মুমিনদের প্রতি নম্র, কাফিরদের প্রতি কঠোর

শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি

ডাউনলোড

মুমিনদের প্রতি নম্রতা ও কাফেরদের প্রতি কঠোরতা, এটা বান্দা কর্তৃক আল্লাহকে ভালবাসার দলিল। কেননা বান্দা যখন আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাসবে তখন সে, সে কাজই করার চেষ্টা করবে, যার দ্বারা আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। যে জিনিসটা আল্লাহ পছন্দ করেন ও ভালবাসেন, মুমিন তার দিকেই ছুটবে।

স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, যে তাকে ভালবাসে সে মুমিনদের প্রতি নম্র ও কাফেরদের প্রতি কঠোর। তাই এটাই হল বান্দা কর্তৃক আল্লাহকে ভালবাসার আমালত। আর এই গুণের মাধ্যমেই, তথা মুমিনদের প্রতি নম্রতা ও কাফেরদের প্রতি কঠোরতার মাধ্যমেই বান্দার আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে। তাই এতে যেমন আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাসার দলিল ও প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনিভাবে এটা আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাসার মাধ্যম বা উপায়ও বটে।

ইবনে রজম রহ: জামিউল উলূম ওয়াল হিকামে বলেন: (মুমিনদের প্রতি নম্র ও কাফেরদের প্রতি কঠোর) এই আয়াত সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:

যেহেতু তারা যখন আল্লাহকে ভালবাসবে, তখন আল্লাহর বন্ধুগণকেও ভালবাসবে, তাদের সান্নিধ্য অবলম্বন করবে, তাদের সাথে ভালবাসা, দয়া, প্রীতি ও কোমলতার আচরণ করবে এবং আল্লাহর শত্রুদের সাথে শত্রুতা করবে, তাদের সাথে কঠোর ও রূক্ষ আচরণ করবে, সেহেতু পরিপূর্ণ ভালবাসার দাবি হল প্রিয় সত্ত্বার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

মুফাস্সিরগণ হাসান বসরী রহ: থেকে বর্ণনা করেন, সালাফদের কাফেরদের থেকে সম্পর্কছিন্ন করা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে, অর্থাৎ তারা কিভাবে তাদের থেকে সম্পর্কোচ্ছেদ করতেন: তিনি বলেন,

তারা নিজেদের কাপড়ের ক্ষেত্রেও এই সতর্কতা অবলম্বন করতেন যে, তা কাফেরদের কাপড়ের সাথে মিলে যায় কি না। তাদের শরীরের কাফেরদের শরীরের সাথে স্পর্শ হয়ে যায় কি না। আর তাদের নিজেদের মাঝে পারস্পরিক সহানভূতির ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা যেকোন মুমিনকে দেখলেই তার সাথে মুসাফাহা ও মুআনাকা করতেন।

এই ঘটনাটি বর্ণনা করেন মুফাসসিরগণ।

আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের আমলটি বিভিন্ন স্থানের মুসলিমদেরকে এক জায়গায় একত্রিত করে। হজ্বের মত। হজ্জ সকল স্থানের হাজীদেরকে এক স্থানে একত্রিত করে। এরকমভাবে জিহাদও। তাতে বিভিন্ন স্থানের, বিভিন্ন পরিবেশের, বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকেরা এক স্থানে জমা হয় নির্দিষ্ট একটি ইবাদত আদায় করার জন্য।

তাই এটি একটি সম্মীলনকারী ইবাদত, যাতে বহু সংস্কৃতি ও বহু রীতি-নীতি থাকে। এধরণের জমায়েতের জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি মোলায়েম হওয়া, দয়াশীল হওয়া, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা এবং অনুপযুক্ত ও অনুচিত বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। যেমন বলা হয়ে থাকে, “কওমের নির্বোধ লোক কওমের সরদার হয় না, বরং কওমের যে ব্যক্তি নিজেকে নির্বোধ সাজায় সে কওমের সরদার হয়”।

শায়খ আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহ: বলেন, (খুব দামি কথা!)

