শায়খ আবদুল আযীয আত-তুয়াইলী
ডাউনলোড
প্রকৃতপক্ষে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহের মাঝে ‘আল উযর বিল জাহল’ অর্থাৎ ‘অজ্ঞতার অজুহাত’ বিষয়ে মতবিরোধ এবং ভুলত্রুটি ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এবং তাদের মাঝে এমন অনেক লোক আছে যারা মনে করে, কোন অজ্ঞ (দ্বীন সম্পর্কে) ব্যক্তি যদি বড় কোন শিরক (শিরকে আকবর) করে তাহলে তার ওজর গ্রহণ করা হবে শুধুমাত্র এই কারনে যে সে নিজেকে ইসলামের সাথে সম্পর্কিত করে এবং দাবি করে সে মুসলমানদের একজন।
যদিও সে আল্লাহ ব্যতিত অন্য কোন উপাস্যের ইবাদত করে, তার কাছে প্রার্থনা করে, তার নামে কুরবানি করে এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এগুলো করে আসছে; তবুও তাকে মুসলমান সাব্যস্ত করা হবে যদি সে মুখ দিয়ে দাবি করে যে “আমি একজন মুসলমান”।
আমাদের মতে, সে যদি আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো ইবাদত করে, তার কাছে প্রার্থনা করে, তার নামে কুরবানি করে এবং মুখে স্বীকার করে যে “আমি আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের উপর আছি, যেই দ্বীনের উপর চলতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন” তাহলে তার ওজর গ্রহন করা হবে না এবং নিঃসন্দেহে এটি আমাদের আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক। এখন যদি একজন কবর পূজারী এবং মূর্তি পূজারীর সাথে তার তুলনা করা হয়; যেখানে এই দুই দলের (কবর পূজারী ও মূর্তি পূজারী) কারোই দ্বীনের ব্যপারে অজ্ঞতার ওজর গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে এদের মুসলিম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে সে কেন এই দুই দলের মাঝে পার্থক্য করবে? যেহেতু কবরপূজারী নিজেকে ইসলামের সাথে সম্পর্কত করছে তাই সে মূর্তি পূজারীকে কাফের সাব্যস্ত করবে এবং কবর পূজারীকে মুসলিম হিসাবে গণ্য করবে।
আর ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততার দ্বারা যদি সম্পূর্ণরূপে নামায ও রোজাবিহীন, বাধ্যবাধকতাহীন শুধু নিজেকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করা বোঝানো হয় তাহলে এটি হবে প্রমাণ ছাড়া কোন একটি বিষয়কে চাপিয়ে দেওয়া। আর ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততার দ্বারা যদি শুধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দ্বীনের উপর বিশ্বাস বোঝানো হয়, সেটা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়াহ হোক, কিংবা ইয়াহুদি বা খ্রীষ্টান কিংবা ও অন্যান্য নবী-রাসূলগণের শরীয়াহ হোক – তাহলে যারা এধরণের কথা বলবে তাদের উচিৎ ইয়াহুদি, খ্রীষ্টান সহ অন্যান্যদের মাঝের অজ্ঞদের ক্ষেত্রে জাহালতের ওজর দেয়া এবং তাদের মুসলিম গণ্য করা। কেননা তারা নিজেদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট দ্বীনের অনুসারী বলে। আর তাদের যে বিচ্যুতি ঘটেছে তার কারণ হল অজ্ঞতা। আর একথা স্পষ্ট যে যারা এই ব্যপারে ইহুদী-খ্রিস্টান ও অন্যান্যদের অজ্ঞতা গ্রহণ করে নেবে (তাদের মুসলিম গণ্য করবে) সে কুফর করল, ইসলামকে ত্যাগ করলো এবং বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট দলিলসমূহকে প্রত্যাখ্যান করল।
