মতবিরোধের ক্ষেত্রে আদব

শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি

ডাউনলোড

মত-বিরোধপূর্ণ বিষয়ে করনীয়: মতবিরোধ এবং দ্বন্দ্বের সময় কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা। মতানৈক্য ও দ্বন্দ্ব বা বিতর্কের বিষয়টিকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরানো।

অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। সুন্নতে রসূল এবং আল্লাহর কিতাব দিয়ে যারা মত-বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ফয়সালা করেন তারা হলেন, আহলে ইলম উলামায়ে কেরাম।

সুতরাং মত-বিরোধপূর্ণ বিষয়টি আহলে ইলম উলামায়ে কেরামের নিকটও নিয়ে যেতে হবে।

যখন কুরআন ও সুন্নাহর হুকুমের ব্যাপারে কোন মতভেদ দেখা দিবে, তখন কুরআন-সুন্নাহর ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য, ন্যায়পরায়ণ ও দ্বীনদার আলেমদের নিকট তা নিয়ে যেতে হবে। মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে এটাই হল মূলনীতি।

এমনিতেই মানুষকে কিতাবুল্লাহ, সুন্নতে রসূল এবং কুরআন-সুন্নাহর নির্ভরযোগ্য, কল্যাণকামী, মর্যাদার অধিকারী ও দ্বীনদার আলেমদের নিকট যেতে হয়। প্রথমত এটা একটি সর্বসম্মত প্রসিদ্ধ বিষয়, কিন্তু যদি মতানৈক্যের সময় হয়, তখন এ শিষ্টাচার আবশ্যকীয় হয়ে যায়। উত্তম চরিত্র জীবনের একটি সাধারণ বিষয় কিন্তু মতানৈক্যের সময় তা অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

মুনাফিকদের অবস্থা হল, তারা যখন ঝগড়া করে তখন মিথ্যা কথা বলে। আমরা আল্লাহ তা’আলার নিকট নেফাক থেকে পনাহ চাই। নেফাক এমন নিকৃষ্ট স্বভাব যে, যখন সে বাদানুবাদ করে তখন সে মিথ্যা বলে। মুমিন এমনটা করেনা, মুত্তাকী মু’মিন আনন্দ এবং রাগ সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলে।

সুতরাং মতভেদের সময় সবধরনের আদাব-শিষ্টাচার থাকতে হবে। যখন আমরা পরস্পরে মতভেদ করব তখন আদাব-শিষ্টাচারের সমাগম ঘটবে, আমরা এর দ্বারা সজ্জিত হব এবং নিজেদের জন্য আবশ্যক করে নিব। আমিও এই গুণটি আমার জন্য আবশ্যক করে নিব।

মত-বিরোধপূর্ণ বিষয়ের কিছু আদাব বা শিষ্টাচার

প্রথম শিষ্টাচার: (মতভেদ-পূর্ণ বিষয়ে এই মনোভাব রাখা যে, সবকিছু) একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্যই। নিজ মতামতের ব্যাপারে গোঁড়ামি না করা, কেননা উদ্দেশ্য তো আমি আল্লাহ তা’আলার হুকুম কি সেটা জানা। তুমি কি আল্লাহ তা’আলার জন্য ইবাদত করছ? তুমি কি আল্লাহ তা’আলার জন্যই আমল করছ?

(উত্তর হল) আমি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি চাই এবং পরকাল চাই। এক্ষেত্রে হক্ব বিষয়টি চাই আমার চাওয়া অনুযায়ী হোক অথবা না হোক মেনে নিতে হবে। কেননা কখনো শরিয়তের নির্দেশ এমন প্রতিষ্ঠিত নির্দেশ হয়ে থাকে যা আমার মতের বিরোধী হয়। অথবা এমন প্রতিষ্ঠিত বিধান যা পালণের দ্বারা জান্নাত লাভেরও কারণ হয়ে থাকে যদিও তা আমার মতের বিরোধী। কখনো যা সহজ এবং ইচ্ছা করা হয়েছে তা ভিন্ন অন্য কিছুতে সমাধান থাকে। তাই এ বিষয়ে আমি যে শিষ্টাচার পোষণ করি, তা হল সবকিছু হবে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই। মতামতের ক্ষেত্রে নিজের মতের উপর কঠোরতা, গোঁড়ামি ও পক্ষ্পাতিত্ব না করা চাই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

দ্বিতীয় শিষ্টাচার: তর্কের সময় নম্র কথা বলা, কথায় নম্রতা অবলম্বন করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

