উস্তাদ হাসান আব্দুস সালাম
এদেশের পটভূমিতে পটপরিবর্তনকারী সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়- আওয়ামি লীগের নের্তৃত্বে পরিচালিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সংঘটিত ১৯৭১ এর যুদ্ধকে।
পাকিস্তানের সেনাশাসিত সরকারের অর্থনৈতিক অসম বন্টনের জের ধরে শেখ মুজিব ও তার সঙ্গীসাথীদের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে।
শেখ মুজিব একাধারে গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়ের কথা কমবেশী বললেও, প্রকৃত অর্থে সে ছিল একজন জাতীয়তাবাদী নেতা।
এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তার অনুসারীদের মাঝে খন্দকার মুশতাক, শেখ মনির মতো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক এবং তাজউদ্দিন, সিরাজুল আলম খানের মতো আল্ট্রা-বামপন্থীদের সন্নিবেশ ঘটার মাঝে।
উপনিবেশবিরোধী সেক্যুলার জাতিয়তাবাদী নেতারাই (যেমন- কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, আলজেরিয়ার আহমেদ বেনবেল্লা, ইন্দোনেশিয়ার আহমদ সুকর্ন বা তিউনিশিয়ার হাবিব বুরগিবা প্রমুখ) ছিল এক্ষেত্রে তার আদর্শ।
অর্থাৎ মুজিবের আওয়ামীলীগের মানহাজ ছিল, বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদকে ভিত্তি করে পূর্ব বাংলা শাসন করা।
এজন্য তাকে ১৯৬৬ সালে প্রথমে ফেডারেল সরকারের অধীনে অধিকত্র সায়ত্তশাসন চাইতে দেখা যায়। অতঃপর ১৯৭০ এ কনফেডারেশন চাইতে দেখা যায়। এবং সবশেষে আলাদা রাস্ট্র চাইতে দেখা যায়।
বিষয়টা এমন নয় যে, মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চায়নি। আবার এমনও নয় যে, সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। বরং উভয়ের মাঝেই সমন্বয় রয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, তোষামোদকারী ও শত্রুভাবাপন্ন উভয় ধাচের ইতিহাসবিদদের পক্ষপাতদুষ্ট আলোচনা ও রচনাবলী এক্ষেত্রে আমাদের প্রান্তিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে গিয়েছে।
যে কারণে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীরা পাকিস্তানকে নব্য উপনিবেশবাদ বলে আখ্যায়িত করতো। অর্থনৈতিক শোষন বা বঞ্চনার স্লোগান ছিল কেবল সাধারণ জনগণের আবেগের স্ফুরণ ঘটানোর উদ্দেশ্যে।
পূর্ব বাংলাকে আলাদা জাতিরাষ্ট্র করার পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে শেখ মুজিব ও আওয়ামি লীগ অর্থনৈতিক শোষনকে সামনে রেখেই সবসময় আন্দোলন করে আসে।
মূলতঃ শেখ মুজিবের ফোকাস ছিল বাংলাভাষী জনতাকে উত্তেজিত করে রাস্ট্রের প্রধান হওয়া। আর যেহেতু সোভিয়েত ও ভারতের সাহায্য ছাড়া রাস্ট্রের অস্তিত্ব আনয়ন কিংবা স্থায়ীত্ব অর্জন সম্ভব না তাই সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের দিকে ঝোঁকা ছাড়া তার বিকল্প ছিল না।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ফুটিয়ে তুলতে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন” শীর্ষক স্লোগান ও পোস্টার গোটা পূর্ব বাংলা চরম প্রতিক্রিয়া সৃস্টি করে। নুরুল ইসলাম ও হাশেম খানের প্রয়াসে চিত্রিত এই পোস্টারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার তুলনামূলক চিত্র পোস্টারে তুলে ধরা হয়। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামিলীগের ল্যান্ডস্লাইড বিজয়ের অন্যতম নিয়ামক ধরা হয় এই পোস্টারটিকে।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট যে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের মূল নিয়ামক ছিলনা তার প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যানেঃ-
মুজিব সরকার স্বাধীনতার পর শুধুমাত্র বৈদেশিক সাহায্যই পায় তৎকালীন সময়ের আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তথাপি,
