দুর্বল ঈমান: লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার!

উস্তাদ হাশিম হাদ্দাদ

একজন মানুষের জন্য তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে ঈমান, আর এই ঈমান কখনো মজবুত থাকে আবার কখনো দূর্বল হয়ে যায়।

রাসূল (সঃ) কে মজবুত ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ

“তুমি বলো আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি অতঃপর তার ওপর অবিচল থাক।”

অর্থাৎ ঈমানের হক আদায় করে তার ওপর অটল থাক। সৎ কর্মের মাধ্যমে ঈমান মজবুত হয় আর অসৎ কর্মের মাধ্যমে ঈমান দুর্বল হয়।

অতএব আমাদের ঈমান মজবুত করা খুবই জরুরী যার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

আমরা এই লেখাটিকে ৪ভাগে বিভক্ত করেছি আল্লাহর সাহায্যে।

যথাঃ
১. দূর্বল ঈমানের লক্ষণ সমূহঃ
২. ঈমান দূর্বল হওয়ার কারণ সমূহঃ
৩. ঈমান উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক বিষয় সমূহঃ
৪. ঈমান মজবুতির উপায় সমূহ বা প্রতিকারঃ

(১) দুর্বল ঈমানের লক্ষন সমূহঃ

আত্ম-সচেতনতার জন্য দুর্বল ঈমানের লক্ষনগুলো ভালোভাবে জেনে রাখা আবশ্যক; দুর্বল ঈমানের কিছু লক্ষন হলঃ

১. পাপ করা সত্ত্বেও মনে পাপবোধ সৃষ্টি না হওয়া, যার ফলে এক সময় অন্তর পাষাণ্ড হয়ে যায়।

আর অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন পাপকর্মে এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে, তার বুদ্ধিশুদ্ধি সহ পাপের হাতে বন্দী হয়ে যায়, সে ঢাকা পড়ে পাপের আবরণে ফলে কোন ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদী তার কোন কাজে আসেনা এবং তার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না, একটা সময় তার মৃত্যু এসে যায় সেই সময় কেউ যদি তাকে বারবার কালিমা পড়াতে চায় তখন সে ওটা শুনতে পায় না এবং বুঝতেও পারে না তার মর্ম, এভাবে তার শেষ পরিনতি হয় খুবই মন্দ।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوۡبُكُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِكَ فَهِیَ كَالۡحِجَارَةِ اَوۡ اَشَدُّ قَسۡوَةً

অনুবাদঃ “অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে, তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন”। (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ৭৪)

২. ইবাদাতে আলসতা ও অবহেলা বোধ করা বা ঢিলেমি করা এবং ইবাদতে মনযোগ না থাকা।

যেমনঃ কোরআন তেলাওয়াত না করা, নির্ধারিত সময়ে সলাত আদায় না করা বা করলেও তাতে কোন মজা না পওয়া ইত্যাদি।

আল্লাহ তালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেনঃ

وَ اِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوۡا كُسَالٰی

অনুবাদঃ “তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায়, একান্ত শিথিল ভাবে ও আলসেমি ভাব নিয়ে (সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১৪২)

৩. খামখেয়ালী মেজাজ।

যেমনঃ সামান্য বিষয়েই তুলকালাম করে ফেলা বা মেজাজ সবসময় তিরিক্ষে বা খিটমিটে হয়ে থাকা।

৪. কুরআনের তেলাওয়াত শুনে বিশেষ করে পাপের জন্য শাস্তি কিংবা সৎকাজের জন্য পুরুস্কারের কথা বলা হয়েছে এমন আয়াতগুলো শুনেও হৃদয়ে  কোন রকমের কোন প্রভাব বা অনুভূতির তৈরি না হওয়া।

৫. আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া এবং তাঁকে স্মরণ করা কঠিন মনে হওয়া।

৬. শারীয়াহ্‌ বিরুদ্ধ কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার পরও মনে কোন অনুশোচনা বা অনুতাপ বোধ না হওয়া।

৭. ধন-সম্পদ, সন্তানাদি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি এসব কিছুর পিছনেই সারাক্ষন ছুটে চলা এবং এগুলো নিয়ে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا الۡحَیٰوةُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّ لَهۡوٌ وَّ زِیۡنَةٌ وَّ تَفَاخُرٌۢ بَیۡنَكُمۡ وَ تَكَاثُرٌ فِی الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَوۡلَادِ ؕ كَمَثَلِ غَیۡثٍ اَعۡجَبَ الۡكُفَّارَ نَبَاتُهٗ ثُمَّ یَهِیۡجُ فَتَرٰىهُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَكُوۡنُ حُطَامًا ؕ وَ فِی الۡاٰخِرَةِ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۙ وَّ مَغۡفِرَةٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رِضۡوَانٌ ؕ وَ مَا الۡحَیٰوةُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ.

