শান্তিপূর্ণ আন্দোলনঃ বিশ্লেষণ ও ব্যবচ্ছেদ!

উস্তাদ হাসান আব্দুস সালাম

ইসলামকেন্দ্রিক জনআক্রোশের পরিবর্তে, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন অনেকেই। এতেই নাকি ক্রমান্বয়ে ইসলামের প্রভাব নিশ্চিত করবে!

বলা হচ্ছে,

(১) বামপন্থীদেরও রাস্ট্রযন্ত্রে প্রভাব নাকি এভাবেই ধীরে ধীরে পোক্ত হয়েছে!

আরো বলা হচ্ছে,
(২) চলমান ব্যবস্থায় না কি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বা সমাবেশের মাধ্যমেই ইসলামের জন্য দাবীদাওয়া আদায় করে নিতে হবে!

কিছুটা তিক্ত লাগলেও বলতে হচ্ছে, এমন আশ্চর্য ও অনুমাননির্ভর বক্তব্য প্রকাশ্যে আত্মবিশ্বাসের সাথে কিভাবে উচ্চারণ করা হয় আমার বোধগম্য নয়।
আমরা কি প্রতিটি সুযোগেই কথা বলাকে অপরিহার্য মনে করি? আমাদের বক্তব্যের পরিনাম নিয়ে কি নুন্যতম মুহাসাবাও করব না!?

বাস্তবতা হচ্ছে,
সেক্যুলার দলগুলোর আন্দোলনগুলোর প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারেও যদি কারো সাধারণ ধারণা থাকে এমন কথা বলা সম্ভব নয়!

বামপন্থা তথা সমাজতান্ত্রিক বা সেক্যুলার রাজনীতির ইতিহাসের কোনো অংশেই এর স্বপক্ষে দলীল খুজে পাওয়া সম্ভব না।
তবে, তাদের সুগারকোটেড মিথ্যায় অন্ধবিশ্বাস থাকলে ভিন্ন কথা!

আসলে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সংকটের ফলে, বরাবরই তাদের সকল চেস্টা ও ত্যাগের ফলাফল ঘরে তুলেছে বিএনপি-জামাতের মতো জাতিয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো!

(১)
বলা হচ্ছে,

শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকুন।

সময় নিন। শক্তিশালী হোন। বামপন্থীদের বদলে রাষ্ট্রযন্ত্রে আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছাই তখন বেশি প্রতিফলিত হবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটাই নিয়ম।

বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া অস্তিত্ব লাভ করে ১৯০৫, ১৯১৭ এর ফেব্রুয়ারি ও অক্টোবরের রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে।
এছাড়াও বামপন্থীদের মডেল সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্র চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম, এংগোলাসহ বহু রাস্ট্রসমূহহে, তীব্র আন্দোলন ও সংঘাতের ফলেই আস্তে আস্তে জনসমর্থন পেয়েই কেবল দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জন করে কমিউনিস্ট বিপ্লবী দলগুলো।

মিশর, সিরিয়া বা ইয়েমেনের মতো মুসলিমপ্রধান ও প্রভাবিত দেশগুলোতেও কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আসার গতিপথ লক্ষ্য করলে, নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া চোখে পড়ে না।

অতঃপর, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন আর কিউবার পরের বাকী রাস্ট্রগুলোতে কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের প্রভাব
ব্যাপকতা লাভ করে সোভিয়েত রাশিয়ার মদদে।
সোভিয়েত রাশিয়ার বার্ষিক কংগ্রেসে দুনিয়ার তাবৎ কমিউনিস্ট রাস্ট্রপ্রধান কিংবা দেশীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা জমায়েত হতো। এবং নিজ নিজ দেশে করনীয় কর্তব্যের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা লাভ করতো। এখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

এবার আসুন, সোভিয়েত বা চীনের প্রভাব ব্যাতীত বামপন্থীদের জাতীয় পর্যায়ে নিয়ামক হবার বাকি দিকগুলোও লক্ষ্য করি!
উদাহারণ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকা যেতে পারে।
ভারতে চারু মজুমদারের নকশালপন্থীদের কঠিন সংগ্রাম, শাসকপন্থীদের কমিউনিস্টদের সাথে দর কসাকসিতে বাধ্য করে। এছাড়াও ইলা মিত্রের তেভাগা আন্দোলনও তথাকথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ বা ‘নিয়মতান্ত্রিক’ কিছু ছিল না!
.
সরকারের সাথে ক্রমাগত শহরাঞ্চলে তীব্র আদর্শিক দন্দ্বই কমিউনিস্টদের আদর্শকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করে তোলে।
যার ফলাফল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে এক পর্যায়ে সিপিআই(এম) তথা কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) টানা ৪০ বছর ক্ষমতায় থাকে।

