তিনটি মূলনীতি!

শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

তিনটি মূলনীতি

ও তার প্রমাণপঞ্জি

[ بنغالي –  Bengali – বাংলা ]

মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রহ.

—™

ثلاثة الأصول وأدلتها

محمد بن عبد الوهاب – رحمه الله –

ترجمة ومراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

অনুবাদ কৃতজ্ঞতা:

ইসলাম হাউজ

সূচীপত্র

ক্র শিরোনাম পৃষ্ঠা
চারটি বিষয় জানা অবশ্য-কর্তব্য
তিনটি বিষয় জানা অবশ্য কর্তব্য
মিল্লাতে ইবরাহীমের মূলকথা
তিনটি মূলনীতি
প্রথম মূলনীতি: রব সম্পর্কে জানা
দ্বিতীয় মূলনীতি: প্রমাণাদিসহ ইসলাম সম্পর্কে জানা ২১
প্রথম পর্যায়: ইসলাম ২১
দ্বিতীয় পর্যায়: ঈমান ২৭
তৃতীয় পর্যায়: ইহসান ২৮
১০ তৃতীয় মূলনীতি: রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানা ৩৩

 

[চারটি বিষয় জানা অবশ্য-কর্তব্য]

জেনে নাও, আল্লাহ তোমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন! চারটি বিষয়ের জ্ঞানলাভ করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

এক. ইলম বা দীনী জ্ঞান: আর তা এমন বিদ্যা যার সাহায্যে দলীল-প্রমাণসহ আল্লাহ, তাঁর নবী এবং দীন-ইসলাম সম্পর্কে সম্যক পরিচয় লাভ করা যায়।

দুই. ঐ জ্ঞান অনুযায়ী আমল করা।

তিন. তার দিকে (মানুষকে) আহ্বান করা।

চার. এই কর্তব্য পালনে সম্ভাব্য কষ্ট ও বিপদ-বিপর্যয়ে ধৈর্য ধারণ। উপরোক্ত কথার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ١ وَٱلۡعَصۡرِ ١ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَفِي خُسۡرٍ ٢ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣﴾ [العصر: ١،  ٣]

“কালের শপথ, সকল মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ সম্পাদন করেছে, আর যারা পরস্পরকে হক্ক তথা সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্য ধারণের নিরন্তর উপদেশ দিয়েছে তারা ব্যতীত।” [সূরা আল-আসর, আয়াত: ১-৩]

উপরে বর্ণিত সূরা সম্পর্কে ইমাম শাফে‘ঈ রহ. এই অভিমত পেশ করেছেন, “যদি আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির ওপর প্রমাণ পেশ করার জন্য এ সূরা ছাড়া অন্য কোনো কিছু অবতীর্ণ না করতেন, তাহলে এ সূরাই তাদের জন্য সব দিক দিয়ে যথেষ্ট হতো।”

ইমাম বুখারী রহ. তার সংকলিত সহীহ বুখারীর একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন: ‘বিদ্যার স্থান হচ্ছে কথা ও কাজের পূর্বে।’ এর সমর্থনে কুরআনের ঘোষণা:

﴿فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ﴾ [محمد: ١٩]

“কাজেই জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনোই ইলাহ নেই। আর (হে রাসূল) নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]

এখানে কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান ও বিদ্যার কথাই আল্লহ প্রথমে উল্লেখ করেছেন।

[তিনটি বিষয় জানা অবশ্য কর্তব্য]

জেনে রাখো, আল্লাহ তোমার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর নিন্মোক্ত তিনটি বিষয়ে জ্ঞানলাভ এবং সেমতে কাজ করা অবশ্য কর্তব্য।

এ তিনটি বিষয় হচ্ছে,

এক. আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, জীবিকা প্রদান করেছেন এবং তিনি আমাদেরকে কোনো দায়িত্বহীনভাবে ছেড়ে দেন নি। (বরং হেদায়াতের জন্য) তিনি আমাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন। যে ব্যক্তি তাঁর আদেশ পালন করবে তার বাসস্থান হবে জান্নাত এবং যে ব্যক্তি তাঁর আদেশ অমান্য করবে তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। এর প্রমান হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَآ إِلَيۡكُمۡ رَسُولٗا شَٰهِدًا عَلَيۡكُمۡ كَمَآ أَرۡسَلۡنَآ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ رَسُولٗا ١٥ فَعَصَىٰ فِرۡعَوۡنُ ٱلرَّسُولَ فَأَخَذۡنَٰهُ أَخۡذٗا وَبِيلٗا ١٦﴾ [المزمل: ١٥،  ١٦]

