শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি
ডাউনলোড
ইবনে হিব্বান ও বায়হাকী রহ: হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণনা করেন:
তিনি কোন এক সীমান্ত প্রহরায় ছিলেন। একদা সবাই সমুদ্র তীরের দিকে ছুটল। (অর্থাৎ কিছু হয়েছে, তাই সবাই সেই দিকে গেল) অত:পর বলা হল, কোন সমস্যা নেই। তাই সবাই প্রত্যাবর্তন করল। আবু হুরায়রা রা: দাঁড়িয়েই রইলেন।
এক ব্যক্তি সেখান দিয়ে অতিক্রম করছিল। সে বলল, আবু হুরায়রা! আপনি কি কারণে দাড়িয়ে আছেন?
আবু হুরায়রা রা: বললেন, আমি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছি: “আল্লাহর পথে একঘন্টা সময় অবস্থান করা কদরের রাত্রিতে হাজরে আসওয়াদের নিকট দাঁড়িয়ে নামায পড়া অপেক্ষা উত্তম।
আল্লাহর পথে এক ঘন্টা অবস্থান করা লাইলাতুল কদরে হাজরে আসওয়াদের নিকট দাঁড়িয়ে নামায পড়া অপেক্ষা উত্তম। আর লাইলাতুল কদর এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আর মসজিদে হারামে নামায পড়া এক লক্ষ নামাযের সমান। এক ঘন্টা রিবাতের মধ্যে কাটানো এর মত নয়; বরং এর থেকেও উত্তম।
যাই হোক, বলা হল, আল্লাহর পথে এক ঘন্টা অবস্থান করা লাইলাতুল কদরে হাজরে আসওয়াদের নিকট দাঁড়িয়ে নামায পড়া অপেক্ষাও উত্তম।
রিবাত অর্থ কি? ইবনে কুদামা রা: বলেন,
রিবাত হল, (ছাগর বা) সীমান্তে অবস্থান করা, কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে শক্তিশালী করার জন্য। ছাগর কি?
উলামায়ে কেরাম বলেন, ছাগর হল এমন স্থান, যার অধিবাসীদেরকে শত্রুরা ভীত-সন্ত্রস্ত করে এবং তারাও শত্রুদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে।
অর্থাৎ এমন স্থান, যেখানে মুসলিমরা শত্রুদের থেকে আশঙ্কাবোধ করে এবং তারা শত্রুদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে। তারা ভয় করে ও অন্যদেরকে ভয় দেখায়।
সর্বনিম্ন রিবাত হল এক ঘন্টা, যেমনটা ইমাম আহমাদ রহ: বলেছেন। আল্লাহর রাস্তায় সর্ব নিম্ন রিবাত কতটুকু? এক ঘন্টা। কারণ হাদীসের শব্দ “একঘন্টা অবস্থান করা”। আর এর পূর্ণাঙ্গ সময় চল্লিশ দিন। যা আবু হুরায়রা ও ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত।
সর্বোত্তম রিবাত হল সর্বাধিক আশঙ্কাজনক ও সবচেয়ে উপকারী সীমান্তে অবস্থান করা। কারণ সেটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং সেখানে থাকা সর্বাধিক উপকারী।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: বলেন, সর্বোত্তম রিবাত হল যেটা সবচেয়ে বেশি কষ্টকর।
রিবাতের ফযীলতের ব্যাপারে আয়াত ও হাদীস অনেক রয়েছে। তান্মধ্যে একটি হাদীস: ইমাম বুখারী রহ: সাহল ইবনে সা’দ আস সায়িদি রা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা: বলেছেন:
“একদিন আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত প্রহরা দেওয়া দুনিয়া ও তার উপর যা কিছু আছে তা অপেক্ষা উত্তম”।
পূর্বের হাদীসে বলা হয়েছে এক ঘন্টা আর এখানে বলা হয়েছে একদিন।
দুনিয়া বলে কি উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্য হল, আখেরাতের পূর্বে যা আছে সব, অথবা যার উপর সূর্য উদয় হয়, যেমনটি অন্য হাদীসে রয়েছে।
পুরো হাদীস-
“একদিন আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত প্রহরা দেওয়া দুনিয়া ও তার উপর যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম। এক সন্ধা বা এক সকাল, যা একজন বান্দা আল্লাহর পথে চলে, তা দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে, সব কিছু থেকে উত্তম।”
(অর্থাৎ যাওয়া ও আসা। তাহলে যাওয়াও সাওয়াব, আসাও সাওয়াব। যেমন হাদীসের মধ্যে রয়েছে, ‘জিহাদ হতে প্রত্যাবর্তনও জিহাদের মত।)
