শায়খ আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসি
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ﴿آلعمران: ١٨٥﴾
“সমস্ত জীবই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে এবং নিশ্চয় উত্থান দিবসে তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে; অতএব যে কেউই অগ্নি হতে বিমুক্ত হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবিষ্ট হয়েছে, ফলতঃ নিশ্চয় সে সফলকাম; আর পার্থিব জীবন প্রতারণার সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়।”[1]
সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি বলেন,
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ﴿آلعمران: ١٨٥﴾
“সমস্ত জীবই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে এবং নিশ্চয় উত্থান দিবসে তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে; অতএব যে কেউই অগ্নি হতে বিমুক্ত হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবিষ্ট হয়েছে, ফলতঃ নিশ্চয় সে সফলকাম; আর পার্থিব জীবন প্রতারণার সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়।”[2]
আর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদের উপর যিনি বলেছেন,
“তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তিকে অনুসরণ করেঃ তার পরিবারের সদস্যগণ, তার সম্পদসমূহ ও তার কর্মসমূহ। এদের মধ্যে দু’টি ফিরে যায়; এবং একটি তার সাথেই থেকে যায়। মানুষ ও সম্পদ ফিরে যায়; তার কর্মসমূহ তার সাথেই থেকে যায়।”[3]
সুতরাং আমার ভাইয়েরা, এখানে রয়েছে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের স্মরণচিহ্ন। এটাই সেই স্থান যা আমাদেরকে সৎকাজ করার জন্য এবং আমাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিতে মনে করিয়ে দেয়।
মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ধাপসমূহের মধ্যে প্রথম ধাপে মৃত ব্যক্তি জিজ্ঞাসিত হয়। তাকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। এগুলোকে আমাদের উলামাগণ নাম দিয়েছেনঃ তিনটি মৌলিক মূলনীতি।
সে প্রশ্ন, পরীক্ষা ও নিরীক্ষার সম্মুখীন হবে। সুতরাং প্রকৃত সাঈদ (সুখী) হচ্ছে সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ দৃঢ়তার সাথে সঠিকভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারার সফলতা ও পথনির্দেশ দিয়েছেন।
আর দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি যাকে এই পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, কিন্তু সুদৃঢ় ও সঠিক উত্তর দেয়া থেকে তাঁকে অবরুদ্ধ করা হয়।
জেনে রাখুন আমার ভাইয়েরা, আল্লাহ আপনাদের বরকত দিন, জেনে রাখুন; ঐ পরীক্ষার উত্তর দেবার ক্ষেত্রে সফলতা ও অবিচলতা মুখস্থ করার উপর নির্ভর করে না। কারণ অনেক কাফেররা এই উত্তর জানে, আর অনেক মুরতাদরাও (দ্বীনত্যাগী) এটা জানে যারা কিনা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে।
এমনকি যারা এই দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে তাদের অনেকেই এই উত্তরগুলো জানে। এই উত্তরগুলো সঠিকভাবে দেবার ক্ষেত্রে যে সফলতা ও অবিচলতা রয়েছে, এবং যে সকল মানুষেরা সাঈদ (সুখী) তাদের সেই চলার পথটিকে লাভ করার জন্য, আপনাকে এই তিনটির (মূলনীতির) মাঝে জীবন পরিচালনা করতে হবে।
আর এই তিনটি (মূলনীতি) হচ্ছে আপনি আপনার দ্বীন, আপনার নবী ও আপনার রব এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। প্রথমে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন, “তোমার রব কে?”
আমরা সকলেই জানি যে আমাদের রব হচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। আর আমরা সকলেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবো যদি আমাদেরকে দুনিয়াতে এই প্রশ্নটি করা হয়।
কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কি কবরে একজন ব্যক্তিকে সফলতা দিবেন? যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া পথনির্দেশ অনুসারে জীবন যাপন করে নি, তাঁকে কি আল্লাহ – যা আমাদের কাছে এখন সহজ মনে হচ্ছে – তার সঠিক উত্তর দেবার তাওফীক দান করবেন?
তাকে কি উত্তর দেবার সফলতা দেয়া হবে, যে কিনা শুনেছিল যে, আল্লাহ তাআলাকে অপমান করা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীনের অমর্যাদা করা হচ্ছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, কিন্তু সে এগুলোর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করে নি? এবং সে শরীয়ত ও আল্লাহর দ্বীনকে হেফাজত করার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করে নি?
