মানুষের সাথে উদারতা

শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি

ডাউনলোড

ইমাম বুখারী রহ. তার রচিত কিতাব সহীহ বুখারীতে, باب المُداراة مع الناس তথা ‘মানুষের সাথে উদারতা বা নম্রতা’ নামে একটি শিরোনাম (অধ্যায়) রেখেছেন।

সেখানে তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত – এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট প্রবেশ করার অনুমতি চাইল। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:

ائذنوا له فبئس ابن العشيرة -أو قال بئس أخو العشيرة

অর্থ:“তাকে অনুমতি দাও। সে তার বংশের কতই না নিকৃষ্ট সন্তান”। অথবা বলেছেন, “সে তার গোত্রের কতই না নিকৃষ্টতম ভাই”।

অতঃপর লোকটি যখন প্রবেশ করল, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে নম্র-ভাবে কথাবার্তা বললেন। (আয়েশা রা. বলেছেন) আমি বললাম, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি তার সম্পর্কে যা বলার তা তো বলেছেন। এখন দেখি আপনি তার সাথে নম্র-ভাবে কথা বলছেন”? তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:

أي عائشة، إن شر الناس منزلة عند الله من تركه -أو قال- من ودعه الناس اتقاء فُحْشه الحديث أخرجه البخاري.

অর্থ: “হে আয়েশা! আল্লাহর কাছে মর্যাদায় নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি, যার অশালীন আচরণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তার সংশ্রব ত্যাগ করে”। (বুখারী)

মানুষের সাথে উদারতা বা নম্র আচরণের ক্ষেত্রে এ হাদিসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ব্যক্তিটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসেছিল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চরিত্র খারাপ বলে উল্লেখ করেছেন যে – এটাই তার চরিত্র, এটাই তার চলাফেরা এবং এটাই তার স্বভাব(সে তার গোত্রের নিকৃষ্টতম ভাই)। কিন্তু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আচরণ কি ছিল?

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কর্মই হল ইসলামের পথ, তার চরিত্র হল কুরআন। তার স্বভাব – কোন ঝগড়াটে বা বিরোধীর স্বভাব নয়। সে তার গোত্রের নিকৃষ্টতম ভাই, কিন্তু আমি কি আমার চরিত্রের নই? তাঁর (রসূলের) আমলই ইসলামী শিষ্টাচার। একারণেই উলামায়ে কেরাম একে আল-মুদারাত বলে নামকরণ করেছন। মুদারাত কি জিনিস?

মুদারাত হল – অজ্ঞ ব্যক্তিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য নম্র ব্যবহার করা এবং ফা-সেকের সাথে কোমল আচরণ করা। তবে মুদাহানাহ এর বিপরীত। মুদাহানাহ হল – ফা-সেকের ফিসক এর ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন –

وَدُّواْ لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُونَ

অর্থ:“ তারা চায় যদি আপনি নমনীয় হন, তবে তারাও নমনীয় হবে”। [ সুরা কালাম ৬৮:৯ ]

এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য হল – ”মুদারাত” বলা হয়, মানুষের সাথে কোমল আচরণ করা। আর “মুদাহানাহ” হল, ব্যক্তি যদি ভুলের উপর থাকে অথবা জুলুম, সীমালঙ্ঘন, ফিসক অথবা পাপাচারে লিপ্ত থাকে তবুও তার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা।

আরও সহজ ভাবে এই দু’টির পরিচয় বলা যায়, তা হল-

মুদারাত: দ্বীনের হেফাজতের জন্য দুনিয়াকে পরিত্যাগ করা কিংবা দ্বীনের জন্য অথবা দুনিয়াবি কোন কল্যালের জন্য দুনিয়াকে বিসর্জন দেয়াই হল মুদারাত।

মুদাহানাহ: আর মুদাহানাহ হল – দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য দ্বীনকে পরিত্যাগ করা।

দুটির হুকুম: প্রথমটি তথা মুদারাত জায়েজ আর মুদাহানাহ হারাম।

এক্ষেত্রে উস্তাদ আবদুল্লাহ আলআ’দম বলেন: “তারাই হল উত্তম মানুষ, যারা এ সুন্নাহ (তথা মুদারাত – অজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের সাথে কোমল ও নম্র ব্যাবহার করা) নিয়ে এগিয়ে চলে। মুজাহিদগণ যারা আল্লাহর রাহে দাওয়াত এবং জিহাদ করতে গিয়ে এর সম্মুখীন হন। তখন মুদারাতের এ সুন্নাহ নিয়ে যে দাঁড়াবে, নিঃসন্দেহে সে কল্যাণ প্রতিষ্ঠাকারী এবং অনিষ্ট প্রতিহত-কারী। এর দ্বারা মানুষের অন্তরে মুহাব্বাত পয়দা হয় এবং তাদেরকে সত্যের দিকে আকর্ষণ করে। তারাই সফলকাম যারা এই গুণ অর্জন করে আল্লাহর দেয়া তাওফিক অনুযায়ী মুসলমানদের ভালবাসতে পারবে এমন সময়ে, যখন মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের অনুসারী – কথায় এবং কাজের ক্ষেত্রে খুব কম পাওয়া যাবে। আর আল্লাহ তা’আলাই তাওফিক দানকারী”।