“নিশ্চয় আমরা তোমাদের প্রতি একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের ওপর সাক্ষীস্বরূপ, যেমন পাঠিয়েছিলাম একজন রাসূল ফির‘আউনের প্রতি। কিন্তু ফির‘আউন সেই রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করলো। ফলে আমরা তাকে পাকড়াও করলাম অত্যন্ত কঠোরভাবে।” [সূরা আল-মুয্‌যাম্মিল, আয়াত: ১৫-১৬]

দুই. ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আল্লাহ কাউকেই তাঁর অংশীদার বা শরীক হিসেবে পছন্দ করেন না- চাই তা কোনো নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতা হোন কিংবা কোনো প্রেরিত রাসূলই হোন না কেন। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨﴾ [الجن: ١٨]

“নিশ্চয় সাজদাহর স্থানসমূহ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহ্বান করো না”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

তিন. যারা রাসূলের আনুগত্য করেন এবং আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের পক্ষে এমন লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা মোটেই জায়েয নয়, যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরূদ্ধাচরণকারী। ঐ লোকেরা যদি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও হয়, তথাপিও নয়। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٖ مِّنۡهُۖ وَيُدۡخِلُهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ أُوْلَٰٓئِكَ حِزۡبُ ٱللَّهِۚ أَلَآ إِنَّ حِزۡبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٢٢﴾ [المجادلة: ٢٢]

“আল্লাহ ও শেষ দিবসের ওপর ঈমান পোষণকারী এমন কোনো সম্প্রদায়কে আপনি পাবেন না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারে। হোক না কেন তারা ঈমানদারদের পিতা, পুত্র বা ভ্রাতা কিংবা গোত্র-গোষ্ঠী। আল্লাহ এদের হৃদয়ে ঈমানকে শক্তিশালী করে রেখেছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত (ফিরিশতা তথা) আত্মিক শক্তি দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করে দেবেন যার নিম্নদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী, সেখানে তারা অবস্থান করবে চিরকাল। আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন তাদের ওপর এবং তারাও সন্তুষ্ট আল্লাহর ওপর। বস্তুত এরাই হচ্ছে আল্লাহর সেনাদল। জেনে রাখো, আল্লাহর এ সেনাদলই হবে পরিণামে সফলকাম।” [সূরা আল-মুজাদালাহ, আয়াত: ২২]

[মিল্লাতে ইবরাহীমের মূলকথা]

জেনে রাখো (আল্লাহ তাঁর আনুগত্য বরণ ও আদেশ পালনের জন্যে তোমাকে পথ প্রদর্শন করুন): নিশ্চয় একনিষ্ঠ আনুগত্যই হলো মিল্লাতে ইবরাহীমের মূলকথা। তা এই যে তুমি শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং শুধুমাত্র তাঁরই জন্য দীনকে খালেস করবে। আর আল্লাহ সকল মানুষকে এরই আদেশ দিয়েছেন এবং এ উদ্দেশ্যেই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦﴾ [الذاريات: ٥٦]

“আমি জিন্ন ও মানব জাতিকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।” [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫৬]

‘তারা আমারই ইবাদত করবে’-এর অর্থ, তারা আমার তাওহীদ তথা (রবুবিয়াত ও ইবাদতে) একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করবে। মূলকথা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ আদেশ হচ্ছে ‘তাওহীদ’।

আর আল্লাহর সর্ববৃহৎ নির্দেশটি হচ্ছে তাওহীদ। যার অর্থ সর্বপ্রকারের ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। পক্ষান্তরে তাঁর বড় নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে শির্ক। তার অর্থ, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে আহ্বান করা। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ ﴾ [النساء: ٣٦]

“এবং তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, অন্য কোনো কিছুকেই তাঁর সঙ্গে শরীক করবে না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬]

[তিনটি মূলনীতি- الأصول الثلاثة]

সুতরাং যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, সেই তিনটি মূলনীতি কি যা প্রত্যেক মানূষেরই জানা অবশ্য কর্তব্য? তুমি উত্তর দেবে যে, বিষয় তিনটি হলো,

প্রত্যেক মানুষ জানবে (১) তার রব সম্পর্কে (২) তাঁর দীন বা জীবন বিধান সম্পর্কে এবং (৩) তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে।

الأصل الأول

প্রথম মূলনীতি: রব সম্পর্কে জানা

যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “তোমার রব কে?” তা হলে বল, সেই মহান আল্লাহ যিনি আমাকে ও অন্যান্য সকল সৃষ্টি জীবকে তাঁর বিশেষ নি‘আমতসমূহ দ্বারা লালন পালন করেন। তিনি আমার একমাত্র মা‘বুদ, তিনি ব্যতীত আমার অন্য কোনো মা‘বুদ নেই। এর প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢﴾ [الفاتحة: ٢]

“যাবতীয় প্রশংসা কেবল আল্লাহরই জন্য যিনি সৃষ্টিকুলের রব।” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ১]

আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই হচ্ছে তাঁর সৃষ্ট বস্তু এবং আমিও সেই সৃষ্ট জগতের একটি অংশ মাত্র।

আর যখন তুমি জিজ্ঞাসিত হবে, “তুমি কিসের মাধ্যমে তোমার রবকে চিনেছ?”