বাস্তবতা হল, (যদি এই মূলনীতি অনুসরণ করা হয়) তাহলে অবশ্যই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব পূর্ব কুরাইশ মুশরিকদের উপরও ইসলামের হুকুম আরোপ করতে হবে (মুসলিম গণ্য করতে হবে)। কেননা তাদের কাজকর্ম ও স্বীকারোক্তি দ্বারা তারা দাবি করে যে তারা মিল্লাতে ইবরাহিমের উপর আছে। এবং তারা হজ্জ, খতনাসহ ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর থেকে প্রাপ্ত কিছু নিয়ম-কানুনও মেনে চলত। তারা এই কথাও মানত যে আল্লাহই হচ্ছেন রব, সৃষ্টি, রিযিকদান, জীবন ও মৃত্যুদান এর ক্ষেত্রে আল্লাহ্র কোন শরীক নেই। এতঃদসত্ত্বেও আল্লাহ্র সাথে শিরক করেছিল কারণ তারা মনে করতো মিথ্যা ইলাহগুলো তাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করবে। তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহ এই সকল গাইরুল্লাহকে মনোনিত করেছে তাদের পক্ষ থেকে শাফায়াত করার জন্য এবং তাদের আর আল্লাহর মাঝে তারা হল মধ্যস্থতাকারী। কিন্তু আল্লাহ তাদের এই ভ্রান্ত দাবি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। কবর পূজারীদের অবস্থা একেবারে এদের মতোই, পার্থক্য হল তারা নিজেদেরকে খাতামুন নাবিয়্যীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসারী দাবি করে। আর জাহেলিয়াতের সময়কার কুরাইশ মুশরিকরা নিজেদেরকে একনিষ্ঠ ইবরাহিমের ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করতো। যাহোক তারা উভয়েই সমান এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কিছু আদেশের অনুসরণ করা বা তার আনীত দ্বীনের কিছু অংশ পালন করা তাদের কোন উপকারে আসবে না, যেভাবে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) এর কিছু আদেশের অনুসরণ করে বা তার আনীত দ্বীনের কিছু অংশ পালন করে কুরাইশ কাফেরদেরও কোন লাভ হয়নি।
সুতরাং ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা দাবি করা কিংবা ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) এর আনীত দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ততা দাবি করা, এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত দ্বীনের কিছু আমল ও ইবাদত পালন করা তাদের ইমান ও কুফরের প্রমাণে কোন পার্থক্য আনে না। এবং ঐসব কুরাইশ মুশরিকিনও কবরপূজারীদের মতোই আল্লাহ্র রুবিবিয়াতকে স্বীকার করতো কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা উভয়েই আল্লাহর সাথে কুফরি করেছে এবং সত্য দ্বীন থেকে বের হয়ে গেছে।
এমনকি, কবরপূজারীরা এটাও দাবি করে থাকে যে তারা যা করছে তা তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছে। যেমন কুরাইশের মুশরিকরাও বলেছিল।
যেমনটি আল্লাহ তা’আলা তাদের ক্ষেত্রে বলেছেন;
“এবং যখন তারা কোন অশ্লীল কাজ করে তখন তারা বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের এমনই করতে দেখেছি এবং আল্লাহ তা’আলা আমাদের এমনটি করতেই আদেশ করেছেন”। (সূরা আরাফ-২৮)
আর বর্তমানে কবরপূজারীদের মাঝের মুশরিকদের অধিকাংশই এ কথাকেই দলিল হিসাবে উপস্থাপন করে। শিরককারীদের নেতাদের একজনকে আমি উমরাহ পালনরত অবস্থায় পেলাম। সে আমাকে বলল, “লোকেরা যা পালন করছে তাতে তিরস্কার করার অধিকার আপনার নেই। কারণ তারা এগুলো তাদের বাপ-দাদাদের থেকে পেয়এছে এবং নিশ্চিতভাবে তারাও তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকে পেয়েছে। অর্থাৎ খালাফরা এটা গ্রহণ করেছে সালাফদের থেকে। তাহলে এগুলো আল্লাহর রাসুল থেকেই এসেছে”।
