রুত ধ্বংস হওয়ার কথা চিন্তা করবে, অনুধাবন করবে যে, এটা হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র এবং নেক আমল অর্জন করার সুবর্ণ সুযোগ আর জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামত ও জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিকে স্মরণ করবে, তখন সে দীর্ঘ দিনের। প্রবৃত্তির পথ থেকে ফিরে আসবে, শিক্ষণীয় তাওবায় অনুপ্রাণিত হবে এবং সামনে নেক আমলের মাধ্যমে অতীত কর্মের ক্ষতিপূরণ করতে চাইবে।

৩. গুনাহর উদ্দীপক ও স্মারক বিষয়সমূহ থেকে দূরে থাকা : যেসকল জিনিস গুনাহর প্রেরণা ও মন্দের আগ্রহ সৃষ্টি করে তা থেকে দূরে থাকবে। যেসকল জিনিস প্রবৃত্তিকে নাড়া দেয় এবং গোপন রিপু জাগিয়ে তুলে- যেমন নগ্ন ফিল্ম দেখা, মাতাল গান – বাদ্য শ্রবণ  করা, অশ্লীল বই – পুস্তক ও ম্যাগাজিন পাঠ  করা, ইত্যাদি থেকে দূরে থাকবে।

৪. ভাল লোকদের সাহচর্য গ্রহণ  করা, দুষ্ট লোকদের থেকে দূরে থাকা: সৎ সঙ্গী তোমাকে উপদেশ দিবে, তোমার দোষ – ত্রুটি ধরিয়ে দিবে। আর অসৎ সঙ্গী মানুষের দ্বীন নষ্ট করে দেয়, সাথীর দোষ – ত্রুটি ধরিয়ে দেয় না, দুষ্টদের সাথে তার সম্পর্ক করে দেয়, ভাল লোকদের থেকে সম্পর্ক বিছিন্ন করে এবং তাকে লাঞ্ছনা, অপমান ও লজ্জার পথে পরিচালিত করে।

আল্লাহর ওলীগণ

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

أَلا إِنَّ أَوْلِيَاء اللّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

“স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। তাদের দুনিয়ার জীবনেও সুসংবাদ আছে এবং আখেরাতেও। আল্লাহর কথায় কোনও পরিবর্তন হয় না। এটাই মহা সাফল্য।”

  • ইমাম তবারী রহ: বলেন: মহান আল্লাহ এখানে বলছেন: জেনে রাখ, আল্লাহর সাহায্যকারীদের আখেরাতে আল্লাহর শাস্তির কোন ভয় নেই। কারণ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন, তাই আল্লাহ তাদেরকে তার শাস্তি থেকে নিরাপদ রাখবেন। আর তারা দুনিয়ায় যা কিছু হারিয়েছে, তার জন্যও দু : খিত হবে না।
  • ওলী কে?

শায়খুল ইসলাম বলেন: যে ই মুমিন ও মুত্তাকী হয়, সে ই আল্লাহর ওলী। হাফেজ ইবনে হাজার বলেন; আল্লাহর ওলী দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছে, সর্বদা তার আনুগত্য করে এবং ইখলাসের সাথে তার ইবাদত করে।

  • কিভাবে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ওলীদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া যাবে: শায়খুল ইসলাম বলেন: যেহেতু মুমিন ও মুত্তাকীগণই আল্লাহর ওলী, সেহেতু বান্দার ঈমান ও তাকওয়ার পরিমাণ হিসাবেই আল্লাহর সাথে তার ওয়ালায়াত (বন্ধুত্ব) হবে। তাই যে সবচেয়ে বেশি ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী, আল্লাহর সাথে তার বন্ধুত্বও সর্বাধিক হবে সুতরাং ঈমান ও তাকওয়ার শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতেই আল্লাহর সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন হয়।
  • আল্লাহর ওলীদের বৈশিষ্ট্যাবলী: শায়খুল ইসলাম বলেন; যার ভালবাসাও আল্লাহর জন্য, ঘৃণাও আল্লাহর জন্য, শুধু আল্লাহর জন্যই ভালবাসে, আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্যই কাউকে দান করে আবার আল্লাহর জন্যই কাউকে নিষেধ করে- এমন ব্যক্তির অবস্থাই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ওলীদের অবস্থা।

ওলী ততক্ষণ পর্যন্ত ওলী হতে পারে না, যতক্ষণ না সে আল্লাহর শত্রুদেরকে ঘৃণা করে, তাদের সাথে শত্রুতা করে এবং তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে। তাই তাদের সাথে শত্রুতা ও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা হল, তার ওলায়াতের পূর্ণাঙ্গতা ও বিশুদ্ধতার চাবিকাঠি ।

  • আল্লাহর ওলীদের বিভিন্ন স্তর: শায়খুল ইসলাম বলেন, আল্লাহর ওলীদের দু’টি স্তর রয়েছে। একটি হল, অগ্রগামী ও নৈকট্যশীলদের স্তর। আর আরেকটি ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী নেককারদের স্তর। আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবের বিভিন্ন স্থানে তাদের কথা আলোচনা করেছেন। যেমন সূরা ওয়াকিয়ার শুরুর দিকে এবং শেষের দিকে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَكُنتُمْ أَزْوَاجًا ثَلَاثَةً فَأَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ وَأَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ أُوْلَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ وَقَلِيلٌ مِّنَ الْآخِرِينَ

“এবং (হে মানুষ!) তোমরা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হবে। সুতরাং যারা ডান হাত বিশিষ্ট, আহা, কেমন যে সে ডান হাত বিশিষ্টগণ! আর যারা বাম হাত বিশিষ্ট , কী (হতভাগ্য) সে বাম হাত বিশিষ্টগণ! আর যারা অগ্রগামী, তারা তো অগ্রগামীই। তারাই আল্লাহর বিশেষ নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা। তারা থাকবে নেয়ামতপূর্ণ উদ্যানে। বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে।”

  • ওলায়াতের প্রকারভেদ: শায়খ ইবনে উসাইমিন বলেন: ওলায়াত দুই প্রকার:

১. আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওলায়াত।

২. বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর ওলায়াত।

প্রথমটির দলীল হল: আল্লাহ তা’আলার বাণী : (اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ) “আল্লাহই ঈমানদারদের বন্ধু (অভিভাবক) “। আর দ্বিতীয়টির দলীল হল আল্লাহ   তা’আলার বাণী 🙁 وَمَن يَتَوَلَّ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ) (“আর যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করে … “)

অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি ওলায়াত আবার দুই প্রকার:

১. ব্যাপক ওয়ালায়াত।

২. বিশেষ ওয়ালায়াত।

ব্যাপক ওয়ালায়াত হল, বান্দার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার ওয়ালায়াত (অভিভাবকত্ব)। এটা মুমিন – কাফের সহ সমস্ত সৃষ্টিজীবকেই অন্তর্ভূক্ত করে। তাই আল্লাহই বান্দাদের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, শাসন ইত্যাদি করে থাকেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

ثُمَّ رُدُّواْ إِلَى اللّهِ مَوْلاَهُمُ الْحَقِّ أَلاَ لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ

“অতঃপর সকলকে তাদের প্রকৃত মুনিবের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। স্মরণ রেখ, হুকুম কেবল তারই চলে। তিনি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।”

বিশেষ ওয়ালায়াত: তা হচ্ছে আল্লাহ তার বিশেষ মনোযোগ, তাওফীক ও হেদায়াতের মাধ্যমে বান্দার দায়িত্বভার গ্রহণ করা। এটা শুধু মুমিনদের সাথেই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوُرِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَآؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর কাফেরদের অভিভাবক হল শয়তান। সে তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যায়।”

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:

)أَلا إِنَّ أَوْلِيَاء اللّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ (

“স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”

  • আল্লাহর ওয়ালায়াত কিভাবে লাভ করা যায়? একমাত্র আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমেই আল্লাহর ওয়ালায়াত লাভ করা যায়।

ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যে স্থায়ী সৌভাগ্য লাভ করতে চায়, সে যেন আল্লাহর দাসত্বে লেগে থাকে। আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত ওয়ালায়াত লাভ করা যায় না।

  • আল্লাহর তা’আলার দাবিসমূহ:

– আল্লাহকে শাসকরূপে গ্রহণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন: أَفَغَيْرَ اللّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا “আমি কি আল্লাহ ব্যতিত অন্য কাউকে ফায়সালাকারীরূপে গ্রহণ করবো।” আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সকল বিষয়ের শাসনকারী রূপে গ্রহণ করা যাবে না।

– শুধু আল্লাহর জন্যই কুরবানী করা: ((قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لاَ شَرِيكَ لَهُ)”বল, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, যার সাথে কোন শরীক নেই“।

সুতরাং যে ইবাদতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, সে কিছুতেই আল্লাহর ওলী হতে পারে না। কারণ তার ওলী হলে কিভাবে তার সাথে শরীক করতে পারে?

– সকল বিষয়ে ও সকল অবস্থায় আল্লাহর কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া। যখন তোমার আল্লাহর সাথে ওয়ালায়াত বিশুদ্ধ হবে, তখন তোমাকে অবশ্যই আল্লাহর দ্বীন ভালোভাবে আকড়ে ধরতে হবে এবং মানুষ দ্বীনের মধ্যে যত বিদআত সৃষ্টি করেছে, তা বর্জন করতে হবে।

– আল্লাহর প্রিয়দেরকে ভালবাসা; আল্লাহর প্রিয়দেরকে ভালবাসতে হবে, আল্লাহর ওলীদেরকে ভালবাসতে হবে এবং ওই সকল লোকদের সাথে শত্রুত করতে হবে, যারা আল্লাহর সাথে শত্রুতা করে, বিদ্বেষ পোষণ করে।

– আল্লাহর পথে কষ্ট সহ্য করা: কারণ এই ওয়ালায়াত তোমার উপর অনেক গুরুদায়িত্ব আরোপ করে। তোমাকে তোমার জীবনের কষ্টে ফেলবে, সম্পদের কষ্টে ফেলবে, দেশ থেকে দূরে থাকার কষ্টে ফেলবে।

– আল্লাহর শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা: আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্য হতে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই মধ্য থেকে হবে।”

– বর্তমানে অনেক মুসলিম আছে, যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব, অন্তরঙ্গতা ও পারস্পরিক সাহায্যের জন্য জোট গঠনের দিকে দৌড়ে যায়। তাহলে কিভাবে একজন বান্দার অন্তরে একসাথে বিপরীতমূখী দু’টি বিষয় একত্রিত হতে পারে!?

– পরিপূর্ণভাবে সতর্ক থাক: জনৈক সালাফ বলেন: প্রকাশ্যে আল্লাহর ওলী আর গোপনে তার শত্রু হয়ো না।

  • তুমি কি আখেরাতের চিন্তা মাথায় রাখ?

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ(

“এই পার্থিব জীবন খেলা – ধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত!”

  • ইমাম বাগাবী রহ: বলেন: اللهو হল: দুনিয়াবী স্বাদের জিনিস শ্রবণ করা। আর اللعب হল: অনর্থক কাজ। দুনিয়াকে এ দু’টি নামে ভূষিত করা হয়েছে যেহেতু দুনিয়া একটি ধ্বংসশীল ও নশ্বর বস্তু। আর পরকালীন জগতই হল স্থায়ী জীবনের জগত। আয়াতে الْحَيَوَانُ অর্থ হায়াত। অর্থাৎ চিরস্থায়ী হায়াত লাভ হবে। যদি তারা জানতো দুনিয়ার ধ্বংসশীলতা ও আখেরাতের স্থায়িত্ব।
  • বহুরূপী চিন্তা: মানুষ চিন্তামুক্ত নয়। চিন্তা দুই প্রকার: দুনিয়ার চিন্তা, আখিরাতের চিন্তা। কেউ এর একটি থেকে মুক্তি হলে আরেকটি থেকে মুক্তি হতে পারবে না। আর গাফেল হল, যার চিন্তা দুনিয়া নিয়ে। জ্ঞানী হল, যার চিন্তা আখেরাত নিয়ে। তাই মানুষ এ দু’টি চিন্তার মাঝেই সীমাবদ্ধ। তৃতীয় কোন চিন্তা নেই।
  • দুনিয়া ও আখেরাতের চিন্তার ফলাফলসমূহ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যার চিন্তা আখেরাত, আল্লাহ তার সকল বিস্তৃত চিন্তাগুলোকে একীভূত করে দেন, তার অন্তরে ধনাঢ্যতা দান করেন এবং দুনিয়া তার নিকট লাঞ্ছিত হয়ে আসে। আর যার চিন্তা দুনিয়া, আল্লাহ তার চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে দেন, তার চোখের সমানে দীদ্রতা ঢেলে দেন আর দুনিয়া তার জন্য যতুটুকু লেখা ছিল, ততটুকুই তার লাভ হয়। (বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ)
  • আখিরাত চিন্তার ফলাফলসমূহ: আখেরাতের চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় দাওয়াত, আমর বিল মারুফ, নেহী আনিল মুনকার ও মানুষের মাঝে সংশোধনের চিন্তা। কারণ যাকে আখেরাতের চিন্তা ব্যস্ত রাখে, সর্বদা জান্নাত লাভের আগ্রহ ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টায় থাকে এবং স্বীয় দ্বীন থেকে কল্যাণের ভালবাসা শিখে, সে তো এমনই হবে।

 রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন: আমি জান্নাত অন্বেষণকারী ও জাহান্নাম থেকে পলায়নকারীদের মত ঘুমন্ত আর কাউকে দেখিনি। (বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী)

  • দুনিয়ার ব্যাপারে সালাফদের অবস্থা: সালাফগণ (রা:) দুনিয়ার অনেক কিছুর মালিক হতেন, ক্রয় – বিক্রয়ও করতেন, কিন্তু দুনিয়া শুধু তাদের সামনেই থাকত; তাদের অন্তরে থাকত আখেরাত। কিন্তু এটা বর্তমানে আমাদের অনেকের অবস্থার বিপরীত। তাদের অন্তর পার্থিব ভোগ – সম্ভার, বিপদাপদ, কামনা – বাসনা ও লোভ লালসায় ভরপুর থাকে। ফলে তাদের আখেরাতের চিন্তা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের চলাফেরায় ইবাদতের প্রভাব – চিহ্ন ম্লান হয়ে পড়েছে এবং তাদের অন্তরে আল্লাহর ভালবাসা ক্ষীণ হয়ে গেছে। তারা তাদের সময়, মনোযোগ ও সম্পদের উদ্ধৃত অংশগুলোকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে।
  • কখন তোমার অন্তর থেকে দুনিয়ার চিন্তা দূর হবে?

ইমাম মালেক রহ: বলেন: তুমি যতটুকু পরিমাণ দুনিয়ার জন্য চিন্তিত হবে, তোমার অন্তর থেকে ততটুকু আখেরাতের চিন্তা বের হয়ে যাবে। আর তুমি যতটুকু পরিমাণ আখেরাতের চিন্তা করবে, তোমার অন্তর থেকে ততটুকু পরিমাণ দুনিয়ার চিন্তা বের হয়ে যাবে।

কারণ অন্তর যখন দুনিয়া ও তার চিন্তায় ভরপুর হয়ে যায়, তার মধ্যে আখেরাত ও আখেরাতের প্রস্তুতির চিন্তা দুর্বল হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে মহান আল্লাহর কালাম চিন্তা করার মত স্থান থাকে না। সুতরাং আখেরাতের সাথে সম্পর্ক গড়া এবং দুনিয়া থেকে নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়াই সব কল্যাণের মূল।

 ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: জেনে রাখ, যখন অন্তর দুনিয়ার চিন্তা ও তার সাথে । সম্পৃক্ততা তথা সম্পদ, নেতৃত্ব, সৌন্দর্য্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়ে যাবে আর আখেরাতের চিন্তা ও তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে যাবে, তখনই কেবল সে কল্যাণের পথে চলতে পারবে।

  • আল্লাহর নিকট যাওয়ার প্রস্তুতি: আর এটাই সকল প্রকার সফলতার চাবিকাঠি, আলোর উৎস। তখনই তার অন্তর আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়গুলো জানার জন্য জেগে উঠবে এবং তা সম্পাদন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টির বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকবে। আর এটাই তার সদিচ্ছার আলামত।
  • সালাফদের আখেরাত চিন্তার কিছু নমুনা: সুফিয়ান সাওরী রহ: বলেন: আমি একরাত পর পর সুফিয়ানের চোখে সুরমা দিয়ে দিতাম। তিনি ভীত – সন্ত্রস্ত অবস্থায় জেগে উঠে জোরে জোরে বলতেন: আগুন … আগুন …। জাহান্নামের স্মরণ আমাকে ঘুম ও জীবনভোগ করতে দিচ্ছে না।
  • ইবনে মাসুদ রা: এক কামারের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন এই আগুন দেখে তার অন্তরে ভয় জাগল। তিনি লোহার নিকট দিয়ে অতিক্রম করতেন। লোহা উত্তপ্ত হত। তা দেখে তিনি আখেরাতের স্মরণে কাঁদতেন। সাহাবা ও সালাফগণ এরূপই ছিলেন।
  • জীবনের প্রতিটি সময়কে গনিমত মনে করতেন; জনৈক যাহিদ (দুনিয়া বিরাগী) বলেন; আমি এমন কারো কথা ভাবতে পারি না, যে জান্নাত – জাহান্নামের কথা শোনার পরও তার একটি মুহূর্ত আল্লাহর আনুগত্য, তথা যিকর, নামায, কুরআন তিলাওয়াত বা ইহসান ব্যতীত কাটাবে। তখন এক ব্যক্তি তাকে বলল: আমি সবচেয়ে বেশি কাঁদি। তিনি বললেন: তুমি যদি হাস, কিন্তু তোমার গুনাহকেও স্বীকার কর, তাহলে এটাই উত্তম, কেঁদে নিজের আমল মানুষকে বলার চেয়ে। আমল প্রচারকারী ব্যক্তির আমল তার মাথার উপরেই উঠে না।
  • তখন উক্ত লোকটি বলল: আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: তুমি দুনিয়াকে দুনিয়াদারদের জন্য ছেড়ে দাও, যেমন তারা আখেরাতকে আখেরাতকামীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। আর দুনিয়াতে মধু পোকার ন্যায় হয়ে থাক। যা খেলে উত্তম জিনিস খায়, খাওয়ালে ভাল জিনিস খাওয়ায় আর কোন কিছুর উপর পড়ে গেলে তাকে ভাঙ্গে না বা তাতে ক্ষত সৃষ্টিও করে না।
  • আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের চিন্তা:

তোমার সব চিন্তাকে এক চিন্তায় রূপান্তর কর; আর তা হল আখেরাতে চিন্তা, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের চিন্তা এবং তার সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার চিন্তা।

বান্দা স্মরণ করবে যে, সে আল্লাহর নিকট ফিরে যাবে, আরও স্মরণ করবে যে, প্রত্যেক শুরুরই শেষ আছে, মৃত্যুর পর তার তাওবার কোন সুযোগ নেই এবং মৃত্যুর পর জান্নাত – জাহান্নাম ছাড়া কোন বাসস্থান নেই। সুতরাং মানুষ যখন চিন্তা করবে, জীবন শেষ হয়ে যাবে, ভোগ – সামগ্রী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এগুলো হল ধোঁকা ও চোখের পর্দা, তখন আল্লাহর শপথ! এই স্মরণই তাকে দুনিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে এবং সত্য ও আন্তরিকভাবে দুনিয়ার রবের দিকে মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করবে। তখন তার হৃদয় বিগলিত হবে। যখন সে কবরগুলোর দিকে দৃষ্টি দিবে এবং কবরবাসীদের অবস্থা চিন্তা করবে, তখন তার অন্তর ভেঙ্গে যাবে। আর তার অন্তর হবে কঠোরতা ও প্রবঞ্চনা থেকে সর্বাধিক মুক্ত। আল্লাহই একমাত্র আশ্রয়!

তোমার অন্তর কি আখেরাতের চিন্তায় ব্যস্ত হয়, নাকি তুমি আখেরাত ভুলেই গেছো? ফলে ঐ সকল লোকদের মত হয়ে গেছে, যারা নামায পড়েও পড়ে না, মাথা ঠোকর দেয়, কিন্তু জানে না, কি নামায পড়ছে, ইমাম কি কিরাত পাঠ করেছে! একটি দিনও এমন স্মরন করতে পারে না, যাতে কুরআন পাঠে হৃদয় প্রকম্পিত হয়েছে?

  • যারা আখেরাতের চিন্তা লালন করে তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী:

১. আত্ম সংশোধন: এটাই তাদের দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক আল্লাহর ইবাদত করা, তার সাথে কাউকে শরীক না করা। তারা জানে, আল্লাহ দয়া করেন, ক্ষমা করেন, মার্জনা করেন, কিন্তু তারা এর উপর ভরসা করে বসে থাকে না, বরং ছোট থেকে ছোট প্রতিটি গুনাহ, ত্রুটি – বিচ্যুতি ও অবহেলা – অলসতার জন্য অনুতপ্ত হয়। কারণ তারা জানে, যে সত্তার নাফরমানী করা হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ। আপনি তাদেরকে দেখবেন, তারা মুসলিমদের বিপদাপদ ও তাদের উপর আপতিত জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের কারণে চিন্তিত। তাদের অন্তর দয়া ও করুণায় ভরা থাকে। সেই আখেরাত চিন্তার কারণে, যা তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করে আছে।

২. সার্বক্ষণিক হিসাব – নিকাশ: পরকালীন চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেখতে পাবেন, সর্বদা নিজের প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব নিকাশ করে।

৩. হাসান বসরী রহ: আল্লাহর বানী- وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ (“এবং শপথ করছি তিরস্কারকারী নফসের”) এর তাফসীরে বলেন: আল্লাহর শপথ! এটা হচ্ছে মুমিনের নফস। প্রতিটি মুমিনই নিজেকে ভৎসনা করতে থাকে আমার একথাটির উদ্দেশ্য কি? আমার এই ভাবনাটির উদ্দেশ্য কি? কিন্তু পাপাচারী নিজের হিসাব করে না।

কিন্তু এই চিন্তা ও মুরাকাবা (আত্মসমালোচনা) তাদেরকে এমন শিকলে বেঁধে ফেলে না যে, মসজিদের কোণায় বা ঘরে বসে বসে শুধু নিজের জন্য কাঁদতে থাকবে আর ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট লোকদের ব্যাপারে ভাববে না, তাদেরকে সংশোধন করবে না, নিজের আশপাশের লোকদের মন্দ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করবে না। বরং তাদের অন্তরে যে চিন্তা থাকবে, তা ই তাদেরকে এই কাজে উদ্বুদু করবে। ফলে নিজের লোকদেরকে সংশোধন করবে, অন্যদেরকে সংশোধন করবে এবং বিপদাপদ ও কষ্ট – মুসিবত সহ্য করবে।

  • মৃত লোকদের দৃশ্য ও তাদের অবস্থা দেখে তাদের শিক্ষা গ্রহণ: তারা তাদের জীবন্ত অন্তরের কারণে প্রতিটি দুনিয়াবী বিষয়কে আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত করবে। অন্যদের মৃত্যু তাদেরকে নিজেদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ফলে তা তাদের পরকালীন আমলের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলবে তারা। পরকালের জন্য আমল সঞ্চয় করতে থাকবে, যা তাদেরকে জান্নাতের উন্নত স্তরে নিয়ে যাবে।
  • আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করাঃ

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنتُمُ الْفُقَرَاء إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ(

“হে লোক সকল! তোমরাই আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং আপনিই প্রশংসিত।”

শাওকানী রহ: বলেন; অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ে তার দিকে মুখাপেক্ষী। ফলে সার্বিকভাবেই তার দিকে মুখাপেক্ষী।

  • প্রকৃত দারিদ্র কি? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: প্রকৃত দারীদ্র হল, প্রতিটি অবস্থায় সর্বদা আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করা এবং বান্দা প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে সবদিক থেকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষী হিসাবে দেখা।
  • অধিকাংশ মানুষের অবস্থা: প্রতিটি মানুষ তার প্রতিটি কথা ও কাজে এবং প্রতিটি ছোট ও বড় বিষয়ে আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষী। অথচ বর্তমানে মানুষ মানুষের পিছনে লেগে থাকে, মানুষের নিকট অভিযোগ পেশ করে। তবে যে বিষয়ে মানুষ সক্ষম, সে বিষয়ে মানুষের সাহায্য চাইলে সমস্যা নেই, কিন্তু মানুষের উপর ভরসা করা, তাদের নিকট ভিক্ষা করা, তাদের পিছনে লেগে থাকা, এগুলোই হল ধ্বংস। কারণ যে আল্লাহর ব্যতিত কোন কিছুর পিছনে ছুটে, তাকে তার দায়িত্বেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

আমরা আত্মগর্ব ও আত্মপ্রবঞ্চনা বশত নিজেদের জ্ঞান – বুদ্ধির উপর ভরসা করে ফেলি! অথচ আমাদের উচিত আল্লাহর নিকট সাহয্য ও তাওফীক চাওয়া, তার নিকট বারবার দু’আ করা এবং যেকোন সংকটে বা সচ্ছলতায় একমাত্র তার সাথে সম্পর্ক গড়া। কিন্তু কিছু মানুষ এই চিন্তা করে সবকিছুর শেষে।

  • আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষীতা প্রকাশের স্বাদ: স্বীয় প্রতিপালকের সামনে ভেঙ্গে পড়া, তাকে ডাকা ও তার নিকট দু’আ করার মাঝে রয়েছে অবর্ণনীয় স্বাদ।
  • জনৈক আল্লাহ ওয়ালা বলেন; আল্লাহর নিকট আমার একটি প্রয়োজন থাকবে আর আমি তার নিকট তা চাইবো, ফলে আমার জন্য মুনাজাত ও মারিফাত লাভ করা এবং বিনয় ও ভগ্নদশা প্রকাশ করার সুযোগ হবে- আমার নিকট আমার এমন অবস্থা সর্বদা থাকা আর আমার প্রয়োজনটি পুরা হতে বিলম্বিত হওয়া অনেক ভাল।
  • আল্লাহর দিকে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ; সাহল আত – তাতারী বলেন: বান্দা ও তার রবের মাঝে সর্বাধিক সংক্ষিপ্ত পথ হল ‘ দীনতা প্রকাশ করা।
  • রহমতের দরজাসমূহ কখন খুলে দেওয়া হয়? শায়খুল ইসলাম বলেন; যখন বান্দা আল্লাহর নিকট সত্যিকারার্থে মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করে এবং একনিষ্ঠভাবে তার নিকট সাহায্য চায়, তখন আল্লাহ তার দু’আ কবুল করেন, তার দুঃখ দূর করে দেন এবং তার জন্য রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেন। আর এমন ব্যক্তিই তাওয়াক্কুল ও দু’আর প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারে, যা অন্যরা আস্বাদন করতে পারে না।
  • আল্লাহর নিকট উসিলা পেশ করার ক্ষেত্রে যে জিনিসটি সর্বোত্তম; বান্দা সর্বোত্তম যে জিনিসের দ্বারা আল্লাহর নিকট ওসিলা পেশ করবে, তা হল সর্বাবস্থায় তার নিকট মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করা, সকল কাজে দৃঢ়ভাবে সুন্নাহর অনুসরণ করা এবং হালাল পন্থায় রিযিক অন্বেষণ করা।
  • কিভাবে তুমি তোমার প্রয়োজন পুরা করবে?

ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যে ব্যর্থ হয়েছে সে কেবল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা এবং দু’আ ও দীনতা প্রকাশে অবহেলা করার কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। আর আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যে যে সফল হয়েছে, সে কেবল শুকর আদায় এবং সর্বান্তকরণে দু’আ ও মুখাপেক্ষীতা প্রকাশ করার কারণেই সফল হয়েছে।

একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত : ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: আমি শায়খুল ইসলামকে দেখেছি, তিনি যখন বিভিন্ন মাসআলা বুঝতেন না বা কঠিন মনে করতেন, তখন দ্রুত তাওবা, ইস্তেগফার, আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা ও কাকুতি মিনতি করতে চলে যেতেন। আল্লাহর নিকট সঠিক সিদ্ধান্ত কামনা করতেন এবং তার রহমতের খানাসমূহ খোলার দু’আ করতেন। অতঃপর অল্প সময়ের মধ্যেই তার উপর অবারিত ইলাহী রহমত নাযিল একটির পর একটি আল্লাহর সাহায্য এমনভাবে আসতে থাকত যে, তিনি কোনটা দিয়ে শুরু করবেন?

  • আউযু বিল্লাহ বলার মধ্যেও দীনতা প্রকাশ রয়েছে; আউযু বিল্লাহর মধ্যে পরিপূর্ণ দীনতা প্রকাশ, আল্লাহকেই আকড়ে ধরা, আল্লাহই যথেষ্ট হওয়ার প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং বর্তমান – ভবিষ্যৎ, ছোট – বড়, মানব বা অমানবসৃষ্ট সকল অনিষ্ট থেকে হেফাজতের ব্যাপারে আল্লাহকেই যথেষ্ট করার বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এর দলীল হল আল্লাহর বাণী- (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ مِن شَرِّ مَا خَلَقَ….)

“বল, আমি ভোরের মালিকের আশ্রয় গ্রহণ করছি, তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে এবং অন্ধকার রাতের অনিষ্ট হতে, যখন তা ছেয়ে যায়। এবং সেই সব ব্যক্তির অনিষ্ট হতে, যারা (তাগা বা সুতার) গিরায় ফু দেয় এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে।”

)قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ مَلِكِ النَّاسِ إِلَهِ النَّاسِ مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ(…

“বল, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি সমস্ত মানুষের প্রতিপালকের। সমস্ত মানুষের অধিপতির। সমস্ত মানুষের মাবুদের। সেই কুমন্ত্রণার অনিষ্ট হতে, যে পেছনে আত্মগোপন করে। যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। সে জিনদের মধ্য হতে হোক বা মানুষের মধ্য হতে।”

দু’আর মধ্যে দৃঢ়তা থাকা এবং ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত না করার আবশ্যকীয়তা; কারণ এটা কাঙ্খিত বিষয়টির গুরুত্ব না থাকা এবং আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষিতা প্রকাশে দুর্বলতা বোঝায়। উদাহরণত; এমন বলবে না- হে আল্লাহ আপনি চাইলে আমাকে তাওফীক দান করুন! অথবা কাউকে বললেন: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন, যদি তিনি চান। অথবা এরূপ বলা; আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত দিবেন যদি তিনি চান। বরং দৃঢ়ভাবে দু’আ করবে, তাতে ইন শা আল্লাহ

তথা যদি আল্লাহ চান, এরূপ শব্দ ব্যবহার করবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; তোমাদের কেউ যেন এরূপ না বলে: হে আল্লাহ! আপনি চাইলে আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি চাইলে আমার প্রতি রহম করুন, আপনি চাইলে আমাকে রিযিক দান করুন! বরং দৃঢ়ভাবে চাইবে। কারণ তিনি তো যা নিজে ইচ্ছা করেন, তা ই দিবেন ; তাকে তো কেউ বাধ্যকারী নেই। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী ও মুসলিম)

  • যে বিষয়টি সকল ইবাদতের মাঝে পাওয়া যায়; অন্তরিক ও বাহ্যিক সকল আমলগুলোর ব্যাপারে কেউ চিন্তা করলে দেখবে, সবগুলোর মধ্যেই আল্লাহর প্রতি দীনতা প্রকাশ করার বিষয়টি রয়েছে। তাই এটা সকল ইবাদতের সমন্বয়ক। সুতরাং ইবাদতের মধ্যে বান্দার দীনতা প্রকাশের পরিমাণ অনুযায়ী তার অন্তরে তার প্রভাব পড়বে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য উপকারী হবে। আপনি শুধু সর্ববৃহৎ কার্যগত ইবাদত, নামাযের মধ্যেই চিন্তা করুন, নামাযে বান্দা তার রবের সামনে শান্ত, ভীত – সন্ত্রস্ত, বিনয়ী ও অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে, সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখে। আর শুরু করে তাকবীরের মাধ্যমে।
  • আল্লাহর নিকট দীনতা প্রকাশ আল্লহর প্রতি ঈমানকে শক্তিশালী করে।
  • কিভাবে আল্লাহর সামনে দীনতা প্রকাশ করা যায়? দীনতা প্রকাশ একটি উদ্দীপক। তা বান্দাকে সর্বদা তাকওয়া ও আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত থাকতে প্রেরণা দেয়। আর এই দীনতা প্রকাশ কতগুলো জিনিসের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় • সৃষ্টিকর্তার বড়ত্ব ও মহত্ব উপলব্ধি করা: যখনই বান্দা আল্লাহর ব্যাপারে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে সর্বাধিক জানবে, তখন সে আল্লাহর সামনে সর্বাধিক দীনতা প্রকাশকারী ও বিনয়ী হবে।
  • মাখলুকের দুর্বলতা ও অক্ষমতার উপলব্ধি: কেউ যখন নিজেকে পরিমাপ করতে পারবে এবং বুঝতে পারবে যে, সে সম্মান, ক্ষমতা ও সম্পদে যে স্থানেই পৌঁছে যাক না কেন, তবু সে দুর্বল, অক্ষম, নিজের ভাল – মন্দ কিছুই করার ক্ষমতা নেই তার, তখন সে নিজেকে ছোট মনে করবে, তার অহংকার শেষ হয়ে যাবে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নম্র হয়ে পড়বে, তার মনিবের সমীপে দীনতা প্রকাশ এবং তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা ও কাকুতি – মিনতি বৃদ্ধি পাবে।
  • আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষিতা প্রকাশের আলামতসমূহ:

১. আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ বিনয়ী হওয়া, সাথে সাথে সর্বোচ্চ ভালবাসাও রাখা।

২. আল্লাহ ও তার প্রিয় বস্তুসমূহের সাথে সম্পর্ক গড়া।

৩. সব সময় ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর ও ইস্তেগফারে থাকা।

৪. নেক আমল কবুল না হওয়ার আশংকায় থাকা।

৫. গোপনে – প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় কর।

৬. আল্লাহর আদেশ – নিষেধসমূহকে বড় মনে করা।

  • আল্লাহর সামনে বিগলিত হয়ে যাওয়ার স্বাদ: যেসকল বিষয়গুলো ঈমানকে সতেজ করে, তার মধ্যে রয়েছে, আল্লাহর সাথে নির্জনে কথা বলা ও বিগলিত হওয়ার স্বাদ। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: বান্দা আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয় সিজদার সময়। কারণ সিজদার অবস্থার মধ্যে যে বিনয় রয়েছে, তা অন্যান্য অবস্থায় নেই। এর মধ্যে এমন ভগ্নাবস্থা ও নয় : রতা রয়েছে, যা অন্যান্য অবস্থায় নেই। একারণেই বান্দা সিজদাবস্থায় আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়। যেহেতু সিজদায় কপাল যমীনে রাখে, অথচ কপালই তার সবচেয়ে উপরের অঙ্গ। কার জন্য এটা যমীনে রাখে? আল্লাহর জন্য। এজন্যই এটা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটর্তী অবস্থা।
  • আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাতে এই কথাগুলো কতই না মধুর! ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; এই অবস্থায় , অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালার সামনে বিগলিত ও নত হওয়ার অবস্থায় এই কথাগুলো বলা কতই না মধুর:

 আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, আপনার সম্মান ও আমার হীনতার উসিলা দিয়ে, আপনি অবশ্যই আমার প্রতি দয়া করুন। আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার শক্তি ও আমার দুর্বলতার উসিলা দিয়ে, আমার থেকে আপনার অমুখাপেক্ষিতা ও আপনার প্রতি আমার মুখাপেক্ষিতার উসিলা দিয়ে! আপনার সকাশে লুটিয়ে দিচ্ছি। এই মিথ্যাবাদী ও অপরাধীর ললাট! আমি ছাড়াও আপনার অনেক গোলাম রয়েছে, কিন্তু আপনি ছাড়া আমাদের কোন মনিব নেই! আপনি ছাড়া কোন আশ্রয় ও কোন ঠিকানা নেই। আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এক হতদরীদ্রের ন্যায়। আপনার নিকট মিনতি করছি এক অনুগত ও নত বান্দার ন্যায়! আপনাকে ডাকছি এক ভীত – সন্ত্রস্ত ফরিয়াদির ন্যায়, যার ঘাড় আপনার সামনে নুয়ে পড়েছে, যার নাক আপনার সামনে ধুলোমলিন হয়েছে, যার চক্ষুদ্বয় আপনার সামনে প্লাবিত হয়েছে। এবং যার হৃদয় আপনার সামনে বিগলিত হয়েছে।

  • কিভাবে আমাদের অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব স্থাপন করবো?

আল্লাহর তা’আলার বড়ত্বের একটি নিদর্শন, যা আল্লাহ তা’আলা স্বীয় কিতাবে তাঁর পবিত্র সত্ত্বার ব্যাপারে বলেছেন:

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

“তারা আল্লাহকে তার যথোচিত মর্যাদা দেয়নি। অথচ কিয়মাতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তার মুঠোর ভিতর এবং আকাশমন্ডলী গুটানো অবস্থায় থাকবে তার ডান হতে। তিনি পবিত্র এবং তারা যে শিরক করে, তা থেকে তিনি বহু উর্ধ্বে।”

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: কিয়মাতের দিন আল্লাহ তা’আলা যমীনকে তার মুষ্ঠিতে নিবেন আর সমস্ত আসমানসমূহকে তাঁর ডান হাতে নিবেন, অতঃপর বলবেন: আমিই একমাত্র বাদশা। দুনিয়ার বাদশারা এখন কোথায়!! ? (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ:)

  • গভীর প্রজ্ঞাবানী: শায়খুল ইসলাম বলেন; বান্দার অন্তরে আল্লাহ তা’আলার বড়ত্ব থাকা তাঁর সম্মানিত বিষয়সমূহকে সম্মান করার দাবি করে। আর তার সম্মানিত বিষয়সমূহকে সম্মান করা তার মাঝে ও গুনাহের মাঝে প্রতিবন্ধক হবে। তাই যারা দুঃসাহসিকভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজসমূহ করে, তারা আল্লাহর যথাযথ বড়ত্ব বুঝেনি ।
  • এই মহা সৃষ্টির ব্যাপারে চিন্তা কর:

এই বিশাল সৃষ্টি- আসামন, যমীন, পাহাড়, বৃক্ষ, পানি, মাটি ইত্যাদি সমস্ত সৃষ্টিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা কিয়মাতের দিন তার আঙ্গুলে রাখবেন এবং উভয় মুষ্ঠিতে জমা করবেন। যেমনটা বিশুদ্ধ দলিলাদী দ্বারা প্রমাণিত।

তাই এটাই আল্লাহ তা’আলা বড়ত্বের প্রমাণ দেয়। এই বিশাল সৃষ্টি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার নিকট ক্ষুদ্র হওয়াই তার বড়ত্ব, মহত্ব ও পরাক্রমের প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই মহিমাময় আল্লাহ বলেছেন:( وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ) অর্থাৎ তারা তাঁর যথাযথ বড়ত্ব প্রকাশ করেনি।

 মহান আল্লাহর বড়ত্ব, শক্তি, ক্ষমতা ও মহা পরাক্রমশীলতা বুঝা আমাদের কতই প্রয়োজন!

আমাদের জন্য জরুরী আল্লাহ তা’আলার মহত্ব বুঝা এবং তাকে সর্বপ্রকার ত্রুটি থেকে পবিত্র করা। আমরা যখন এটা বুঝবো, তখন আমাদের অন্তরে আল্লাহ তা’আলা ও তার আদেশ – নিষেধের ভালবাসা , মহত্ব ও সম্মান সৃষ্টি হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন: (مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا) তোমাদের কি হল, তোমরা আল্লাহর মহিমাকে একেবারেই ভয় করো না!? “অর্থাৎ তাঁর সাথে সম্মানের ব্যবহার করো না।

হাসান বসরী রহ: বলেন; অর্থাৎ তোমাদের কি হল, যে তোমরা আল্লাহর তা’আলার হক বুঝ না এবং তার শুকর আদায় কর না!

মুজাহিদ রহ: বলেন; অর্থাৎ তোমাদের রবের বড়তের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না।

ইবনে আব্বাস রা: বলেন: তার যথাযথ সম্মান বুঝ না।

ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; এসকল মতগুলো একটি অর্থের দিকেই ফিরে। তা হচ্ছে, তারা যদি আল্লাহ তা’আলার বড়ত্ব প্রকাশ করত এবং তার যথাযথ সম্মান বুঝত, তাহলে অবশ্যই তাকে এক বলে স্বীকার করত, তার আনুগত্য করত এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করত। আর আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য হচ্ছে তার অবাধ্যতার কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা এবং তার সম্মান অনুযায়ী তার থেকে লজ্জাবোধ করা।

  • সবচেয়ে বড় মূর্খতা: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: সবচেয়ে বড় জুলুম ও মূর্খতা হল, তুমি মানুষের নিকট হতে শ্রদ্ধা ও সম্মান কামনা করবে, অথচ তোমার অন্তর আল্লাহ তা’আলার বড়ত্ব ও মর্যাদা থেকে মুক্ত। কারণ তুমি যখন মাখলুকের সম্মান ও বড়ত্ব প্রকাশ কর, তখন ওই ব্যক্তি তোমাকে এ অবস্থায় দেখছে যে, তুমি আল্লাহকে এতটুকু সম্মান করছো না যে, আল্লাহ তোমাকে এ অবস্থায় দেখুক, তা তুমি চাও।
  • আন্তরিকভাবে আল্লাহকে সম্মান করার বিভিন্ন রূপ:

১. আল্লাহ তা’আলার সম্মান থাকার একটি আলামত হল, তাঁর কোন সৃষ্টিকে তাঁর সমকক্ষ না করা। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও না: যেমন: এরূপ বলা: ‘আল্লাহ ও তোমার জীবনের শপথ! আমার আল্লাহ ও তুমি ব্যতীত কেউ নেই।’ অথবা “আল্লাহ ও আমি যা চাই।’

২. ভালবাসা, সম্মান ও মর্যাদা দানের ক্ষেত্রেও না।

৩. আনুগত্যের ক্ষেত্রেও না। যেমন তুমি মাখলুকের আদেশ – নিষেধের এমনভাবে আনুগত্য করলে, যেমন আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করা হয়, অথবা তার চেয়ে বেশি করলে, যেমনটা অধিকাংশ জালিম ও পাপিষ্ঠদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

৪. ভয় ও আশার ক্ষেত্রেও না। অর্থাৎ আল্লাহর বিষয়গুলোকে সহজভাবে দেখবে, তার হককে ছোট করে দেখবে না, সেগুলোর ব্যাপারে একথা বলবে না যে, এগুলো সব ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং এগুলোকে অতিরিক্ত বিষয় বানাবে না বা এগুলোর উপর মাখলুকের হককে প্রাধান্য দিবে না।

৫. এমন যেন না হয় যে, আল্লাহ ও তার রাসূল এক দিকে, একপ্রান্তে, আর লোকজন একদিকে এক প্রান্তে , তখন তুমি লোকজনের দিকে থাকলে, আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে থাকলে না।

৬. মাখলুকের সাথে কথা বলার সময় তাদেরকে স্বীয় মন ও বিবেক সপে দেওয়া আর আল্লাহর খেদমত করার সময় শুধু দেহ ও যবান দেওয়া – এমন অবস্থা থেকে বিরত থাকবে।

৭. নিজের উদ্দেশ্যকে আল্লাহর উদ্দেশ্যের উপর প্রাধান্য দিবে না।

৮. আল্লাহর সম্মানের আরেকটি হল, স্বীয় মনের ভেতরের খারাপ অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহর অবগত হওয়াকে লজ্জা করবে।

৯. তার সম্মানের আরেকটি হল, নামি দামি মানরুষকে যতটা লজ্জা করবে নির্জনে আল্লাহ তা’আলাকে তার চেয়ে বেশি লজ্জা করবে।

এ সবগুলো হল অন্তরে আল্লাহর সম্মান না থাকা। যে এমন হবে, আঙ্কাহ তা’লা মানুষের অন্তরে তার সম্মান বা ভয় সৃষ্টি করবেন না। মানুষের অন্তর থেকে তার ভয় ও সম্মান পড়ে যাবে। যদিও তার অনিষ্টের ভয়ে তাকে সম্মান করতে পারে, কিন্তু এটা হচ্ছে ঘৃণার সম্মান । ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্মান নয়।

  • আল্লাহ তা’আলার নাম ও গুণাবলীতে তার বড়ত্বের কথা চিন্তা কর: আল্লাহ তা’আলার বড়ত্বের ব্যাপারে কুরআন সুন্নাহর বর্ণনা অনেক রয়েছে। একজন মুসলিম যখন তা ভাববে, তখন তার অন্তর কেঁপে উঠবে, হৃদয় স্পন্দিত হবে, মন বিনয়াবনত হবে, তার চেহারা মহা মহিম আল্লাহর সামনে ঝুকে যাবে, তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সর্বশ্রোতা ও সবজান্তা আল্লাহর জন্য নুয়ে পড়বে, পূর্ববর্তী – পরবর্তী। সকল সৃষ্টির রবের প্রতি ভয় বেড়ে যাবে এবং দাসত্বের মেহরাবে তার গর্দার সিজদায় লুটিয়ে পড়বে।

তার যে সমস্ত সুন্দর নাম ও উন্নত গুণাবলী আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তার মধ্যে রয়েছে,

العظيم المهيمن الجبار المتكبر القوي الفهار الكبير المتعال سبحانه و تعالى

তিনি মহান, প্রতাপশালী, পরাক্রশালী, বড়ত্বের অধিকারী, শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী, বড়, সুউচ্চ, পবিত্র, উন্নত..

وهو الحي الذي لا يموت والجن والإنس يموتون

তিনি চিরঞ্জীব , কখনো মরেন না। আর জিন ও মানুষ মৃত্যুবরণ মরে।

وهو القاهر فوق عباده ويسبح الرعد بحمده والملائكة من خيفته

তিনি নিজ বান্দাদের উপর ক্ষমতাশালী। বজ্র ও ফেরেশতাগণ তার ভয়ে তার প্রশংসা সহ তাসবীহ পাঠ করে।

عزیز ذو انتقام ، قيوم لا ينام ، وسع كل شيء علما ، يعلم خائنة الأعين وما تخفي الصدور

 তিনি পরাক্রমশালী , প্রতিশোধ গ্রহণকারী। চির প্রতিষ্ঠিত , কখনো ঘুমান না। সব জিনিসকে ইলমের মাধ্যমে পরিব্যপ্ত করে আছেন। তিনি চোখের গোপন খেয়ানত এবং অন্তরে যা আছে তাও জানেন।

  • গুনাহের কিছু কুফল:

ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: গুনাহের একটি কুফল হল, তা অন্তরে মহান আল্লাহর বড়ত্ব কমিয়ে দেয়।

বিশর আল হাফি বলেন, মানুষ যদি আল্লাহর বড়ত্বের ব্যাপারে চিন্তা করত, তাহলে কখনো তার বাধ্যতা করত না।

যার অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব হালকা হয়ে যায়, অতঃপর সে গুনাহ ও বিরুদ্ধাচরণে উদাসীন হয়ে যায়, সে যেন জেনে রাখে যে, সে নিজেরই ক্ষতি করছে। আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য বান্দা রয়েছে, যারা আল্লাহ তা’আলার আদেশের অবাধ্যতা করে। না এবং তাদেরকে যে আদেশ করা হয়, তারা তা ই পালন করে। যারা সংখ্যায়ও আমাদের থেকে অধিক এবং আমাদের থেকে বেশি ভয় ও ইবাদতও করে। তারা দিবারাত্রি আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে, কখনো বিরতি দেয় না।

  • নিজেকে আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনায় অভ্যস্ত কর; বান্দা যখন নিজের অন্তরকে নামাযের মধ্যে চিন্তা, অনুধাবন, আনুগত্য ও একাগ্রতায় রাখতে অভ্যস্ত করবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহর ভয়, ভালবাসা ও আল্লাহর নিকট যা আছে তার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। তার কোন অবস্থা ও কোন কাজ তার সৃষ্টিকর্তার ভয়শূণ্য হবে না।

ফলে শয়তান যখন তাকে কোন বিষয়ে প্ররোচিত করবে, কোন মন্দ বিষয়কে তার সামনে সুন্দর করে তুলবে , তখন সে এই কথা বলে তা থেকে মুক্ত থাকবে: “আমি সকল জগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভয় করি”।

  • যিকর দুই প্রকার: কাযী ইয়ায রহ: বলেন: আল্লাহর যিকর দুই প্রকার: অন্তরের যিকর, যবানের যিকর। অন্তর অন্তরের যিকর আবার দুই প্রকার:

 তার মধ্যে একটি হচ্ছে ; আল্লাহ তা’আলার বড়ত্ব, মহত্ব , ক্ষমতা, রাজত্ব এবং আসমানসমূহে ও যমীনে তার নিদর্শনবলীর ব্যাপারে চিন্তা করা। এটাই হল সর্বোন্নত ও সবচেয়ে বড় যিকর।

দ্বিতীয়টি হল; তার আদেশ – নিষেধ পালনের সময় অন্তরে তাকে স্মরণ করা; আর স্মরণ করার মাধ্যমে তিনি যা আদেশ করেছেন, তা পালন করা আর তিনি যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা এবং যেসকল বিষয় সন্দেহপূর্ণ তার নিকট থেমে যাওয়া।

আর শুধু যবানের যিকর: এটা হল দুর্বল যিকর। কিন্তু তথাপি এর মধ্যেও মহা ফযীলত রয়েছে, যা অসংখ্য হাদিসে এসেছে ।

আল্লাহর যিকরের ফল: আল্লাহ তা’আলার যিকর অন্তরে আল্লাহর বড়ত্বের উপলব্ধি সৃষ্টি করে এবং একথার অনুভূতি সৃষ্টি করে যে, তিনিই সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান, তিনি চিরঞ্জীব, চিরপ্রতিষ্ঠিত, আসমানসমূহ ও যমীনকে টলে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন এবং এগুলোর সংরক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না। আর তখনই যিকরকারী সফলতা ও প্রশান্তি অনুভব করবে, যে সফলতা ও প্রাপ্তির অনুভূতি তার অন্তর ও অঙ্গ – প্রত্যঙ্গকে ডেকে নিবে।

الذين آمنوا وتطمئن قلوبهم بذكر الله ألا بذكر الله تطمئن القلوب

“যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে প্রশান্ত হয়। শুনে রাখ, আল্লাহর যিকরে অন্তর প্রশান্ত হয়।”

তিনিই আল্লাহ, যিনি মহান। ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; কতগুলো আশ্চর্যজনক বিষয় হল:

তুমি আল্লাহকে জান , কিন্তু তাকে ভালবাসো না।

তুমি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর আওয়ায শুন, কিন্তু তাতে সাড়া দাও না।

তুমি আল্লাহর সাথে লেন – দেনের লাভ বুঝ, কিন্তু তারপরও অন্যের জন্য কাজ

কর।

 তুমি আল্লাহর ক্রোধের পরিমাণ জান, কিন্তু তারপরও তাতেই পতিত হও।

তুমি আল্লাহ তা’আলার অবাধ্যতার মধ্যে বিষন্নতার যন্ত্রণা অনুভব কর, তথাপি তুমি তার আনুগত্যের মাধ্যমে তার ঘনিষ্ঠতা অন্বেষণ কর না।

তুমি আল্লাহর কথা ব্যতীত অন্য কিছুতে লিপ্ত হওয়া ও তার আলোচনা করার মাঝে অন্তরের সংকীর্ণতা অনুভব কর, তথাপি তার স্মরণ ও তার সঙ্গে মুনাজাতের মাধ্যমে বক্ষ প্রশস্ত করার প্রতি আগ্রহী হও না।

তুমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর সাথে অন্তর সম্পর্কিত হলে শাস্তি অনুভব কর, কিন্তু তথাপি আল্লাহর দিকে মনোযোগী ও অনুরাগী হওয়ার মাধ্যমে তা থেকে বাঁচতে চাও না।

এর থেকে আরও আশ্চর্যজনক হল, তুমি জান , তাকে ছাড়া তোমার কোন উপায় নেই এবং তুমিই তার নিকট সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী, তথাপি তুমি তার থেকে বিমুখ আর যা তার থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করবে, তার দিকে ধাবিত।

  • সর্বাধিক আশ্চর্যজনক জিনিস: ফুযাইল ইবনে ইয়াযকে বলা হল: সর্বাধিক আশ্চর্যজনক জিনিস কি? তিনি বললেন; তা হল: তুমি আল্লাহকে চিন, কিন্তু তারপরও তার অবাধ্যতা কর।
  • প্রকৃত মুমিন; যার অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব বিচরণ করে। যার দেহ সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, যার অন্তর অনুগত হয় এবং মন বিনিত হয়। সে তার রুকুতে রবের সাথে নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলে; হে আল্লাহ তোমার জন্যই রুকু করলাম, তোমার প্রতিই ঈমান এনেছি এবং তোমার নিকট আত্মসমর্পণ করেছি। আমার কর্ণ, চক্ষু, মগজ, অস্তি, চর্বি সব তোমার সামনে নত হয়েছে।

এ কারণেই ইমাম আহমাদ রহ: বলেন; তুমি যদি তোমার অন্তর পরিশুদ্ধ করে নিতে পার, তখন তুমি আর কাউকে ভয় করবে না।

 ইজুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালাম জনৈক তাগুত বাদশার সামনে দন্ডায়মান। তার সাথে কঠিনভাবে কথা বলছেন। তারপর তিনি প্রত্যাগমন করলেন, তখন লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করল : হে ইমাম ! আপনি তাকে ভয় করলেন না? তিনি বললেন: আমি আল্লাহর বড়ত্বের কথা চিন্তা করছিলাম, এ কারণে সে আমার নিকট বিড়ালের ন্যায় হয়ে গেল।

 কিন্তু এখন দেখি, অনেক মানুষ অফিসার, আইন , প্রশাসন ইত্যাদিকে আল্লাহর থেকে অধিক ভয় করে। কোন সন্দেহ নেই, এটা তার অন্তরের সমস্যা। আর জ্ঞানী ব্যক্তি স্বীয় মনের সাথে জেরা করে।

  • মুসলিমের জীবনে আল্লাহর বড়ত্ব অনুধাবনের গুরুত্ব: যে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের প্রতি দৃষ্টি দিবে, সে তার সম্মানিত বিষয়সমূহকে সম্মান করবে এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন করবে, তার আদেশ – নিষেধকে বড় মনে করবে এবং তার জন্য তার একটি ছোট অবাধ্যতাও কঠিন মনে হবে। সে এমন ভয় করবে, যেন একটি আস্ত পাহাড় তার উপর পতিত হবে।

আমরা যদি আল্লাহর বড়ত্ব অনুধাবন করি, তার প্রতি যে দাসত্ব, আনুগত্য ও বিনয় প্রদর্শন করা আবশ্যক তা উপলব্ধি করি এবং তার যথাযথ হক বুঝতে সক্ষম হই, তাহলে আমরা নিজেদের মন থেকে বেশি বেশি হিসাব নিতে পারবো , আমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতরাজী ও আমাদের পক্ষ থেকে তার অবাধ্যতার পরিমাণ মিলিয়ে দেখতে পারবো এবং আমাদের প্রতি তার হক ও আমরা আমাদের আখেরাতের জন্য কি অগ্রে প্রেরণ করেছি, তাও মিলিয়ে দেখতে পারবো।

  • বড়ত্ব আল্লাহর একটি গুণ: ইমাম ইসহানী বলেন: বড়ত্ব আল্লাহর একটি গুণ, কোন সৃষ্টি এর উপযুক্ত নয়।

তবে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির মাঝেও এক প্রকার বড়ত্ব সৃষ্টি করেছেন, এ কারণে সৃষ্টির কেউ কেউ অন্যকে বড় মনে করে থাকে।

যেমন মানুষের মধ্যে কেউ সম্পদকে বড় মনে করে।

কেউ সম্মানকে বড় মনে করে।

কেউ ইলমকে বড় মনে করে।

কেউ ক্ষমতাকে বড় মনে করে।

কেউ পদকে বড় মনে করে।

এভাবে প্রতিটি সৃষ্টিকেই এক অর্থে সম্মান করা হয়। আরেক অর্থে করা হয় না।

 আর আল্লাহ তা’আলা সর্ববস্থায়ই বড় বা সম্মানিত। সুতরাং যে আল্লাহর বড়ত্বের হক বুঝতে পেরেছে, তার উচিত, এমন কথা না বলা, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন, এমন কোন গুনাহয় লিপ্ত না হওয়া, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন না। কারণ প্রতিটি মানুষ যা অর্জন করেছে, তিনি তার হিসাব গ্রহণ করবেন।

مَا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ

মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত

 

ইমাম ইবনে কাসীর রহ: বলেন; অর্থাৎ আদম সন্তান যত কথা বলে, তার প্রতিটি কথা পর্যক্ষেণকারী সদা উপস্থিত ফেরেশতা রয়েছে, যে প্রতিটি কথা লিখে রাখে, একটি শব্দ বা একটি হরকতও ছাড়ে না। অনুরূপ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ كِرَامًا كَاتِبِينَ يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ

“নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে প্রহরীগণ নিযুক্ত আছে। সম্মানিত লেখকগণ। যারা জানে, তোমরা যা কর।”

  • অন্তর ঠিক হয় যবান ঠিক হওয়ার দ্বারা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: বান্দার ঈমান ঠিক হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তর ঠিক না হয় আর বান্দার অন্তর ঠিক হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার যবান ঠিক না হয়। (বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ)
  • যবানকে উপকারী কথায় ব্যস্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা; যবানকে আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত রাখ, তার আনুগত্য, তাসবীহ, হামদ, তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) ও ইস্তেগফারে ব্যস্ত রাখ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মজলিসে ৭০ বারের অধিক আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করতেন। আমরা কি আমাদের কোন মজলিসে একবারও আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করি?
  • তুমি কত পুরস্কার ও কল্যাণ নষ্ট করে দিলে; হে আল্লাহর বান্দা! তুমি একটি মজলিসে বসে কথাবার্তা বলছো, কিন্তু তুমি জান না, তুমি কি হারাচ্ছো। তুমি যদি যিকর ও ইস্তেগফারে মনোনিবেশ করতে তাহলে সেটা তোমার জন্য কতই না। ভাল হত। এতে তোমার হয়ত দুই মিনিট বা তিন মিনিট সময় ব্যয় হত। তুমি যদি এই দুনিয়ায় একটি খেজুর বৃক্ষ রোপন করতে চাইতে, তাহলে তাতে তুমি কত চেষ্টা ও সময় ব্যয় করতে! পানি দিতে, রক্ষণাবেক্ষণ করতে, পরিচর্যা করতে। এতে ফল দিতে হয়ত এক বছর লেগে যেত। আবার কখনো ফল না দেওয়ার সম্ভাবনাও থাকত। কিন্তু তিন মিনিটের মধ্যে তুমি জান্নাতে একটি খেজুর বৃক্ষ লাভ করতে পারতে, যার কাল্ড হত স্বর্ণের। তুমি কি কখনো কোন মজলিসে একশত বার সুহবানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি বলে দেখেছো? তোমার পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগত না।

হে ভাই! তুমি যবানের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া থেকে সাবধান হও। কারণ এটি হল একটি হিংস্র ক্ষতিকর জন্তুর ন্যায়, তুমি যার প্রথম শিকার।

হে ভাই! যবানের ব্যাপারে উদাসীন হওয়া থেকে সাবধান হও। কারণ তোমার অঙ্গ – প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে এটাই তোমার বিরুদ্ধে সর্বাধিক অপরাধ করে থাক। তুমি তোমার আমলনামায় কিয়মাতের দিন যত বদ আমল দেখতে পাবে, তার অধিকাংশই তোমার যবানই তোমার বিরুদ্ধে লিখিয়েছে। নবী ﷺ বলেছেন: মানুষের মুখের ফসলগুলোই মানুষকে জাহান্নামে উল্টোমুখী করে বা নাকের উপর করে নিক্ষেপ করে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী রহ:)

একারণেই নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন হয়ত ভাল কথা বলে, নয়ত চুপ থাকে। (বুখারী মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা: বলেন; দীর্ঘ সময় বন্দী করে রাখার ক্ষেত্রে তোমার যবান থেকে উপযুক্ত জিনিস আর কিছু নেই।

  • ভদ্রতা কি?

