ইনসাফকারী হোন!

শায়খ খালিদ বাতারফি

বর্তমান যুগ – যে যুগে দ্বীনের কর্মী, উলামা, তালিবুল ইলম এবং মুজাহিদিনদের মাঝে অনেক মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, এ যুগে আমাদের ইনসাফের খুব বেশি প্রয়োজন। বিশেষ করে তার সাথে – যার পুণ্যের পরিমাণ বেশি আর মন্দের পরিমাণ কম। 

দ্বীনের কর্মীদের ভুল-ত্রুটির কারণে যেন আমরা তাদেরকে ফেলে না দেই। তাদের সঙ্গে বে-ইনসাফী না করি এবং তাদেরকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত না করি।

কারণ এটা সেই ন্যায়পরায়ণতা, যার প্রতি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন।

অভিধানে ইনসাফ অর্থ হল (‘লিসানুল আরব’এর সংজ্ঞার সারকথা): অন্যকে নিজের থেকে অর্ধেক প্রদান করা। অর্থাৎ আপনি যে অধিকার ভোগ করেন, তা অন্যকেও প্রদান করা। এবং বলা হয়- আমি অমুকের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছি, অর্থাৎ আমি আমার হক পরিপূর্ণ আদায় গ্রহণ করেছি। এমনকি আমি ও সে অর্ধেকের ক্ষেত্রে বরাবর হয়েছি।

মুহাম্মদ কিলআজী তার “মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা” নামক অভিধানে বলেন: ইনসাফ হল তা, যা জুলুমের বিপরীত।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর মহান কিতাবে ইনসাফের প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং জুলুম থেকে সতর্ক করে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন –

وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ

“আর মানুষকে তাদের জিনিস-পত্র কম দিও না।” (সূরা আল-আ’রাফ ৭:৮৫)

তিনি আরো বলেন:

وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا

“এবং যখন কথা বলবে, তখন ন্যায্য কথা বলবে।” (সূরা আল-আনআম ৬:১৫২) 

ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন: আল্লাহ তা’আলা কথা ও কাজে আপন-পর সকলের সাথে ইনসাফ বা ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেকের জন্য, প্রত্যেক সময় ও প্রত্যেক অবস্থায় ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে আদেশ করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন।” (সূরা আন-নাহল ১৬:৯০)

ইবনে উয়াইনাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন: আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর এই বাণী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল: إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ । তিনি বললেন: আয়াতে উল্লেখিত ‘আদল’ অর্থ হল ‘ইনসাফ বা ন্যায়নীতি’। ‘ইহসান’ অর্থ হল অনুগ্রহ। ইবনে উয়াইনাহ এটা তার ‘উয়ুনুল আখইয়ার’ এ উল্লেখ করেছেন।

এছাড়াও আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যা ইনসাফের প্রতি উৎসাহিত করে এবং জুলুম থেকে সতর্ক করে। ইনসাফের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল: নিজের থেকে মানুষকে ন্যায়বিচার করা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ

“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর সাক্ষীরূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।” (সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫)

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার সহীহে আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুআল্লাক সনদে দৃঢ়তার শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করেন: আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: যে ব্যক্তি তিনটি জিনিস নিজের মাঝে একত্রিত করল, সে ঈমানকে একত্রিত করল: “নিজ থেকে ন্যায়বিচার করা, পৃথিবীকে শান্তি উপহার দেওয়া এবং সংকটের মাঝেও আল্লাহর পথে খরচ করা।”

যেটা পূর্বে বলেছি যে – বিশেষভাবে দ্বীনের কর্মী, আলেমদের এবং যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারি – তাদের ভুলের ক্ষেত্রে ইনসাফ করা। এ বিষয়টি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। আহলুস-সুন্নাহ ওয়ালা জামাত নিজ প্রতিপক্ষদের ব্যাপারে সর্বাধিক ইনসাফ করেন। এ ব্যাপারেই শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ তার “দারউ তাআরুযিল আকল ওয়ান নাকল” পুস্তিকায় প্রথমে এমন এক দল আলেমের কথা উল্লেখ করেন, যাদের বিভিন্ন বিদআতি ও হক-পরিপন্থী মতামত ছিল, তারপর বলেন:

“কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই ইসলামে যথেষ্ট অবদান এবং বহু স্বীকৃত নেক আমল ছিল। অনেক নাস্তিক ও বিদআতিদের যুক্তি খণ্ডনে এবং অনেক আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের সাহায্যকরণে এই ব্যক্তিদের এমন এমন অবদান আছে – যা সকলের নিকট স্পষ্ট। যারা এদের প্রকৃত অবস্থা জানেন, তারা এদের ব্যাপারে সঠিক তথ্য, সততা, ন্যায় ও ইনসাফের সাথে আলোচনা করেছেন। 

কিন্তু যখন তাদের নিকট এই সর্বজন গৃহীত মূলনীতিটি সংশয়পূর্ণ হয়ে গেল, যেটা শুরু হয়েছিল মু’তাযিলাদের থেকে (অথচ তারা ছিল জ্ঞানী-গুণী), তখন তাদের প্রয়োজন হল এটা প্রতিহত করার এবং তার অনিবার্য ফলাফলগুলো মেনে নেওয়ার। এর কারণেই তাদের জন্য এমন অনেক কথা বলা আবশ্যক হয়ে পড়ল – যা মুসলমান, উলামা ও দ্বীনদারগণ প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে মানুষের মধ্যে কেউ তাদের গুণাবলী ও ভালো কাজগুলোর কারণে তাদেরকে মর্যাদা দিতে লাগল। আর কেউ তাদের কথার মধ্যে বিভিন্ন বিদআত ও ভ্রান্তি থাকার কারণে তাদের নিন্দা করতে লাগল। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল মধ্যমপন্থা”।