অনুবাদঃ তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ব্যতীত আর কিছু নয়, যেমন এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা খড়কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।
(সূরাঃ হাদীদ, আয়াতঃ ২০)

তিনি আরও বলেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ مِنۡ اَزۡوَاجِكُمۡ وَ اَوۡلَادِكُمۡ عَدُوًّا لَّكُمۡ فَاحۡذَرُوۡهُمۡ

অনুবাদঃ হে মুমিনগণ, তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের দুশমন। অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক।
(সূরাঃ তাগাবুন, আয়াতঃ ১৪)

৮. ক্রমাগত মানসিক দৈন্যতার পাশাপাশি আর্থিক কৃপণতা বাড়তে থাকা, ধনসম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবনতা, উম্মাহ’র বিপদ-আপদে তাদের কল্যাণার্থে সাহায্য করার জন্য কোন প্রকারের অস্থিরতা তৈরী না হওয়া।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

هٰۤاَنۡتُمۡ هٰۤؤُلَآءِ تُدۡعَوۡنَ لِتُنۡفِقُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۚ فَمِنۡكُمۡ مَّنۡ یَّبۡخَلُ ۚ وَ مَنۡ یَّبۡخَلۡ فَاِنَّمَا یَبۡخَلُ عَنۡ نَّفۡسِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ الۡغَنِیُّ وَ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ ۚ وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَكُمۡ ۙ ثُمَّ لَا یَكُوۡنُوۡۤا اَمۡثَالَكُمۡ.

অনুবাদঃ শুন, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান জানানো হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্থ। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।
(সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ ৩৮)

৯. নিজে না করে অন্যকে ভাল কাজের আদেশ দেওয়া।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَكُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡكِتٰبَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ.

অনুবাদঃ “তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও আর নিজেরা নিজেদেরকে ভূলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না? (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ৪৪)

১০. অন্যের অবনতি, ক্ষয়-ক্ষতি দেখে তাদের সাহায্যে এগিয়ে না যাওয়া বরং উল্টো মানসিক তৃপ্তি বোধ হওয়া।

১১. যেসব বিষয় মাকরুহ্‌ (অপছন্দনীয়) সেগুলোকে হালকা ভাবে নেওয়া, এবং সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে দূরে না থাকা।

এদের উপমা দিতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) এক রাখালের কথা বলেছেন যে, যার বকরিগুলো নিষিদ্ধ এলাকা কাছেই ছড়ায়, যার ফলে একসময় সেগুলো নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করে ফেলে। (বুখারী, মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বলেনঃ “মুমিনের কাছে তার গুনাহকে মনে হয় পাহাড়ের মতো, যা এক্ষুনি তার মাথায় ভেঙ্গে পড়বে, আর মুনাফিকের কাছে মনে হয় নাকের কাছে উড়া মাছির ন্যায়, যাকে সে হাতের এক ঝটকায় তাড়িয়ে দিবে” (ফতহুল বারী)

এরকমভাবে ছোটখাটো (ভালো) নেকির কাজগুলোকে গুরুত্ব না দেওয়া বা সেগুলোর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করা, হোক না কাউকে পানি পান করানো বা কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলা বা মসজিদ হতে ময়লা পরিস্কার করা।

এক ব্যাক্তি রাস্তায় একটি গাছের ঢাল পড়ে থাকতে দেখে বলল; আল্লাহর কসম! আমি এটা সরিয়ে দেব যাতে মুসলিমদের চলাফেরা করতে অসুবিধা না হয়, অতপর সে সেটা সরিয়ে দেয় এবং জান্নাতে প্রবেশ করে। (মুসলিম)

রাসুল (সঃ) বলেনঃ মুসলমানদের পথ হতে একটি কষ্টদায়ক বস্তু যে সরিয়ে দিবে তার জন্য একটি “হাসানাহ” বা পুণ্য লেখা হবে, আর যার একটি হাসানাহ কবুল হয়ে যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আদাবুল মুফরাদঃ ৫৯৩)

১২. বিপদে ধৈর্য ধারন করতে না পারা, বিপদ-আপদ আসলে আতঙ্কে উদভ্রান্ত হয়ে পড়া, এটি দুর্বল ঈমানের ফলাফল কারণ, আল্লাহর উপর তার তাওয়াক্কুল নেই। যেমনঃ কেউ মারা গেলে উচ্চস্বরে বিলাপ করে, বুক চাপড়িয়ে কান্নাকাটি করা ইত্যাদি।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

قُلۡ لَّنۡ یُّصِیۡبَنَاۤ اِلَّا مَا كَتَبَ اللّٰهُ لَنَا ۚ هُوَ مَوۡلٰىنَا ۚ وَ عَلَی اللّٰهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ.