বাংলাদেশে ৭১ পরবর্তী সময়ে সিরাজুল আলম খানের নের্তৃত্বে জাসদ একাধারে মুজিব, খালিদ মুশাররাফ ও জিয়ার শাসনামলে এতবেশী সংঘাতে লিপ্ত হয় যে, জাসদ সরকারবিরোধী শক্তির আইকনে পরিণত হয়।

বিশেষত ১৯৭৪ এর ১৭ই মার্চে তৎকালীন বেইলি রোডে স্বরাস্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলির বাড়ি অবরোধে এগিয়ে যায় জাসদ। অতঃপর পুলিশের গুলিতে প্রায় ৫০ এর মতো জাসদকর্মী নিহত হয়।
নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক, প্রাক্তন জাসদ নেতা মাহমুদূর রহমান মান্নার বক্তব্যানুযায়ী, জাসদ নেতা ইনু আগেই সেদিন গুলি ছোড়ে যেন আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে!!

এত কঠিন ক্র্যাকডাউনের পরেও জাসদ নেতারা হতোদ্যোম না হয়ে, এঘটনাকে ১৯৫২ সালে কিউবাতে ক্যস্ট্রোর মনকাডা ব্যারাক আক্রমণের সাথে তুলনা করে এবং আন্দোলনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি করে।

উল্লেখ্য, ক্যস্ট্রো শখানেক অনুসারী নিয়ে মনকাডা দূর্গে সশস্ত্র আক্রমণ করে এবং তাতে অনেকেই নিহত হয়। পরিনামে ক্যস্ট্রোর ১৫ বছর সাজা হয়।

ইতিহাসের জ্ঞান রাখেন তাদের সকলেই জানেন,
এদেশে বামপন্থী রাজনীতির ব্যাপকতায় সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে জাসদ। এবং আরো উল্লেখ্য, ৭২ থেকে ৮০ পর্যন্ত জাসদ ব্যাতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকা চোখে পড়ার মত ছিল না।
যদি ১৫ই আগস্ট সামরিক অভ্যুথানে মুজিবের পতন না হতো কিংবা কর্নেল তাহের ৭ই নভেম্বরের পর আবার ক্যুএর চেষ্টা না করতো, জাসদের প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করতো!

এছাড়া সিপিবি ও তাদের অংগ সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নেরও রয়েছে তীব্র আন্দোলন ও সংঘাতের রক্তাক্ত ইতিহাস। আর সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কথা কে না জানে!

তাই বর্তমানে বাম দল বা ব্যাক্তিত্বের মূল্যায়ন যে কেবল বর্তমানের প্রেসক্লাবের সামনের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বা বয়ান-বিবৃতির ফল, এমন চিন্তাধারা ব্যাক্তির মানসিক বৈকল্যই নির্দেশ করে।

১৯৯১ এ সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, চীন কিংবা ভিয়েতনামের পুজিবাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরেও, বিভিন্ন দেশের বাম সংগঠনগুলো এখনো অন্যান্য দেশের বামপন্থীদের সাথে লিয়াজো বজায় রেখেই চলে।
যার ফলে মিডিয়া, সংবাদপত্র বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উইংয়ের সমর্থনে আগের মতো না হলে, মোটামুটি একটা মাত্রায় বাম সংগঠনগুলো ভারত, বাংলাদেশসহ মুসলিমপ্রধান রাস্ট্রগুলোতে এখনো কিছুটা প্রভাব ধরে রেখেছে। যার ফলে রাস্ট্রযন্ত্র এদের কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়।

এখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে, হাফ ডজন লোকের মানববন্ধন কিংবা ডিভোর্সি আর লম্পট সুশীল সমাজের গালভরা বিবৃতির ভূমিকা আসলে তেমন নেই বললেই চলে!