জিহাদ কঠোরতা ও নম্রতা উভয়টিকে চায়। নম্রতা চায় মুমিনদের প্রতি, কঠোরতা চায় কাফের প্রতি। এটি একটি সম্মিলিত ইবাদত। আপনি একা একা জিহাদ করতে পারবেন না। বরং আপনাকে অবশ্যই একটি জনসমষ্টির মাঝে থাকতে হবে।

আর উক্ত জনমষ্টি হবে আপনার থেকে ভিন্ন। তাদের অভ্যাসে, স্বভাবে, বচনভঙ্গিতে, ঘুমের সিস্টেমে। একজন নাক ডাকবে, একজন ডাকবে না। একজনের লোকমাটা ছোট, একজনের লোকমাটা বড়।

এসব ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই অন্ধ, মূক ও বধির হয়ে থাকতে হবে। কোন দোষের দিকে তাকাবেন না; শুধু উত্তম বিষয়গুলোর দিকেই তাকাবেন, যতক্ষণ না কোন অন্যায় দেখা যায়। অর্থাৎ যা-ই আপনার স্বভাব-বিরুদ্ধ হোক না কেন। কিন্তু যদি সেটা হয় অন্যায়, তখন তো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে পারবেন।

অতএব, ক্ষমা করা, দৃষ্টি নিচু করা, দয়া প্রদর্শন করা ও কোমলতার সাথে পথপ্রদর্শন করাই কাম্য।

“সম্মানিত ব্যক্তিদের একান্ত গোপনীয় দোষগুলো ক্ষমা করে দাও, আর নীচু লোকের গালমন্দ এড়িয়ে যাও সম্মানিত লোকদের মত।”

যখন এমন না হবে তখন সৃষ্টি হবে বিদ্বেষ। যেটা শয়তানের বাহন। এতে হিংসা ঝগড়া ইত্যাদি সৃষ্টি হবে। যা খুবই নিকৃষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা: যা থেকে সতর্ক করেছেন।

কখনো বলতে থাকবে মদীনার লোকজন এমন… অমুক এলাকার লোকজন এমন… অমুক গোত্রের লোকজন এমন… এভাবে বিভিন্ন কথা উঠবে।

ইমাম তিরমিযি রহ: যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা: থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল সা: বলেন:

“তোমাদের মাঝে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের রোগ সৃষ্টি হয়েছে। হিংসা ও বিদ্বেষ।”

(সম্ভবত যে এই হাদিসটির গভীরে সচেতন দৃষ্টি ফেরাবে, সে বুঝতে পারবে, হাদিসটির আলোচ্য বিষয় হল হিংসা। এখানে হিংসা থেকেই সতর্ক করেছেন।

কিন্তু রাসূল ﷺ উল্লেখ করেছেন দুটি, (হিংসা ও বিদ্বেষ বা শত্রুতা।) এটা এমন জিনিস, যা মুন্ডিয়ে দেয়। কিন্তু আমি এটা বলছি না যে, মাথাকে মুন্ডিয়ে দেয়; বরং দ্বীনকে মুন্ডিয়ে দেয়। শপথ সেই সত্ত্বার, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না।

আর ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন করবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি জিনিস বলে দিব না, যা তোমরা করলে পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হবে?