অনুবাদঃ আপনি বলুন! আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখেছেন (তা’ই পৌছবে); তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক, আল্লাহর উপরই মুমিনদের ভরসা
করা উচিত। (সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৫১)

১৩. দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে যাওয়া। দুনিয়ার মোহে অন্ধ হওয়ার একটি লক্ষন হল পার্থিব কোন কিছুর ক্ষতি হলেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া।

১৪. সবসময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকা। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই শুধু বেঁচে থাকা। চরম আত্ন-কেন্দ্রিক জীবন যাপন করা।

(২) যে সকল কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়ঃ

ঈমানের দুর্বলতা হলো বর্তমানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি রোগ। যার কারণে প্রায়ই মানুষকে নালিশ করতে শোনা যায় ‘আমার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে,’ ‘আমি ইবাদতে কোনো প্রশান্তি পাই না,’ ‘আমার ঈমান যেন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে,’ ‘কুরআন তিলাওয়াত আমার অন্তর বিগলিত করে না,’, ‘আমি সহজেই গুনাহে জড়িয়ে পড়ি’ ইত্যাদি।

অন্তর বা হৃদয়কে আরবিতে বলা হয় ক্বল্ব্। তাক্বাল্লুব অর্থ হলো পরিবর্তন, বৈচিত্র্য, ওঠানামা। তাক্বাল্লুব থেকেই কলব নামটি এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “কলব হলো গাছের গোড়ায় পড়ে থাকা পাতার মতো, যা বাতাসে বারবার ওলটপালট হয়।” (আহমাদ ৪/৪০৮)

আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যাপ্ত পরিমাণে বলতেন : “হে আল্লাহ্‌! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো।” এক ব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমাদের ব্যাপারে আশংকা করেন? আমরা তো আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন সেই বিষয়ে আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করে নিয়েছি। তিনি বলেন, “অন্তরসমূহ মহামহিমান্বিত করুণাময়ের দু’ আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত। তিনি সেগুলোকে ওলট-পালট করেন।” (ইবনে মাজাহ, ৩৮৩৪)

নিন্মে ঈমান দূর্বল হয়ে যাওয়ার কিছু কারণ বর্ণনা করা হচ্ছেঃ

১. ঈমানী পরিবেশ হতে দূরে থাকে এবং জিকিরের মজলিস ও সালেহীনদের মজলিস হতে দূরে থাকা এবং জামাতের সহিত নামাজ আদায় করা হতে বিরত থাকা।

হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “আমাদের (দ্বীনি) ভাইয়েরা আমাদের নিকট নিজ পরিবার পরিজন হতে অধিক উত্তম, কেননা আমাদের পরিবার- পরিজন আমাদেরকে দুনিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় আর আমাদের (দ্বীনি) ভাইয়েরা আমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়”

২. সৎ অবিভাবক বা রাহবাদের অবিদ্যমানতা।

তাই সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) রাসুল (সঃ)কে কবরে রাখার পর দুনিয়াতে তিনার (যুগ্য সৎ রাহবারের) শূন্যতা অনুভব করেছিলেন।

৩. ফাসেক-ফুজ্জার (পাপাচারী)দের সঙ্গ দেওয়া।

এটি ঈমান দুর্বল হওয়ার অন্যতম একটি কারণ,
তাই এক ফার্সি কবি এটিকে খুব সুন্দরভাবে কবিতার ভাষায় এরূপ ব্যাক্ত করেছেনঃ

صحبت صالح ترا صالح کند+صحبت طالح ترا کند

অর্থাৎ সৎলোকের সান্নিধ্য তোমাকে সৎ বানিয়ে দিবে, আর অসৎ লোকের সান্নিধ্যে তোমাকে মন্দ বানিয়ে দিবে।

৪. দুনিয়াবী বিষয়ে গভীর ভাবে নিমগ্ন হওয়া (ডুবে যাওয়া), আর দুনিয়ার প্রতি অশক্ত হওয়া ও আখেরাত হতে বিমুখ হওয়া শেষ পরিণতি মন্দ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ যেই শেষ পরিণতির উপর আমল সমূহ নির্ভর করে।

রাসূল (সাঃ) এই বিষয়টির গুরুতর নিন্দা করেছেন এবং এমন ব্যক্তিদেরকে দিনারের গোলাম বলে গণ্য করেছেন,

তিনি বলেনঃ “ধ্বংস হোক দেরহামরের গোলামরা, ধ্বংস হোক দিনারের গোলামরা। (বুখারী)

৫. পরিবার, সন্তান-সন্তানাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য হতে বিরত থাকা।

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

اِنَّمَاۤ اَمۡوَالُكُمۡ وَ اَوۡلَادُكُمۡ فِتۡنَةٌ ؕ وَ اللّٰهُ عِنۡدَهٗۤ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ.