‘৭১ এর পর থেকেই নিত্য ব্যবহার্য প্রয়ােজনীয় পণ্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শিল্প-কারখানা ও কৃষি ক্ষেত্রের উৎপাদন স্বাধীনতার পূর্বেকার (১৯৬৯-৭০) পর্যায়ে উত্তরণ করা সম্ভব হয়নি। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ১৯৭২-৭৩ সালে এসে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের শেষ স্বাভাবিক বছরের (১৯৬৯-৭০) তুলনায় প্রকৃত অর্থে ১২-১৪% ভাগ কমে যায়।
অনুরূপভাবে, মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭২-৭৩ সালে ১৯৬৯-৭০ সালের চেয়ে একপঞ্চমাংশ কম ছিল।
দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ধানের উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালে ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৫% ভাগ কম ছিল।
১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় শিল্প উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালে প্রায় ৩০% ভাগ হ্রাস পায়।
১৯৬৯-৭০ সালের সামগ্রিক শিল্প-উৎপাদনের নিরিখে ১৯৭২-৭৩ সালে অবনতিশীল পরিস্থিতিতে দেখা যায়।
পাট শিল্পে উৎপাদন শতকরা ২৮ ভাগ, বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে সূতা উৎপাদন ২৩% ভাগ ও কাপড়ে ৩% ভাগ কম ছিল। এবং চিনি উৎপাদন হয়েছিল মাত্র পঞ্চমাংশ।
১৯৭২-৭৩ সালে দেশের রফতানী ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়েছিল।
শেখ মুজিবের শাসনাধীন বাংলাদেশের সূচনা-পর্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির পেছনে বহু কারণ ছিল।
প্রথমত, মুজিব সরকারের রাষ্ট্রীয়করণ নীতির কারণে সকল বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা সরাসরি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে চলে আসে।
কিন্তু রাষ্ট্র এসবের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, কোন ব্যবস্থাপনা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও যােগ্যতা না থাকার পরেও- আওয়ামী লীগের উঁচু মহলে ভালাে সম্পর্ক ও যােগাযােগ থাকার কারণে একদল লােক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ লাভ করে।
এ সকল লােকজন সরকার দলের পৃষ্ঠপােষকতায় শিল্পাঞ্চল দখল করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে পদ-পদবীর জোরে নিজেদের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক ভাগ্য গড়ে তুলতে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালায়।
অযােগ্য প্রশাসনের সঙ্গে খুচরা যন্ত্রাংশের অপর্যাপ্ততা, কাঁচামালের অভাব ও ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোেগ্য মাত্রায় হ্রাস করে।
দ্বিতীয়ত, দেশের নাজুক অর্থনৈতিক সম্পদের এক বড়াে অংশ মুনাফালােভী ব্যবসায়ীরা ভারতে পাচার করতে থাকে। দেশের প্রধান রফতানী আয়ের উৎস পাট এবং খাদ্যশস্য পাচার করা একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যে পরিণত হয়।
চোরাচালান নির্ভর এসব অবৈধ ব্যবসা বন্ধের জন্য মুজিব সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পড়ে।
১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে পনের লক্ষ টন ধান ও আট লক্ষ টন চাল ভারতে পাচার হয়ে যায়। চোরাচালানের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে ব্যাপক অবনতি ঘটে এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা যায়।
এসব কারণ ছাড়াও, অপর্যাপ্ত মুদ্রা সরবরাহ ও অর্থের ঘাটতি দেশের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার পেছনে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখে।
১৯৭৩-৭৪ সালের বার্ষিক পরিকল্পনা রিপাের্টে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন স্বীকার করে যে :
“দেশের কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষভাবে ভূমিহীন গ্রামীণ শ্রমজীবী এবং ব্যাপকভাবে শহুরে জনগণ এই পরিস্থিতির শিকার।
নিত্য ব্যবহার্য মৌলিক সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা ও উচ্চমূল্য সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে।”
অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার জনগণের উপর আওয়ামিলীগ সরকারের শোষন ও নিপীড়ন আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের চেয়েও বহুগুণ বেশী ছিল।
এছাড়াও, আরো অন্যান্য কারণের শেখ মুজিবের আওয়ামি লীগ আওড়াতে থাকে- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জানমালের হেফাজত কিংবা বাকস্বাধীনতা রক্ষার মতো বিষয়াবলী।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল, বিবিসি, আমেরিকা স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও অন্যান্য স্বাধীন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ১৯৭১ এ গণহত্যায় নিহতদের সংখ্যা ২,৬৯,০০০ থেকে ৩ লাখ দেখানো হয়েছে।
বিপরীতে, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে বামপন্থীই কেবল নিহত হয়েছে ৬০০০০ এর অধিক। এর বাইরে এক্সট্রা জুডিশিয়াল অন্যান্য হত্যাযজ্ঞ তো আছেই।
অর্থাৎ, এভূমির মানুষের উপর শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ পাক ফৌজিদের তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণে জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছিল।
বাকস্বাধীনতা বা রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের দমননীতি এই ছিল যে, গুটিকয়েক পত্রিকা ব্যাতীত সব নিষিদ্ধকরণ এবং পূর্বের ছয়টি রাজনৈতিক দল এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা।
গণতন্ত্রের কথা যদি বলা হয় তবে দেখা যায় যে, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন করে শেখ মুজিব ওয়ান পার্টি শাসন প্রতিষ্ঠা করে সাংবিধানিকভাবেই গণতন্ত্রকে স্থায়ী বিদায় জানায়। যাকে মুজিব আখ্যায়িত করেছিল তার “২য় বিপ্লব” নামে।
তাহলে এবিষয়টি নিশ্চিত যে,
হত্যা-নির্যাতন, গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের ফলেই ১৯৭১ এ পাকিস্তানের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত বা সফল হয়নি। বরং এগুলো মুজিবের মূল প্রোগ্রামকে শক্তিশালীকারী প্রভাবক ছিল।কেবল। মুজিবের মূল মানহাজ ছিল “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ”।
কিন্তু ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে খোলামেলাভাবে ধর্মের উপর ভাষা বা ভূমিকে প্রাধান্য দেয়ার আহবান করা পলিটিকালি ইনকারেক্ট হতো, এটা মুজিব ও তার অনুসারীদের কাছে উপলব্ধ ছিল।
আলোচনার প্রাপ্ত ফলাফল হলো,
অর্থনীতি, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নয় বরং একটি জাতি সাধারণত নিজের অধিকার ফিরে পেতে চায় এই মূলনীতিটি সামনে রেখেই সাধারণত পরিবর্তনের ঝড়ের সূচনা ঘটে।
জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ব্যাপক হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন গোত্র বা বর্ণ অথবা ধর্মই ব্যাপকভাবে মানুষকে পরিবর্তনের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
শেখ মুজিবসহ আধুনিক সেক্যুলার নেতারা ধর্মের পরিবর্তে জাতিয়তাবাদকে ভিত্তি ধরেছে এবং ধর্মকে একতার মূল ভিত্তি না করে ব্যাক্তিগত অভিরুচির অংশ করে দিয়েছে।
শেখ মুজিব বা অন্যান্য লিবারেল জাতিয়তাবাদীরা ধর্মকে পুরোপুরি মুছে ফেলেনি, কারণ এমনটা হলে প্রতিরোধে আগুন জাতীয়তাবাদি স্লোগান ঠেকাতে সক্ষম নাও হতে পারতো।
আমরা সুনিশ্চিত যে, ইসলাম অবশ্যই জাতিয়তাবাদ অপেক্ষা শক্তিশালী আদর্শ! কিন্তু ইসলামের নের্তৃত্বকে জাতিয়তাবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হলো কিভাবে!!? এব্যপারে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে।
কিন্তু আপাতত এটাই বাস্তবতা যে, হাল জমানায় ইসলামের বিপরীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অঘোষিত ধর্ম হচ্ছে “জাতিয়তাবাদ”। আর শেখ মুজিব ধর্মকে অপসারণ না করে পূর্বসূরী জিন্নাহর মতই জাতিয়তাবাদকে ধর্মের স্থলাভিষিক্ত করে দিয়ে ফসল ঘরে তুলেছে।
এর প্রেক্ষিতে কার্যকর ইসলামপন্থা কী হতে পারে?