আহনাফ ইবনে কায়সকে ভদ্রতা ও মানবতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন: সত্যকথন, মুসলিম ভাইদের সাথে সদাচরণ ও সর্বস্থানে আল্লাহর স্মরণ।

  • প্রাজ্ঞবানী: অনেক কথা মুখ দিয়ে চলে আসে, আর তার কারণে মানুষ ধ্বংস হয়।
  • প্রকৃত মুসলিম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: মুসলিম সে ই, যার যবান ও হাত থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে।
  • সবচেয়ে কঠিন আমল: দাউদ আত – তায়ী একদা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল আযীযকে বলেন; তুমি কি জান না, যবানের হেফাজত করাই সবচেয়ে কঠিন ও সর্বশ্রেষ্ঠ আমল? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের কি অবস্থা হবে?
  • যবানের ব্যাপারে সালাফদের অবস্থা: হাসান বসরী রহ: বলেন: যবান হল, দেহের নিয়ন্ত্রক। যখন তা অঙ্গ – প্রত্যঙ্গের উপর কোন অপরাধ করে, তখন সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপরাধে লিপ্ত হয়। যবান যখন ভাল থাকে, তখন সমস্ত দেহও ভাল থাকে। হাসান ইবনে সালিহ বলেন; আমি তাকওয়ার অনুসন্ধান করলাম। তাতে যবানের চেয়ে কম আর কিছুর মধ্যে পেলাম না।

 ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, তিনি আবু বকর রা: এর নিকট গেলেন। তিনি দেখলেন, আবু বকর রা: তার জিহ্বা টেনে ধরেছেন। ওমর রা: বললেন: থামুন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! আবু বকর রা: বললেন: এটা আমাকে অনেক ঘাটে অবতরণ করিয়েছে! কে বললেন একথা?! তিনি হলেন নবী রাসূলদের পরে সর্বোত্তম ব্যক্তি। আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহু।

 তাউস ইবনে কাইসান দীর্ঘ নিরবতার ব্যাপারে ওযর পেশ করতেন। তিনি বলতেন আমি আমার যবানকে পরীক্ষা করেছি, আমি দেখলাম সে হচ্ছে দুগ্ধপোষ্য শিশুর ন্যায় দুষ্ট ।

  • কিভাবে তুমি তোমার দোষ – ত্রুটি গোপন করবে? কায়েস ইবনে সায়িদা ও আকসাম ইবনে সাইফী এক জায়গায় একত্রিত হলেন। একজন আরেকজনকে বললেন: আদম সন্তানের মধ্যে কি পরিমাণ দোষ পেলে? অপরজন বলল: তা অগণিত, আমি ৮ হাজার গুনেছি। তারপর একটি পদ্ধতি পেয়েছি, যেটি অবলম্বন করলে তুমি তোমর সব দোষ গোপন করতে পারবে। প্রথমজন বললেন; তা কি? অপরজন বললেন; তা হচ্ছে যবানের হেফাজত করা।
  • যবানের হেফাজত মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য: জনৈক তাবিয়ী বলেন; আমি আতা ইবনে আবি রাবাহের সাথে ত্রিশ বছর হেরেমে থেকেছি। এ সময় তিনি কখনো আল্লাহ। ও তার আয়াতসমূহের আলোচনা, সৎ কাজের আদেশ, অসৎকাজে বাঁধা প্রদান ও অতি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কোন কথা বলেননি। আমরা তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: তোমরা কেন বুঝ না! তোমরা কি ভুলে গেছ, তোমাদের উপর ফেরেশতা নিযুক্ত আছে, যারা তোমাদের প্রতিটি শ্বাস – প্রশ্বাসও সংরক্ষণ করেন এবং প্রতিটি কথাবার্তা লিখে রাখেন। এর দ্বারা আল্লাহর সামনে তোমাদেরকে হিসাবের সম্মুখীন করবে।
  • যে সমস্ত বিষয় থেকে যবানকে হেফাজত করা হবে: অভিশম্পাত দেওয়া, অশ্লীল ও লাগামহীন কথাবার্তা বলা, বেশি বেশি আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক হাসি – ঠাট্টা করা, আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক অনর্থক কথাবার্তা অধিক পরিমাণে বলা এবং গীবত, চোগলখোরী ও ব্যঙ্গ – বিদ্রুপ করা থেকে যবানকে হেফাজত করতে হবে। বিশেষত; আল্লাহর আয়াত, কিতাবসমূহ, নবী – রাসূল, উলামা, তালিবুল ইলম, দায়ি ও মুজাহিদদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করা থেকে হেফাজত করতে হবে। কারণ এগুলো নেফাকির আলামত।
  • কিভাবে যবানকে হেফাজত করা যাবে?

১. যবানকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত করা এবং যবানকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত করলে আল্লাহর নিকট কি পরিমাণ বিনিময় রয়েছে, তা অনুধাবন করা। কারণ উত্তম কথা তোমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। কারণ বিশুদ্ধ হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত, তিনি বলেন: বান্দা এক টুকরো খেজুর ও একটি উত্তম কথার দ্বারা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়।

২. সালাফে সালিহের জীবনী পাঠ : তাতে উত্তম নমুনা রয়েছে, যা অর্থবহ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

৩. আল্লাহর নিকট দু’আ করবে, যেন আল্লাহ তোমার যাবানকে অনর্থক কথা থেকে হেফাজত করেন এবং সঠিক কথা বলার তাওফীক দান করেন। কারণ এর দ্বারা আমল সংশোধন হবে এবং গুনাহ মাফ হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আমল সংশোধন করে দিবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।”

হাদিসে বর্ণিত দু’আর মধ্যে রয়েছে (اللهم اهدني و سددني) “হে আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দান কর এবং আমার কথা ও কাজ সঠিক করে দাও।”

 এই বলে আল্লাহর নিকট দু’আ করবে : হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এমন যবান চাই, যা তোমাকে আমার প্রতি সন্তুষ্ট করবে এবং এমন যবান থেকে আশ্রয় চাই, যা তমাকে আমার প্রতি ক্রোধান্বিত করবে।

  • কথার মধ্যে দু’টি বড় বিপদ রয়েছে: ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: যবানের মধ্যে দু’টি বড় বিপদ রয়েছে, যার একটি থেকে মুক্তি পেলেই আরেকটি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। একটি হল: কথা বলার বিপদ, আরেকটি হল; চুপ থাকার বিপদ। আপন আপন সময়ে প্রত্যেকটিই অপরটি থেকে বড় বিপদ হতে পারে।

যেমন যে হক কথা বলা থেকে চুপ থাকে, সে হল বোবা শয়তান, আল্লাহর অবাধ্য, মানুষকে প্রদর্শনকারী, শৈথিল্যকারী, (যদি নিজের উপর আশংকা থাকে)। আর যে ভ্রান্ত কথা বলে সে হল, বাকশীল শয়তান, আল্লাহর অবাধ্য। বেশিরভাগ মানুষই কথা বলা ও চুপ থাকার ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থা থেকে বিচ্যুত। মধ্যমপন্থীরাই হচ্ছে সরল সঠিক পথের অনুসারী। যারা নিজেদের যবানকে বাতিল কথা থেকে হেফাজত করে আর যা পরকালে উপকারী হবে, তা বলে।

যুহদ বা দুনিয়া বিমুখতা

আল্লাহ তা’আলা বলেন: (قُلْ مَتَاعُ الدَّنْيَا قَلِيلٌ وَالآخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَنِ اتَّقَى)

“বল, দুনিয়ার ভোগ – সম্ভার তুচ্ছ। যারা আল্লাহকে ভয় করে, তাদের জন্য আখেরাতই উত্তম।”

ইমাম বাগাবী রহ: বলেন: অর্থাৎ হে মুহাম্মদ! তুমি বল, তার উপকারীতা ও তার দ্বারা সুবিধা গ্রহণ তুচ্ছ ও নগন্য। যারা শিরক ও রাসূলের অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকে তাদের জন্য আখিরাতই উত্তম ও শ্রেষ্ঠ।

  • যুহ্দ এর সংজ্ঞা: যুহদ হল, দুনিয়ার প্রতি পতনশীলতার দৃষ্টি দেওয়া, ফলে তা তুচ্ছ মনে হওয়া এবং তা থেকে বিমুখ থাকা সহজ হওয়া।

ইমাম আহমাদ রহ: বলেন; যুহদ হল স্বল্প আশা করা।

তার থেকে এরূপ আরেকটি বর্ণনা রয়েছে যে, যুহদ হল: দুনিয়া আসার কারণে আনন্দিত না হওয়া এবং চলে যাওয়ার কারণেও দু : খিত না হওয়া। তাকে জিজ্ঞেস করা হল; এক ব্যক্তির নিকট এক হাজার দিনার আছে, সে কি যাহেদ (দুনিয়া বিমুখ)? তিনি বললেন: হ্যাঁ, হতে পারে, শর্ত হল, তা বৃদ্ধি পেলেও সেআনন্দিত হতে হবে না এবং কমে গেলেও দুঃখিত হবে না।

আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে যুহ্দ (দুনিয়া বিমুখীতা) অবলম্বন করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। তার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, তার প্রশংসা করেছেন এবং তার বিপরীত অবস্থাকে মন্দ বলেছেন। দুনিয়ার প্রতি আসক্তি আর আখেরাত থেকে বিমুখ হওয়াকে নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন: بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى “ আসলে তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ আখেরাতই শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী।”

রাসূলুল্লাহ ﷺ  বলেন: দুনিয়া যদি আল্লাহর নিকট মাছির পাখা সমপরিমাণও হত, তাহলে আল্লাহ তা’আলা কোন কাফেরকে দুনিয়ার এক ফোটা পানিও পান করাতেন। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

  • গভীর প্রজ্ঞাবনী: ইমাম আহমাদ রহ: বলেন; দুনিয়ার কমটা যথেষ্ট হয়, কিন্তু বেশিটা যথেষ্ট হয় না।
  • যুহদের হাকীকত: যুহদ শুধু দরীদ্রতা নয় বা এমনটাও নয় যে, তোমার থেকে দুনিয়া ফিরিয়ে রাখা হল, ফলে তুমি ফিরে থাকলে; বরং যুব্দ হল; তা তোমার অন্তরে মাল থাকবে না, যদিও তোমার হাতে মাল থাকে।
  • তুমি কিভাবে দুনিয়া বিমুখ হবে? তার কয়েকটি পন্থা:

১. বান্দা নিজের কাছে যা আছে, তার তুলনায় আল্লাহর নিকট যা আছে তার উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়া। আর এমন অবস্থা তৈরী হবে আখেরাতের প্রতি সত্যিকার ও নিশ্চিত বিশ্বাসের দ্বারা। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বান্দাদের রিযিকের যিম্মাদারী নিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا “যমীনে যত প্রাণী আছে, সকলের রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর।”

২. বান্দার অবস্থা এমন হওয়া যে, যখন তার কোন বিপদ আসে, যেমন সম্পদ, সন্তান বা অন্য কিছু চলে যায়, তখন সে দুনিয়ায় যা কিছু চলে গেছে, তার থেকে আখেরাতে যে বিনিময় স্থায়ীভাবে লাভ করবে, তার প্রতি অধিক আগ্রহী হবে। আর এটাও পরিপূর্ণ ইয়াকীনের দ্বারাই সৃষ্টি হয়।

৩. বান্দার নিকট হকের ব্যাপারে তার প্রশংসাকারী আর নিন্দাকারী সমান হয়ে যাওয়া: এটা দুনিয়া বিমুখতা, তাকে তুচ্ছ মনে করা ও তার প্রতি কম আগ্রহ থাকার একটি প্রমাণ। কারণ যার নিকট দুনিয়া বড় হবে, সে প্রশংসাকে ভালবাসবে এবং নিন্দাকে অপছন্দ করবে। ফলে এটা তাকে নিন্দার ভয়ে অনেক হক বর্জন করতে এবং প্রশংসার আশায় অনেক অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করবে।

সুতরাং যার নিকট তার প্রশংসাকারী ও নিন্দাকারী সমান হয়ে যাবে, এটাই তার অন্তর থেকে মাখলুকের বড়ত্ব দূর হয়ে যাওয়া এবং আল্লাহ ও যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি আছে তার ভালবাসা দৃঢ় হওয়ার প্রমাণ বহন করবে।

  • দুনিয়ার স্বাদ ও আখেরাতের স্বাদের মাঝে পার্থক্য; ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন: আখেরাতের স্বাদ বড় ও স্থায়ী আর দুনিয়ার স্বাদ ছোট ও সাময়িক। এমনিভাবে দুনিয়ার কষ্ট ও আখেরাতের কষ্টও এমনই। আর এর ভিত্তি হল ঈমান ও ইয়াকীনের উপর। তাই যখন ঈমান শক্তিশালী হয়ে যাবে, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে ফেলবে, তখন সে উন্নত স্বাদকে নিদ্রার উপর প্রাধান্য দিবে এবং কঠিন যন্ত্রণার পরিবর্তে লঘু যন্ত্রণা সহ্য করে নিবে।

قَالُوا لَن نُّؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا

“তারা বলল, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সেই সত্তার কসম! আমাদের নিকট যে উজ্জল নিদর্শনাবলী এসেছে, তার উপর আমরা কিছুতেই তোমাকে প্রাধান্য দিতে পারবো না। সুতরাং তুমি যা করতে চাও কর, তুমি যাই কর না কেন তা এই পার্থিব জীবনেই হবে।”

  • যুহদই স্বস্তি: জনৈক দুনিয়াবিমূখ সালাফ বলতেন: দুনিয়া বিমুখতা মন ও দেহের স্বস্তি। আর দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ, চিন্তা ও পেরেশানী।
  • দু’টি একত্রিত হয় না: বলা হয়ে থাকে: আল্লাহ তা’আলা দাউদ আঃ এর নিকট ওহী পাঠালেন যে, আমি অন্তরসমূহের উপর হারাম করেছি যে, একই অন্তরে আমার ভালবাসা আবার অন্যদের ভালবাসা একত্রিত হতে পারবে না। হে দাউদ! তুমি যদি আমাকে ভালবাসা, তাহলে অন্তর থেকে দুনিয়ার ভালবাসা দূর করে ফেল। কারণ আমার ভালবাসা আর দুনিয়ার ভালবাসা এক সাথে জমা হয় না। হে দাউদ! যারা আমাকে ভালবাসে, তারা সেই সময় আমার সামনে দাড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ে, যখন অলস লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে এবং তারা নির্জনে আমাকে স্মরণ করে, যখন গাফেলরা বিভোর থাকে।
  • দুনিয়ার বিবরণ: আলী রা: কে বলা হল: আমাদের জন্য দুনিয়ার বর্ণনা তুলে ধরুন। তিনি বললেন: সংক্ষেপে না দীর্ঘ করবো? তারা বলল; সংক্ষেপে। তিনি বললেন: দুনিয়ার হালালগুলোর হিসাব দিতে হবে আর হারামগুলোর জন্য আযাব হবে।
  • যুহদের সুফল:

১. আল্লাহর সাক্ষাতের প্রতি আগ্রহ।

২. দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত না হওয়া এবং তার জন্য অনুতাপ না থাকা।

৩. নেতৃত্ব ও পদের লোভ থেকে মুসলিমদের সুরক্ষা।

৪. মানুষকে দেখানো ও খ্যাতি অর্জনের ফেৎনা থেকে মুসলিমদের সুরক্ষা, যা আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে মন ফিরিয়ে রাখে।

৫. নারীদের ফেৎনা থেকে সুরক্ষা।

৬. হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা এবং এমন সন্দেহ ও সংশয়পূর্ণ জিনিস থেকে দূরে থাকতে সহায়ক, যা হারামে পৌঁছে দেয়।

৭. ফুযায়ল ইবনে ইয়ায বলেন: তোমাদের অন্তরসমূহের জন্য এটা অসম্ভব যে, দুনিয়া বিমুখ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ পাবে।

  • কিভাবে আখেরাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে? ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন; দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আখেরাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে না। তাই দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয় ঈমানের সমস্যার কারণে, অথবা জ্ঞানের সমস্যার কারণে, অথবা উভয়ের যৌথ সমস্যার কারণে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ দুনিয়াকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করেছেন। তারা তার থেকে তাদের অন্তর ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাকে এমনভাবে পরিত্যাগ করেছিলেন, যে তার প্রতি আর ঝুকেননি। দুনিয়াকে জেলখালা মনে করেছেন; জান্নাত নয়। তাই তারা দুনিয়ার ব্যাপারে প্রকৃত যুহদ অবলম্বন করেছিলেন। তারা চাইলে দুনিয়ার সকল প্রিয় বস্তুই লাভ করতে পারতেন, প্রতিটি আগ্রহই পুরা করতে পারতেন, কিন্তু তারা বিশ্বাস করতেন: এটা হল কোন রকমে অতিক্রম করার জায়গা; আনন্দের জায়গা নয়। এটা হল, গ্রীস্মের মেঘের ন্যায়, যা সামান্যতেই বৃষ্টিপাত করে। এক উদ্ভট স্বপ্নের ন্যায়, যা এখনো দেখা শেষ হয়নি; অমনি সফরের ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হল।
  • যুহদ অবলম্বনে সহায়ক বিষয়সমূহ:

– দুনিয়ার দ্রুত পতন, তার ধ্বংসশীলতা, অসম্পূর্ণতা ও হীনতার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া এবং তাতে ভীড় জমানোর মধ্যে যে দুঃখ, কষ্ট ও দুর্ভোগ রয়েছে তা চিন্তা করা।

আখেরাতের আগমন, তার স্থায়িত্ব ও তাতে যে সমস্ত নেয়ামত রয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা চিন্তা করা।

 মৃত্যু ও পরকালের কথা বেশি বেশি স্মরণ করা।

– আখেরাতের জন্য মুক্ত হওয়া, আল্লাহর ইবাদতের দিকে মনোযোগী হওয়া এবং সময়গুলোকে যিকর ও কুরআন তিলাওয়াতের দ্বারা আবাদ করা।

– দ্বীনি স্বার্থকে দুনিয়াবী স্বার্থের উপর প্রাধান্য দেওয়া।

– খরচ  করা, দান করা এবং অধিক পরিমাণে সদকা করা।

– দুনিয়াদারদের মজলিস ত্যাগ করা এবং আখেরাতকামীদের মজলিসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।

যাহেদদের ঘটনাবলী পাঠ  করা, বিশেষত: রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীদের জীবনী।

দুনিয়াতে যুহদ অবলম্বন কোন নফল কাজ নয়, বরং এটা যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত কামনা করে, তাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যকীয় বিষয়। তার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ অবলম্বন করেছিলেন। এটাই আল্লাহর ভালাবাসা এবং মানুষের ভালাবাসা লাভের একমাত্র পথ। হাদিসের মধ্যে এসেছে : জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যা আমি করলে আল্লাহও আমাকে ভালবাসবে এবং মানুষও ভালবাসবে। তিনি বললেন; দুনিয়া বিমুখতা অবলম্বন কর; তাহলে তোমাকে আল্লাহ ভালবাসবেন। আর মানুষের নিকট যা আছে, সেগুলোর ব্যাপারে বিমুখতা অবলম্বন কর; তাহলে তোমাকে মানুষ ভালবাসবে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে মাজাহ)

  • আল্লাহর সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি:

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)وَاتَّقُواْ يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ(

 “সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন করানো হবে। অতঃপর প্রত্যেককে সে যা উপার্জন করেছে, তা বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তাদের প্রতি কোনরূপ জুলুম করা হবে না।”

রাসূল ﷺ বলেন: যে আল্লাহর সাক্ষাৎকে ভালবাসে, আল্লাহও তাকে ভালবাসেন। আর যে আল্লাহর সাক্ষাৎকে অপছন্দ করে, আল্লাহও তাকে অপছন্দ করেন। আয়েশা রা: বা রাসূলের কোন একজন স্ত্রী বললেন; আমরা তো মৃত্যুকে অপছন্দ করি। তিনি বললেন এটা নয়। বরং বিষয়টা হল: যখন মুমিনের মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার পক্ষ থেকে সম্মান লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার নিকট তার সামনে যা আছে, তার থেকে অধিক প্রিয় কিছু থাকে না। তাই সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎকে ভালবাসে, ফলে আল্লাহও তার সাক্ষাৎকে ভালবাসেন। আর কাফেরের যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তাকে আযাব। ও শাস্তির সংবাদ শোনানো হয়। তখন তার নিকট তার সামনে যা আছে, তার থেকে অপছন্দনীয় আর কিছু থাকে না। ফলে সে আল্লাহর সাক্ষাৎকে অপছন্দ করে, ফলে আল্লাহও তার সাক্ষাৎকে অপছন্দ করেন। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী )

আবুদ দারদা রা:বলেন;আমি আমার প্রভুর সাক্ষাতের আশায় মৃত্যুকে ভালবাসি।

আবু আম্বাসা আলখাওলানী বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা এই ছিল যে, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাদের নিকট মধুর চেয়েও প্রিয় ছিল।

ঘনিষ্ঠ ও অপরিচিত; অনুগত বান্দা স্বীয় রবের ঘনিষ্ঠ। সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকে ভালবাসে, আল্লাহও তার সঙ্গে সাক্ষাৎকে ভালবাসেন।

আর গুনাহগারের মাঝে ও তার মনিবের সাথে থাকে দূরত্ব। গুনাহের দূরত্ব। সে তার প্রভুর সাক্ষাৎকে অপছন্দ করে। আর তার তো এমনটা হবেই। যুননুন রহ: বলেন; প্রত্যেক অনুগতই ঘনিষ্ট আর প্রত্যেক গুনাহগারই অপরিচিত।

  • আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি কিভাবে হবে?

১. আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতকে ভালবাসা। কারণ এমনটা তো কল্পনা করা যায় না। যে, অন্তর কোন প্রিয়জনকে ভালবাসা, আর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ও তার দর্শনকে ভালবাসবে না।

২. বিভিন্ন প্রকার কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করা। ধৈর্য হল ভালবাসার পথের গুরুত্বপূর্ণ স্তর। প্রেমিকদের জন্য এটা জরুরী।

৩. আল্লাহর সঙ্গে নির্জনতা ও মুনাজাত এবং তার কিতাবের তিলাওয়াত হবে তার প্রিয় জিনিস। তাই সর্বদা তাহাজ্জুদ পড়বে। রাতের নিরবতা ও সকল প্রকার বাঁধামুক্ত অবসর সময়গুলোকে গনিমত মনে করবে। কারণ আনন্দ লাভের সর্বনিম্ন স্তরটাই হল প্রিয়জনের সঙ্গে নির্জনে আলাপ করা। তাই যার নিকট ঘুম ও কথাবার্তায় লিপ্ত থাকা রাতের মুনাজাতের চেয়ে অধিক মজাদার হবে, তার ভালবাসা কিভাবে বিশুদ্ধ হতে পারে? কারণ প্রেমিক তার প্রেমাস্পদের খেদমত ও আনুগত্যে থাকাতেই অধিক স্বাদ অনুভব করে। আর যখন ভালবাসা শক্তিশালী হবে, তখন তার আনুগত্য ও খেদমতও শক্তিশালী হবে।

৪. তার উপর অন্য কোন প্রেমাস্পদকে প্রাধান্য না দেওয়া: আল্লাহ ও তার রাসূলই তার নিকট অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হওয়া। বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম বলেন; আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি ওমর রা: এর হাত ধরা। ওমর রা: বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয়ই আপনি আমার নিকট আমার প্রাণ ব্যতীত আর সব কিছু থেকে অধিক প্রিয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: চলবে না, আল্লাহর শপথ! যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমার নিকট তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় না হব। এবার ওমর রা: বললেন; এখন আপনি আমার নিকট আমার প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এবার ঠিক আছে ওমর! তাহলে আল্লাহকে ভালবাসার একটি আলামত হল: বান্দা কৃর্তক আল্লাহর উপর কোন জিনিসকে প্রাধান্য না দেওয়া। না নিজের সন্তান বা পিতামাতাকে, না অন্য কোন মানুষকে এবং না নিজ প্রবৃত্তিকে। যে আল্লাহর উপর তার অন্য কোন প্রিয় জিনিসকে প্রাধান্য দিল, তার অন্তর রোগী।

৫. সর্বদা আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকা। তার যবান তা থেকে বিরতি না দেওয়া এবং তার অন্তর কখনো তা থেকে মুক্ত না হওয়া। কারণ যে কোন জিনিসকে ভালবাসে, অনিবার্যভাবেই সে তার ও তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহের আলোচনা বেশি বেশি করবে। ফলে তার ইবাদত, তার কালাম, তার স্মরণ, তার আনুগত্য ও তার ওলীদেরকে সে ভালবাসবে।

৬. আল্লাহর কালামকে ভালবাসা। তাই যখন তুমি তোমার নিজের মাঝে বা অন্য কারো মাঝে আল্লাহর ভালবাসা আছে কি না তা পরিক্ষা করতে চাইবে, তখন দেখবে, তার অন্তরে কুরআনের ভালবাসা আছে কিনা। কারণ এটা সকলে জানা কথা যে, যে কোন প্রিয়জনকে ভালবাসে, তার নিকট তার কথাই সর্বাধিক প্রিয় হয়।

৭. আল্লাহর যে সকল ইবাদত ও যিকর তার থেকে ছুটে গেছে, তার জন্য আফসোস করা: তাই দেখবে, তার নিকট সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হবে, কোন একটি সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া। তাই যখন তার থেকে কোন একটি সময় চলে যায়, তখন সে তার জন্য এত ব্যথিত হয়, যা সম্পদের লোভী ব্যক্তির স্বীয় সম্পদ হাতছাড়া হওয়া, চুরি হওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাথা থেকে অধিক। সে দ্রুত এর কাযা করে নেয়, সুযোগ হওয়ার সাথে সাথেই।

  • তারা নিফাকের আশংকা করতেন : আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا(

“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি তাদের পক্ষে কোন সাহায্যকারী পাবে না।”

আল্লামা সা’দী বলেন, এখানে আল্লাহ মুনাফিকদের পরিণতি বর্ণনা করছেন তারা সর্বনিকৃষ্ট আযাব ও শাস্তিতে থাকবে। তারা থাকবে সমস্ত কাফেরদের নিম্ন স্তরে। কারণ তারা আল্লাহর সাথে কুফরী ও রাসূলের দুশমনীর ক্ষেত্রে তো তাদের মত, আর তার উপর অতিরিক্ত , তারা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত করেছে এবং মুনিদের বিরুদ্ধে। এমনভাবে বিভিন্ন প্রকার শত্রুতা করার সুযোগ পেয়েছে, যা অনুভব ও উপলব্ধিও করা যায় না। আর এই কপটচারিতার দ্বারা তারা নিজেদের উপর ইসলামের বিধান কার্যকর করাতে সমর্থ হয়েছে এবং এমন বিষয়ালীর অধিকারী হয়েছে, যার অধিকারী তারা ছিল না।

একারণে এবং এধরণের অন্যান্য কারণে তার সবচেয়ে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হয়েছে। তাদের আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তির কোন পথ নেই এবং তাদের এমন কোন সাহায্যকারীও নেই, যে তাদের থেকে তার আযাবকে প্রতিহত করবে। একথা সকল মুনাফিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে যাদেরকে আল্লাহ মন্দ কর্ম থেকে তাওবা করার তাওফীক দানের মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন তারা ব্যতীত।

 বুখারী ও মুসলিম রহ: থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: তিনটি জিনিস যার মধ্যে থাকবে, সে হবে কাট্টা মুনাফিক। আর যার মধ্যে এর কোনওটি থাকবে, তার মধ্যে নিফাকির একটি বৈশিষ্ট্য আছে বলে ধর্তব্য হবে, যতক্ষণ না সে তা পরিহার করে। উক্ত বৈশিষ্টগুলো হল: সে যখন কথা বলবে, মিথ্যা বলবে, ওয়াদা করলে তার ব্যতিক্রম করবে, প্রতিশ্রুতি দিলে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ঝগড়া করলে পাপাচার করবে।

  • নিফাকের কয়েকটি আলামত :

– মিথা কথা বলা, আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদার বরখেলাফ করা, মিথ্যা কসম কাটা এবং প্রতিশ্রুতি দিলে গাদ্দারি করা।

– আরেকটি হল ইসলামের মূল ও প্রধান বিষয়, তথা কুরআন – সুন্নাহ নিয়ে ঠাট্টা করা এবং নেককার ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে ঠাট্টা করা।

– নামাযে অলসতা করা। মসজিদের প্রতিবেশি হওয়া সত্ত্বেও মসজিদে না। যাওয়া। আর সেখানে নামায পড়ার চেয়ে বড় মুনাফিকি আর কি আছে?!

– মানুষকে নিজের আমল দেখানো এবং খ্যাতি কামনা করা।

– আল্লাহর যিকর কম করা।

– আল্লাহর ক্রোধের বিষয়সমূহকে পছন্দ করা।

  • আরবি ব্যতীত অন্য ভাষা শিখে গর্ববোধ করা: শায়খুল ইসলাম বলেন; যে আরবি ব্যতীত অন্য কোন ভাষা শিখে, তাতে কোন লাভ নেই। গর্ব করা, না করার ভিত্তি হল আরবি ভাষা। তাই এটা নেফাকির আলামত। এটা ঈমানের ত্রুটি ও ঈমানকে কম মূল্যায়ন করার ফলে সৃষ্টি হয়।
  • জিহাদ পরিত্যাগ করা নিফাকির আলামত: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন; যে জিহাদ না করে বা জিহাদের সংকল্পও না করে মৃত্যুবরণ করল, সে নিফাকির একটি শাখাসহ মৃত্যুবরণ করল। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

ইমাম নববী রহ: বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল: যারা এমনটা করে, তারা এই বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে জিহাদ হতে পশ্চাতে অবস্থানকারী মুনাফিকদের মত। কারণ জিহাদ পরিত্যাগ করা নেফাকির একটি অংশ ।

  • আরেকটি নেফাক হল; নামাযকে সঠিক সময় থেকে বিলম্ব করে পড়া: যারা নামাযকে সঠিক সময় থেকে বিলম্ব করে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ধ্বংস ও কঠিন শাস্তির ধমকি দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:( فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ) “তাই দুর্ভোগ ওই সমস্ত নামাযীদের, যারা তাদের নামাযে অলসতা করে।

অর্থাৎ সঠিক সময় থেকে বিলম্ব করে এবং একেবারে সময়ের পরে আদায় করে। যেমনটা ইমাম মাসরুক রহ: বলেছেন। এটা মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য। একদল লোক আসরের নামায বিলম্ব করে পড়েছিল, দেখুন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ব্যাপারে কি বলেছেন- “ এটা মুনাফিকের নামায। এটা মুনাফিকের নামায।” সে অপেক্ষায় থাকে, সূর্য শয়তানের দুই সিংয়ের মধ্যখানে আসার , তারপর দাঁড়িয়ে চারটি ঠোকর দেয়, যাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই করে। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

  • যারা আল্লাহর জন্য আমল করে, তাদেরকে তিরস্কার করা; ইবনে কাসীর রহ; বলেন: আল্লাহর জন্য আমলকারীদেরকে তিরস্কার করা মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য। তাদের ছিদ্রান্বেষণ ও তিরস্কার থেকে কখনোই কেউ নিরাপদ থাকে না।
  • নেককাজে ওযর পেশ করা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের উপকারী কাজে প্রতিযোগীতা না করাও মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর শপথ! আমরা নিজেদের ব্যাপারে এবং আমাদের ভাইদের ব্যাপারে এই ভয়ংকর কুস্বভাবের আশংকা করি, যার ব্যাপারে মুসলিমগণ উপলব্ধিই রাখে না।

আপনারা এই আয়াতটির ব্যাপারে চিন্তা করুন, যেটা বনী সালামা গোত্রের জাদ ইবনে কায়সের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হে জাদ! তুমি কি এ বছর রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে? সে ওযর পেশ করল, যেমনটা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

وَمِنْهُم مَّن يَقُولُ ائْذَن لِّي وَلاَ تَفْتِنِّي أَلاَ فِي الْفِتْنَةِ سَقَطُواْ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِالْكَافِرِينَ

“আর তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে, যে বলে আমাকে অব্যাহতি দিন এবং আমাকে ফেৎনায় ফেলবেন না। জেনে রাখ, ফোয় তারা পড়েই আছে। নিশ্চয়ই জাহান্নাম কাফেরদেরকে বেষ্টন করে রাখবে।”

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُونَ(

“তোমার কাছে জিহাদ না করার অনুমতি চায় তো তারা, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং তাদের অন্তর সন্দেহে নিপতিত। ফলে তারা নিজেদের সন্দেহের ভিতর দোদুল্যমান।”

এখানে আল্লাহ তা’আলা তার নবী ﷺ কে মুনাফিকদের আলামত জানিয়ে দিচ্ছেন যে, যে নিদর্শনের মাধ্যমে তাদেরকে চেনা যাবে, তা হচ্ছে, তাদেরকে যখন জিহাদে বের হতে বলা হবে, তখন তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট জিহাদে বের না হওয়ার অনুমতি প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর পথে জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকার চেষ্টা করবে।

আল্লাহ তা’আলা তার নবী মুহাম্মাদ ﷺ কে বলছেন : হে মুহাম্মাদ! তুমি যখন তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে বের হও, তখন যদি কেউ ওযর ব্যতীত জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকতে তোমার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে, তাহলে তুমি অনুমতি দিবে না। কারণ এ ব্যাপারে তোমার নিকট অনুমতি চায় শুধু মুনাফিকরাই, যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে না।

  • আমর বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার বর্জন করা নেফাকির আলামত: আল্লাহ তা’আলা বলেন:

الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُواْ اللّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

“মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী, সকলেই একে অন্যের মত। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে এবং তারা ভাল কাজে বাঁধা দেয় এবং নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। নিশ্চয়ই মুনাফিকরা পাপিষ্ঠ।”

মুসলমানদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করা; তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল; তারা মুসলমানদেরকে নির্বোধ, স্বল্পজ্ঞান সম্পন্ন ও কম চিন্তাশীল বলে। আর তারা নিজেদেরকে মনে করে সঠিক চিন্তার অধিকারী। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

)وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُواْ أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاء(

“যখন তাদেরকে বলা হয়, লোকেরা যেরূপ ঈমান এনেছে, তোমরা সেরূপ ঈমান আন, তখন তারা বলে: নির্বোধরা যেরূপ ঈমান এনেছে, আমরা কি সেরুপ ঈমান আনবো!?”

  • তারা নিফাকির আশংকা করতেন; হাফেজ ইবনে রজব রহ: বলেন: সাহাবা ও তাদের পরবর্তী সালাফে সালিহগণ নিজেদের ব্যাপারে মুনাফিকির আশংকা করতেন। একারণে তারা প্রচন্ড চিন্তা ও পেরেশানী অনুভব করতেন। একারণে একজন মুমিন ব্যক্তি নিজের উপর ছোট নিফাকির আশংকা করবে এবং এই আশংকা করবে যে, পাছে তা পরিণামে তার উপর প্রবল হয়ে যায়, অতঃপর বড় নিফাকির রূপ পরিগ্রহ করে। যেমনটা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে যে: সুপ্ত মন্দের ছিটেফোটাই পরিণতিতে মন্দ পরিসমাপ্তির কারণ হয়।

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: হুযায়ফা রা: কে বলেন: হে হুযায়ফা! আমি তোমাকে আল্লাহর দুহাই দিয়ে বলছি , বল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি তোমার নিকট তাদের মধ্যে আমার নামও উল্লেখ করেছেন? তিনি বললেন না, তবে এর পর আর কাউকে আমি এমনটা বলবো না।

 হাসান বসরী রহ: বলেন: আমি যদি জানতে পারি, আমি নিফাক থেকে মুক্ত, তাহলে এটাই আমার নিকট পুরো পৃথিবী থেকে উত্তম হবে।

ইবনে আবি মুলাইকা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর ত্রিশ জন সাহাবীকে পেয়েছি, প্রত্যেকেই নিজের ব্যাপারে মুনাফিকির আশংকা করতেন।

হাসান বসরী রহ: বলেন; নিফাক হল; ভেতর – বাহির কথা – কাজে মিল না থাকা।

  • নিফাক থেকে সবচেয়ে দূরে যে: গুফরার আযাদ করা গোলাম ইবনে ওমর বলেন: মানুষের মধ্যে নিফাক থেকে সর্বাধিক দূরে সেই ব্যক্তি, যে নিজের ব্যাপারে সর্বাধিক নিফাকির ভয় করে। যে মনে করে, তাকে এ থেকে মুক্তিদানকারী কিছু নেই। আর তার সবচেয়ে নিকটবর্তী হল; যাকে তার মধ্যে অনুপস্থিত গুণের প্রশংসা করা হলে, তার মন খুশি হয় এবং সে তা গ্রহণ করে নেয়।
  • নিফাকি কান্না; চোখ দিয়ে অশ্রু বের হবে, কিন্তু অন্তর থাকবে শক্ত। সে বিনয় প্রকাশ করবে, কিন্তু সেই হবে সর্বাধিক কঠিন অন্তরের অধিকারী।
  • যদি মুনাফিকরা ধ্বংস হয়ে যেত; হুযায়ফা রা: এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন: হে আল্লাহ! মুনাফিকদেরকে ধ্বংস করুন! তিনি বললেন: হে ভাতিজা! সব মুনাফিকরা যদি ধ্বংস হয়ে যেত, তাহলে তুমি রাস্তায় পথচারি স্বল্পতায় একাকিত্ব বোধ করতে।
  • সত্যবাদী ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে নিফাকির আশংকা করে।
  • নিফাক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যায় কেবল মুনাফিক। আর নিফাকির আশংকা করে শুধু মুমিন।

শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জোড়া

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُواْ لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

“যাদেরকে লোকে বলেছিল, লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে জমায়েত হয়েছে, তাই তোমরা তাদেরকে ভয় করো। তখন এটা (এই সংবাদ) তাদের ঈমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বলে উঠে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।

আল্লামা সা’দী বলেন: অর্থাৎ “লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে এবং তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। তারা এটা বলেছিল মুমিনদের মাঝে আতংক ও ভীতি ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু এটা আল্লাহর উপর তাদের ঈমান ও ভরসাই বৃদ্ধি করেছে। তারা বলে উঠেছে আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। অর্থাৎ আমাদের সকল বিপদের জন্য তিনিই যথেষ্ট। তিনিই উত্তম অভিভাবক। বান্দার সকল বিষয়ের ব্যবস্থাপনা তারই দায়িত্বে এবং তিনিই তাদের সুবিধা – অসুবিধা দেখেন।

  • সর্বদা স্মরণ রাখ

– যার আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নেই, তথা যে স্বীয় রব থেকে বিচ্ছিন্ন, আল্লাহ তার অভিভাবক, সাহায্যকারী বা কর্মবিধায়ক হবেন না।

– আর যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখে, নিজ প্রয়োজন তার থেকে চেয়ে নেয়, তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, নিজের বিষয়াদী নিজ রবের দিকে ন্যস্ত করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন, দিকনির্দেশনা দেন, যেকোন দূরের বিষয়কে তার জন্য নিকটবর্তী করে দেন এবং তার জন্য যেকোন কঠিন বিষয়কে সহজ করে দেন।

– যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে, আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। আর যে আল্লাহর হক নষ্ট করে, আল্লাহ তাকে নষ্ট (বা ক্ষতিগ্রস্ত) করেন।

– যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করে, আল্লাহ তাকে তার অধীন করে দেন। কিন্তু যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে সে মর্যাদাবান হয়।

– যখন কেউ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে, আল্লাহ সকল মানুষের অনিষ্টের জন্য তার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হয়ে যান। কারণ সকল সৃষ্টির ভাল – মন্দ তার হাতে সকলের অন্তর তার নিয়ন্ত্রণে। আর তার ব্যাপারে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তা ই ঘটবে। কারণ কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, খাতা শুকিয়ে গেছে।

– মুমিনের অবস্থা: যখন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে, তখন সকাল সন্ধা অন্তর তার সাথেই জুড়ে থাকে। সে আল্লাহর জন্যই দাঁড়ায়, আল্লাহর জন্যই বসে, আল্লাহর জন্যই কথা বলে। তার নড়াচাড়া, স্থিরতা, শ্বাস – প্রশ্বাস ও প্রতিটি কথায় আল্লাহর কথাই চিন্তা করে। প্রত্যেক এমন জিনিসের পিছু ছুটে, যাতে আল্লাহর ভালবাসা রয়েছে। সবশেষে যখন এই মহান ও উন্নত স্তরে পৌঁছে এবং আল্লাহর ভালবাসা ও সন্তুষ্টি লাভ করে, তখন সে দ্বিতীয় ফলটি লাভ করে, যা হল আল্লাহর ভালবাসার প্রতিফল।

– জনৈক আলেম বলেন: মুমিন বান্দা যখন আল্লাহকে ভালবাসে, তখন সে তার প্রতিটি কথা ও কাজের মধ্যেই আল্লাহকে সম্পৃক্ত করে।

– যে নিজ প্রয়োজনাদি পূরণে, আল্লাহর নিকট যে বিনিময় রয়েছে তা লাভের জন্য এবং আশংকাজনক ও কষ্টদায়ক জিনিস থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য যথেষ্ট হয় যান। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:  وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ“আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।”

  • আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গে তোমার অন্তরকে যুক্ত করো না; কিছু মানুষের অন্তর আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত নয়; বরং অমুক কর্মকর্তা, অমুক বন্ধু বা কয়েকটা পৃষ্ঠা পূর্বে লিখেছে, সেগুলোর সাথে বা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের সাথে বা শেয়ারের ফলাফলের প্রতীক্ষা বা এজাতীয় বিষয়ের সাথে জড়িত। কিন্তু আল্লাহর থেকে কোন কিছু। পাওয়ার প্রতীক্ষায় থাকে না তাদের মন। আর কিছু মানুষ উপকরণকে অনর্থক মনে করে, ফলে কোন উপকরণই অবলম্বন করেন। বস্তুত সবচেয়ে বড় উপকরণ হল আল্লাহর সাথে সম্পর্ক।
  • আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের কিছু নমুনা: ইয়ারমুকের যুদ্ধের বছর যখন আবু উবায়দা রা: কাফেরদের সঙ্গে লড়ার জন্য অতিরিক্ত সাহায্য চেয়ে ওমর রা: বরাবর পত্র পাঠালেন এবং তাকে অবগত করলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে এত সংখ্যক শত্রু জমা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে লড়ার মত সামর্থ তাদের নেই। যখন তার পুত্র পৌঁছলো , সব মানুষ কাঁদতে লাগল। সবচেয়ে বেশি কাঁদছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা:। তিনি স্বয়ং ওমর রা: কে যুদ্ধে বের হওয়ার পরামর্শ দিলেন। ওমর রা: মনে করলেন, এটা সম্ভব নয়। তাই তিনি আবু উবায়দা রা: কে লিখলেন: মুসলিমের উপর যত বিপদই আসুক না কেন, সে যদি আল্লাহর নিকট থেকে তা সমাধান করাতে চায়, তাহলে আল্লাহ তার জন্য পথ খুলে দেন এবং সমাধান করে দেন। তাই আমার পুত্র তোমার নিকট পৌঁছলে তুমি আল্লাহর সাহায্য চেয়ে যুদ্ধ শুরু করে দিবে।
  • অনেক মানুষের হিসাবের পাল্লায় ওমর রা: এর অবস্থানটিকে আত্মঘাতি ও নিশ্চিত। পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া মনে হবে। কিন্তু ওমর রা: বিশ্বাস করতেন যে, বিজয় একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আর যেহেতু তার অন্তর আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত ছিল, এজন্য তিনি সর্বদা আল্লাহর নিকট চেয়েছেন, একমাত্র তার সাথেই সম্পর্ক করেছেন, যদিও সামর্থ্যমত উপকরণও অবলম্বন করতেন। আর পত্র আসার সেই কঠিন মুহূর্তটিতেও তিনি সেই বাস্তবতাকে ভুললেননি, যার দীক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন। তিনি স্মরণ করলেন, আল্লাহই সকল বিষয়ের উর্ধ্বে, তিনিই সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। তাই তিনি পরিপূর্ণ আস্থা ও গভীর ঈমানের সাথে একথা বলেছিলেন।
  • উন্নত মনোবল:

এটাই সেই বস্তু, যা বান্দাকে এমন উন্নত মানুষে পরিণত করে, যার ফলে তার পা থাকে মাটিতে, আর আত্মা ও অন্তর যুক্ত থাকে আল্লাহর সঙ্গে।

 এটাই বান্দাকে এমন উন্নত মানুষে পরিণত করে, যার ফলে প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই তার অন্তর আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত থাকে। সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করে না, আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট আশা করে না, আল্লাহ ব্যতীত কারো কাছে নত হয় না, আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ ব্যতীত কারো সাহায্য প্রার্থনা করে না। তার সকল বিষয় আল্লাহ সঙ্গে যুক্ত থাকে। কোন মানুষ ও দুনিয়ার কোন শক্তির প্রতি সে ভ্রুক্ষেপ করে না। দুনিয়ার বস্তুরাজি তার সংকল্প, দৃঢ়তা, ঈমান ও ইয়াকীনকে একটুও টলাতে পারে না।

হাদিসের মধ্যে রয়েছে … জেনে রেখ, যদি সকল মানুষও একত্রিত হয়ে তোমাকে কোন উপকার করতে চায়, তথাপি আল্লাহ তোমার জন্য যা লিখে রেখেছেন তার চেয়ে বেশি কোন উপকার করতে পারবে না। অনুরূপ যদি সকল মানুষ তোমার কোন ক্ষতি করতে একত্রিত হয়, তাহলেও আল্লাহ যা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তার থেকে অধিক কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, খাতা শুকিয়ে গেছে।

আল্লাহ শপথ! কোন বান্দা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ব্যর্থ হবে না। আর যাকেই আল্লাহ বিপদে তার নিকট দু’আ করার তাওফীক দান করেছেন, তার দু’আ অবশ্যই কবুল হবে এবং তাকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে।

  • বদর যুদ্ধ ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক: উপকরণের অবস্থান যত উধ্বেই পৌঁছে যাক কেন, তা উপকরণ হওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। সুতরাং তার সঙ্গে অন্তর যুক্ত করা উচিত নয় বরং সেই আল্লাহর সঙ্গে অন্তর যুক্ত করা উচিত, যার মালিকানাধীন আকাশম – লী ও পৃথিবী। আল্লাহ তা’আলা বদর যুদ্ধে মুসলিমদেরকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে সাহায্য করার কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই বাস্তবতার প্রতিও গুরুত্ব দিয়ে বলেন:

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِينَ وَمَا جَعَلَهُ اللّهُ إِلاَّ بُشْرَى وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ وَمَا النَّصْرُ إِلاَّ مِنْ عِندِ اللّهِ إِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

“(স্মরণ কর,) যখন তোমরা নিজ প্রতিপালকের কাছে ফরিয়াদ করেছিল, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদে সাড়া দিলেন। বললেন:) আমি তোমাদের সাহায্যার্থে। এক হাজার ফেরেশতার একটি বাহিনী পাঠাচ্ছি, যারা একের পর এক আসবে। এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ কেবল এজন্যই দিয়েছেন, যাতে এটা তোমাদের জন্য সুসংবাদ হয় এবং যাতে এর দ্বারা তোমাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। আর সাহায্য তো কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমতাবান, প্রজ্ঞাময়।”

সুতরাং ফেরেশতাগণ হলেন মাধ্যম মাত্র। অন্তর তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত নয়; বরং অন্তর যুক্ত হবে প্রকৃত সাহায্যকারী আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে।

  • বাস্তব প্রশিক্ষণ; কেন জীবনের শুরুতেই তোমার সন্তানকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়াতে শিখাবে না?