অর্থ: তোমরা মানুষের সাথে উত্তম কথা বল। [সূরা বাকারা ২:৮৩]

এব্যাপারে ইমাম কুরতুবী রহ. এর একটি অত্যন্ত সুক্ষ্ম কথা রয়েছে। তিনি তার তাফসীর গ্রন্থে বলেছেন, সকলের জন্য উচিত মানুষের সাথে নম্রভাবে কথা বলা। হাস্যজ্জল চেহারায় মিলিত হওয়া, চাই সে নেককার হউক কিংবা বদকার, সুন্নি হউক বা বিদআতি হউক। তবে মুদাহানাহ ব্যতীত অর্থাৎ তার কাজে সন্তুষ্ট হওয়া ব্যতীত। এবং এমন কথা ব্যতীত যা দ্বারা সে মনে করে যে, তুমি তার মতের উপর সন্তুষ্ট।

উত্তম চরিত্র হবে, তবে অবশ্যই সত্যের উপর থেকে। কেননা আল্লাহ তা’আলা মূসা ও হরুন আলাইহিস সালামকে বলেছেন:

فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا

অর্থ: তোমরা তার সাথে নম্রতার সাথে কথা বল। [সূরা ত্বা-হা ২০:৪৪]

অর্থাৎ ফেরআউনের সাথে নরম ভাষায় কথা বল। আল্লাহ তা’আলা মূসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিয়েছেন ফেরআউনের সাথে নম্রভাবে কথা বলার জন্য।

অথচ কোন বক্তা কিংবা উপদেশ দাতা মূসা ও হারুন আলাইহিস সালাম থেকে উত্তম নয় অথবা যাদের পরস্পরে মতভেদ হয়েছে তারাও মূসা ও হারুন আলাইহিস সালাম থেকে উত্তম নয়। আর পাপাচারীদের মধ্য থেকে ফেরআউনের চেয়ে নিকৃষ্টও কেউ নেই। অথচ আল্লাহ তা’আলা তার সাথে নম্র কথা বলতে আদেশ করেছেন।

তালহা ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আ’তাকে বললাম আমার কাছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ একত্রিত হয়। কিন্তু আমার মাঝে রয়েছে কঠোরতা, ফলে আমি তাদেরকে কিছু কঠিন কথা বলে দেই, এর জওয়াবে তিনি আমাকে বললেন তুমি এমনটা করোনা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

মানুষের সাথে উত্তম কথা বল। [সূরা বাকারা ২:৮৩]

এটা হল দ্বিতীয় শিষ্টাচার।

তৃতীয় শিষ্টাচার: তৃতীয় আদব হচ্ছে, (অন্যের ব্যাপারে) সু-ধারণা পোষণ করা এবং তার কথাকে উত্তম ব্যাখ্যার দিকে ফিরানো। সত্য তো সত্যই আর মিথ্যা তো মিথ্যাই। কারো হস্তক্ষেপ বা মন্তব্য এটা তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ বা মন্তব্য। কারো ভুল হস্তক্ষেপ বা মন্তব্যের ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিব যে, হতে পারে তার কোন (শরীয়তসম্মত কারণ বা) ওজর রয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উত্তম ধারণা যদি তোমাকে ক্ষতির সম্মুখীন করে, তাহলেও কি তুমি তার প্রতি উত্তম ধারণা করবে?!

হ্যাঁ, তবে যে হস্তক্ষেপ বা মন্তব্য সহীহ নয় এবং ভুল থেকেও খালি নয়, তা অবশ্যই ভুল হবে। কিন্তু হতে পারে তার কাছে এটার এমন কোন বুঝ রয়েছে বা এমন কোন ভালো আশায় বলেছে কিংবা তার কাছে এটির এমন কোন ফলাফল রয়েছে, যা তোমার ধারণাকে পালটিয়ে সু-ধারণায় পরিণত করবে ভুল থাকার পরও। এক্ষেত্রে ভুল ঠিকই থাকবে কিন্তু মুসলমান সম্পর্কে তোমার ধারণা তো ভাল থাকল।

চতুর্থ শিষ্টাচার: মতভেদ চলাকালীন সময়ে কথার আওয়াজকে উঁচু না করা, অর্থাৎ এটা এমন স্বভাব যা সুদৃঢ় করা ও পরিচর্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজেকে এ স্বভাবের প্রতি সর্বাপেক্ষা বেশি মুখাপেক্ষী মনে করি। মোটকথা মতভেদের সময় আওয়াজকে উঁচু না করাটাই আদব।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:

وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ

আপনি আপনার চলার মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করুন, এবং কণ্ঠস্বর নিচু করুন। [সূরা লুকমান ৩১:১৯]

অতঃপর আল্লাহ তায়ালা উঁচু আওয়াজের নিকৃষ্টতা বর্ণনা করে বলেন:

إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

অর্থ:নিশ্চয়ই আওয়াজের মধ্যে গাদার আওয়াজই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।[সূরা লুকমান ৩১:১৯]

সুতরাং উঁচু আওয়াজ শিষ্টাচার নয়। হক্ব ও সত্য বিষয়গুলো তার প্রমাণ এবং শক্তির দিক থেকে সুস্পষ্ট, তাতে এমন কোন গুজামিল নেই যে, বলবে মাসআলাটি এমন এমন হতে পারে। এক্ষেত্রে হক্ব ও সত্য বিষয়গুলো বাস্তবে ঘটিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমরা আমাদের সাধ্যমত (আদবের সাথে) হক্ব বিষয়গুলো তুলে ধরব। স্বভাবত এ সকল শিষ্টাচার অনুশীলনের মুখাপেক্ষী আমরা সকলেই। তাই নিজেরা আগে তার উপর অনুশীলন করি। হয়তো প্রথমবার আমি ভুল করব এবং দ্বিতীয়বার ভুল করব, যা চিকিৎসা ও অনুসরণের মুখাপেক্ষী। তাই আমার নিজের জন্যও এ সকল আবশ্যকীয় শিষ্টাচার জরুরী মনে করি।

পঞ্চম শিষ্টাচার: (পঞ্চম আদব হচ্ছে) চলমান এবং গ্রহণযোগ্য মতভেদের ক্ষেত্রে আমাদের একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়া। “হ্যাঁ তুমি এক মতের উপর আছ, অপর দিকে আরেকটি গ্রহণযোগ্য অভিমত রয়েছে, যদিও আমি তার বিরোধী”, “তো তোমার মতটা যদিও সঠিক কিন্তু আমি যা বলেছি তা কি বাতিল”?

এটাই চলমান মতভেদ, কেননা এভাবেই মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। (এক্ষেত্রে আদব হল) আমি যা বলেছি তা বাতিল নয় কিন্তু আমি মনে করি মতামতটি তোমার মত থেকে উত্তম বা সঠিক অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এ মতামত যা আমি ধারণা করছি যে, তোমারটা বাতিল আর আমারটা সহিহ, এটা আদব নয়। সুতরাং চলমান মতানৈক্যের ক্ষেত্রে আমাদের একে অপরকে স্বীকার করে নেয়া, এটাই আদব।

ইমাম ইউসুফ সাদাফী রহ. বলেন, এ কথাটা শ্রবণ কর! তিনি বলেন, আমি ইমাম শাফি রহ. থেকে বড় কোন জ্ঞানী দেখিনি। একদিন একটি মাসআলা নিয়ে তাঁর সাথে আমি মতভেদ করলাম। অতঃপর আমরা একজন আরেকজন থেকে পৃথক হয়ে গেলাম। পুনরায় তার সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি আমার হাত ধরলেন, অতঃপর বললেন, হে আবু মূসা! এটা কি সত্য বিষয় নয় যে, আমরা একে অপরের ভাই – যদিও কোন একটি মাসআলায় আমরা একমত হতে পারিনি? আমরা একে অপরের সাথী এবং ভাই, যদিও আমরা দু একটি মাসআলায় মতভেদ করে থাকি, এটা আমাদের ভ্রাতৃত্বের কোন ক্ষতি করবেনা।

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, এটাই এই ইমামের পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রাজ্ঞ ফকীহ হওয়ার প্রমাণ। গবেষকগণ সর্বদাই পরস্পর মতভেদ করে থাকেন।

এ পাঁচ প্রকার শিষ্টাচার আমরা যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করব। এগুলো দ্বারা নিজেদেরকে সজ্জিত করার চেষ্টা করব এবং নিজেদেরকেও এসকল আদবের উপর পরিচালনা করার চেষ্টা করব।

আমরা আল্লাহ তা’আলার নিকট দু’আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার তাওফিক দান করেন, এবং আমাদের অপরাধগুলোকে ক্ষমা করেন। আমীন।

والسلام عليكم ورحمة الله وبركاته

(Visited 367 times, 1 visits today)