আর জান্নাতের এক চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও দুনিয়ার উপর যা কিছু আছে তা অপেক্ষা উত্তম”। হাদিসটি রয়েছে বুখারীতে।
আরেকটি হাদিস, সহীহ মুসলিমে সালমান রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা: কে বলতে শুনেছি:
“একদিন একরাত আল্লাহর পথে প্রহরা দেওয়া এক মাস রাত্রি জাগরণ করা ও একমাস রোজা রাখা অপেক্ষা উত্তম।
সে যদি এমতাবস্থায় মারা যায়, তাহলে সে যে আমল করার মধ্যে রত ছিল তার প্রতিদান অব্যাহত থাকবে, তার রিযিক সরবরাহ করা হবে এবং তাকে ফাত্তান থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।”
এটাও একদিন প্রহরা দেওয়ার সাওয়াব।
ফাত্তান থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে মানে হল মুনকার ও নাকীর তথা কবরের প্রশ্ন থেকে নিরাপদে রাখা হবে।
ইমাম আবু দাউদ রহ: তার সুনানে ফুযালা ইবনে উবায়দ থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা: বলেন,
প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আমল বন্ধ হয়ে যায়, একমাত্র আল্লাহর রাস্তায় প্রহরা দানকারী ব্যতিত। কারণ তার আমলগুলো তার জন্য বৃদ্ধি পেতে থাকবে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এবং তাকে কবরের ফাত্তান থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
এখানে ইমাম কুরতুবী রহ: এর খুবই সুক্ষè একটি কথা: ইমাম কুরতুবী রহ: বলেন,
এ দুটি হাদিস থেকে এই দলীল পাওয়া যায় যে, রিবাত ঐ সকল আমলগুলোর মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ, যেগুলোর সাওয়াব মুত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। অনেক আমলই রয়েছে, যেগুলোর সাওয়াব মানুষের মৃত্যুর পরও জারি থাকবে। যেমন সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম, যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হয় এবং সন্তান।
যেমন আবু হুরায়রা রা: এর হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন,
যখন মানুষ মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল জারি থাকে: সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান।
এস্থানে ইমাম কুরতুবি রহ: বলেন,
রিবাত হল এসবগুলো থেকে উত্তম। কারণ সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান, যে তার পিতামাতার জন্য দু’আ করে, তা শেষ হয়ে যায় উক্ত সদকা শেষ হয়ে যাওয়ার দ্বারা, ইলম নষ্ট হয়ে যাওয়ার দ্বারা এবং সন্তানের মৃত্যু বরণ করার দ্বারা।
অর্থাৎ এগুলোও চলতে থাকবে, কিন্তু যখন এসব জিনিসগুলো শেষ হয়ে যাবে, তখন তার সাওয়াবও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু রিবাতের বিনিময় শেষ হবে না। তিনি বলেন, আর রিবাতের বিনিময় কিয়ামত পর্যন্ত বহুগুণ বৃদ্ধি করা হবে।
কারণ ‘বৃদ্ধি পাওয়া’র উত্তম অর্থ হল ‘দ্বিগুণ হওয়া।’ এটা কোন কারণের উপর নির্ভরশীল নয় যে, তা শেষ হয়ে গেলে এটাও শেষ হয়ে যাবে। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থায়ী অনুগ্রহ কিয়ামত পর্যন্ত।
ইমাম নববী রহ: বলেন (এখানে ইমাম নববী রহ: এর খুবই সূক্ষ কথা), তিনি বলেন-
এটা প্রহরাদানকারীর জন্য প্রকাশ্য মর্যাদা। তার মৃত্যুর পর তার আমল জারি থাকা তারই বিশেষ মর্যাদা, যে ব্যাপারে কেউ তার সমকক্ষ নেই।
যেমনটা ইমাম নববী রহ: বলেছেন।
হাদিস অনেক রয়েছে। রিবাতের ফযীলত অনেক বেশি। সালাফ রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আযমাইন রিবাত ও জিহাদের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। বিশেষত: রিবাতের প্রতি।
উদাহরণস্বরূপ আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: শামে রিবাত করেছেন। ইমাম শাফি রহ: ইস্কান্দারিয়ায় রিবাত করেছেন। সে সময় এটা সীমান্ত অঞ্চল ছিল।