সে যখন কোন উপকারী জিনিস চাইবে , কিন্তু তুমি তা দিতে পারবে না, তখন তুমি তাকে বলবে: বৎস! চল, আমরা দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর নিকট চাই। কারণ আল্লাহই রিযিকদাতা। তিনিই আমাদের সকল কিছুর ব্যবস্থাপক। আর তিনি যদি তোমাকে এটা এনে দেওয়ার মত অর্থ আমাকে না দেন, তাহলে বুঝতে হবে এটা এখন আমাদের জন্য উপকারী নয়। কারণ আল্লাহই এটা আমাদের থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন।

নেককারদের উপদেশ সমগ্র থেকে কয়েকটি

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

“(স্মরণ কর,) যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশাচ্ছলে বলেছিল: বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক ভয়ংকর জুলুম।”

  • আল্লামা সা’দী রহ: বলেন: তাকে উৎসাহ ও ভীতি প্রদর্শনের সাথে কতগুলো আদেশ – নিষেধ পালনের উপদেশ দেন। ইখলাসের আদেশ করেন, শিরক করতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর এর কারণও স্পষ্ট করে বলেন: “নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় জুলুম।”
  • এটা বড় হওয়ার কারণ হল: এরচেয়ে নিকৃষ্ট ও মারাত্মক কিছু হতে পারে না, যে মাটি থেকে সৃষ্ট কোন বস্তুকে সকল বস্তুর মালিকের সাথে সমান করে ফেলে, যে কোন ক্ষমতার অধিকারী না, তাকে সকল ক্ষমতার অধিকারীর সাথে সমান করে ফেলে, সর্ব দিক থেকে পরমুখাপেক্ষী ও অসম্পূর্ণ সত্তাকে, সর্বদিক থেকে পরিপূর্ণ ও অমুখাপেক্ষি সত্তার সাথে সমান করে ফেলে।
  • সর্বদা নেকের নিয়ত কর; ইমাম আহমাদের পুত্র আব্দুল্লাহ তার বাবাকে বললেন: হে আব্বা! আমাকে উপদেশ দিন! তিনি বললেন: তুমি নেকের নিয়ত রাখবে, কারণ যতক্ষণ তুমি নেকের নিয়ত রাখবে, ততক্ষণ নেকেরই সওয়াব লাভ করবে।
  • কিভাবে আল্লাহ তোমাকে সম্মান দান করবেন? এক ব্যক্তি হাসান বসরী রহ: কে বললেন: আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: তুমি আল্লাহর হুকুমকে সম্মান কর তাহলে আল্লাহ তোমাকে সম্মান দান করবেন।
  • ভালবাসা, ভয় ও আশা; এক ব্যক্তি তাউসকে বলল: আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি: তুমি আল্লাহকে এমনভাবে ভালবাসা, যে কোন জিনিস তোমার নিকট তার থেকে প্রিয় না থাকে। তাকে এমন ভয় করবে যে, তোমার নিকট তার থেকে ভয়ের আর কিছু থাকবে না। আল্লাহর প্রতি এমন আশা করবে যে, এই আশা তোমার মাঝে ও উক্ত ভয়ের মাঝে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। আর তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, অন্য মানুষের জন্যও তা পছন্দ করবে।
  • আল্লাহর কিতাব: জনৈক ব্যক্তি উবাই ইবনে কা’বকে বলল; আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: আল্লাহর কিতাবকে অনুসরণীয় হিসাবে আকড়ে ধর এবং তাকে বিচারক ও ফায়সালকারী মান।
  • ফেরেশতা হয়ে যাও: জনৈক ব্যক্তি মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসি কে বলল: আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি: তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে ফেরেশতা হয়ে যাও। লোকটি বলল; এটা কিভাবে? তিনি বললেন: দুনিয়াতে যুহদ অবলম্বন কর।
  • সবচেয়ে বড় উপদেশ: ইবনে তাইমিয় রহ: কে একজন পশ্চিমা লোকের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হল: লোকটি বলল: হে শায়খুল ইসলাম আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: তুমি আমার নিকট ওসিয়ত চাচ্ছো! তাহালে শোন, আল্লাহর কিতাব থেকে বড় উপদেশ আর কিছু নেই, যে তা চিন্তা ও অনুধাবন করে –

وَللّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُواْ اللّهَ

“আকাশমন্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আল্লাহরই। আমি তোমাদের আগে কিতাবীদেরকে এবং তোমাদেরকেও জোর নির্দেশ দিয়েছি, যে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।”

এটাই হল বড় উপদেশ । এটাই দুনিয়াতে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য, তথা আল্লাহকে ভয় কর।

  • সতর্ক হও, সতর্ক হও: জনৈক ব্যক্তি ওমর ইবনে আব্দুল আযীযকে বলল: আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: তুমি ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে সতর্ক থাক, যারা নেককার লোকদের সাথে মিশে, কিন্তু তাদের দ্বারা উপকৃত হতে পারে না, অথবা যারা গুনাহকারীদেরকে ভৎসনা করে, কিন্তু নিজে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে না। অথবা যারা প্রকাশ্যে শয়তানকে অভিশম্পাত করে, কিন্তু গোপনে শয়তানের অনুসরণ করে।
  • সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ কর: জনৈক যুবক আবুদ দারদা রা: এর নিকট এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূলের সঙ্গী! আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: হে বৎস! তুমি সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখবে, তাহলে আল্লাহকে তোমাকে দুঃখের সময় স্মরণ করবেন।
  • অন্তরের চিকিৎসা: ইবরাহিম আলখাওয়াস বলেন; অন্তরের চিকিৎসা পাঁচটি জিনিসের মধ্যে: চিন্তার সাথে কুরআন পাঠ করা, পেট খালি থাকা, রাত্রি জাগরণ করা, শেষ রাতে অনুনয় বিনয় করা এবং নেককার লোকদের সাথে বসা।
  • ভদ্রতা কি? মুহাম্মাদ ইবনে আলীকে জিজ্ঞেস করা হল: ভদ্রতা কি? তিনি উত্তর দিলেন: গোপনেও এমন কোন কাজ না করা, যেটা করতে প্রকাশ্যে লজ্জাবোধ কর।
  • মানুষের জন্য কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা করা:

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ

“বল, আমি এর কারণে তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না এবং আমি ভনিতাকারীদের অন্তর্ভূক্ত নই।”

আল্লামা সা’দী রহ: বলেন; অর্থাৎ এমন দাবি করি না, যা আমার মধ্যে নেই এবং যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ি না। আমি শুধু আমার নিকট যে ওহী প্রেরণ করা হয়, তারই অনুসরণ করি।

ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদেরকে লৌকিকতা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আসমা রা: থেকে বর্ণিত, জনৈকা মহিলা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমার একজন সতিন আছে। তাই আমি যদি আমার স্বামী থেকে যা পাইনি , তার ব্যাপারে পরিতৃপ্তি (অর্থাৎ পাওয়ার ভাব) প্রকাশ করি, তাহলে কি কোন গুনাহ হবে? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: যে কৃত্রিমতা করে অপ্রাপ্ত বিষয়ের পরিতৃপ্ততা প্রকাশ করে, সে দুই মিথ্যার পোশাক পরিধানকারীর ন্যায়। (বুখারী মুসলিম)

ইমাম নববী রহ: বলেন: হাদিসের শব্দ- আলমুতাশাব্বি- অর্থ হল যে পরিতৃপ্তি প্রকাশ করে, অথচ আসলে সে পরিতৃপ্ত নয়। এখানে তার অর্থ হল, সে প্রকাশ করবে যে, তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, অথচ তার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর দুই মিথ্যার পোশাক পরিধানকারী মানে হল; যাহেদ, আলেম বা সম্পদশালীদের পোশাক পরিধান করে মানুষের নিকট মিথ্যা প্রকাশ করল। যেন মানুষ প্রতারিত হয়, অথচ সে উক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।

নেককারদের বৈশিষ্ট্য হল তারা এমন কোন কথ বলেন না, এমন কোন কাজ করেন না, এমন কোন গুণ প্রকাশ করেন না এবং কোন ইবাদতের দাবি করেন, যার গভীর হাকিকত তাদের অন্তরে নেই। তাই তারা মানুষের সামনে নিজেদের মন্দগুলো গোপন রেখে নেকগুলো শুধু প্রকাশ করে বেড়ান না। সালাফগণ তাদের অবস্থা গোপন রাখতেন এবং কৃত্রিমত বর্জন করার উপদেশ দিতেন।

  • কৃত্রিমতার কিছু নমুনা:

ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: এক যুবকের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সে মাথা নিচু করে আছে। তিনি বললেন; এই! মাথা উচু কর। বিনয় অন্তরে যতটুকু আছে, ততটুকুই, মাথা নিচু করার দ্বারা তা বেড়ে যাবে না। যে অন্তরে যতটুকু বিনয় আছে, তার থেকে বেশি প্রকাশ করল, সে নিফাকির উপর নিফাকি প্রকাশ করল। কাহমাস ইবনে হাসান থেকে বর্ণিত, জনৈক লোক ওমরের নিকট এমনভাবে শ্বাস নিল যেন সে চিন্তিত। ওমর রা: তাকে কিল দিলেন।

  • রিয়া বা লোক দেখানো একটি কৃত্রিমতা; তথা হচ্ছে ছোট রিয়া। যেমন মাখলুকের জন্য কৃত্রিমতা করা, ইবাদতে আল্লাহর জন্য ইখলস অবলম্বন না করা। বরং কখনো আত্মিক স্বার্থের জন্য বা কখনো দুনিয়া অর্জনের জন্য করা।
  • তুমি আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার সময়কে স্মরণ কর: মাখলুকের জন্য লৌকিকতা করা, মাখলুকের প্রশংসা কুড়ানো, মাখলুকের প্রশংসা কামনা করা বা এজাতীয় বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে; শুধু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকেই উদ্দেশ্য বানাবে। আর কিয়মাতের দিন আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার কথা স্মরণ করবে, যেদিন সকল গোপন বিষয়সমূহের যাচাই বাছাই হয়ে যাবে। ফলে তার কোন শক্তি বা সাহায্যকারী থাকবে না।
  • অতিরিক্ত কৃত্রিমতা; অনেকে আছে, তার কোন আত্মীয় তার সাক্ষাতে আসলে তার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত লৌকিকতা করে। অনেক মাল খরচ করে। তাকে ইকরাম করতে গিয়ে নিজেকে অনেক কষ্টের মধ্যে ফেলে। অথচ অনেক সময় স্বল্প আয়ের লোক হয়ে থাকে। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ পরিপন্থি ।
  • কৃত্রিমতার কতিপয় আলামত:

ইলম ছাড়া বানিয়ে কথা বলা। মাসরুক বলেন: আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের নিকট গেলাম। তিনি বললেন: হে লোকসকল! যে একটি বিষয় সম্পর্কে জানে, সে ই যেন তা বলে। আর যে জানে না, সে যেন বলে দেয়, আল্লাহই ভাল জানেন। কারণ এটাও একটি ইলম যে, কেউ না জানলে বলে দিবে “আল্লাহই ভাল জানেন”।

আল্লাহ তা’আলা তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন:

قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ

(বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ:)

ছন্দ মিলানো: ইবনে আব্বাস রা: বলেন: তারা যদি তোমাকে আমির বানায়, তাহলে তাদের আগ্রহ থাকাবস্থায় তাদের নিকট হাদিস বলবে। আর দেখ, দু’আর মধ্যে ছন্দ মিলানো থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামকে দেখেছি, তারা এটা থেকে বেঁচে থাকতেন।” ইমাম গাযালী রহ: বলেন: কৃত্রিমতার সাথে যে ছন্দ মিলানো হয়, সেটা হচ্ছে মাকরুহ। কারণ কাকুতি – মিনতি ও বিনয় তো নিন্দিত নয়। অন্যথায় হাদিসে বর্ণিত দু’আ সমূহের মধ্যেও তো মিলানো মিলানো বাক্য রয়েছে, কিন্তু সেগুলো অকৃত্রিম।

ছড়ছড়ানো, অনর্গল বলতে থাকা এবং অপ্রয়োজনে দীর্ঘ করা: ছড়ছড়ানো মানে হচ্ছে, লৌকিতা করে সত্য থেকে বের হয়ে গিয়ে অধিক কথা বলা। রাসূলুল্লাহ ﷺ  বলেন; নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও কিয়মাতে আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী আসনে থাকবে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর চরিত্রের অধিকারীগণ। আর তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ও কিয়মাতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরের আসনে থাকবে অধিক কথোপকথনকারী বাচালরা।

ইমাম আসকারী বলেন: এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উদ্দেশ্য হল: ভ্রান্ত বিষয়াদীর অনেক গভীরে ঢোকা থেকে নিষেধ করা আর লৌকিকতার সাথে বাগ্মিতা ও বাকপটুত্বের নিন্দা করা আর তার বিপরীতটির প্রশংসা করা।

  • মৃত্যু পর্যন্ত অটল থাকা:

আল্লাহ তাআলা বলেন: (وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ) তোমার প্রভুর ইবাদত করতে থাক, নিশ্চিত বিষয় (মৃত্যু) আসার আগ পর্যন্ত।”

আল্লামা সা’দী রহ: বলেন; অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সময় বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের মাধ্যমে আল্লহর নৈকট্য অর্জন করতে থাক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবের আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। তার প্রভুর পক্ষ থেকে নিশ্চিত বিষয় তথা মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত তার রবের ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন।

প্রতিটি সত্যিকার মুসলিমের জন্য আল্লাহর দ্বীনের উপর অটল থাকা একটি মৌলিক লক্ষ্য; অর্থাৎ দৃঢ়তা ও সতর্কতার সাথে সিরাতে মুস্তাকীমে চলা। বিশেষত: এই যামানায়, যখন সর্বপ্রকার ফেনা ও কুপ্রবৃত্তি ছড়িয়ে পড়েছে।

  • দৃঢ় থাকার উপায়সমূহ:

১. কুরআনের দিকে মনোযোগী হওয়া। আলকুরআনুল আযীমই হল দৃঢ় থাকার প্রথম মাধ্যম। এটা হল আল্লাহর মজবুত রশ্মি এবং স্পষ্ট আলো। যে এটাকে আকড়ে ধরবে আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন, যে এর অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাকে মুক্তি দিবেন এবং যে আল্লাহর নিকট দু’আ করবে, আল্লাহ তাকে সঠিক পথের দিশা দিবেন।

২. আল্লাহর শরীয়তের সাথে লেগে থাকা এবং তার উপর আমল করা; আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يُثَبِّتُ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللّهُ مَا يَشَاء

“যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদেরকে এ সুদৃঢ় কথার উপর স্থিতি দান করেন। দুনিয়ার জীবনেও এবং আখেরাতেও। আর আল্লাহ জালেমদেরকে করেন বিভ্রান্ত। আর আল্লাহ (নিজ হিকমতে) যা চান, তাই করেন।”

ইমাম কাতাদা রহ: বলেন; আল্লাহ তাদেরকে পার্থিব জীবনে কল্যাণ ও নেক আমলের দ্বারা দৃঢ় করবেন এবং পরকালীন জীবনে তথা কবরে দৃঢ় করবেন।

৩. দু’আ হল আল্লাহর মুমিন বান্দাদের একটি বৈশিষ্ট্য। তারা দু’আর মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়, যেন আল্লাহ তাদেরকে অবিচল রাখেন- (رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا)

হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে যখন হেদায়াত দান করেছো, এরপর আর আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না।”

রাসূলুল্লাহ ﷺ বেশি বেশি এই দু’আ করতেন 🙁يا مقلب القلوب ثبت قلبي علي دينك) “হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অটল রাখ।” (বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী)

৪. আল্লাহকে স্মরণ করা: আল্লাহর নিম্মোক্ত আয়াতে এই দু’টি বিষয়কে কিভাবে এক সাথে আনা হয়েছে চিন্তা করে দেখুন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُواْ وَاذْكُرُواْ اللّهَ كَثِيراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلَحُونَ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন দলের মুখোমুখী হও, তখন অটল থাক এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো, হয়ত তোমরা সফল হবে।” [ সুরা আনফাল ৮:৪৬ ]

তাহলে এটাকে জিহাদে অটল থাকার সবচেয়ে বড় উসিলা বানিয়েছেন।

৫. ভাল পরিবেশ এবং ঈমানী পরিবেশ তৈরী করা; নেককারদের সঙ্গে আলোচনা কর এবং তাদের নিকট যাওয়া দ্বীনের উপর অটল থাকতে বড় সহায়ক।

  • দুই সমাপ্তির মাঝে পার্থক্য:

কাফের ও পাপিষ্ঠরা সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদের মুহূর্তে দৃঢ়তা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে তারা মৃত্যুর সময় শাহাদাত উচ্চারণ করতে পারবে না। নাউযু বিল্লাহ!

  • মন্দ পরিসমাপ্তির কিছু নমুনা:

জনৈক ব্যক্তিকে তার মৃত্যুর সময় বলা হল: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলুন! তখন সে তার মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে তার কথা প্রত্যাখ্যান করল। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ!

 আরেকজন তার মৃত্যুর সময় বলতে লাগল; এটা ভাল অংশ। এটার দাম সস্তা।

 আর আরেকজন মৃত্যুর সময় দাবার গুটির নাম উল্লেখ করছিল।

চতুর্থ আরেকজন সুর, গানের কিছু শব্দ এবং প্রেমিকার স্মরণ করছিল।

 এর কারণ হল এ জিনিসগুলো তাদেরকে আল্লাহর যিকির থেকে ভিন্ন কাজে ব্যস্ত রেখেছিল।

 পক্ষান্তরে দ্বীন ও নেক আমলের অধিকারী লোকদেরকে আল্লাহ মৃত্যুর সময় দৃঢ়তা দান করেন এবং উত্তম পরিসমাপ্তি দান করেন।

  • উত্তম পরিসমাপ্তির আলামত: কালিমা উচ্চারণ করতে পারা। কখনো চেহারা লাল হতে দেখা যাবে বা সুঘ্রাণ ছড়াবে বা তাদের আত্মা বের হওয়ার সময় কোন সুসংবাদ পাওয়া যাবে।
  • নেককারদের জীবনের গোপন রহস্যাবলী:

আল্লাহ তা’আলা বলেন:( ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ) “তোমরা তোমাদের রবকে ডাক বিনিতভাবে ও চুপিস্বারে। নিশ্চয়ই তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।” [ সুরা আরাফ ৭:৫৫ ]

ইমাম তবারী রহ: বলেন: আল্লাহ তা’আলা এখানে বলছেন : হে লোকসকল! তোমরা যেসকল বহু উপাস্য ও মূর্তিসমূহকে ডাক সেগুলোকে বাদ দিয়ে এককভাবে তোমাদের প্রভুকে ডাক, শুধুমাত্র তার নিকটই দু’আ কর। বিনয় নলতা ও দীনতার সাথে, গোপনে, অর্থাৎ আন্তরিক বিনয় ও তার একত্ববাদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে। এমন নয় যে, উচ্চ স্বরে ও ঝগড়া করার মত ডাকবে, অথচ অন্তরে আল্লাহর প্রভুত্ব ও একত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস থাকবে না। যা মুনাফিক ও ধোঁকাবাজদের কাজ।

যেমন হাসান বসরী রহ: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি পুরো কুরআন জমা করেন, কিন্তু তার প্রতিবেশী তা টেরও পেত না।

আরেক ব্যক্তি অনেক ফিকহ শিখেছে , কিন্তু মানুষ তা জানত না।

আরেক ব্যক্তি নিজ ঘরে দীর্ঘ সময় নামায পড়ত আর তার ঘরে মেহমান থাকত, কিন্তু তারা তা টের পেত না।

 আমরা এমন অনেক লোক দেখেছি , যারা দুনিয়ার যেকোন আমল গোপনে করতে। পারলে তা আর কখনো প্রকাশ্য হত না।

 একসময় মুসলিমগণ অনেক জোড়ালো দু’আ করতেন, কিন্তু তাদের কোন আওয়ায শোনা যেত না। শুধু তাদের মাঝে ও তাদের রবের মাঝে ফিস ফিস আওয়ায় হত। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: তোমরা মিনতির সাথে গোপনে তোমাদের প্রভুকে ডাক। আল্লাহ তা’আলা তার এক বান্দার কথা আলোচনা করে তার কাজের প্রশংসা করেন এই বলে : إِذْ نَادَى رَبَّهُ نِدَاء خَفِيًّا “ যখন সে তার প্রতিপালককে ডেকেছিল চুপিস্বারে।”  [ সুরা মারঈয়াম ১৯:৩ ]

একনিষ্ঠ বান্দারা তাদের নেক আমলকে অন্যদের থেকে গোপন করতে অনেক আগ্রহী থাকতেন। পক্ষান্তরে অন্যরা তাদের গুনাহগুলোকে গোপন করতে আগ্রহী থাকতো। সেই কল্যাণ লাভের আশায়, যা হাদিসে এসেছে- আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকী, মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী ও গোপনে তার ইবাদতকারী বান্দাদেরকে ভালবাসেন। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

ইমাম খুরাইয়ী বলেন: তারা এটা পছন্দ করতেন যে, এক ব্যক্তির নেক আমলের এমন গোপন একটি অংশ থাকুক, যা তার স্ত্রী বা অন্য কেউও জানবে না।

 তোমার নেক আমল গোপন কর: সালামা ইবনে দিনার বলেন, তুমি তোমার মন্দ আমলগুলোকে যেরূপ গোপন কর, তোমার নেক আমলগুলোকে তার থেকে অধিক গোপন কর।

বিশর আলহাফি বলেন: তুমি অখ্যাত থাক এবং হালাল খাবার আহার কর। সেই ব্যক্তি পরকালে স্বাদ লাভ করবে না, যে দুনিয়াতে মানুষের নিকট পরিচিত হতে চায়।

 মুহাম্মদ ইবনুল আলা বলেন: যে আল্লাহকে ভালবাসে, সে এটাও ভালবাসে যে, মানুষ তাকে না চিনুক ।

 মুসলিম ইবনে ইয়াসার বলেন: কোন স্বাদ উপভোগকারী নিভৃতে আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাত করার মত স্বাদ উপভোগ করেনি।

  • সালাফদের ইবাদত গোপন করার কিছু নমুনা:

বর্ণিত আছে, ওমর রা: গভীর রাতে বের হলেন। হযরত তালহা রা: তাকে দেখে ফেললেন। ওমর রা: একটি ঘরে প্রবেশ করলেন, তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আরেকটি ঘরে প্রবেশ করলেন। সকালবেলা তালহা সেই ঘরে গেলেন। সেখানে দেখলেন এক অন্ধ অচল বৃদ্ধা। তিনি মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন; এই লোকটি কি কারণে তোমার ঘরে আসে? মহিলা বলল: লোকটি এত এত দিন ধরে আমাকে দেখাশোনা করছে। আমার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র এনে দেয়। আমার অসুবিধা হলে দূর করে। তখন তালহা রা: বললেন: ধ্বংস তোমার হে তালহা! তুমি ওমরের দোষ – ত্রুটির পিছনে পড়েছো?!

যায়নুল আবিদীন আলী ইবনে হাসান মদীনার একশ পরিবারের লোকদের খরচ বহন করতেন। রাতের বেলা তাদের নিকট খাবার নিয়ে আসতেন। তারা মৃত্যু পর্যন্ত জানত না, কে তাদের নিকট খাবার নিয়ে আসে। মৃত্যুর পর তারা অনুসন্ধান করে জানতে পারলো, এগুলো যায়নুল আবিদীনের পক্ষ থেকে আসতো। বিধবাদের ঘরে খাদ্য বহনের কারণে তারা তার পিঠে চিহ্ন দেখতে পেল।

মুহাম্মাদ ইবনে ওয়াসি বলেন: যদি কেউ ২০ বছরও নিজ ঘরে কাঁদে, আর তার স্ত্রীও একই ঘরে থাকে, তবুও সে তা জানবে না।

ইবনুল মুবারক রহ: যুদ্ধের সময় তার চেহারায় পর্দা দিতেন, যাতে কে তাকে না চিনে ।

 ইমাম আহমাদ রহ: বলেন; আল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ: কে এত সুউচ্চ মর্যাদা দান করেছেন শুধু তার গোপন আমলের কারণে।

 ইমাম শাফেয়ী রহ: বলেন; আমি কামনা করি, সমস্ত মানুষ এই ইলম শিখুক, কিন্তু তারা তা আমার দিকে সম্পৃক্ত না করুক।

  • একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী: এই গোপন করা শুধু ঐ সমস্ত আমলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যেগুলোতে গোপন করা শরীয়তসিদ্ধ। আর তা শুধু নাওয়াফেলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফরজের ক্ষেত্রে নয়। উপরন্তু আলেমগণ এর থেকে ঐ সকল লোকদেরকে পৃথক করেছেন, যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করবে। কারণ তার ক্ষেত্রে প্রকাশ করাই ভাল।
  • সালিহদের কিছু বৈশিষ্ট্য:

আল্লাহ তা’আলা বলেন:( أُوْلَـئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ) “ তারাই ঐ সকল লোক, যাদেরকে আল্লাহ পথপ্রদর্শন করেছেন। তাই তুমি তাদের পথেরই অনুসরণ কর।”  [ সুরা আন’য়াম ৬:৯০ ]

মুমিনদের কর্তব্য হল, সালিহদের বৈশিষ্ট্যাবলী জানা, তাদের জীবনী অধ্যয়ন  করা, তাদের উন্নত চরিত্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তাদের উত্তম বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসন্ধান করে তার অনুসরণ করা।

  • তাবিয়ীদের শিরোমণি সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ: এর কয়েকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য: তিনি বলেন: আমার ত্রিশ বছর এমন অতিবাহিত হয়েছে যে, মুআয্যিন আযান দেওয়ার সময় আমি মসজিদে উপস্থিত।

তিনি বলেন; চল্লিশ বছর যাবত আমার জামাতে নামায ছুটেনি ।

  • ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য:

১. তিনি নির্জনতা ভালবাসতেন। ইমাম আহমাদ বলেন: আমি নির্জনতাকেই আমার অন্তরের জন্য অধিক প্রশান্তিদায়ক মনে করি।

২ , তিনি প্রসিদ্ধিকে অপছন্দ করতেন; মারওয়াযী বলেন: ইমাম আহমাদ আমাকে বললেন: তুমি আব্দুল ওয়াহাবকে বল, যে তুমি অখ্যাত থাক। কারণ আমি প্রসিদ্ধির ফেনায় আক্রান্ত হয়েছি।

৩. তাকে মানুষ সম্মান করুক, তিনি এটা অপছন্দ করতেন না: মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেন: আমি আবু আব্দুল্লাহকে দেখেছি, তিনি যখন রাস্তায় হাটতেন, তখন কেউ তার পিছু পিছু হাটলে তিনি তা অপছন্দ করতেন।

৪. তার বিনয়; খুরাসানী তাকে বলেন; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে, আপনাকে দেখার তাওফীক দান করেছেন। তিনি বললেন: বস, এটা কি!? আমি কে? আরেক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত: আমি আবু আব্দুল্লাহর চেহারায় চিন্তার রেখা দেখতে পেলাম। আর এর কারণ ছিল এক ব্যক্তি তার প্রশংসা করে বলেছিল: আল্লাহ আপনাকে ইসলামের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

৫. তার রাত্রি জাগরণ: মারওয়াযী বলেন; আমি আবু আব্দুল্লাহকে দেখলাম, তিনি তার নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অর্ধরাত্রির মত জাগরণ করলেন, যা প্রায় সাহরীর সময় পর্যন্ত হয়ে গেল।

৬. মুসলিম ভাইদের জন্য তার দু’আ; আব্দুল্লাহ বলেন: আমি অনেক সময় বাবাকে দেখেছি, বিভিন্ন কওমের জন্য নাম ধরে ধরে দু’আ করতেন। তিনি অনেক বেশি দু’আ করতেন এবং নিচু স্বরে করতেন। মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়েও নামায পড়তেন।

৭. তার স্বল্পনিদ্রা : তিনি এশার নামায পড়ার পর উত্তমরূপে কয়েক রাকাত নামায পড়তেন। তারপর বিতর পড়ে হালকা ঘুমাতেন। তারপর আবার দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন। তার কেরাত হত কোমল ও মৃদু স্বরে। মাঝে মাঝে কিছু অংশ আমি বুঝতাম না।

৮. অধিক রোজাপালন: তিনি নিয়মিত অনেকদিন রোজা রাখার পর কিছুদিন রোজামুক্ত থাকতেন। তিনি সোমবার, বৃহ : বার ও আয়্যামে বীযের রোজা কখনো ছাড়তেন না। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মৃত্যু পর্যন্ত নিয়মিত রোজা রেখেছেন।

৯. দরীদ্রদের সম্মান করা: মারওয়াযী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি ইমাম আহমাদের মজলিস অপেক্ষা কোন মজলিসে দরীদ্রদের এত সম্মানের অবস্থায় দেখিনি। তিনি তাদের প্রতি ধাবিত ছিলেন আর দুনিয়াদারদের থেকে বিরাগী ছিলেন।

১০. তার স্বল্পকথন; তিনি যখন আসরের পর ফাতওয়া প্রদানের জন্য স্বীয় মজলিসে বসতেন, তখন কোন প্রশ্ন করার আগে তিনি কথা বলতেন না।

১১. তার উত্তম চরিত্রের কিছু চিত্র; তিনি হিংসাপরায়ণ বা তরিৎপ্রবণ ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যধিক বিনয়ী, উত্তম চরিত্রবান, সহনশীল, সদা উজ্জলমুখ, নরম, কোমল। কোন কঠোরতা ছিল না তার মাঝে। প্রতিবেশীদের কষ্ট সহ্য করতেন।

১২. আল্লাহর সম্মানের প্রতীকসমূহকে সম্মান করতেন; তিনি আল্লাহর জন্যই ভালবাসতেন, আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করতেন। আর যখন কোন দ্বীনি বিষয়ে ব্যতিক্রম ঘটত, তখন তার ক্রোধ হত কঠিন।

  • ইমাম বুখারী রহ: এর কিছু চরিত্র – বৈশিষ্ট্য:

ইমাম বুখারী রহ: এর অন্যান্য অনেক প্রশংসনীয় গুণাবলীর মাঝে বিশেষভাবে তিনটি গুণ উল্লেখযোগ্য :

১. তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী।

২. মানুষের জিনিসের প্রতি লোভী ছিলেন না।

৩. মানুষের বিষয়াদী নিয়ে ব্যস্ত হতেন না। তার একমাত্র ব্যস্ততা ছিল ইলম।

প্রবল – দুর্বলের মাঝে কোন পার্থক্য করতেন না: আব্দুল মাজীদ ইবনে বুখারী বলেন; আমি সবল – দুর্বলের মাঝে সমতাকারী ইমাম বুখারীর মত কাউকে দেখিনি।

যবানের হেফাজত:  ইমাম বুখারী রহ: বলেন: আমি যখন থেকে জানি যে, গীবত গীবতকারীর জন্য ক্ষতিকর, তখন থেকে কখনো কারো গীবত করিনি।

তার রাতের ইবাদত; তিনি শেষ রাতে ১৩ রাকাত নামায পড়তেন।

  • সালিহদের সার্বক্ষণিক অভ্যাস:

শায়খুল ইসলাম বলেন; তাদের উল্লেখযোগ্য সার্বক্ষণিক অভ্যাসগুলো হল:

আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করা ও সর্বদা কাকুতি মিনতি করা

– হাদিসে বর্ণিত দু’আ শিখে তা দ্বারা দু’আ করা এবং দু’আ কবুলের সম্ভাব্য সময়গুলোতে- যেমন, শেষ রাতে, আযান – ইকামতের সময়, সিজদায় ও নামাযের পরে দু’আ করা।

এর সাথে ইস্তেগফারও  করা, কারণ কেউ ইস্তেগফার করত : আল্লাহর প্রতি রুজু হলে আল্লাহ তাকে মৃত্যু পর্যন্ত উত্তম ভোগ – সামগ্রী দান করেন।

 দিনের শুরুতে , শেষে এবং ঘুমের সময় নিয়মিত যিকরের অভ্যাস করা।

 যে সমস্ত বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা আসে, তাতে ধৈর্য ধারণ করা। কারণ এতে আল্লাহ তার নিজ শক্তি দ্বারা তাকে সাহায্য করেন এবং তার অন্তরের গভীরে ঈমান গেঢ়ে দেন।

ফরজসমূহ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণভাবে পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় করার প্রতি যত্নবান হওয়া, যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায । কারণ এগুলো হল দ্বীনের খুটি।

 সর্বদা সব কাজে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ জপতে থাকা। কারণ এর মাধ্যমে সে গুরুদায়িত্ব পালন, বিপদ মোকাবেলা করা ও উন্নত মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে।

 দু’আ ও প্রার্থনায় অলসতা না করা। কারণ বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তাড়াহুড়া করে একথা না বলে যে, আমি দু’আ করলাম, কিন্তু দু’আ কবুল হল না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার দু’আ কবুল হয়।

 আর বিশ্বাস করবে যে, বিজয় ধৈর্যের মাঝে এবং সফলতা কষ্টের সাথে। আর সংকটের সাথেই সচ্ছলতা রয়েছে। নবী বা অন্য কেউ সবর ব্যতীত ভাল ফলাফল লাভ করতে পারেনি। সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

সংশোধিত হওয়া ও সংশোধন করা:

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَقَالَ مُوسَى لأَخِيهِ هَارُونَ اخْلُفْنِي فِي قَوْمِي وَأَصْلِحْ وَلاَ تَتَّبِعْ سَبِيلَ الْمُفْسِدِينَ

“মূসা তার ভাই হারুনকে বলল, আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করবে। সব কিছু ঠিকঠাক রাখবে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করবে না।” [ সুরা আরাফ ৭:১৪২ ]

আরেক স্থানে বলেন:

وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ إِنْ أُرِيدُ إِلاَّ الإِصْلاَحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلاَّ بِاللّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ

“আমার এমন কোন ইচ্ছা নেই যে, আমি যেসব বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করি, তা তোমাদের পিছনে গিয়ে নিজেই করতে থাকবো। নিজ সাধ্যমত সংস্কার করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আমার নেই। আর আমি যা কিছু করতে পারি, তা কেবল আল্লাহর সাহায্যেই পারি। আমি তারই উপর নির্ভর করেছি এবং তারই দিকে ফিরি।” [ সুরা হুদ ১১:৮৮ ]

তাই কোন ব্যক্তিগত বা অন্যকে প্রভাবিতকারী ইবাদতই সংশোধিত হওয়া ও সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত নয়। বিশেষত: যে সকল ইবাদতের উদ্দেশ্যই ইসলাহ বা সংশোধণ করা। যেমন আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার। তাই আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার ও সমস্ত সৃষ্টিজীবের কল্যাণকামনা করা ঈমনের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যা আহলে হক, তথা নবী – রাসূল ও তাদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য। তাদের প্রধান কাজই ছিল আমর বিল মারুফ, তথা তাওহীদ, ইনসাফ ও উন্নত আখলাকের অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করা এবং নেহি আনিল মুনকার, তথা যমীনে শিরক, অবাধ্যতা, জুলুম ও ফ্যাসাদ হতে বাঁধা দেওয়া।

  • আমর বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকারের গুরুত্ব: আল্লাহ তা’আলা বলেন:

الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

“যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করবে। আর সকল বিষয়ের চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।”  [ সুরা হাজ্জ্ব ২২:৪১ ]

আরেক স্থানে বলেন:

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“তোমাদের মধ্য হতে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে, অন্যায় কাজে নিষেধ করবে। আর তারাই সফল।”  [ সুরা ইমরান ৩:১০৪ ]

  • হযরত লুকমানের স্বীয় সন্তানের প্রতি উপদেশের ঘটনা বর্ণনা করত: বলেন:

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

“হে বৎস! নামায কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ করো, অন্যায় কাজে নিষেধ করো এবং তোমার উপর যে বিপদ আপতিত হয়, তার উপর সবর করো। নিশ্চয়ই এটা দৃঢ় সংকল্পের কাজ।” [ সুরা লুকমান ৩১:১৭ ]

এক্ষেত্রে আমাদের নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি তার উম্মতকে সর্বপ্রকার ভালকাজের আদেশ করেছেন এবং সর্ব প্রকার মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমাদের মধ্যে যে কোন মন্দ কাজ দেখতে পায়, সে যেন তা হাত দ্বারা বাঁধা দেয়, যদি তা না পারে, তাহলে যেন মুখ দ্বারা বাঁধা দেয়, যদি তাও না পারে, তাহলে যেন অন্তর দ্বারা বাঁধা দেয়। আর এটা হল সর্বচেয়ে দুর্বল ঈমান। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ:)

  • সমাজ সংশোধন: ড.আব্দুল কারীম যিদান বলেন: ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য হল, তাতে প্রতিটি ব্যক্তি সমাজ সংশোধনের দায়িত্ব পালন করবে। অর্থাৎ প্রতিটি সদস্যের মাঝে সমাজ সংশোধন, যথাসম্ভব তা থেকে ফাসাদ দূর করণ এবং এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অন্যের সাথে সহযোগীতামূলক অংশ গ্রহণের আগ্রহ থাকবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ

“তোমরা সৎ ও তাকওয়ার কাজে একে অন্যের সহযোগীতা করো আর গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে অকে অন্যের সহযোগীতা করো না।” [ সুরা মায়েদা ৫:২ ]

সবচেয়ে বড় পারস্পরিক সহযোগীতা হল: সমাজ সংশোধনে পরস্পরে সাহায্য করা। যখন একজন ব্যক্তি সমাজ সংশোধনে আগ্রহী থাকবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:( وَلاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ بَعْدَ إِصْلاَحِهَا) “এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তাতে অশান্তি বিস্তার করো না।” [ সুরা আরাফ ৭:৫৬ ]

তাই মুসলিম সমাজে নারী – পুরুষ পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরস্পর সহযোগীতামূলক সমাজ সংশোধন, কল্যাণ বিস্তার ও নৈরাজ্য মোকাবেলায় কাজ করে। ঐ সকল মুনাফিকদের বিপরিত, যাৱা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সংশোধন করার দাবি করে। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলছেন :

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ قَالُواْ إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ أَلا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَـكِن لاَّ يَشْعُرُونَ

“আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্ গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।” [ সুরা বাকারা ২:১১/১২ ]

  • মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য; আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ

“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীগণ একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ করে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করে।”  [ সুরা তাওবা ৯:৭১ ]

আর মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন:

الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ

মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীগণ একের অন্যের মতই। তারা অন্যায়ে কাজের আদেশ করে এবং সৎ কাজে নিষেধ করে।”  [ সুরা তাওবা ৯:৬৭ ]

  • আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারে সালিহীনের অবদানসমূহ:

১. আলী ইবনে আবি তালিব রা: বলেন; হে লোকসকল ! তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংস হওয়ার কারণ হল; তারা অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে, আর তাদের মধ্যে যারা আল্লাহওয়ালা ও আলেম ছিল, তারা তাদেরকে বাঁধা দেয়নি। তাই আল্লাহ তা’আলা তাদের সকলের প্রতি তার শাস্তি অবতীর্ণ করেন। তাই তাদের উপর যেরূপ শাস্তি এসেছিল, তোমাদের উপরও অনুরূপ শাস্তি আসার পূর্বেই তোমরা আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার করতে থাক। জেনে রাখ, আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার কারো রিযিক কমায় না এবং কারো মৃত্যু তরান্বিত করে না।

২. সুজা ইবনুল ওয়ালীদ বলেন: আমি সুফিয়ানের সাথে হজ্জ করতাম। কখনো দেখিনি, আসা যাওয়ার সময় তার যবান আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার থেকে বিরত হয়েছে।

৩. আবু আব্দুর রহমান আল – আমরী বলেন: আল্লাহর ব্যাপারে অবহেলা মানে তোমার নিজের প্রতি নিজের গাফলতি। যেমন তুমি আল্লাহকে অসন্তুষ্টকারী একটি বিষয় দেখতে পেলে, অতঃপর মাখলুকের ভয়ে কোন আদেশ – নিষেধ না করে তা অতিক্রম করে চলে গেলে।

  • যে মাখলুকের ভয়ে আমর বিল মারুফ ছেড়ে দেয়, তার প্রভাব চলে যায়। এরপর সে তার সন্তানকে আদেশ করলে ও সন্তান তা হালকা করে দেখে।
  • তুমি কিভাবে কল্যাণময় হবে? শায়খ সা’দী রহ: আল্লাহর এই আয়াতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন: (وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنتُ) “এবং আমাকে করেছেন কল্যাণময়, আমি যেখানেই থাকি না কেন।”  [সুরা মারঈয়াম ১৯:৩১]

অর্থাৎ যেকোন এলাকায় ও যেকোন যামানায় আল্লাহ আমাদের কল্যাণ ও বরকত রেখেছেন, কল্যাণের শিক্ষাদান, তার প্রতি আহ্বান, অকল্যাণ থেকে বাঁধা দান এবং কথা ও কাজে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করার মধ্যেই। ফলে তখন যে ই তার নিকট বসবে বা তার সাথে মিলিত হবে, সে ই তার বরকত লাভ করবে এবং তার মাধ্যমে তার সাহচর্য গ্রহণকারীগণও সৌভাগ্যবান হবে।

  • উপদেশ দানের শর্তাবলী: উপদেশ দানের জন্য নিম্নোক্ত তিনটি বিষয় আবশ্যক: ১. আদেশ – নিষেধের পূর্বে ঐ বিষয়ের ইলম থাকা। কাযী আৰু ইয়ালা উল্লেখ করেন। একমাত্র সেই ব্যক্তিই সৎকাজের আদেশ বা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে, যে আদেশ – নিষেধকৃত বিষয়টির ব্যাপারে কুরআন – সুন্নাহর বুঝ রাখে।

২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধের মাঝে কোমলতা অবলম্বন করা। কারণ যেকোন বিষয়ের মধ্যে কোমলতা বিষয়টিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে।

৩. আমল বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকারের পরে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তা’আলা হযরত লুকমানের তার সন্তানের প্রতি প্রদত্ত উপদেশ বর্ণনা করত; বলেন;

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

হে বৎস, নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ। [ সুরা লুকমান ৩১:১৭ ]

وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنفُسِهِمْ

তারা নিজেদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়।  

[ সুরা হাশর ৫৯:৯ ]

আল্লামা সা’দী রহ: বলেন; আনসারদের যে বৈশিষ্ট্যটির মাধ্যমে তারা অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন এবং বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছেন, তা হল ‘ ইছার ‘ তথা অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া ।

 এটা হল সর্বোন্নতমানের দানশীলতা। আর তা হল নিজের প্রিয় সম্পদ বা অন্য কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নিজের শুধু প্রয়োজন না- বরং প্রচন্ড অভাব ও ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তা অন্যকে দান করা।

 এটা একমাত্র এমন পরিশুদ্ধ অন্তর ও আল্লাহ প্রেমের দ্বারাই হতে পারে, যা প্রবৃত্তির চাহিদা ও তার স্বাদ পুরা করার আগ্রহের উপর বিজয়ী হয়েছে।

 তার মধ্যে রয়েছে, জনৈক আনসারি সাহাবীর সেই ঘটনাটি, যার প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছে। যিনি তার নিজের ও স্ত্রী – সন্তানের খাবারের উপর মেহমানকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেরা ক্ষুধা নিয়ে রাত কাটান।

‘ইছার’ হল ‘আছারা (স্বার্থপরতা)’ র বিপরীত। তাই ইছার প্রশংসিত, কিন্তু আছারাহ তথা স্বার্থপরতা নিন্দি । কারণ এটা হল কার্পণ্য ও সংকীর্ণতার বৈশিষ্ট্য।

আর যে ইছারের গুণ লাভ করেছে,নিশ্চয়ই সে মনের লোভ -লালসা থেকে মুক্ত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ “ আর যারাতাদের অন্তরের কৃপণতা থেকে মুক্তি লাভ করেছে, তারাই সফল।” [ সুরা হাশর ৫৯:৯ ]

আর স্বভাবগত কার্পণ্য থেকে মুক্ত থাকলে আল্লাহর সকল হুকুমের ক্ষেত্রেই কার্পণ্যমুক্ত থাকা যায়। কারণ যখন কোন বান্দা স্বভাবগত কার্পণ্য থেকে মুক্ত হয়, তখন আল্লাহ ও তার রাসূলের সকল হুকুমের ব্যাপারেই তার মন উদার হবে। সে স্বতস্ফূর্ততা, আনুগত্য ও উদারতার সাথেই তা করবে। আর আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় তার প্রিয় ও আকর্ষণীয় হলেও তা বর্জন করতে পারবে।

  • সাহাবাদের ভ্রাতৃত্ব ও নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দানের কিছু নমুনা:

রাসূলুল্লাহ ﷺ এই সত্য ভ্রতৃত্বের বীজ আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে বপন করেছিলেন। সেদিনের কথা স্মরণ করুন, যেদিন জনৈক আনসারী তার মুহাজির ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন; এই রাখলাম আমার সম্পদ, তা আমার ও তোমার মাঝে যৌথ। এই রাখলাম আমার দুনিয়া, তার অর্ধেক আমার, অর্ধেক তোমার। এই যে আমার দুই স্ত্রী, তাদের মধ্য থেকে যে সুন্দর তাকে তালাক দিয়ে দিচ্ছি, সে তোমার।

 দেখুন, মিসকিনদের বাবা আবু জা’ফর রা: এর অবস্থা: তিনি আমাদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে চললেন খানা খাওয়াতে। অবশেষে সেই পাত্রটিও বের করলেন, যাতে কিছু ছিল না। তিনি সেটা খুললেন। আমরা তার মধ্যে যা ছিল তা চেটে খেলাম।

 আবু হুরায়রা রা: বলেন: হাদিসটি সহীহ বুখারীতে রয়েছে, তিনি বলেন: দানশীলতা হল যা বিদ্যমান আছে তা দান করা। মিসকিনদের জন্য সর্বোত্তম মানুষ হল জাফর। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বের হতেন। নিজের সন্তানদের খাবারের উপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মেহমানদের অগ্রাধিকার দিতেন।

  • তাবিয়ীদের কিছু ভ্রাতৃত্ব ও ইছারের নমুনা: তাবিয়ীদের একজন বড় ইমাম বলেন: আল্লাহর শপথ! যদি পুরো দুনিয়াকে আমার জন্য এক লোকমায় জমা করে দেওয়া হয়, আর আমার এক দ্বীনি ভাই আমার নিকট আসে, তাহলে আমি কোন পরওয়া না করে, তা তার মুখে দিয়ে দিবো।
  • ইছার করা (তথা অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কিসের প্রয়োজন? ইছার করার জন্য প্রয়োজন একটি কোমল হৃদয়। এমন একটি হৃদয় যাতে অজস্র চিন্তা একত্রিত হলেও সে সবগুলো নিয়েই চিন্তা করে। অবশেষে দুঃখ বেদনায় ফেটে পড়ে। প্রয়োজন এমন একটি হৃদয়, যা মুসলমানদের চিন্তা, পেরেশানীর ভার বহনের জন্য সুপ্রশস্ত।
  • মনের প্রিয় জিনিসগুলোর উপর আল্লাহর ভালবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া; এমনিভাবে আল্লাহর ভালবাসাকে মনের ভালবাসার বস্তুগুলোর উপর প্রাধান্য দেওয়া এবং আল্লাহ যা ভালবাসেন, তাকে প্রবৃত্তির ভালবাসার উপর প্রধান্য দেওয়াও ইছারের জন্য আবশ্যক। সুতরাং ইছার দু’টি জিনিসের দাবি করে:

১. আল্লাহ যা ভালবাসেন তা  করা, যদিও মন তা অপছন্দ করে। কখনো মন কোন একপ্রকার ইবাদতকে অপছন্দ করে, যেমন ধরুন, তার মধ্যে কার্পণ্য, স্বার্থপরতা বা অলসতা আছে, সেক্ষেত্রে প্রকৃত ইছার হবে নিজের অপছন্দের উপর আল্লাহর ভালবাসাকে প্রাধান্য দেওয়া।

২. ইছারের দ্বিতীয় প্রকার ; আল্লাহ যা অপছন্দ করেন, তা বর্জন  করা, যদিও তোমার মন তা পছন্দ করে ও ভালবাসে।

এ দু’টি জিনিসের মাধ্যমে সঠিক ইছার সাব্যস্ত হবে। কিন্তু যে মুমিন আল্লাহর ভালবাসার স্তরে পৌঁছতে চায় এবং আল্লাহর ভালবাসা নিজের দিকে আকর্ষণ করতে চায়, তাকে আরও কষ্ট করতে হবে এবং দুর্বল মনকে শায়েস্ত করতে হবে, যাতে এই স্তরে পৌঁছতে পারে এবং এরকম ইছার বাস্তবায়ন করতে পারে। তাই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য, মহা সফলতা লাভ করার জন্য এবং উচ্চ মেহনত ও ভয়াবহ বিপদ সহ্য করার জন্য কোমড় বাঁধতে হবে।

  • ইছারের মাধ্যমগুলো:

১. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং শুধু তার জন্যই আমল করা: যখন বান্দা কোনরূপ অলসতা ব্যতীত মনে প্রাণে আল্লাহর দিকে এগুতে চায়, যখন সে আখেরাতের দিকে দৌড়ায়, তখন সে নেক আমল ও ঈমান অর্জনকারী ইবাদতে কোন বিরতি দেয় না।

২. দয়া ও নম্রতা; দয়া ছাড়া কোন ইছার হয় না। একারণে কোন মানুষের অন্তর যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র, কোমল ও দয়াশীল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য ইছারকারী হওয়া সম্ভব নয়। যখন আল্লাহ কাউকে কঠোর হৃদয় থেকে মুক্তির মাধ্যমে দয়া করেন, ফলে তার অন্তর অপরের জন্য দুঃখ বেদনায় ফেটে পড়ে, তখন এই দয়ার মাধ্যমেই সে ইছার করতে পারে। যেটাকে আল্লাহ রহমত বলে উল্লেখ করেছেন। যার অর্থ হচ্ছে অন্তর নরম হওয়া।

তাই যার অন্তর কঠিন, সে তো ইছার থেকে অনেক দূরে; কঠিন হৃদয়ের অধিকারী তার অন্তরে ইছারের কোন পথ বা প্রমাণই খুজে পায় না।

 কারণ আল্লাহ তা’আলা যখন কোন বান্দাকে নরম – কোমল অন্তর দান করেন, তখন সে মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া থেকে নিজে বিরত থাকে ও অন্যদেরকে বিরত রাখে এবং এমন ব্যক্তি আল্লাহর মুমিন বান্দাদেরকে উপকার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

৩. মৃত্যু ও আখেরাতের স্মরণ ; এটা হল ইছারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এটাই অন্য মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া থেকে নিজেকে হেফাজত করার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তাদের প্রতি সর্বপ্রকার কল্যাণ পৌঁছাতে উৎসাহিত হওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

৪. বান্দার একথা স্মরণ করা যে, সে আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে; সে যখন এটা স্মরণ করবে, তখন তার নিকট দুনিয়া তুচ্ছ হয়ে যাবে আর পরকালীন ভবিষ্যৎ বড় হবে। সে মৃত্যু ও তার যন্ত্রণার কথা চিন্তা করবে, কবর ও তার শয্যার কথা চিন্তা করবে।

  • আল্লাহর প্রশংসা করা:

 আমাদের প্রভুর সঙ্গে আমাদের মুনাজাতে, দু’আয় ও সারা জীবনে আমাদের একটি ত্রুটি হল আমরা আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা কম করি, তার বড়ত্ব, মহত্ব ও পবিত্রতা কম বর্ণনা করি। অথচ তিনি আমদেরকে দ্বীনি ও দুনিয়াবী কত নেয়ামত দান করেছেন, যা গণনা ও অনুমানের বাইরে।

  • একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত: যদি এক ব্যক্তি তোমাকে প্রত্যেক মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দান করে, তার জন্য তোমার সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও বিভিন্ন মজলিসে অত্যধিক প্রশংসার অবস্থা কেমন হবে?! অথচ আল্লাহর জন্যই সর্বোচ্চ সম্মান। আমরা আমাদের প্রত্যহিক জীবনের একটি মুহূর্তও তার থেকে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারবো না। তাহলে কি এই মহান অনুগ্রশীল, দয়াশীল, দানবীর, রিযিকদাতা এবং বহু সুন্দর নাম ও উন্নত গুণাবলীর অধিকারী রব দিবা – রাত্রি , সর্বস্থানে ও সকল অবস্থায় প্রশংসা ও সম্মান পাবার উপযুক্ত নন?!
  • কুরআনে আল্লাহর প্রশংসা; আমরা যদি কুরআন যথাযথভাবে অনুধাবন করি, তাহলে দেখতে পাবো, পুরো কুরআনই আল্লাহ তা’আলার সত্ত্বা, তার নাম, গুণাবলী, কুদরত ও মহত্বের ব্যাপারেই আলোচনা। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে। [ সুরা যুমার ৩৯:৬৭ ]