অথবা এরকম বলেছেন,

“আমি কি তোমাদেরকে এমন জিনিস বলে দিব না, যার মাধ্যমে তোমরা পরস্পরে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে? তা হচ্ছে তোমরা তোমাদের পরস্পরের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও।”

যখন আপনার মাঝে ও কোন ব্যক্তির মাঝে দূরত্ব থাকবে, সালাম এটার জন্য আরোগ্য দানকারী চিকিৎসা হিসাবে কাজ করবে। প্রথম প্রথম এটাকে কঠিন মনে হবে। কিন্তু নফসকে দমনকারী ও শয়তানকে পরাস্তকারী হল এই সালাম ও মুসাফাহা। এটা অভিজ্ঞতালব্ধ কথা, সবার জানাশোনা বিষয়। যেমন আরেক হাদীসে রাসূল সা: বলেছেন:

“এটা  ভালবাসা ছড়ায়।”

সমঝোতা শুরু হয় কিসের মাধ্যমে? সালামের মাধ্যমে। আর তাদের মাঝে উত্তম হল যে প্রথমে সালাম দেয়।

উস্তাদ আব্দুল্লাহ আদহাম রহঃ বলেন,

তাই প্রত্যেক মুজাহিদের উচিত, তার ভাইদের জন্য কোমল, সহজ ও অনুগত হওয়া, তাদের জন্য বিনয় ও কল্যাণকামিতার ডানা বিছিয়ে দেওয়া এবং তাদের দয়াশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়া।

মুসনাদে আহমাদে ইরবাদ ইবনে সারিয়া রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা: বলেন, “মুমিন হল লাগামবিশিষ্ট উটের মত, তাকে যেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সে সেদিকেই যায়। ‘নিহায়াতি গারবিল হাদিস’ কিতাবে এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়: লাগামযুক্ত উটের মত, মানে লাগাম বাধা, যার নাকে ছিদ্র করে রশি ঢুকানো হয়েছে।  ফলে সে তার চালকের বিরোধিতা করতে পারে না।

আরেকটি হাদিস, মুসনাদে আহমাদেরই, হযরত সাহল ইবনে সাদ আস সায়ীদি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন,

“মুমিন হল ভালবাসার স্থান, সেই ব্যক্তির মাঝে কোন কল্যাণ নেই, যে ভালবাসে না এবং তাকেও কেউ ভালবাসে না।”

অর্থাৎ মুমিন হবে নম্র, কোমল ও হৃদয়বান।

সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ রহ: তার তাফসীর ফি যিলালিল কুরআনে বলেন,

মানুষ একটি স্নেহময় কোল, একটি উন্নত পরিচর্যা, একটি মহানুভব সান্নিধ্যের মুখাপেক্ষী। একটি এমন ভালবাসার মুখাপেক্ষী, যা তাদেরকে পরিবেষ্টিত করে নিবে। একটি এমন সহনশীলতার মুখপেক্ষী, যা তাদের অজ্ঞতা, দুর্বলতা ও ত্রুটির কারণে তাদের ব্যাপারে সংকীর্ণতাবোধ করবে না।

এমন একটি অন্তরের মুখাপেক্ষী, যা তাদেরকে দিবে, তাদের থেকে কিছু লাভ করতে চাইবে না। যা তাদের পেরেশানীর বোঝা বহন করবে, কিন্তু তাদের উপর তার বোঝা চাপাবে না এবং তারা তার কাছে পাবে সার্বক্ষণিক যত্ন, পরিচর্যা, দয়া, ক্ষমা, অনুগ্রহ, ভালবাসা ও সন্তুষ্টি। আর এরকমই ছিল রাসূলুল্লাহ সা: এর হৃদয়।

এরকমই ছিল মানুষের সাথে তার জীবন যাপন। তিনি কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নেননি। কখনো তার অন্তর সংকীর্ণ হয়নি, মানুষের মানবীয় দুর্বলতার কারণে।

এটাই মানুষের স্বভাব। দেখুন, আপনিও এমন লোককে ভালবাসবেন, যে আপনাকে ভালবাসে, আপনার প্রতি দয়া করে ও আপনার উপর সহজ করে দেয়।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি আল্লাহ আমাদেরকে তার ইবাদত করার তাওফীক দান করুন ও তার অবাধ্যতার বিষয়গুলোকে আমাদের থেকে দূরে রাখুন! আমীন!

ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

(Visited 238 times, 1 visits today)