তাকে কি উত্তর দেবার সফলতা দেয়া হবে, যখন কিনা সে তার জীবন অতিবাহিত করেছে ও মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু সে আল্লাহর জন্য নামায পড়ে নি, এমনকি একবারও আল্লাহ সুবহানা ওয়া তাআলার উদ্দেশ্যে রুকু বা সিজদা করে নি, এবং আল্লাহর দ্বীনকে অপমান করা হচ্ছে শুনে ক্রোধে তার মুখের রং কখনো পরিবর্তিত হয় নি, এবং তার হৃদয় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি যখন সে দেখেছে দিন রাত্রি আল্লাহর দ্বীনের পবিত্র বিষয়সমূহ লঙ্ঘিত হচ্ছে? তাকে কি সফলতা দেয়া হবে যাতে সে বলতে পারে, “আমার প্রতিপালক হলেন আল্লাহ সুবহানা ওয়া তাআলা”?
যদি আপনি চান আল্লাহ আপনার পালনকর্তা হয়ে যান, তবে যতটা আপনি রাগান্বিত হন আপনার নিজের জন্য অথবা আপনার পরিবার, সন্তান, স্ত্রী ও বাবা-মা এর জন্য, তার চেয়ে বেশী রাগান্বিত হতে হবে আল্লাহর জন্য। এই মুহূর্তে আমাদের অনেকেই, আমি বলতে চাচ্ছি যে অনেক মানুষই আছেন – আমাদের কেউ এরকম হওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই – যারা নিজেদের বাবা ও মাকে অপমানিত হতে দেখলে তাদের মুখের রং পরিবর্তিত হয়ে যায়, সে রাগান্বিত হয় ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু সে হয়ত নীরবভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যায় যখন সে শুনে আল্লাহর প্রতি অমর্যাদা করা হচ্ছে এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি অবমাননা করা হচ্ছে এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি ঠাট্টা-তামাশা করা হচ্ছে।
আমরা ঠিক এমনই একটি যুগে বাস করছি যেখানে আমাদের মহান রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে আর সে কিছুই করছে না। সে তার জীবন খেল-তামাশার মাঝে অতিবাহিত করছে, আর এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা এই তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার সফলতা প্রদান করবেন না। তিনটি প্রশ্ন বা তিনটি মৌলিক মূলনীতি।
কে আপনার প্রতিপালক? যদি আপনি চান যে, আল্লাহ আপনার পালনকর্তা হয়ে যান, তাহলে আপনার জীবন হতে হবে আল্লাহর দ্বীনের জন্য এবং আপানার মৃত্যু হতে হবে আল্লাহর দ্বীনের জন্য।
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿الأنعام: ١٦٢﴾ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ﴿الأنعام: ١٦٣﴾
তুমি বলে দাওঃ “আমার নামায, আমার সকল ইবাদত (কুরবানী ও হজ্জ), আমার জীবন ও আমার মরণ – সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি, (অর্থাৎ আমি যেন তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক স্থির না করি।) আর আমার আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই হলাম প্রথম।”[4]
যদি আপনি বলতে চান। “আল্লাহর দ্বীন হলো ইসলাম”, তাহলে আপনার জীবন হতে হবে ইসলামের জন্য এবং আপনার মরণ হতে হবে ইসলামের জন্য। আপনার জীবন যেমন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং মিথ্যা মতবাদসমূহ কিংবা এইসব তাগুতদের (শরীয়তের আইন পরিবর্তনকারী জালেম শাসকবৃন্দ, বাতিল মূর্তি/প্রভূ সমূহ ইত্যাদি) জন্য নিয়োজিত না হয়। আপনার জীবন যেন হয় শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জন্য উৎসর্গকৃত, আর তা হলেই আপনাকে সফলতা দেয়া হবে এই উত্তর দেবারঃ “আমার দ্বীন হলো ইসলাম”।
আপনার জীবন অতিবাহিত হতে হবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দেখানো পথ অনুসারে। আপনি মেনে চলুন তাঁর সুন্নাহ (কথা ও কাজ), মেনে চলুন তাঁর দেখানো পথ, অনুসরণ করুন তাঁর জীবন, তাহলে আপনাকে সফলতা দেয়া হবে এই উত্তর দেবারঃ “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আল্লাহর রাসূল।“
