তাফসিরনীতি – ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ

ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কারের ইতিহাসে ইবনু তাইমিয়াহ্ খুব পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই। ‘How Tafsir is Performed?’-র বাঙলানুবাদ হচ্ছে ‘তাফসিরনীতি’।

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

তাফসির নীতি

(How Tafsir is Performed?-র বাঙলানুবাদ)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ্

 

কথামুখ

بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কারের ইতিহাসে ইবনু তাইমিয়াহ খুব পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই।

Islamhouse.com থেকে প্রকাশিত ‘How Tafsir is Performed?’-র বাঙলানুবাদ হচ্ছে তাফসিরনীতি

 

তাফসির নীতি

 

তাফসির করার সবচে বিশুদ্ধ পদ্ধতিটি কী তা যদি তুমি জানতে চাও, তবে এর উত্তর হলো- সবচে বিশুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআনের মাধ্যমে কুরআনকে ব্যাখ্যা করা। কারণ, কুরআন কোনো এক স্থানে যা ইঙ্গিত করে, অন্যস্থানে তা ব্যাখ্যা করা থাকে এবং কোনো এক নির্দিষ্ট ঘটনার ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা অন্যস্থানে বিস্তারিত বিবৃত থাকে। কিন্তু এটি যদি কোনো ক্ষেত্রে তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে তোমার উচিত সুন্নাহর দিকে মনোনিবেশ করা, আর সুন্নাহই কুরআনকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইদ্রিস আশ্শাফিয়ি বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ যা কিছু বলেছেন, তা কুরআন থেকেই আহরিত।’

আল্লাহ বলেন–

إِنَّآ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ بِٱلْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُۚ وَلَا تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا

‘নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসংবলিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করতে পারো। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে তর্ক করো না।’[1]

وَأَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

‘আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে সেই সব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।’[2]

وَمَآ أَنزَلْنَا عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِى ٱخْتَلَفُوا۟ فِيهِۙ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

‘আপনার কাছে তো গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এজন্য যে, তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে তাদের জন্য তা স্পষ্ট করবেন এবং যাতে এটি ইমানদারদের জন্য হিদায়াত ও রহমতের অবলম্বন হয়।’[3]

এ কারণেই নবি বলেন,

‘জেনে রেখো, আমাকে কুরআন ও এর মতো কিছু দেয়া হয়েছে।’[4]

অর্থাৎ সুন্নাহ। প্রকৃতপক্ষে, কুরআনের মতো সুন্নাহও ওয়াহির মাধ্যমে তাঁকে দেয়া হয়েছে। পার্থক্য এতোটুকুই- তা কুরআনের মতো করে তাঁর সামনে তিলাওয়াত করা হয়নি। ইমাম আশ্ শাফিয়ি ও অন্যান্য আলিমগণ এর সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তি ও আলোচনা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এগুলো উদ্ধৃত করার স্থান এটি নয়।[5]

কুরআন বুঝার জন্য তোমার উচিত প্রথমে স্বয়ং কুরআনকে দেখা, যদি তা তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। নবি মুয়াজ (رضي الله عنه)-কে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কীভাবে বিচার করবে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি কিতাবুল্লাহ অনুযায়ী বিচার করবো।’ নবি প্রশ্ন করলেন, ‘যদি তুমি তাতে কিছু না পাও, তখন কী করবে?’ তিনি বললেন, ‘আমি নবি – র সুন্নাহর সহায়তা নেবো।’ নবি আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘যদি তুমি এতেও তা না পাও, তখন কী করবে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি ইজতিহাদ করবো।’ এ কথা শুনে নবি মুয়াজ-র কাঁধে মৃদু আঘাত করলেন এবং বললেন, ‘প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর রাসুলের দূতকে পথপ্রদর্শন করেছেন, যা তাঁর রাসুলকে সন্তুষ্ট করলো।’[6]

যদি কোনো ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তখন সাহাবিদের কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করো। এজন্য যে, তাঁরা কুরআন বেশি জানেন, তাঁরা এর নাযিল হওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর নাযিল হবার পরিস্থিতি পার করেছেন। কেন ও কোন্ পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছে। তারা জানেন এবং সম্পূর্ণভাবে বুঝেন। বিশেষভাবে এটি আলিমগণ ও আমিরদের ক্ষেত্রে সত্য, যেমন পূণ্যবান চার খলিফা ও আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনু জারির আত্ তাবারি বলেন, ‘আবু কুরাইব আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, ‘জাবির ইবনু নুহ্ আমাদের জানিয়েছেন,

‘মারসুক থেকে আবু দুহা, আবু দুহা থেকে আল্আমাশ আমাদের জানিয়েছেন যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ বলেছেন, ‘যিনি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, তাঁর শপথ করে বলছি, কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই, যে আমি জানি না তা কোন প্রেক্ষিতে কোন্ স্থানে নাযিল হয়েছিল। কুরআন সম্পর্কে আমার চে’ বেশি জানে এবং আমি তার কাছে পৌঁছুতে পারি- এমন কেউ আছে যদি আমি জানতে পারতাম, তবে নিশ্চয়ই আমি তাকে দেখতে যেতাম।”[7]

আবু ওয়ালি থেকে আল্আমাশ আরও বর্ণনা করেন- ইবনু মাস্ য়ুদ বলেছেন, ‘আমাদের মাঝে কেউ যদি কুরআনের দশ আয়াত শিখতেন, তিনি এ আয়াতগুলোর অর্থ ও বিধান না জানা পর্যন্ত সামনে বাড়তেন না।’ আরেকজন বড় আলিম হলেন আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস رضي الله عنه, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর রাসুলের ভাতিজা এবং কুরআনের মুফাসির। আল্লাহর রাসুলের দুয়ার কারণে তিনি এই মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আল্লাহর রাসুল দুয়া করেন, ‘ও আল্লাহ! তাকে ইসলামের জ্ঞান দান করুন এবং কুরআনের মর্মার্থ শিক্ষা দিন।[8]

মুহাম্মাদ ইবনু বাশার আমাদের বর্ণনা করেন- ওয়াকি জানিয়েছেন যে, মারসুক থেকে মুসলিম (ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা), মুসলিম থেকে আমাশ, আমাশ থেকে সুয়িয়ান আমাদের জানিয়েছেন, আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ وما أنزلنا عليك বলেছেন, ‘কুরআনের অতুলনীয় একজন ব্যাখ্যাদাতা ইবনু আব্বাস!’ আল্ মাসরুক থেকে মুসলিম ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা, মুসলিম ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা থেকে আল্আমাশ, আল্আমাশ থেকে সুফ্য়িয়ান, সুফ্য়িয়ান থেকে ইসহাক আল্আজরাক, ইসহাক আল্আজরাক থেকে ইয়াহ্য়িয়ার মাধ্যমে ইবনু জারিফও এই হাদিসটি সামান্য ভিন্ন শব্দে- ‘ইবনু আব্বাস কুরআনের অতুলনীয় একজন ব্যাখ্যাদাতা!’-বর্ণনা করেন। আল্আমাশ থেকে জাফার ইবনু আওন, জাফার ইবনু আওন থেকে বুন্ দারের মাধ্যমেও তিনি এই হাদিসটি একই শব্দে বর্ণনা করেন। সুতরাং, ইবনু আব্বাস رضي الله عنه সম্পর্কে বলা কথাগুলো প্রকৃতপক্ষেই ইবনু মাস্ য়ুদ رضي الله عنه-র নিজের বলা কথা। ইবনু মাস্ য়ুদ رضي الله عنه মারা যান খুব সম্ভবত ৩৩ হিজরিতে। ইবনু আব্বাস رضي الله عنه তাঁর মৃত্যুর পর ছত্রিশটি বছর বেঁচে ছিলেন এবং ইসলামি জ্ঞান-কোষাগারে প্রচুর অবদান রেখে গেছেন তিনি।

আল্আমাশ আবু ওয়ালি থেকে বর্ণনা করেন- ইবনু আব্বাস رضي الله عنه আলি رضي الله عنه দ্বারা হাজ্জের আমির নিযুক্ত হন। তিনি একটি ভাষণ দেন এবং সূরা বাকারাহ্ থেকে পাঠ করেন, অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি সূরা নুহ থেকে পাঠ করেন। তিনি এই পাঠকৃত আয়াত এমনভাবে ব্যাখ্যা করলেন, যদি রুমান, তুর্কি ও দালামিরা তা শুনতো, তবে তারা ইসলাম গ্রহণ করে ফেলতো। এই কারণেই ইসমায়িল ইবনু আব্দির রহমান সুদ্দি তাঁর লিখিত তাফসিরের অধিকাংশ ব্যাখ্যাই এই দুজন আলিম- ইবনু মাস্ য়ুদ ও ইবনু আব্বাস رضي الله عنهم-এর থেকে নিয়েছেন।

——————————————————————

[1] সূরা আন্ নিসা ৪: ১০৫

[2] সূরা নাহ্ ল ১৬:৪৪

[3] সূরা নাহ্ ল-১৬: ৬৪

[4] আহমাদ, মুসনাদ, খন্ড:৪, ১৩১; আবু দায়ুদ, সুনান, সুন্নাহ্,

[5] আলোচনার জন্য দেখুন আশ্ শাফিয়ি, আর্ রিসালাহ

[6] এ হাদিসটি মুসনাদ ও সুনান সংগ্রহের হাদিসে ভালো সনদে বর্ণিত হয়েছে। (আহমাদ, মুসনাদ: দারিমি, সুনান, মুকাদ্দিমাহ, ৩০; তিরমিজি, সুনান, আহকাম, ; আবু দায়ুদ, সুনান, আক্ দিয়াহ্, ১১)

[7] ইবনুল কাসির, জামিয়ুল উসুল ফি আহাদিসির্ রসুল- ১৩৯২/১৯৭২, খন্ড: ৯, পৃ: ৪৮

[8] আহ্ মাদ, মুসনাদ খন্ড ১: ২৬৬, ৩১৪, ৩২৮, ৩৩৫