শায়খ সালিহ আল-ফাওযান
পিডিএফ ডাউনলোড করুন
ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন
কুফুরীর সংজ্ঞা: কুফুরীর আভিধানিক অর্থ আবৃত করা ও গোপন করা।
আর শরী‘আতের পরিভাষায় ঈমানের বিপরীত অবস্থানকে কুফুরী বলা হয়।
কেননা কুফুরী হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান না রাখা, চাই তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক কিংবা না হোক; বরং তাঁদের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয় ও সন্দেহ, উপেক্ষা কিংবা ঈর্ষা, অহংকার পোষণ করা কিংবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ না করে প্রবৃত্তির অনুসরণ ইত্যাদি সবই সমান মাপের কুফুরী।
যদিও সরাসরি মিথ্যা প্রতিপন্নকারীরা বড় কাফির হিসাবে বিবেচিত। অনুরূপভাবে ঐ অস্বীকারকারীও বড় কাফির, যে অন্তরে রাসূলগণের সত্যতার প্রতি বিশ্বাস রাখা সত্ত্বেও হিংসাবশতঃ তাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে থাকে।
কুফরীর প্রকারভেদ: কুফুরী দুই প্রকার। যথা:
প্রথম প্রকার: বড় কুফুরী
এ প্রকারের কুফুরী মুসলিম ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত:
১. মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কুফুরী:
এর দলীল আল্লাহর বাণী:
﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا أَوۡ كَذَّبَ بِٱلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَهُۥٓۚ أَلَيۡسَ فِي جَهَنَّمَ مَثۡوٗى لِّلۡكَٰفِرِينَ ٦٨﴾ [العنكبوت: ٦٨]
“যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা রচনা করে, অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে অস্বীকার করে, তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে? জাহান্নামই কি এইসব কাফিরের আবাস নয়?” [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৬৮]
২. মনে বিশ্বাস রেখেও অস্বীকার অহংকারশতঃ কুফুরী:
এর দলীল আল্লাহর বাণী:
﴿وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤﴾ [البقرة: ٣٤]
“যখন আমরা ফিরিশতাদের বললাম, আদমকে সাজদাহ কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সাজদাহ করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩৪]
৩. সংশয়জনিত কুফুরী:
একে ধারণাজনিত কুফুরীও বলা হয়। এর দলীল আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿وَدَخَلَ جَنَّتَهُۥ وَهُوَ ظَالِمٞ لِّنَفۡسِهِۦ قَالَ مَآ أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَٰذِهِۦٓ أَبَدٗا ٣٥ وَمَآ أَظُنُّ ٱلسَّاعَةَ قَآئِمَةٗ وَلَئِن رُّدِدتُّ إِلَىٰ رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهَا مُنقَلَبٗا ٣٦ قَالَ لَهُۥ صَاحِبُهُۥ وَهُوَ يُحَاوِرُهُۥٓ أَكَفَرۡتَ بِٱلَّذِي خَلَقَكَ مِن تُرَابٖ ثُمَّ مِن نُّطۡفَةٖ ثُمَّ سَوَّىٰكَ رَجُلٗا ٣٧ لَّٰكِنَّا۠ هُوَ ٱللَّهُ رَبِّي وَلَآ أُشۡرِكُ بِرَبِّيٓ أَحَدٗا ٣٨﴾ [الكهف: ٣٥، ٣٨]
“নিজের প্রতি যুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমি মনে করিনা যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি আমার পালনকর্তার কাছে আমাকে পৌঁছে দেওয়া হয়ই, তবে তো আমি নিশ্চয়ই এর চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তদুত্তরে তার সাথী তাকে বলল, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন তোমাকে মানবাকৃতিতে? কিন্তু আল্লাহই আমার পালনকর্তা এবং আমি কাউকে আমার পালনকর্তার সাথে শরীক করি না।” [সূরা কাহফ, আয়াত: ৩৫-৩৮]
৪. উপেক্ষা প্রদর্শন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কুফুরী:
এর দলীল আল্লাহর বাণী:
﴿ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ عَمَّآ أُنذِرُواْ مُعۡرِضُونَ ٣ ﴾ [الاحقاف: ٣]
“আর কাফিররা যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৩]
৫. নিফাকী ও কপটতার কুফুরী:
এর দলীল হল:
﴿ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ ثُمَّ كَفَرُواْ فَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَهُمۡ لَا يَفۡقَهُونَ ٣ ﴾ [المنافقون: ٣]
“এটা এজন্যে যে, তারা ঈমান আনবার পর কুফুরী করেছে। ফলে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। অতএব, তারা বুঝে না”। [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৩]
দ্বিতীয় প্রকার: ছোট কুফুরী
এ প্রকারের কুফুরী মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কৃত করে না। একে ‘আমলী কুফুরী’ ও বলা হয়। ছোট কুফুরী দ্বারা সে সব গোনাহের কাজকেই বুঝানো হয়েছে, কুরআন ও সুন্নায় যাকে কুফুরী নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের কুফুরী বড় কুফুরীর সমপর্যায়ের নয়।
যেমন, আল্লাহর নি‘আমতের অকৃতজ্ঞতা ও কুফুরী করা যা নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে,