তখন তুমি উত্তর দেবে, তাঁর নিদর্শনসমূহ ও তাঁর সৃষ্টিরাজির মাধ্যমে (আমি আমার রবকে চিনেছি)। আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে দিবা-রাত্রি, সূর্য-চন্দ্র আর তাঁর সৃষ্ট বস্তুসমূহের মধ্যে রয়েছে সাত আকাশ, সাত যমীন এবং যা কিছু তাদের ভিতরে এবং যা কিছু এতদুভয়ের মধ্যস্থলে রয়েছে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُۚ لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ٣٧﴾ [فصلت: ٣٧]

“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত্রি ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সাজদাহ করবে না, চন্দ্রকেও নয়। বরং সাজদাহ করবে একমাত্র সে আল্লাহকে যিনি ঐ সবকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে থাক।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৭]

অনুরূপ আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يُغۡشِي ٱلَّيۡلَ ٱلنَّهَارَ يَطۡلُبُهُۥ حَثِيثٗا وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتِۢ بِأَمۡرِهِۦٓۗ أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٥٤﴾ [الاعراف: ٥٤]

“নিশ্চয় তোমাদের রব হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি রজনীর দ্বারা দিবসকে সমাচ্ছন্ন করেন, যে মতে তার ত্বরিৎ গতিতে একে অন্যের অনুসরণ করে চলে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজিকে স্বীয় নির্দেশের অনুগতরূপে। জেনে নাও, সৃষ্টি করার ও হুকুম প্রদানের মালিক তো তিনিই। সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ কতই না বরকতময়।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]

আর যিনি রব হবেন তিনিই হবেন মা‘বুদ বা উপাস্য। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢١،  ٢٢]

“হে মানুষ! তোমরা ইবাদাত করবে সেই মহান রবের যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও। যিনি তোমাদের জন্যে যমীনকে করেছেন বিছানা স্বরূপ আর আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ। আর যিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি নাযিল করেন, অতঃপর এর দ্বারা উদ্গত করেন নানা প্রকার ফলশস্য তোমাদের জীবিকা হিসেবে। অতএব, তোমরা কোনো কিছুকেই আল্লাহর সমকক্ষ তথা অংশীদার করো না, অথচ তোমরা অবগত আছ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১-২২]

ইবন কাসীর বলেছেন, “যিনি এ সব জিনিসের সৃষ্টিকর্তা তিনিই তো ইবাদতের যোগ্য।”

[যেসব ইবাদাতের নির্দেশ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন]

 

যেসব ইবাদতের নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন তা হচ্ছে, ১. ইসলাম (পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন) ২. ঈমান (স্বীকৃতি দেওয়া তথা অন্তর, মুখ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা মেনে নেওয়া) ৩. ইহসান। (সার্বিক সুন্দরতমভাবে যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা)। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,

(ক) الدعاء (আদ-দো‘আ) প্রার্থনা, আহ্বান;

(খ) الخوف (আল-খাউফ) ভয়-ভীতি;

(গ) الرجاء (আর-রাজা) আশা-আকাঙ্খা;

(ঘ) التوكل (আত-তাওয়াক্কুল) নির্ভরশীলতা, ভরসা;

(ঙ) الرغبة (আর-রাগবাহ) অনুরাগ, আগ্রহ;

(চ) الرهبة (আর-রাহবাহ) শঙ্কা;

(ছ) الخشوع (আল-খুশূ‘) বিনয়-নম্রতা;

(জ) الخشية (আল-খাশিয়াত) ভীত হওয়া;

(ঝ) الإنابة (আল-ইনাবাহ) আল্লাহর অভিমুখী হওয়া, তাঁর দিকে ফিরে আসা;

(ঞ) الاستعانة (আল-ইস্তে‘আনাত) সাহায্য প্রার্থনা করা;

(ট) الاستعاذة (আল-ইস্তে‘আযা) আশ্রয় প্রার্থনা করা।

(ঠ) الاستغاثة (আল-ইস্তেগাসাহ) উদ্ধার প্রার্থনা;

(ড) الذبح (আয-যাবহ) যবাই করা;

(ঢ) النذر (আন-নযর) মান্নত করা ইত্যাদি।

এগুলোসহ আরও যে সব ইবাদতের নির্দেশ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন, সেগুলো কেবল আল্লাহর জন্যই করতে হবে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨﴾ [الجن: ١٨]