আল্লাহ তা’আলা কুরআনের অনেক আয়াতে নিজেই তার পবিত্র ও বরকতময় সত্ত্বার পরিচয় তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি দেখুন :

)قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌاللَّهُ الصَّمَدُلَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْوَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ(

“বল, তিনি আল্লাহ একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই।” (সূরা ইখলাস)

وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا

“আল্লাহর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। তাই তেমারা সেগুলোর মাধ্যমে তাকে ডাক।” [ সুরা আরাফ ৭:১৮০ ]

بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ

তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, `হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। [ সুরা বাকারা ২:১১৭ ]

لِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“আসমানসমূহ, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, সবকিছুর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।” [ সুরা মায়েদা ৫:১২০ ]

هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

“তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই অভ্যন্তর। তিনি প্রতিটি বস্তুর ব্যাপারে অবগত।” [ সুরা হাদীদ ৫৭:৩ ]

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ

لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاء وَيَقْدِرُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তার মত কিছু নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। আকাশমণ্ডলী ও যমীনের যাবতীয়। চাবি তারই কর্তৃত্বে। তিনি যাকে ইচ্ছা রিযিক সম্প্রসারিত করে দেন এবং যাকে ইচ্ছা সংকোচিত করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রতিটি বস্তুর ব্যপারে অবগত।” [ সুরা শূরা ৪২:১১/১২ ]

قُل لِّمَنِ الْأَرْضُ وَمَن فِيهَا إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ قُلْ مَن بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ

(হে রাসূল! তাদেরকে) বল, এই পৃথিবী এবং যারা এতে বাস করছে তারা কার মালিকানায়, যদি তোমরা জান? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? বল কে সাত আকাশের মালিক এবং মহা আরশের মালিক? তারা অবশ্যই বলবে, এসব আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা আল্লাহকে) ভয় করবে না? বল, কে তিনি , যার হাতে সব কিছুর কর্তৃত্ব এবং যিনি আশ্রয় দান করেন এবং তার বিপরীতে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না? বল, যদি জান? তারা অবশ্যই বলবে (সমস্ত কর্তৃত্ব) আল্লাহর। বল, তবে কোথা হতে তোমরা যাদুগ্রস্ত হচ্ছে? সুরা মু’মিনুন ২৩:৮৪-৮৯ ]

)تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ(

কল্যাণময় সেই সত্তা,যার হতে সমস্ত রাজত্ব। তিনি প্রতিটি বিষয়ে ক্ষমতাবান। [ সুরা মুলক ৬৭:১ ]

هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاء الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি গুপ্ত ও প্রকাশ্য সবকিছুর জ্ঞাত। তিনি সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু। তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি বাদশা, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, সকলের রক্ষক, মহা ক্ষমতাবান, সকল দোষ – ত্রুটির সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত। তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। তিনিই আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিকর্তা, অস্তিত্বদাতা, রূপদাতা, সর্বাপেক্ষা সুন্দর নামসমূহ তারই, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা তারই তাসবীহ পাঠ করে এবং তিনিই ক্ষমতাময় , হেকমতের মালিক। [ সুরা হাশর ৫৯:22-২৪ ]

এছাড়াও রয়েছে কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত, আয়াতুল কুরসী। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই আল্লাহর প্রশংসা।

 তিনি নিজের বিভিন্ন গুণ বর্ণনা করেন। তিনি সর্বোত্তম সাহায্যকারী, সকল দয়াশীলদের শ্রেষ্ঠ দয়াশীল, সর্বশ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল, সর্বোত্তম বিচারক, সর্বোত্তম রিযিকদাতা, সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ মিমাংসাকারী, সর্বশ্রেষ্ঠ অবতরণকারী।

  • হাদিসে আল্লাহর প্রশংসা; রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন; আল্লাহ হতে অধিক প্রশংসাপ্রিয় কেউ নেই। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী ও মুসলিম)

ইমাম নববী রহ: বলেন: প্রকৃতপক্ষে এতে বান্দারই উপকার। কারণ তারা আল্লাহর প্রশংসা করলে আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কার দান করেন, ফলে তারা উপকৃত হয়। আর আল্লাহ তা’আলা জগতবাসী থেকে অমুখাপেক্ষী। তাদের প্রশংসা তার কোন উপকার আসে না, আর তাদের নিন্দাও তার কোন ক্ষতি করে না। এই হাদিসে আল্লাহর প্রশংসা, তাবসীহ, তাহলীল, তাহমীদ, তাকবীর ও সকল প্রকার যিকরের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নবী ﷺ বলেন:  ألظواب ياذا الجلال والإكرام “সর্বদা ইয়া জালজালালে ওয়াল ইকরাম বলতে থাকো।” অর্থাৎ সর্বদা বেশি বেশি বল এবং তোমাদের দু’আর মধ্যে তা উচ্চারণ কর।

জনৈক গ্রাম্য লোক নবী ﷺ এর নিকট এসে বলল: আমাকে কিছু দু’আ শিক্ষা দিন, যাতে আমি পড়তে পারি। নবী ﷺ বললেন; বল

لا إله إلا الله وحده لا شريك له الله أكبر كبيرا والحمد لله كثيرا سبحان الله رب العالمين لا حول ولا قوة إلا بالله العزيز الحكيم

“আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক। তার সাথে কোন শরীক নেই। আল্লাহ মহান। অফুরন্ত প্রশংসা তার জন্য। তিনি পবিত্র। জগতসমূহের প্রতিপালক। পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ব্যতীত সাহায্য বা শক্তির কোন উৎস নেই।” লোকটি বলল; এগুলো তো আমার রবের জন্য, তাহলে আমার জন্য কি? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: বল- اللهم اغفرلي وارحمني واهدني وارزقني “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে পথপ্রদর্শন করুন এবং আমাকে রিযিক দান করুন।” (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম)

এই হাদিসে শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা আর শেষে নিজের জন্য দু’আ।

 বিপদের দু’আ:

لا إله إلا الله العظيم الحليم , لا إله إلا الله رب العرش العظيم , لا إله إلا الله وب السماوات ورب الأرض ورب العرش الكريم

আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যিনি মহান , সহনশীল । আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যিনি মহান আরশের অধিপতি। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যিনি আকাশম – লীর রব, পৃথিবীর রব এবং সম্মানিত আরশের রব (বুখারী মুসলিম)

নামাযে আল্লাহর প্রশংসাগুলোর ব্যাপারে চিন্তা কর;

 যা নামাযের নিম্লোল্লেখিত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে :

১. নামাযের তাহরীমা বাঁধার তাকবীর ও এক রুকন থেকে আরেক রুকনে যাওয়ার তাকবীর: যখন বল, আল্লাহু আকবার, তাতে আল্লাহর মহত্ব এবং সবকিছু থেকে তার বড় হওয়ার কথা রয়েছে।

২. নামায শুরুর দু’আ

سبحانك اللهم وبحمدك , وتبارك اسماك , و تعالى جدك , ولا إله غيرك

“হে আল্লাহ! তোমার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি। তোমার নাম বরকতময়। তোমার মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে এবং তুমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই।”

تعالى جدك মানে হচ্ছে তোমার মর্যাদা, মহত্ব ও ক্ষমতা সুউচ্চ ।

৩. ‘আউযু বিল্লাহ’। অথাৎ আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। মানুষ তো একমাত্র তার নিকটই আশ্রয় প্রার্থনা করে, যাকে সে শক্তিশালী ও ক্ষমতাশীল মনে করে।

৪. বিসমিল্লাহ। এখানে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা, তার উপর ভরসা এবং তার রহমান (পরম দয়ালু) ও রহীম (সীমাহীন মেহেরবান) নামের উল্লেখ রয়েছে।

৫. ফাতিহা। তার প্রথম তিনটি আয়াতের মধ্যে আল্লাহর প্রশংসা, ও গুণকীর্তন রয়েছে। যা হচ্ছে- (الْحَمْدُ للّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ الرَّحْمـنِ الرَّحِيمِ مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ)“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। যিনি সীমাহীন দয়ালু, বড়ই মেহেরবান। বিচার দিবসের মালিক।”

৬. রুকুর যিকরসমূহ:

سبحان ربي العظيم“আমার মহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি”

 سبوح, قدوس, رب الملائكة والروح“তিনি পবিত্র, ফেরেশতা ও রূহের রব।”

 سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي”হে আল্লাহ, হে আমাদের রব! তোমার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও”

 سبحان ذي الجبروت, والملكوت, والكبرياء, والعظمة“ পরাক্রম, রাজত্ব, বড়ত্ব ও মহত্বের অধিকারী আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”

৭. রুকু থেকে উঠার দু’আসমূহ:

 سمع الله لمن حمده”যে আল্লাহর প্রশংসা করছে, আল্লাহ তা শুনছেন।

 ربنا ولك الحمد, حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه”হে আমাদের রব! তোমার অফুরন্ত প্রশংসা করছি, উত্তম ও বরকমতয় প্রশংসা।

))رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ، مِلْء السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ، وَمِلْء مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ، أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ، أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْدُ، وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ، اللَّهُمَّ لا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ((.

আকাশমন্ডলীর সমপরিমাণ, পৃথিবীর সমপরিমাণ ও এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু আছে তার সমপরিমাণ এবং এছাড়াও আপনি যা চান তার সমপরিমাণ। প্রশংসা ও মর্যাদার অধিকারী। বান্দা যা বলেছে , তার সর্বাধিক উপযুক্ত সত্তা। আর আমরা সবাই তোমার দাস। হে আল্লাহ! তুমি যা দান কর, তা ঠেকাবার কেউ নেই আর তুমি যা ঠেকাও তা দান করার কেউ নেই। তোমার শক্তির বাইরে কোন প্রচেষ্টাকারীর প্রচেষ্টা উপকারে আসবে না।

৮ , সিজদার দু’আ সমূহ:

سبحان ربي الأعلي “ আমার মহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”

سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي“হে আল্লাহ! তোমার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি। হে আমাদের রব! হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর।”

 سبوح, قدوس,رب الملاؤكة والروح“ তিনি পবিত্র, ফেরেশতা ও রূহের রব।”

اللهم لك سجدت وبك آمنت ولك أسلمت، سجد وجهي للذي خلقه وصوره وشق سمعه وبصره تبارك الله أحسن الخالقين

“হে আল্লাহ! তোমার জন্যই সিজদাহ করেছি, তোমার প্রতিই ঈমান এনেছি এবং তোমার নিকটই আত্মসমর্পণ করেছি। আমার চেহারা সেই সত্তার জন্য সেজদাহ করেছে, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তার আকৃতি দান করেছেন এবং তার কর্ণ ও চক্ষু ফেড়েছেন। আল্লাহ বরকতময়। তিনি সর্বোত্তম সৃষ্টিকারী।”

سبحان ذي الجبروت والملكوت والكبرياء والعظمة “ পরাক্রম, রাজত্ব, বড়ত্ব ও মহত্বের অধিকারী আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”

৯. তাশাহুদ :

التحيات لله والصلوات والطيبات، السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته، السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين،أشهد أن لاإله إلا الله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله

 সমস্ত শান্তি, রহমত ও কল্যাণ আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার প্রতি আল্লাহর সালাম, রহমত ও বরকত। সালাম আমাদের উপর এবং আল্লাহর সকল নেককার বান্দাদের উপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তার বান্দা ও তার রাসূল।

ইমাম নববী রহ: বলেন: التحيات এর অর্থ কেউ বলেন: রাজত্ব, কেউ বলেন: স্থায়িত্ব, কেউ বলেন: সম্মান, কেউ বলেন: জীবন।

১০. দরূদে ইবরাহিমির শেষাংশে রয়েছে- إنك حميد مجيد “নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত ও মর্যাদাময়“। এখানে আল্লাহর অফুরন্ত প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে।

তাহলে তুমি নামাযে তোমার অন্তর, যবান ও অঙ্গ – প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করছে। তাই এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখবে। ঐ সকল উদাস ও অসাড় লোকদের মত হবে না, যারা নামাযের মধ্যে কি বলছে, তা নিজেও জানে না। যারা এ সমস্ত যিকর ও দুআগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করে না।

  • সালাম পরবর্তী আল্লাহর প্রশংসাসমূহ:

কেউ এগুলো যথাযথভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাবে, তাতে শুধু আল্লাহর প্রশংসাই প্রশংসা!

(ثلاثا) أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ

আস্তাগফিরুল্লাহতথা আমি আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি..(তিনবার)।

اللّٰهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ، وَمِنْكَ السَّلاَمُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ

হে আল্লাহ! আপনি শান্তিময়। আপনার নিকট থেকেই শান্তি বর্ষিত হয়। আপনি বরকতময়, হে মহিমাময় ও সম্মানের অধিকারী!

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ،

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

তারপর,

اللّٰهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الجَدُّ

হে আল্লাহ, আপনি যা প্রদান করেছেন তা বন্ধ করার কেউ নেই, আর আপনি যা রুদ্ধ করেছেন তা প্রদান করার কেউ নেই। আর কোনো ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অধিকারীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আপনার কাছে কোনো উপকারে আসবে না।

لَا إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللّٰهِ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ، وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ، لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لَا إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ وَلَوْ كَرِهَ الكَافِرُوْنَ

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি নেই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করি, নেয়ামতসমূহ তাঁরই, যাবতীয় অনুগ্রহও তাঁর এবং উত্তম প্রশংসা তাঁরই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, আমরা তাঁর দেয়া দ্বীনকে একনিষ্ঠভাবে মান্য করি, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।

(ثلاثاوثلاثين) سُبْحَانَ اللّٰهِ، وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ، وَاللّٰهُ أَكْبَرُ

সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, ও আল্লাহু আকবার। (তেত্রিশবার করে)

আল্লাহ কতই না পবিত্র-মহান। সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য। আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

তারপর বলবে,

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

لَا إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তারই এবং সকল প্রশংসা তাঁর। তিনিই জীবিত করেন এবং মৃত্যু দান করেন। আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

قراءة آية الكرسي.وسورة الإخلاص والمعوذتين

আয়াতুল কুরসী।সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস।

সকাল – সন্ধ্যার যিকরগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা দেখুন:

সকাল – সন্ধ্যার যিকরগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা, সম্মান ও বড়ত্ব প্রকাশক অনেক দু’আ ও যিকর রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন:

سيد الاستغفار : اللهم أنت ربي لا إله أنت ، خلقتني وأنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت ، أعوذ بك من شر ما صنعت ، أبوء لك بنعمتك علي , وأبوء بذنبي فاغفر لي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت

اللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك فمنك وحدك لا شريك لك فلك الحمد ولك الشكر

حسبي الله لا إله إلا هو عليه توكلت وهو رب العرش العظيم – (سبع مرات)

سبحان الله و بحمده ( مائة مرة)

لا إله إلا الله وحده لا شريك له ، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء  قدير – ( مائة مرة إذا أصبح)

اللهم عالم الغيب والشهادة فاطر السماوات والأرض ورب كل شيء و ملیکه

أشهد أن لا إله إلا أنت ، أعوذ بك من شر نفسي , ومن شر الشيطان وشركه  وأن أقترف على نفسي سوءا , أو أجره إلى مسلم ،(وإلى غير ذلك من أذكار الصباح والمساء

সায়্যিদুল ইস্তেগফার: হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো, আমি তোমার বান্দা। আমি আমার সাধ্যমত তোমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার উপর থাকবো। আমি আমার মন্দ কৃতকর্মসমূহ থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং তোমার প্রতিই প্রত্যাবর্তন করছি, যেহেতু তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছে। আমি আমার গুনাহসমূহের কারণেও তোমার প্রতি প্রত্যাবর্তন করছি। তাই তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি ছাড়া তো ক্ষমা করার আর কেউ নেই।

হে আল্লাহ! এই সকাল বেলা আমার উপর এবং তোমার প্রতিটি সৃষ্টির উপর যত নেয়ামত এসেছে, তা কেবল তোমার থেকেই। তোমার সাথে কোন শরীক নেই। আর কৃতজ্ঞতা তোমারই জ্ঞাপন করছি।

আমার জন্যই আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি তার উপরই ভরসা করেছি, তিনিই মহান আরশের রব। (সাত বার)

সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি (আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি) (একশত বার)

আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক। তার সাথে কোন শরীক নেই। রাজত্ব তারই। প্রশংসা শুধু তারই জন্য। তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর ক্ষমতাবান। (সকাল বেলা একশত বার)

হে আল্লাহ! দৃশ্য ও অদৃশ্য বিষয়ের ইলমের অধিকারী! আসমান – যমীন সৃষ্টিকারী! প্রতিটি জিনিসের প্রতিপালক ও মালিক! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমাদের অন্তরের অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্ট ও তার শিরক থেকে এবং আমার নিজেকে কোন অকল্যাণে লিপ্ত করা থেকে বা কোন মুসলিমের প্রতি তা টেনে আনা থেকে।

সকাল সন্ধ্যার এজাতীয় আরো অনেক যিকির রয়েছে।

  • ঘুমের পূর্বের যিকরগুলোতে আল্লাহর প্রশংসার কথাগুলো চিন্তা করুন

– আয়াতুল কুরসী।

اللهم رب السماوات السبع ورب الأرض , ورب العرش العظيم , ربنا ورب كل شيء , فالق الحب والنوى , ومنزل التوراة والإنجيل , والفرقان , أعوذ بك من شر كل شيء أنت آخذ بناصيته . اللهم أنت الأول فليس قبلك شيء , وأنت الآخر فليس بعدك شيء , وأنت الظاهر فليس فوقك شيء , وأنت الباطن فليس دونك شيء , اقض عنا الدين وأغتنا من الفقر

“হে আল্লাহ! সপ্তাকাশ ও পৃথিবীর রব, মহান আরশের রব, আমদের ও প্রতিটি সৃষ্টির রব, (বীজের) দানা ও খোসা বিদীর্ণকারী, তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআন অবতীর্ণকারী! তোমার হাতে যাদের ভাগ্য এমন প্রতিটি জিনিসের অনিষ্ট থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তুমিই প্রথম, তোমার পূর্বে কোন কিছু নেই। তুমিই সর্বশেষ, তোমার পরে কিছু নেই। তুমিই বিজয়ী, তোমার উপরে কেউ নেই। তুমিই অভ্যন্তরে, তোমার নীচে কেউ নেই। তুমি আমাদের ঋণ পরিশোধ করে দাও, আমাদেরকে দারীদ্র থেকে মুক্ত কর।”

– সুবহানাল্লাহ তেত্রিশ বার, আলহামদু লিল্লাহ তেত্রিশ বার এবং আল্লাহু আকবার চৌত্রিশ বার।

  • আমরা আল্লাহর প্রশংসা গুণে শেষ করতে পারব না:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সেজদার একটি দু’আ ছিল এই :

اللهم إني أعوذ برضاك من سخطك وبمعافاتك من عقوبتك وأعوذ بك منك لا أحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك

“হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির মাধ্যমে তোমার অসন্তুষ্টি থেকে এবং তোমার ক্ষমার মাধ্যমে তোমার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই। আমি তোমার শাস্তি থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি। আমি তোমার প্রশংসা গুণে শেষ করতে পারব না, তুমি সেই রূপই, যেরূপ তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে বর্ণনা করেছো।”

ইমাম মালেক রহ: বলেন: لا أحصي ثناء عليك এর অর্থ হল: আমরা যদি তোমার প্রশংসায় খুব পরিশ্রমও করি, তথাপি তোমার নেয়ামত, অনুগ্রহ ও তার যথোচিত প্রশংসা গুণে শেষ করতে পারবো না।

  • আপনি কি জানেন, নিম্নোক্ত কথাগুলো বলাও আল্লাহর প্রশংসা

لا اله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين 

তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই তুমি পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম

لا حول ولا قوة إلا بالله

আল্লাহর সাহায্য ও শক্তি ব্যতীত কোন সাহায্য ও শক্তি নেই।

سبحان الله و بحمده سبحان الله العظيم

আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি। মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।

سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر

আল্লাহ পবিত্র, সমস্ত প্রশংসা তার জন্য, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আল্লাহই সবচেয়ে বড়।

  • তোমার অন্তরে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে নাও:

১. তুমি জানবে এবং নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করবে যে, যিনি সমস্ত সৃষ্টির মালিক, সৃষ্টির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করেন, তিনিই আল্লাহ, তিনি একক। তার সাথে কোন শরীক নেই। তাই আসমান – যমীনে ছোট – বড় যত সৃষ্টি আছে সকলেই আল্লাহর দাস, তার প্রতি মুখাপেক্ষী। তারা নিজেদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। তারা জীবন, মৃত্যু বা পুনরুত্থানের ক্ষমতাও রাখে না। তাই একমাত্র আল্লাহই তাদের সকলের মালিক। তারা তার প্রতি মুখাপেক্ষী, তিনি তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী। তিনি পবিত্র।

২. তুমি আরও জানবে ও বিশ্বাস করবে যে, সমস্ত কিছুর ভান্ডার এককভাবে আল্লাহর নিকট। অন্য কারো নিকট নয়। তাই দুনিয়াতে যত কিছু আছে তার মূল ভান্ডার আল্লাহর নিকট। খ্যাদ্য, পানীয়, পানি, বাতাস, ধন – সম্পদ, সমুদ্র ও অন্যান্য সকল জিনিস আল্লাহর নিকট রয়েছে। তাই আমাদের যত কিছুর প্রয়োজন হবে, আমরা তা আল্লাহর নিকট চাইবো, তার বেশি বেশি ইবাদত ও আনুগত্য করবো। তিনিই সমস্ত প্রয়োজন পুরাকারী এবং আহ্বানে সাড়াদানকারী। তিনিই সর্বোত্তম প্রার্থনাস্থল ও সর্বোত্তম দানকারী। তিনি যা দেন, তা রোধকারী কেউ নেই এবং তিনি যা রোধ করেন, তা দানকারী কেউ নেই।

৩. তুমি একথাও জানবে ও বিশ্বাস করবে যে, একমাত্র আল্লাহই প্রকৃত উপাস্য, তার সাথে কোন শরীক নেই। এককভাবে তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত। তাই তিনিই । জগতবাসীর প্রতিপালক ও উপাস্য। আমরা পরিপূর্ণ বিনয়, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে তার বিধিবদ্ধ বিধানাবলী মান্য করত; তারই ইবাদত করবো। সুতরাং অন্য কারো নিকট প্রার্থনা করবে না, একমাত্র তার নিকটই প্রার্থনা করবে। অন্য কারো নিকট সাহায্য চাইবে না, একমাত্র তারই নিকট সাহায্য চাইবে। অন্য কারো উপর ভরসা করবে না, একমাত্র তার উপরই ভরসা করবে। অন্য কাউকে ভয় করবে না, একমাত্র তাকেই ভয় করবে। অন্য কারো ইবাদত করবে না, একমাত্র তারই ইবাদত করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি প্রতিটি জিনিসের সৃষ্টিকর্তা। তাই তোমরা তারই ইবাদত করো। তিনিই প্রতিটি জিনিসের উপর নিয়ন্ত্রক।

দেখ, চিন্তা কর এবং অনুধাবন কর, কিভাবে একজন মুসলিম তার প্রতিটি দিনে এবং পুরো জীবনে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত প্রতিটি অবস্থায় ও প্রতিটি কাজে আল্লাহর সুন্দর নাম, উন্নত গুণাবলী এবং অগণিত ও অসংখ্য নেয়ামতরাজী উল্লেখ পূর্বক তার প্রশংসা ও বড়ত্ব বর্ণনা করছে।

এই যে বাক্যগুলো, যিকর ও দুআগুলো, প্রতিদিন বার বার পাঠ করছে: তুমি কি তার ব্যাপারে চিন্তা করছো, নাকি অবচেতনভাবে শুধু বলে যাচ্ছো?

  • কিভাবে তুমি দীর্ঘ সিজদাহ করবে?

দীর্ঘ সিজদাহ আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক থাকা এবং তার সঙ্গে মুনাজাত ও ঘনিষ্টতার স্বাদ প্রাপ্তির ইঙ্গিত করে। আর এর বিপরীতটা বিপরীতটার ইঙ্গিত করে।

সহীহুল বুখারীতে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে : রাসূলুল্লাহ ﷺ এগার রাকাত নামায পড়তেন। ঐ নামাযগুলোতে তিনি এতটুকু দীর্ঘ সিজদাহ করতেন যে, তার মাথা উঠানোর পূর্বেই তোমরা পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ পড়তে পারবে।

 রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে সিজদাহ দীর্ঘ করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন: বান্দা তার রবের সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয় সিজদাবস্থায়। তাই তোমরা (সিজদার মধ্যে) বেশি বেশি দু’আ কর। (বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম রহ:)

এটি একটি দামি ও সোনালী সুযোগ: দুর্বল অযোগ্য ও গুনাহগার বান্দা এই অবস্থায় আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। তাই তোমার উচিত সিজদাহ দীর্ঘ করা এবং সকল প্রয়োজন পুরাকারী, আহ্বানে সাড়াদানকারী, সর্বোত্তম প্রার্থনাস্থল ও সর্বোত্তম দানকারী আল্লাহর নিকট বেশি পরিমাণে দু’আ ও মিনতি করা এবং তোমার দুঃখ, ব্যাথা ও অভিযোগগুলো খুলে বলা।

  • সিজদাহ দীর্ঘ করার কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ: দু’আ করার সময় কিছু বিষয় দায়িকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে সিজদাহ দীর্ঘ হয় এবং আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাত, ঘনিষ্ঠতা এবং দীনতা ও মুখাপেক্ষীতা প্রকাশের স্বাদ লাভ করা যায়। উক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে:

১. দু’আ করার সময় আল্লাহর প্রশংসার কথা স্মরণ করা। আমরা পূর্বের আলোচনায় আল্লাহর প্রশংসার ব্যাপারে আলোচনা করেছি। অনেক আছে, দু’আর মধ্যে তার দ্বীনী ও দুনিয়াবী প্রয়োজনাদীর কথায় ব্যস্ত থাকে, কিন্তু এটা অনুধাবনও করে না যে, তার দু’আর বিরাট একটি অংশ দখল করে আছে আল্লাহর প্রশংসা। উলামায়ে কেরাম এও উল্লেখ করেছেন যে, দু’আ কবুলের মাধ্যমগুলোর মধ্যে একটি হল আল্লাহর প্রশংসা করা ও তার মর্যাদা বর্ণনা করা এবং দু’আর মধ্যে আল্লাহর দীর্ঘ প্রশংসা করতে বিরক্ত বা ক্লান্ত না হওয়া। কারণ আল্লাহ আমাদেরকে অগণিত নেয়ামতের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছেন।

২. দু’আর মধ্যে তোমার পূর্বের বর্তমানের গুনাহগুলো স্মরণ করা এবং ভবিষ্যতে তাতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে আশংকা করা। অতঃপর আল্লাহর নিকট দু’আ করা যেন আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেন। সহীহ মুসলিমে এসেছে, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’আ করেছেন:

اللهم إني أعوذبك من شر ما عملت ومن شر ما لم أعمل

হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার কৃত অন্যায় কর্ম থেকে এবং যেগুলো এখনো করিনি, তা থেকে পানাহ চাই।” মুহাদ্দিসগণ বলেন: এর অর্থ হল, যে সমস্ত গুনাহ আমি করে ফেলেছি , যেগুলো দুনিয়াতেই শাস্তির দাবি করে অথবা আখেরাতে শাস্তি দাবি করে, যদিও বা আমি তার ইচ্ছা করেনি, সেগুলোও ক্ষমা করে দাও।

রাসূলুল্লাহ ﷺ  থেকে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত আছে, তিনি এই দু’আ করতেন-

اللهم اغفرلي ذنبي كله, دقه وجله, وأوله وآخره وعلانيته وسره

হে আল্লাহ! আমি ছোট – বড়, শুরুতে – শেষে , প্রকাশ্যে – গোপনে যত গুনাহ করেছি, সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও।”

৩. দু’আর মধ্যে কুরআনে বর্ণিত দু’আগুলো করবে। যেমন:

ربنا تقبل منا انك انت السميع العليم

হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী।

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

“হে আমাদের রব! আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী – সন্তান দান কর আর আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম বানাও” (দেখুন, কাহতানীর ছোট্ট দু’আর কিতাবটি)

৪. দু’আর মধ্যে রাসূলুল্লাহ  ﷺ যেসকল ব্যাপক অর্থবোধক দু’আ করেছেন, সেগুলো দিয়ে দু’আ করবে। যেমন:

اللهم إني أسألك من الخير كله : عاجله وآجله ، ما علمت منه وما لم أعلم ، وأعوذ بك من الشر كله عاجله وآجله ، ما علمت منه وما لم أعلم ، اللهم إلي أسألك من خير ما سألك عبدك ونبيك ، وأعوذ بك من شر ما استعاذ بك منه عبدك ونبيك ، اللهم إني أسألك الجنة ، وما قرب إليها من قول أو عمل ، وأعوذ بك من النار وما قرب إليها من قول أو عمل ، وأسألك أن تجعل كل قضاء قضيته لي خيرا

হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট নগদ, বিলম্বিত , জানা – অজানা সকল কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আমি তোমার নিকট তাৎক্ষণিক বা পরবর্তী জানা অজানা সকল অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তোমার নিকট সেই বস্তু কামনা করছি, যা তোমার বান্দা ও তোমার নবী তোমার নিকট প্রার্থনা করেছে এবং আমি তোমার নিকট সেই বস্তু থেকে আশ্রয় চাচ্ছি , যা থেকে তোমার নবী তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট জান্নাত ও যে সকল কথা ও কাজ জান্নাতের নিকটবর্তী করবে, তার তাওফীক প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট জাহান্নাম ও যেসকল বিষয় জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে, তা থেকে আশ্রয় কামনা করছি। আর আমি প্রার্থনা করি যে, তুমি আমার জন্য সকল কল্যাণের ফায়সালা কর।

اللهم أصلح لي ديني الذي هو عصمة أمري ، وأصلح لي دنياي التي فيها معاشي ، وأصلح لي آخرتي التي فيها معادي ، واجعل الحياة زيادة لي في كل خير ، و اجعل الموت راحة لي من كل شر

হে আল্লাহ! আমাকে এমন দ্বীনদারী দান কর, যা আমার একমাত্র রক্ষাকবচ। আমার জন্য আমার দুনিয়ার সুব্যবস্থা করে দাও, যার দ্বারা আমি জীবিকা নির্বাহ করবো। আমার জন্য আমার আখেরাত সংশোধন করে দাও, আমার। প্রত্যাবর্তনস্থল। আমার বেঁচে থাকাকে সর্বপ্রকার কল্যাণ বৃদ্ধিকারী বানাও। আর আমার মৃত্যুকে সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে প্রশান্তি স্বরূপ বানাও।

اللهم آتنا في الدنيا حسنة , وفي الآخرة حسنة, وقنا عذاب النار-

হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর, আখিরাতে কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর।

اللهم إني أسألك العفو العافية في الدنيا والآخرة-

হে আল্লাহ! তোমার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষমা ও নিরাপত্তা চাই।

يا حي يا قيوم برحمتك أستغيث أصلح لي شأني كله ولا تكلني إلى نفسي طرفة عين لا إله إلا أنت

হে চিরঞ্জীব, সদা প্রতিষ্ঠিত! তোমারই রহমতের আশ্রয় চাই। আমার জন্য আমার সকল অবস্থা সংশোধন করে দাও। এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের দায়িত্বে সপে দিও না। তুমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই।

এই দু’আগুলো তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল চাহিদাগুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই এগুলোই হল ব্যাপক, পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্তকারী। তাই এগুলোর প্রতি যত্নবান হও। সর্বদা তোমার দুয়ার মধ্যে এগুলো বারবার পড়তে থাক। তাহলেই তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হতে পারবে।

৫. তোমার অন্তর ও নিয়্যতের অবস্থা স্মরণ করবে, অতঃপর সর্দা আল্লাহর নিকট দু’আ করবে, যেন আল্লাহ তোমার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেন। তাকে রিয়া (লোক দেখানো), বিদ্বেষ, অহংকার, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে পবিত্র করেন এবং তোমার নিয়্যত সঠিক করে দেন। ফলে তুমি একমাত্র আল্লাহর জন্যই আমল করতে পার। দুনিয়া উপার্জনার জন্য, প্রশংসা কুড়ানোর জন্য বা পদ লাভের জন্য আমল না কর।

 “ রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি দু’আ করতেন:

اللهم مصرف القلوب صرف قلوبنا علي طاعتك

হে আল্লাহ! অন্তরসমূহ নিয়ন্ত্রণকারী! আমাদের অন্তরগুলোকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরাও।

আরও বলতেন:

يا مقلب القلوب ثبت قلبي علي دينك

হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরগুলোকে তোমার দ্বীনের উপর অটল রাখ ।

 কারণ আল্লাহর নিকট মানুষের মূল্য তার অন্তরের পবিত্রতা, সচ্ছতা, নিষ্ঠা ও সততার ভিত্তিতে।

৬. তোমার নিপীড়িত ও বন্দী ভাইদের কথা স্মরণ করবে, তারপর তাদের জন্য দু’আ করবে, যেন আল্লাহ তাদেরকে সকল পেরেশানী থেকে মুক্তি দান করেন, সকল সংকট থেকে উত্তরণ করেন, তাদের অন্তরকে দৃঢ় করে দেন এবং তাদের একাকিত্বের সঙ্গী হন ।

 নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন: কোন মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতে দু’আ করলে তা কবুল হয়। তার শিয়রে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দু’আ করে, তখন উক্ত নিযুক্ত ফেরেশতা বলে: আমীন! আল্লাহর তোমার জন্যও এমনটা কবুল করুন! (সহীহ মুসলিম)

আর যে তার মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতে দু’আ করে, সে তার চেতনায় ও অনুভূতিতে উন্নতি অনুভব করবে। কারণ এই ব্যক্তি শুধু তার ব্যক্তিকে নিয়েই চিন্তা করে না, বরং সমস্ত মুসলিমদেরকে নিয়ে চিন্তা করে।

৭. আল্লাহর নিকট জান্নাতের উচ্চস্তর লাভের জন্য দু’আ করবে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: জান্নাতে ১০০ টি মর্যাদার স্তর রয়েছে। যা আল্লাহ তার পথের মুজাহিদদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। প্রতি দুই স্তরের মাঝে আসমান – যমীন দূরত্ব। তাই তোমরা যখন আল্লাহর নিকট দু’আ করবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউসের দু’আ করবে। কারণ এটাই জান্নাতের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান । এর উপর হল দয়মায়ের আৱশ। আর সেখান থেকেই জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী)

হে ভাই! তোমার বেশি আমল ও বেশি ইবাদতের উপর ভরসা করো না। এটার দিকে লক্ষ্যও করো না। বরং আল্লাহর ব্যাপক রহমত, উদারতা, অনুগ্রহ, দানশীলতা ও ইহসানের কথা স্মরণ করো। কারণ তিনিই পরম দয়ালু, উদার, দানশীল ও মহা অনুগ্রহকারী।

৮. দু’আ তিনবার করে করবে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দু’আ করতেন, তিনবার করে করতেন। কোন কিছু চাইলে তিনবার করে চাইতেন। (বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী রহ.)

এতে বুঝা গেল, দু’আ তিনবার করে পুনরাবৃত্তি করা পছন্দনীয়।

 দু’আ পুনরাবৃত্তি করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহর নিকট যা আছে, তার প্রতি তোমার আগ্রহ, আশা ও লোভ অনেক বেশি। আর আল্লাহ তা’আলা তার নেয়ামতরাজীর ব্যাপারে বান্দার দৃঢ় আশাকে ভালবাসেন।

৯. তোমার মুসলিম ভাইদের জন্য ক্ষমার দু’আ করবে। হাদিসের মধ্যে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন; যে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর পক্ষ থেকে তার জন্য একটি করে সওয়াব লিখেন। (বর্ণনা করেছেন ইমাম তাবারানী।)

এতে তাদের জন্য বিরাট পুরস্কারের কথা বলা হল, যারা জীবিত – মৃত সকল মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তাহলে এটা যদি তিনবার করে। পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে সওয়াব কেমন হতে পারে!? কতজনের পক্ষ থেকে তার নেক লাভ হতে পারে…?!

জ্ঞাতব্য: প্রিয় ভাই! আত্মীয় – স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহারের একটি প্রকার হল; তাদের জন্য দু’আ করা। তাই সর্বদা তাদের জন্য দু’আ করতে ভুলবে না। অনেক দু’আকারীই এ বিষয়টিতে উদাস।

১০. নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত বিষয় থেকে আশ্রয় চাইতেন , তুমিও সেসকল বিষয় থেকে আশ্রয় কামনা করবে। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ দু’আ করতেন ;

اللهم إني أعوذ بك من العجز,والكسل, والجبن, والبخل, والهرة, وعذاب القبر, اللهم آت نفسي تقواها, وزكها أنت خير من زكاها. أنت وليها ومولاها . اللهم إني أعوذ بك من علم لا ينفع, ومن قلب لايخشع, ومن نفس لا تشبع, ومن دعوة ال يستجاب لها

“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কার্পণ্য, বার্ধক্য ও কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমার নফসকে তার উপযুক্ত তাকওয়া দান কর এবং তাকে পরিশুদ্ধ কর। তুমিই তো সর্বোত্তম পরিশুদ্ধকারী। তুমিই তার অভিভাবক ও দায়িত্বশীল। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন ইলম থেকে, যা উপকৃত করে না, এমন অন্তর থেকে, যা ভয় করে না, এমন নফস থেকে, যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দু’আ হতে, যা গৃহিত হয় না।

اللهم إني أعوذ بك من زوال نعمتك , وتحول عافيتك, وفجاءة نقمتك, وجميع سخطك

হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার নিয়মাতের পরিসমাপ্তি , তোমার নিরাপত্তার বিলুপ্তি, তোমার আকস্মিক শাস্তি এবং তোমার সর্বপ্রকার ক্রোধ থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

اللهم إني أعوذ بك من شر سمعي, ومن شر بصري, ومن شر لساني ,ومن شر قلبي, ومن شر منيي

হে আল্লাহ! আমি আমার কানের অনিষ্ট থেকে, আমার চোখের অনিষ্ট থেকে, আমার যবানের অনিষ্ট থেকে, আমার অন্তরের অনিষ্ট থেকে এবং আমার বীর্যের অনিষ্ট থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

اللهم إني أعوذ بك من منكرات الأخلاق, والأعمال, والأهواء

হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট মন্দ চরিত্র , মন্দ আমল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

  • সর্বদা স্মরণ রাখবে:

আবুদ দারদা রা: বলেন; যে বেশি বেশি দরজায় করাঘাত করে, তার জন্যই দরজায় খোলা হয়। আর যে বেশি বেশি দু’আ করে, তার দু’আই কবুল করা হয়।

  • পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন থাক: কিছু কিছু মানুষ যখন তার দু’আ কবুলের কোন আলামত দেখতে না পায়, তখন সে তার প্রভুর উপর রাগান্বিত হয়। কিন্তু নিজের উপর ও নিজের গুনাহসমূহের উপর রাগান্বিত হয় না, যা তার দু’আ কবুল হতে বাঁধা দেয়।
  • দু’আকারী সর্ববস্থায়ই লাভবান: জেনে রাখ, দু’আর ফল নিশ্চিত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যেকোন মুসলিম দু’আ করুক, যদি তা কোন গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের ব্যাপারে না হয়, তাহলে আল্লাহ তাকে তিনটির যেকোন একটি প্রতিদান দেনই । হয়ত নগদই তার দু’আ কবুল করেন, অথবা এটা তার আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন অথবা তাকে অনুরূপ একটি মন্দ বিষয় থেকে রক্ষা করেন। একজন বলল: তাহলে তো আমরা বেশি বেশি দু’আ করবো? তিনি বললেন: আল্লাহ তার চেয়েও অধিক দানকারী।

এক স্নেহশীলের উপদেশ: দু’আর মধ্যে সর্বদা বারবার এগুলো বলবে:

لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين

তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম।

لاحول ولا قوة إلا بالله

আল্লাহর শক্তি ও সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি ও সাহায্য নেই। এগুলো দু’আ কবুলের সবচেয়ে বড় মাধ্যমগুলোর অন্তর্ভূক্ত।

***********

আপনার মুজাহিদ ভাইদের জন্য দুআর আবেদন রইল

ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও ভোটাভুটি

ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও ভোটাভুটি

শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিন (হাফিজাহুল্লাহ)

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ভোটাভুটি

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

শাইখ আবু কাতাদাহ আল ফিলিস্তিনি

[এটি শাইখের একটি খুতবাহ থেকে নেয়া হয়েছে। আত তিবয়ানকে দেয়া বিশেষ প্রশ্নের জবাব।]

দারুল ইরফান

১৪৩৮ হিজরী

অনুবাদকের কথা

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার জন্য, দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক শেষ নবী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ উপর এবং তাঁর পরিবার, তাঁর সাহাবীগণ এবং কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর সকল অনুসারীর উপর।

অতঃপরঃ

আমরা, তিবয়ান প্রকাশনী, অত্যন্ত আনন্দের সাথে পরিবেশন করছি শাইখ আবু কাতাদাহ উমার ইবনে মাহমুদ আবু উমার আল ফিলিস্তিনের সাথে রেকর্ডকৃত একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা শাইখকে কারামুক্ত করুন। এই পরিবেশনায় প্রায় চল্লিশটি প্রশ্ন-উত্তর গুছানো হয়েছিল, যেগুলো অনেকগুলো পর্বে পরিবেশন করার কথা ছিল। শাইখ প্রথম পর্বটি সম্পন্ন করার পর আর বাকিগুলো করতে পারেননি, কারণ তিনি গ্রেফতার হন এবং এখন পর্যন্ত বন্দী আছেন। অনুবাদ এর সাথে রেকর্ডিংও পাওয়া যাচ্ছে, যা দ্বারা সকল আরবী ভাষাভাষী পাঠকরা অডিও উত্তরগুলো দিয়ে উপকৃত হবেন।

রেকর্ডিং এর অনুবাদের পাশাপাশি আমরা টিকা যোগ করেছি যা অনুঃটিকা আকারে আসবে, যেহেতু এটি কোন রচনা নয় বরং একটি অডিও রেকর্ডিং এর অনুবাদ; তাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে শাইখ একটি শব্দ বলেছেন অথবা একটি বাক্য শুরু করেছেন, তারপর অন্য বাক্যে চলে যাচ্ছেন। আমাদের সামর্থ্যরে সর্বোত্তম চেষ্টা করেছি এর শাব্দিক অনুবাদ করার।  এর ফলে এই গ্রন্থের অনেক অংশ, বিশেষ করে বাক্যের শুরুগুলো মনে হতে পারে অপ্রাসঙ্গিক।

আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার কাছে দো‘আ করি যেন, তিনি শাইখ এবং তাঁর সাথে সকল কারারুদ্ধ মুসলিম মুসলিমীনদের মুক্ত করেন এবং তাঁকে পুরস্কৃত করেন, এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে সময় ব্যয় করার এবং চেষ্টার জন্য আর সেই সাথে পুরস্কৃত করেন সকলকে যারা এই কাজ প্রচার করে আল্লাহর দ্বীন আহবানের দিকে নিয়োজিত।

বিতাড়িত শয়তান থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)-

সকল প্রশংসা আল্লাহর, তাঁর প্রশংসা অঢেল, পবিত্র এবং মহান। শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক সৃষ্টির সেরা মুহাম্মদ, তাঁর সুন্দর, পবিত্র পরিবার, তাঁর সাথীগণ এবং আল-গুর আল মায়ামিন[1], কেয়ামত পর্যন্ত তাদের ভালো পথনির্দেশনার অনুসারীদের প্রতি।

অতঃপরঃ

দার-আত-তিবয়ানের আমাদের ভাইয়েরা আমার কাছে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসেন এবং এই গরীব বান্দাকে অনুরোধ করেন সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে। অতঃপর সেগুলো লিপিবদ্ধ করে আমার নিকট হস্তান্তর করেন। আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার কাছে প্রার্থণা করি যেন, তিনি আমাকে বিষয়গুলোর সত্যতাকে পরিস্কার করতে সাহায্য করেন এবং সক্ষম করেন তা অর্জনের জন্য, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা পছন্দ করেন এবং সন্তুষ্ট হন।

আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার কাছে প্রার্থণা করি যেন, তিনি ভাইদের উত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন এবং এই ভাই থেকে তাদের যে আশা ও তাঁর সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, সেজন্য আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন।

প্রথম প্রশ্নটি ছিল, সম্মানিত শাইখ, যারা সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থা এবং এর বৈধতা প্রচার করে, তারা নতুন একটি সংশয় নিয়ে এসেছে যার উপর তাদের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করছে।

এবং এই সংশয় একটি হাদিসের উপর ভিত্তি করে, যার উদ্ধৃতি নিম্নে উল্লেখিত করছিঃ

রসূল এর স্ত্রী উম্মে সালামা বিনতে আবি উমাইয়া ইবনে আল-মুগাহিবাহ বলেনঃ “আমরা যখন আল-হাবসার যমীনে এসে পৌঁছলাম আমাদের নিরাপত্তা দিলেন সর্বোত্তম প্রতিবেশী, আল নাজাসি। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা এরূপই ছিলাম (শান্তি এবং নিরাপত্তায়), যতক্ষণ না একজন তার সামনে এসে দাঁড়াল-অর্থাৎ, তার রাজত্বের বিষয়ে বিরোধিতা করল। আল্লাহ সাক্ষী, কখনও এত শোকাহত হইনি যা হয়েছিলাম সেই মুহুর্তে, ভয়ে যে সে কি নাজ্জাসিকে পরাজিত করবে, কারণ কোন লোক নাজ্জাসির মত আমাদের অধিকার প্রদান করবে না। তিনি বলেন, মাঝখানে ছিল নীল নদের প্রশস্ততা।

আল্লাহর রসূল এর সাথীরা বললেন, কে হবে সেই ব্যক্তি যে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করবে এবং আমাদের জন্য সংবাদ নিয়ে আসবে? জুবায়ের বিন আওয়াম বললেন, আমি যাবো। তিনি ছিলেন স্বল্প বয়স্কদের একজন। তাঁর জন্য একটি ঢালা প্রস্তুত করা হল। সেটিকে বুকের নিচে দিয়ে তিনি সাঁতরাতে লাগলেন, যতক্ষণ না নীল নদের সেখানে পৌঁছলেন যেখানে লোকেরা জড়ো হয়েছিল। তিনি ততদূর ভিতরে গেলেন, যেখান থেকে তিনি তাদের দেখতে পাচ্ছিলেন। উম্মু সালামা বলেন, আমরা আল্লাহর কাছে নাজ্জাসির জন্য দু‘য়া করতে লাগলাম, যাতে তিনি শত্রুর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন এবং শত্রুর উপর বিজয়ী হতে পারেন। আমরা তার সাথে উত্তম পরিবেশে ছিলাম, যতক্ষণ না আমরা রসূল এর কাছে ফিরে এলাম, রসূল তখন মক্কাতে ছিলেন।”

প্রশ্নকারী বলেন, আহমেদ এবং আল-বায়হাকী হাদিসটি বর্ণনা করেন। এই বর্ণনাটি আহমেদ থেকে, ইবনে ইসহাক হতে যিনি বলেন, আস জুহরি আমাদের বর্ননা করেন (হাদ্দসানা)  উম্মু সালামা থেকে আবি বকর ইবনে আব্দির রহমান ইবনে আল হারিব ইবনে হিসাম হতে।[2]

তাদের মতে এটিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে, নাজ্জাসি তখন কাফের থাকার পরও তাঁরা আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলেন, যাতে সে যমীনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় আর যদি দুয়া হয়ে থাকে সর্বোচ্চ সমর্থন, তাহলে ভোটদানের মত আরও অনুরূপ বিষয়গুলো আরও বেশী গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে। অতঃপর তারা বলে, যদি তোমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষেধ কর, তাহলে কি কোন ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার বদলে তার জন্য এই দুয়া করা বৈধ যে এই সংসদে আসন পায়? প্রথমদিকে এরূপ ভাবে ব্যবহার করার বিষয়ে আপনার মতামত চাচ্ছি এবং এই সংসদীয় নির্বাচনে ভোটদান যারা অনুমোদিত মনে করেছেন, তাদের সাথে আমাদের সঠিক অবস্থান কি হবে?

জাযাকাল্লাহু খায়ের।

সাফল্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার পক্ষ হতে আর আমার বক্তব্য হচ্ছে নির্বাচনের বিষয়টা হচ্ছে একটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়, আধুনিক এবং নতুন ঘটনা থেকে উদ্ভুত হওয়া একটি বিষয়।

কোন বিষয় ফাতওয়া দেওয়ার পূর্বে সেটিকে প্রণিধান করা আবশ্যক এবং বিষয়টির সঠিক মূলে  ফিরে যাওয়া এবং মুফতি অথবা বক্তার কল্পনা অনুযায়ী নয়; বরং  (যে এটি উদ্ভাবন করেছে এবং ব্যবহার করেছে)  তার পরিভাষা অনুযায়ী বিহিত করা জরুরী। তাই প্রথমেই আমাদের জানা প্রয়োজন যারা এই বিষয়টি উদ্ভাবন করেছে এবং যারা এটি ব্যবহার করছে তাদের কাছে নির্বাচনের বিষয়টি কিরূপ? তারপর আমাদের জানতে হবে এই বিষয়ের উপর মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার বিধান কি, আলিমগণ যা জানেন সেই অনুযায়ী ইজতিহাদের পদ্ধতি কি অথবা আলিমদের মতামতই বা কি?

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, নির্বাচনের বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন সংশয় সৃষ্টি করছে এবং এটি জানা কথা যে, এই সংশয় বাস্তবে কখনও শেষ হবে না।[3]

 মানুষ এটি নিয়ে অনেক কথা বলেছে এবং সুদৃষ্টি সম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তির নিকট এটা স্পষ্ট যে, এই নির্বাচনের বিষয়টিকে একটি যন্ত্র অথবা মাধ্যম হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটিকে দেখা হয় সেই ভিত্তির উপর যা হতে তা উৎসারিত। যার অর্থ হচ্ছে, একটি আক্বীদাহ অথবা মূলনীতির বাস্তবিক প্রতিফলন অথবা যেভাবে তারা আজকে বলছে যে, এটি একটি ভাবাদর্শ।

সুতরাং এটিই হচ্ছে বিষয়। তাই আমরা যদি ভিত্তিটা বুঝতে পারি তাহলে সেই সময়ে এর শাখা-প্রশাখাকেই বুঝতে আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। কিছু আলোচনা আমি প্রায়ই শুনে থাকি শুধু নির্বাচনের বিষয়ে, অন্য কথায়, এটিকে আলাদা করে, বাস্তবতা হতে অনেক দূরে রেখে এবং এর মূল থেকে অনেক দূরে রেখে কিছু আলোচনা।  এটি হচ্ছে গোপন করা এবং তা মন্দের মধ্যে শামিল । আরো যথাযথভাবে বলা যায় যে, এটা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি।

নির্বাচন হচ্ছে একটি মাধ্যম। কিন্তু তা কিসের মাধ্যম?  কি হতে উৎসারিত এই মাধ্যম?