অনুবাদঃ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার। (সূরাঃ তাগাবুন, আয়াতঃ ১৫)

৬. খুব দীর্ঘ আশা রাখা (দুনিয়া ভোগের জন্য)।

ذَرۡهُمۡ یَاۡكُلُوۡا وَ یَتَمَتَّعُوۡا وَ یُلۡهِهِمُ الۡاَمَلُ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ.

অনুবাদঃ “আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, খেয়ে নিক এবং ভোগ করে নিক এবং আশায় ব্যাপৃত থাকুক। অতি সত্বর তারা জেনে নেবে”। (সূরাঃ হিজর, আয়াতঃ ৩)

হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ “আমি তোমাদের ব্যাপারে দুটি জিনিসকে অধিক ভয় করি, এক. প্রবৃত্তির অনুসরণ। দুই. দীর্ঘ আসা, কেননা, প্রবৃত্তির অনুসরণ হক থেকে বাধা প্রদান করে, আর দীর্ঘ আশা আখেরাতকে ভুলিয়ে দেয়।

৭. অধিকহারে পানাহার করা এবং অধিক ঘুমানো ও কথাবার্তা বলা, আখেরাত হতে গাফেল করে দেয়।

৮. খুবই স্বল্প ইলম বা জ্ঞান অন্বেষণ করা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

قُلۡ هَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ

অনুবাদঃ “বলুন! যারা জানে (আলেম) এবং যারা জানে (আলেম) না; তারা কি সমান হতে পারে”। (সূরাঃ যুমার, আয়াতঃ ৯)

এক কথায় বলতে গেলে ঈমান মজবুত হওয়ার যে সকল কারণ বা উপায়সমূহ রয়েছে ঐ সকল কারণসমূহের প্রতি যত্নবান না হওয়া।

(৩) চারটি জিনিস ঈমান উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকঃ

১. অহংকার বা দাম্ভিকতা, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য হতে বিরত রাখে।

২. হিংসা, যা নাসিহা বা উপদেশ গ্রহণ করা হতে বিরত রাখে।

৩. ক্রোধ, যা ইনসাফ ও বিনয়ী হওয়া থেকে বিরত রাখে

৪. প্রবৃত্তি, যা এবাদত এর উপর ধৈর্য ধারনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।

তাই এই চারটি ব্যাধী হতে আগে নিজেকে মুক্ত করতে হবে তারপর (নিম্নে আগত ৪র্থ ভাগের ) ১৫ টি টিপস গ্রহণ করতে হবে, তাহলে আশা করা যায় দূর্বল ঈমানের প্রতিকার করা ও ঈমানকে মজবুত করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।

(৪) ঈমান মজবুত করার উপায় বা প্রতিকার সমূহঃ

ঈমান মজবুত করার অনেক উপায় রয়েছে তবে এই লেখায় আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করব যা ঈমানকে মজবুত করতে সহায়তা করবে ইনশাআল্লাহ, এসব উপায়গুলো দৈনন্দিন অভ্যাস এর সাথে সংযুক্ত বা জড়িত বাকি সব কথার অন্যতম একটি কথা হলো ঈমান মজবুত রাখার জন্য সব সময় খোলা থাকে বেঁচে থাকা জরুরি।

১. গভীর চিন্তা ভাবনার শহিত অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা।

আল-কুরআনের- আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্বলিত -আয়াত সমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা, নবী- রাসূল ও তাদের উম্মতদের মহান মহান কাহিনী সম্বলিত আয়াত সমূহ মনযোগ দিয়ে পাঠ করা। কারণ, তাতে আমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছেঃ

আল্লাহ তালা বলেনঃ

لَقَدۡ كَانَ فِیۡ قَصَصِهِمۡ عِبۡرَةٌ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ

অনুবাদঃ তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয়।
(সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১১১)

আর তেলাওয়াত এবং চিন্তা-গবেষণা উভয়টি দুর্বল ঈমানের কার্যকরী ও উত্তম চিকিৎসা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَكَّلُوۡنَ.