“আর সাজদাহর স্থানসমূহ একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। অতএব, আল্লাহর সঙ্গে কাউকেই আহ্বান করবে না।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

সুতরাং কেউ যদি উপরোক্ত বিষয়ের কোনো একটি কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে সম্পাদন করে তবে সে মুশরিক ও কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَمَن يَدۡعُ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ لَا بُرۡهَٰنَ لَهُۥ بِهِۦ فَإِنَّمَا حِسَابُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦٓۚ إِنَّهُۥ لَا يُفۡلِحُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ١١٧﴾ [المؤمنون: ١١٧]

“যে ব্যক্তি এক আল্লাহর সাথে অন্য কোনো উপাস্যকে আহ্বান করে, তার নিকট তার সমর্থনে কোনই যুক্তি প্রামাণ নেই তার হিসাব-নিকাশ হবে তার রবের কাছে। নিশ্চয় কাফের লোকেরা কখনই সফলকাম হবে না।” [সূরা মুমিনূন, আয়াত: ১১৭]

তাছাড়া হাদীসে এসেছে,

«الدُّعَاءُ مُخُّ العِبَادَةِ»

“দো‘আ বা প্রার্থনা হচ্ছে উবাদতের সারাংশ”।[1]

[দো‘আ হচ্ছে ইবাদত।] এর প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠﴾ [غافر: ٦٠]

“আর তোমাদের রব বলেন: তোমরা সকলে আমাকেই ডাকবে, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব, যারা আমার ইবাদত করতে অহঙ্কার করে, তারা তো জাহান্নামে প্রবেশ করবে অতিশয় ঘৃণিত অবস্তায়।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৬০]

ভয় করা ইবাদত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿فَلَا تَخَافُوهُمۡ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١٧٥﴾ [ال عمران: ١٧٥]

“অতঃপর তোমরা তাদের ভয় করবে না, বরং আমাকেই ভয় করে চলবে, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক। [সূরা আলে ইমরান: ১৭৫]

আশা করা ইবাদত। এর দলীল আল্লাহর বাণী,

﴿فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠﴾ [الكهف: ١١٠]

“অতএব, যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাৎ লাভের আশা-আকাঙ্খা পোষণ করে, সে যেন সৎ কর্ম করে। আর নিজ রবের ইবাদতে অপর কাউকে শরীক না করে।” [সূরা কাহাফ: ১১০]

নির্ভরশীলতা ইবাদত। এর দলীল আল্লাহর বাণী,

﴿وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ﴾ [المائ‍دة: ٢٣]  .

“আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করবে, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২৩]

আল্লাহ আরও বলেছেন,

﴿وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ﴾ [الطلاق: ٣]  .

“আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভরশীল হয়, তার জন্য তিনিই (আল্লাহ) যথেষ্ট।” [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ৩]

আগ্রহ, ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও বিনয় ইবাদত হিসেবে বিবেচিত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী

﴿إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ﴾ [الانبياء: ٩٠]

“নিশ্চয় এরা সৎকর্মে ত্বরিত ও সদা তৎপর ছিল। আর ভক্তি ও ভয় সহকারে আমাকে আহ্বান করতো এবং আমার প্রতি এরা বিনয়-বিনম্র।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯০]

ভীত-শঙ্কিত থাকা ইবাদত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿فَلَا تَخۡشَوۡهُمۡ وَٱخۡشَوۡنِي﴾ [البقرة: ١٥٠]

“সুতরাং তোমাদের তাদের ভয় করো না, একমাত্র আমাকেই ভয় করে চল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫০]

নৈকট্যলাভের কামনা এবং কৃত পাপের জন্যে অনুশোচনা ইবাদত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَأَنِيبُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَأَسۡلِمُواْ لَهُۥ﴾ [الزمر: ٥٤]

“আর তোমরা সকলে স্বীয় রবের পানে ফিরে এসো এবং তাঁরই নিকট সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণ কর।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৪]

সাহায্য প্রার্থনা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত: এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ [الفاتحة: ٥]

“(হে আমাদের রব), আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি আর একমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৪]

আর হাদীসে এসেছে,

«وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ».

“যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন একমাত্র আল্লাহর নিকটেই তা (বিনম্রভাবে) চাইবে।”[2]

আশ্রয় চাওয়া ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿قُلۡ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ ١ مَلِكِ ٱلنَّاسِ ٢﴾ [الناس: ١،  ٢]

“বল, আমি মানুষের রব ও মানুষের অধিপতির নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” [সূরা আন-নাস, আয়াত: ১,২]

উদ্ধার কামনা করা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿إِذۡ تَسۡتَغِيثُونَ رَبَّكُمۡ فَٱسۡتَجَابَ لَكُمۡ﴾ [الانفال: ٩]

“আরও (স্মরণ কর) যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে উদ্ধারের জন্য আবেদন জানিয়েছিলে তখন তিনি তোমাদের আবেদনে সাড়া দিলেন (কবুল করলেন)”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৯]

জবেহ করাও ইবাদত: এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣﴾ [الانعام: ١٦٢،  ١٦٣]

“(হে রাসূল) বলে দাও, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্যই। তাঁর কোনোই শরীক নেই এবং আমি এ জন্য আদিষ্ট আর আমিই হচ্ছি মুসলিমদের অগ্রণী”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬২-১৬৩]

হাদীসে এসেছে,

«لَعَنَ اللهُ مَن ذَبَحَ لِغَيرِ اللهِ».