ইবনে তাইমিয়া রহ: এখানে সামষ্টিকভাবে উল্লেখ করেন, তিনি তার আল ফাতাওয়া আল কুবরায় বলেন:
জিহাদ ও রিবাতের ফযীলত অনেক বেশি। একারণে পূর্বে নেককার মুমিনগণ সীমান্ত এলাকায় রিবাত করতেন।
যেমন ইমাম আওযায়ী, ইসহাক আলফিযারী, মাখলাদ ইবনে হুসাইন, ইবরাহীম ইবনে আদহাম, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, রাইফ আলমুআশী, ইউসুফ ইবনে আসবাত সহ অন্যান্য ইমামগণ।
তারা শামের সীমান্তে অঞ্চলগুলোতে রিবাত করতেন। তাদের কেউ কেউ খুরাসান, ইরাক ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে শামের সীমান্ত অঞ্চল আসতেন রিবাতের জন্য। কারণ তখন শামবাসী নাসারাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত।
একারণেই সেসময়ের ইলম ও ফিকহের কিতাবসমূহে তারতুস এলাকার আলোচনা অনেক বেশি এসেছে। কারণ উক্ত এলাকা মুসলমানদেরকে উত্তেজিত করে রাখত।
যার ফলে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল ইমাম সিবতী ও অন্যান্য আলেম মাশায়েখগন সেখানে রিবাতের জন্য যেতেন। উলামায়ে কেরাম বলেন এ সময়ের দিকেই খলীফা মামুন ইন্তেকাল করেন।
মোটকথা, জিহাদ ও রিবাতের মর্যাদা অনেক বড়। নেককার গণ তথা মুমনিগণ ও সালাফ রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আযমাইন জিহাদ ও রিবাতের ব্যাপারে তীব্র আকাঙ্খী ছিলেন।
আর রিবাতের মধ্যে এত অধিক সওয়াব থাকার কারণ হল, এতে অনেক কষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে এত বিনিময়, কারণ তাতে কষ্ট অনেক বেশি এবং তার ব্যাপারে এত উৎসাহ বাণী এসেছেও এই কষ্টের কারণেই।
শায়খ আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহ: তারবিয়াতুল জিহাদিয়াহ কিতাবে বলেন:
রিবাতের মধ্যে দৃঢ়পদ থাকা কারাগারে দৃঢ়পদ থাকা অপেক্ষা অনেক বেশি কঠিন। কারণ কারাগার এমন একটি অবস্থা, যার কোন সমাধান নেই এবং যার ব্যাপারে তার কোন কর্তৃত্ব নেই।
অথচ সংগঠনের ভিতর থাকাবস্থায় দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি তার ইচ্ছাধীন। যখন ইচ্ছা এটা ছেড়ে দিতে পারে, যখন ইচ্ছা তাতে অটল থাকতে পারে।
তাই সংঠনের ভিতর দৃঢ়পদ থাকা কঠিন ও তিক্ত। একারণেই কুরআন কারীমে রিবাতের আদেশটি দুই বার সবরের আদেশের পরে উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলছেন:
“হে মুমিনগণ! সবর অবলম্বন কর, মোকাবিলার সময় সবরের পরিচয় দাও, সীমান্ত রক্ষার জন্য দৃঢ় হও এবং আল্লাহকে ভয় কর। যাতে তোমরা সফলতা লাভ কর।”
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল আদম বলেন:
কিতালের বিষয়টি সহজ। যার জন্য আল্লাহ সহজ করেছেন। কিন্তু নফসের উপর কঠিন ও কষ্টকর বিষয় হল যুদ্ধ কবলিত এলাকায় যুদ্ধের অপেক্ষায় দৃঢ়পদ থাকা। আমরা এর খোজখবর নিয়েছে, তাতে তার ব্যতিক্রম পাইনি, যা আমরা উল্লেখ করলাম। অর্থাৎ এজন্য অভিজ্ঞ লোকের উপদেশ শোন।
তিনি আত তাযাকেরে উল্লেখ করেন,
তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞাতব্য: (এই জ্ঞাতব্যটির ব্যাপারে সজাগ হোন!) তিনি বলেন:
জেনে রাখুন! কিতাল হল মানবাত্মার কঠিন বিষয়কে সহজ করার, তাকে পরিশুদ্ধ করার এবং তাকে সবর ও কষ্টসহিষ্ণুতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার স্থান, মানুষের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঈমান বৃদ্ধি করার উর্বর যমীন এবং বরকতময় প্রাঙ্গন, যেখানে মানুষ নিজ সত্ত্বা থেকেও একাকী হয়ে যায়, ধ্বংসশীল দুনিয়ার আবর্জনা থেকে উর্ধ্বে উঠে যায়।
সুতরাং মানুষের উচিত এই স্থানগুলোর প্রতি তীব্র আকাঙ্খী হওয়া। আল্লাহ ই তাওফীক দানের মালিক।