অনুবাদঃ আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর কালাম পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। (সূরাঃ আনফাল, আয়াতঃ ২)

২. আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ যথাযথভাবে পালন করা এবং সাথে সাথে নফল সমূহের প্রতিও যত্নবান হওয়া।

কেননা, তা (নফল) আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হাদীসে এসেছেঃ “ফরজ ওয়াজিব এর মধ্যে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় সুন্নত ও নফল এর মাধ্যমে তা পূরণ করে দেওয়া হয়”। (তিরমিজি)

৩. হাদিস অধ্যায়নের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং সাহাবায়ে কেরাম ও স্বর্ণযুগের লোকদের চরিত্র ও আমল সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী নিজের চরিত্র গঠন করা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

لَقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِیۡهِمۡ اُسۡوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنۡ كَانَ یَرۡجُوا اللّٰهَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ فَاِنَّ اللّٰهَ هُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ.

তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা কর, তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ বেপরওয়া, প্রশংসার মালিক।
(সূরাঃ মুমতাহিনা, আয়াতঃ ৬)

৪. সর্বাবস্থায় অধিক পরিমাণে আল্লাহর (সকল প্রকারের) জিকিরে নিমগ্ন থাকা।

কেননা, জিকির হলো ইবাদতের রুহ, এবং আল্লাহ তালার আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি মনোযোগ দেয়া।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِكۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِكۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ.

অনুবাদঃ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (সূরাঃ রা’দ, আয়াতঃ ২৮)

৫. হাঁটাচলা- সর্বাবস্থায় নিজের উপর আল্লাহর নেয়ামত-রাজি উপলব্ধি করা এবং তিনার সকল সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করা এবং সাথে সাথে তার প্রশংসা জ্ঞাপন করা।

الَّذِیۡنَ یَذۡكُرُوۡنَ اللّٰهَ قِیٰمًا وَّ قُعُوۡدًا وَّ عَلٰی جُنُوۡبِهِمۡ وَ یَتَفَكَّرُوۡنَ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ هٰذَا بَاطِلًا ۚ سُبۡحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.

اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ.

অনুবাদঃ যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।

অনুবাদঃ নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে। (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ১৯০-১৯১)

বলা হয়ে থাকে যে, “মালুমাত” তথা জানা বিষয়ের মাঝে ফিকির করার দ্বারা ইলম বাড়ে আর “মাখলিক্বাত” তথা সৃষ্টি নিয়ে ফিকির করার দ্বারা ঈমান বাড়ে।

৬. শেষ রাত্রিতে —যখন হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন —আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান ও মুনাজাত করার জন্য নির্জনতা অবলম্বন করা।

وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَهَجَّدۡ بِهٖ نَافِلَةً لَّكَ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا.

অনুবাদঃ রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করুন, এটি আপনার জন্যে অতিরিক্ত কর্তব্য। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মোকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।
(সূরাঃ বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৭৯)

৭. আল্লাহ ওয়ালা ও সাদেকিন (যারা সর্বদা নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় আল্লাহর সকল আদেশ-নিষেধ পালন করে নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণ করে) ‘দের সংস্পর্শে যাওয়া এবং তাদের সাথে উঠাবসা করা এবং তাদের ইলম ও আখলাক হতে উপকৃত হওয়া, এবং যারা আবেদ, যাহেদ, আমলী উলামা রয়েছেন তাদের বিভিন্ন প্রবন্ধ পাঠ করা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ كُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ.

অনুবাদঃ হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১১৯)

৭. প্রত্যেক ঐসকল হেতু বা কারণ যা মানুষের ক্বলব ও আল্লাহর মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সেগুলোর হতে দূরে থাকা।

তন্মধ্যে একটি হলো (যেটি কোরআনে এসেছে) যে, জিহাদ ফরজ অবস্থায় তা বাস্তবায়নের সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জিহাদে শরীক না হওয়া এবং জিহান হতে দূরে বসে থাকা, ফলে আল্লাহ তাআলা তার মাঝে এমন প্রতিবন্ধকতা বা পর্দা তৈরি করে দিবেন যে, আর জিহাদ করার মত তার তৌফিক ঝুটবেনা। (নাউযুবিল্লাহ)

আর এটি শুধু জিহাদের সাথেই খাস নয় বরং সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই (এই হুমকি) প্রযোজ্য।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوۡلِ اِذَا دَعَاكُمۡ لِمَا یُحۡیِیۡكُمۡ ۚ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَحُوۡلُ بَیۡنَ الۡمَرۡءِ وَ قَلۡبِهٖ وَ اَنَّهٗۤ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ.