“যারা অপরের নামে যবেহ করে আল্লাহ তাদের অভিশাপ দেন।”[3]

মান্নত পূর্ণ করাও ইবাদত। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿يُوفُونَ بِٱلنَّذۡرِ وَيَخَافُونَ يَوۡمٗا كَانَ شَرُّهُۥ مُسۡتَطِيرٗا ٧﴾ [الانسان: ٧]

“তারা অঙ্গীকার পূরণ করে আর সেদিনকে (কিয়ামত দিবসকে) ভয় করে, যে দিনের বিপদ-আপদ হবে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী।” [সূরা আদ-দাহার, আয়াত: ৭]

 

الأصل الثاني

দ্বিতীয় মূলনীতি: প্রমানাদিসহ ইসলাম সম্পর্কে জানা

আর দীন-ইসলাম হচ্ছে, তাওহীদ বা এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ, অকুণ্ঠ নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর আনুগত্য বরণ এবং শির্ক থেকে মুক্ত থাকা।

বস্তুত দীনের রয়েছে তিনটি পর্যায়,

(ক) ইসলাম, (খ) ঈমান ও (গ) ইহসান।

المرتبة الأولى

প্রথম পর্যায়: ইসলাম

ইসলামের রুকন বা স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি:

১) ‘আল্লাহ ব্যতীত নেই কোনো হক্ব মা‘বুদ এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল’- একথার সাক্ষ্য প্রদান করা।

২) সালাত সুপ্রতিষ্ঠিত করা।

৩) যাকাত প্রদান করা।

৪) রামাযান মাসের সাওম পালন করা।

৫) আল্লাহর ঘর হজ করা।

[ইসলামের রুকনসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা]

প্রথম রুকন: কালেমায়ে শাহাদাত এর পক্ষে প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]

“আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, একমাত্র তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই। আর ফিরিশতাবৃন্দ এবং জ্ঞানবান ব্যক্তিগণও ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে ঘোষণা করেন যে, মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]

এর অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে একমাত্র তিনি আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো ইবাদতের যোগ্য ইলাহ নেই।

এর দু’টি দিক রয়েছে, একটি নেতিবাচক, অপরটি ইতিবাচক। নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে, ‘কোনোই মা‘বুদ নেই’ এর দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছুর ইবাদত করা হয় তা সম্পূর্ণরূপে নাকচ করা হয়েছে। আর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত’ এর দ্বারা ইবাদত দৃঢ়তার সঙ্গে একমাত্র আল্লাহ’র জন্যই সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর রাজত্বে যেমন কোনো অংশীদার নেই, তেমনি তাঁর ইবাদত ক্ষেত্রেও কোনো অংশীদার থাকতে পারে না।

এ তাওহীদ বা একত্ববাদের তাফসীর ও ব্যাখ্যা এসেছে আল্লাহর বাণী কুরআনে। যেমন, আল্লাহর বাণী,

﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦٓ إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُۥ سَيَهۡدِينِ ٢٧ وَجَعَلَهَا كَلِمَةَۢ بَاقِيَةٗ فِي عَقِبِهِۦ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢٨﴾ [الزخرف: ٢٦،  ٢٨]

“আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম নিজ পিতা ও নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমরা যে সব মূর্তির পূজা অর্চনা করছ আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, আমি তাঁরই ইবাদত করি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আর তিনিই আমাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন এবং ইবরাহীম এক চিরন্তন কালেমারূপে রেখে গেছেন তাঁর পরবর্তীদের জন্যে, যাতে তারা সেই বাণীর পানে ফিরে যেতে পারে। [সূরা আয-যুখরূফ, আয়াত: ২৬-২৮]

অনুরূপ আল্লাহর অপর বাণী,

﴿قُلۡ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ كَلِمَةٖ سَوَآءِۢ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ أَلَّا نَعۡبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشۡرِكَ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَتَّخِذَ بَعۡضُنَا بَعۡضًا أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُولُواْ ٱشۡهَدُواْ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٦٤﴾ [ال عمران: ٦٤]