﴿ وَضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا قَرۡيَةٗ كَانَتۡ ءَامِنَةٗ مُّطۡمَئِنَّةٗ يَأۡتِيهَا رِزۡقُهَا رَغَدٗا مِّن كُلِّ مَكَانٖ فَكَفَرَتۡ بِأَنۡعُمِ ٱللَّهِ فَأَذَٰقَهَا ٱللَّهُ لِبَاسَ ٱلۡجُوعِ وَٱلۡخَوۡفِ بِمَا كَانُواْ يَصۡنَعُونَ ١١٢ ﴾ [النحل: ١١٢]
“আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এমন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। তথায় প্রত্যেক স্থান হতে আসত প্রচুর রিযিক ও জীবিকা। অতঃপর সে জনপদের লোকেরা আল্লাহর নি‘আমতের প্রতি অকৃতজ্ঞা প্রকাশ করল।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১১২]
এক মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াও এ ধরনের কুফুরীর অন্তর্গত। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ»
“কোনো মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী কাজ। আর তার সাথে যুদ্ধ করা কুফুরী”।[1]
তিনি আরো বলেন:
«لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ»
“আমার পর তোমরা পুনরায় কাফির হয়ে যেও না, যাতে তোমরা একে অপরের গর্দান উড়িয়ে দেবে”।[2]
গায়রুল্লাহর নামে কসমও এ কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ أَشْرَكَ »
“যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে কসম করল, সে কুফুরী কিংবা শির্ক করল”।[3]
কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ মুমিন হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ فِي ٱلۡقَتۡلَىۖ ﴾ [البقرة: ١٧٨]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর নিহতদের ব্যাপারে ক্বিসাস গ্রহণ করা ফরয করা হয়েছে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৭৮]
এখানে হত্যাকারীকে ঈমানদারদের দল থেকে বের করে দেওয়া হয় নি; বরং তাকে ক্বিসাসের অলী তথা ক্বিসাস গ্রহণকারীর ভাই হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
﴿ فَمَنۡ عُفِيَ لَهُۥ مِنۡ أَخِيهِ شَيۡءٞ فَٱتِّبَاعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَأَدَآءٌ إِلَيۡهِ بِإِحۡسَٰنٖۗ ﴾ [البقرة: ١٧٨]
“অতঃপর হত্যাকারীকে তার (নিহত) ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কিছুটা মাফ করে দেওয়া হয়, তবে (নিহতের ওয়ারিসগণ) প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং (হত্যাকারী) উত্তমভাবে তাকে তা প্রদান করবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৭৮]
নিঃসন্দেহে ভাই দ্বারা এখানে দীনী ভাই বুঝানো উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱقۡتَتَلُواْ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَهُمَاۖ ﴾ [الحجرات: ٩]
“মু‘মিনদরে দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৯]
এর পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَ أَخَوَيۡكُمۡۚ ﴾ [الحجرات: ١٠]
“মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা কর।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১০]
সার কথা:
১. বড় কুফুরী ইসলামী মিল্লাত থেকে বের করে দেয় এবং আমলসমূহ নষ্ট করে দেয়। পক্ষান্তরে ছোট কুফুরী ইসলামী মিল্লাত থেকে বের করে না এবং আমল ও নষ্ট করে না। তবে তা তদনুযায়ী আমলে ত্রুটি সৃষ্টি করে এবং লিপ্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখি করে।
২. বড় কুফুরীতে লিপ্ত ব্যক্তি চিরস্থায়ী ভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে; কিন্তু ছোট কুফুরীর কাজে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করলেও তাতে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে না; বরং কখনো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। ফলে সে মোটেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।
৩. বড় কুফুরীতে লিপ্ত হলে ব্যক্তির জান-মাল মুসলিমদের জন্য বৈধ হয়ে যায়। অথচ ছোট কুফুরীতে লিপ্ত হলে জান-মাল বৈধ হয় না।
৪. বড় কুফুরীর ফলে মুমিন ও এ কুফুরীতে লিপ্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত শত্রুতা সৃষ্টি হওয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। তাই সে ব্যক্তি যত নিকটাত্বীয়ই হোক না কেন, তাকে ভালবাসা ও তার সাথে বন্ধত্ব স্থাপন করা মুমিনদের জন্য কখনোই বৈধ নয়।
পক্ষান্তরে ছোট কুফুরীতে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে কোনো বাধা নেই; বরং তার মধ্যে যতটুকু ঈমান রয়েছে সে পরিমান তাকে ভালোবাসা ও তার সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত এবং যতটুকু নাফরমানী তার মধ্যে আছে, তার প্রতি ততটুকু পরিমান ঘৃণা ও বিদ্বেষভাব পোষণ করা যেতে পারে।
—
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮, ৬০৪৪, ৭০৭২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৪
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২১, ১৭৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫, ৬৬
[3] সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৫১