অনুবাদঃ হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্তুতঃ তোমরা সবাই তাঁরই নিকট সমবেত হবে। (সূরাঃ আনফাল, আয়াতঃ ২৪)

৮. নিজের আত্মা ও অভ্যন্তরিন অবস্থাকে সংশোধন করা।

কেননা সেসব লোকদের শেষ পরিণতি মন্দ হয় না যাদের প্রকাশ্য আমল ভালো হয় এবং অভ্যন্তরীন অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়,

আর সর্বাবস্থায় মুসলমানদের’কে ভালোবাসা ও তাদের কল্যাণকামী হওয়া এবং মুসলিমদের মাঝে যারা বদকার রয়েছে তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করা।

৯. মৃত্যুকে (অধিক পরিমাণে) স্মরণ করা যা আকস্মিকভাবে এসে পড়বে, এবং (সুন্নাহ ও আদব ঠিক রেখে) বেশি বেশি কবর যেয়ারত করা কারণ, এতে দিল নরম হয় এবং মৃত্যুর স্বরণ’কে বাড়িয়ে দেয়।

রাসূল (সঃ) বলেনঃ আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম কিন্তু এখন তোমারা কবর যেয়ারত কর কেননা, কবর যেয়ারতে মৃত্যুর স্বরণ রয়েছে। (আবু দাউদ)

এবং প্রতিনিয়ত “মুহাসাবা” (আত্মসমালচনা) তথা নিজের হিসেব নিকেশ করা যে, “আমি কি আমল করলাম”? “মৃত্যুর জন্য কেমন প্রস্তুতি নিলাম”আখেরাতের জন্য কি প্রেরণ করলাম ইত্যাদি।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ لۡتَنۡظُرۡ نَفۡسٌ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٍ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ.

অনুবাদঃ মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্যে সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা’আলা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।
(সূরাঃ হাশর, আয়াতঃ ১৮)

যেমন হযরত উমর (রঃ) বলেনঃ

حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا

অর্থাৎ “আল্লাহ তোমার হিসাব নেয়ার পূর্বেই নিজের হিসাব নাও”।

“মুহাসাবা” এর বহু উপকারীতা রয়েছে; যথা- নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব হয় এবং হায়াত শেষ হওয়ার পূর্বে পূর্বেই প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়, যথাযথ আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়, পরিশেষে মৃত্যুর আগে আগে তওবা করার সুযোগ পাওয়া যায়, অতএব মুহাসাবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল।

১০. ইলমি হালাকা বা মজলিস সমূহে বসা এবং গুরুত্বপূর্ণ বয়ান, ওয়াজ-নাসিহা ইত্যাদি শ্রবণ করে সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়া, যার ফলে অন্তর বিগলিত হবে, ঈমান মজবুত হবে এবং জরুরী ইলমও অর্জন হবে।

দ্বীনি মজলিসে বসার ফজিলতঃ

রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘আল্লাহর একদল ফেরেশতা রয়েছেন, যাঁরা আল্লাহর স্মরণে মগ্ন লোকেদের খুঁজে বের করতে (সারা ‍দুনিয়া) পরিভ্রমণ করে বেড়ান। যখন তাঁরা কোথাও আল্লাহর জিকিরে মগ্ন লোকেদের দেখতে পান, তখন ফেরেশতারা পরস্পরকে ডেকে বলেন-
‘তোমরা আপন আপন কাজ করার জন্য এগিয়ে এসো। তখন তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো দিয়ে নিকটবর্তী আকাশ পর্যন্ত সেই লোকদের ঢেকে দেন।’

তখন তাঁদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যদিও ফেরেশতাদের চেয়ে তিনিই অধিক জানেন-
مَا يَقُوْلُ عِبَادِيْ؟
‘আমার বান্দারা কি বলছে?’
তখন তাঁরা (ফেরেশতারা) বলেন- তারা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছে, আপনার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে। আপনার গুণগান করছে এবং আপনার মহত্ত্ব প্রকাশ করছে।

তখন তিনি (আল্লাহ) জিজ্ঞাসা করেন-
هَلْ رَأَوْنِي؟ ‘তারা কি আমাকে দেখেছে?
তখন তাঁরা (ফেরেশতারা) বলেন- ‘হে আমাদের রব! আপনার শপথ! তারা আপনাকে দেখেনি।

তিনি বলেন-
وَكَيْفَ لَوْ رَأَوْنِي؟
‘আচ্ছা, যদি তারা আমাকে দেখতো তাহলে কী করতো?
তাঁরা (ফেরেশতারা) বলেন-
‘যদি তারা আপনাকে দেখতো, তবে তারা আরও অধিক পরিমাণে আপনার ইবাদত করতো, আরো অধিক আপনার মাহাত্ম্য ঘোষণা করতো, আরো অধিক পরিমাণে আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করতো।’

বর্ণনাকারী বলেন, ‘আল্লাহ বলেন-
فَمَا يَسْأَلُونِيْ؟
‘তারা আমার কাছে কী চায়?
ফেরেশতারা বলেন-
তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়।

তিনি জিজ্ঞাসা করবেন-
‘তারা কি জান্নাত দেখেছে?’
ফেরেশতারা বলেন-
‘না’, আপনার সত্তার কসম! হে আমাদের রব! তারা তা দেখেনি।’