ইসলাম অবশ্যই জাতিয়তাবাদের সকল অবস্থাকে ঢালাওভাবে অস্বীকার করে না।
সম্ভবত উলামায়ে কেরামের বক্তব্য থেকে প্রাপ্ত বক্তব্য এও যে,
ইসলাম জাতি, গোত্র, দেশ, ভাষা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পরিচয়প্রদান, অধিকার আদায়ের দাবী বা গ্রহণযোগ্য পরিমাণের আত্মাভিমানকে নিন্দা করেনা।
اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا
“নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারো।”
তাই জাতিয়তাকেন্দ্রিক যে আবেগ ও উন্নাসিকতা বিদ্যমান, তার অগ্রহণযোগ্য অংশকে পরিত্যাগ করে, এর সহনীয় অংশকে সেভাবেই দেখা উচিৎ সম্ভবত।
যেহেতু, আমাদের সামর্থ্য সীমিত, সাহায্যকারীর সংখ্যা কম কিন্তু শত্রু অনেক। আর আল্লাহ তা আলার কাছেই সাহায্য চাওয়া হয়।
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কিছু প্রস্তাবনাঃ-
____
এটা জানা কথা যে, সকল কথা সঠিক হলেই বলা জরুরী না। আমরা আমাদের আকিদা-মানহাজ বুঝব, আত্মস্থ করব এবং ব্যাক্তি-পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনাকরত তা সম্ভাব্য সর্বত্র ছড়িয়ে দিব।
মানুষকে শরিয়ার শাসনের অপরিহার্যতা এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের অসারতা ও এর বিপদের মাত্রা বোঝানোকে আমাদের দাওয়াতের মূল বানিয়ে নিব।
আর কেনই বা তা করব না? আমাদের নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) কি জাতির সবচেয়ে বড় ও ব্যাপক মুনকারকে প্রতিহত করাকেই অগ্রগামী দায়িত্ব গণ্য করেন নি?
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কথা এটাই যে,
শরিয়াহকে হাকিম হিসেবে মেনে নেয়া, (অর্থাৎ বিধান প্রণয়ন ও বিচার ফয়সালা কেবল শরিয়াহর আলোকেই হবে) তাওহিদের অন্যতম রুকন এবং দুনিয়া আখিরাতের সফলতা-সমৃদ্ধির মাধ্যম- এই দাওয়াতের ব্যাপারে একঘেয়েমিতা যেন কোনোদিন চেপে না বসে সেদিকে সতর্ক থাকা কাম্য।
অবশ্যই আমরা এমন কোনো কথা বা কাজে জড়াব না যা আমাদের আদর্শের পরিপন্থী। যেমনটা সেক্যুলারদের সাথে মুদাহানা, সংশ্লেষণ আর তোষামোদে লিপ্ত আত্মপরিচয়হীনরা করে থাকে।
এই শিবিরের অগ্রভাগে আছে “ইসলামী” পরিচয়ের দাবীদার উদারপন্থী মর্ডানিস্ট, ইখওয়ানি বা ‘জলদগম্ভীর’ সাহিত্যিকরা।
বক্তব্য, লেখাসহ সকল দাওয়াতী মেহনতে সরলতা, কোমলতা ও দৃঢ়তাকে আকড়ে ধরাই সুন্দর হবে আশা করা যায়।
উপেক্ষা-অযোগ্য বাস্তবতা হচ্ছে ইসলামের সামগ্রিক মাসলাহা এবং রাজনৈতিক পরিপক্কতার দাবী এটাই যে,
সাধারণ মুসলিম থেকে শুরু করে নিস্ক্রিয় বা অচেতন শত্রুদেরকে পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মুয়াফিক বা অনুগামী করতে আমরা সচেস্ট হওয়ার চেস্টা করব।
এমন কিছুই করব না যার ফলে কেউ আমাদের বিরুদ্ধবাদী বা প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।
