দাওয়াহঃ ভারসাম্য অপরিহার্য!

শায়খ আবু মুহাম্মাদ আল মাকদিসি

আমাদের দা’ওয়াহ ও জিহাদকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য নবীজি (সাঃ) এর জীবন থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা নেয়ার আছে। এই শিক্ষা একজন দা’য়ী ও মুজাহিদের সামনে যে পথ আছে তা সহজতর করে দেবে এবং তাদেরকে সফলতা অর্জন করতে সাহায্য করবে।

ফলে দা’ওয়াহ এবং জিহাদে কল্যাণ আসবে এবং একই সঙ্গে তা দা’ঈ ও মুজাহিদীনদেরকে মন্দ ও ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখবে।


নবী (সাঃ) এর মহান, মহিমামন্ডিত জীবন ইতিহাসের উপর যত্নসহকারে গবেষণা ও বিবেচনা করলে যে কেউ জানতে পারবে যে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তাঁর নবী (সাঃ) কে কীভাবে পরিচালিত করতেন। ফলে সে উপলব্ধি করতে পারবে যে দাওয়াহর ভাষা, কৌশল, বিকল্প পন্থা এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তিনি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতেনঃ

শ্রোতার স্বভাব ও তার আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অবস্থান। কাজেই একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ, তাদের উপজাতি, এবং তাদের স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ।
শ্রোতার দাওয়াহ গ্রহণের স্পৃহা এবং আল্লাহ্‌র দীনের প্রতি তার অবস্থান অর্থাৎ সে দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত কি না সেই তথ্য ।
মুমীনদের দল এবং দাওয়াহর সামর্থ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি সময়ে বা পর্যায়ে তাদের সামগ্রিক অবস্থা ও বাস্তবতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা।

এসব করা হয় শারিয়াহ এর নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী। যেকোনো ঘটনায় লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে, তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন যে শারিয়াহ এর অপরিবর্তনীয় নীতিমালা এবং দীন ও তাওহীদের সুদৃঢ় খুঁটিসমূহ লঙ্ঘন না করে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উপকার বয়ে এনেছে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষয়-ক্ষতি এড়াতে সহায়তা করেছে।

তিনি (সাঃ) তাঁর শ্রোতার স্বভাব, নৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান এবং যেসকল গুনাবলি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শ্রোতা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে সেগুলোকে খুবই গুরুত্ব দিতেন।

রাসূল (স) তাঁর দাওয়াহর প্রারম্ভে যেভাবে শ্রোতাদের আহবান করেছিলেন তা থেকেই এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ ইসলামের শত্রু থাকাকালে আবু সুফিয়ান এবং হিরাক্লিয়াসের কথোপকথন উল্লেখ করা যেতে পারেঃ 

তিনি তোমাদের কী করতে নির্দেশ দেন?’-হিরাক্লিয়াসের এই প্রশ্নের জবাবে আবু সুফিয়ান রাসূল (স) এর দাওয়াহর মূলভিত্তি তাওহীদের কথা উল্লেখ করেন।

এরপর তিনি আরও বলেন,’ তিনি(রাসূল (সা)) আমাদের সালাত আদায়, যাকাত দান, সত্যবাদিতা, সচ্চরিত্র এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দেন।

এক মুহূর্ত ভেবে দেখুন, দাওয়াহর বক্তব্য কতটা শক্তিশালী হলে তা শত্রুর মনেও গেঁথে যায়!


অন্যান্য হাদিসের বর্ণনায় এসেছে যে নবী (সাঃ) এছাড়াও ওয়াদা রক্ষা করা, আমানতদারি পূর্ণ করা, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়া, ভালোবাসাহীন কর্কশ ব্যবহারকে তিরস্কার করা এবং অনুরূপ সর্বজনস্বীকৃত উত্তম গুণাবলী চর্চা করার নির্দেশ দিতেন।

জনগনকে দীনের ভালো দিকগুলো দেখানোর জন্যই তিনি এমনটা করেছিলেন।

সেই সাথে রাসূল (সাঃ) তাদের এই শিক্ষাও দিতে চেয়েছিলেন যে, যেসকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমাজের বুদ্ধিদীপ্ত এবং অভিজাতশ্রেনী গর্ববোধ করে এবং যে সকল উত্তম গুণাবলীকে তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখে সেগুলোকে উৎকর্ষ দান করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