“বল, হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন এক বাণীর প্রতি আস যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান। আর তা হচ্ছে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত করবো না, আমরা কোনো কিছুই তাঁর শরীক করব না। আর আমরা আল্লাহকে ছেড়ে একে অপরকে কস্মিনকালেও রব বলে গ্রহণ করব না, কিন্তু তারা যদি এতে পরাম্মুখ হয়, তাহলে তোমরা (আহলে কিতাবদের) বলে দাও, জেনে রাখো, আমরা হচ্ছি আল্লাহতে আত্মসমর্পিত মুসলিম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪]

আর ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্যের স্বপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿ لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨﴾ [التوبة: ١٢٨]

“অবশ্যই তোমাদের কাছে সমাগত হয়েছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল যাঁর পক্ষে দূর্বহ ও অসহনীয় হয়ে থাকে তোমাদের দুঃখকষ্টগুলো, যিনি তোমাদের প্রতি সদা সচেতন। মুমিনদের প্রতি যিনি চির স্নেহশীল ও দয়াবান।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১২৮]

আর ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে,

১. তিনি যা আদেশ করেছেন তা অনূসরণ করা।

২. তিনি যে বিষয়ের সংবাদ প্রদান করেছেন তা সত্য বলে স্বীকার করা।

৩. তিনি যা থেকে নিষেধ করেন তা বর্জন করা এবং

৪. কেবল তাঁর প্রবর্তিত শরী‘আত অনুযায়ীই আল্লাহর ইবাদত করা।

 

[দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকন সালাত, যাকাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা]

আর সালাত, যাকাতের প্রমাণ এবং তাওহীদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে আল্লাহর বাণী,

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥﴾ [البينة: ٥]

“আর তাদের তো কেবল এ আদেশই দেওয়া হয়েছিল যে, তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করে দীন ইসলামকে খালেস করে নিবে কেবল আল্লাহর জন্য। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত প্রদান করবে। আর এটাই হচ্ছে সুদৃঢ় দীন।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

[চতুর্থ রুকন সাওমের ব্যাখ্যা]

সাওমের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣﴾ [البقرة: ١٨٣]

“হে ঈমানদারগণ, সিয়াম সাধনা তোমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩]

[পঞ্চম রুকন সম্পর্কে ব্যাখ্যা]

হজের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ﴾ [ال عمران: ٩٧]

“আর আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে সফরের সামর্থ রাখে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে কা’বাগৃহের হজ করা ফরয, কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি এ আদেশ অমান্য করে তা হলে (জেনে রাখ) আল্লাহ সৃষ্টিকুল থেকেই অমুখাপেক্ষী।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]

المرتبة الثانية

দ্বিতীয় পর্যায় : ঈমান

ঈমানের শাখা-প্রশাখা সত্তরেরও অধিক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে উচ্চারণ করা। আর সর্বনিম্ন হচ্ছে পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরে সরিয়ে দেয়া, আর লজ্জাশীলতা হচ্ছে, ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে একটি শাখা।

তবে ঈমানের রুকন বা স্তম্ভ হচ্ছে ছয়টি:

(১) আল্লাহর ওপর ঈমান।

(২) ফিরেশতাগণের ওপর ঈমান।

(৩) আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমান।

(৪) রাসূলগণের ওপর ঈমান।

(৫) শেষ দিবসের ওপর ঈমান।

(৬) তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান।

ছয়টি রুকনের দলীল হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ﴾ [البقرة: ١٧٧]

“তোমরা পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাবে এতে কোনোই পূণ্য ও কল্যাণ নেই; বরং পূণ্য হচ্ছে যে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফিরিশতাকুল, কিতাবসমূহ ও নবীগণের ওপর ঈমান আনয়ন করে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭]

আর তাকদীর এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّا كُلَّ شَيۡءٍ خَلَقۡنَٰهُ بِقَدَرٖ ٤٩﴾ [القمر: ٤٩]

“নিশ্চয় আমরা প্রতিটি জিনিসের তাকদীর নির্ধারণ করে সৃষ্টি করেছি।” [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ৪৯]

المرتبة الثالثة

তৃতীয় পর্যায় : ইহসান

ইহসান-এর স্তম্ভ মাত্র একটি, আর তা হচ্ছে,

‘আল্লাহর ইবাদত করার সময় তুমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছ এটা মনে করা, আর যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও তবে এ কথা মনে করে নেওয়া যে, নিশ্চয় তিনি তোমাকে দেখছেন।’

ইহসানের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨﴾ [النحل: ١٢٨]

“নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও ইহসান অবলম্বন করে, আল্লাহ (জ্ঞানে এবং সাহায্য-সহযোগিতায়) তাদের সঙ্গে রয়েছেন।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৮]