এটা শুধু এদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অন্যান্য অনেক আলেম ও দ্বীনদারের মাঝেও এটা ঘটেছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সকল মুমিন বান্দাদের ভালো কাজগুলো গ্রহণ করবেন আর মন্দগুলো ক্ষমা করবেন।

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের সেই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।” (সূরা আল-হাশর ৫৯:১০)

কোন সন্দেহ নেই – যে রাসূলের দিক থেকে আগত ইলমের মাধ্যমে সত্য ও দ্বীন অন্বেষণ করার জন্য পরিশ্রম করবে, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল করবে, আল্লাহ তার ভুলগুলো ক্ষমা করবেন। সেই দু’আর প্রতিফলন স্বরূপ, যা তিনি তার নবী ও মুমিনদের জন্য কবুল করেছেন। তিনি বলেছেন:

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দ্বারা যদি কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, তবে সেজন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করো না।” (সূরা বাকারাহ ২:২৮৬)

বে-ইনসাফীর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা বা পক্ষপাতিত্ব, অজ্ঞতা, অন্ধ অনুসরণ, প্রবৃত্তি, সমশ্রেণীর প্রতি হিংসা।

বে-ইনসাফী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কয়েকটি উপায়ে। তন্মধ্যে কয়েকটি হল: আল্লাহর ভয়, মুসলমানের সম্মানের ব্যাপারে সতর্কতা এবং এ বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করা। এমনভাবে সংশ্লিষ্ট মাসআলা ও তার প্রবক্তার ব্যাপারে সূক্ষ্মভাবে যাচাই করা, চাই মতটি যা ই হোক না কেন।

অর্থাৎ তিনি সেটা বলেছেন কি না, বা বলে থাকলে কী বলেছেন। যদি বলে থাকেন, তাহলে কোন দিক থেকে বলেছেন। হতে পারে তিনি ভুল ব্যাখ্যা করেছেন অথবা অজ্ঞ ছিলেন, তখন তাকে শিক্ষা দান করতে হবে। অবশ্যই মুসলমানদের মাঝে কল্যাণকামিতার চেতনার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। তাই আমি কারো প্রতি উপদেশ পেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তার ব্যাপারে কোন হুকুম আরোপ করব না। যখন তার সামনে উপদেশ পেশ করা হবে এবং তার থেকে বিমুখতা দেখা যাবে, সেই সময় অবশ্যই সত্যকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করতে হবে।

আরেকটি উপায় হল – কোন পক্ষপাতিত্ব না করে শুধুমাত্র হকের পক্ষে থাকা। চাই সেটা আমাদের দল, আমাদের আদর্শ এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী হোক। মূলকথা হল – একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদেরকে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হতে হবে। আমরা আমাদের জীবনে যা কিছু বলি এবং যা কিছু করি, তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আমরা যদি ইনসাফ না করি, তাহলে এটা আমাদের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধের কারণ হতে পারে। এ জাতীয় উপায়গুলো আমাদেরকে বে-ইনসাফী থেকে রক্ষা করতে পারে।

আমাদেরকে জুলুম থেকে পরিপূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তার সহীহে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه و سلم فِيمَا يَرْوِيهِ عَنْ رَبِّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى، أَنَّهُ قَالَ: “يَا عِبَادِي: إنِّي حَرَّمْت الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْته بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا؛ فَلَا تَظَالَمُوا

“আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার নিজের উপর জুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা একে অপরের প্রতি জুলুম করো না।” (সহীহ মুসলিম – ২৫৭৭)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, সহীহুল মুসলিমে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ ﷺ: «اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاتَّقُوا الشُّحَّ فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ: حَمَلَهُمْ عَلى أَنْ سَفَكُوا دِمَاءَهُمْ وَاسْتَحَلُّوا مَحَارِمَهُمْ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ

 “তোমরা জুলুম থেকে সতর্কভাবে বেঁচে থাক। কারণ জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে। আর কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কারণ কৃপণতা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে। এ কৃপণতাই তাদেরকে প্ররোচিত করেছে রক্তপাতের জন্য এবং হারাম কাজকে হালাল করার দিকে”। (মুসলিম – ২৫৭৮)

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে জুলুম থেকে রক্ষা করেন। আমাদেরকে সৃষ্টির সকল জীবের সাথে, এমনকি আমাদের বিরোধীদের সাথেও ইনসাফ করার তাওফিক দান করেন। কিয়ামতের দিন আমাদের ঘাড়ে কোন জুলুমের অভিযোগ বাকি না রাখেন, বিশেষত: মুসলমানদের বিরুদ্ধে জুলুমের অভিযোগ।

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের প্রতি তার দয়া বর্ষণ করেন। আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদার ভাইদেরকে ক্ষমা করেন এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের ব্যাপারে কোন হিংসা-বিদ্বেষ অবশিষ্ট না রাখেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম মহানুভব, অসীম দয়ালু।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

(Visited 434 times, 1 visits today)