অনুরূপভাবে, তিনি (সাঃ) তাদেরকে ইব্রাহিম (আঃ) এর মিল্লাতের ব্যাপারে দাওয়াহ দিয়েছিলেন। ইব্রাহীমকে (আ) কুরাইশরা সম্মান করত ও তাঁর অনুসারী হিসেবে নিজেদের দাবি করত। রাসূল (সা) তাদেরকে বোঝান যে তিনি এবং যারা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাই ইব্রাহিম (আঃ) এর সবচেয়ে যোগ্য অনুসারী।

একইভাবে, হিরাক্লিয়াসের কাছে প্রেরিত পত্রে নবী (সাঃ) এর তাওহীদের বাণীর পরেই উল্লেখ করেন

ইসলাম গ্রহন করুন এবং নিরাপদ থাকুন,আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুন পুরষ্কার দেবেন। আর যদি ইসলামের এই দাওয়াহ প্রত্যাখ্যান করেন, তবে আপনার বিপথে চালিত প্রজাদের গুনাহসমূহ আপনার উপর অর্পিত হবে।

এটা হিরাক্লিয়াসের প্রজাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করে এবং তাদের জানিয়ে দেয় যে রাসূল(স) তাদের হিদায়াতের জন্য চিন্তিত ছিলেন।

এটা আরও ইঙ্গিত দেয় যে তাদের পথভ্রষ্টতার জন্য হিরাক্লিয়াসই দায়ী ছিল। এ ধরনের বিবৃতির মাধ্যমে নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) প্রমান করেছিলেন যে তারা আন্তরিকভাবেই মানুষের হিদায়াতের জন্য চিন্তিত ছিলেন ও তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ভয় পেয়েছিলেন।

সকল নবীর দাওয়াহতেই একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়। এর উদাহরণ আমরা দেখতে পাই যখন নূহ (আ) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেনঃ

হে আমার জাতি! আল্লাহর ইবাদাত কর! তিনি ব্যাতিত তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয়ই, আমি তোমাদের জন্য এক মহান দিবসের আযাবের ভয় করছি!

এমন কথা ব্যবহারে কোনো প্রকার লজ্জা নেই যা মানুষের হিদায়াতের ব্যাপারে একজন দায়ী বা মুজাহিদের আন্তরিকতার সাক্ষ্য দেয়।

এটি আরও সাক্ষ্য দেয় যে সে কিভাবে তাদের মঙ্গল কামনা করে, কিভাবে সে দুর্বল ও মজলুমদের সাহায্য করতে ভালবাসে এবং তাদেরকে জুলুম থেকে, জালিম ও সীমালঙ্ঘনকারিদের শোষণ থেকে রেহাই দিতে চায়, সে কিভাবে নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আর লড়াই করতে চায় জুলুম, মন্দ ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে

আল্লাহর কসম, দুর্বল মনের অধিকারী এবং নবী (সাঃ) এর জীবন এবং অন্যান্য সকল নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) এর দাওয়াহর ব্যাপারে অজ্ঞ লোক ছাড়া কেউ এমন কথায় লজ্জা পেতে পারেনা বা তার সমালোচনা করতে পারে না ।

আমদের দীন এসেছে সমগ্র মানবজাতিকে পথ প্রদর্শন করতে, তাদেরকে দাসদের (সৃষ্টির) দাসত্ব থেকে মুক্ত করে সকল দাসের প্রভু এক আল্লাহর ইবাদাতমুখী করতে । আর আমাদের নবী (সাঃ) প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র মানবজাতির কাছে রহমত স্বরূপ।

ধরনের বিবৃতি দীনের মৌলিক বিষয়াদিকে বিকৃত করে না বা তার নীতিগুলোকে অস্পষ্ট করে না কিংবা কাফিরদের তোষামোদ করে না।

বরং এটি দীনের মৌলিক ভিত্তি থেকে উৎসরিত সত্যের এক জ্যোতির্ময় দৃঢ় উপস্থাপন। মানুষের কাছে দায়ীকে অবশ্যই পরিষ্কারভাবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে।

যে সকল অমুসলিমরা এই সব গুণাবলীকে শ্রদ্ধা করে তাদের কাছে সত্যকে কেন্দ্রীভূত করে গড়ে ওঠা এইসব গুণাবলীর উপর জোর দেওয়াটা দোষের কিছু নয়।