(২)
শান্তিপূর্ণ, গোবেচারা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী-দাওয়া আদায়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের দৃস্টি আকর্ষণ করে বলতে হচ্ছে,
‘৯০ দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন বা সমকালীন বিএনপি-জামাতের আন্দোলনেও যে পরিমাণ ক্যজুয়ালটি হয়েছে, হয় এমনটা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর হাতেও হয়নি!
শুধুমাত্র সরকারের বেধে দেয়া নিয়মে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কোনো বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদরা অগ্রসর হয় না।

৬০ এর দশকে শেখ মুজিব এত বেশী বন্দী হতো যে, সার্বক্ষনিক একটা ব্যাগ প্রস্তুত রাখতো জেলে যাওয়ার জন্য। তার দল আওয়ামি লীগের এমন কোনো নেতা ছিল না, যে নিদেনপক্কে কয়েক দফা ও কয়েক বছর জেল খাটেনি।

আর আমাদের আন্দোলনের রোডম্যাপ বর্ণনাকারীদের এব্যাপারে দৃঢ়তা দূরে থাকুক, কারাগারকে কেমন যেন কবরের ন্যায় মনে করে চলেছেন!

তারা বলছেন,

ঝরে যেতে পারে আরো অনেক তাজা প্রাণ। গ্রেফতার হবে সম্ভাবনাময় বাকিসব ধর্মীয় নেতারা। আমরা ক্ষমতা ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে পিছিয়ে যেতে পারি অন্তত ত্রিশ বিশ বছর। তাই কদম ফেলতে হবে হিসেব করে।

আফসোস! অথচ ক্ষমতা ও আদর্শের প্রভাব নস্ট হচ্ছে পশ্চাদপদ মানসিকতার জন্যই। বন্দীত্ব বা শাহাদাতের কারণে না!

ইসলাম ও ইতিহাসের আলোকে সার্বজনীন বাস্তবতা এটাই যে,
নিজেদের আদর্শের জন্য অথবা বিপ্লবের লক্ষ্য হাসিলের জন্য সফল বিপ্লবী শ্রেণীটি এত বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে যে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষই তাদের এই ত্যাগকে এক পর্যায়ে সমর্থন দিতে শুরু করে। এবং তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সুসংহত হয়েছে!

তাই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন একটি অলীক বস্তু। ইতিহাস কখনো এর সত্যতা ও সফলতার নজির হাজির করতে পারবে না!

হ্যা! রাজনীতিবিদরা এই বাক্যাংশটি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকে চাতুর্যতার সাথে। তবে এর বাস্তবতা হচ্ছে এটা একটি কৌশলগত উক্তি ছাড়া কিছুই না। অন্যথায়, তাদের আন্দোলনের দিনগুলোতে পেট্রোল, ককটেল আর টায়ার কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপস্থিত হয়!?

বাস্তবতা হচ্ছে, যে কোনো আন্দোলনের উদ্দেশ্যই থাকে বিপরীত পক্ষকে চাপ প্রয়োগ করব দাবী আদায় করা অথবা পরিবর্তনের পথ পরিস্কার করা।
এমনকি গান্ধীর অহিংস নীতিও এতটা ফ্যাকাশে ছিল না। খেলাফত আন্দোলন, সত্যাগ্রহ বা অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধী কিছুটা হলেও ব্রিটিশরাজকে প্রশাসনিক চাপের মুখোমুখি করেছিল।

যেখানে আমরা সকলেই জানি যে,
হাজার হাজার কেন, লাখ লাখ ইসলামপন্থীদের সমাবেশেরও কোনো মিডিয়া হবে না, বৈদেশিক কোনো লবি মিলবে না। একথা জানা সত্ত্বেও কিভাবে কেউ আশা করে যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নূন্যতম ফায়দা মিলবে!!? আর কিভাবেই একে হাতিয়ার সাব্যস্ত করতে পারে
!!.

আর কেনই বা আমরা নিজেদের দূর্বলতা ও নিস্ক্রিয়তার বৈধতা আদায়ে, বিপ্লবী জনসাধারণকে তাওহিদের উত্তাপ থেকে মুক্ত করে দিব!?
অথচ যদি আমরা কোনো সামগ্রিক পরিবর্তন নাও চাই, তথাপি প্রেশার পলিটিক্সের মাধ্যমে আংশিক পরিবর্তন ও প্রতিরোধের জন্যও তীব্র আন্দোলন অত্যন্ত জরুরী অনুষঙ্গ!

তাই না বুঝে শান্তিপূর্ণ/ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলাটা আসলে আন্দোলন বা বিক্ষোভের প্রকৃত বুঝের পাশাপাশি, এব্যাপারে গতানুগতিক যে চিন্তাধারা বিদ্যমান, সেব্যাপারেও ত্রুটিযুক্ত বুঝ থাকারই পরিচায়ক।

(Visited 923 times, 1 visits today)