যদি আপনারা চান যে, আল্লাহ যেন আপনাদের এই জায়গায় (অর্থাৎ কবরে) সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার তাওফীক দান করেন, হে আমার ভাইয়েরা, তাহলে আপনাদেরকে এই তিনটি মূলনীতির উপর জীবন যাপন করতে হবে।
বিষয়টি উত্তর মুখস্থ করে রাখার মত সংকীর্ণ নয়; বরং বিষয়টি হলো এগুলোর সত্যতা নিজ জীবনে সঞ্চারণ করা এবং দৈনন্দিন জীবনে এগুলোর বাস্তবায়ন করা। আপনার চেহারার বর্ণ পরিবর্তিত হবে এবং আপনি ক্রোধান্বিত হবেন আল্লাহর দ্বীনের জন্য এবং আপনার ঘৃণা হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্যই দান করুন এবং আল্লাহর জন্যই বিরত থাকুন, তাঁর জন্য অগ্রসর হোন, তাঁর জন্য অগ্রগামী হোন, পুরো জীবন ও মৃত্যু অতিবাহিত আল্লাহর দ্বীনের জন্য।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য হবে আল্লাহর তাওহীদ (একত্ববাদ) । আপনি এই দ্বীনে প্রবেশ করেন এই বাক্যের সাথেঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোনো উপাস্য নেই), এবং যদি আপনি তাদের দলভুক্ত হতে চান যারা সাঈদ (সুখী), তাহলে আপনার জীবন শেষ করতে হবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” দিয়ে, যেমনটি হাদীসে এসেছেঃ
“যার শেষ বাক্য হবে লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[5]
সুতরাং আল্লাহর তাওহীদ কেবল শুরুতেই নয়, বরং এটা দিয়েই শুরু এবং শেষ। তাওহীদ দিয়েই বান্দার জীবনের শুরু এবং শেষ, আল্লাহর দ্বীন দিয়েই শুরু এবং শেষ, ঐসব আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ নয় যেগুলো লোকেরা আজকাল বলে থাকেঃ “জর্দানই প্রথম”, “সিরিয়াই প্রথম”, “আরব আমিরাতই প্রথম”[6] ইত্যাদি। সমস্ত মিথ্যা মতবাদ ও স্লোগানসমূহ যেগুলো জনগণের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ক্রীড়া কৌতুক করে, সেগুলোকে পরিত্যাগ করুন।[7]
এইগুলোকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করুন এবং আল্লাহর তাওহীদকে পরিণত করুন প্রথম এবং শেষ বিষয়; যদি সত্যিই আপনি এই স্থানে (কবর) নিরাপত্তা ও আনন্দ পেতে চান।
আপনার জীবনকে উৎসর্গ করুন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর বাণীকে বুলন্দ করার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাহ ও পথনির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করুন। অন্যথায়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, এই জীবনের কোনোই মূল্য নেই, যদি আমরা এ সময় আল্লাহর দ্বীনের অমর্যাদা হতে দেখেও নীরব থাকি, এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অবমাননা হচ্ছে জেনেও দূরে বসে থাকি, এবং আমাদের মুখের রং পরিবর্তিত হয় না, এবং আমরা আল্লাহর দ্বীনের জন্য কিছুই করি না।
আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস আমাদের উপর প্রযোজ্য যখন তিনি বলেছেন,
“শেষ সময় আসবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন লোক অন্য একজনের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, এবং বলেঃ “আহা! তার জায়গায় যদি আমি হতে পারতাম।”[8]
আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, জমিনের বাহিরের থেকে ভেতরটাই আজ উত্তম যদি আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অবমাননা করা হচ্ছে জেনেও চুপ করে থাকি, যদি আমরা আল্লাহর কিতাবের বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে জেনেও নীরবতা অবলম্বন করি, এবং যদি আমরা চুপ থাকি যখন আমাদের সামনে আল্লাহর দ্বীনের অবমাননা করা হচ্ছে। আমাদের হতে হবে, হে আমার ভাইয়েরা, এই দ্বীনের প্রকৃত সন্তান।