হুদায়বিয়া সন্ধির ব্যাপারে আল-বুখারিতে বর্ণিত একটি ঘটনাও এই বিষয়টির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। আল বুখারী বর্ণনা করেনঃ 

কুরাইশ বংশের বনু-কিনানাহ গোত্রের এক ব্যাক্তি নবী (সাঃ) ও তার সাহাবিদের কাছে এসে বলল,

এই হচ্ছে অমুক ও অমুক এবং সে এমন এক সম্প্রদায়ের লোক যারা কুরবানির জন্য নির্ধারিত পশুদের সম্মান করে, তাই পশুগুলো তাকে দিয়ে দাও।

তাই তাকে পশুগুলো দিয়ে দেওয়া হয়। পশুগুলো আনতে গিয়ে সে সবাইকে তালবিয়াহ পাঠরত অবস্থায় দেখতে পেল। এই দৃশ্য দেখে সে বলে উঠলো,

আল্লাহ মহান! এই লোকসকলকে ক্বাবায় যেতে না দেয়া ন্যায়সঙ্গত হবে না।

পরে সে তার গোত্রের মানুষদের কাছে ফিরে এসে বলল, “আমি মালা পরানো এবং চিহ্নিত করা কুরবানির পশু দেখেছি, তাই আমি মনে করি যে তাদেরকে ক্বাবায় যেতে না দেয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না…।


সুতরাং তৎকালীন জনগণের মানসিক অবস্থার বিষয়ে রাসূল(সা) এর জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা সম্পর্কে ভাবুন। আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে তার বাণী

ঈমান ইয়েমেনিদের মাঝে, আর কুফর পূর্ব দিক হতে; শান্তি তাদের মধ্যে যারা ছাগল ও ভেড়া লালনপালন করে, আর অহংকার ও লোকদেখানো ভাব এবং– (আরেক বর্ণনা অনুযায়ী)- আত্মগরিমা হচ্ছে অসামাজিক এবং অভদ্র ঘোড়া মালিক আর বেদুঈনদের মধ্যে,”

এর মাধ্যমে রাসূল (সা) সাহাবীরা যেসকল লোকদের নিয়ে কাজ করতেন তাদের অবস্থা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দেন।

তাই তিনি(সা) ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখে কুরাইশদের আক্রমন করতে হাসান (রাঃ) কে আদেশ দেওয়ার আগে হাসান (রাঃ) কে আবু বকর (রাঃ) এর কাছে গিয়ে কুরাইশদের যুদ্ধ ও ইতিহাসের ব্যাপারে জেনে নিতে আদেশ করেছিলেন ।

একইভাবে, তিনি (সাঃ) মুয়ায (রাঃ) কে ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে পাঠানোর সময় প্রথমে বলেন, “তুমি কিতাবীদের কাছে যাচ্ছ।

এরূপে তিনি (সাঃ) মুয়ায (রাঃ) কে প্রথমেই তাদের আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক পটভূমি সম্বন্ধে অবহিত করেন এবং তারপর ইঙ্গিত করেন কিভাবে তাদের সাথে কথা বলতে হবে, তাদের দাওয়াহ দেয়ার সময় কোন বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে এবং কি বিষয় দিয়ে তাদের দাওয়াহ দেয়া শুরু করতে হবে

এই বিষয়গুলো বিবেচনা করুন এবং তা নিজের অন্তরে গেঁথে নিন। তারপর ভেবে দেখুন কিভাবে তিনি (সাঃ) কিভাবে মানুষদেরকে তাদের বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী দাওয়াহ দিয়েছেন ও তাদের সাথে কথা বলেছেন।

মানুষ যে ব্যাপারগুলো শ্রদ্ধা করে সেগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে তিনি সেগুলোকে স্পষ্টভাবে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের সামনে তুলে ধরতেন। এই কথা শুনে সংকীর্ণমনা হয়ে পড়বেন না। এ ব্যাপারটিকে অজ্ঞদের মতো চাটুকারিতা বা তোষামোদ ভাববেন না।

কারণ আল-বুখারীতে এসেছে আলী (রাঃ) এর বর্ণনায়

মানুষকে তাদের বুঝ অনুযায়ী দাওয়াহ দাও তুমি কি তা পছন্দ করবে যে আল্লাহ ও তার রাসুল (সাঃ) এর ব্যাপারে মিথ্যা ধারনা দেয়া হোক?” 