তিনি (আল্লাহ) জিজ্ঞাসা করেন-
‘যদি তারা দেখতো তবে তারা কী করতো?’
তাঁরা (ফেরেশতা) বলেন-
‘যদি তারা তা (জান্নাত) দেখতো তাহলে জান্নাতের জন্য আরো অধিক লোভ করত, আরো বেশি কামনা করতো এবং জান্নাতের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হতো।’

তখন আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করেন-
‘তারা কী থেকে আল্লাহর আশ্রয় চায়?’
ফেরেশতারা বলেন-
‘জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চায়।’

আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেন-
‘তারা কি জাহান্নাম দেখেছে?’
তাঁরা জবাব দেন-
‘আল্লাহর কসম! হে আমাদের প্রতিপালক! তারা জাহান্নাম দেখেনি।

তিনি জিজ্ঞাসা করেন-
‘যদি তারা তা দেখতো তখন তাদের কী অবস্থা হতো?
তাঁরা বলেন-
যদি তারা তা (জাহান্নাম) দেখতো তাহলে তারা তা থেকে দ্রুত পালিয়ে যেতো এবং একে সবচেয়ে বেশি ভয় করতো।

তখন আল্লাহ বলেন-
فَأُشْهِدُكُمْ أَنِّيْ قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ

‘আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম।’
তখন ফেরেশতাদের একজন বলেন-
তাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আছে, যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং সে কোনো প্রয়োজনে এসেছে।
তখন আল্লাহ তাআলা বলেন-
তারা এমন উপবেশনকারী; যাদের মজলিসে (কোনো) উপবেশনকারীই বিমুখ হয় না।’ (বুখারি)

১১. (সকল প্রকার) গুনাহের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা, এবং আল্লাহকে ভয় করা, এটি দুর্বল ঈমানের চিকিৎসা হিসেবে অনেক উপকারী পদক্ষেপ।

وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَخۡشَ اللّٰهَ وَ یَتَّقۡهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ.

অনুবাদঃ যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে তারাই কৃতকার্য। (সূরাঃ নূর আয়াতঃ ৫২)

১২. আল্লাহর মহত্ত্বকে উপলব্ধি করা এবং তিনার তাওহিদ বা একত্ববাদকে জানা এবং তিনার সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

فَاعۡلَمۡ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ

অনুবাদঃ জেনে রাখুন, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। (সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ ১৯)

উপরুক্ত আয়াতে আল্লাহর তাওহীদের ইলম অর্জন করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে..

আর অন্তরের সাথে সম্পর্কিত আমল সমূহ যেমন; ভয়, আসা, মুহাব্বত, তাওয়াক্কুল, সু-ধারণা, বিশ্বাস, রিযা বিল ক্বাযা (আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্টি), শুকর, সত্যবাদিতা, তওবা, (সকল ইবাদতে) একনিষ্ঠতা, খুশু-খুযু, দোয়া, বশ্যতা ও আত্মসমর্পণ ইত্যাদিকে একমাত্র আল্লাহর জন্য করা, তার সাথে অন্য কাউকে শরিক না করা। আল্লাহ তালা বলেনঃ

وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ ۬ۙ حُنَفَآءَ وَ یُقِیۡمُوا الصَّلٰوةَ وَ یُؤۡتُوا الزَّكٰوةَ وَ ذٰلِكَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَةِ.

অনুবাদঃ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম। (সূরাঃ বাইয়্যিনাহ, আয়াতঃ ৫)

১৩. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। এর মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি হয় যেমন; আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

سَیَهۡدِیۡهِمۡ وَ یُصۡلِحُ بَالَهُمۡ.

অনুবাদঃ তিনি তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন (দুনিয়া ও আখেরাতে) এবং তাদের (বাহ্যিক ও অন্তরের) অবস্থা ভাল করবেন।
(সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ ৫)

তাছাড়া জিহাদের ময়দানে এমন অগণিত অলৌকিক ঘটনা বা কারামত প্রকাশ পায় যার দ্বারা ঈমান তাজা ও মজবুত হয়, এমনকি একজন কাফির যদি জিহাদের ময়দানের অবস্থা সরাসরি প্রত্যক্ষ করে, তাহলে (এসব কারামাত দেখে) সে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে মানতে বাধ্য হবে।

১৪. এই সবগুলোর সাথে সাথে (এবং সেগুলোর উপর অটল থাকার জন্য) আল্লাহর কাছে বিনয়ের সাথে, ভাংগা অন্তর নিয়ে দোয়া করা। রাসূল (সঃ) নিম্নোক্ত দোয়াটি অধিকহারে করতেন।

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ.