অনুরূপ আল্লাহর বাণী,

﴿وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ ٢١٧ ٱلَّذِي يَرَىٰكَ حِينَ تَقُومُ ٢١٨ وَتَقَلُّبَكَ فِي ٱلسَّٰجِدِينَ ٢١٩ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٢٢٠﴾ [الشعراء: ٢١٧،  ٢٢٠]

“আর ভরসা কর সেই পরাক্রান্ত ও দয়াবানের ওপর, যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি সালাতে দাঁড়াও আর যখন তুমি সালাত আদায়কারীদের সঙ্গে উাঠাবসা কর। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ২১৭-২২০]

তদ্রূপ আল্লাহর অপর বাণী,

﴿وَمَا تَكُونُ فِي شَأۡنٖ وَمَا تَتۡلُواْ مِنۡهُ مِن قُرۡءَانٖ وَلَا تَعۡمَلُونَ مِنۡ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيۡكُمۡ شُهُودًا إِذۡ تُفِيضُونَ فِيهِۚ﴾ [يونس: ٦١]

“এবং তুমি (হে রাসূল) যে কোনো পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থান কর না কেন, আর তা সম্পর্কে কুরআন থেকে যা কিছু তিলাওয়াত কর না কেন এবং তোমরা যে কোনো কর্ম সম্পাদন কর না কেন আমরা সে সবের পূর্ণ পর্যবেক্ষক হয়ে থাকি; যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬১]

এ-সম্পর্কে হাদীসের প্রমাণ হচ্ছে, জিবরীল ‘আলাইহিস সালামের এ সুপ্রসিদ্ধ হাদীস যা ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “একবার আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম এমতাবস্থায় সেখানে মিশমিশে কাল কেশ, ধবধবে সাদা পোষাক পরিহিত একজন মানুষ এসে উপস্থিত হলেন। ভ্রমণের কোনো নিদর্শনই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল না, অথচ আমরা কেউ তাকে চিনতে পারি নি। অতঃপর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসলেন এবং হস্তদ্বয় তাঁর উরুদেশে রাখলেন, এরপর বললেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করুন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম হচ্ছে, এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্যিকার মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সালাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। সালাত প্রতিষ্ঠা করা। যাকাত প্রদান করা রমযান মাসের সাওম পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর ঘরের হজ করা।

আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন। এতে আমরা আশ্চর্য হলাম যে, তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করছেন আবার নিজেই তার সত্যায়ন করছেন।

অতঃপর তিনি বললেন: আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবহিত করুন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঈমান হলো) আল্লাহ, ফিরিশতাকুল, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের ওপর ঈমান আনয়ন করা।

এরপর আগন্তুক বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে সংবাদ দিন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তুমি ইবাদতে লিপ্ত হবে, তখন তুমি যেন আল্লাহকে দেখছ এ কথা মনে করতে হবে, আর যদি এটা সম্ভব নাও হয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।

অতঃপর আগন্তুক বললেন, “আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন” নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞেসকারী অপেক্ষা অধিক জানে না।

এরপর আগন্তুক বললেন, তাহলে আমাকে কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে জানান। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন,

যখন পরিচারিকা স্বীয় মালিকের জন্ম দেবে, নগ্নদেহ ও নগ্ন পদ বিশিষ্ট ও জীর্ণ-শীর্ণ পোষাক পরিহিত ছাগলের রাখালরা সুউচ্চ অট্টালিকায় বসবাস করবে।

হাদীস বর্ণনাকারী বললেন, আগন্তুক পরক্ষণেই প্রস্থান করলেন। এরপর আমরা কিছুক্ষণ নীরব নিস্তব্ধ থাকলাম। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে উমার, তুমি কি জান প্রশ্নকারী কে ছিলেন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি হচ্ছেন জিবরীল, তিনি তোমাদেরকে দীন শিক্ষা প্রদানার্থে তোমাদের কাছে এসেছিলেন।’[4]

الأصل الثالث

তৃতীয় মূলনীতি: নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানা

তৃতীয় মূলনীতি হচ্ছে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানা। তিনি হচ্ছেন, মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ তথা আবদুল্লাহর পুত্র, তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিব, তাঁর পিতা হাশেম। হাশেম কুরাইশ বংশের লোক এবং এটি আরব কাওম ও গোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী ইবরাহীম খলীলুল্লাহর পুত্র ইসলাইলের বংশ হতে উদ্ভুত। (তার ওপর এবং আমাদের নবীর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক)।

তিনি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি তেষট্টি (৬৩) বছর জীবিত ছিলেন, নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর এবং “নবী ও রাসূল” হিসেবে তেইশ বছর (অতিবাহিত করেছেন)।