এবং এই আয়াতে মুশরিকদের দলিলের ব্যাপারে ঠিক দুটি জিনিস বর্ণিত হয়েছে। আর তা হল তারা দাবি করতো যে তাদের পূর্বপুরুষদের তারা এই দ্বীনের উপর পেয়েছে, এবং আল্লাহ্ই তাদেরকে এই কাজগুলো করতে আদেশ করেছেন। হাফিয ইবনে কাসির (রহঃ) বলেন, তারা বিশ্বাস করতো তাদের পূর্বপুরুষদের কার্যক্রমগুলো উৎস হলেন আল্লাহ্ ও শরীয়ত। যদিও কাবা শরীফ উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করা একটি অশ্লীল কাজ, কিন্তু তারা ব্যাখ্যা দিতো যে, যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ এই কাজটি করতো এবং যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষরা আল্লাহ্র আদেশ অনুসারেই কাজ করতো তাই কাজটি আল্লাহ্রই নির্দেশিত। আর সবচেয়ে খারাপ হল, যখন অজ্ঞতার অজুহাত-এর বিষয়ে ইলম পিপাসু ছাত্ররা ভুল ধারণায় পতিত হয়। খুব সচরাচর এটি ঘটে থাকে যে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেসব একগুয়ে ব্যক্তি যে হুজ্জাহ আনার পরও তা প্রত্যাখ্যান করে, তাদের ক্ষেত্রেও তাকফির করা হয় না। বরং যারা নিজেদের দুয়াত আস-সাহওয়াহ বলে দাবি করে তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলেছে, তাদের হাফিয আল-আসাদ (বাসারের পিতা; আল্লাহ তার উপর লানত বর্ষন করুক) ও তার মতো অন্যান্য আরব মুরতাদ তাগুত শাসকদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে কেউ কেউ তো এমনও বলে যে – আমি এমন কারো উপর তাকফির করি না যে নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবি করে।
এবং এটাই সেই পথভ্রষ্টতা। যদি এই অবস্থান সঠিকই হতো তাহলে কেন আবু বকর সিদ্দিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ মুসায়লামা ও তার সাথী-সঙ্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং শহীদ হয়েছে্ন, যাদের মধ্যে হাফেয, কারী এবং আলেমও ছিল। এবং আলেমরা যাদের উপর কাফের ফাতওয়া দিয়েছে তাদের অধিকাংশই মুরতাদদের অন্তর্ভুক্ত। যদিও তাদের অধিকাংশই নিজেদেরর মুসলিম হিসাবে দাবি করতো এবং ইসলাম ছাড়া নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন নাম গ্রহণ করতো না।
বরং এই ভ্রান্ত মূলনীতি অনুসরণ করার কারণে তো এমনও বক্তব্য বের হয়েছে যে – যে ব্যক্তি বলে ‘আমি মুসার দ্বীনের উপর আছি’ অথবা ‘আমি ঈসার ধর্মের উপর আছি’ সে কুফর করেনি। এবং এই মূলনীতি সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর দ্বীন, তার কিতাব এবং তার নবীর সুন্নাহ থেকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে। এবং যদি বলা হয় যে – এ কথা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমনের ও তাদের শরীয়াহ রহিত হয়ে যাবার পর তারা শরীয়তে মুহাম্মাদী অনুসরণ না করার কারণে তারা কুফর করেছে’ তাহলে তো এই কথা বলা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায় যে, তারা যদি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পর নিজেদের মুসলিম হিসাবে দাবি করে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে অজ্ঞরা ওজর বিল জাহল পাবে এবং মুসলিম গণ্য হবে। এবং একথা স্বীকার করাও আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায় যে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমনের সময় তাদের অজ্ঞ ব্যক্তিরা সকলেই মুসলিম ছিল আর তারা শুধু তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনের কারণে কাফেরে পরিণত হয়েছে। এবং অবশ্যই এবং কথা বাতিল ও মিথ্যা।