আমাদেরকে আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে হবে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য আমাদের মুখের রং পরিবর্তিত হতে হবে এবং আমাদের রাগান্বিত হতে হবে এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে তারা ছাড়া আর কেই যেন আমাদের ঘনিষ্ঠ হতে না পারে। আমরা অপমানিত করবো তাকে, যে আল্লাহর দ্বীনকে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর দ্বীনের অবমাননা করে, যদিও সে আমাদের নিকটতম ব্যক্তি হয়ে থাকে।
এই মাইলফলকগুলো আল্লাহর দ্বীনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাইলফলক, আমার ভাইয়েরা। “আল ওয়ালা ওয়াল বারা” (আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং ঘৃণা) এর মাইলফলক, ঈমানের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতল।
ঈমানের কিছু হাতল রয়েছে। এর মানে হলো সেই হাতলসমূহ যা মানুষেরা আঁকড়ে ধরে। কিছু মানুষ আছে যারা ঐচ্ছিক বা নফল ইবাদতসমূহ এবং তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার হাতলগুলো আঁকড়ে ধরে রাখে এবং সর্বাপেক্ষা মূল্যবান হাতলটিকে পরিত্যাগ করে।
এই মূল্যবান হাতল, যা হলো ঈমানের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতল, তা হলো আল্লাহর ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য ঘৃণা, তাঁর জন্য বন্ধুত্ব এবং তাঁর জন্য শত্রুতা।
আপনার বন্ধু কারা? কারা আপনার প্রিয়পাত্র? কারা আপনার অভিভাবক? কাদেরকে আপনি নিজের নিকটে আনেন? কাদের সাথে আপনি বন্ধুত্ব করেন? কাদেরকে আপনি সহায়তা করেন? নিজেকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করুন। নিজের কাছে জবাবদিহি চান।
তাকিয়ে দেখুন কাদেরকে আপনি দান করেন এবং কাদেরকে দান করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ যাদেরকে আপনি দান করেন, আপনার প্রিয়পাত্র, আপনার ঘৃণার পাত্র, আপনার ঘনিষ্ঠ, আর আপনার শত্রু; এসবই নির্ধারণ করতে হবে আল্লাহর জন্য এবং শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।
আপনার কাছের লোক হবে তারা, যারা এই দ্বীনকে বিজয় দান করে, এবং যারা এই দ্বীনকে ভালোবাসে, এবং যারা এই দ্বীনের অনুসরণ করে। আর আপনার দূরের লোক হবে তারা, যারা এই দ্বীনের শত্রু, যারা এই দ্বীনের বিরুদ্ধে লড়াই করে; এমনকি যদিও এই লোকেরা হয় আপনার পরিবারের নিকটতম সদস্য।
হে আল্লাহর বান্দা, অন্য কোনো মানদণ্ডকে স্থান দিও না! পরিবারের মানদণ্ড, অন্তরঙ্গতার মানদণ্ড, দেশ ও জাতীয়তাবাদের মানদণ্ড; এইগুলোকে ঈমান ও দ্বীনের মানদণ্ডের উপর স্থান দিও না। ঈমানের মানদণ্ডের উপরে অন্য কোনো মানদণ্ডের স্থান নেই।
এবং গভীরভাবে চিন্তা করো, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথা, যিনি সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে দয়ালু, চিন্তা করো তাঁর পরিস্থিতির কথা। দেখো কিভাবে এই দ্বীন, এই বিশ্বাস একজন ব্যক্তি ও তার পুত্রের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে, আর এর একটি অন্যতম সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছেন নূহ (আলাইহি সালাম)।
যখন আল্লাহ তাঁকে (আলাইহি সালাম) তাঁর পুত্র সম্পর্কে বলেছিলেন,
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ ﴿هود: ٤٦﴾
তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ “হে নূহ! এই ব্যক্তি তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়, সে অসৎ কর্ম-পরায়ণ, অতএব, তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করো না, যে সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নেই; আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি অজ্ঞ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”[9]