আমাদের উচিৎ হবে ইসলামী লক্ষ্য আদর্শকে সামনে রেখে নিজেদের পরিকল্পনা ও চিন্তাচেতনা সুসজ্জিত করা। স্বভাবজাতভাবেই নিজ জাতিকেন্দ্রিক চিন্তা আসা মানেই তা কুফর বা ইলহাদ বলে নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকা কাম্য হবে।
জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন চিন্তা বা আধুনিক রাস্ট্রীয় সীমানার আলোকে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচী, যা শরঈ সীমানা লংঘন করেনা; সেসবকে প্রত্যাখ্যান না করাও আমাদের দাওয়াতকে গনমুখী রাখতে এবং সামগ্রিকভাবে বিশুদ্ধ মানহাজের দিকে আহবানকারী ইসলামপন্থীদের শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
শরীয়ার মাপকাঠিতে বিবেচ্য হওয়ার পর- বাকস্বাধীনতা, জুলুমের অবসান বা অর্থনৈতিক মুক্তি ইত্যাদির মতো যে সকল ইস্যু শরিয়তের তামকীন বাস্তবায়নের বিশুদ্ধ মানহাজের পরিপন্থী নয় সেগুলোও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এবং তা প্রত্যাখানের পরিবর্তে সমর্থন জোগানো, জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নে আমাদের প্রাসঙ্গিক করে তুলবে আশা করা যায়।
বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের মৌলিক ও নূন্যতম হক আদায় করতে আমরা মানুষকে সাহায্য করব এবং অতিরিক্তের জন্য চাপাচাপি না করে উৎসাহ জোগাব।
সুসংবাদ দানকারী হবো, ঘৃণা সৃস্টিকারী হবো না। মানুষকে হকের উপর আনয়নকারী হবো, বিতাড়নকারী হবো না। মুনাফা অর্জন করতে গিয়ে মূলধন হারানো কিংবা অতি-অনুগত বানাতে গিয়ে প্রতিপক্ষ তৈরির মতো বোকামী যেন আমরা না করি। ভুলকে যথাযথ পদ্ধতিতে ভুল বলা আর শত্রু তৈরি করা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়।
আলহামদুলিল্লাহ, বিবেকবান মানুষদের নিকট এটা অস্পষ্ট নয় যে,
আকিদা ও মানহাজের অভেদ্য প্রশ্নে অটল থেকে মানুষকে তাগুতের বিরুদ্ধাচরণ ও শরিয়াহর শাসনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান করা এবং পছন্দনীয়, অতিরিক্ত বা শাখাগত বিষয়ে চাপাচাপি না করে নিজেদের দাওয়াতের অনুগামী রাখা; পরস্পরবিরোধী কোনো অবস্থান নয়।
আল্লাহ তা আলা আমাদের বোঝার তাওফিক দিন,
বিচ্ছিন্ন ও আবেগপ্রসূত কর্মকান্ডের কোনো ফলাফল অর্জিত হয় না।
রক্তমাংসের তৈরি মানুষের সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রাখা জরুরী সবসময়ের জন্যই।
তীব্র জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের জঠরে জন্ম নেয়া এবং সুবিধাবাদী সেচ্ছাচারী শাসনের মাঝে বেড়ে ওঠা আবেগপ্রবণ এই জাতির কাছে আমাদের প্রমাণ করা প্রয়োজন,
ইসলামের পরিচয় আমাদের জাতিকে আক্রান্ত করে না।
ইসলামের স্লোগান আমাদের ইতমিনান বা প্রশান্তির দিকেই আহবান করে।
ইসলামের শাসনই কেবল সকল প্রকার শোষন, বঞ্চনা ও জুলুম থেকে গোটা জাতিকে মুক্তি দিতে পারে।
ইসলামই কেবল সকল সময়ে, সকল প্রসঙ্গে সমাধান পেশ করে।
এবং সকল প্রকার সমস্যা ও সংকটের সমাধানে ইসলামের প্রস্তাবনাই সম্ভাব্য সকল প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠতম!