মুয়ালাত ও তাওয়াল্লির মাঝে পার্থক্য

শায়খ আলি আল খুদাইর

ডাউনলোড

সম্মানিত শাইখ আলি ইবনু খুদাইর আল-খুদাইর (فك الله أسره)  -কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:

“মুয়ালাত এবং তাওয়াল্লির মধ্যবর্তী সীমানা কোনটি? আর উভয়ের মাঝে পার্থক্য কীভাবে বুঝব?”

উত্তরে সম্মানিত শাইখ বলেন: “কুফফারদের সাথে তাওয়াল্লি করা হচ্ছে বড় কুফর (তথা কুফরে আকবার)[1], এবং এর মধ্যে কোনো তাফসিল নেই। আর এটি চার প্রকারের:

(১) কুফফারদের ধর্মের কারণে তাদের ভালোবাসা (মাহাব্বাহ)।[2]

যেমন, কেউ হয়তো গণতন্ত্রের কারণে গণতন্ত্রপন্থীদের ভালোবাসে। একইভাবে আইন প্রণয়নকারী সংসদ সদস্য, আধুনিকতাবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং তাদের সমপর্যায়ের লোকদের তাদের লক্ষ্য-উদেশ্য এবং বিশ্বাসের (আকীদাহ) কারণে ভালোবাসে। তাহলে এই ব্যক্তি তাওয়াল্লির কুফর করার মাধ্যমে কাফির হয়ে গেছে।

আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

“হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”[3]

কারণ, ‘ওয়ালি’র অর্থ হচ্ছে ‘মুহিব্ব’ (যে ভালোবাসে)। ইবনুল আসির (رحمه الله) তাঁর ‘আন-নিহায়াহ’ (৫/২২৮) গ্রন্থে এটি বলেছেন।

(২) সাহায্য (নুসরাহ) এবং সহায়তার (ই’আনাহ) মাধ্যমে তাওয়াল্লি।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে কুফফারদের সহায়তা করবে, সে একজন কাফির, মুরতাদ। সে তাদের মতোই, যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদি এবং নাসারা (খ্রিষ্টান)–দের সাহায্য করে ।

আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

“হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”[4]

এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে শাইখ নাসির আল-ফাহদ রচিত “আত-তিবইয়ান ফি কুফরি মান আ’আন আল-আম্রিকান” পড়তে পারেন[5]। কারণ, এ বিষয়ের উপর লিখিত বইগুলোর মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। আর, ইরজাগ্রস্তদের প্রতারণা কোনোভাবেই যেন আপনাদের বোকা বানাতে না পারে।[6]

(৩) মৈত্রী (তাহালুফ)-এর মাধ্যমে তাওয়াল্লি।

যে কুফফারদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে এবং বন্ধুত্বের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের সহায়তার জন্য অঙ্গীকার করে, যদিও সেই অঙ্গীকারকে কাজে রূপ না দেওয়া হয়, সেইসাথে তাদের সমর্থন করে এবং এ ব্যাপারে তাদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়, তাহলে এটা যেন তাদের মতো যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ نَافَقُوا يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِنْ قُوتِلْتُمْ لَنَنْصُرَنَّكُمْ

“আপনি (হে মুহাম্মাদ ﷺ) কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি? তারা তাদের কিতাবধারী কাফের ভাইদেরকে (ইখওয়ান) বলে: (আল্লাহর কসম) তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশ থেকে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা কখনও কারও কথা মানব না। আর যদি তোমরা (যুদ্ধে) আক্রান্ত হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।”[7]

আর এই প্রতিশ্রুতি মুনাফিকরা দিয়েছিল মদিনার কিছু ইয়াহুদিদের।

আর, আল-কাসিম ইবনুস সালাম তাঁর ‘আল-গারিব’ (৩/১৪২) গ্রন্থে বলেন, “আর যে হালিফ (যে অঙ্গীকারাবদ্ধ) তাকেও ‘ওয়ালি’ বলা হয়। আর ইবনুল আসির (رحمه الله) তাঁর ‘আন-নিহায়া’ (৫/২২৮) গ্রন্থে অনুরূপ কথাই বলেছেন।

এরকমই আমরা দেখতে পাই জিহাদ এবং মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে জোট গঠন করার মাঝে। আর এই জিহাদকেই তারা ‘ইরহাব’ (সন্ত্রাসবাদ) বলে অপবাদ দেয়।

(৪) চুক্তি (মুয়াফাকাহ)’র মাধ্যমে তাওয়াল্লি।

কেউ যদি কুফফারদের মতোই গণতন্ত্রকে শাসনের একটি পথ মনে করে, কুফফারদের মতো করেই সংসদ, আইন পরিষদ, সভা, সংঘ তৈরি করে, তাহলে সে তাদের (কুফফারদের) সাথে তাওয়াল্লি করল।

আর এটি নাজদের ইমামগণ চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এমনকি বিশেষ করে যারা কাফির মুশরিকদের কুফর ও শিরকের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, তাদের ব্যাপারে বইও সংকলন করা হয়েছে। ইমাম সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ‘আদ-দালাইল’ বইটি সংকলন করেছেন, যেটা ‘হুকমু মুয়ামালাত আহলিল ইশরাক’ নামে পরিচিত। আর হামাদ বিন আতিক্ব ‘আন-নাজাতি ওয়াল-ফিকাকী মিন মুয়ালাতিল মুরতাদ্দিন ওয়া আহলিল ইশরাক’ বইটি সংকলন করেছেন।

আর এই চার প্রকারের প্রত্যেকটি তাওয়াল্লিই হচ্ছে স্বতন্ত্রভাবে কুফর (যা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়)। আর উক্ত ব্যক্তি কী বিশ্বাস করে, তা এখানে ধর্তব্য নয়[8] যেমনটা ইরজাগ্রস্ত ব্যক্তিরা দাবি করে থাকে।

আর মুয়ালাত (এটি তাওয়াল্লির চেয়ে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত) হচ্ছে দুই প্রকার:

(১) (মুয়ালাত) এর একটি প্রকারকে তাওয়াল্লি বলা হয় আর এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। কখনো কখনো এটিকে ‘আল-মুয়ালাতুল কুবরা’[9] বা ‘আল-উসমা’[10] বা ‘আল-আমমাহ’[11] বা ‘আল-মুতলাকাহ’[12]–ও বলা হয়। আর এ সবগুলোই তাওয়াল্লির সমার্থক শব্দ।

(২) গৌণ বা সীমাবদ্ধ মুয়ালাহ।

কুফফারদের সম্মান করা বা তাদের বিভিন্ন সভায় সামনে বসতে দেওয়া বা (মুসলিমদের বাদ দিয়ে) তাদের কর্মসংস্থান করা এবং অনুরূপ সব কার্যকলাপ এর অন্তর্ভুক্ত । অতএব, এটি হচ্ছে ফিসক (অবাধ্যতা) এবং কাবিরা গুনাহ।

আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاء تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ

“হে মুমিণগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও…”[13]

সুতরাং, তিনি (আল্লাহ) – ‘বন্ধুত্বের বার্তা পাঠানো’ –কে মুয়ালাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর তিনি তাদেরকে এ জন্য কুফফার হিসেবে সম্বোধন করেননি, বরং ঈমানদার বলেছেন।[14]

যখন আবু মূসা আল-আশ’আরি (রাঃ) লেখক হিসেবে একজন খ্রিষ্টানকে নিযুক্ত করেন, তখন উমার (রাঃ) তাঁকে তিরস্কার করে এই আয়াতগুলো (সূরা মা’ইদাহ, ৫/৫১) ব্যাখ্যা করেন।[15]

এ বিষয়ে আরো জানতে সুলাইমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের ‘মাজমুয়াতুত তাওহিদ’–এ ‘আওসাক উরাল ঈমান’ বইটি আর আব্দুল লতিফ বিন আব্দুর রহমানের ‘মাজমু আর-রাসাইল ওয়াল মাসাইল’–এ ‘আল-মুয়ালাহ’ বইটি দেখতে পারেন।

-শাইখ আলি বিন খুদাইর আল-খুদাইর (فك الله أسره)  -এর কথা সমাপ্ত।

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ (رحمه الله) বলেন, “নিজের ব্যাপারে আন্তরিক প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হলো তাওয়াল্লি এবং মুয়ালাতের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম কীরূপ পার্থক্য করেছেন, তা জেনে নেয়া। উদাহরণস্বরূপ, মুয়ালাত হচ্ছে কুফফারদের সাথে নমনিয়তার সাথে কথা বলা, তাদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করা, তাদের ময়লা-আবর্জনা সাফ করা এবং অনুরূপ সেসব জিনিস সাধারণভাবে করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তি যদি কুফফারদের ধর্মকে খোলাখুলি অস্বীকার করেও থাকে, তবুও সে কাবীরা গুনাহগার এবং সে খুবই বড় বিপদে আছে।

আর তাওয়াল্লি হচ্ছে, তাদের (কুফফারদের) সম্মান করা বা তাদের চাটুকারিতা করা বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, তাদের প্রকাশ্যে ত্যাগ না করা, এ সবকিছুই হচ্ছে রিদ্দাহ। আর যে এগুলো করে, তার উপর মুরতাদের বিধান আরোপ করা আবশ্যক, যা কিতাব (কুর’আনুল কারিম), সুন্নাহ এবং উম্মাহর ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।”[16]

শাইখ নাসির বিন হামাদ আল ফাহাদ (فك الله أسره) বলেন, “কুফফারদের সাথে মেলামেশা তিন প্রকারের হতে পারে:

(১) প্রথম প্রকার: এমন মেলামেশা, যা কুফরে লিপ্ত করে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।

আর, কিছু ওলামায়ে কেরাম এই প্রকারকে তাওয়াল্লি হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুতরাং, যে ধরনের মেলামেশা কুফর এবং রিদ্দাহ হিসেবে প্রমাণিত, সেগুলো এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। আর এটি হচ্ছে কুফফারদের ধর্মকে ভালোবাসার মতো অথবা (ইসলামের উপর) তাদের বিজয়ী রূপে দেখার আকাঙ্ক্ষা করা ইত্যাদির মতো। আমাদের বর্তমান সমস্যাটি এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত, আর সেটা হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সহযোগিতা (মুসাহারাহ) করা।

(২) দ্বিতীয় প্রকার: হারাম মেলামেশা, যেগুলো কুফর নয়।

আর কিছু উলামায়ে এই প্রকারকে ‘মুয়ালাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব, যেসব কাজ হারাম হিসেবে প্রমাণিত কিন্তু কুফর নয়, সেগুলো এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, তাদের (কুফফারদের) যেকোনো সভায় সামনে বসতে দেওয়া, তাদের প্রথমে অভিবাদন জানানো, তাদের প্রতি কোনোরূপ ভালোবাসা প্রদর্শন – যা তাওয়াল্লির পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় না ইত্যাদি।

(৩) তৃত্বীয় প্রকার: জায়িয মেলামেশা। এটি মুয়ালাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।জায়িয হিসেবে প্রমাণিত সকল কাজ এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন,  মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেসব কুফফার যুদ্ধ করে না, তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা, তাদের প্রতি ইনসাফ করা[17]­[18] এবং কুফফার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা[19] ইত্যাদি।

-শাইখ নাসির আল ফাহাদ (فك الله أسره)  -এর কথা সমাপ্ত।[20]

আর এই শেষ প্রকারের মেলামেশার বহু তফসিল রয়েছে, যেমনটা ফিকহের বইসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলো।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (رحمه الله) বলেন, “সাধারণ বিধান হচ্ছে, যা কিতাব (কুর’আনুল কারিম) ও সুন্নাহতে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রকারের ব্যবসায়ী লেনদেন হারাম নয় । ঠিক তেমনি, যতটুকু কিতাব (কুর’আনুল কারিম) ও সুন্নাহতে আদেশ করা হয়েছে, তার বাইরে কোনো প্রকারের ইবাদাত নেই। সুতরাং, দ্বীন হচ্ছে তা-ই, যা আল্লাহ করার আদেশ দিয়েছেন এবং যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, অর্থাৎ হারাম। আর এর বিপরীত হলো আল্লাহ্‌ যা হারাম করেননি, তা হারাম করার মাধ্যমে শির্ক করা এবং আল্লাহ্‌র অনুমোদনহীন কোনো শরিয়ত প্রণয়ন করা।”[21]

তিনি আরো বলেন, “মুসলিমদের জন্য কুফফারদের সম্পত্তি ও ঘোড়া ক্রয় করা জায়িয; যেমনটা বেদুইন, কুর্দি, তুর্কিদের থেকেও ক্রয় করাও জায়িয। আর তাদের কাছে খাদ্য, বস্ত্র এবং তদ্রূপ জিনিস বিক্রয় করাও জায়িয। কিন্তু সেসব বস্তু তাদের কাছে বিক্রয় করা হারাম, যা তাদের হারাম কাজে লিপ্ত হতে সহায়তা করবে। যেমন- তাদের কাছে ঘোড়া বা অস্ত্র বিক্রয় করা, যার ফলে তারা আমাদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং বিভিন্ন হারামে লিপ্ত হতে পারে।[22] আল্লাহ আদেশ করেন,

وَتَعَاوَنُواْ عَلَى الْبرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُواْ عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।[23][24]

তিনি আরো বলেন, “কুফফারদের কাছে কোনো অস্ত্র বিক্রয় করা জায়িয নেই, যা দিয়ে সে একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।”[25]

হাফেয ইবনে হাজার আসক্বলানী (رحمه الله) সালাফগণের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “কুফফারদের সাথে লেনদেন করা জায়িয; শুধু তাদের কাছে এমন কোনো কিছু বিক্রয় ব্যতীত, যা দিয়ে তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে পারে।”[26]

আর কুফফারদের সাথে লেনদেন করার কিছু শর্ত রয়েছে।

(১) লেনদেন এমন জিনিসের হতে হবে, যা হালাল।

(২) জিনিসগুলো এমন হতে হবে যা, কুফফাররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না।

(৩) লেনদেন এমন কিছুর হওয়া যাবে না, যা একজন মুসলিমকে হেয় প্রতিপন্ন করে।[27]

হাফেয ইবনে হাজার আসক্বলানী (رحمه الله) সালাফগণের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে আরো বলেন, “কুফফারদের সাথে সাক্ষাৎ করা শুধুমাত্র তখনি বিধিবদ্ধ, যখন আশা করা যায় যে সে ইসলাম কবুল করতে চায়।”[28]

এ বিষয়ে অধিকতর তাফসিল চাইলে ফিকহের কিতাব দেখুন।

—-

[1] কুফরে আকবার হচ্ছে সেই প্রকারের কুফর, যা একজন মুসলিমকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।

[2] এই ধরনের তাওয়াল্লি হচ্ছে মূলত কুফর। এই কুফর/রিদ্দাহ’র জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুফফারদের সাহায্য করার প্রয়োজন পড়ে না, আর না এটার জন্য প্রয়োজন মুসলিমদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার। শুধুমাত্র, (কুফফারদের প্রতি) এ ধরনের ভালোবাসাই (হুব্ব) হচ্ছে রিদ্দাহ। আর যে এটিকে অপর তিন প্রকারের তাওয়াল্লির জন্য শর্ত বানায়, তাহলে সেটা হবে ইরজাগ্রস্ত এবং তাজাহহুমের অনুসারী।

[3] সূরা আল-মা’ইদাহ- ৫১

[4] সূরা আল-মা’ইদাহ- ৫১

[5] আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “The Exposition Regarding the Disbelief of the One That Assists the Americans”. এটি সম্মানিত শাইখ ২০০১ সালে জায়োনিস্ট ক্রুসেডের প্রথমদিকে লিখেছিলেন। নোট: এ বইটি ‘আত-তিবইয়ান পাবলিকেশন্স’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং তার ইংরেজি সংস্করণ পাওয়া যায়। ইনশাআল্লাহ্‌ অদূর ভবিষ্যতে এর বাংলা সংস্করণ ও পাওয়া যাবে।

[6] শাইখ এখানে ইরজাগ্রস্ত এবং তাজাহহুমগ্রস্ত লোকদের যুক্তির দিকে ইঙ্গিত করছেন। তারা দাবি করে থাকে, “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুফফারদের সাহায্য করা কুফর নয়, যতক্ষণ না সেটা তাদের প্রতি ভালোবাসার কারণে অথবা ইসলামকে ঘৃণার কারণে হয়ে থাকে। শুধুমাত্র তখনি সেটা রিদ্দাহ হবে। কিন্তু, সেটা যদি দুনিয়াবী লাভের জন্য করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা রিদ্দাহ নয়।” এই সংশয়ের বিভিন্নভাবে উত্তর দেঅয়া যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে সোজা উত্তরটি হচ্ছে; যদিও কেউ মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুফফারদের সাহায্য করার জন্য আঙুল না তোলে, কিন্তু সে শুধু ইসলামকে ঘৃণা করে অথবা কুফফারদের ভালোবাসে, তাহলেও সেটা ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী রিদ্দাহ। এটার জন্য কুফফারদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজনন পড়ে না, এমনকি এক পয়সা না দিয়ে হলেও। হে আমার ভাই, যে ঈমানের স্বাদ পেয়েছেন! যদিও কেউ কুফফারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের হয় এবং মুসলিমদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করে কিন্তু তার অন্তর ইসলামকে ঘৃণা করে বা কুফরকে ভালোবাসে, তাহলে সে একজন কাফির কারণ তার মধ্যে তাওয়াল্লির কুফর রয়েছে, যদিও সে কুফফারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারণে কুফফারদের দ্বারা নিহত হয় হে আমার তাওহিদী ভাইয়েরা! যদি তোমরা এ ব্যাপারটি বুঝে থাকো, তাহলে তোমাদের এটা বুঝে নেয়া উচিত যে, এই মুরজিয়ারা ‘মুযাহারাহ’ (মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুফফারদের সাহায্য করা)–কে ঈমান ভঙ্গের কারণ মনে করে না। সুতরাং, ইরজাগ্রস্ত ব্যক্তিদের কথা যেন তোমাকে প্রতারিত না করে!

[7] সূরা আল-হাশর- ১১

[8] দুন আন-নাসার ইলাল ই’তিক্বাদ

[9] গুরুতর মুয়ালাহ

[10] বৃহত্তর মুয়ালাহ

[11] সাধারণ মুয়ালাহ

[12] নিশ্চিত মুয়ালাহ

[13] সূরা আল-মুমতাহিনা, ১

[14] নোট: কিছু ওলামায়ে কেরামের মতে, আল্লাহ যে তাদের ঈমানদার বলে সম্বোধন করেছেন, এর অর্থ এই না যে কাজটি কুফরে আকবার নয়। এটি শাইখ আব্দুল ক্বাদির বিন আব্দুল আজিজ কর্তৃক তাঁর ‘আল-জামি ফি ত্বলাবুল ইলম আশ-শারিফ’–গ্রন্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর আলোচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে আর তা ‘আত-তিবইয়ান পাবলিকেশন্স’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘মিল্লাতে ইবরাহিম’–বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে বিদ্যমান।

[15] শাইখ আলি ইবনুল খুদাইর (فك الله أسره) যে হাদীসের কথা বলছেন তা হলো, “আবু মূসা আল-আশ’আরি (রাঃ) বলেন, আমি উমার (রাঃ)–কে বললাম, ‘আমার একজন লেখক আছে, যে হচ্ছে খ্রীষ্টান।’ উমার (রাঃ) বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে? তোমার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত! তুমি কি শুনোনি আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” কেন তুমি একজন হানিফ (মুসলিম) ব্যক্তিকে (কাজে) নিচ্ছ না?’ অতঃপর আবু মূসা (রাঃ) বললেন, ‘হে আমিরুল মু’মিনিন! তাকে শুধু আমার দরকার কিছু লেখালেখির জন্য আর তার ধর্ম তার কাছে (সেটি আমার বিষয় না)।’ উমার (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে অপমানিত করেছেন, তাই আমিও তাদের সম্মান করি না। আমি তাদের মর্যাদা দেই না, কেননা আল্লাহই তাদের অবনমিত করেছেন। আমি তাদের আমার নিকট আসতে দেই না, কেননা আল্লাহই তাদের আমাদের থেকে সর্বাধিক দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।” এটি ইবনে তাইমিয়্যাহ ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘ইক্বতিদাহ আস-সিরাতে মুসতাকিম’ (৫০)-গ্রন্থে। তিনি এই হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম বাইহাক্বী তার সূনানুল কুবরা (১০/১২৭)–তেও এটি বর্ণনা করেছেন।

[16] আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, ১৫/৪৭৯

[17] এটি আসলে একটি ফরজিয়াত, কারণ আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।” [সূরা আল-মা’ইদাহ- ৮]

আর আল্লাহর প্রণীত আইন ব্যতীত কোথাও কোনো ন্যায়বিচার নেই, হোক সেটা মানুষের বানানো আইন অথবা স্বঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার’ সংস্থা অথবা তদ্রূপ কুফর বা জুলুম। আর যে শরিয়াহ’র আইন ব্যতীত অন্য কিছুকে ন্যায়সঙ্গত বা ভালো অথবা আরো উৎকৃষ্ট মনে করবে, তাহলে সেটা হবে রিদ্দাহ, যা পরিষ্কারভাবে ঈমানভঙ্গের ১০টি কারণের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

[18] উক্ত আয়াত,

لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (٨) إِنَّمَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ قَاتَلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَأَخْرَجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ وَظَاهَرُوا عَلَى إِخْرَاجِكُمْ أَنْ تَوَلَّوْهُمْ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (٩)

“ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেছে এবং বহিস্কারকার্যে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারাই জালেম।” [সূরা আল-মুমতাহিনা, ৮-৯]

[19] আর যাদের অভিভাবক কুফফার, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ

“পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে” [সূরা লুকমান, ১৫]

[20] আত-তিবইয়ান ফি কুফরি মান আ’আন আল-আম্রিকান

[21] আস-সিয়াসাহ আশ-শারিয়াহ- ১৫৫

[22] ইসলামের শত্রুদের কাছে অস্ত্র বিক্রয় করা বা যুদ্ধ অভিযানের জন্য কোনো যানবাহন বিক্রয় করা হচ্ছে এক ধরনের তাওয়াল্লি। বিক্রয়ের ব্যাপারটা এভাবে দেখতে হবে যে, “কুফফারদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাহায্য করা, দুনিয়াবী স্বার্থে।” আর, ‘আদ-দালাইল’ অধ্যায়নের পর এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, এটি কোনো উজুহাত নয় বরং এটি মুসাহারাহ, ঈমান ভঙ্গের অষ্টম কারণ। সুতরাং, যে আল্লাহর শত্রুদের দরকারী কোনো কিছু বিক্রয় করে সাহায্য করবে এবং অতঃপর দাবি করবে যে, “আল্লাহ ব্যবসায়ীক লেনদেন জায়েজ করেছেন,” তাহলে এরূপ ছদ্দবেশ ধারণকারী ধর্মদ্রোহী থেকে সাবধান থাকবেন।

[23] সূরা আল-মা’ইদাহ- ২

[24] আল মাসাইলুল মারদিনিয়াহ, ১৩২-১৩৩

[25] ইক্বতিদাহ আস-সিরাতুল মুসতাকিম- ২৯৯

[26] ফাতহুল বারী, ৪/৪১০

[27] ফাতহুল বারী, ৪/৪৮২। কিন্তু, মুরতাদদের সাথে লেনদেনের কিছুই নাই, শুধুমাত্র তরবারি ব্যতীত।

[28] ফাতহুল বারী, ১০/১১৯। অতঃপর, তিনি বলেন “এটা স্পষ্ট যে, কুফফারদের সাথে সাক্ষাৎ করাটা নিয়ত এবং তা থেকে কীরূপ উপকার পাওয়া যাবে, তার উপর নির্ভরশীল।” অতএব, এটি সর্বাবস্থায় হারামও নয় আবার জায়িযও নয়, বরং তা অবস্থার উপর নির্ভর করে।

 

[এই পর্বটি মূলত শাইখ আলি আল-খুদাইর (فك الله أسره) –এর প্রশ্নোত্তর- ‘আল-হাদ্দুল ফাসিল বায়ানুল মুয়ালাত ওয়াত-তাওয়াল্লিলুল কুফফার’ –থেকে সংগৃহীত। আর শেষে শাইখ নাসির আল ফাহাদ (فك الله أسره) –এর ‘আত-তিবইয়ান’ এবং সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে।]

(Visited 603 times, 1 visits today)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − thirteen =