শ্রোতা একগুঁয়ে ও দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত নাকি শান্ত ও শুনতে ইচ্ছুক এই ব্যাপারে রাসূল(সা) এর বিজ্ঞ বিবেচনার পরিচয় পাওয়া যায় মহান আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) নিম্নোক্ত নির্দেশ বাস্তবায়নের দৃষ্টান্তে।

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) বলেনঃ

যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং কখনও তোমাদের নিজেদের বাড়িঘর থেকেও বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি দয়া দেখাতে ও তাদের প্রতি ন্যায় আচরণ করতে আল্লাহ তাআলা কখনও নিষেধ করেন না, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন।

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) আরও বলেনঃ

“(হে মুসলিমরা) তোমারা কিতাবধারিদের সাথে উত্তম পন্থা ছাড়া কনোরকম তর্ক-বিতর্ক করোনা, আবার তাদের মধ্যে যারা যুলুম করে তাদের কথা আলাদা…

অনুরূপভাবে, স্বৈরশাসক ফিরআউনকে প্রথমবার দাওয়াহ দিতে পাঠাবার সময় আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) মুসা (আঃ) ও হারুন (আঃ) কে নির্দেশ দিয়েছিলেনঃ

“(হেদায়েত পেশ করার সময়) তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হতে পারে সে তোমাদের উপদেশ কবুল করবে অথবা সে (আমায়) ভয় করবে।

কিন্তু যখন সে সুস্পষ্ট আয়াতের বিরোধিতা ও প্রত্যাখ্যান করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল, মুসা (আঃ) তাকে বললেনঃ 

“(এর জবাবে) সে (মুসা) বলেছিল, তুমি একথা ভালো করেই জানো (নবুওতের প্রমান সম্বলিত এসব) অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞান আসমানসমূহ ও যমিনের মালিক ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি, হে ফিরআউন, আমি তো মনে করি তুমি সত্যিই একজন ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষ।

তাই একবার ভেবে দেখুন কিভাবে তারা ফেরাউনকে প্রথমে দাওয়াহ করেছিলেন, আর একগুঁয়েমি প্রদর্শনের পর কিভাবে তাকে সম্বোধন করেছিলেন।

রাসূল (সা) কীভাবে মুমিনদের ও তাদের দাওয়াহর সামর্থ্য, তারা যে পর্যায়ে বসবাস করছিল তার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তাও লক্ষনীয়।

সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি আস্তে আস্তে জিহাদের বিধানের বাস্তবায়ন করেছিলেন। কিন্তু শুরুর দিকে প্রথমে পিছে হঠার, ক্ষমা করার, উপেক্ষা করার, মুশরিকদের বিমুখ হওয়ার ও তারা যে ক্ষতি সাধন করে তাতে ধৈর্যধারণ করার নির্দেশ ছিল।

মুমিনরা যখন হিজরত করলেন, আশ্রয় ও সমর্থন পেলেন এবং তারা যখন তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন, তখন তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক ও মুশরিকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়।কিন্তু তখনও তা তাদের উপর ফরজ (আবশ্যকীয়) ছিল না।

এসময়ে তিনি (সাঃ) এমন অনেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে বিরত থাকতেন যাদের মৃত্যু মুসলিমদের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

মুনাফিকরা কিভাবে তাদের ক্ষতিসাধন করেছে তা শুনে সাহাবীরা যখন ওই মুনাফিকদের হত্যা করার অনুমতি চেয়ে তার(সা) কাছে আবেদন করতেন, তিনি (সাঃ) উত্তর দিতেন

তাদের ছেড়ে দাও, (নতুবা) লোকেরা বলবে মুহাম্মাদ (সাঃ) তার সঙ্গীদের হত্যা করে।

কোনো সময় তিনি বলতেন,

তাহলে ইয়াসরিবে অনেকগুলো নাক তার জন্য দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।