যা জানা যায় তা হচ্ছে ব্যবস্থা সম্পর্কে, ব্যবস্থা যাদেরকে বলা হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং যেগুলো অধিকার দেয় সিয়াদাহ (সার্বভৌম কর্তৃত্ব, হুকুম, নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব, আধিপত্য, বিধান নির্ধারণ) মানুষকে শাসনতন্ত্র বিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে জানা যায় যে, সিয়াদাহ হচ্ছে সর্বোচ্চ পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব যার উপর কোন কর্তৃত্ব নেই। যার অধিকার আছে আইন প্রণয়নের – এটিই হচ্ছে সিয়াদাহ। তারা বলে সিয়াদাহ হচ্ছে মানুষের জন্য, সিয়াদাহ জাতির জন্য।

তাই এই সিয়াদাহ যা হতে উৎসারিত হয় আইন প্রণয়নের অধিকার, আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব, বিচারের কর্তৃত্ব, অতঃপর কার্যকরণের কর্তৃত্ব- তাহলে এগুলো মানুষের ইচ্ছের ভিত্তিতে হতে হবে এবং তার উপর ভিত্তি করে, যা মানুষ চায় এবং সমর্থন করে।

 গণতন্ত্র  দুটি বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুর উপর ভিত্তি এবং সংখ্যালঘুর অধিকার লড়াই এবং বিতর্কের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠে পৌঁছানো। সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার হচ্ছে শাসন করা, আইন প্রণয়ন করা এবং বিষয়গুলো কার্যকরী করা এবং সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা করা। এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত্তি। তাই আমরা যেভাবে দেখি এটি সিয়াদাহ -এর অর্থকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

সেক্ষেত্রে নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ইচ্ছের প্রতিফলন। কিভাবে আমরা জানবো মানুষের কি ইচ্ছে? তারা বলে নির্বাচন এবং ভোটদানের মাধ্যমে।

সুতরাং ভোটদান হচ্ছে মানুষের ইচ্ছের কথা জানানোর একটি মাধ্যম, যেখানে তাদের নিজেদের  অধিকার থাকবে আইন প্রণয়নের তথা সিয়াদাহর, যে সংসদীয় ব্যবস্থায় বর্তমানে আমরা আছি। তাই সংসদ হচ্ছে সেই কেন্দ্র যেখান থেকে অনেক বিষয় আসে, যার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে আইন প্রণয়ন। অন্য কথায় বলতে গেলে, কোন কিছুকে হালাল মোড়ক দেয়া অথবা কোন কিছুর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া। এটিই হচ্ছে আইন প্রণয়নের (তাসরি) অর্থ। আইন প্রণয়নের মানে কোন কিছুকে হালাল ঘোষণা করা এবং  তার উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার আইন অথবা কোন কিছুকে হারাম ঘোষণা করা এবং তার অনুমতি ছিনিয়ে নেয়া।

মানুষের দ্বারা নির্বাচিত এই কেন্দ্রের অধিকারের মধ্যে পড়ে আইন প্রণয়ন। এটি এমন একটি বিষয় যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার অধিকার, তাঁর প্রভুত্বের (উল্যুহিয়্যাত) সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, উল্যুহিয়্যাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার  এই হুকুমের অর্থ ব্যতীত সম্পূর্র্ণ নয়।

নিশ্চিতভাবেই সৃষ্টি তাঁর

এটিই হচ্ছে তাঁর কর্তৃত্ব (রুবুবিয়্যাত)।

সার্বভৌম ক্ষমতা তাঁর।[4]

আর এটিই হচ্ছে উলুহিয়্যাত।

এবং যিনি ইলাহ, তিনিই হুকুম দেন। তাই আমরা যদি তর্ক করি, স্বতন্ত্রভাবে একজনকে হুকুম দেয়ার অধিকার আছে বলেই বর্ণনা করি, তবে সেটিই হবে আস-সাইয়্যিদ, যাকে আনুগত্য করা হয়। যেমনটি ইবনে আব্বাস বলেন (মহান আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন) যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা বলেনঃ

বলঃ তিনিই আল্লাহ, তিনি এক, একক।[5]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা বলেন, আস-সাইয়্যিদ আল-মুতা (যাকে আনুগত্য করা হয়)। আস-সাইয়্যিদ, যার কোন হুকুমকে অবহেলা করা যায় না, আল-মুতা, যার আদেশ কেউ অমান্য করতে পারে না।[6]

তাই এখন আমরা সংসদকে আস-সাইয়্যিদ হিসেবে বুঝি, অন্য কথায় ইলাহ হিসেবে। এবং এই নির্বাচন প্রতিনিধিত্ব করে সাইয়্যেদকে নির্বাচিত করার জন্য। এটাই যা তারা বুঝে, ইলাহ নির্বাচন।

গণতন্ত্রের পুত্ররা এভাবেই ব্যাপারটাকে বুঝেছে এবং এর অনুসারীরা এভাবেই এতে সম্মতি জানিয়েছে। যেমনটি কিছু লোক কল্পনা করে যে, এটি সুবিধার অর্জন অথবা এরই প্রতিফলন অথবা একটি মাধ্যম একজন শাসককে নির্বাচিত করার যে, শরীয়াহ দিয়ে শাসন করবে তাদের উপর যারা তর্ক করছে কিভাবে এরূপ একটি মূলতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করা যায়।

না, আইন প্রণয়ন, সংসদ একটি আইন প্রণয়নের কেন্দ্র এবং একটি তত্বাবধায়নের সংস্থা এবং এর আছে প্রভুত্বব্যঞ্জক দায়িত্ব। উদাহরণস্বরুপ, কিছু ব্যবস্থায় দেখা যায়, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, অধিকার থাকে মন্ত্রীদের  নিয়োগের এবং সেখান থেকে কর্তৃত্ব প্রয়োগের।

এগুলো হচ্ছে প্রথম বিষয় হতে মধ্যম বিষয় যা হলো আইন প্রণয়নের অধিকার, যাদের এই অধিকার রয়েছে এবং যে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

তাহলে নির্বাচন কি?  নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে যে কোন কিছুকে হালাল এবং হারাম ঘোষণার ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের জন্য আমার ইচ্ছের প্রতিফলনে একজন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে আমি তার উপর সন্তুষ্ট। এবং এটি সুস্পষ্ট যে, তা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র” সাথে সাংঘর্ষিক এবং সাংঘর্ষিক সেই মুসলিমের ইচ্ছের সাথে যে বলে, আমি নিজেকে আল্লাহর আনুগত্যে উপস্থাপন করছি উল্যুহিয়্যার মধ্য দিয়ে। অন্য কথায়, আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করি না, আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা ব্যতীত অন্য কাউকে আইনদাতা হিসেবে গ্রহণ করি না। আমি আমার উপর কোন শাসককে গ্রহণ করি না, এই অর্থে শাসক বলতে সে নয় যে শাসন করে বরং আল্লাহ ব্যতীত যে হুকুম প্রণয়নের অধিকার রাখে। সমসাময়িক অনেকেই এটাকে সঠিক বলে আখ্যায়িত করে থাকেন হাকিমিয়্যাহ হিসেবে।

অতঃপর তারা কেন এই বিষয়ে বিতর্ক করে? কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করা হয়?

আমরা কি এখন কাফিরকে সাহায্য করার বিষয়ে অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে কথা বলছি?

আমরা কি এখন একজন কাফিরের পতাকার নিচে থেকে আরেকজন কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রদানের বিষয়ে কথা বলছি?

তাহলে কেন আলোচ্য বিষয় থেকে সরে যাওয়া হচ্ছে?

যে বিষয়টি আমাদের সামনে আছে তা হলো, একজন ব্যক্তি তার রব (ইলাহ), প্রভু (সাইয়্যেদ), আইনদাতা (মুশারি) বেছে নিচ্ছে। যেই এই বিষয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত হবার অনুমতি দেয়, সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার এ দ্বীনে অনেক বড় কিছু নিয়ে এসেছে।

কারণ, যে কোন প্রয়োজনের উপর দ্বীনের প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে, যেহেতু এই ব্যাপারে ঐকমত আছে। দ্বীন প্রয়োজনীয়তার উপর অন্য কোন প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দেয়া যাবে না, যেমন বলেছেন আশ-শাতিবি[7] (রহ.)। কারণ, প্রয়োজন বিভিন্ন পর্যায়ের হয়, এবং দ্বীন প্রয়োজনকেই প্রাধান্য দিতে হয়, যেকোন প্রয়োজনের আগে এটাকে স্থান দিতে হয় আগে, নিজের স্বকীয়তা (নাফ্স) থেকে, ধন-সম্পদ (মাল) থেকে, সম্মান (আল-ইরদাহ), সন্তান-সন্ততি থেকে, এই সবকিছুর শেষ পর্যন্ত থেকে।[8]

আমাদের সামনে এখন যে প্রশ্ন, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা হলো সাহায্য করার বিষয়ে আলোচনা; একজন কাফিরের বিরুদ্ধে আরেকজন কাফিরকে সাহায্য করার অনুমতির ব্যাপারে।

 এ ক্ষেত্রে রায় হলো যে, কাফিরকে সহযোগিতা করা যাবে না। যদি কতিপয় আলিমগণ এক কাফিরের বিরুদ্ধে আরেক কাফিরকে সহযোগিতা করা অনুমতিযোগ্য দেখে এজন্য যে, এর মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য কোন সুফল রয়েছে। তাহলে সেই বিষয়টি ফিকহার গন্ডির অন্তর্ভুক্ত। কারণ তা রায়কে বাতিল করে দেয় না। অন্যদিকে, যারা একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে কাফিরকে সহযোগিতা করা অনুমতিযোগ্য এরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, আমি তাদের  সেই সকল ফুকাহাদের অন্তর্ভুক্ত করব, যারা এই ফতোয়া দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছে। উদাহরনস্বরূপ, যারা আমেরিকাকে সহযোগিতা করার জন্য তালেবানদের বিরুদ্ধে অনুমতি দিয়েছে।

 এটি অবশ্যই অনুমদনযোগ্য নয়। কারণ সহযোগিতা মৌলিকভাবে আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত এবং আনুগত্য কেবলই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার, তাঁর রসূল এবং ঈমানদারদের জন্য। কাফিরদের প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।[9]

তাহলে আমাদের সামনে এমন একটি বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, ফিকহর কিছু কিতাবে যার উল্লেখ রয়েছে। যেমনটি বলা যায় আল-হায়ছামি[10]  উল্লেখ করেছেন, আশ-শাফি থেকে, তাঁর আল ফতোয়া আল হাদিছিয়া তে। তিনি এই কিতাবে কোন সুফল অর্জনের উদ্দেশ্যে এক কাফিরের বিরুদ্ধে আরেক কাফিরকে সাহায্য করা  অনুমতিযোগ্য কি না এই বিষয় তুলে ধরেছেন এবং এই সম্পর্কিত আলিমগণের কিছু উক্তিও উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই বিষয়টি হলো ফিকহার বিষয়।

অনেকে বলতে পারে “আমি তার আনুগত্য স্বীকার করলাম।” না, বরং প্রকৃতপক্ষে সে তার আনুগত্য স্বীকার করছে না, বরং শুধু নিজেরই আনুগত্য করছে …।

সুতরাং এটিকে …… প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা, কারও বক্তব্য বা কোন প্রশ্ন হিসেবে ব্যবহার করাতে কিছু সমস্যা প্রতীয়মান হয়। বাস্তবিকতায়, উক্ত প্রশ্নতেও কিছু ভুল লক্ষণীয়। যেমনটি তার বক্তব্য যে, দু‘য়া হলো সমর্থনের সর্বোচ্চ স্তর, এটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ, রসূল দু‘য়া করেছিলেন উমার (রাঃ) এর জন্য যখন তিনি বলেছেন, “হে আল্লাহ! ইসলামকে ইজ্জাত দাও দুই উমারের যে কোন একজনকে দিয়ে,  হে আল্লাহ! ইসলামকে ইজ্জাত দাও দুই উমারের মাধ্যমে।” আরেক রেওয়াতে যার ভিত্তি সহীহ, যদিও বা শব্দসমষ্টি ভিন্ন।[11]

সুতরাং তার জন্য দু‘য়া করা কি ইসলামে সমর্থিত? এই বক্তব্য যে, দু‘য়া যে কোন দৃষ্টিতে হলো সমর্থনের সর্বোচ্চ স্তর, একটি মিথ্যে (বাতিল) বক্তব্য। যখন আমরা দু‘য়া করি কাফির পথপ্রদর্শনের জন্য, তখন আমরা আসলে ইসলামেরই আনুগত্য স্বীকার করি। ঠিক তেমনি, তারা সেই কাফিরের (নাজ্জাসি) তার কাফির শত্রুদের উপর বিজয়ের জন্য দু‘য়া করেছিলেন, এই জন্য যে, তারা বিশ্বাস করত যে, এই সমর্থনে মুসলিমদের সুফল হবে।

এই বিষয় হলো কর্মের সাথে সম্পর্কিত এবং একটি আক্বীদাহ সম্পর্কিত বিষয়ের সামনে তা একটি গৌণ বিষয়। সুতরাং আমরা এর উপর অটল থাকার আশা করি।

এখন আরেকটি প্রশ্নঃ যদি আপনি নির্বাচনকে নিষেধ করেন, সেক্ষেত্রে আপনার জন্য কি অনুমোদিত হবে যে, আপনি কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার পরিবর্তে তার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘য়া করবেন, যেন সে সংসদে আসন লাভ করে?

এটা স্পষ্টই একটি ভ্রান্ত ধারণা। এই আকাঙ্খা কোন মুসলিমের মনে আসতেই পারে, সে ইচ্ছা পোষণ করল যেন অমুক অমুকের উপর বিজয়ী হোক মুসলিমের শত্রুর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, যাতে যা উত্তম তা থাকে তার জন্য। এই বিষয়টি দু‘য়া সম্পর্কিত বিষয় থেকে ভিন্ন।

প্রকৃতপক্ষে, এই সবকিছু আমাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পথে দাঁড়ায় না যে, ব্যক্তিকে নির্বাচন করা, তার জন্য ভোট দেয়ার অর্থই তাকে মনোনীত করা। যাকে বলা যায় যে, ভোট প্রদান মানেই মনোনয়ন প্রক্রিয়া, তুমি কাউকে মনোনয়ন করলে স্রষ্টার প্রতিরূপ হিসেবে।

সুতরাং তুমি এই একজনের জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছ, তোমার জন্য এই একজনকে উলুহিয়্যাতের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা পোষণ করার কারণ হলো যে সে মুসলিমদের মধ্যে কম অনিষ্টকর, এটা একটা বিষয় এবং অন্য আরেকজনকে তোমার জন্য একজন রব হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা পোষণ করা, সেটা আরেকটা বিষয়। আমি এই বিষয়টা আবার আলোচনা করছি , যাতে করে এটা সকলের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যখন তুমি কারো জন্য দু‘য়া কর, যদি আমরা বলি যে তুমি তার জন্য দু‘য়া করতে পার,  তখন তুমি আল্লাহর নিকট দু‘য়া করেছ এই সাংসদকে অপর সাংসদের উপর বিজয়ী হবার জন্য, তুমি বেছে নিয়েছো সেই উপাস্য যে এই অন্যন্য (মিথ্যা) উপাস্যের চেয়ে কম খারাপ। সে একজন আইন প্রণেতা তবে তাদের জন্য অন্যদের থেকে কম খারাপ; এই বক্তব্য তাদের জন্য, তোমার জন্য নয়। কিন্তু সাংঘর্ষিক হবে যদি তুমি তাকে আইনপ্রণেতা হিসেবে মেনে নাও।

এর মানে এই যে, আমি দু‘য়া করতে পারি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার কাছে যে, “হে আল্লাহ! অমুককে প্রতিষ্ঠিত করো, কারণ সে তাদের জন্য তার পথভ্রষ্টতায় এবং তার কুফরীতে অপেক্ষাকৃত কম অনিষ্টকর ।” তবে তাকে তোমার ইলাহ হওয়ার জন্য ভোট দেয়া, সেটা আরেকটি বিষয়। এটা দেখা যাচ্ছে, পূর্বোক্ত বিষয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তোমার জন্য অনুমোদিত নয় যে, তুমি শাসিত হবে বা তুমি তোমার উপর একজন কাফিরের শাসক মেনে নেবে অথবা তুমি একজন কাফিরের শাসনকে স্বীকার করবে। কিন্তু এটা কি অনুমোদিত তোমার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার  কাছে সেই কাফিরের জন্য দু‘য়া করা, যে মুসলিমদের ও মুসলিমদের নিকটবর্তীদের জন্য কম অনিষ্টকর এবং যে মুসলিমদের ক্ষতি করে না? উত্তর হলো, হ্যাঁ। কিন্তু, তুমি এই দু‘য়াতে তাকে তোমার জন্য শাসক হিসেবে পছন্দ করবে না। কারণ যদি তুমি তাকে (কাফিরকে) পছন্দ করো তোমার জন্য শাসক হিসেবে, তাহলে তুমি কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলে। যে ব্যক্তি মুসলিমদের উপর একজন কাফিরের শাসক স্বীকার করে, সেও কিছুক্ষণের জন্য অবিশ্বাস করল, যা আলিমগণের কিতাবগুলোতে স্পষ্টত উদ্ধৃত রয়েছে। “আল-আক্বিদাহ আত-তাওয়াবিয়্যাহ,[12]  শার আল আক্বিদাহ আত-তাওয়াবিয়্যাহ” -ইবনে আবি আল ইজ্জ আল হানাফী।[13]

 যদি তুমি বলো, “হে আল্লাহ! তুমি ওই কাফিরকে শক্তিশালী কর, যেন সে মুসলিমদের ক্ষতি না করে এবং তার লোকদের প্রতি উত্তমরূপে সাব্যস্ত হয়। ফলে তার লোকেরাও মুসলিমদের জন্য উত্তমরূপে সাব্যস্ত হয়” – এটা সম্পূর্র্ণ আরেকটি বিষয়।

তোমার জন্য একটি ইলাহ পছন্দ করে নেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় তোমার জন্য তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিকটবর্তী হিসেবে আশা করার বিষয় থেকে। কারণ মিথ্যে ইলাহরা হল কুফর এবং তারা তাদের কুফরী, মিথ্যাচার, তাদের ফিস্ক, তাদের যুজুরে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত।

এখানে অবশ্যই পার্থক্য আছে এটা বলার মধ্যে যে, কোন ব্যক্তি বলল, “আমার ইলাহ মহান এবং তিনি আকাশে বিরাজমান”। এবং ওই ব্যক্তি তাকে কল্পনা করল  শ্রশ্রুমন্ডিত এক পুরুষ রূপে। এর সাথে পার্থক্য রয়েছে যদি একই ব্যক্তি বলে, আমার ইলাহ হলো গরু”। দুইটি ইলাহ এখানে মিথ্যে। কিন্তু পুর্বোক্তের সাথে পরবর্তীর পার্থক্য বিদ্যমান।

আলিমগণ ওয়াহদাত আল উজুদ এর লোকদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মের ব্যাপারে ওয়াহদাত আল উজুদের লোকদের  থেকে অপেক্ষাকৃত উত্তম। কেননা ওয়াহদাত আল উজুদের লোকেরা জমিতে দেয়া সারকে তাদের ইলাহ হিসেবে বিশ্বাস করে এবং হতে পারে  তা নাজাসাহ (অপবিত্র)।  অপরদিকে খ্রিষ্টানরা তাদের ইলাহ হিসেবে বিশ্বাস করে ঈসা আলাইহিস সালামকে, যা পুর্বোক্ত বিশ্বাস অপেক্ষা উত্তম।

তাহলে এর মানে কি এই যে, কাফিরদের মধ্যে কে উত্তম, সেজন্য এক ইলাহকে অন্য ইলাহ থেকে উত্তম ঘোষণা করব? আমার নিজের জন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে ঠিক করা কি আদৌ বৈধ হবে? এ ব্যাপারে বলা যায়, এই বিষয়ে প্রয়োজন উপস্থাপনায় সততা।

আমাদের সঠিক অবস্থান কি হবে তাদের প্রতি যারা এমন মতামত পোষণ করে যে, সাধারণ আইন পরিষদের নির্বাচনে ভোট প্রদান বৈধ?

লক্ষ্যনীয় যে, আইন পরিষদের নির্বাচনের বিষয়টি ফিকহের বিষয়ের সাথে নয় বরং তাওহীদের সাথে সম্পর্কিত। যারা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, তারা তা করে থাকে বেশ কয়েকটি কারণবশতঃ। এরূপ দ্বিমত পোষণকারীরা বিভিন্ন স্তরের ।

তাদের মধ্যে রয়েছে এমন সকল লোক যারা নির্বাচনকে অনুমোদিত মনে করে, কারণ তারা মনে করে না যে হুকুম হলো আল্লাহর জন্য বরং তারা মনে করে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আইনদাতা হিসেবে মেনে নেয়া যাবে, যদি তা মানুষের সম্মতিক্রমে হয়। এই বিষয়ে লক্ষ্য করা যায়, এমন কিছু জামা‘আতের যারা ইসলামের দাবি করে। তারা বলে, আমরা স্বীকার করলাম শাসক আমাদের, যাদের মানুষ স্বীকার করেছে। তারা হলো কাফির যদিও তারা ইসলামের দাবি করে।

আরো কিছু লোক আছে যারা নির্বাচনের সত্যতা জানে না এবং যেরূপ আলোচনা করেছি, তারা এটাকে একটি মাধ্যম হিসেবে দেখে। এরূপ অন্যদের সাথে পার্থক্য ক্ষীণ, কারণ সত্যকে উপলব্ধি করেনি। তাই তাদের উসুল সঠিক কিন্তু তারা নির্বাচনের সত্যতা জানতে ভিন্নতা অবলম্বন করে। তাই তারা ভেবে নেয় যে রাষ্ট্র চালানোর জন্য অপেক্ষাকৃত ভালোকে বেছে নেয়ার এটি একটি মাধ্যম। এবং তারা এটি দেখতে পায় আব্দুর রহমান ইবন আওফের কর্মে যখন তিনি উসমানের সমর্থনে বলেন, “হে আলী! আমি উসমানের সমমাপের কাউকেও পাইনি, তুমি নও, অন্য কেউ নয়।”[14]

অতঃপর সে এটিকে একরকমের ভোটদান হিসেবে দেখে। তাই সে ভিন্নতা প্রকাশ করে। এটি ছাড়াও অনেকে এটাকে বৈধ মনে করে। সে এটিকে একটি দরজা হিসেবে দেখে ইসলামের আইন প্রণয়নের জন্য প্রবেশ করা যায়। ইসলামকে তুলে ধরার জন্য, আল্লাহর দিকে আহবানের জন্য, ইসলামকে সাহায্য করার জন্য। তাই এরা প্রথম লোকেদের চেয়ে একধাপ নিচে যারা সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে দেয়ার যোগ্যতা খুঁজে পায়। এবং সংসদ দ্বারা প্রণীত আইনকে বৈধ মনে করে। কিন্তু এরা তৃতীয় স্তরেও নেই। তাই এরা মধ্যম।

বিষয়টি হচ্ছে আমরা এক একটি অবস্থানকে তার স্তর অনুযায়ী দেখি। কিন্তু এখানে একটি বিষয় চলে আসে, কেউ বলতে পারে আপনারা কেন তাকফীর করেন এবং তাদেরকে অজ্ঞতার অজুহাত দেন না?

আমি বলি, না। আমি প্রথমেই তাদের উপর তাকফীর করি না। আমরা তাদের উপর তাকফীর করি না যারা একে বৈধ বলেছেন, আমরা তাকফীর করি না এই ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে যে বলে, আমি আল্লাহর আইনের উপর ভরসা করি, অতঃপর ভুল করে। কারণ, বিদাআতী লোকেদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হচ্ছে যে তারা বলে, তোমরা অবিশ্বাস করেছো, যদি সে তাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। বরঞ্চ, এই বিষয়ে সঠিক ব্যাপার হচ্ছে তাকে বলা, তুমি ভুল করেছো। আমরা দেখি একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা এই বিষয়ে ফাতওয়া দেয় (যে ভোটদানের বৈধতা ইত্যাদি) এই কারণে যে তারা (গণতন্ত্রের) সত্যতার বিষয়ে অজ্ঞ, আরো অনেকে আছে  যারা বলে যে, এটি বৈধ যদি তোমার অভিপ্রায় আন্তরিক হয়। তাই মনে হয় যে সে এমন একটি বিষয়ে কথা বলছে, যা মূলত, বৈধ কিন্তু অভিপ্রায়ের সংশোধনের দরকার আছে। কারণ অভিসন্ধির সংশোধনী আলোচিত হয় বৈধ বিষয়ে, যেমন আপনি যদি বলেনঃ সঠিক উদ্দেশ্যের সাথে সালাত আদায় করেন।

তাই আমরা বলি না যে তারা অবিশ্বাস করেছে এবং তাদের অজ্ঞতার অজুহাত দেই, কারণ সত্যিকার অথের্, যারা বৈধতার ফাতওয়া দিয়েছে তারা কুফফারের ফাতওয়া দেননি। কিন্তু তারা প্রকৃত সত্যকে বুঝতে একটি ভুল করেছেন।

 এটি ইতিহাসে অনেকবার ঘটেছে। এটি আমাদের জন্য বলা বৈধ যে যারা কিছু দ্রব্যের ভোগকে বৈধতা দিয়েছেন, অর্থাৎ যখন লোকেরা ক্বাত[15]  নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, কিছু লোক বলেছিলেন এটি হালাল এবং কিছু লোক বলেছিল এটি হারাম। যারা এটিকে হালাল বলেছিলেন (এই জন্য বলেছিলেন) যে তারা এটিকে মাদক হিসেবে দেখেননি, আর যারা এটিকে হারাম বলেছিলেন তারা এটিকে নেশাদ্রব্য হিসেবে দেখেছিলেন। নিশ্চয়ই, যে কোন একদল সঠিক।

এটা কি কারো জন্য বলা বৈধ যে“ তুমি অবিশ্বাস করেছ, কারণ তুমি সেটা নিষেধ করেছ যা আল্লাহ হালাল করেছেন?” এবং অপরজনে এটা বলা যে“ তুমি অবিশ্বাস করেছ কারণ তুমি মাদককে বৈধ করেছ?” এখানে বিষয় হচ্ছে যে সত্যটাকে বোঝার পার্থক্য, অথচ তারা মূলে একমত।

আমি আশা করি আমি বিষয়টি পরিস্কার করতে পেরেছি, যদিও আমার মনে হয় পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতার কারণে আলোচনাটি অনেক সংক্ষিপ্ত।

তিনি বলেনঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে; আপনি সহৃদয় যা আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন শ্রদ্ধেয় শাইখ, এর উপর ভিত্তি করে সে ব্যক্তির পিছনে সালাত পড়ার রায় কি হবে যে এটিকে বৈধ মনে করে? এক্ষেত্রে যিনি পিছনে সালাত আদায় করছেন তাকে কি পুনরায় সালাত আদায় করতে হবে, নাকি তা মাকরুহ, নাকি তাতে কোন অসুবিধা নেই?

এই সবকিছুই নির্ভর করে অবস্থা জানার উপর। সে যদি ভুল করে থাকে, ভুল করে থাকে নির্বাচনকে বুঝতে, তবে এর পেছনে আমরা সালাত পড়ব এবং এই বিষয়ে কোন অসুবিধা নেই, কোন অপছন্দনীয়তাও নেই, এমনকি কোন বিশেষ অগ্রাধিকারও নেই। মানে তার ছাড়া অন্য কাউকে আমরা সামনে ঠেলে দিব না, অন্য কোন কারণ ব্যতীত যা এই কারণ নয়।

সেসকল লোকদের ক্ষেত্রে যারা এটিকে বৈধ মনে করে কারণ তারা বিশ্বাস করে মানুষের নিজের আইন প্রণয়নের বৈধতা আছে এবং সংসদ যা বলে আমরা তা মেনে নেয়, তবে এদের পেছনে আমরা একেবারেই সালাত পড়বো না। এবং এই সালাত অপছন্দ নয়, বরং  নিষিদ্ধ (বাতিল)। আমরা এদের পিছনে সালাত পড়ি না।

সেই ব্যক্তির জন্য যে বলে যে আমরা সংশোধনের জন্য এর মধ্যে প্রবেশ করতে চাই এবং আমরা জানি যে তা কুফর। আর তাতে আমরা বিশ্বাস করি না, তবে এরূপ ব্যক্তির জন্য আমরা নির্বাচনের বিষয়ে ফিরে যাবো না এবং সেই সাথে তার সাথে সংশ্লিষ্ট সাংসদ যা প্রণয়ন করছে সে বিষয়ে যাবো না; বরং আমরা দেখবো যে সে কিসে বিশ্বাস করে, সেটি নয় যা সংবিধান বলছে। আমরা এরূপ ব্যক্তিদের পিছনে সালাত আদায় করবো  যদিও ইমামার জন্য অন্যরা তাদের চেয়ে বেশী যোগ্য।

***************

আমাদের প্রকাশিত (বাংলা) অন্যান্য কিতাবসমূহঃ 

তাওহিদ: সকল মূলনীতির চূড়ান্ত মূলনীতি

–শাইখ আসিম বিন তাহির হাফিজাহুল্লাহ্

 

তাওহীদের কালিমা

শাইখ হারেস আন নাযযারী রহ.

 

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা

শায়খ আতিয়াতুল্লাহ রহঃ

 

তাফসির নীতি

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ্

 

আকীদা সংক্রান্ত দশটি মাসআলা

যা না জানলেই নয়

আবনাউত তাওহীদ

 

কা‘ব বিন মালেক রাযি. এর

ঘটনা থেকে শিক্ষা

শায়খ আবু আব্দুল্লাহ উসামা রহ.

 

শিরকঃ চারটি মূলনীতি

শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রহ.

 

দৈনন্দিনের

সহস্রাধিক সুন্নাহ

শহীদ শাইখ খালেদ আল হুসাইনান রহ.

 

পরীক্ষা ও সবর: নির্বাচিত আয়াত ও হাদীস

 

কাশ্‌ফুশ্‌ শুবহাত (সংশয় নিরসন)

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব রহ.

 

গণতন্ত্রঃ একটি জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন)!

আবূ মুহাম্মদ আসিম আল-মাকদিসী

 

ইসলামী গণতন্ত্রের সংশয় নিরসন

দার আত-তিবইয়ান

 

ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব রহ.

**********

[1] আলগুর আলমায়ামিনঃ এই বাক্যাংশের আক্ষরিক অর্থ, “রহমতপ্রাপ্ত সাদা একজন”। …সাদা একজন… এটা আবু হুরাইরার একটা হাদীসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে [মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার উপর সন্তুষ্ট হন], রসূল বলেনঃ “বস্তুত পুনরুত্থান দিবসে অজুর কারণে আমার উম্মাহকে গুররান মুহাজ্জালিন হিসেবে ডাকা হবে”- বুখারী, মুসলিম এবং অন্যগুলো হতে বর্ণিত। গুররান মানে হচ্ছে এমন যা ঔজ্জল্যের কারণে ঘোড়ার কপালে জ্বলতে থাকে এবং ‍মুহাজ্জিলিন মানে হচ্ছে এমন ঔজ্জল্য বা সাদা যা ঘোড়ার খুরে জ্বলতে থাকে।

[2] এই হাদীসটি ইমাম আহমদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন এবং হাসান হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে আল-ওয়াদীর “আস-সহীহ আল-মুসনাদ” এ #১৬৭২ এবং অনুরূপ স্বীকৃতি মিলেছে “সহীহ” হিসেবে আহমেদ শাকির এর তাখরীজ এর “মুসনাদে আহমদ” এ। খন্ড ৩/১৮০

[3] গণতন্ত্রের অগ্রগতির বিষয়ে বিদ্যমান সবচেয়ে প্রচলিত, সমন্বিত এবং যুক্তিখন্ডনের জন্য, সন্দেহ নিয়ে আলোচনার জন্য, দারুল ইরফান পাবলিকেশন্স- এর “The Doubts Regarding The Rulings of Democracy in Islam” বা ইসলামী গণতন্ত্রের সংশয় নিরসন নামক বইটি দেখতে পারেন।

[4] সূরা আল-আরাফ ৫৪

[5] সূরা ইখলাস-১

[6] এই সূরার তাফসীরে বর্ণিত এই বাক্যাংশটি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু ওয়াইল, শাকিক ইবনে সালামাহ, এবং আবু জাফর যা উল্লিখিত হয়েছে ইবনে জারির আত-তাবারীতে এবং ইবনে কাসীর (রহ.) ও এটাকে উল্লেখ করেছেন যায়িদ ইবনে আসলাম হতে। আল-কুরতুবী (রহ.) ও সুফিয়ান হতে এটাকে উল্লেখ করেন। ইবনে তাইমিয়্যাহ তার “মজমুয়ায়ে আলÑফাতওয়া” এর খন্ড ৮/১৫০ তে ইবনে আব্বাসের এই উদ্বৃতিটাকে দূর্বল বলে অভিহিত করেছেন, কিন্তু এরপরই তিনি বলেছেন যে সালাফরা এই বাক্যাংশের মতই উদ্ধৃতি নিশ্চিত করেছেন। আশ-শাওকানি (রহ.)ও তাঁর ফাত আল-কাদির” গ্রন্থের খন্ড ৫/৭৫৪  এটাকে দূর্বল বলে অভিহিত করেছেন। আল-আলবানী তার তাখরীজ এর “কিতাব আস-সুন্নাহ” গ্রন্থের # ৬৬৬ এ ইবনে মাসউদের এই উদ্ধৃতিটাকে ইবনে অসীম এর দ্বারা দূর্বল বলেছেন  আলী ইবনে আবী তালিব হতে আল-আলবানী তার “তাশিহি আল-আকাইদ” এর ১১৯ এ একই ধরনের একটি বাক্যাংশ উদ্ধৃতি করেছেন, কিন্তু এটা উল্লেখ করেছেন যে, এখানে একটি দূর্বলতা আছে এবং সনদে একটি ত্রুটি আছে। যাহোক, আবু ওয়াইল এর বর্ণনাকে সহীহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন আল-আলবানী তার তাখরীজ এর “কিতাব আস-সুন্নাহ” গ্রন্থের # ৬৭১ এ। এখন পর্যন্ত এর চেয়ে শক্তিশালী রাসুলের ﷺ যে হাদীসটি আস-সাইয়্যিদ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দিকে আরোপ করেছেন তা হলো যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আশ-শাকির হতে যিনি বলেনঃ আমি বনু আমীর এর একটি প্রতিনিধিদলের সাথে রাসুল ﷺ এর নিকট গমন করি, সুতরাং আমরা বলিঃ “আপনি হচ্ছেন আমাদের সাইয়্যেদ”, কিন্তু তিনি বললেন, “আল্লাহই হচ্ছেন আস-সাইয়্যেদ……” হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে আবু দাউদ, আহমেদ, বুখারীর “আল-আদাবুল মুফরাদ” সহ অন্যগুলোতে। হাদিসটি সহীহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন আশ-শাওকানিও তার ফাত আল-কাদির” গ্রন্থের ১/৩৩৬ এবং ১১/৫৬৪৬এ। এটাকে আরো সহীহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন আল-আলবানী তার “সহীহ আবি দাউদ” এর #৪৮০৬এ, সহীহ আল-আদাবুল মুফরাদ এ #১৫৫ এ, “মিশকাত আল-মাসাবিহ” #৪৮২৬ এ, “ইসলাহ আল-মাসাজিদ” ১৩৯ এ। এটাকে আরো সহীহ বলে স্বীকৃতি মিলেছে “সহীহ মুসলিমের শর্তের উপর ভিত্তি করে” আল-ওয়াদী’র “আস-সহীহ আল-মুসনাদ” #৫৭৮ এ। আবু ওয়ালী’র উক্তিটি সহীহ বলে স্বীকৃত, আরো বলেছে আল-আলবানী তার তাখরীজ এর “কিতাব আস-সুন্নাহ” গ্রন্থের # ৬৭১ এ।

[7]  তিনি হচ্ছেন আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবন মুসা ইবন মুহাম্মদ আল-গিরানতি আল-আন্দালুসি, যিনি আশ-শাতিবি নামে পরিচিত। তিনি মালিক্যিয়্যাহদের ইমাম থেকে এসেছেন। তিনি ৭৯০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি“আল-ইতিশাম” এবং “আল-মুওয়াফাত ফি উসুল আশ-শারীআহ” গ্রন্থের প্রণেতা।

[8]  আশ-শাতিবি বলেনঃ “যেহেতু উম্মাহ, বরং অবশিষ্ট মিল্লাত, পাঁচটি প্রয়োজনীয়তাকে সংরক্ষণ করার জন্য শারীআহকে রাখা হয় সেগুলো হচ্ছেঃ ধর্ম (আদ-দ্বীন), স্বকীয়তা (নাফ্স), সন্তান-সন্ততি (নাসল), ধন-সম্পদ (মাল), এবং জ্ঞান (আকল)।”“আল-মুওয়াফাত ফি উসুল আশ-শারীআহ খন্ড১/৩৮। এছাড়াও, মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-হানাফী আল-হালাবি, যিনি ইবনে আমীর আল-হাজ্জ নামে পরিচিত (যিনি ৮৭৯ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন) বলেনঃ এবং সকল প্রয়োজনীয়তার মধ্যে দ্বীনের সংরক্ষণকে অন্যগুলোর উপর প্রাধান্য দিতে হবে, যেখানে সংঘর্ষ আছে, কারণ এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম লক্ষ্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ

“আমি জ্বিন এবং মানুষকে আমার ইবাদাত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি”। [সুরা আয যারিয়াত-৫৬]

এবং এছাড়াও এটা একটা লক্ষ্য এই কারণে যে (অন্য সক লক্ষ্যের লক্ষ্য থাকে শুধু দ্বীনের স্বার্থে)। এবং এর সুফল হচ্ছে সকল সুফলের পরিপূর্ণতা, এবং এই সুফল সারা জাহানের রবের চিরস্থায়ী সুখ অর্জনের সবচেয়ে নিকটবর্তী হবার। এরপর নিজের বংশ (আন-নাসব) সংরক্ষণ, মান, ধন-সম্পদ এর চেয়ে স্বকীয়তা সংরক্ষণের অগ্রাধিকার দিতে হবে বেশী, দ্বীনের সুবিধাবাদির অন্তর্ভুক্তির কারণে, কারণ ধর্মীয় সুবিধাগুলো ইবাদাতের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব এবং তাদের অর্জন (ইবাদাতের কর্মকান্ড) স্বকীয়তার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। এরপর বংশধারা সংরক্ষণকে বেশী অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, কারণ এটা শিশুর স্বকীয়তার অস্তিত্ব। কারণ, যেনার নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বংশানুক্রম মিশে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই, তাই শিশুটি শুধু একজনের দিকেই ধাবিত হয়, ফলে তার পিতাকে সন্তানের দেখা শোনা ও তার স্বকীয়তার সংরক্ষণে অধিক মনোনিবেশ করে। অন্যথায়, শিশুটি অবহেলিত হতো এবং তার নিজের সংরক্ষণের অসামর্থ্যতার দরুন তার স্বকীয়তাও হারিয়ে যেতো। এরপর ধন-সম্পদের সংরক্ষণের চেয়ে জ্ঞানের সংরক্ষণকে বেশী অগ্রাধিকার দেয়া হয়, স্বকীয়তা হারানোর কারণে ( চেতনা হারানোর সাথে সাথে স্বকীয়তাও স্বাভাবিকভাবে হারিয়ে যায়) মানুষ প্রাণীদের সাথে যোগ দেয় ( তার মানে হল, যদি মানুষ তার চেতনা বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, কর্মে অদক্ষতা, সত্য ও মিথ্যের প্রভেদ তৈরি করতে না পারার দরুন সে তখন পশু হয়ে যায়) এবং এর হারানোর সাথে তার দায়িত্বও পতিত হয়ে যায়। এবং সেখান থেকে স্বকীয়তা হারানোর আবশ্যকতার সাথে এটা হারানোও আবশ্যক হয়ে যায় এবং এটা হলো পরিপূর্র্ণ রক্তপণ (যদি কোন ব্যাক্তি অন্য কারও ক্ষতি করে এবং তার চেতনার ক্ষতি সাধন করে এবং যদি সে তাকে হত্যা করে তাহলে এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে রক্তপণ দেওয়ার জন্য সে দায়ী থাকবে)। এর পর সবার শেষে আসে ধন-সম্পদ সংরক্ষণের বিষয়টি।” “আত-তাকরীর ওয়াত-তাহবীর ফি শারহ কিতাব আত-তাহরীর,” খন্ড ৩/২৩১।

[9] মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করার বিষয় সংক্রান্ত সমন্বিত আলোচনার জন্য, আত-তিবয়ান কর্তৃক প্রকাশিত “Ad-Dalail Fi Hukum Muwalat Ahl Al-Ishrak”, “The Evidences For The Ruling Regarding Allainces With The Infidels” By Imam Sulayman Ibn Abdullah Ibn Muhammad Ibn Abdil Wahhab and “At-Tibyan Fi Kufri Man Aan Al-Amrican”, “The Exposition Regarding The Disbelief of The One That Assists The Americans” By Shykh Nasir Ibn Hamad Al-Fahd – এই বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।

[10] তিনি হচ্ছেন আহমেদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হাজর আল-হায়তামি আল-মাক্কী আশ-শাফী । তিনি ৯০৯ হিজরীতে মিসরে জম্নগ্রহণ করেন। তিনি আল-আযহার এ পড়িয়েছেন এবং ৯৭৪ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন। তার রচিত বইগুলোর মধ্যে এগুলো অন্যতম – Al-Badr At-Tāli’ Bi-Mahāsin Man Ba’d Al-Qarn As-Sābi’” by Ash-Shawkānī, Vol. 1/109.“Al-Fatāwā Al-Hadīthiyyah”, “Al-Ināfah Fī Mā Jā’a Fī As-Sadaqati Wadh- Dhiyāfah”, “Al-I’lām Bi-Qawāti’ Al-Islām”, and “As-Sawā’iq Al-Muhriqah ‘Alā Ahl Ar-Rafdhi Waz-Zandaqah”

[11] এই হাদীসটি তিরমিযী শরীফে, আহমেদ এবং অন্যগুলোতে একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত যে রাসুল ﷺ বলেনঃ “হে আল্লাহ! আবু জাহল ইবনে হিশাম অথবা উমর এর মধ্যে থেকে যাকে আপনার পছন্দ হয় তাকে দিয়ে আপনি ইসলামকে ইজ্জাত দান করুন।” তিনি বলেনঃ “এবং তাঁর নিকট সবচেয়ে পছন্দের ছিলেন উমার।” এই হাদীসটি “হাসান সহীহ গারীব” বলে স্বীকৃতি পেয়েছে তিরিমিযীতে #৩৬৮১ এ। এটাকে সহীহ বলে আরো স্বীকৃতি মিলেছে আল-আলবানীর সহীহ আত-তিরমিযীতে #৩৬৮১ এ। “….. ইবনে আল-খাত্তাব …..” বাক্যাংশটুকু যোগ করে আহমেদ শাকির এটাকে সহীহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার তাখরীজ এর মুসনাদে আহমেদ এর খন্ড ৮/৬০, আশ-শাওয়াভিকি এটাকে সহীহ বলেছেন এবং ইবনে হিব্বান এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তার দুআ আল মাকাসিদ আল-হাসানাহ এর ১১৩ এতে।

[12] লেখক আবু জাফর আহমেদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ ইবনে আব্দিল মালিক আল-আজদি আল-হাজারি আল-মিশরী আত-তাহাবী। তিনি ২৩৯ হিজরীতে জম্নগ্রহণ করেন এবং ৩২১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – “Al-‘Aqīdah At-Tahāwiyyah”, are “Sharh Ma’ānī Al-Āthār”,“Sharh Mushkil Al-Āthār”, and “Mukhtasir At-Tahāwī Fī Al-Fiqh Al-Hanafī”।

[13] তিনি সাদর আদ দ্বীন আবুল হাসান আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ আল-আশারী আদ-দিমাস্কি আস-সালেহী আল-হানাফী, ইবনে আবী আল-ইজ্জ নামে পরিচিত। জম্ন ৭৩১ হিজরী, মৃত্যু ৭৯২ হিজরী। তার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম – Sharh of “Al-‘Aqīdah At-Tahāwiyyah”, are “Al-Itbā’”,  “At-Tanbīh ‘Alā Mushkilāt Al-Hidāyah” and “An-Nūr Al-Lāmi’ ‘Alā Mā Yu’mal Bihi Fī Al-Jāmi’”   এই দুটো এখন আর পাওয়া যায় না।

[14] কাহিনীটি হলো এরকমঃ “সাহাবাদের গুণাবলীর বই” – আল-বুখারী বর্ণনা করেন, অধ্যায়ঃ “ বাইয়্যাতের ঘটনা এবং উসমান ইবনে আফফানের উপর সবাই একমত হওয়া” এবং একই অধ্যায়ে, উমার (রাঃ) তাঁর পরে খিলাফাহ ত্যাগ করার পর, ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি শুরা গঠন করেছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, উসমান এবং আলী ছাড়া আর তিনজন খিলাফাহকে প্রত্যাখ্যান করেন। হাদীসটির বর্ণনাকারী আমর ইবন মায়মুন বলেনঃ সুতরাং আব্দুর রহমান বললেন, তাই তোমাদের দুজনের মধ্যে কে প্রার্থী তাকে সমর্থনের জন্য তার রায় দিবে যাতে করে আমরা তাকে মনোনীত করতে পারি এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এবং ইসলামের দিকে সে রুজু হয় এবং যাতে করে সে দেখতে পাবে যে তার চেয়ে আর কে বেশী ভালো হবে। সুতরায় উভয় সাবাহীই (উসমান এবং আলী) চুপ থাকলেন। সুতরাং আব্দুর রহমান বললেন, তোমরা দুজনেই এই ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দেবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমার উপর সাক্ষ্য থাকুন যে, আমি তোমাদের দুজনের মধ্যে ভালো জনকেই বেছে নিবো। তারা দুজনেই সম্মতি প্রদান করলেন। তাই আব্দুর রহমান তাদের দুজনের একজনের হাত ধরে তুলে নিয়ে বললেন, আপনি আল্লাহর রাসুল ﷺ এর আত্নীয় এবং সবার জানামতে প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং আপনি আল্লাহর নিকট প্রতিজ্ঞা করুন এই মর্মে যে, যদি আমি আপনাকে মনোনীত করি তাহলে আপনি ন্যায় বিচার করবেন এবং যদি আমি উসমানকে মনোনীত করি তাহলে আপনি উসমানের আনুগত্য করবেন। এরপর তিনি উসমানের একটি হাত তুলে নিলেন এবং তাকেও একই কথা বললেন। এরপর যখন তিনি তার অঙ্গীকারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন, তিনি বললেন, হে উসমান! আপনার হাতটি বাড়িয়ে দিন। তখন আব্দুর রহমান তার হাতে বাইয়্যাত নিলেন এবং এরপর আলী তার হাতে বাইয়্যাত নিলেন এবং এরপর পর্যায়ক্রমে সর্বসাধারণ সেই ঘরে প্রবেশ করলো এবং উসমান ইবন আফফান (রাঃ) এর হাতে আনুগত্যের বাইয়্যাত নিলেন।” হাদীস #২৭০০

[15] ক্কাত, আরো পরিচিত খাট, ঘাট, চাট এবং মিররা নামে। উত্তর আফ্রিকার গরম আবহাওয়ায় জম্ন নেয়া এটি একটি পুস্পময় গাছ। শতাব্দীকাল যাবৎ আরব উপদ্বীপ এবং সোমালিয়াতে খাট মাদকদ্রব্যের উপকরণ হিসেবে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এর তাজা পাতা এবং শীর্ষ চিবানো হয় এবং মাঝে মাঝে শুকিয়ে চা করা হয়। আনন্দাদায়ক এবং সতেজতা পাবার জন্য এটা ব্যবহার করা হয়। যারা ক্কাত এর নিষিদ্ধতার কথা বলেছেন, তারা হলেনঃ Ahmad Ibn Hajr Al-Haytamī in his book“Tahthīr Ath-Thuqāt Min Akl Al-Kaftata Wal-Qāt”, Abū Bakr Ibn Ibrāhīm Al-Muqrī Al-Harāzī Ash-Shāfi’ī in his book “Tahrīm Al-Qāt”, Shaykh Muhammad Ibn Ibrāhīm Ibn ‘Abdil-Latīf Āl Ash-Shaykh, Shaykh ‘Abdil-‘Azīz Ibn ‘Abdillāh Ibn Bāz, Shaykh Abul-Hasan Mustafā Ibn Ismā’īl As-Sulaymānī, Shaykh Muqbil Ibn Hādī Al-Wādi’ī, and Shaykh Abū Nasr Muhammad Ibn ‘AbdillāhAl-Imām।

গণতন্ত্র একটি দ্বীন!

শায়খ আসিম বিন তাহির

পিডিএফ ডাউনলোড করুন 

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

গণতন্ত্রঃ

একটি জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন)!

আবূ মুহাম্মদ আসিম আল-মাকদিসী

[আল্লাহ তাঁকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিন]

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ

الديمقراطية دين

لأبي محمد المقدسي

গণতন্ত্রঃ একটি জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন)!

