শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি
ডাউনলোড
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
بدأ الإسلام غريبًا وسيعود غريبًا كمابدأ فطوبى للغرباء رواه مسلم
অর্থ: ইসলাম এসেছে নিঃসঙ্গ-অপরিচিতভাবে, অচিরেই আবার তা পূর্বের ন্যায় নিঃসঙ্গ-অপরিচিত হয়ে যাবে, সুসংবাদ (নিঃসঙ্গ-অপরিচিত) গুরাবাদের জন্যই। (মুসলিম)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে ঐ সকল লোকদের প্রশংসা করেছেন যারা অপরিচিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – طوبى ‘তুবা’ অর্থাৎ সুসংবাদ। আবার طوبى ‘তুবা’ নামে জান্নাতে একটি গাছও রয়েছে। অতএব সুসংবাদ এই গুরাবাদের জন্যই।
গুরাবার উদ্দেশ্য: গুরাবা দ্বারা তাদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে – যারা ওহী তথা কুরআন সুন্নাহকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে – যেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ আঁকড়ে ধরেছিলেন। এটাই ‘গুরাবা’ এর অর্থ। একাকী থাকা কিংবা বিরোধিতা করা, এটা গুরাবার অর্থ নয়। বরং গুরাবা অর্থ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই আদর্শের উপর ছিলেন তা আঁকড়ে ধরা। যেমনটি হাদিসে এসেছে: بدأ الإسلام غريبًا ( ইসলামের সূচনা হয়েছে গরীব তথা নিঃসঙ্গ-অপরিচিত অবস্থায়)। গুরাবারা হাদিসের এই আদর্শকেই আঁকড়ে ধরেছে, যে আদর্শের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন। সুতরাং غربة ‘গুরবাত’ হল, সত্যের জন্য মানুষ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া।
শেষ জামানায় বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে, মতভেদ বৃদ্ধি পাবে এবং বিদআ’ত বৃদ্ধি পাবে, এমনকি সুন্নাহ অপরিচিত হয়ে যাবে। সেই সাথে সত্যও অপরিচিত হয়ে যাবে। জমিনে প্রতিষ্ঠিত থাকবে বাতিল শক্তি – আর যা সত্যের অনুগামী হবে তা হবে প্রত্যাখ্যাত। غربة বা অপরিচিত বলতে এটাকেই বুঝানো উদ্দেশ্য। যার উপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রতিষ্ঠিত ছিলেন – আর তাদের এই আদর্শটাই এক সময় অপরিচিত হয়ে যাবে।
সুতরাং শেষ জামানার অপরিচিতি প্রথম জামানার অপরিচিতির সাথে মিলে যাবে। যে অবস্থার উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুরা ছিলেন, শেষ জমানায় অবস্থা আবার তেমনই হয়ে যাবে। যার ইঙ্গিত এই হাদিসে এসেছে:
بدأ الاسلام غريبا وسيعود غريبا كما بدأ فطوبي للغرباء رواه مسلم
অর্থ: ইসলাম এসেছে নিঃসঙ্গ-অপরিচিতভাবে, অচিরেই আবার তা পূর্বের ন্যায় নিঃসঙ্গ-অপরিচিত হয়ে যাবে, সুসংবাদ (নিঃসঙ্গ-অপরিচিত) গুরাবাদের জন্যই। (মুসলিম)
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল-আ’দম বলেন: হাদিসে নববীতে গুরাবাদের গুণাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গায় এর ব্যাপারে ইঙ্গিত এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরাবাদের সামষ্টিক গুণাবলী হাদিস শরীফে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, فهم النُّزّاع من القبائل অর্থাৎ, গুরাবা হল ঐ সমস্ত লোক যারা তাদের গোত্রের মধ্যে যোদ্ধা।
যেমনটি বিষয়ের শুরুতে ছিল, প্রত্যেক গোত্রের নেককারগণ একত্রিত হবেন। আর তারাই হল প্রত্যেক গোত্রের যোদ্ধাগণ। তারা এমন সব লোক যারা সুন্নাতে নববীর সাহায্যে মানুষের ফাসাদকৃত বিষয় সংশোধন করেন।