অর্থাৎ “হে অন্তরকে পরিবর্তনকারী আল্লাহ! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের ওপর অটল রাখ”। (আহমদ)

এরকম ভাবে নিজের ঈমানকে নবায়ন করার জন্যও আল্লাহর নিকট দোয়া করা।

মুস্তাদরাকে হাকেমে এসেছে, হযরত ইবনে ওমর (রাদিঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

إن الإيمان ليخلق في جوف أحدكم كما يخلق الثوب. فاسألوا الله تعالى : أن يجدد الإيمان في قلوبكم.

অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের সিনার (ভেতরের) ঈমান এমনভাবে পুরাতন (পঁচে) হয়ে যায় যেমনিভাবে কাপড় পুরাতন হয়ে যায়, তাই তোমাদের প্রত্যেকে আল্লাহর নিকট দোয়া করবে তিনি যেন তোমাদের অন্তরে ঈমদনকে নবায়ন (মজবুত) করে দেন।

তদ্রূপ সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) ‘দের ব্যাপারে এসেছে যে, তিনারা একত্রে বসতেন এবং (একে অপরকে ডেকে) বলতেন;

اجلس بنا نؤمن ساعة

অর্থাৎ ” আস! আমরা কিছুক্ষনের জন্য ঈমানকে আবার নবায়ন (তাজা,মজবুত) করি”

১৫. হাদীসে বর্ণিত ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করার তিনটি বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দেওয়া।

রাসূল (সঃ) বলেনঃ

তিনটি গুণ যার মাঝে থাকবে সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে।
(১) আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সঃ) যার নিকট অন্য সবকিছুর চেয়েও অধিক প্রিয় বা প্রাধান্য।

(২) যে ব্যাক্তি কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহ তালার জন্যই ঘৃণা করে।

(৩) কুফরীতে প্রবেশ করাকে যে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো অপছন্দ করে। (বুখারী)
এই তিন প্রকারের লোক নিজের ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

১৬. আল ওয়ালা ওয়াল বারা ঠিক রাখা।

আল ওয়ালা ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা) এটি একটি হারানো আকিদা, এই আকিদাটি’র কথা মুসলমানরা প্রায় ভূলেই গেছে, তাই তাদের আজ এই দুরবস্থা,

অতএব এটার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি অর্থাৎ মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা চাই সে পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই বসবাস করুক না কেন, আর কুফরের সাথে বিদ্বেষ রাখা কারণ, দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব রাখলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে এমনকি একসময় ঈমান হারা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।

আল্লাহ তালা বলেনঃ

مُحَمَّدٌ رَّسُوۡلُ اللّٰهِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ مَعَهٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَی الۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَیۡنَهُمۡ

অনুবাদঃ মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল।
(সূরাঃ ফাতহ, আয়াতঃ ২৯)

তিনি আরো বলেনঃ

اِنَّمَا وَلِیُّكُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوةَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّكٰوةَ وَ هُمۡ رٰكِعُوۡنَ.

অনুবাদঃ তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রসূল এবং মুমিনগণ-যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র। (সূরাঃ মায়িদাহ, আয়াতঃ ৫৫)

রাসূল (সঃ) বলেনঃ যে কেউ আল্লাহ তা’আলার (সন্তুষ্টি) জন্য কাউকে ভালোবাসো এবং আল্লাহ তালার জন্যই কাউকে ঘৃণা করলো এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে কিছু দান করে আবার আল্লাহর জন্যই কাউকে দান করা হতে বিরত থাকে -সে তার ঈমান পরিপূর্ণ করেছে। (আবু দাউদ)

পরিশে কথা হলো; ঈমানের মজবুতি এমন একটি বিষয় যেই ঈমানের মজবুতির উপর আল্লাহর সাহায্য ও সঙ্গ নির্ভর করে, তাই যার ঈমান যত বেশি মজবুত হবে, সে ততো বেশি আল্লাহর সাহায্য পাবে, আর বিপরীতে যে নিজের ঈমানের প্রতি যতটুকু গাফেল হবে এবং নিজের ঈমান বৃদ্ধি করার ফিকির ছেড়ে দেবে, তার থেকে আল্লাহর নুসরাত বা সাহায্য ততটুকু দূর হয়ে যাবে। অতএব এটি (আল্লাহর সাহায্য) ঈমানের সাথে জড়িত বিষয়।

তাই আমরা ঈমান মজবুতির জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট বেশি বেশি দোয়া করব এবং সাথে সাথে সকল প্রকারের বাহ্যিক প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তালা সর্বপ্রথম আমি অধমকে অতঃপর সকল মুসলিম ভাই বোনদের’কে এসবের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

(Visited 6,402 times, 9 visits today)