আবূ মুহাম্মাদ আসিম আলমাকদিসী

আর যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না এবং সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”

 

সূচিপত্র

অনুবাদকের কথা.. 5

লেখকের কথা.. 6

স্বর্গীয় সৃষ্টি, নাযিলকৃত কিতাবসমূহ, ইব্রাহীম (আ.) এর দাওয়াহ্ এবং সবচেয়ে.. 7

মজবুত হাতল-এগুলোর সূত্রপাত এবং উদ্দেশ্য.. 7

গণতন্ত্র একটি নব উদ্ভাবিত দ্বীন, যেখানে এর উদ্ভাবকরা হল মিথ্যা উপাস্য এবং অনুসারীরা হলো তাদের দাস. 12

গণতন্ত্রের প্রচারক ও সমর্থকদের ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক কতিপয় যুক্তির খন্ডন. 16

প্রথম অযৌক্তিক অজুহাতঃ… 17

দ্বিতীয় অযৌক্তিক অজুহাতঃ… 23

তৃতীয় অযৌক্তিক অজুহাতঃ… 26

চতুর্থ অযৌক্তিক অজুহাতঃ… 29

পঞ্চম অযৌক্তিক অজুহাতঃ… 30

সংসদীয় বিষয়ঃ বিবেচনা করুন, চিন্তা করুন ওহে জ্ঞানবান সমঝদার মানুষেরা.. 34

 

অনুবাদকের কথা

“পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ তা‘আলার নামে”

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন-

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ

“আর যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না এবং সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩: ৮৫)

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি চিরঞ্জীব, সৃষ্টিকর্তা, একক এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি তাঁর নিজের সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করাকে কখনও মাফ করেন না। এবং তিনি কখনও ঐ ব্যক্তির আমল গ্রহণ করেন না যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য কারও ইবাদত করে। তিনিই একক, তিনি একত্ববাদকে তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বানিয়ে দিয়েছেন। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা এবং আদর্শ হচ্ছেন মুহাম্মদ ﷺ, সর্বশেষ নবী ও রাসূল, আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবারের উপর, তাঁর সাহাবাদের উপর এবং কেয়ামত পযর্ন্ত যারা তাঁকে অনুসরণ করবে তাঁদের সবার উপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। (আমীন)

অতঃপর, আমি যা বলতে চাই, আমাদের দ্বীনি ভাই, আবূ মুহাম্মদ আল-মাকদিসীর ‘গণতন্ত্রঃ একটি জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন)’ নামক আরবীতে লিখিত বইটি পড়ে আরবী ভাষা বোঝে না এমন মুসলিমদের এই মহাবিপর্যয় সর্ম্পকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করলাম। এই মহাবিপর্যয় মানুষের চিন্তাধারা, তাওহীদের আদর্শ এবং সর্বোপরী ঈমানদারদের দ্বীনি চেতনাকে কুলষিত করেছে। অনেক অবিশ্বাসী-কাফের মিথ্যা দাবীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায় যে গণতন্ত্র কোন জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন) নয়। আমি খুবই আনন্দিত যে, আবূ মুহাম্মদ আল-মাক্দিসী এই বাতিল সংবিধান এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের মিথ্যা দাবীকে পরিষ্কারভাবে খন্ডন করে দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যকে প্রমাণের জন্য কুর’আন এবং সুন্নাহ্র সঠিক দলিলের পাশাপাশি বুদ্বিবৃত্তিক যৌক্তিক প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেছেন। এভাবে তিনি এমন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যা অসঙ্গতি ও অসার বক্তব্য বর্জিত এবং সহজে বোধগম্য। আমি অনেকদিন ধরেই কাফেরদের নব উদ্ভাবিত গণতন্ত্রের যুক্তি খন্ডন এবং শিরকী সংসদীয় পরিষদের বিরূদ্ধে যুক্তি খন্ডনের পূর্ণাঙ্গ দলিল খুঁজছিলাম। এই মহৎ কাজটি আমাদের প্রাণ প্রিয় শাইখ সূচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। আমি এই বইটি পেয়ে ভীষণ আনন্দিত কারণ ‘ত্বাগুত’ ও তাগুতের পৃষ্ঠপোষক, সহযোগী এবং ভন্ড আলেমরা তাদের কুফরী সংবিধান ও সংসদের পক্ষে যে সব মিথ্যা ও প্রতারণাপূর্ণ যুক্তি দাঁড় করায় তাাদের সকলের জবাবে কুর’আন ও সুন্নাহর আলোকে পূর্ণাঙ্গ দলিল পেশ করা হয়েছে। আমি সমস্ত কিছুই এই মূল্যবান বইতে পেয়েছি। তাই আমি বইটি অনুবাদের সিদ্বান্ত নিয়েছি যাতে যারা আরবীতে পড়তে পারেন না তারা যেন মিথ্যা থেকে সত্যের পার্থক্য করতে পারেন, পথভ্রষ্টতা থেকে নিজেদের বাচাঁতে পারেন, পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার নির্দেশনা পান এবং যারা গণতন্ত্রের উপর বিশ্বাস করে তাদের বিরূদ্ধে যেন দলিল পেশ করতে পারেন। আমি আশা করি আল্লাহ্ তা‘আলা আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে গ্রহণ করবেন এবং সকল প্রশংসা তাঁর জন্যেই যিনি প্রথম (আল-আওওয়াল) এবং শেষ (আল-আখির)।

অনুবাদক

লেখকের কথা

“পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ তা‘আলার নামে”

সকল প্রশংসা আল্লাহর। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর কাছে আশ্রয় চাই, তাঁরই কাছে ক্ষমা চাই এবং আমরা তাঁর কাছে পানাহ চাই নফসের প্রতারণা হতে এবং আমাদের খারাপ কাজ হতে। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন তাকে কেউ গোমরাহ করতে পারে না, আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন তাকে কেউ হেদায়েত দিতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কেউ নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ ﷺ তাঁর বান্দা এবং শেষ রাসূল। তিনি আমাদের নেতা এবং তিনি আমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। মহানবী মুহাম্মদ ﷺ, তাঁর পরিবার, তাঁর সাহাবাগণ এবং যারা তাঁকে কেয়ামত পযর্ন্ত অনুসরণ করবে তাঁদের সকলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। (আমীন)

অতঃপর, শিরকী শাসন ব্যবস্থার সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক পূর্বে এই বইটি লিখার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল এবং এটা এমন একটা সময় যখন মানুষ গণতন্ত্রের দ্বারা মোহগ্রস্থ হয়ে আছে। কখনও তারা গণতন্ত্রকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অথবা ‘শূরা কাউন্সিল’ (পরামর্শসভা) বলে থাকে। আবার কখনও তারা এমন যুক্তি উপস্থাপন করে যেন, আপাত দৃষ্টিতে, গণতন্ত্রকে একটি বৈধ মতবাদ বলে মনে হয়। তারা ইউসূফ (আ.) এর সাথে রাজার শাসনব্যবস্থার ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করে। আবার অন্য সময়ে তারা নাজ্জাসীর শাসনব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে শুধু তাদের স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তারা সত্যের সাথে মিথ্যার এবং আলোর সাথে অন্ধকারের এবং ইসলামের একত্ববাদের সাথে গণতন্ত্রের শিরকী ব্যবস্থার মিশ্রণ ঘটায়। আমরা, আল্লাহর সাহায্যে, এই সব মিথ্যা যুক্তি খন্ডন করেছি এবং প্রমাণ করেছি যে গণতন্ত্রঃ একটি জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন); তবে এটি আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন) নয়।

এটি আল্লাহ প্রদত্ত একত্ববাদদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) নয়। সংসদ ভবন হচ্ছে এই শিরকের কেন্দ্রস্থল এবং শিরকী বিশ্বাসের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। আমাদের জীবনে তাওহীদ বাস্তবায়ন করতে হলে এই সমস্ত কিছুুুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে আর এটাই হচ্ছে বান্দার উপর আল্লাহর হক। যারা গণতন্ত্রের অনুসারী, আমাদের অবশ্যই তাদেরকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং আমরা অবশ্যই তাদের ঘৃণা করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখবো এবং তাদেরকে পর্যদস্ত করবো। গণতন্ত্র একটি সুস্পষ্ট শিরকী মতাদর্শ এবং নির্ভেজাল কুফরী যে ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর কিতাবে সতর্ক করেছেন। এবং তাঁর রাসূল ﷺ সারা জীবন এই সব ত্বাগুতের (মিথ্যা উপাস্যদের) বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ছিলেন। তাই, হে আমার একত্ববাদী ভাইয়েরা, অটল থাক নবীর প্রকৃত অনুসারীরূপে এবং যারা গণতন্ত্র ও এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন তাদের সাহায্যকারী হও। নিজের জীবনকে সাজাও তাদেরকে অনুসরণ করার জন্যে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানকে প্রয়োগ করে থাকে। রাসুল ﷺ এই পথ সর্ম্পকে বলেছেন, “আমার উম্মাহর মধ্যে একদল লোক থাকবে যারা আল্লাহর আদেশ পালন করতে থাকবে এবং যারা তাদেরকে ত্যাগ করবে অথবা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে কেউই তাদের ক্ষতি করতে পারবে না যতক্ষণ না পূর্বনির্ধারিত সময় উপস্থিত হয়

(কিয়ামত হয়)।”

আমি আল্লাহর নিকট দোয়া করি যাতে আল্লাহ আমাকে এবং আপনাকে ঐ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি প্রথম (আল-আও্ওয়াল) এবং যিনিই শেষ (আল-আখির)।

আবূ মুহাম্মদ আল-মাক্দিসী।

স্বর্গীয় সৃষ্টি, নাযিলকৃত কিতাবসমূহ, ইব্রাহীম (আ.) এর দাওয়াহ্ এবং সবচেয়ে

মজবুত হাতল-এগুলোর সূত্রপাত এবং উদ্দেশ্য

প্রত্যেকের জানা উচিত যে, আল্লাহই সমস্ত বস্তু ও প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ আদম সন্তানকে সালাত, যাকাত বা অন্য যে কোন ইবাদত জানার ও পালন করার পূর্বে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির আদেশ দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে- কেবল এক আল্লাহর উপর ঈমান আনা এবং তাঁকে ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয় তাদের বর্জন করা। এ কারণেই আল্লাহ সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন, নবীদের পাঠিয়েছেন, কিতাব নাযিল করেছেন এবং জিহাদ ও শাহাদাতের আদেশ দিয়েছেন। আর এ কারণেই আর-রহমানের অনুসারী এবং শয়তানের অনুসারীদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে এবং এ কারণেই দারুল ইসলাম এবং খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

“আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এই জন্য যে তারা আমারই ইবাদত করবে” [সূরা আয-যারিয়াত ৫১: ৫৬]

যার অর্থ- আমাদের সৃষ্টি ও অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা।

তিনি আরো বলেছেনঃ

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطّٰغُوتَ ۖ فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلٰلَةُ ۚ فَسِيرُوا فِى الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عٰقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ

“আর নিশ্চয়ই, আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দেয়ার জন্য যে, আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত (অন্য সকল বাতিল ইলাহ) থেকে নিরাপদ থাকো (বর্জন কর)।” [সূরা আন-নাহল ১৬: ৩৬]

“লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্ – আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নাই”- এই বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তি। এটা ছাড়া কোন দোয়া, সালাত, সওম, যাকাত, হজ্জ্ব, জিহাদ, অথবা অন্য কোন ইবাদতই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বাণীতে ঈমান আনা ব্যতীত কেউই নিজেকে জাহান্নামের আগুন হতে বাঁচাতে পারবে না। কারণ এটাই হচ্ছে একমাত্র হাতল যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন তাঁর অনুসারীদের, যা তাদের জান্নাতে নিয়ে যাবে। অন্য কোন হাতল জাহান্নামের আগুন হতে বাঁচাতে সক্ষম নয়। আল্লাহ বলেনঃ

لَآ إِكْرَاهَ فِى الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَىِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطّٰغُوتِ وَيُؤْمِنۢ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقٰى لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

“নিশ্চয়ই, সঠিক পথ ভ্রান্ত পথ থেকে আলাদা। যে ত্বাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস করবে, সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙ্গবে না।” [সূরা বাকারাহ্ ২: ২৫৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেনঃ

إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَوْثٰنًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِندَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُۥٓ ۖ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

“যারা ত্বাগুতকে বর্জন করে তার (ত্বাগুতের) ইবাদত থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে, এবং আল্লাহর অভিমুখী হয় (তওবাহর মাধ্যমে), তাদের জন্য আছে সু-সংবাদ। অতএব সু-সংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।” [সূরা আয-যুমার ৩৯: ১৭]

লক্ষ্য করুন, আল্লাহ্ তাঁর প্রতি ঈমান আনার পূর্বে সকল মিথ্যা উপাস্যদের (বা ত্বাগুত-দের) অস্বীকার করার কথা বলেছেন। এই আয়াত আমাদের দেখাচ্ছে, কিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রতি ঈমান আনার পূর্বে, সমস্ত বাতিল ইলাহ্-(উপাস্য)কে পরিত্যাগ করার কথা বলেছেন। (লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্ – কোন উপাস্য নেই, আল্লা­হ্ ব্যতীত) এই বাণীর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা একত্ববাদের আদেশ দিয়েছেন, যা নির্দেশ করে মজবুত হাতলের সবচেয়ে বড় নীতি সর্ম্পকে; সুতরাং কেউই সত্যিকার ঈমানদার হতে পারবে না যত পর্যন্ত না সে অন্য সকল বাতিল উপাস্যকে চূড়ান্ত ও পুরোপুরি ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। সেই উপাস্যগুলো, যাদের সাথে কুফরী (বিশ্বাস না করা) করতে হবে এবং যাদের ইবাদত থেকে দূরে থাকতে হবে, সেগুলো কেবল পাথর, মূর্তি, গাছ বা কবর নয় (সিজদা বা দোয়ার মাধ্যমে যাদের ইবাদত করা হয়)- বস্তুত মিথ্যা ইলাহর আওতা আরও অনেক বেশি! এই উপাস্যগুলোর আওতার মধ্যে পড়ে প্রত্যেক জীব বা জড় যেগুলোর ইবাদত করা হয় আল্লাহ তা‘আলা-কে বাদ দিয়ে এবং তারা এই ইবাদত গ্রহণ করে বা সন্তুষ্ট থাকে। [1]

যখন কোন সৃষ্টি নিজের আত্মার উপর যুলুম করে, তখন সে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা অতিক্রম করে। আল্লাহ ছাড়া অন্য ইলাহ-এর ইবাদত করা এরূপ যুলমের অন্তর্ভুক্ত। এই ইবাদতের মধ্যে আছে সেজদা, মস্তক অবনতকরণ, দোয়া প্রার্থনা, শপথ করা এবং বলি দেওয়া। আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে মান্য করাও এক ধরনের ইবাদত। আল্লাহ আহলে কিতাব (ইহুদী ও নাসারা) সম্প্রদায় সর্ম্পকে বলেন,

اتَّخَذُوٓا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبٰنَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓا إِلَّا لِيَعْبُدُوٓا إِلٰهًا وٰحِدًا ۖ لَّآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحٰنَهُۥ عَمَّا يُشْرِكُونَ

“তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীগণকে তাদের আরবাব (প্রভু) রূপে গ্রহণ করেছে …।” [2]

যদিও তারা তাদের পন্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীগণদের সেজদা করে নাই বা তাদের ধর্ম যাজকদের সামনে মাথা নত করে নাই, কিন্তু তারা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করা সংক্রান্ত তাদের বিধান মেনে নিয়েছে এবং অনুসরণ করেছে। সেজন্যেই আল্লাহ তাদের এই কাজকে অর্থাৎ পন্ডিত ও ধর্মযাজকদের প্রভু বা উপাস্যরূপে গ্রহণ করার শামিল বলে গণ্য করেছেন। কারণ বিধানের ক্ষেত্রে আনুগত্য এক ধরনের ইবাদত এবং তা একমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট, যেহেতু আল্লাহই একমাত্র স্বত্তা যিনি বিধান দিতে পারেন। সুতরাং, যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো আইন বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা চালায়, সে বস্তুত একজন মুশরিক। প্রমাণ স্বরূপ মুহাম্মদ ﷺ-এর সময়ের ঐ ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়, যখন একটি মরা ছাগল নিয়ে আর-রাহমান (আল্লাহর) বান্দা ও শয়তানের অনুসারীদের মধ্যে বিবাধ হয়। মুশরিকরা যুক্তি দ্বারা মুসলিমদের বোঝাতে চাচ্ছিল যে, ছাগলটি প্রাকৃতিক ভাবে বা নিজে নিজেই মারা যায়, তার মধ্যে ও মুসলিমদের যবেহ্ করা ছাগলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা দাবী করছিল যে, মৃত ছাগলটিকে আল্লাহই যবেহ করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, আল্লাহ তাঁর হুকুম জারি করে দিলেন এবং বললেন,

وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُۥ لَفِسْقٌ ۗ وَإِنَّ الشَّيٰطِينَ لَيُوحُونَ إِلٰىٓ أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجٰدِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

“… যদি তোমরা তাদের কথামত চল (আনুগত্য বা অনুসরণ কর) তবে অবশ্যই মুশরিক হবে।” [সূরা আনআম ৬: ১২১]

সুতরাং ‘ইলাহ্’ বা ‘উপাস্য’ শব্দটি দ্বারা এমন সব লোকদেরও বোঝায় যারা আল্লাহর পাশাপাশি নিজেকে বিধানদাতা, আইনপ্রণেতা অথবা সংসদ প্রতিনিধি রূপে স্থান করে নেয় (কারণ এসকল পদে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিধানের পরিপন্থী বিধান প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা দেয়া হয়); আর যারা তাদেরকে এসকল পদে নির্বাচিত করে (ভোট দেয়া বা অন্য কোন রূপে সমর্থন করার মাধ্যমে) তারা হয় মুশরিক- কারণ তারা সীমালংঘন করেছে (অর্থাৎ আল্লাহ  তা‘আলার পাশে আরেক বিধানদাতা মেনে নেয়ার মাধ্যমে শরীক করেছে)। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর দাস হিসেবে এবং আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করার জন্য; কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তা প্রত্যাখান করেছে এবং নির্ধারিত সীমা লংঘন করেছে। আইনপ্রণেতারা নিজেদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাতে চায় এবং তারা বিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করতে চায় যা কারো জন্যে বৈধ নয় শুধুমাত্র আল্লাহ ছাড়া। যদি কেউ, নিজেকে বিধানদাতা হিসেবে অধিষ্ঠিত করার মাধ্যমে, সীমা অতিক্রম করে, তবে সে একজন উপাস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তার ইসলাম এবং তার একত্ববাদ গ্রহণ যোগ্য হবে না, যতক্ষণ না সে যা করেছে তা অস্বীকারপূর্বক বর্জন করবে এবং সেই ভ্রান্ত জীবন ব্যবস্থার কর্মী ও সমর্থনকারীদের থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে জিহাদ করবে; অর্থাৎ যতক্ষণ না সে নিশ্চিতভাবে জানবে যে, গণতন্ত্র একটি ভ্রান্ত মতবাদ এবং এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করবে। আল্লাহ বলেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ ءَامَنُوا بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓا إِلَى الطّٰغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوٓا أَن يَكْفُرُوا بِهِۦ وَيُرِيدُ الشَّيْطٰنُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلٰلًۢا بَعِيدًا

“… এবং তারা ত্বাগুতের কাছে বিচার প্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” [সূরা নিসা ৪: ৬০]

মুজাহিদ (রহ.) বলেন, “‘ত্বাগুত’ (উপাস্য) হচ্ছে মানুষরূপী শয়তান যার কাছে মানুষ বিচার ফয়সালার জন্যে যায় এবং তারা তাকে অনুসরণ করে।”

শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ্ (রহ.) বলেন, “… আর এ কারণেই, যে কুর’আনের নির্দেশিত বিধান ছাড়া বিচার ফয়সাল করে না সে হচ্ছে ‘ত্বাগুত’।” [3]

ইব্ন আল-কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি, যে তার সীমা অতিক্রম করে, হয় ইবাদত, অনুসরণ অথবা আনুগত্যের মাধ্যমে – সুতরাং কোন মানুষের উপাস্য হয় সেই ব্যক্তি যাকে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পাশাপাশি বিচারক সাব্যস্ত কর হয়, অথবা আল্লাহর পাশাপাশি যার ইবাদত করা হয়, অথবা যার অনুসরণ করা হয় আল্লাহকে অগ্রাহ্য করে, অথবা যাকে মান্য করা হয় এমন বিষয়ে যার মাধ্যমে আল্লাহকে অমান্য করা হয়”।

তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর রাসূল যে বিধান নিয়ে এসেছেন, যদি কেউ তা দিয়ে বিচার-ফয়সালা না করে বা তার দিকে প্রত্যাবর্তন না করে, সে মূলতঃ অন্য কোন উপাস্যের অনুসরণ করছে।” [4]

বর্তমান সময়ে যে সব উপাস্যের ইবাদত করা হয়, অর্থাৎ তথাকথিত আইনপ্রণয়নকারী পরিষদের মানুষের তৈরী দেবদেবী, উপাস্য ও তাদের ভ্রান্ত অনুসারীদেরকে প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যই বর্জন করতে হবে, যেন সবচেয়ে মজবুত রজ্জু (ইসলাম বা আল্লাহর একত্ববাদ) শক্তভাবে ধারণ করা যায় এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তা হলো তথা কথিত আইন প্রণয়নকারী পরিষদের মানুষের তৈরী ক্ষণস্থায়ী উপাস্য বা দেব-দেবীগুলোকে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

أَمْ لَهُمْ شُرَكٰٓؤُا شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنۢ بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِىَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظّٰلِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“তাদের কি এমন কতগুলো ইলাহ্ (উপাস্য) আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেন নাই? ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়ে যেতো…” [সূরা আশ-শুরা ৪২: ২১]

মানুষ এই সব ‘আইন প্রণয়নকারী’-দের অনুসরণ করে আসছে এবং বিধান দেয়া বা আইন প্রণয়ন করাকে তাদের, তাদের সংসদের এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শাসন ব্যবস্থার অধিকার ও বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিয়েছে। তারা তাদের সংবিধানের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, জনগণই প্রকৃতপক্ষে বিধান দেয়। [5]

এ কারণেই, আইন প্রণয়নকারীরা তাদের অনুসারীদের ইলাহ হয়ে যায়। অনুসারীগণ তাদেরকে এই কুফরী মতবাদ ও শিরকের ব্যাপারে মেনে নিয়েছে যে রূপ আল্লাহ খ্রিস্টানদের ব্যাপারে বলেছেন যখন, তারা আনুগত্য করেছিল তাদের ধর্মযাজক ও সন্ন্যসীদের। আজকের গণতন্ত্রের অনুসারীরা ঐসব সংসার বিরাগী ও ধর্মযাজকদের থেকে বেশি নিকৃষ্ট ও অপবিত্র; কারণ যদিও তারা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করত কিন্তু তারা নিজেদেরকে আইন প্রণয়নকারী বলে দাবী করত না এবং তারা নিজেরা সংবিধান তৈরী করত না। কেউ যদি তাদের কথা গ্রহণ না করত অথবা অনুসরণ না করত তাহলে তারা তাদের শাস্তি প্রদান করত না; আর না তারা তাদের মিথ্যা উপাস্যগুলোর পক্ষে প্রমাণ দেয়ার জন্য আল্লাহর কিতাব ব্যবহার করত। এই বিষয়টি যদি আপনার কাছে স্পষ্ট হয় তবে আপনার জানা উচিত, ইসলামের মজবুত হাতলকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং মানুষের তৈরি উপাস্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হলো ইসলামের চূড়া। আর এর দ্বারা আমি ‘জিহাদ’-কে বুঝাতে চাচ্ছি। জিহাদ করতে হবে ত্বাগুত, তার অনুসারী এবং সাহায্যকারীর বিরুদ্ধে, এই মানব রচিত সংবিধানকে ধ্বংস করার জন্যে এবং চেষ্টা করতে হবে যেন মানুষ এদের ইবাদত থেকে ফিরে আসে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। অবশ্যই এই পদক্ষেপের সাথে থাকতে হবে একটি ঘোষণা এবং প্রকাশ্য বক্তব্য, ঠিক যেমনটি নবীগণ করেছিলেন এবং আমারা অবশ্যই তা করব একই পদ্ধতিতে এবং একই পথ অবলম্বন করে – যে পথটি আল্লাহ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, ইব্রাহীম (আ.) মিল্লা­ত (আদর্শ) এবং তাঁর দাওয়াহ্কে আমাদের আর্দশ হিসাবে নেয়ার আদেশ প্রদানের মাধ্যমে।

তিনি (আল্লা­হ্ তা‘আলা) বলেন,

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِىٓ إِبْرٰهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُۥٓ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَءٰٓؤُا مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدٰوَةُ وَالْبَغْضَآءُ أَبَدًا حَتّٰى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُۥٓ إِلَّا قَوْلَ إِبْرٰهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَآ أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِن شَىْءٍ ۖ رَّبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

“তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ([6])রয়েছে উত্তম আর্দশ। যখন সে তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আনবে’।” [সূরা মুমতাহিনা ৬০: ৪]

কাজেই এই বক্তব্যের অর্থ স্পষ্ট হয়েছে। ভেবে দেখুন, কিভাবে আল্লাহ বিদ্বেষের পূর্বে শত্রুতার কথা দিয়ে শুরু করেছেন। বিদ্বেষের চেয়ে শত্রুতা বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ একজন ব্যক্তি ত্বাগুতের অনুসারীদেরকে ঘৃণা করতে পারে কিন্তু তাদের শত্রু হিসাবে নাও ভাবতে পারে। তাই কোন ব্যক্তি (মুসলিম হিসেবে) তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তাদের ঘৃণা করবে এবং শত্রু হিসেবে গণ্য করবে। ভেবে দেখুন, কিভাবে আল্লাহ মিথ্যা উপাস্যগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পূর্বে সেগুলোর অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ দ্বিতীয়টির চেয়ে প্রথমটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষই পাথর, মূর্তি, দেবতা, সংবিধান, আইন এবং বাতিল জীবন ব্যবস্থার (দ্বীন) প্রত্যাখান করে কিন্তু তারা এই সব উপাস্য ও বাতিল দ্বীনের অনুসারীদের ও সাহায্যকারীদের প্রতাখ্যান করতে অস্বীকার করে। এই কারণেই, এ ধরনের লোক তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারবে না। যদি সে এইসব উপাস্যগুলোর দাসদের প্রত্যাখান করে তবে বুঝা যায় যে, সে তাদের ভ্রান্ত ব্যবস্থা এবং তারা যাদের ইবাদত করে সেগুলাকেও প্রত্যাখান করে। প্রত্যেকের কমপক্ষে অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য, যা ছাড়া কেউ নিজেকে (জাহান্নাম হতে) বাঁচাতে পারবে না, তা হলো মিথ্যা উপাস্যগুলো বর্জন করা এবং তাদের শির্কী ও মিথ্যা মতাদর্শনের অনুসারী না হওয়া। আল্লাহ বলেন,

ولقد بعثنا في كلِّ أمةٍ رسولاً أنِ اعبدوا االله واجتنبوا الطاغوت

“আল্লাহর ইবাদত করার ও ত্বাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা নাহল ১৬: ৩৬]

এবং তিনি আরো বলেন,

واجتنبوا الرجس من الأوثان

“… সুতরাং তোমরা বর্জন কর মূর্তি পূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাক মিথ্যা কথন হতে”। [সূরা হজ্জ্ব ২২: ৩০]

এবং তিনি ইব্রাহীম (আ.) এর দোয়া সম্পর্কে বলেন,

واجْنُبْنِي وبنيّ أن نعبد الأصنام

“আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা হতে দূরে রেখ।” [সূরা ইব্রাহীম ১৪: ৩৫]

ত্বাগুতের আনুগত্য, গোলামী ও সমর্থনকে অস্বীকার করার মাধ্যমে যদি কেউ এই পৃথিবীতে ত্বাগুতকে বর্জন না করে, তাহলে আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কোন ভাল আমলই তার কাজে আসবে না এবং এজন্য সে অনুতপ্ত হবে এমন এক সময়ে যখন কোন অনুতাপই কাজে আসবে না। অতঃপর তারা পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে এবং তারা বলবে যে তারা ত্বাগুতকে প্রত্যাখান করবে এবং মজবুত হাতলের (ইসলামের বিধান) অনুসরণ করবে এবং এই মহান দ্বীনের (ইসলামী জীবন ব্যবস্থার) অনুসরণ করবে। আল্লাহ বলেন,

إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا ۗ كَذٰلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمٰلَهُمْ حَسَرٰتٍ عَلَيْهِمْ ۖ وَمَا هُم بِخٰرِجِينَ مِنَ النَّارِ

“যখন অনুসৃতগণ অনুসরণকারীদের দ্বায়িত্ব অস্বীকার করবে এবং তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, আর যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, ‘হায়! যদি একবার আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরাও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম যেমন তারা আজ আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল।’ এইভাবে আল্লাহ তাদের কার্যাবলীকে পরিতাপরূপে তাদেরকে দেখিয়ে দিবেন আর তারা কখনও অগ্নি হতে বের হতে পারবে না।” [সূরা বাকারা ২: ১৬৬-১৬৭]

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে; এই দুনিয়াতে ফিরবার কোন পথ থাকবে না। তাই যদি আপনি নিরাপত্তা চান এবং আল্লাহর দয়ার আশা করেন যা আল্লাহ সৎ কর্মশীল ব্যক্তিদের দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই এইসব ত্বাওয়াগীত (ত্বাগুতের বহু বচন)-দের বর্জন করতে হবে। প্রত্যাখ্যান করুন তাদের শিরকী মতাদর্শকে (গণতন্ত্র) এখনই! এই মুহূর্তে!!। কেউ আখেরাতে এদেরকে প্রত্যাখান করতে পারবে না যদি সে দুনিয়াতে এদেরকে প্রত্যাখান না করে। কিন্তু যারা তাদের (ত্বাগুতের) বাতিল জীবন ব্যবস্থাকে সাহায্য করবে এবং তার অনুসরণ করবে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন এক আহ্বানকারী বলবে, “সে তারই অনুসরণ করবে যার ইবাদত সে করতো। যে সূর্যের ইবাদত করত, সে সূর্যের অনুসরণ করবে। যে চন্দ্রের ইবাদত করত, সে চন্দ্রের অনুসরণ করবে। যারা মিথ্যা উপাস্যদের ইবাদত করত, তারা তাদের অনুসরণ করবে। কিন্তু যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল তাদেরকে বলা হবে, “তোমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছো?।” তোমরা কেন তাদের অনুসরণ করছো না? এবং তারা উত্তর দিবে, “আমরা আমাদের রবের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা তাদের অনুসরণ করছি না কারণ দুনিয়াতে আমরা তাদের অনুসরণ করিনি, যখন আমাদের টাকা পয়সা ও কর্তৃত্বের খুবই প্রয়োজন ছিল। তাহলে কিভাবে তুমি এখন আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করতে বলছ? [7]

এ ব্যাপারে আল্লাহ্ আরও বলেছেনঃ

احشروا الذین ظلموا وأزواجھم وما كانوا یعبدون

(ফিরিশতাদের বলা হবে) “একত্র কর জালিম ও তাদের সহচরদের এবং তারা যাদের ইবাদত করতো তাদের।” [সূরা সাফফাত ৩৭: ২২]

এখানে সহচর বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা তাদের পছন্দ করে, তাদের মিথ্যা আদর্শের সমর্থক কিংবা সাহায্যকারী। এরপর আল্লা­হ্ বলেছেনঃ

فَإِنَّهُمْ يَوْمَئِذٍ فِى الْعَذَابِ مُشْتَرِكُونَ إِنَّا كَذٰلِكَ نَفْعَلُ بِالْمُجْرِمِينَ إِنَّهُمْ كَانُوٓا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَآ إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ

তাদের সকলকেই সেই দিন শাস্তির জন্য শরীক করা হবে। অপরাধীদের প্রতি আমি এইরূপই করে থাকি। তাদের নিকট “আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই” বলা হলে তারা অহংকার করতো।” [সূরা সাফফাত ৩৭: ৩৩-৩৫]

সাবধান হও! একত্ববাদের কালেমাকে প্রত্যাখান কর না ও এড়িয়ে চলো না। এই কালেমা দ্বারা যা বোঝানো হয়েছে তার ব্যাপারে উদাসীন থেকো না। সর্বদা এর জন্য গর্ববোধ কর। এটা হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ। সত্য অনুসরণের ব্যাপারে অবজ্ঞা কর না, ত্বাগুতের সাহায্যকারী হয়ো না। কারণ তাহলে তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। শেষ বিচারের দিন তোমাকে তাদের (যালেমদের) সাথে উঠানো হবে, তাদের (যালেমদের) শাস্তির অংশীদার হতে হবে। তোমার অবশ্যই জানা উচিত যে, আল্লাহ আমাদের এই সত্য দ্বীন দিয়েছেন আর এই দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ‘ইসলাম’ অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পন করা এবং আল্লাহ এই দ্বীনকে তাঁর একাত্ববাদী বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। কাজেই যারা এর অনুসরণ করবে, তাদের আমল গ্রহণ যোগ্য হবে, আর যে কেউ অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তা প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং সে হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলছেনঃ

وَوَصّٰى بِهَآ إِبْرٰهِۦمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يٰبَنِىَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفٰى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ

“এবং ইব্রাহীম ও ইয়াকুব এই প্রসঙ্গে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, হে পুত্রগণ! আল্লহ্ই তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পনকারী না হয়ে তোমরা কখনও মৃত্যুবরণ কর না।” [সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৩২]

তিনি বলছেনঃ

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلٰمُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتٰبَ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًۢا بَيْنَهُمْ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِـَٔايٰتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

“নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন।” [সূরা আল-ইমরান ৩: ১৯]

এবং তিনি আরও বলছেনঃ

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ

“আর যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) গ্রহণ করতে চায় তা কখনও কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আল-ইমরান ৩: ৮৫]

‘দ্বীন’ (ধর্ম) শব্দটিকে শুধুমাত্র খ্রিষ্টান, ইহুদী এবং এমন অন্যান্য ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা থেকে সতর্ক থাকা উচিৎ, কারণ এতে হতে পারে যে কেউ অন্য কোন বাতিল জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ করবে এবং বিপথগামী হবে। ‘দ্বীন’ বলতে বোঝায় প্রত্যেক ধর্ম, জীবন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা এবং বিধান যা মানুষ অনুসরণ করে ও মেনে চলে। এই সকল বাতিল জীবন ব্যবস্থা ও মতাদর্শকে আমাদের অবশ্যই বর্জন ও পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই এগুলোকে অস্বীকার করতে হবে, এর সাহায্যকারী এবং সমর্থকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং শুধুমাত্র একত্ববাদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে; এই জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। সকল কাফের, যারা ভিন্ন জীবন ব্যবস্থার অনুসারী, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ আমাদেরকে এটাই বলার জন্য হুকুম দিয়েছেন,

قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡكَٰفِرُونَ (١) لَآ أَعۡبُدُ مَا تَعۡبُدُونَ (٢) وَلَآ أَنتُمۡ عَٰبِدُونَ مَآ أَعۡبُدُ (٣) وَلَآ أَنَا۠ عَابِدٞ مَّا عَبَدتُّمۡ (٤) وَلَآ أَنتُمۡ عَٰبِدُونَ مَآ أَعۡبُدُ (٥) لَكُمۡ دِينُكُمۡ وَلِيَ دِينِ (٦)

“বল, ‘হে কাফিররা আমি তার ইবাদত করি না যার ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি এবং আমি তার ইবাদতকারী না যার ইবাদত তোমরা করে আসছো। এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।” [সূরা কাফিরূন ১০৯: ১-৬]

তাই যখন কোন সমাজের মুসলিমদের অবশ্যই উচিৎ নয় কাফেরদের সাথে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐক্যমত হওয়া, মিলিত হওয়া অথবা সংগঠিত হওয়া যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। তারা যদি সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপারে একমত হয় তবে তাই তাদের দ্বীন (জীবন বিধান) হয়ে যাবে। রাসূল ﷺ বলেছেনঃ

“(মুসলিমদের থেকে) যে কেউ কোন মুশরিকের সাথে দেখা করে, একসাথে থাকে, বসবাস ও অবস্থান করে (চিরস্থায়ী রূপে) এবং তার (মুশরিক) জীবন পদ্ধতি, তার মত, ইত্যাদির সাথে একমত পোষণ করে এবং তার (মুশরিক) সাথে বসবাস উপভোগ করে, তাহলে সে তাদেরই একজন।” [8]

এই সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে সাম্যবাদ (Communism), সমাজতন্ত্র (Socialism), ইহবাদ (ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে যারা আলাদা ভাবে দেখে) বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ (Secularism) এবং অন্যান্য যত মতবাদ ও রীতিনীতি যা মানুষ নিজে উদ্ভাবন করেছে অতঃপর এসব মতবাদকে নিজের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হিসেবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট। এই সব দ্বীনের একটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। এটা এমন একটি জীবন ব্যবস্থা যা আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। এ লেখনীর মাধ্যমে, এই নবোদ্ভাবিত জীবন ব্যবস্থা – যার দ্বারা অনেক লোক মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছে, তার কিছু ভুল তুলে ধরা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা নিজের দ্বীনকে ইসলাম বলে দাবী করে (অর্থাৎ তারা দাবী করে যে তারা মুসলিম)। তারা জানে গণতন্ত্র এমন একটি দ্বীন যা ইসলাম থেকে আলাদা এবং তারা এও জানে এটি একটি ভ্রান্ত পথ, এবং এর প্রতিটি দরজায় শয়তান বসে মানুষকে জাহান্নামের দিকে ডাকছে।

ইহা বিশ্বাসীদের জন্যে স্মারকপত্র (মনে করিয়ে দেয়া) এবং

যারা জানে না তাদের জন্যে সতর্কবাণী,

এবং উদ্ধতের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলিল।

এবং ইহা আল্লাহর নিকট একটি ক্ষমা প্রার্থনা।

গণতন্ত্র একটি নব উদ্ভাবিত দ্বীন, যেখানে এর উদ্ভাবকরা হল মিথ্যা উপাস্য এবং অনুসারীরা হলো তাদের দাস

প্রথমতঃ আমাদের গণতন্ত্র (Democracy) শব্দটির উৎস সর্ম্পকে সচেতন হতে হবে। আমাদের সবার জানা থাকা উচিত যে এটা আরবী শব্দ নয়, এটি একটি গ্রীক শব্দ। দু’টি শব্দের সমন্বয়ে তা গঠিত হয়েছেঃ ‘গণ’ (Demos) অর্থ জনগণ এবং ‘তন্ত্র’ (Cracy) অর্থ হলো বিধান, কর্তৃত্ব বা আইন। গণতন্ত্রের শাব্দিক অর্থ হলো মানুষের দেয়া বিধান, মানুষের কর্তৃত্ব, বা মানুয়ের তৈরী আইন। গণতন্ত্রের সমর্থকদের মতে, এটিই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং এ কারণেই তারা এ ব্যবস্থার প্রশংসা করে এবং সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। একই সাথে, তা কুফর, শিরক, এবং মিথ্যা মতবাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক; কারণ আপনি জানেন, যে প্রধান কারণে আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে কারণে কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে এবং নবী-রাসূলগণ প্ররণ করা হয়েছে, আর যে ঘোষণা দেয়া আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক, তা হলো আল্লাহর একাত্ববাদের ঘোষণা। প্রতিটি ইবাদত একমাত্র তাঁরই দিকে নিবদ্ধ করা এবং তাঁকে ছাড়া অন্য সকল কিছুর ইবাদত করা হতে দূরে থাকা। বিধানের অর্থাৎ আইন, বিচার বা শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আনুগত্য যা এক ধরনের ইবাদত তা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য; আর এই আনুগত্য যদি অন্য কাউকে করা হয় তবে মানুষ মুশরিক হয়ে যাবে এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

গণতন্ত্র বলে থাকে আইন জনগণের দ্বারা বা অধিকাংশ লোকের দ্বারা প্রবর্তিত হয় যা গণতন্ত্র পন্থীদের সবচেয়ে বড় দাবী। কিন্তু বর্তমানে আইন প্রবর্তনের অধিকার চলে গেছে বিচারকদের হাতে বা বড় নেতা, বড় ব্যবসায়ী ও ধনীদের হাতে, যারা তাদের টাকা ও মিডিয়ার মাধ্যমে সংসদে স্থান করে নেয় এবং তাদের প্রধান উপাস্যরা (রাজা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ইত্যাদি) ক্ষমতা রাখে যে কোন সময় ও যে কোন ভাবে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার। সুতরাং, বহু ঈশ্বরবাদের (polytheism) এক পাশে হচ্ছে গণতন্ত্র এবং অন্য পাশে হলো আল্লাহর সাথে কুফরী করা যা অনেক কারণেই ইসলামের একত্ববাদের, নবী ও রাসূলদের দ্বীনের বিরোধী। আমরা এ গুলোর কিছু এখানে উল্লেখ করবো।

প্রথমতঃ এখানে আইন হচ্ছে মানুষের বা ত্বাগুতের, আল্লাহর আইন নয়। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ﷺ হুকুম দিয়েছেন আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার ফয়সালা করার জন্যে এবং মানুষের ইচ্ছা দ্বারা প্রভাবিত না হতে এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা থেকে সরে যেতে যেন প্রলুব্ধ না হন। আল্লাহ বলছেনঃ

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَآءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَنۢ بَعْضِ مَآ أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ

“কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি আল্লা­হ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুয়ায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি কর, তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ না কর এবং তাদের সম্বন্ধে সর্তক হও যাতে আল্লাহ্ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তারা তার কিছু হতে তোমাকে বিচ্যুত না করে” [সূরা মায়িদা ৫: ৪৯]।

এটাই ইসলামের একত্ববাদ। অথচ গণতন্ত্রে, যা একটি শিরকী জীবন ব্যবস্থা, তার দাসেরা বলে, “তাদের মাঝে বিচার কর যা মানুষের দ্বারা গ্রহীত হয়েছে এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর এবং ওদের ব্যাপারে সতর্ক হও যেন ওরা তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে না করে ওদের ইচ্ছা ও বিধানের দিকে।” তারা এ কথাটি বলে থাকে এবং গণতন্ত্রও তাই বলে থাকে। তারা নিজেরাই বিধান দিয়ে থাকে। এটি একটি স্পষ্ট কুফরী, বহু ঈশ্বরবাদ তথা শিরক, যদি তারা বিধান দেয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। তারা তাদের বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করে সাজায়, তাদের কার্যকলাপ আরও নিকৃষ্ট; যদি কেউ তাদের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বা তাদের নীতির সাথে এক মত না পোষণ করে বা বিরোধিতা করে তখন তারা বলে, “তাদের মাঝে ফয়সালা কর যেভাবে সংবিধান এবং তাদের বিশেষ শ্রেণীর লোকেরা চায় এবং ঐসব লোকেদের ঐক্যমত ছাড়া কোন বিধান, কোন আইন ব্যবহার করা যাবে না।”

দ্বিতীয়তঃ তাদের সংবিধানের মতে, আইন বা বিধান দিবে সংসদে নির্বাচিত কতিপয় মানুষ বা ত্বাগুতেরা যারা নিজেদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ করছে। এটা তাদের সংবিধানের কথা, যেই সংবিধানকে তারা আল-কুর’আন থেকেও পবিত্র বলে মনে করে থাকে। [9]

তারা এইসব মানব-রচিত সংবিধান বা আইনকে আল্লা­হ্ তা‘আলার নাযিলকৃত আল-কুর’আনের দেয়া বিধান বা আইনের উপর প্রাধান্য দেয়। সে জন্যে গণতন্ত্রে কোন শাসন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না যদি তা তাদের সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত না হয় কারণ তাদের আইনের উৎস হচ্ছে এই সংবিধান। গণতন্ত্রে আল কুর’আনের আয়াত, রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ্ ও তাঁর হাদীসের কোন দাম নেই। এটা তাদের জন্যে সম্ভব নয় যে, আল কুর’আন ও রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ্ অনুসারে কোন আইন প্রণয়ন করবে যদি তা তাদের ‘পবিত্র’ সংবিধনের সাথে না মিলে। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন তাহলে তাদের আইন বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞাস করতে পারেন। আল্লাহ বলেছেনঃ

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنٰزَعْتُمْ فِى شَىْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْءَاخِرِ ۚ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

“… অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোন ব্যাপারে মতবৈষম্যের সৃষ্টি হয় তবে সেটি আল্লা­হ্ ও রাসূল ﷺ-এর দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক। এটি সঠিক কর্মনীতি ও পরিণতির দিক দিয়ে এটিই উত্তম।” [সূরা আন্-নিসা ৪: ৫৯]

কিন্তু গণতন্ত্র বলেঃ “যদি তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দেয় তবে তা সংবিধান, সংসদ, রাষ্ট্রপ্রধান বা তাদের আইনের কাছে নিয়ে যাও।”

আল্লা­হ্ বলেছেন,

أُفٍّ لكم ولما تعبدون من دون ا الله أفلا تعقلون

“অভিশাপ তোমাদের উপর এবং তাদের উপর যাদের তোমরা আল্লাহর পাশাপাশি ইবাদত কর। তারপরও কি তোমরা বুঝবে না?” [সূরা আম্বিয়া ২১: ৬৭] [10]

জনসাধারণ যদি আল্লাহর শরীয়ত গণতন্ত্রের মাধ্যমে বা ক্ষমতাসীন মুশরিকদের আইনসভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে কখনও তারা তা করতে সক্ষম হবে না যদি ত্বাগুতেরা (রাজা, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট) অনুমতি না দেয়, যদি তাদের সংবিধান অনুমোদন না দেয় – কারণ এটিই গণতন্ত্রের ‘পবিত্র’ গ্রন্থ। অথবা বলা যায় যে, এটা গণতন্ত্রের বাইবেল বা তাওরাত যা তারা নিজেদের খারাপ ইচ্ছা ও খেয়াল-খুশি দ্বারা কুলষিত করেছে।

তৃতীয়তঃ গণতন্ত্র হচ্ছে সেকিউলারিজম-এর [11]নিকৃষ্ট ফল এবং এর অবৈধ সন্তান, কারণ সেকিউলারিজম হচ্ছে একটি ভ্রান্ত মতবাদ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসন-কতৃত্ব থেকে ধর্মকে আলাদা করা। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণ বা ত্বাগুতের শাসন; আল্লাহর শাসন নয় কারণ গণতন্ত্রে আল্লাহ আদেশ কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়, যতক্ষণ না তা তাদের সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এভাবে অধিকাংশ জনগণ যা চায়, অধিকন্তু—তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সমস্ত ত্বাগুতেরা যা চায় তা তাদের সংবিধানের অংশ হয়ে যায়। সুতরাং সমস্ত জনগণ যদি একসাথে হয়ে ত্বাগুতদের ও গণতন্ত্রের উপাস্যদের বলেঃ “আমরা আল্লাহর শাসন চাই, আমরা কোন মানুষকে, সাংসদদেরকে এবং শাসকদেরকে বিধানদাতা হতে দিব না। আমরা মুরতাদ, ব্যভিচারী, চোর, মদ্যপায়ীদের ক্ষেত্রে আল্লাহর শাস্তি জারি করতে চাই। আমরা মহিলাদেরকে হিজাব পরতে বাধ্য করতে চাই। আমরা পুরুষ ও মহিলাদেরকে তাদের সতীত্ব রক্ষা করতে বাধ্য করতে চাই। আমরা অনৈতিক অশ্লীলতা, ব্যভিচার, নীতি বহির্ভূত কাজ, সমকামিতা এবং এই ধরনের যত খারাপ কাজ আছে তা প্রতিরোধ করতে চাই।” সে মুহূর্তে, তাদের

উপাস্যরা বলবেঃ “এটা গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার ও ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ নীতির বিরোধী!” সুতরাং গণতন্ত্রের স্বাধীনতা হচ্ছেঃ আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ও বিধান থেকে মুক্ত হওয়া এবং তাঁর বেধে দেয়া সীমা লংঙ্ঘন করা। নৈতিক বিধানগুলো বিধিবদ্ধ করা হয় না এবং প্রত্যেকে যারা তাদের সাথে একমত হবে না অথবা তাদের দেয়া সীমা রেখা মানবে না, তাহলে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। [12]

এ কারণেই, গণতন্ত্র এমন একটা দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা যা আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা থেকে আলাদা। এটা হচ্ছে ত্বাগুতের শাসন, আল্লাহর শাসন নয়। এটা হচ্ছে অন্য উপাস্যদের আইন; আল্লাহর আইন নয়, যিনি একক এবং সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। যে কেউ গণতন্ত্রকে গ্রহণ করল, সে এমন আইনের শাসন মেনে নিলো যা মানব-রচিত সংবিধানের অনুসারে লেখা এবং সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দেয়া শাসন ব্যবস্থার চেয়ে ঐ শাসন ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিলো। সুতরাং, কোন ব্যক্তি আইন প্রণয়ন করুক বা নাই করুক, বহুঈশ্বরবাদীয় নির্বাচনে জয়ী হোক বা নাই হোক, কেউ যদি মুশরিকদের সাথে গণতন্ত্রের নীতির বিষয়ে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, বিচার ফয়সালা করার ক্ষেত্রে তাদের সাথে একমত হয় এবং আল্লাহর কিতাব, বিধান ও কর্তৃত্বের চেয়ে তাদের কিতাব, বিধান ও কর্তৃত্বকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে সে নিজে একজন অবিশ্বাসী রূপে পরিগণিত হবে। একারণেই, গণতন্ত্র অবশ্যই একটি স্পষ্ট ভ্রান্ত পথ; একটি শিরক ব্যবস্থা। গণতন্ত্রে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং প্রতিটি দল বা গোত্র বিভিন্ন উপাস্য থেকে তাদের উপাস্যকে নির্বাচন করে থাকে যে তার খেয়াল ও ইচ্ছা মতো বিধান দিবে কিন্তু তা হতে হবে সংবিধানের নীতি মোতাবেক। কেউ কেউ তাদের উপাস্যদের (বিধান দাতা) নির্বাচিত করে নিজস্ব মতবাদ বা চিন্তাধারা মোতাবেক; সুতরাং প্রত্যেক দলের নিজস্ব উপাস্য থাকে – কখনও গোত্রভিত্তিকভাবে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়, যেন প্রত্যেক গোত্রের একেকজন উপাস্য থাকে। কেউ আবার দাবি করে তারা ‘ধার্মিক উপাস্য’ নির্বাচিত করে, যার দাড়ি আছে [13]অথবা দাড়ি বিহীন উপাস্য বা ইলাহ এবং এমন আরও অনেক রকম। আল্লাহ বলেন:

أَمْ لَهُمْ شُرَكٰٓؤُا شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنۢ بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِىَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظّٰلِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“তাদের কি এমন কতগুলো ইলাহ (উপাস্য) আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেন নাই? ফয়সালার (বিচার দিবসের) ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়ে যেত। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।” [সূরা আস-শূরা ৪২: ২১]

এই এম.পি. রা বাস্তবেই অংকিত, খোদাই করে দাঁড় করানো মূর্তিদের মত উপাস্য যাদেরকে তাদের উপাসনালয়ে (সংসদ ভবন বা দলীয় অফিসে) স্থাপন করা হয়। এই সব প্রতিনিধিরা বা সাংসদরা গণতন্ত্র এবং সংসদীয় শাসন ব্যবস্থাকে তাদের দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা রূপে গ্রহণ করে থাকে। তারা সংবিধান অনুসারে দেশ শাসন করে থাকে, আইন দেয় এবং এর পূর্বে তারা তাদের সবচেয়ে বড় উপাস্য, সবচেয়ে বড় মুশরিক থেকে অনুমতি নিয়ে থাকে, যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় তা গ্রহণ বা বর্জনের। এই সবচেয়ে বড় উপাস্য হলো রাজপুত্র বা রাজা বা দেশের রাষ্ট্রপতি। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের বাস্তবতা এবং এই জীবন ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ। এটাই হচ্ছে মুশরিকদের দ্বীন, আল্লাহর দেয়া দ্বীন নয়, আল্লাহর রাসূলের ﷺ দ্বীন নয়। এটাই হচ্ছে বহু উপাস্যদের দ্বীন, এক আল্লাহর দ্বীন নয়। আল্লাহ বলেনঃ

يٰصٰىحِبَىِ السِّجْنِ ءَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوٰحِدُ الْقَهَّارُ مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسْمَآءً سَمَّيْتُمُوهَآ أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطٰنٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوٓا إِلَّآ إِيَّاهُ ۚ ذٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“… ভিন্ন ভিন্ন বহু উপাস্য শ্রেয়, না পরাক্রমশালী এক আল্লা­হ? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতকগুলি নামের ইবাদত কর, যেই নামগুলি তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ, এইগুলির কোন প্রমাণ আল্লা­হ্ পাঠান নাই।…” [সূরা ইউসুফ ১২: ৩৯-৪০]

তিনি আরো বলেনঃ

ۗأَءِلٰهٌ مَّعَ اللَّهِ ۚ تَعٰلَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

“… আল্লাহর সহিত অন্য ইলাহ আছে কি? ওরা যাকে শরীক করে আল্লাহ তা হতে বহু ঊর্ধ্বে।” [সূরা আন্ নামল ২৭: ৬৩]

কাজেই আপনাকে বেছে নিতে হবে ‘আল্লাহ্ প্রদত্ত দ্বীন, তাঁর বিশুদ্ধ বিধান, তাঁর দীপ্তিময় আলো ও তাঁর সীরাতুল মুসতাকিম (সরল পথ)’ অথবা ‘গণতন্ত্রের দ্বীন এবং এর বহু ঈশ্বরবাদ, কুফরী, এবং এর ভ্রান্ত পথের’ মধ্যে যেকোন একটিকে। আপনাকে অবশ্যই এক আল্লাহর বিধান অথবা মানব রচিত বিধানের মধ্যে থেকে যে কোন একটিকে গ্রহণ করতে হবে। আল্লা­হ্ বলেনঃ

قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَىِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطّٰغُوتِ وَيُؤْمِنۢ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقٰى لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

“… সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। যে ত্বাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লা­হ্তে ঈমান আনবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙ্গবে না।” [সূরা বাকারা ২: ২৫৬]

আরও বলেনঃ

وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ ۖ فَمَن شَآءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَآءَ فَلْيَكْفُرْ ۚ إِنَّآ أَعْتَدْنَا لِلظّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ۚ وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَآءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِى الْوُجُوهَ ۚ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَآءَتْ مُرْتَفَقًا

“বল, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক আর যার ইচ্ছা সত্য প্রত্যাখ্যান করুক।’ আমি যালিমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি…।” [সূরা কাহ্ফ ১৮: ২৯]

তিনি আরও বলেন,

أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُۥٓ أَسْلَمَ مَن فِى السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ قُلْ ءَامَنَّا بِاللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ عَلَيْنَا وَمَآ أُنزِلَ عَلٰىٓ إِبْرٰهِيمَ وَإِسْمٰعِيلَ وَإِسْحٰقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَآ أُوتِىَ مُوسٰى وَعِيسٰى وَالنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُۥ مُسْلِمُونَ وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ

“তারা কি চায় আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন? যখন আকাশে ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সমস্তই স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করেছে! আর তাঁর দিকেই তারা প্রত্যাবর্তন করবে। বল, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যা মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে প্রদান করা হয়েছে তাতে ঈমান এনেছি। আমরা তাঁদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না এবং আমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণকারী। কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চায় তাহলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আলে ইমরান ৩: ৮৩-৮৫]

গণতন্ত্রের প্রচারক ও সমর্থকদের ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক কতিপয় যুক্তির খন্ডন

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ

هُوَ الَّذِىٓ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتٰبَ مِنْهُ ءَايٰتٌ مُّحْكَمٰتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتٰبِ وَأُخَرُ مُتَشٰبِهٰتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشٰبَهَ مِنْهُ ابْتِغَآءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَآءَ تَأْوِيلِهِۦ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُۥٓ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرّٰسِخُونَ فِى الْعِلْمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُولُوا الْأَلْبٰبِ رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

“তিনিই তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কতক আয়াত ‘মুহ্কাম’ (সুস্পষ্ট), এগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহাত’ (অস্পষ্ট/রূপক); যাদের অন্তরে সত্য-লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে, আমরা এতে বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে আগত; এবং বোধশক্তি সম্পন্নরা ব্যতীত অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। হে আমাদের রব! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করোনা এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা।” [সূরা আলি ‘ইমরান ৩: ৭-৮]

এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর নীতি অনুযায়ী মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করেছেনঃ

♦ ঐ সমস্ত মানুষ যারা বিজ্ঞ এবং দৃঢ় বিশ্বাসীঃ

তারা ইহাকে (আল-কুর’আন) গ্রহণ করে এবং এর সব কিছুতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা সমন্বয় সাধন করে সাধারণের সাথে অসাধারণের, সসীমের সাথে অসীমের, এবং বিস্তারিতের সাথে সংক্ষিপ্তের। যদি তারা কোন বিষয়ে না জানে তাহলে তারা তা আল্লাহ্ প্রদত্ত সুদৃঢ় মূলনীতির দিকে ফিরে আসে।

♦ ঐ সমস্ত মানুষ যারা পথভ্রষ্ট ও ভুলের মধ্যে আছেঃ

এইসব মানুষ আল-কুর’আনের যে সব আয়াত অস্পষ্ট তার অনুসরণ করে থাকে। এরা এ কাজ করে ফিত্না ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। এরা যা স্পষ্ট ও বোধগম্য তার অনুসরণ করে না। এদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ওরা যারা গণতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে এবং সংসদ বা আইনসভা প্রতিষ্ঠা করেছে। এর সমথর্করা ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করে থাকে এবং এরাই অধিক ভুল করে। ওরা কিছু আয়াত নেয় এবং তা সুস্পষ্ট আয়াত, মূলনীতি ও ব্যাখ্যার সাথে সম্বনয় না করে গ্রহণ করে সত্যের সাথে মিথ্যার; আর আলোর সাথে অন্ধকারের সংমিশ্রণ ঘটানোর জন্যে।

অতঃপর, এখন আমরা ওদের কিছু ভ্রান্ত যুক্তি নিয়ে আলোচনা করব আল্লাহর সাহায্যে, যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, স্রষ্টা, পুনরুত্থানকারী ও অবাধ্য জনগোষ্টিকে পরাভ‚তকারী, তাদের যুক্তিগুলো খন্ডন করে সেগুলোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো।

প্রথম অযৌক্তিক অজুহাতঃ

 ইউসুফ (আ.) মিশরের রাজার পক্ষে কাজ করেছিলেন বা তার মন্ত্রী ছিলেন এই যুক্তিটি ঐসব গোঁড়ামিপূর্ণ লোকেরা দিয়েছিল যাদের গণতন্ত্রের পক্ষে অন্য কোন দলিল ছিল না। তারা বলতঃ ইউসুফ (আ.) কি ঐ রাজার পক্ষে কাজ করেনি যে আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাসনকার্য পচিালনা করত না? সুতরাং, তাদের মতে, কাফির সরকারের সাথে যোগ দেয়া এবং সংসদে বা আইনসভায় যোগ দেয়া এবং এই ধরনের লোকদের ভোট দেয়া বৈধ। ([14]) তাদের এই যুক্তির জবাবে যা কিছু বলব, তার সব ভাল আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং সব মন্দ আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে।

প্রথমতঃ ঐসমস্ত লোকেরা আইন সভায় বা সংসদে যোগদানকে বৈধ করার জন্যে যে যুক্তি দেয় তা অসত্য এবং ভ্রান্ত কারণ এই সংসদ এমন সংবিধানের উপর নির্ভরশীল যা আল্লাহর দেয়া বিধান বা সংবিধান নয়; অধিকন্তু—তা গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যা মানুষের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কোন কিছুকে হালাল (বৈধ) বা হারাম (অবৈধ) করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, মহান আল্লাহর নির্দেশের কোন পরোয়া করেনা। আল্লা­হ্ বলছেনঃ

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِى الْءَاخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِينَ

“কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চায় তবে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আলি ইমরান ৩: ৮৫]

সুতরাং, কেউ কি এমন দাবী করতে পারবে যে ইউসুফ (আ.) এমন কোন দ্বীন বা বিধানের অনুসরণ করেছিলেন যা আল্লাহ প্রদত্ত নয়? অথবা এমন কোন দ্বীনের অনুসরণ করেছিলেন যা তাঁর একত্ববাদী পূর্বপুরুষদের দ্বীন নয়? অথবা তিনি কি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থাকে সম্মান করার জন্যে শপথ নিয়েছিলেন অথবা সেই অনুসারে কি দেশ পরিচালনা বা শাসন করেছেন-যে রূপ, আজ যারা সংসদ দ্বারা বিমোহিত, যেরূপে বর্তমানে তারা শাসন পরিচালনা করছে? তিনি তাঁর দুর্বলতার সময়ে বলেছিলেনঃ

قَالَ لَا يَأْتِيكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِۦٓ إِلَّا نَبَّأْتُكُمَا بِتَأْوِيلِهِۦ قَبْلَ أَن يَأْتِيَكُمَا ۚ ذٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِى رَبِّىٓ ۚ إِنِّى تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُم بِالْءَاخِرَةِ هُمْ كٰفِرُونَ وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ ءَابَآءِىٓ إِبْرٰهِيمَ وَإِسْحٰقَ وَيَعْقُوبَ ۚ مَا كَانَ لَنَآ أَن نُّشْرِكَ بِاللَّهِ مِن شَىْءٍ ۚ ذٰلِكَ مِن فَضْلِ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى النَّاسِ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ

“যে সম্প্রদায় আলাহ্কে বিশ্বাস করে না ও আখিরাতে অবিশ্বাসী, আমি তাদের মতবাদ বর্জন করছি। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের মতবাদের অনুসরণ করি। আল্লাহর সাথে কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। এটা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। [সূরা ইউসুফ ১২: ৩৭-৩৮]

এবং তিনি আরও বলেছিলেনঃ

يٰصٰىحِبَىِ السِّجْنِ ءَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوٰحِدُ الْقَهَّارُ مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسْمَآءً سَمَّيْتُمُوهَآ أَنتُمْ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطٰنٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوٓا إِلَّآ إِيَّاهُ ۚ ذٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“হে কারা সঙ্গীরা ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয় না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতগুলো নামের ইবাদত করছো, যেই নাম তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছো, এইগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠান নাই। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন তাঁকে ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে, এটাই হলো সরল দ্বীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এই ব্যাপারে অবগত নয়।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৩৯-৪০]

কিভাবে এটা সম্ভব যে তিনি যখন শক্তিহীন ছিলেন তখন প্রকাশ্যে এই কথাটি বলেছিলেন আর যখন তিনি ক্ষমতা পেলেন তা গোপন করে ছিলেন বা তার বিপরীত কাজ করেছিলেন? এর জবাব কি দিবে, হে! যারা এই মিথ্যা দাবীতে

বিশ্বাসী। হে রাজনৈতিক নেতারা, আপনি কি জানেন না, যে মন্ত্রণালয় (যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীদের মন্ত্রীপরিষদ রয়েছে) হলো একটি কার্য নির্বাহী কর্তৃপক্ষ (যারা কর্ম সম্পাদনের জন্যে ক্ষমতা প্রাপ্ত) এবং সংসদ হলো একটি আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ (যাদের কাজ আইন প্রণয়ন করা) এবং এই দু’য়ের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে? এই দু’য়ের মধ্যে আদৌ কোন তুলনা সম্ভব নয়।

এখন, আপনি অবশ্যই নিশ্চিত যে ইউসুফ (আ.) ঘটনা সংসদে যোগদান করার জন্যে কোন বৈধ যুক্তি হতে পারে না। অধিকন্তু, এই বিষয়টি আরো একটু আলোচনা করা যাক এবং আমরা এটাও বলতে পারি যে, এই ঘটনাকে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের জন্যে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না কারণ, সংসদ ও মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়া উভয়ই কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার শামিল।

দ্বিতীয়তঃ ইউসুফ (আ.) এর কাজের সাথে গণতন্ত্রের সেবকব বাতিল রাষ্ট্রের, মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণকারীদের তুলনা করা যায় না যারা আল্লাহর পাশাপাশি বিধান দেয় এবং আল্লাহর দ্বীনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাঁর শত্রুদের সাহায্য করে। এটা বাতিল এবং অযৌক্তিক তুলনা, এর কারণ হচ্ছেঃ

(১)- যে কেউ ঐ সমস্ত সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অংশগ্রহণ করে, যেখানে আল্লাহর  বিধান বা শরীয়তকে প্রয়োগ করা হয় না, তাদেরকে অবশ্যই মানুষের তৈরী সংবিধানকে গ্রহণ করতে হয় এবং আনুগত্য ও একনিষ্ঠতা প্রর্দশন করতে হয় সেই সব ত্বাগুতের প্রতি যাদের সাথে কুফরী (অস্বীকার) করার আদেশ আল্লাহ একেবারে প্রথমেই দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ ءَامَنُوا بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓا إِلَى الطّٰغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوٓا أَن يَكْفُرُوا بِهِۦ وَيُرِيدُ الشَّيْطٰنُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلٰلًۢا بَعِيدًا

“… তারা ত্বাগুতের কাছে বিচার প্রার্থী হতে চায়, যদিও ওদেরকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” [সূরা নিসা ৪: ৬০]

তাদেরকে অবশ্যই মন্ত্রিপরিষদে ঢোকার পূর্বেই এই কুফরী সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্যে সরাসরি শপথ করতে হয় যে রূপ সংসদে অংশ গ্রহণের সময় বলতে হয়। [15]

যে এই দাবী করবে যে ইউসুফ (আ.) যিনি ছিলেন বিশ্বাসযোগ্য, মহান এক ব্যক্তির সন্তান, ঐরকম করেছেন (কুফরী করেছে) যদিও আল্লাহ তাঁকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “আমি তাঁকে মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়ে ছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধ চিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।” [16]

ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে জেনে বুঝে কেউ মিথ্যা আরোপ করলে সেই ব্যক্তি একজন কাফির হয়ে যাবে, সে হবে নিকৃষ্ট লোকদের একজন এবং সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। সে ইবলিসের চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট হয়ে যাবে, যখন আল্লাহর সম্মতি নিয়ে সে শপথ করে এই বলেছিল,

قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ

“আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি ওদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের ব্যতীত।” [সূরা সাদ ৩৮: ৮২-৮৩]

ইউসুফ (আ.) প্রকৃতপক্ষে আল্লা­হ্ তা‘আলার একজন মনোনীত বান্দা ও মানব জাতির একজন মহান নেতা।

(২)- যে এই সমস্ত সরকারের মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়, সে সাংবিধানিক ভাবে শপথ গ্রহণ করুক বা না করুক, সে মানুষের তৈরী বিধানের আনুগত্য করতে এবং পরিপূর্ণ ভাবে তা মেনে নিতে বাধ্য। সে তখন ঐ মতবাদের একজন আন্তরিক দাস ও একান্ত বাধ্যগত সেবকে পরিণত হয় যে মতবাদ মিথ্যা, অধর্ম, অন্যায়, নাস্তিকতা এবং কুফরী দ্বারা মিশ্রিত।

ইউসুফ (আ.) যিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী ছিলেন, তিনি কি সেরূপ হতে পারেন? তার কাজকে কি আমরা কাফিরদের মধ্যে যোগ দানের সাথে তুলনা করব? যে কেউ আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ.); যিনি আল্লাহর নবীর ছেলে ও আল্লাহর নবীর দৌহিত্র; তাকে এমন কোন ব্যাপারে অভিযুক্ত করবে যে, তার কার্যক্রম ছিল আজকের এই কুফরী মতবাদ- গণতন্ত্রের দাসদের মত তাহলে সেই ব্যক্তির কুফরী সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহই থাকবে না এবং সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। সে একজন অবিশ্বাসী হয়ে যাবে কারণ আল্লাহ বলেনঃ “প্রত্যেক জাতির কাছে আমি একজন নবী পাঠিয়ে ছিলাম এই কথা বলার জন্যে, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এবং সমস্ত ত্বাগুত থেকে দূরে থাক’।” [17]

এটাই ছিল ইউসুফ (আ.) এবং সমস্ত নবীদের (আ.) সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তাহলে, এটা কি আদৌ সম্ভব যে তিনি মানুষকে আল্লাহর হুকুমের দিকে ডেকেছেন দু’সময়েই – যখন তিনি ক্ষমতাশীল ছিলেন এবং যখন তিনি দুর্বল ছিলেন; তারপর তিনি আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হলেন অথচ আল্লাহ তার ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন তার একজন পরিশুদ্ধ, একনিষ্ঠ বান্দা হিসেবে? কিছু মুফাস্সিরীন ([18]) বলেছেন এই আয়াত ([19]) হচ্ছে একটি দলিল যে, ইউসুফ (আ.) রাজার আইন ও নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করেননি এবং তাকে তা মানতে বা প্রয়োগ করতে বাধ্য করা হয়নি। বর্তমানে ত্বাগুতের মন্ত্রীপরিষদ বা তাদের সংসদ কি ঐভাবে পরিচালিত যেভাবে ইউসুফ (আ.)-এর সময় পরিচালিত হত? একজন মন্ত্রী কি ঐভাবে দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী কাজ করতে স্বাধীন? যদি তা না হয়, তাহলে এই দু’য়ের মধ্যে কোন তুলনা চলে না।

(৩)- ইউসুফ (আ.) মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আল্লাহর সাহায্যে। আল্লাহ  বলেনঃ

وَكَذٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِى الْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَآءُ ۚ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَن نَّشَآءُ ۖ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ

“এইভাবেই ইউসুফকে আমি সেই দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম।” [সূরা ইউসুফ ১২: আয়াত ৫৬]

সুতরাং, এটাই হচ্ছে আল্লাহর দেয়া কর্তৃত্ব, কোন ব্যক্তি বা রাজার ক্ষমতা ছিল না তাকে আঘাত করার বা তাকে সেই কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করার, যদিও তিনি রাজা এবং তার বিধান ও বিচার ব্যবস্থার বিরূদ্ধাচরণ করেছিলেন। ইউসুফ (আ.)-কে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দেয়া হলেও, কিভাবে এই সব নিকৃষ্ট ও মন্দ লোকগুলোকে, যারা ত্বাগুতের সরকারের বড় বড় পদে আসীন, তাঁর সাথে তুলনা করা যায়, যিনি একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতেন?

(৪)- ইউসুফ (আ.) রাজার কাছ থেকে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়েই মন্ত্রী পরিষদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ বলছেনঃ

وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِى بِهِۦٓ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِى ۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُۥ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ

“অতঃপর রাজা যখন তাঁর সাথে কথা বলল, তখন রাজা বলল, ‘নিশ্চয়ই, আজ তুমি আমাদের নিকট বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছ’।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৫৪]।

তাকে কোন প্রকার শর্ত বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই মন্ত্রী পরিষদ পরিচালনা করার জন্যে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।

وَكَذٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِى الْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَآءُ ۚ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَن نَّشَآءُ ۖ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ

“এইভাবেই ইউসুফকে আমি সে দেশে প্রতিষ্ঠত করেছিলাম; তিনি সেই দেশে যথা ইচ্ছা স্থান করে নিতে পারতেন”। [সূরা ইফসুফ ১২: ৫৬]

তার কোন প্রতিপক্ষ ছিল না, কেউ তাকে তার কাজের জন্যে প্রশ্ন করার ছিল না।

এখনকার ত্বাগুতের মন্ত্রীদের কি এমন কোন কিছু আছে যা এক্ষেত্রে তুলনা যোগ্য? যদি মন্ত্রী এমন কিছু করেন যা রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা বা রাজপুত্রের দ্বীন বা দেশের সংবিধানের বিরোধী, তাহলে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্ত করা হবে।

তাদের মতে মন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা বা রাজপুত্রের ইচ্ছা, তাদের নীতি বা প্রজাতন্ত্রের দাস এবং তাকে তা অবশ্যই মানতে হবে। সে কখনই রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজার হুকুমকে অথবা সংবিধানকে অমান্য করতে বা এর অবাধ্য হতে পারবে না, যদিও তা আল্লাহর হুকুমের এবং তাঁর দ্বীনের (ইসলামের) বিরোধী হয়। যে কেউ বর্তমান অবস্থাকে ইউসুফ (আ.) এর অবস্থার মতই বলে দাবী করবে, সে নিজের অপরিসীম ক্ষতি করবে। সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে একজন কাফির বলে বিবেচিত হবে এবং ইউসুফ (আ.)-কে আল্লাহ যে পরিশুদ্ধ করেছেন তাতে অবিশ্বাসী বলে বিবেচিত হবে। যেহেতু বর্তমান অবস্থা ইউসুফ (আ.) এর মত নয়, তাই এই দু’য়ের মধ্যে তুলনা করা উচিৎ নয়। সুতরাং ত্বাগুতদেরকে তাদের নির্বোধ কথাবার্তা এবং কূটতর্ক এখানেই ত্যাগ করতে হবে।

তৃতীয়তঃ এই মিথ্যা যুক্তিকে খন্ডন করার আরেকটি মারাত্মক অস্ত্র হচ্ছে, যে কোন কোন মুফাস্সিরীনের মতে সেই রাজা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইবন আব্বাস (রা.)-এর ছাত্র মুজাহীদ (রহ.) তা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এই প্রমাণই এ ঘটনাকে ব্যবহার করার সকল যুক্তিকে বাতিল করে দেয়। আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস রাখি এবং বিশ্বাস করি যে, তাঁর কোন সৃষ্টির কথা অথবা ব্যাখ্যা, যার কোন দলিল ও প্রমাণ নেই, তার চেয়ে আল্লাহর কিতাবের আক্ষরিক অর্থের আনুগত্য করা আরও বেশী যথার্থ। ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে আল্লাহর কথাই আমাদের জন্যে সুদৃঢ় প্রমাণঃ

وكذلك مكنا لیوسف في الأرض

“সুতরাং এইভাবেই ইউসুফকে আমি সেই দেশে প্রতিষ্ঠিত করিলাম”। [সূরা ইউসুফ ১২: ২১]

আল্লা­হ্ আল-কুর’আনে অন্য এক জায়গায় এই বিষয়ের সারমর্ম বর্ণনা করেছেন। তিনি ঈমানদারদের অবস্থান বর্ণনা করছেন যখন তাদেরকে তিনি কোন ভূমিতে কর্তৃত্ব দেনঃ

الَّذِينَ إِن مَّكَّنّٰهُمْ فِى الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَءَاتَوُا الزَّكٰوةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عٰقِبَةُ الْأُمُورِ

“আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দিবে ও অসৎকার্যের নিষেধ করবে; আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে”। [সূরা হাজ্জ ২২: ৪১]

আমাদের এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইউসুফ (আ.) তাদের মধ্যে একজন। শুধু তাই নয় তিনি তাদের মধ্যেও একজন মহান নেতা, যাদেরকে আল্লাহ পৃথিবীতে ক্ষমতা দিলে তারা সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করে। যারাই ইসলাম সম্পর্কে জানে তাদের কারও কোন সন্দেহ নেই যে ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট বিষয় হল তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ), যা ছিল ইউসুফ (আ.)-এর দাওয়াতের মূল বাণী এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে আল্লাহর সাথে অংশীদারীত্ব (শিরক) যেই ব্যাপারে ইউসুফ (আ.) সতর্ক করেছিলেন, ঘৃণা করেছিলেন এবং অংশীদারীত্ববাদের মিথ্যা প্রভুদের ও দেবতাদের আঘাত করেছিলেন। অবশ্যই সুনিশ্চিত নিদর্শন আছে যে, আল্লাহ যখন ইউসুফ (আ.)-কে ক্ষমতা দান করেছিলেন, তিনি তাঁর পিতৃপুরুষ, ইয়াকুব (আ.) ও ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বীনের অনুসরণ করেছিলেন এবং মানুষকে সেদিকে আহ্বান করেছিলেন এবং যারা এই দাওয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করত বা অসম্মতি প্রকাশ করত তাদের প্রত্যেককেই আক্রমন করেছিলেন। তিনি আল্লাহর শরীয়ত পরিত্যাগ করেননি। তিনি আল্লাহর শরীয়ত বা বিধান প্রতিষ্ঠিত না করার ক্ষেত্রে কাউকে সাহায্য করেননি। তিনি কোন বিধানদাতা (যারা আল্লাহর আইন বিরোধী বিধান প্রতিষ্ঠা করে) বা কোন ত্বাগুতদের সাহায্য করেননি। তিনি তাদেরকে এরূপ সাহায্য করেননি যে রূপ বর্তমান সময়ের ক্ষমতার দাসে পরিণত হওয়া মানুষেরা করছে। তিনি তাদের সাথে আইন প্রণয়নে অংশ গ্রহণ করেননি যে রূপ আজকের মোহগ্রস্থ লোকগুলো সংসদে করছে। তিনি তাদের আচার-আচারণ এবং কর্মপন্থা অস্বীকার ও বর্জন করেছিলেন। তিনি তাদের খারাপ কাজগুলোকে পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি আল্লাহর একত্ববাদের দিকে মানুষকে ডেকেছিলেন এবং তাদেরকে আক্রমন করেছিলেন যারা এর বিরোধিতা করেছিল, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। যে কেউ এমন বিশ্বাসযোগ্য, সম্মানজনক, মহৎ ব্যক্তিদের সন্তানের নামে এমন কিছু বর্ণনা দেয় যা আল্লাহর দেয়া বর্ণনা থেকে ভিন্ন, তাহলে সে পবিত্র ইসলাম থেকে বের হয়ে একজন অপবিত্র কাফিরে পরিণত হবে। এই ব্যাপারে অপর একটি দলিল হচ্ছে আল্লাহর এই কথার ব্যাখ্যাঃ

وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِى بِهِۦٓ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِى ۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُۥ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ

“রাজা (যখন এই ব্যাপারটি শুনল সে) বলল, ‘ইউসুফকে আমার নিকট নিয়ে আসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর নিযুক্ত করব’, যখন সে (রাজা) তাঁর [ইউসুফ (আ.)] সাথে কথা বলল, সে বলল, ‘নিশ্চয়ই, আজ তুমি আমাদের নিকট বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছ’।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৫৪]

কেউ কি চিন্তা করতে পারে রাজার সাথে ইউসুফ (আ.) কি বিষয়ে কথা বলেছিলেন; তিনি কি রাজাকে তাকে ভালবাসার জন্যে, তাকে ক্ষমতা দেয়ার জন্যে, তাকে বিশ্বাস করার এবং তার প্রতি আস্থা রাখার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন? তিনি কি মন্ত্রী, আল-আজিজ, এর স্ত্রীর ঘটনার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন, যেই ঘটনার সমাপ্তি হয়েছিল সকলের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে? অথবা তিনি কি জাতীয় ঐক্য এবং অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেছিলেন? বা অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে? কেউই এমন দাবী করতে পারবে না যে তার অদৃশ্যের জ্ঞান আছে অথবা কেউ প্রমাণ ছাড়া কোন কথা বলতে পারেন না। যদি সে তা করে, সে একজন মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে। কিন্তু এই আয়াত “যখন সে তাঁর সাথে কথা বলেছিল …” এর ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আল্লাহ্ ইবাদত করার ও ত্বাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা নাহল ১৬: ৩৬]

এবং আল্লা­হ্ বলেন,

وَلَقَدْ أُوحِىَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخٰسِرِينَ

“তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই এই প্রত্যাদেশ হচ্ছে যে, তুমি আল্লাহর সাথে শরীক স্থির করলে তোমার সমস্ত আমল নিস্ফল হবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে” [সূরা-যুমার ৩৯: ৬৫]।

এবং তাঁর কথার মাধ্যমে ইউসুফ (আ.)-এর দাওয়াত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা পাওয়া যায়, “যে সম্প্রদায় আলাহ্কে বিশ্বাস করে না এবং আখিরাতে অবিশ্বাসী আমি তাদের মতবাদ বর্জন করেছি। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের মতবাদ অনুসরণ করি, কোন বস্তুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা আমাদের কাজ নয়।” [সূরা-ইউসুফ ১২: ৩৭-৩৮]

এবং তাঁর বক্তব্য, “হে কারা সঙ্গীরা ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয় না পরাক্রমশালী এক আল্লা­হ্? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতগুলো নামের ইবাদত করছো, যেই নাম তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছো, এইগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ্ পাঠান নাই। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লা­হরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন তাঁকে ব্যাতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে, এটাই সরল দ্বীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এই ব্যাপারে অবগত নয়”। [সূরা-ইউসুফ ১২: ৩৯-৪০]

অতএব, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটাই ইউসুফ (আ.)-এর মহান বক্তব্য কারণ, এটি তাঁর মহামূল্যবান জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন) এবং এটিই তাঁর দাওয়াতের, তাঁর দ্বীন এবং তাঁর পিতৃপুরুষদের দ্বীনের ভিত্তি। যদি তিনি কোন অসৎ কাজের নিষেধ করে থাকেন, তাহলে তার মধ্যে শিরকের চেয়েও অধিক কোন খারাবি হতে পারেনা যা তা এই মূলনীতির (তাওহীদের) বিরোধিতা করে থাকে। যদি এটা সত্য বলে গৃহীত হয় এবং তাঁর প্রতি রাজার উত্তর হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই, আজ তুমি আমাদের নিকট বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছ’, তাহলে এটা সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, রাজা তাকে অনুসরণ করেছিল, তার সাথে এক মত হয়েছিল, শিরকী জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন) পরিত্যাগ করেছিল এবং ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.)-এর দ্বীনের অনুসরণ করেছিল। ধরে নেই যে, অন্তত রাজা ইউসুফ (আ.) ও তার পিতার তাওহীদ ও দ্বীন যে সঠিক সে ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছিল। সে তাকে বলার স্বাধীনতা, তার দ্বীনের দিকে আহ্বান করার অনুমতি এবং যারা এর বিরোধী তাদের আক্রমন করার অনুমতি দিয়েছিল। এবং রাজা তাকে কোন বাধা দেয়নি এই কাজগুলো করার জন্যে, না তাকে তার দ্বীনের বিপরীত কোন কিছু করার জন্যে আদেশ করেছিল। তাহলে ইউসুফ (আ.)-এর অবস্থা ও আজকে যারা ত্বাগুতের প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে আছে, আর যারা তাদের সাহায্য করছে সংসদে আইন প্রণয়নে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে, তাদের অবস্থার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে।

চতুর্থতঃ যদি আপনি উপরোক্ত সব কিছু জানেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত যে, ইউসুফ (আ.)-এর মন্ত্রনালয়ে অংশগ্রহণ একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল না এবং ইবরাহীম (আ.)-এর দ্বীনের সাথেও সাংঘর্ষিক ছিল না। কিন্তু বর্তমান সময়ের ত্বাগুতের মন্ত্রনালয়ে অংশগ্রহণ তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। ধরে নেই, রাজা ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং কাফেরই ছিল। তারপরও ইউসুফ (আ.)-এর শাসন ভার গ্রহণ করা একটা ছোট বিষয়, এটা প্রধান বিষয় হতে পারে না কারণ এটা হয়তোবা দ্বীনের উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল না। কারণ ইউসুফ (আ.) কোন প্রকার কুফরী বা শিরক করেননি। তিনি কাফেরদের অনুসরণ করেননি অথবা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও বিধান মেনে নেননি। তিনি মানুষকে তাওহীদের দিকে ডেকে ছিলেন। শরীয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ্ বলছেনঃ

لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ

“আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি শরী’আত ও একটি স্পষ্ট পথ এবং একটি জীবন পদ্ধতি দিযেছি।” [সূরা মায়িদা ৫: ৪৮]

এমন কি নবীদের শরীয়াহ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু তারা সবাই তাওহীদের ক্ষেত্রে এক। রাসূল মুহাম্মদ ﷺ বলেন,

نحن معاشرَ الأنبیاء إخوةٌ لعلات دیننا واحد

“আমরা (নবীরা) একে অপরের ভাই যাদের পিতা একজনই কিন্তু মাতা ভিন্ন ভিন্ন, আমাদের দ্বীনও একই।” ([20])

তিনি বুঝিয়েছেন যে তাদের সকলেই তাওহীদের ক্ষেত্রে এক ছিলেন এবং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে এবং শরীয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল। সুতরাং কোন একটা জিনিস আমাদের জন্যে পূর্বের কোন আইন অনুসারে অবৈধ হতে পারে কিন্তু আমাদের শরীয়ায় তা বৈধ হতে পারে যেমন গণীমতের মাল অথবা বিপরীতটাও সত্য হতে পারে অথবা তা পূর্বে জাতিদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু আমাদের জন্যে বৈধ। সুতরাং অতীতের সমস্ত আইনই আমাদের আইন নয়, বিশেষত যখন তা আমাদের শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক (পরস্পরবিরোধী) হয়। এরূপ একটি সাংঘর্ষিকতার নিদর্শনস্বরূপ বলা যায়, যা ইউসুফ (আ.)-এর জন্য বৈধ ছিল, তা আমাদের জন্য

অবৈধ। ইবন হিব্বান তার বইতে এবং আবূ ইয়ালা এবং আত্-তাবারানীতে বর্ণনা করেন যে রাসূল মুহাম্মদ ﷺ বলেছেন,

لیأتین علیكم أُمراء سفھاء یقربون شرار النّاس، ویُؤخرون الصلاة عن مواقیتھا، فمن

أدرك ذلك منكم فلا یكونن عریفًا، ولا شرطیاً، ولا جابیاً، ولاخازنا

“অপরিণতমনস্ক ব্যক্তি শাসক হিসেবে তোমদের কাছে আসবে এবং সবচেয়ে খারাপ কাজটি করবে, খারাপ লোকেরা হবে তার সঙ্গী এবং তারা সালাত বিলম্বে আদায় করবে। তোমাদের মধ্যে যারাই তা অনুধাবন করবে, তারা যেন তাদের উচ্চ পদে আসীন না হয় বা তাদের কর্মচারী না হয় অথবা তাদের সংগ্রহকারী অথবা কোষাধ্যক্ষ না হয়।”

এখানে যা বোঝানো হয়েছে তা হচ্ছে এই শাসক কাফের নয় কিন্তু তারা হবে অসৎ চরিত্রের এবং নির্বোধ। একজন সতর্ককারী সাধারণত সবচেয়ে বড় অন্যায় এবং গর্হিত কাজ সম্পর্কে সতর্ক করে। তাই, যদি তারা কাফের হতো, তাহলে রাসূল ﷺ তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু তাদের সবচেয়ে খারাপ কাজ যা রাসূল ﷺ এখানে

উলে­খ করেছেন তা হচ্ছে তারা সবচেয়ে খারাপ লোকদেরকে বন্ধু বানাবে এবং সালাতে শৈথিলতা প্রকাশ করবে। এরই কারণে নবী মুহাম্মদ ﷺ আমাদের কাউকে তাদের কোষাধ্যক্ষ বা মন্ত্রী হতে অনুমতি দেননি। সুতরাং যদি আমাদের আইনে অত্যাচারী শাসকের কোষাধ্যক্ষ বা মন্ত্রী হিসেবে কাজ করা নিষিদ্ধ এবং অবৈধ, তবে কিভাবে একজন কাফের রাজা এবং মুশরিক শাসকের মন্ত্রী হিসাবে কাজ করা বৈধ হবে?

قال اجعلني على خزائن الأرض إني حفیظٌ علیم

“আমাকে দেশের ধনভান্ডারের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন, আমি তো উত্তম রক্ষক, সুবিজ্ঞ।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৫৫]

এটা সত্য এবং সুনিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত যে এটা পূর্ববতী লোকদের দ্বীনের সাথে সংশিষ্ট এবং এটাকে আমাদের আইনে বাতিল করা হয়েছে এবং আল্লাহই ভাল জানেন। এটাই পর্যাপ্ত হওয়া উচিত তার জন্যে যে হেদায়াত চায় কিন্তু যে তার নিজের চিন্তাভাবনা, মানুষের মতামত এবং কথাকে দলিল এবং প্রমাণ থেকে বেশি প্রাধান্য দেয়- সে সুনিশ্চিতভাবে হেদায়াত পাবে না।

ومن یرد الله فتنته فلن تملك له من االله شیئاً

“আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান না তার জন্য আল্লাহর নিকট তোমার কিছুই করার নেই।” [সূরা মায়িদা ৫: ৪১]

পরিশেষে, এই অসার, অমূলক যুক্তি সম্পর্কে কথা শেষ করার আগে আমরা কিছু মোহগ্রস্থ ব্যক্তিদের ভ্রান্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিতে চাই যারা শিরক ও কুফরে নিমজ্জিত প্রমানিত হয় তাদের কুফরী মন্ত্রনালয়ে এবং শিরকী সংসদে যোগ দেয়ার মাধ্যমে। তারা ইউসুফ (আ.) এর রাজার মন্ত্রনালয়ে যোগদেয়ার ব্যাপারে শাইখ-উল-ইসলাম ইবন তাইমিয়ার উক্তিকে তাদের যুক্তি ও অজুহাতের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। এটা প্রকৃত পক্ষে মিথ্যার সাথে সত্যের সংমিশ্রণ। এটা শাইখ-এর উপর মিথ্যা অপবাদ এবং তার সম্পর্কে খারাপ বক্তব্য দেয়া ছাড়া কিছুই না। তিনি এই কাহিনী উলে­খ করে সংসদে অংশগ্রহণ এবং কুফরী করার অথবা আল্লাহর বিধান প্রয়োগ না করার দলিল হিসেবে তা ব্যবহার করেননি। না, আমরা বিশ্বাস করি যে, এই মুসলিম শাইখ এবং তার দ্বীন এবং তার কলব এই খারাপ দাবী থেকে মুক্ত। পরবর্তীকালে ভন্ড লোকেরা ছাড়া আর কেউই তা দাবী করতে পারে না। আমরা এটা বলছি কারণ কোন জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মুসলমান এই ধরনের বক্তব্য দিতে পারে না। কাজেই, শাইখের মতো একজন আলেম কিভাবে এটা বলতে পারে, যদিও এ ব্যাপারে তার বক্তব্য পরিষ্কার এবং পুরোপুরিভাবে আপোষহীন। তার সমস্ত বক্তব্যের মূল লক্ষ্য ছিল দু’টি কাজের মধ্যে জঘন্যতমটি প্রতিরোধ করা এবং দু’টি পরস্পর বিরোধী বিষয়ের মধ্যে থেকে যেটা উত্তম বিষয়টি গ্রহণ করা। আপনি জানেন যে, দুনিয়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাওহীদ এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন বা শিরক করা। ‘আল-হিসবা’এ বর্ণিত আছে যে, ইউসুফ (আ.) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভাল কাজে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ([21])

অর্থাৎ বিবিধ সম্পাদিত কাজের উত্তম তদারকি বা তত্ত্বাবধান করা। ইউসুফ (আ.)-এর কাজের বর্ণনায় তিনি (ইবনে তাইমিয়া) বলেছেন- “তিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভাল কাজে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি তাদেরকে ঈমানের দিকে ডেকেছেন যতটুকু তারপক্ষে সম্ভব।” তিনি আরো বলেছেন, কিন্তু তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব তিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভাল কাজ সম্পাদন করেছিলেন।” ([22])

নিঃসন্দেহে আল্লাহ উল্লেখ করেননি যে, ইউসুফ (আ.) আল্লাহর পাশাপাশি বিধান দিয়েছিলেন বা আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিধান দ্বারা বিচার কার্য সম্পাদন করেছিলেন বা তিনি গণতন্ত্রের অথবা এমন দ্বীনের (জীবন ব্যবস্থা) অনুসরণ করেছেন যা আল্লাহর দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে মোহগ্রস্থ ব্যক্তিরা তার কথার সাথে তাদের কুৎসিত প্রমাণের মিশ্রণ ঘটায় এবং সাধারণ মানুষদেরকে বিপথে নেওয়ার জন্যে মিথ্যা যুক্তি দাঁড় করায়। তারা মিথ্যার সাথে সত্যকে এবং অন্ধকারের সাথে আলোর সংমিশ্রণ ঘটায়। আমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে যে দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে তা হল, আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসূল ﷺ যিনি আমাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক। আল্লাহর রাসূলের ﷺ কথার পর অন্য কারও কথা গ্রহণ করা হতে পারে বা নাও হতে পারে। একারণেই যদি এই কথা শেখ ইবনে তাইমিয়ার হয়ও- তারা যে রূপ দাবী করছে বা তার চেয়েও বড় কোন আলেমেরও হয়, আমরা তা গ্রহণ করবো না যতক্ষণ না তারা প্রমাণ দিতে পারে যে রূপ আল্লাহ বলেছেনঃ

قلْ ھاتوا برھانكم إن كنتم صادقین

“বলঃ যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর।” [সূরা বাকারা ২: ১১১]

কাজেই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, তাওহীদকে আঁকড়ে থাকুন। মুশরিকদের এবং তাওহীদের শত্রুদের পথভ্রষ্ঠকারী এবং মিথ্যা গুজবে কর্ণপাত করবেন না। তাদের অসঙ্গতিপূর্ণ কূটতর্কে কর্ণপাত করবেন না। তাই নিজের তওহীদকে শক্ত হাতে ধরে রাখুন। শিরকের অনুসারীদের এবং তাওহীদের শত্র“দের বিপথগামী মিথ্যা প্রচারণার দিকে মনোনিবেশ করবেন না। আল্লাহর দ্বীনের অনুসরণ করে এমন লোকের মতো হয়ে যান, যে সব লোকদের সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে নবী মুহাম্মদ ﷺ বলেন,

لا یضرّھم من خالفھم ولا من خذلھم حتى یأتيَ أمرُ االله وھم كذلك

“তারা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে না যারা দ্বিমত পোষণকরবে এবং তাদেরকে ত্যাগ করবে যতক্ষণ না আল্লাহর নির্ধারিত দিবস আসে, যে সময় পর্যন্ত তারা ঐ পথেই থাকবে।” ([23])

দ্বিতীয় অযৌক্তিক অজুহাতঃ

যদিও নাজ্জাসী আল্লাহর শারীআহ্ প্রয়োগ করেনি, তথাপি সে মুসলিম ছিল।রাজনৈতিক দলগুলো, হোক না তারা ক্ষমতাসীন শাষক গোষ্ঠী বা বিরোধীদল, নাজ্জাসীর ঘটনাকে ব্যবহার করে ত্বাগুতের কার্যাবলীকে বৈধ করার জন্যে। তারা বলেঃ “নাজ্জাসী ইসলাম গ্রহণের পর তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করেন নাই এবং এরপরও রাসূল ﷺ তাকে আল্লাহর ন্যায়নিষ্ঠ দাস বলেছেন, তার জন্যে জানাযার সালাত পড়ে ছিলেন এবং সাহাবীদের তাই করতে আদেশ করেছিলেন।” সফলতা আসে একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে; এই ব্যাপারে আমাদের কথা হলোঃ

প্রথমতঃ যারা এই প্রতারণামূলক যুক্তিটি দেখান, সবার প্রথমে তাদেরকে যাচাই যোগ্য ও সঠিক দলিল দ্বারা প্রমাণ করতে হবে যে, নাজ্জাসী ইসলাম গ্রহণের পরও আল্লাহর দেয়া বিধান প্রয়োগ করেননি। আমি তাদের যুক্তিটি বিচার বিশ্লেষণ করার পর যা পেলাম তা হলো, অসত্য বিবৃতি ও ভিত্তিহীন আবিষ্কার যা কিনা সত্যিকারের বা যাচাই যোগ্য কোন দলিল দ্বারা প্রমানিত নয়। আল্লাহ বলছেনঃ

قل ھاتوا بُرھانكم إن كنتم صادقین

“বলঃ যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর।” [সূরা বাকারা ২: ১১১]

দ্বিতীয়তঃ আমাদের মতে এবং যারা আমাদের বিরোধিতা করেন তাদেরও মতে সত্য হচ্ছে যে, নাজ্জাসী মারা গিয়েছিলেন ইসলামের হুকুম পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বে; তিনি মারা গিয়েছিলেন এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلٰمَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِى مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

“আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করিলাম।” [সূরা মায়িদা ৫: ৩]

এই আয়াতটি নাযিল হয়েছিল বিদায় হজ্জের সময় কিন্তু নাজ্জাসী মারা গিয়েছিলেন তার পূর্বে যে রূপ হাফিজ ইবনে কাসির (রহ.) এবং অন্য আলেমগণ বর্ণনা করেছেন। ([24])

সুতরাং সেই সময় তার জন্য কর্তব্য ছিলো আল্লাহর বিধান যতটুকু জানা ছিল ততটুকু অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করা, আনুগত্য করা এবং কার্য সম্পাদন করা। এই ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় ছিল আল-কুর’আনের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো।

আল্লাহ্ বলছেনঃ

وَأُوحِىَ إِلَىَّ هٰذَا الْقُرْءَانُ لِأُنذِرَكُم بِهِۦ وَمَنۢ بَلَغَ ۚ

“এই কুর’আন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটা পৌঁছাবে তাদেরকে এর দ্বারা আমি সর্তক করি।” [সূরা আন‘আম ৬: ১৯]

সেই সময় যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ রকম ছিল না যা আমরা আজকে দেখতে পাচ্ছি। কিছু হুকুম কারও কাছে পৌঁছাতে কয়েক বছর লেগে যেত এবং কোন কোন সময় এমনও হতো যে, রাসূল ﷺ এর কাছে না আসা পর্যন্ত কোন কোন হুকুম জানাও যেত না। সুতরাং সেই সময় দ্বীন ছিল নতুন এবং আল-কুর’আন তখনও নাযিল হচ্ছিল। সেই কারণেই দ্বীন তখনও পরিপূর্ণ হয়নি। এই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায় বুখারী শরীফের বর্ণনা মতে; আব্দুলাহ ইবনে মাসুদ বলেছিলেনঃ “আমরা রাসূল ﷺ কে সালাতের মধ্যে সালাম দিতাম এবং তিনি তার উত্তর দিতেন। কিন্তু নাজ্জাসীর কাছ থেকে ফিরে আসার পর আমরা তাকে সালাম দিলাম কিন্তু তিনি সালামের উত্তর দিলেন না। তিনি বললেনঃ “সালাতের একটি উদ্দেশ্য আছে।” যে সমস্ত সাহাবীরা ইথোপিয়ায় ছিল, যা ছিল নাজ্জাসীর পাশে, রাসূল (ﷺ) এর হুকুমের অনুসরণ করে আসছিল কিন্তু তারা জানতো না যে সালাতের মধ্যে কথা বলা এবং সালাম দেয়া নিষেধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও সালাত একটি ফরজ হুকুম এবং রাসূল ﷺ প্রতিদিন দিনে রাতে পাঁচ বার করে সালাতের ইমামতি করেছিলেন। আজ যারা শির্কী মতবাদ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা কি এমন দাবী করতে পারবেন যে, আল-কুর’আনের, ইসলামের হুকুম তাদের কাছে পৌঁছায়নি? তারা কি ভাবে তাদের এই অবস্থানকে নাজ্জাসীর ঐ অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করবেন যখন ইসলাম পরিপূর্ণ ছিল না?

তৃতীয়তঃ এটা জানা কথা যে নাজ্জাসী আল্লাহর হুকুমের যতটুকু জানতেন ততটুকু প্রয়োগ করতেন, আর যে কেউ এর বিপরীত কথা বলবে, তাকে প্রমাণ ছাড়া কিছুতেই বিশ্বাস করা যাবে না কারণ ইতিহাসের প্রমাণাদি আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে, তিনি সেই সময় আল্লাহর আইন সম্পর্কে যতটুকু জানতেন, ততটুকু প্রয়োগ করতেন।

(১) সেই সময় তাকে আল্লাহর যে সব হুকুম মানতে হতো তার একটি হলোঃ “আল্লাহর একত্ববাদেকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদ ﷺ-কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মানা এবং ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর দাস ও রাসূল বলে বিশ্বাস করা।” তিনি তা করে ছিলেন কিন্তু আপনি কি তা দেখতে পান তাদের প্রমাণে? নাজ্জাসীর যে চিঠিটি তিনি রাসূল ﷺ-কে দিয়েছিলেন তা তারা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ওমর সোলায়মান আল-আসকর তার পুস্তিকা “The Council’s Judgement of the Participation in the Ministry and the parliament”-পুস্তকে তা উলে­খ করেছেন।

(২) তার রাসূল ﷺ-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং হিজরত করার জন্যে অঙ্গীকারঃ পূর্বের চিঠিটিতে সেই বিষয়ের প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে, নাজ্জাসী বলেছিলেনঃ “আমি রাসূলের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করছি” এবং তার ছেলে জাফর (রা.) এবং তার সঙ্গীদের কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং তিনি জাফর (রা.) এর সাহায্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এই চিঠিতে উল্লেখ ছিল যে, নাজ্জসী তার ছেলেকে (আরিয়া বিন আল-আসরাম ইবন আবজার) রাসূল ﷺ-এর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এতে আরও উল্লেখ ছিল যে, “ও আল্লাহর রাসূল ﷺ যদি আপনি চান আমি আপনার কাছে চলে আসি, আমি অবশ্যই তা করবো। কারণ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনার কথা সত্য।” তারপরই সে মারা যায় অথবা রাসূল ﷺ সেই সময় চাচ্ছিলেন না যে তিনি তা করুক। এই সমস্ত ব্যাপারগুলো পরিষ্কার নয় এবং এই ঘটনার কোন সঠিক দলিল নেই। সুতরাং এই ধরনের কোন রায় এবং একে একটি দলিল হিসেবে ব্যবহার করা গ্রহণ যোগ্য নয়। অধিকন্তু, তা তাওহীদ ও ইসলামের মূলনীতির বিরোধী হয়ে যাবে।

(৩) রাসূল ﷺ ও তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করা এবং তার আনুগত্য করাঃ নাজ্জাসীর কাছে যারা হিজরত করে গিয়েছিল, তিনি তাদের সাহায্য করেছিলেন এবং তাদেরকে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তিনি তাদের পরিত্যাগ করেননি। তিনি তাদেরকে কোরআইশদের হাতেও তুলে দেননি। তিনি ইথোপিয়ান খ্রিষ্টানদের তাদের ক্ষতি করতে দেননি, যদিও ঈসা (আ.) সম্পর্কে তাদের আক্বিদা সঠিক ছিল। আরও একটি চিঠি ছিল যা নাজ্জাসী রাসূল ﷺ কে প্রেরণ করেছিলেন (ওমর আল-আসকর এই চিঠিটির কথাও উক্ত পুস্তিকাতে উলে­খ করেছেন) যাতে উলে­খ ছিল যে তিনি তার ছেলেকে ৬০ জন ইথোপিয়ান লোক সহ রাসূল ﷺ এর কাছে প্রেরণ করে ছিলেন তাকে সাহায্য, তার আনুগত্য এবং তার সঙ্গে কাজ করার জন্যে। তথাপিও ওমর আল-আসকর সহসা তার উক্ত পুস্তিকাতে বলে যে নাজ্জাসী আল্লাহর দেয়া বিধান প্রয়োগ করেনি যা কিনা একটা মিথ্যা এবং একজন মুওয়াহীদের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে, সেই সময় তিনি যতটুকু আল্লাহর হুকুম জেনেছিলেন ততটুকু প্রয়োগ করেছিলেন। এবং যে এটা ছাড়া অন্য কিছু বলবেন, আমরা তা কখনও বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি সুনিশ্চিত দলিল দিতে পারেন। অন্যথায় সে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেঃ “বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর।” তিনি (ওমর আল-আসকর) তার দাবীর পক্ষে কোন সুনিশ্চিত দলিল দেননি। কিন্তু তিনি তার প্রমাণের জন্যে কিছু ইতিহাস গ্রন্থের অনুসরণ করেছেন এবং আমরা সকলেই জানি এইসব ইতিহাস গ্রন্থের অবস্থা আর তা নিঃসন্দেহে ঘোলাটে বা অনিশ্চিত তথ্য সম্বলিত।

চতুর্থতঃ নাজ্জাসীর অবস্থা এরূপ ছিল যে তিনি যখন দেশের শাসক, তিনি কাফের ছিলেন এবং তারপর ইসলাম গ্রহণ করে তার রাজত্ব চলাকালে। তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন পরিপূর্ণ ভাবে রাসূল (ﷺ) এর হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমে, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল তার পুত্রকে প্রেরণ করা, রাসূল (ﷺ) এর কাছে কিছু লোকবল প্রেরণ এবং হিজরত করার জন্যে রাসূল (ﷺ) এর কাছে অনুমতি চাওয়া। রাসূল (ﷺ)-কে এবং তার দ্বীনকে সাহায্য করার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো

তার অনুসারীদের সাহায্য করা। আপাত দৃষ্টিতে তিনি সব ত্যাগ করেছিলেন যা ছিল ইসলাম বিরোধী। তিনি সত্যকে জানার এবং দ্বীনকে শেখার চেষ্টা করেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত যা ঘটেছিল দ্বীনের বিধান পরিপূর্ণ হওযার পূর্বে এবং তার

কাছে পরিপূর্ণ রূপে পৌঁছানোর পূর্বে। এই ব্যাপারটি রাসূল (ﷺ) এর বাণী থেকে এবং এ সম্পর্কিত সঠিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত। যারা এ ব্যাপারে একমত নন তাদের প্রত্যেককে আমরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি তারা যা বলছেন তা প্রমাণ করার জন্যে সঠিক দলিল দিয়ে কারণ শুধু মাত্র ইতিহাস গ্রন্থ কোন দলিল হতে পারে না।

যে পরিস্থিতির সঙ্গে তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে তুলনা করছেন তা সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিন্ন। এটা হচ্ছে এমন এক দল লোকের ব্যাখ্যা যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করছে আবার তারা ত্যাগ করছে না যা ইসলামের বিপরীত বা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। তারা ইসলামের ওপর আছে বলে দাবী করছে আবার একই সময়ে তারা ধরে রেখেছে যা ইসলামের বিপরীত এবং এটা নিয়ে তারা গর্বও বোধ করে। তারা নাজ্জাসী যেভাবে খৃষ্টধর্ম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেভাবে গণতন্ত্রের দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করেনি, বরং, তারা গণতন্ত্রের পক্ষে দেয়া বক্তব্যসমূহ ও প্রচারণায় মোহগ্রস্থ হয়ে মানুষেকেও এই মিথ্যা দ্বীনের প্রতি আহবান করছে। তারা নিজেদেরকে ‘আলিহা’-তে পরিণত করে, মানুষের জন্য আইন প্রণয়ন করে, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন দিনও অনুমতি দেননি, তারা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সাথে তাদের এই দ্বীনের ব্যাপারে একমত হয়ে তাদের কাজে যোগদান করে, তারা কাফিরদের সাথে তাদের তৈরী সংবিধান অনুসারে দেশ পরিচালনা করছে। তারা এই সংবিধানকে অনুসরণ করছে এবং তাদেরকে ঘৃণা করে যারা এই সংবিধানকে আক্রমন বা প্রত্যাখ্যান করে। তারা দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার পরে এবং তাদের কাছে আল-কুর’আনের বাণী এবং রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ্ পৌঁছানোর পরেও এই সব কিছু করছে। আপনি যেই হোন না কেন আমি আপনাকে শপথ করে বলছি, এটা কি ন্যায় সঙ্গত যে এই মিথ্যা, অন্ধকারময়, দুর্গন্ধময় পরিস্থিতিকে এমন একজন মানুষের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা, যে কিনা ইসলামের সঙ্গে বেশী দিন ধরে পরিচিত নয়, যে কিনা সত্যের সন্ধান করছিলেন এবং সাহায্য করেছিলেন দ্বীনকে তা পরিপূর্ণ হওয়ার এবং তার কাছে পৌঁছানোর পূর্বে? কতই না ব্যবধান এই দুই পরিস্থিতির মানুষগুলোর মধ্যে! হ্যাঁ, তারা হয়তো বুঝাতে চায় দু’টি পরিস্থিতি একই কিন্তু তা সত্যের মাপকাঠিতে নয়! এই দুই অবস্থা সমান হতে পারে বাতিলের মানদন্ডে, যাদের উপর থেকে আল্লাহ্­তাঁর হেদায়েত বোঝার বোধশক্তি উঠিয়ে নিয়েছেন তাদের ইসলাম বিরোধী গণতন্ত্র নামক দ্বীনে বিশ্বাসের কারণে।

وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَو وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ أَلَا يَظُنُّ أُولٰٓئِكَ أَنَّهُم مَّبْعُوثُونَ لِيَوْمٍ عَظِيمٍ

“দুর্ভোগ তাহাদের জন্যে যাহারা মাপে কম দেয়, যাহারা লোকের নিকট হইতে মাপিয়া লইবার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাহাদের জন্যে মাপিয়া অথবা ওজন করিয়া দেয়, তখন কম দেয়। উহারা কি চিন্তা করে না যে, উহারা পুনরুথিত হইবে মহাদিবসে?” [সূরা মুতাফফিফীন ৮৩: ১-৫]

তৃতীয় অযৌক্তিক অজুহাতঃ

গণতন্ত্রকে বৈধ করার জন্যে তাকে পরামর্শসভা বা শুরা কমিটি নাম দেয়া বা তার সাথে তুলনা করা। কিছু অজ্ঞ লোক মুওয়াহীদদের ব্যাপারে আল্লাহর বক্তব্যকেঃ

وأمرھم شورى بینھم

“… যাহারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।” ([25])

এবং রাসূল (ﷺ) এর কথাকে –الأمـر في وشاورھم “… এবং তারা সকল বিষয়ে পরামর্শ করে” ব্যবহার করে তাদের ভ্রান্ত দ্বীন গণতন্ত্রের পক্ষে দলিল দেয়ার জন্যে। তারা গণতন্ত্রকে শুরা (তারা বলে যে গণতন্ত্র আর ইসলামিক শুরা বোর্ড একই) বলে অভিহিত করে এই ভ্রান্ত দ্বীনকে ধর্মীয় রংয়ে-রাঙ্গাতে চায় এটাকে বৈধ করার জন্যে। এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য নিম্নে দেয়া হলো এবং আমরা আল্লা­হর সাহায্য কামনা করছিঃ

প্রথমতঃ নাম পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ নাম পরিবর্তন করার মাধ্যমে মূল বিষয়টি পরিবর্তিত হয়ে যায় না। কিছু ধর্মীয় দল কাফেরদের এই দ্বীনে বিশ্বাস করে এবং বলেঃ আমরা গণতন্ত্র বলতে বুঝাতে চাচ্ছি (আমরা যখন এর দিকে আহ্বান করি, উৎসাহ দেই, এর পক্ষে কাজ করি) বাক স্বাধীনতা এবং মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকার স্বাধীনতা এবং এই ধরনের আরো অনেক কিছু। আমরা তাদেরকে বলিঃ তুমি এর দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছ বা কি কল্পনা করছো তাতে কিছু যায় আসেনা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গণতন্ত্র আসলেই কী ত্বাগুতেরা যেটিকে প্রয়োগ করছে এবং তারা যেই মতবাদের দিকে মানুষকে ডাকছে এবং যার নামে নির্বাচন করা হচ্ছে। শাসন ও বিচার ব্যবস্থা যেখানে আপনারা অংশ গ্রহণ করছেন কার দেয়া বিধান অনুসারে চলবে? আপনারা হয়তো মানুষকে প্রতারিত করতে পারবেন কিন্তু কখনই আল্লা­হ্কে প্রতারিত করতে পারবেন না।

إنّ المنافقین یُخادعون االله وھو خادعھم

“নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লা­হ্কে প্রতারিত করতে চায় কিন্তু আল্লা­হ্ই তাদেরকে প্রতারিত করবেন।” [সূরা নিসা ৪: ১৪২]

এবং

یُخادعون االله والذین آمنوا وما یخدعون إلا أنفسھم وما یشعرون

“আল্লা­হ্ এবং মুমিনগণকে তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ভিন্ন কাউকেও প্রতারিত করে না, এটি তারা বুঝতে পারে না”। [সূরা-বাকারা ২: ৯]

সুতরাং কোন জিনিসের নাম পরিবর্তন করে দিলেই ঐ জিনিসের রীতি-নীতির পরিবর্তন হয়ে যায় না। নাম পরিবর্তনরে মাধ্যমে হারাম কখনও হালাল হবে না এবং হালাল কখনও হারাম হয়ে যাবে না। রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ

لَیَسْتَحِلَّنَ طائفةٌ مِنْ أُمّتي الخمرَ باسمٍ یُسَمُّونَھا إِیَّاه

“আমার উম্মতের এক দল লোক মদকে বৈধ করবে একে ভিন্ন একটি নাম দিয়ে।”

আলেম এবং বিচারকগণ যারা ইসলামের তাওহীদকে অপমান বা আক্রমন করে, তাদের প্রত্যেককেই কাফের বলে গণ্য করেন। তারা গণ্য করেন তাদের প্রত্যেকেই কাফের হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়ে যায় যে, তারা কোন র্শিকী কাজের নাম বদলে দিয়ে সেই কাজে লিপ্ত হয়; ঠিক তাদের মত যারা এই র্শিকী মতবাদ, কুফর তথা গণতন্ত্রকে “শুরা” বলে তা বৈধ করতে চায় এবং মানুষকে এদিকে ডাকে।