শাইখ আবু মুহাম্মদ আল-মাকদিসী হাফিজাহুল্লাহ তাঁর কিতাব ”আর রিসালাতুস সালাছিনিয়্যা”তে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন যে, আল্লাহর দুশমনদের সাথে শুধু উত্তম আচরণের কারণে যারা মুসলমানদেরকে কাফের বলে, তারা এ বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছে। তারা ‘মুদারাত’ এবং ‘মুদাহানাহ’ এর মাঝে পার্থক্য করতে পারেনি। এর ফলে তারা মুদারাত কে বানিয়ে ফেলেছে কুফরী, এবং মুদাহানাহ যা মূলত গুনাহের কাজ – তাকেও বানিয়েছে কুফরী”।

তিনি আরও বলেন. “তুমি দেখবে, তাদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছে যারা অন্যদেরকে দোষারোপ করে বিদআ’তী বলে। তারা নিজেদের বিরোধীদেরকে এমন বিষয়ে কাফের বলে, যা দ্বীনের মধ্যে কুফরীর কারণ নয়। তাদের ধারণামতে এটা কুফরী – ব্যাস, এর উপর ভিত্তি করেই তারা কুফরীর হুকুম লাগিয়ে দেয়। অথচ মুদারাতের  মত প্রশংসনীয় কিছু শরিয়ত সম্মত কাজও যে রয়েছে, এটা তদের দুর্বল আকল বুঝতেও সক্ষম নয়”।

শাইখ মাকদিসী হাফিজাহুল্লাহ আরও বলেন, “তারা এমন ব্যক্তিকে তাকফীর করে(কাফের বলে) – যে কাফেরদের সাথে বসে, আসা-যাওয়া করে এবং তাদের সাথে নম্র-ভাবে বা হাসিমুখে কথা বলে। আর যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে, হাসি-ঠাট্টা করে এবং নম্রতা দেখায় তাদেরকেও কাফের বলে।

বাস্তব কথা হল – এসব গুলো বরাবর করা জায়েজ নয় এবং শুধু একারণে তাকফির করাও জায়েজ নয়। এগুলোর মধ্যে কিছু কাজ শরিয়ত সম্মত, যেগুলোর কথা মাত্র উল্লেখ করেছি”।

শাইখ যে কাজগুলোর উল্লেখ করেছেন তম্মধ্যে শরিয়ত সম্মত হল – কাফেরের সাথে বসা এবং দাওয়াতের উদ্দেশ্যে তাদের কাছে আসা-যাওয়া করা, দাওয়াতের উদ্দেশ্যে তাদের সাথে কথা-বার্তা ও তর্কের ক্ষেত্রে নম্রতা অবলম্বন করা। দাওয়াতের জন্য এটাই উত্তম পদ্ধতি ও কৌশল।

তিনি আরও বলেন, “আমরা তোমার সামনে সহীহ বুখারীর একটি ঘটনা আলোচনা করেছি। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইয়াহু-দী বালককে তার অসুস্থাবস্থায় দেখতে গেলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে গিয়ে বালকটিকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এরপর বালকটি ইসলাম গ্রহণ করে।

সুতরাং মুসলমানদের জন্য অনুমতি আছে যে, সে কোন কাফেরকে অসুস্থাবস্থায় দেখতে যাবে এবং তার সাথে উত্তম আচরণ করবে। এ উদ্দেশ্যে যে, সে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। তো তার এ যাওয়াটা জায়েজ হয়ে গেল।

মোটকথা মুদারাত (উদারতা বা নম্র আচরণ) এটা সুন্নাহ এবং তা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আখলাক। আর মুদাহানাহ- এটা অ-পছন্দনীয় এবং পরিত্যজ্য।

সুতরাং মুদারাত হল ইবাদত, যা মানুষ যথোপযুক্ত সময়ে করবে। কঠোরতার জন্যও সময় রয়েছে এবং নম্রতার জন্যও সময় রয়েছে। আর এটাই হল হেকমত বা কৌশল যে, প্রতিটি জিনিসকে তার যথাস্থানে রাখা।

আমরা আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের কথা এবং কাজে হেকমত দান করেন । আমীন।

جزاكم الله خيرًا

(আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।)

(Visited 211 times, 1 visits today)