তিনটি মৌলিক মূলনীতি, আমাদের উলামাগণ এর এই নাম দিয়েছেন কারণ এটা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মূলনীতি। আল্লাহর তাওহীদ সুসম্পন্ন করা, এবং এই দ্বীনকে অনুসরণ করা যেভাবে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং সন্তুষ্ট থাকেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অনুসরণ করা, এবং তাঁকে নিজের আদর্শ বানানো; আর এমন অবস্থায় পৌঁছা যে, এগুলোই ছিল তার জীবন ও অন্তরের চাহিদা।
এই তিনটি এমন বিষয় যার উপর বাস্তবিকই আমাদের এই জীবন অতিবাহিত করা উচিৎ, যাতে আল্লাহ আমাদেরকে সফলতা দান করেন, এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন যারা এই স্থানে (কবরে) সাইদ (সুখী), এবং যাতে আমরা এমন দিনে অনুশোচনা না করি যেদিন অনুশোচনা আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
আমি আল্লাহ জাল্লা ওয়া আলা এর কাছে দোয়া করি যাতে তিনি ক্ষমা করেন আমাদের জীবিত ও মৃতদেরকে, যারা অনুপস্থিত তাদেরকে, আমাদের পুরুষ ও মহিলাদেরকে, এবং সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীগনের উপর।
********
[1] সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ১৮৫
[2] সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ১৮৫
[3] সহীহ বুখারি ও মুসলিম
[4] সূরা আনআম, আয়াতঃ১৬২-১৬৩
[5] আবু দারদা হতে সুনানে নাসাঈ তে বর্ণিত
[6] লেখক এখানে জাতীয়তাবাদ প্রকৃতির স্লোগানের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন এবং উদাহরণ হিসেবে আরব ভূখণ্ডসমূহে চলমান কিছু স্লোগানের স্বরূপ উল্লেখ করেছেন। যেমন, এদিকে আমরা শুনতে পাই “ইস্ট অর ওয়েস্ট, ‘অমুক’ ইজ দ্যা বেস্ট” কিংবা এই ধরণের অন্য কোনো স্লোগান। বৃহত্তর পরিসর থেকে ক্ষুদ্রতর পরিসর পর্যন্ত বিভিন্ন পরিসরে অজ্ঞ লোকেরা এই ধরনের স্লোগান ব্যবহার করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে যার মূল যুক্তি হচ্ছে; আমি “অমুক” দল/প্রতিষ্ঠান/এলাকা/দেশ এর লোক তাই ‘অমুক’ দল/প্রতিষ্ঠান/এলাকা/দেশ ই শ্রেষ্ঠ । আল্লাহ আমাদেরকে এমন জাহেল- অজ্ঞ উক্তি করা থেকে হেফাজত করুন। আমীন। আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ﴿الحجرات: ١٠﴾
মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই… (সূরা হুজুরাত, আয়াতঃ১০)
এছাড়াও আল্লাহ পাক বলেন,
إِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ﴿الأنبياء: ٩٢﴾
নিশ্চয় তোমাদের এই উম্মত হলো এক জাতি এবং আমিই তোমাদের রব, অতএব আমারই ইবাদত করো। (সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ৯২)
[7] সারা পৃথিবীতে আজ মিথ্যা বাতিল স্লোগানের কোনো অভাব নেই। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ভন্ডামীপূর্ণ স্লোগান দিয়ে ভরে উঠেছে। “দিন বদলের” স্লোগান থেকে শুরু করে “চেতনার” স্লোগান পর্যন্ত, কিংবা সরাসরি “জয় বাংলা”, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদের পরোক্ষ স্লোগান পর্যন্ত সবই এখন সহজলভ্য। আর একটু মনযোগ দিয়ে তাকালেই দেখা যায় যে, হয় এইসব স্লোগান দিচ্ছে কোনো ভণ্ড মিডিয়ার দল, অথবা এর পিছনে রয়েছে কোন রাজনৈতিক দল অথবা রয়েছে কোনো মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানী (এদের সবই দেশী, শুধু প্রভু বা মালিকানা টা বিদেশী) । এরা সবাই এই সব স্লোগানের দ্বারা মানুষদেরকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে। এভাবেই এরা জনগণের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ক্রীড়া কৌতুক করে। সবশেষে জনগণের ক্ষতি করে লাভ হয় এদেশের তাগুতগোষ্ঠীর, ভণ্ড মিডিয়ার কতিপয় ব্যক্তিবর্গের, কিছু চাটুকারের এবং বিদেশী শয়তানদের।
[8] সহীহ বুখারী
[9] সূরা হূদ, আয়াতঃ৪৬