দ্বিতীয়তঃ মুশরিকদের গণতন্ত্রের সাথে মুওয়াহীদদের পরামর্শকে (শুরা) তুলনা করা এবং শুরা পরিষদ এর সাথে পাপিষ্ঠ, অবাধ্য কাফেরদের পরামর্শ পরিষদ একই রকম বলা একটা নিকৃষ্ট তুলনা। আপনি জানেন যে, সংসদীয় পরিষদ হলো মূর্তি পূজার একটি মন্দিরের ন্যায় এবং শিরক-এর প্রানকেন্দ্র যেখানে থাকে গণতন্ত্রের উপাস্যগুলো এবং তাদের প্রভু ও সহযোগীরা, যারা দেশ শাসন করে তাদের সংবিধান এবং আইন অনুসারে যার অনুমতি আল্লাহ্ তা‘আলা দেননি। আল্লাহ্ বলছেনঃ

“হে কারা সঙ্গীরা ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয় না পরাক্রমশালী এক আল্লা­হ্ ? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতগুলো নামের ইবাদত করছো, যেই নাম তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছো, এইগুলোর কোন প্রমাণ আল্লা­হ্ পাঠান নাই। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লা­হরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন অন্য কারও ইবাদত না করতে, কেবল তাঁর ব্যতীত, এটাই সরল দ্বীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ইহা আবগত নয়।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৩৯-৪০]

এবং তিনি আরও বলছেনঃ “তাদের কি অন্য অংশীদার/ইলাহ আছে যারা তাদের জন্যে বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের যার অনুমতি আল্লাহ্ দেন নাই?” [সূরা শূরা ৪২: ২১]

সুতরাং এই তুলনাটি শিরক-এর সঙ্গে তাওহীদের, অবিশ্বাস এর সঙ্গে বিশ্বাস (আল্লা­হ্তে) এর তুলনা করার মত। এটা হচ্ছে আল্লাহর ও তার দ্বীনের উপর মিথ্যা আরোপ করা। এটি হচ্ছে সত্যের সাথে মিথ্যার, অন্ধকারের সঙ্গে আলোর সংমিশ্রণ করা। এক জন মুসলিমকে অবশ্যই জানতে হবে যে আল্লা­হর দেয়া শুরা এর সঙ্গে নোংরা গণতন্ত্রের পার্থক্য হচ্ছে আকাশের সঙ্গে পাতালের যে রূপ পার্থক্য বা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে যে পার্থক্য সে রূপ। শুরা বা পরামর্শ করা হচ্ছে একটি স্বর্গীয় পদ্ধতি বা নিয়ম এবং গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের তৈরী যা দুর্নীতিগ্রস্থ এবং কুরুচীপূর্ণ।পরামর্শ করা হলো আল্লা­হর দেয়া একটি বিধান, আল্লা­হর দ্বীনের অংশ কিন্তু গণতন্ত্র হলো আল্লা­হর বিধান, আল্লা­হর দ্বীনের সাথে কুফরী করা, আল্লা­হর দ্বীনকে অস্বীকার করা। পরামর্শ বা শুরা হবে সেই বিষয়ে যেই বিষয়ে আল্লা­হ ও তাঁর রাসূলের কোন পূর্ব সিদ্ধান্ত নেই কিন্তু যখনই আমাদের কাছে আল-কুর’আনের আয়াত থাকবে, দলিল বা রায় থাকবে, তখন কোন পরামর্শ হবে না। আল্লা­হ বলছেনঃ

وما كان لمؤمنٍ ولا مؤمنةٍ إذا قضى االله ورسولُھ أمراً أن یكون لھم الخیرة من أمرھم

“যখন আল্লা­হ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন, তখন সে বিষয়ে কোন মুমিন পুরুষ বা মুমিন নারীর ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই”। [সূরা আহযাব ৩৩: ৩৬]

গণতন্ত্রের দুই দিকই ঝুঁকিপূর্ণ। এক দিকে আল্লা­হর বিধান নিয়ে পরামর্শের কোন সুযোগ নেই। এবং অন্য পাশে গণতন্ত্রে মানুষের বিধান, মানুষের দেয়া আইনকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তারা এটা তাদের সংবিধান থেকে পেয়েছেঃ

জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রে মানুষই সর্বময় কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার মালিক। গণতন্ত্র হচ্ছে অধিকাংশ লোকের দেয়া আইন, অধিকাংশ লোকের শাসন, এবং অধিকাংশ লোকের দেয়া দ্বীন। অধিকাংশই নির্ধারণ করে কোনটি হালাল, কোনটি হারাম। এভাবে গণতন্ত্রে মানুষ সৃষ্টিকর্তার স্থানে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শুরায়, মানুষ বা অধিকাংশ লোক আল্লাহর হুকুম, আল্লাহর রাসূলের হুকুম এবং তারপর মুসলিম নেতার আনুগত্য করতে বাধ্য। এবং নেতা অধিকাংশের মতামত বা রায় গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। এমন কি অধিকাংশ লোক নেতার আনুগত্য করতে বাধ্য যদিও নেতা কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয় যতক্ষণ না তা আল্লাহর অবাধ্যতা হয়। গণতন্ত্র এবং এর দিকে আহবানকারীরা আল্লাহর আইনের, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। তারা আত্মসমর্পণ করতে নাকট করে এই বলে যেঃ আইন হবে অধিকাংশের মতের অনুসারে, …। এই পৃথিবীতে এই কথা শোনা অনেক ভাল মহান বিচার দিবসে শোনার চেয়ে যে দিন মানুষ তার বিচারের সম্মুখীন হবে, যখন তারা হাউজে কাওসারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবে এবং ফেরেশতারা তাদেরকে প্রতিরোধ করবে। বলা হবে “তারা পরিবর্তন করে ছিল”, তখন রাসূল (ﷺ) বলবেনঃ

سُحقاً سُحقاً لمن بدّل بعدي

“তারা জাহান্নামে, তারা জাহান্নামে, যারা আমার পরে পরিবর্তন সাধন করেছে।”

গণতন্ত্রের উৎপত্তি কুফরী এবং নাস্তিকতার ভূমি থেকে, এটি ইউরোপের কুফরী এবং দুর্নীতির কেন্দ্রস্থলগুলো হতে উদ্ভূত হয়, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের রীতি-নীতি ও ধর্ম ছিল আলাদা। এই মতবাদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল এমনই এক পরিবেশের যেখানে এই মতবাদের সমস্ত বিষ ও ত্রুটি বিদ্যমান ছিল। সম্ভবত পশ্চিমা বিশ্বে সেকুলারিজম (ধর্ম থেকে জীবনের আলাদা করার রীতি) চর্চা শুরুর পূর্বে থেকেই গণতন্ত্রের চর্চা ছিল, আর সে কারণেই সমকামিতা, মদ্যপান ও অন্যান্য গর্হিত কাজ সেখানে বৈধ ছিল। তাই যে কেউ এই মতবাদের প্রশংসা করে বা এটিকে ‘শুরা’র সাথে এক করে সে অবশ্যই একজন কাফের-অবিশ্বাসী, না হয় মূর্খ এবং নির্বোধ। বর্তমানে এখানেই ঘটেছে দুইটি বিপরীত জিনিসের সংমিশ্রণ। শয়তানের অনুসারীরা যে কাফেরদের মতবাদে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অবাক হয়ে যাই তাদের কথা শুনলে যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করে আবার মানুষকে গণতন্ত্রের প্রতি উৎসাহ দেয় এবং একে বৈধতার রং দিতে চায়। পূর্বে যখন মানুষ সমাজতন্ত্রের প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন কিছু লোক ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা বলা শুরু করেছিল এবং তারও পূর্বে ছিল জাতীয়তাবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ এর কথা। আজকাল তাদের অনেকেই গর্ববোধ করছে এবং মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে এই সংবিধানের প্রতি… তারা লজ্জাও বোধ করে না ইসলামিক ফুকাহাদের বাদ দিয়ে এই সংবিধানের দাসদের ফুকাহা নাম দিতে এবং তাদেরকে এই নামে ডাকতে। তারা একই অভিব্যক্তিগুলো ব্যবহার করে যেরূপ ইসলামিক আইনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যেমন আইনদাতা, বৈধ, অবৈধ, অনুমোদন যোগ্য, নিষিদ্ধ, এবং তারপরও তারা ভাবে তারা সকলেই সঠিক পথে আছে, তারাই হেদায়েত প্রাপ্ত। কোন শক্তি, কোন ক্ষমতা নেই শুধু মাত্র আল্লাহর ছাড়া। এটি জ্ঞানী ও বিবেকবানদের হারানো ছাড়া কিছুই নয় এবং সঠিক ও যোগ্য লোকদের বাদ দিয়ে অযোগ্য লোকদেরকে কঠিন কাজের দায়িত্ব অর্পন করা। তারা সমস্ত— কিছু অযোগ্য, কুচক্রের অধিকারী লোকদের কাছে দিয়ে দিয়েছে। কি করুনাই করা হয়েছে বিজ্ঞজন ও জ্ঞানীদের প্রতি, দ্বীন এবং এর প্রকৃত আহবানকারীদের প্রতি। আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, এটা খুবই আজব ব্যাপার যে, অনেক মানুষই নিজেকে মুসলিম দাবী করে কিন্তু তারা ‘লা ইলাহা ইলালাহ’-এর অর্থ জানে না। তারা জানে না এর শর্তগুলো কী, এর দাবীগুলো কী। তাদের অনেকই সব সময় এর (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই) বিরোধিতা করে এবং বর্তমানের র্শিকী মতবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তারা নিজেদেরকে মুওয়াহীদ এবং এর দিকে মানুষকে আহবানকারী বলে দাবী করে। তাদের অবশ্যই এই কালেমার অর্থ ও এর প্রকৃত দাবী সম্পর্কে জানতে আলেমদের কাছে যেতে হবে, কারণ আল্লাহ বনী আদমকে প্রথম যে হুকুমটি দিয়েছেন তা হলো এই কালেমা সম্পর্কে জানা। এই কালেমার শর্তগুলো কী কী এবং কী কী এর সাথে সাংঘর্ষিক তা অজু বা সালাত ভঙ্গের কারণ জানার পূর্বে জানতে হবে কারণ কোন অজু বা কোন সালাতই কবুল হবে না যদি কারও মধ্যে তাওহীদের বিপরীত কিছু থাকে। যদি তারা উদ্ধত হয় ও সত্য গ্রহণ না করে, তাহলে তারা ক্ষতি গ্রস্থদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।

ইসলামী আইনবীদ এবং আলেম আহমেদ শাকির (রহ.)-এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আমি শেষ করবো, যিনি ঐ সব কাফেরদের কথার উত্তর দিয়েছেন যারা আল্লাহর বাণীর বিকৃতি ঘটায় এবং “যাহাদের বিষয়গুলো পারস্পরিক

আলোচনার মাধ্যমে স্থিরকৃত হয়” এই আয়াতের অপব্যবহারকরে তাঁর নামে মিথ্যার উদ্ভাবন করে গণতন্ত্রকে সাহায্য করে এবং যারা কাফেরদের দ্বীন বাস্তবায়নে সদা তৎপর। “এবং তারা সকল বিষয়ে পরামর্শ করে” এবং “যাহারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে” এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় আহমেদ শাকির উমদাদ-আত-তাফসীর-গ্রন্থে বলেছেনঃ বর্তমান সময়ে যারা এই দ্বীনকে নিয়ে উপহাস করে- তারা এই আয়াতগুলোর রূপক অর্থে ব্যাখ্যা দেয় ইউরোপীয় সাংবিধানিক পদ্ধতিকে; তারা তাদের মতের বৈধতা প্রমানের জন্য ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’ নাম দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছে।” এই সব উপহাসকারীরা এই আয়াতগুলিকে আদর্শবাণী বা তাদের শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করছে এবং এভাবে মুসলিম জাতিকে, মানুষকে এবং যারা ইসলামের দিকে ফিরে আসছেন তাদের প্রত্যেককে প্রতারিত করছে। তারা একটি সঠিক বাক্য ব্যবহার করছে কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা বলে ইসলাম পরামর্শের দিকে ডাকে এবং এই ধরনের আরো অনেক কথা।

সত্যিই! ইসলাম পরামর্শের দিকে ডাকে কিন্তু ইসলাম কোন ধরনের পরামর্শের দিকে ডাকে? আল্লাহ­হ্ বলেছেনঃ

“এবং সকল বিষয়ে পরামর্শ কর। এবং যখন তোমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাও, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।”। এই আয়াতের অর্থ খুবই পরিষ্কার এবং সুনিশ্চিত। এই আয়াতের কোন ব্যাখ্যা অথবা রূপক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এটা রাসূল (ﷺ)-এর উপর আল্লাহর একটি হুকুম ছিল এবং তারপর খলিফাদের উপর। অর্থাৎ সাহাবাদের যারা ছিলেন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মতামত ব্যক্ত করতেন সেসব বিষয়ের উপর যেসবের ব্যাপারে মতামত বা যুক্তি দেয়া যায়। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন যেটা তিনি সবচেয়ে সঠিক, সবচেয়ে ভাল, সবচেয়ে উপকারী মনে করতেন কোন বিষয়ের সমাধান করার জন্যে এবং তা কোন দল ইচ্ছা বা মতামতের উপর নির্ভর করত না অথবা কোন সংখ্যা বা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ইত্যাদি সংখ্যানীতির উপর নির্ভর করতো না। যখন তিনি কোন সমস্যার সমাধান করতেন তখন তিনি আল্লাহর উপর নির্র্ভর করতেন এবং যা যা করণীয় তা করতেন। এজন্যে কোন দলিল বা প্রমাণের প্রয়োজন নেই যে, ঐসব মানুষেরা যাদেরকে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) পরামর্শ করার জন্যে হুকুম দিয়েছিলেন তারা ছিলেন আদর্শ খলিফা তার মৃত্যুর পরে, ছিল সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ এবং যারা আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করেছিলেন, সালাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং যাকাত আদায় করেছিলেন। তারা ছিলেন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত মুজাহিদ যাদের সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ

لِیلني منكم أولو الأحلام والنھى

“আমার পরে তোমাদের মধ্য হতে ভদ্র ও বুদ্ধিমান লোকেরা আসবে।”

তারা নাস্তিক ছিল না, অথবা তারা আল্লাহর দ্বীন ও হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। তারা সেই সব অসৎ লোকদের মত ছিলেন না যারা এখনকার সময়ে সমস্ত খারাপ কাজে লিপ্ত । তারা এরূপ ছিলা যে ক্ষমতা দাবী করতেন না অথবা

এমন কোন আইন তৈরী করতেন না যা আল্লাহর আইনের বিরোধী এবং আল্লাহর আইনকে ধ্বংস করে দেয়। এই সব কাফেরদের স্থান হচ্ছে তলোয়ারের অথবা চাবুকের নিচে, পরামর্শ সভায় নয়। আরেকটি আয়াত আছে সূরা আস-শুরায় যার অর্থ পরিষ্কার ও সুনিশ্চিতঃ “যারা তাদের প্রভুর হুকুমের আনুগত্য করে এবং তারা তাদের স্বর্গীয় দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করে, তাদের বিষয়গুলো তারা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে, তারা ব্যয় করে যা আমি তাদের দিয়েছি।”

চতুর্থ অযৌক্তিক অজুহাতঃ

রাসূল (ﷺ) আল-ফুজুল সংগঠনে যোগ দিয়ে ছিলেন। কিছু বোকা লোক নবুয়্যতের পূর্বে রাসূল (ﷺ)-এর আল-ফুজুল সংগঠনে যোগ দেয়াকে তাদের শিরকি শাসন ব্যবস্থার সংসদে যোগ দেয়াকে বৈধ করার জন্যে ব্যবহার করতে চায়। এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য নিচে দেয়া হলো এবং আমরা আল্লাহর সাহায্য কামনা করছিঃ যে ব্যক্তি এই প্রতারণামূলক অজুহাত ব্যবহার করতে চায়, হয় তারা বুঝে না আল-ফুজুল সংগঠনটি আসলে কি ছিল এবং সে এমন বিষয়ে কথা বলছে যে বিষয়ে তার জ্ঞান নেই অথবা সে মূল ব্যাপারটা জানে এবং সে সত্যের সঙ্গে মিথ্যার, আলোর সঙ্গে অন্ধকারের এবং শিরক এর সঙ্গে ইসলামের সংমিশ্রণ করতে চাচ্ছে। ইবনে ইসহাক, ইবনে কাসির, এবং আল-কুরতুবি (রহ.) উলে­খ করেছেন-আল-ফুজুল সংগঠনটি তখনই গঠন করা হয়েছিল যখন কুরাইশের কিছু গোত্র আব্দুলাহ বিন জাদান-এর সম্মানার্থে তার বাড়িতে একত্রিত হয়েছিলেন। তারা সকলে এতে একমত হয়েছিলেন যে যখনই মক্কায় তারা কোন নির্যাতিত লোক দেখবে, তারা তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করবে যতক্ষণ পর্যন্ত অত্যাচারী অত্যাচার বন্ধ না করে। কুরাইশরা তখন এই সংগঠনটির নাম দিল ‘আল-ফুজুল’ সংগঠন যার অর্থ ‘নৈতিক উৎকর্ষতার’ একটি সংঘ। ইবনে কাসির (রহ.) আরও বলেছেনঃ “আল-ফুজুল সংগঠনটি ছিল আরবদের জানা সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে সম্মানজনক সংগঠন। প্রথম যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে কথা বলেছিলেন এবং এর দিকে আহবান করেছিলেন তিনি হলেন আল-যুবাইর বিন আব্দাল-মুত্তালিব। এই সংগঠনটি সংগঠিত হয়ে ছিল যুবাইদ গোত্রের এক লোকের কারণে। সে কিছু ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে মক্কায় এসেছিল। আল-আস ইবনে ওয়ায়িল তাকে আক্রমন করে তার পণ্য সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়। তখন আল-যুবাইদী আল-আহলাফ গোত্রের কিছু লোককে সাহায্যের জন্যে আহবান করে কিন্তু তারা আল-আস বিন ওয়ায়িল-এর বিপক্ষে তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে এবং আল-যুবাইদীকে অপমান করে। আল-যুবাইদী তার ক্ষতিপূরণের জন্যে পরের দিন সূর্য উদয়ের সময় আবূ-কুবায়স পাহাড়ের কাছে গেলেন যখন কুরাইশরা কাবার প্রাঙ্গনে সভা করছিল। তিনি তাদেরকে সাহায্যের জন্যে আহবান করলেন এবং কিছু কবিতা আবৃত্তি করলেন। তখন আল-যুবাইর বিন আব্দাল-মুত্তালিব দাড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ তার জন্যে কি কোন সমতা বিধানকারী নেই? এর পরই হাশিম, যুহরাহ এবং তাইম ইবনে বিন মুর্রা আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের বাড়িতে একত্রিত হলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাদ’আন তাদের জন্যে কিছু খাবার তৈরী করলেন। তারপর তারা নিষিদ্ধ মাসে যুলকা’দায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর নামে শপথ করে এই মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হন যে, তারা অত্যাচারিতের পক্ষে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করবেন যাতে করে জালিম মজলুমের পাওনা আদায় করতে বাধ্য হয়। যতদিন পর্যন্ত সমুদ্রে ঢেউ উত্থিত হবে, যতদিন পর্যন্ত হেরা ও ছাবীর পর্বতদ্বয় আপন স্থানে স্থির থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের এই অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে। আর জীবন যাত্রায় তারা একে অপরের সাহায্য করবে। তারপর তারা আস ইবনে ওয়ায়িল-এর নিকট গিয়ে তার থেকে যুবাইদীর পণ্য উদ্ধার করে তাকে ফেরত দেন। একটি গরীব পর্যায়ের হাদীসে কাসিম ইবনে ছাবিত উলে­খ করেন, কাছ’আম গোত্রের এক ব্যক্তি হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কায় আগমন করে। তার একটি কন্যা তার সঙ্গে ছিল। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত রূপসী এবং তার নাম ছিল আল-কাতুল। নাবীহ ইব্ন হাজ্জাজ মেয়েটিকে পিতার নিকট হতে অপহরণ করে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। ফলে কাছ’আমী লোকটি তার মেয়েকে উদ্ধারের ফরিয়াদ জানায়। তাকে তখন বলা লো, তুমি “হিলফুল ফুজুল” সংগঠনের শরণাপন্ন হও। লোকটি কা’বার নিকটে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, হিলফুল ফুজুলের সদস্যগণ কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে হিলফুল ফুজুল-এর কর্মীগণ কোষমুক্ত তরবারি হাতে ছুটে আসে এবং বলে, তোমার সাহায্যকারীরা হাজির; তোমার কি হয়েছে? লোকটি বলল, নাবীয়াহ আমার কন্যাকে ধর্ষন করেছে এবং তাকে জোর করে আটকে রেখেছে। অভিযোগ শুনে তারা লোকটিকে নিয়ে নাবীয়াহ-এর গৃহের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হন। নাবীয়াহ বেরিয়ে আসলে তারা বলেন, “মেয়েটিকে নিয়ে আয়। তুই তো জানিস আমরা কারা, কি কাজের শপথ নিয়েছি আমরা!” নাবীয়াহ বলল, “ঠিক আছে, তাই করছি, তবে আমাকে একটি মাত্র রাতের জন্য মেয়েটিকে রাখতে দাও!” তারা উত্তরে বলেছিল- “না কক্ষণো না, একটি উটের দুগ্ধ দোহন করার সময়ের জন্য নয়।” তারপর সেই মুহূর্তেই নাবীয়াহ মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।”

আল-যুবাইর আল-ফুজুল সম্পর্কে নিম্নের কবিতা লিখেছিলেনঃ

আল-ফুজুল অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সংগঠিত

থাকতে দেয়া হবে না কোন অত্যাচারীকে মক্কায়

তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ এ ব্যাপারে

সুতরাং প্রতিবেশী এবং দুর্বলরা ছিল নিরাপদ তাদের দ্বারা।

এই সংগঠনটি এবং তাদের উদ্দেশ্যকে আজকের মানুষ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছে। আল-বায়হাকী এবং আল হামিদী বর্ণনা করেন যে রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ “আমি আব্দুলাহ ইবনে জাদ’আনের ঘরে আল-ফুজুল এর অঙ্গীকার সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেই অঙ্গীকার ভঙ্গকরার বিনিময়ে যদি আমাকে লাল উটও দেয়া হয় তবু আমি তাতে সম্মত হব না। আর ইসলামের আমলেও যদি তার প্রতি আহবান করা হতো আমি তাতে সাড়া দিতাম।” এবং আল-হামিদী আরও যুক্ত করেন, তারা সংগঠিত হয়ে ছিল মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং অত্যাচারীর দ্বারা কেউ যেন অত্যাচারিত না হয়- এই মহৎ উদ্দেশ্যে। এখন আমরা এই সব মানুষদের জিজ্ঞাসা করছি বলুনঃ “কি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে আপনাদের এই সংঘে যার জন্য আপনারা যোগদান করেছেন তাদের সাথে যারা আল্লাহর  সাথে অংশীদার স্থাপন করে শয়তানের সংবিধান অনুসারে দেশ শাসন করছে?” এবং আমরা জানি যে এই পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয় কুফরী সংবিধানকে, এর আইনকে, এর দাস এবং ত্বাগুতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে অথচ তারা আল্লাহ দ্বীন এবং তার অনুসারীদেরকে আক্রমন ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, এবং তারা আল্লাহর শত্রুদের, তাদের দ্বীনের সাহায্য ও তাদের দ্বীন অনুসরণ করে যাচ্ছে। আল-ফুজুল সংগঠনটি কি আল্লাহর সাথে কুফরী বা শির্ক করেছিল, আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কোন আইন দিয়েছিল এবং আল্লাহর দ্বীনকে বাদ দিয়ে কি অন্য কোন দ্বীনকে সম্মান দেখিয়েছিল? যদি আপনি হ্যাঁ বলেন তাহলে আপনি দাবী করছেন যে, রাসূল (ﷺ) কুফরীতে অংশ নিয়েছিলেন, আল্লাহর বিধানের পাশাপাশি বিধান দিয়েছিলেন, তিনি এমন দ্বীনের অনুসরণ করেছিলেন যা আল্লাহর দ্বীন নয় এবং যদি ইসলাম আসার পরও তাকে তাতে যোগ দেয়ার জন্যে ডাকা হত তাহলে তিনি যোগ দিতেন! (নাউযুবিলাহ!) যে কেউ যদি এমন দাবী করেন, তাহলে তিনি তার নিজের কুফরী, পথভ্রষ্টতা, নাস্তিকতাকে মানুষ ও জ্বীনদের কাছে প্রকাশ করে দিবেন।

যদি আপনি বলেনঃ এতে কোন কুফরী ছিল না, না তারা আল্লাহর পাশাপাশি আইন দিয়ে ছিল অথবা এতে কোন খারাপ ছিল না। এটার কাজ ছিল শুধু মাত্র অত্যাচারিত ও বিপদ গ্রস্থদের সাহায্য করা। তাহলে কি ভাবে আপনি এর সাথে একটা কুফরী, পথভ্রষ্ট, আল্লা­হ্কে অমান্যকারী পরিষদের তুলনা করেন? এখন, আমরা আপনাদের একটি স্পষ্ট ও সাবলীল প্রশ্ন করছি এবং আমরা এর উত্তরের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর সম্পর্কে আপনাদের একটি বিশুদ্ধ, সুস্পষ্ট সাক্ষ্য চাচ্ছি যা হবে লিখিত। প্রশ্নটি হলো : যদি পরিস্থিতি এরূপ হয় যে অত্যাচারিত ও বিপদগ্রস্থ লোকদের সাহায্য করার জন্যে আল-ফুজুল সদস্যদেরকে প্রথমে কুরয়াইশদের দেবতা লাত, উজ্জা ও মানাত-এর নামে এবং কুরাইশের কাফেরদের দ্বীনের, এর মূর্তি, ছবির প্রতি আনুগত্যের শপথ করতে হতো, তাহলে কি রাসূল (ﷺ) এতে অংশ গ্রহণ করতেন অথবা তিনি কি এর সাথে এক মত হতেন যদি ইসলাম আসার পর তাকে এ ধরনের কাজে ডাকা হত?

যদি তারা বলেঃ “হ্যাঁ, তিনি রাজি হতেন এবং এতে অংশ নিতেন … এবং তাই হয়ে ছিল”, তাহলে মুসলিম জাতি তার থেকে মুক্ত এবং তিনি তাদের থেকে মুক্ত এবং তিনি তার কুফরকে আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির সামনে প্রকাশ করে দিলেন। কিন্তু যদি তারা বলেঃ “না তিনি তা করতেন না”, তাহলে আমরা বলিঃ “এই সব ভ্রান্ত অজুহাত, অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনা এবং মূর্খতাকে ত্যাগ করুন এবং শিক্ষা গ্রহণ করুন যুক্তি কি রূপ হওয়া উচিত।”

পঞ্চম অযৌক্তিক অজুহাতঃ

তাদের এই যোগদানের পেছনে রয়েছে মহৎ উদ্দেশ্য

তারা বলে এই পরিষদে যোগ দেয়ার পিছনে অনেকগুলো ভালো উদ্দেশ্য আছে। এবং তাদের অনেকই এমনও দাবী করেন যে পরিষদ ভাল উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, তারা বলেঃ “এটা হচ্ছে আল্লাহর দিকে ডাকা, সঠিক কথা বলা।”

এবং তারা আরও বলেঃ “এর মাধ্যমে কিছু খারাপ দূর হয়, আল্লাহর দিকে ডাকার উপর এবং যারা ডাকছে তাদের উপর চাপ কিছুটা লাঘব হয়।” তারা বলেঃ “আমরা এই স্থান ও পরিষদ খ্রিষ্টান, কমিউনিষ্ট এবং অন্যদের জন্যে ছেড়ে দিতে পারি না।” এবং কেউ কেউ আরও বাড়িয়ে বলেঃ “আমরা এ কাজ করছি আলাপ আলোচনা বা পরামর্শের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করার জন্যে।” এবং তাদের আরো অনেক স্বপ্ন ও ইচ্ছা এই উদ্দেশ্যকে ঘিরে আছে।

এর উত্তরে আমাদের বক্তব্য নিম্নে দেয়া হলো এবং আমরা আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি। আমরা প্রথমে জিজ্ঞাসা করতে চাইঃ “কে তার দাসদের উদ্দেশ্যকে নির্দিষ্ট করে দেন এবং কে তা সম্পূর্ণ রূপে জানেন? আল্লাহ! যিনি সব কিছু জানেন, তিঁনি না আপনি? যদি আপনারা বলেনঃ “আমরা জানি …”। আমরা বলিঃ “তোমরা তোমাদের দ্বীনে, এবং আমরা আমাদের দ্বীনে, তোমরা যাদের ইবাদত কর আমরা তাদের ইবাদত করি না এবং আমরা যাঁর ইবাদত করি তোমরা তাঁর ইবাদত কর না” কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ “এমন কিছু নেই যা আমি লিখে রাখিনি।” এবং এই সব গণতন্ত্র পন্থীদের প্রত্যাখ্যান করে আল্লা­হ্ বলছেনঃ

أفحسبتم أنما خلقناكم عبثاً

“তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টিনকরেছি …” [সূরা মু’মিনূন ২৩: ১১৫]

তিনি আরও বলেছেনঃ “তোমরা কি মনে কর যে আমি কোন কারণ ছাড়াই তোমাদের সৃষ্টি করেছে?” এটাই আমাদের দ্বীন কিন্তু গণতন্ত্র নামক দ্বীনে, এই শক্তিশালী সুস্পষ্ট আয়াতগুলোকে বিবেচনা করা হয় না কারণ তাদের মতে মানুষ নিজেই নিজের বিধান দাতা। গনতন্ত্র মতবাদে বিশ্বাসীরা বলেঃ “হ্যাঁ, মানুষকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে। সে যা ইচ্ছা তাই পছন্দ করতে পারে এবং যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সে যে কোন বিধান ও দ্বীন ইচ্ছা হলে গ্রহণ করতে পারে বা বর্জন করতে পারে। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না যে নব উদ্ভাবিত বিধান আল্লাহর বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তা সংবিধান ও তাদের আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং তার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তোমাদের উপর ও আল্লাহর পাশাপাশি তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের উপর অভিশাপ।”

যদি তারা বলেঃ “আল্লাহই সীমা রেখা নির্দিষ্ট করে দেন এবং তিনি সব কিছু বিবেচনা করে উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন কারণ তিনি সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা এবং তিনি জানেন তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে।”

أفٍّ لكم ولما تعبدون من دون االله أفلا تعقلون

“এবং তিনি জানেন সমস্ত কিছুর রহস্য, তিনি সব কিছু জানেন।” [সূরা আম্বিয়া ২১: ৬৭]

আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করছিঃ “আল্লাহ্ কিতাবে সবচেয়ে বড় কোন উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন এবং তাঁর রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন ইসলামের দিকে ডাকার জন্যে এবং কোন উদ্দেশ্যে আল্লাহ কিতাব নাযিল করেছেন এবং হুকুম করেছেন জিহাদের এবং শহীদ হওয়ার জন্যে ? ইসলামিক রাষ্ট্র যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই উদ্দেশ্যে কি ? ওহে, খিলাফার প্রচারকরা ? যদি তারা গৌন উদ্দেশ্যগুলোর কথা বলে এবং দ্বীনের মূল ভিত্তিকে পরিবর্তন করে ফেলে, আমরা বলিঃ এই সব পাগলামী, মোহ ছাড়েন এবং দ্বীনের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে জানেন। ‘লা ইলাহা’র অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন কারণ এই জ্ঞান অর্জন ও এর উপর আমল করা ছাড়া কোন ইবাদত, কোন জিহাদ, কোন শাহাদাতই গ্রহণ যোগ্য হবে না। যদি তারা বলেঃ “সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো তাওহীদের উপর থাকা এবং ঐসব কিছু থেকে দূরে থাকা যা এর বিপরীত যেমন র্শিক।” আমরা বলিঃ “এটা কি তাহলে যুক্তি সংঙ্গত যে, সবচেয়ে বড় এই উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করা এবং ত্বাগুতের দ্বীন গণতন্ত্রকে গ্রহণ করার জন্যে রাজী হওয়া এবং এমন বিধানকে সম্মান করা যা আল্লাহর বিধান নয় এবং ঐসব বিধান দাতাকে অনুসরণ করা যারা আল্লাহর পাশাপাশি বিধান দেয়? সুতরাং যদি তা করেন তাহলে আপনি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো তাওহীদ (ত্বাগুতকে অস্বীকার করা এবং আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা), সেই তাওহীদকে ধ্বংস করে দিবেন, কিছু গৌন উদ্দেশ্যের জন্যে।” কোন্ নীতি, কোন বিধান, কোন দ্বীন আপনাদের এই পন্থার সাথে একমত হতে পারে, শুধু কাফেরদের দ্বীন গণতন্ত্র ছাড়া? মুশরিকদের পরিষদে আপনারা কোন দ্বীনের দিকে ডাকছেন, কোন অধিকারের কথা বলছেন যখন আপনারা ইসলামের মূলনীতি এবং এর দিকে আহবানের মূল উৎসকে মাটির নিচে কবর দিয়েছেন ? ইসলামের গৌন ও ক্ষুদ্র বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্যে এর উৎস এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যকে কি কবর দেয়া উচিৎ? আপনারা ইসলামের ছোট ও গৌন উদ্দেশ্য যেমনঃ ‘মদ নিষিদ্ধ করা, কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা দেয়ার জন্যে ত্বাগুতের কাছে যাচ্ছেন, যদিও তাদেরকে কাফের হিসেবে ঘোষণা না দিলেও তারা কাফের। ইসলামের মূল উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে আপনারা তাদের সাথে কী আলোচনা করছেন? আপনাদের এই বিষয়ে কোন দলিল আছে কি? যদি আপনি বলেনঃ “আল্লা­হ্ বলেছেন… , আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন …”, আপনি মিথ্যা বলছেন কারণ গণতন্ত্র নামক দ্বীনে তাঁদের কোন গুরুত্ব নেই, তাদের হুকুমকে তারা মানে না। তাদের নিজেদের সংবিধান অনুসারে যা বলা বা অনুমোদন করা হয়েছে, তারা তারই অনুসরণ করে। যদি বলেন সংবিধানের দ্বিতীয় ধারা অনুসারে … এবং ধারা (২৪) …, ধারা (২৫) অনুসারে এবং অন্যান্য কুফরী আইন অনুসারে … ,” তাহলে এর চেয়ে অধিক কুফরী, র্শিক ও নাস্তিকতা আর কারও মধ্যে আছে কি? যারা গণতন্ত্রের পথ অবলম্বন করছে এরপরও কি তাদের কোন ভিত্তি বা তাওহীদ আছে?

ألمْ تَرَ إِلَى الَّذِینَ یَزْعُمُونَ أنَّھُمْ ءَامَنُواْ بِمَا أنْزِلَ إلَیْكَ وَمَا أنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ یُرِیدُونَ أن یَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أمِرُواْ أن یَكْفُرُواْ بِه وِیُرِیدُ الشَّیْطَانُ أَن یُضِلَّھُمْ ضَلاَلاً بَعِیداً

“তুমি কি তাদেরকে দেখ নাই যারা দাবি করে যে, তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা ত্বাগুতের কাছে বিচার ফয়সালার জন্যে যেতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু শয়তান চায় তাদেরকে সঠিক পথ থেকে বহু দূরে নিয়ে যেতে?” [সূরা নিসা ৪: ৬০]

উত্তর দিন, হে সংশোধনের পথ অবলম্বনকারীগণ, যারা এই শিক্ষা দিচ্ছেন কুফরীর কেন্দ্রস্থলগুলোতে শিরক ও কুফর অবলম্বন না করে কি কোন আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব? যেই আল্লা­হ্ শরীআতের বাস্তবায়নের জন্য আপনারা যে এত উদ্বিগ্ন, সেই শরীআকে কি আপনারা এই পথে প্রয়োগ করবেন? আপনারা কি জানেন না এটি একটি রুদ্ধ কাফিরদের পথ? শুধু যুক্তির কারণেই যদি ধরে নেই আপনাদের এই কর্মপন্থা সফল হবে, তবুও এটি আল্লা­হর বিধান হবে না; তা হবে মানুষের তৈরী সংবিধানের আইন। তা হবে অধিকাংশ লোকের আইন। তা কখনও আল্লা­হর বিধান হবে না যতক্ষণ না আপনারা আল্লা­হর হুকুম ও বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করবেন এবং যতক্ষণ না আপনারা বিনয়ের সাথে আল্লা­হর আনুগত্য করবেন। কিন্তু এই আত্ম সমর্পন যখন গণতন্ত্র এবং মানুষের তৈরী সংবিধানের বিধান ও হুকুমের কাছে হবে, তা হবে ত্বাগুতের বিধানের কাছে আত্ম সমর্পন যদিও তা অনেক ব্যাপারে আল্লা­হর হুকুমের সাথে একমত হয়। আল্লা­হ বলছেনঃ

إن الحكم ِإلا  الله

“কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লা­হর”। তিনি বলেননিঃ “বিধান দেয়ার ক্ষমতা মানুষের”। তিনি বলেছেনঃ

وأن احكم بینھم بما أنز ل االله

“সুতরাং তাদের মাঝে ফয়সালা কর আল্লা­হ যা নাযিল করেছেন তার দ্বারা”।

তিনি বলেননিঃ “সুতরাং তাদের মাঝে ফয়সালা কর আল্লা­হ যা নাযিল করেছেন তার মধ্যে থেকে যা তোমাদের পছন্দ হয়” অথবা “তাদের মাঝে ফয়সালা কর সংবিধান ও এর আইন দ্বারা”। এটা বলে গণতন্ত্র ও মানুষের তৈরী সংবিধানের গোলামেরা। তুমি কোন পক্ষে? তুমি কি এখনও তোমার ভ্রান্ত এবং পুরানো মতবাদের পক্ষে? তুমি কি তোমার বিবেক খুইয়েছ? তুমি কি দেখ না তোমার আশে পাশে কি ঘটেছে যারা গণতন্ত্রের পথ ধরে ছিল? আমাদের জন্যে উদাহরণ হয়ে আছে আলজেরিয়া, কুয়েত, মিশর এবং আরও অনেকে। তুমি কি এখনও নিশ্চিত নও যে গণতন্ত্র কাফেরদের খেলা? গণতন্ত্র কাফেরদের নিখুঁত ভাবে তৈরী একটি হাস্য নাট্য? তুমি কি এখনও নিশ্চিত নও যে, এই পরামর্শ পরিষদ ত্বাগুতের একটি খেলা? সে যখন চায় তখন তা শুরু করে আবার যখন চায় তা বন্ধ করে দেয়? ত্বাগুতের অনুমতি ছাড়া কোন আইনই বাস্তবায়ন করা যায় না। তবে কেন এই সুনিশ্চিত কুফরের ব্যাপারে এত যুক্তি-অজুহাত? এটা পরিষ্কার হীনমন্যতা। এত কিছুর পরও তাদের বলতে শোনা যায়ঃ “কিভাবে আমরা এই সংসদ কমিউনিষ্ট, খ্রিষ্টান এবং অন্য সব নাস্তিকদের কাছে ছেড়ে দিব?”। তাহলে যাও তাদের সাথে জাহান্নামে যাও! আল্লাহ বলছেনঃ

وَلَا يَحْزُنكَ الَّذِينَ يُسٰرِعُونَ فِى الْكُفْرِ ۚ إِنَّهُمْ لَن يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْـًٔا ۗ يُرِيدُ اللَّهُ أَلَّا يَجْعَلَ لَهُمْ حَظًّا فِى الْءَاخِرَةِ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

“এবং তাদের দিকে ঝুঁকে যেও না যারা কুফরীর দিকে দৌড়ে যায়। তারা আল্লাহর  কোন ক্ষতি করতে পারে না এবং আল্লাহ পরকালে তাদের কিছুই দেবেন না, এবং তাদের শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠোর।” [সূরা আলি ‘ইমরান ৩: ১৭৬]

যদি আপনি এই সব নাস্তিকদের সাথে যোগদেন তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি আপনি তাদের সাথে শিরক-এ অংশ গ্রহণ করাকে উপভোগ করছেন। যদি আপনি চান তাহলে তাদের কুফরী ও শিরক-এ আপনি অংশ নিতে পারেন;

তবে জেনে রাখুন, তাদের সাথে এই অংশ গ্রহণ এই পৃথিবীতে শেষ হয়ে যাবে না। এটা আখিরাতেও অটুট থাকবে, যে রূপ আল্লাহ্ সূরা নিসায় বলেছেন। তিনি প্রথমে সর্তক করেছেন এই সব পরিষদে যোগ দেয়ার ব্যাপারে এবং মানুষকে এই সব পরামর্শ পরিষদ এড়িয়ে চলতে আদেশ করেছেন এবং তাদের সাথে বসতে নিষেধ করেছেন। যদি কেউ বসে, সে তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হবে। আল্লা­হ্ বলেনঃ

“কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং তাকে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসংগে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসিও না, অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফির সকলকেই আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন।” [সূরা নিসা ৪: ১৪০]

  • বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ৭-এর ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।”
  • তৃতীয় তফসিল-শপথ ও ঘোষণা অনুচ্ছেদের ২(ক )এ বলা হয়েছে “আমি ………….. সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (বা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী) পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব;

-আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;

-আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব;

-এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।”

তৃতীয় তফসিল- শপথ ও ঘোষণা অনুচ্ছেদের ৫-এ বলা হয়েছে, “আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্তার সহিত পালন করিব;

-আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;

-আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং সংসদ সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।”

এখানে শুধু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (ﷺ) সুন্নাহ্কে প্রত্যাখ্যান করা হয়নি বরং সংসদ সদস্যরা আল্লাহর ও রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের পরিবর্তে এই সংবিধানের রক্ষা, সমর্থন এবং একে টিকিয়ে রাখতে শপথ করছেন। এরপরও কি আপনি নিশ্চিত নন যে, এটা শিরক, এটা পরিষ্কার কুফর? আপনি কি জানেন না এটি আল্লাহর দ্বীন নয় এবং এটি একত্ববাদের দ্বীন নয় ? তাহলে কেন আপনি তা গ্রহণ করছেন? এটা তাদের জন্যে ছেড়ে দিন, এটাকে পরিত্যাগ করুন এবং একে এড়িয়ে চলুন। এটা যাদের দ্বীন তাদের কাছে ছেড়ে দিন এবং ইব্রাহীম (আ.)-এর দ্বীনের অনুসরণ করুন। ইউসুফ (আ.) তার দুর্বলতার সময়ে, জেলে থাকার সময়ে যে রূপ বলেছেন, আপনিও সে রূপ বলুনঃ

“যে সম্প্রদায় আল্লা­হতে ও আখিরাতে বিশ্বাস করে না, আমি তাদের মতবাদ বর্জন করছি। আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের মতবাদের অনুসরণ করি। আল্লাহর সহিত কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। ইহা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।” [সূরা ইউসুফ ১২: ৩৭-৩৮]

হে মানুষেরা! ত্বাগুতকে এবং তার পরামর্শসভাকে বর্জন করুন, তাদেরকে ত্যাগ করুন এবং তাদেরকে অস্বীকার করুন যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের দ্বীনকে (মানুষের তৈরী যে কোন ধরনের জীবন ব্যবস্থা) ছেড়ে ইসলামকে গ্রহণ না করে। এটাই হচ্ছে সুস্পষ্ট পথ, স্বচ্ছ আলোর মত কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না।

“আল্লাহর ইবাদত করবার ও ত্বাগুতকে বর্জন করবার নির্দেশ দিবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। অতঃপর তাদের কতককে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং কতকের উপর পথভ্রান্তি সাব্যস্ত হয়েছিল” [সূরা নাহল ১৬: ৩৬]।

আল্লাহ আরও বলেনঃ “হে কারা সঙ্গীরা ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয় না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ ? তাঁকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতগুলো নামের ইবাদত করছো, যেই নাম তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছো, এইগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠান নাই। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন অন্য কারও ইবাদত না করতে, কেবল তাঁর ব্যতীত, এটাই সরল দ্বীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ইহা আবগত নয়”। [সূরা ইউসুফঃ ৩৯-৪০]

তাদেরকে এড়িয়ে চলুন, তাদেরকে ত্যাগ করুন, তাদের লোকদেরকে এবং তাদের র্শিকী মতবাদ ত্যাগ করুন খুব বেশী দেরী হয়ে যাওয়ার পূর্বে অর্থাৎ মহান বিচার দিবস আসার পূর্বেই। আপনার ইচ্ছা, সাধনা, পরিতাপ সেই দিন কোন কাজেই আসবে না। আল্লাহ্ বলছেনঃ “আর যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, ‘হায়! যদি একবার আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরাও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম যেমন তারা আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করল।’ এইভাবে আল্লা­হ্ তাদের কার্যাবলীকে পরিতাপরূপে তাদেরকে দেখাবেন আর তারা কখনও অগ্নি হতে বের হতে পারবে না”। [সূরা বাকারা ২: ১৬৭]

এখনই তাদের পরিহার করুন এবং তাদেরকে বলুনঃ “তোমরা ইব্রাহীম (আ.) দ্বীনের ও নবীদের পথের অনুসরণ কর”,

যে রূপ আমরা বলছিঃ

ওহে, মানুষের তৈরী আইনের দাসেরা… এবং সংবিধানের দাসেরা …

ওহে, গণতন্ত্র নামক দ্বীনের সেবকেরা …

ওহে, আইনদাতারা …

আমরা তোমাদের এবং তোমাদের দ্বীনকে বর্জন করছি …

আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করছি

এবং আরও অস্বীকার করছি তোমাদের র্শিকী সংবিধানকে

এবং তোমাদের মুশরিকদের পরামর্শসভাকে

এবং তোমাদের সাথে আমাদের শত্রুতা ও ঘৃণা শুরু হলো

চিরদিনের জন্যে যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লা­হ্তে ঈমান আন।

সংসদীয় বিষয়ঃ বিবেচনা করুন, চিন্তা করুন ওহে জ্ঞানবান সমঝদার মানুষেরা

“আমি ভাবতে পারতাম না যে আল্লাহ তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর মাধ্যমে যেই শরীয়াহ দিয়েছেন, তার জন্য তাঁর বান্দাদের অনুমোদন প্রয়োজন। কোন প্রকৃত মু’মিন মনে করে না যে, আল্লা­হ্ যে বিধান নাযিল করেছেন তাঁর কিতাব ও রাসূল (ﷺ)-এর মাধ্যমে, তা মানার ক্ষেত্রে তাঁর বান্দার অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। কারণ আল্লাহ বলেছেনঃ

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِينًا

“আল্লা­হ্ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ বা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লা­হ্ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে” [সূরা আহযাব ৩৩: ৩৬]

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتّٰى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِىٓ أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

“কিন্তু না, তোমার রবের শপথ! তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমাদের উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিন্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।” [সূরা নিসা ৪: ৬৫]

এবং তিনি আরও বলেছেনঃ

“তারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লা­হ্ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তার জন্যে তো আছে জাহান্নামের অগ্নি, যেখানে সে স্থায়ী হবে? উহাই চরম লাঞ্ছনা।” [সূরা তওবা ৯: ৬৩]

কিন্তু দেখা যাচ্ছে আল্লা­হর বিধান তার পূর্ণ পবিত্রতা নিয়ে আল-কুর’আনে আজও বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর কতিপয় বান্দারা সংসদের মাধ্যমে একে আইন হিসেবে পাশ করতে চাইছে! আল্লাহর বান্দার সিদ্ধান্ত যদি আল্লাহর দেয়া বিধান থেকে ভিন্ন হয়, তাঁর বান্দার সিদ্ধান্তই আইন হয়ে যাবে এবং তা আইন সভা বা সংসদের মাধ্যমে পাশ হয়ে সরকারের কার্যনির্বাহী পরিষদ দ্বারা তা বাস্তবায়িত হবে যদিও তা কুর’আন-সুন্নাহর বিরোধী। এর প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ মদ নিষিদ্ধ করেছেন কিন্তু সংসদ তা বৈধ করেছে, আল্লাহ তাঁর দেয়া সীমানা রক্ষা করতে বলেছেন কিন্তু সংসদ তা ভঙ্গ করেছে। মূল কথা হচ্ছে, সংসদের সিদ্ধান্তই আইন হয়ে যাবে যদিও তা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।”

أَوْ تَقُولُوا لَوْ أَنَّآ أُنزِلَ عَلَيْنَا الْكِتٰبُ لَكُنَّآ أَهْدٰى مِنْهُمْ ۚ فَقَدْ جَآءَكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ ۚ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن كَذَّبَ بِـَٔايٰتِ اللَّهِ وَصَدَفَ عَنْهَا ۗ سَنَجْزِى الَّذِينَ يَصْدِفُونَ عَنْ ءَايٰتِنَا سُوٓءَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يَصْدِفُونَ

“এখন তো তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক সুস্পষ্ট দলীল, হিদায়াত ও রহমত এসেছে। অতঃপর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? যারা আমার নিদর্শনসমূহ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় সত্যবিমুখতার জন্যে আমি তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিব।” [সূরা আন‘আম ৬: ১৫৭]

وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدٰى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلّٰى وَنُصْلِهِۦ جَهَنَّمَ ۖ وَسَآءَتْ مَصِيرًا

“কারও নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাহাকে দগ্ধ করব, আর উহা কত মন্দ আবাস।” [সূরা নিসা ৪: ১১৫]

***********

[1] এর মধ্যে ফেরেশতা, নবী বা ধার্মিক লোকরা অন্তর্ভূক্ত নয় যাদের ইবাদাত মানুষ করছে কিন্তু তারা তাদের তাদের ইবাদাত করতে বা তাদের ইলাহ হিসেবে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।[উদাহরণ স্বরূপ-ঈসা(আঃ)

[2] সূরা তাওবাহ ৯ : আয়াত ৩১

[3] মাজমু আল-ফাতাওয়া ২৮তম খন্ড,পৃষ্ঠা ২০১

[4] ই‘লাম আল-মুওয়াকক্বি‘য়ীন ১ম খন্ড, পৃষ্ট-৫০

[5] বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ধারা নং ৭(১)ও ৭(২):

৭(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কতৃত্বে কার্যকর হইবে।

[6] قال بعض المفسرين الذين معه: اتباعه اوالانبياء الذين علي طريقته

[7] হাদীসটি সহীহ-বিচার দিবসে বিশ্বাসীদের আল্লাহর সাক্ষাৎ পাওয়ার হাদিসটির অংশ বিশেষ।

[8] আবূ দাউদঃ কিতাবুল জিহাদ

[9] বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ধারা নং ৭(২):

৭(২) জনগণের অভিপ্রায়ে পরম অভিব্যক্তিকরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য পূর্ণ হয় তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।

একই কথা বলা হয়েছে ৩য় ভাগের ২৬ ধারায়। এবং সংবিধানের ৫ম ভাগের সংসদ নামক পরিচ্ছেদে সংসদ প্রতিষ্ঠা নামক ধারায় বলা হয়েছে:

৭(১) ‘জাতীয় সংসদ’ নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে।

[10] আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে বলেছেন যে, ইবরাহীম(আঃ) এই কথাটি তাঁর কওমের (জাতি) কাছে বলেছিলেন তাদের দেব-দেবীর অক্ষমতা প্রকাশ করার পর।

[11] সেক্যুলারিজমঃ সমাজ ও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করা হয় যে মতবাদে তাই সেক্যুলামিজম , অর্থাৎ সমাজ ব্যবস্তা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার রাজনীতি চলবে তার নিজস্ব নীতি অনুসারে। এতে ধর্মকে আনা যাবে না বা তা হবে ধর্মীয় অনুশাসন মুক্ত।

[12] সুতরাং আপনি যদি আপোষহীনভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান, তবে আপনি হবেন একজন দেশদ্রোহী ও গণতন্ত্রের শত্রু।

[13] দুঃখজনক ব্যাপার, এই বিষয়টি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কুয়েত, জর্ডান, সৌদি আরব, মিশর – এমন দেশে বিদ্যমান।

[14] উদাহরণ স্বরূপ আমাদের দেশের তথাকথিত ইসলামিক দলগুলো, যারা গণতন্ত্রকে ইসলামের একটি অংশ বানিয়ে নাম দিয়েছে – ইসলামী গণতন্ত্র। আমরা তাদের এই কুচক্রান্ত ও পথভ্রষ্টতা থেকে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট আশ্রয় চাই।

[15] বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় তফসিল- ‘শপথ ও ঘোষনা’ অনুচ্ছেদের ২(ক) বলা হয়েছেঃ “আমি সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী( বা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বা উপমন্ত্রী)পদের কতৃব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব;

-আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব।

-আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব।

-এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।”

-এবং তৃতীয় তফসীল-‘শপথ ও ঘোষনা’ অনুচ্ছেদের ৫- এ বলা হয়েছে, আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি যে কতৃব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন -অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব;

-আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;

এবং সংসদ সদস্যরূপে আমার কতৃব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।”

[16] সূরা ইউসূফ ১২: আয়াত ২৪

[17] সূরা নাহল ১৬:৩৬

[18] মুফাসসীরিনঃ যারা আল-কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা করেন।

[19] ما كان لياخذ اخاه في دين الملك .. “রাজার আইনে তিনি তাঁর ভাইকে আটক করতে পারতেন না। সূরা ইউসূফ….. [১২:৭৬]

[20] বুখারী শরীফ : আবূ হুরাইরাহ রা: থেকে বর্ণিত।

[21] মাজমু আল-ফাতাওয়া খন্ড ২৮ : পৃষ্ঠা ৬৮

[22] মাজমু আল-ফাতাওয়া খন্ড ২০:  পৃষ্ঠা ৫৬

[23] সহীহ মুসলিম

[24] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: খন্ড ৩য় : পৃষ্ঠা ২৭৭

[25] সূরা শূরা ৪২ : ৩৮।