“মানুষের ফাসাদকৃত বিষয়কে সংশোধন করা” এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কাজটি যারা করেন, তারা হল নেককার, যাদের পরিমাণ মানুষের মাঝে খুবই কম সংখ্যক। আর এরাই হল নেককার এবং সংশোধনকারী। যারা তাদের নাফরমানি করে তাদের সংখ্যা বেশি, আর যারা তাদের অনুসরণ করে তাদের সংখ্যা খুব কম। তারা হল ঐ সমস্ত লোক, যারা তাদের দ্বীন(হেফাযতের জন্য) তা নিয়ে পলিয়ে যায়। তারা কিয়ামতের দিন ঈসা ইবনে মারিয়াম আলাইহিস সালাম এর নিকট একত্রিত হবে।
এই হল হাদিসের সারমর্ম। এমনটাই ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম রহ. তার কিতাব “মাদারিজুস সালিকীন” এ গুরবাত বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। গুরাবাদের সকল গুণাবলী সেখানে তিনি একত্রিত করেছেন এবং এ বিষয়ে আলোচনাও করেছেন।
মোটকথা ঐ সকল গুণাবলী যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবাদের মাঝে ছিল সেগুলোকে আঁকড়ে ধরাই হল ওহীকে আঁকড়ে ধরা। আল্লাহর কালাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরাই হল গুরবাত বা অপরিচিতি।
এসকল গুরাবাদের গুণাবলী এবং মর্যাদা সেদিন প্রকাশ পাবে, যেদিন মানুষের অবস্থা শোচনীয় ও করুণ হবে। সমাজে খারাবী বৃদ্ধি পাবে, চারিত্রিক অধঃপতন ঘটবে, নেককার মানুষ হ্রাস পাবে। ফলে তুমি এমন সাহায্যকারী কমই দেখবে, যারা সত্যের উপর থেকে তোমাকে পথ দেখাবে। তাছাড়া সুন্নাহ শিক্ষাদানকারী থাকবেনা। ফলে তুমি এমন কাউকে দেখতে পাবেনা – যে তোমাকে সত্যের দিকে পথ দেখাবে – যার ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন।
অতঃপর উস্তাদ আল-আ’দম বলেন: এ জামানায় সবচেয়ে অধিক অপরিচিত ব্যক্তি হল মুজাহিদগণ। তারা নিজেদেরকে কুরবানি করেছে এবং নিজ জন্মভূমিকে ত্যাগ করেছে। প্রিয়জনদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে, নিজেদের স্বাদকে পরিত্যাগ করেছে। তারা জাহালত বা অজ্ঞতা এবং তার ত্রুটি থেকে ঊর্ধ্বে উঠে এসেছে, ফলে তারা তাগুতকে তোষামোদ করেনা। তারা তাদের দ্বীনের মধ্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ কাফেরদেরকে সুযোগ দেন না এবং প্রবৃত্তির অনুসারীদের প্রতি নমনীয়ও হন না। বিদআ’তিদের প্রতি কোমল হন না বরং তারা তাদের নবীর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তারা সাহাবাদের নীতির উপর চলেন। তাছাড়া তারা সাহাবাদের পন্থাকে পরিত্যাগ করেননি – যে পথ তাদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিবে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:
{وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيل اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ * وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ * فَآتَاهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآخِرَةِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ}
অর্থ: এবং কত নবী যুদ্ধ করেছেন, এবং তাদের সাথে বহু আল্লাহ ওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন। একথা ব্যতীত তাদের আর কোন কথা ছিলনা যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ এবং আমাদের কাজে সীমালঙ্ঘন তুমি ক্ষমা কর, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখ এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে পার্থিব পুরস্কার এবং পরকালের উত্তম পুরস্কার দান করেন। আল্লাহ সৎকর্মপরায়নদেরকে ভালবাসেন। (সূরা আলে ইমরান – ১৪৬-১৪৮)
ইহা হল শেষ জামানার গুরবাত বা অপরিচিত সম্পর্কে আলোচনা। আমরা আল্লাহ তা’আলার নিকট দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের খাতেমা বিল-খাইর নসিব করেন এবং তিনি যেন আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় মৃত্যু দান করেন। আমীন।
والسلام عليكم ورحمة الله وبركاته