তিনি (সাঃ) ইহুদীদের সঙ্গে সন্ধি ও শান্তি চুক্তি করেছেন এবং তাদের বিদ্যমান মৈত্রীচুক্তি এই পর্যায়ে বহাল রাখেন যে তিনি (সাঃ) এমনকি তাদের মৈত্রীদের সাথেও চুক্তিবদ্ধ হন। তবে সেটার শর্ত ছিল এই যে তিনি কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হলে তারা তাকে সাহায্য করবে।

কিন্তু এরপরও তারা তার (সাঃ) এর ক্ষতি করতো এবং (ব্যাঙ্গ করে) “রাইনাবলত যা অত্যন্ত অপমানজনক কথা হিসেবে বিবেচিত হতো, তারপরও তারা বলতেন,

আমরা শুনলাম ও তোমাদের কিছুই শুনলাম না,” ও অনুরূপ অন্যান্য বাক্য, যা তিনি সাঃ ধৈর্য ধরে সহ্য করতেন।

তারা তার (সাঃ) মৃত্যু কামনা করে তাকে অভিবাদন জানাত।

এর বিনিময়ে তিনি সহজ উত্তর দিতেন, “ওয়া আলাইকুম (তোমাদের উপরও)।

তারা তার ক্ষতিসাধন করা সত্ত্বেও তিনি (সাঃ) তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন না,তাদের হত্যা করতেন না।

বরং এর বিপরীতে যখন সাহাবারা তাদের হত্যা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন তখন তিনি (সাঃ) তাদের বারণ করেছেন।

রাসূল (সাঃ) তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলতেন। তিনি (সাঃ) আইশাহ (রা) কে তাদের অনিষ্টের পাল্টা-জবাবে তাদের অভিশাপ দিতে বারণ করতেন, আর তিনি (সাঃ) বলতেন,

যেখানে উদারতা পাওয়া যায় সেখানে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়, আর যেখানে উদারতা নেই তা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়।

নিঃসন্দেহে এগুলো একারণেই যে রাসূল(সাঃ) মুসলিম রাষ্ট্রের পরাজয়ের কথা বিবেচনা করতেন যেটা তখনও সূচনাপূর্বের কাছাকাছি ছিল ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল মাত্র।

পরবর্তী নির্দেশ ছিল সীমালঙ্ঘনের পাল্টা জবাব দেয়া ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যারা ঈমানদারদের তাদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ থেকে বিতাড়িত করেছিল।

অতঃপর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) বদরে মুসলিমদেরকে শক্তিশালি করেন । এটাই ছিল তাদের প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়, কারণ তা মদিনার অধিকাংশ কাফিরদের ঘাড়ে আঘাত হানে ও বাকিদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটায়।

এই পর্যায়ে, নবী (সাঃ) কিছুসংখ্যক ইহুদিকে বশীভূত করেন, যাদের হত্যা মুসলিমদের বা মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি সাধন করবে না।

নবী (সাঃ) ইহুদীদের ত্বাগুত কাব ইবনুল আশরাফ ও সমমনা অন্য লোকদেরকে কে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি (সাঃ) এই হত্যাকান্ড ব্যাপকহারে ঘটাননি, বরং, তিনি (সাঃ) শুধু তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন যারা তাকে আঘাত করেছিল ও যাদের হত্যার কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া হবে না।

যখন মদিনার পরিস্থিতি নবী (সাঃ)এর জন্য আরও সুস্থিত হল, তিনি কিছু সংখ্যক লোককে নির্বাসিত করেন ও কিছু সংখ্যক লোককে হত্যা করেন। ইহুদিরা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা চুক্তিভঙ্গ করার পরই শুধুমাত্র এগুলো করা হয়েছিল ।

এবং তা করা হয়েছিল মদিনাবাসী ও ইহুদীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ও স্বার্থযুক্ত নতুন মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে। যদি রাসূল (সাঃ) কোনও ভালো কারণ ছাড়া এর আগেই এমনটা করতেন তাহলে তা তাদের মধ্যে ক্রোধের উদ্রেক করত।

কিন্তু নবীজি (সাঃ) এর কর্মপদ্ধতি ছিল প্রাজ্ঞ শারঈ ফিকহ ও রাজনৈতিক মূলনীতি অনুসারে; আর যে কেউ এই দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত সে নিশ্চয়ই পথভ্রষ্ট হবে ও মুসলিমদের ক্ষতি সাধন করবে।

 

(Visited 860 times, 1 visits today)