তাকে সূরা “ইকরা” নাযিল করার মাধ্যমে নবী এবং সূরা মুদ্দাসসির নাযিল করার মাধ্যমে রাসূল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শির্ক থেকে সতর্ক করার জন্যে এবং তাওহীদ তথা অদ্বিতীয় আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেন।

এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمُدَّثِّرُ ١ قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢ وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ وَٱلرُّجۡزَ فَٱهۡجُرۡ ٥ وَلَا تَمۡنُن تَسۡتَكۡثِرُ ٦ وَلِرَبِّكَ فَٱصۡبِرۡ ٧﴾ [المدثر: ١،  ٧]

“হে কম্বলে দেহ আবৃতকারী। উঠে দাঁড়াও, সকলকে সতর্ক কর ও নিজ রবর মহিমা ঘোষণা কর। বস্ত্রসমূহ পাক-সাফ রাখ, শির্কের কদর্যতাকে সম্পূর্ণ বর্জন কর, বিনিময় লাভের আশায় ইহসান করো না। আর নিজ প্রভূর (আদেশ পালনে) ধৈর্য ধারণ কর। [সূরা আল- মুদ্দাসসির, আয়াত: ১-৭]

এখানে               ﴿قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢﴾ [المدثر: ٢]

“উঠে দাঁড়াও ও সতর্ক কর” এর অর্থ, শির্কের বিরুদ্ধে সতর্ক কর এবং তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানাও।

﴿وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣﴾ [المدثر: ٣]

“আর তোমার রবের মহিমা ঘোষণা কর” এর অর্থ তাওহীদের মাধ্যমে আল্লাহর মাহাত্ম্য প্রচার কর।

﴿ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ ﴾ [المدثر: ٤]

“আর তোমার পোষাক পরিচ্ছদ পাক-সাফ রাখ” এর অর্থ “আমলসমূহ”কে শির্কের কলুষ-কালিমা থেকে পবিত্র রাখ।

﴿ وَٱلرُّجۡزَ فَٱهۡجُرۡ ٥ ﴾ [المدثر: ٥]

“আর কদর্যতা বর্জন কর” এর মধ্যে ‘রুজয’ এর অর্থ প্রতিমা আর ‘হাজর’ এর অর্থ ছেড়ে দেওয়া। সুতরাং আয়াতের পূর্ণ অর্থ হচ্ছে, প্রতিমা পূজা ও পূজকদের ত্যাগ করা, প্রতিমা থেকে সম্পর্কচ্ছুতি এবং পূজকদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করা।

তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দশ বছর ধরে এ তাওহীদের দিকেই মানুষদের আহ্বান জানিয়েছেন। তারপর তাকে আসমানে মি‘রাজে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়। অতঃপর মক্কা ভূমিতে তিন বছর উক্ত সালাত সূচারুরূপে সম্পাদনের পর মদীনায় হিজরত করার আদেশপ্রাপ্ত হন।

হিজরতের অর্থ শির্ক-কলুষিত স্থান পরিত্যাগ করে ইসলামী রাজ্যে গমন করা। এ উম্মতের (উম্মতে মুহাম্মাদীয়া) জন্য শির্ক-কলুষিত স্থান থেকে ইসলামী রাজত্বে হিজরত করা ফরয। এ হিজরত কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুন্ন ও অব্যাহত থাকবে।

এর সপক্ষে প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَالُواْ فِيمَ كُنتُمۡۖ قَالُواْ كُنَّا مُسۡتَضۡعَفِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ قَالُوٓاْ أَلَمۡ تَكُنۡ أَرۡضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةٗ فَتُهَاجِرُواْ فِيهَاۚ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ٩٧ إِلَّا ٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ لَا يَسۡتَطِيعُونَ حِيلَةٗ وَلَا يَهۡتَدُونَ سَبِيلٗا ٩٨ فَأُوْلَٰٓئِكَ عَسَى ٱللَّهُ أَن يَعۡفُوَ عَنۡهُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَفُوًّا غَفُورٗا ٩٩﴾ [النساء: ٩٧،  ٩٩]

“নিশ্চয় যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের ‘জান কবয’ করার সময় ফিরিশতাগণ বলবে, কি অবস্থায় তোমরা ছিলে? তারা বলবে, আমরা মাটির পৃথিবীতে ছিলাম অসহায় অবস্থায়। ফিরিশতাকূল বলবেন: আল্লাহর দুনিয়া কি এতটা প্রশস্ত ছিল না, যাতে তোমরা হিজরত করতে পারতে? অতএব, এরা হচ্ছে সেই সব লোক যাদের শেষ আশ্রয় হবে জাহান্নাম। আর এ হচ্ছে নিকৃষ্টতম আশ্রয়স্থল। কিন্ত যেসব আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এমনভাবে অসহায় হয়ে পড়ে যে, কোনো উপায় উদ্ভাবন করতে তারা সমর্থ হয় না, এমন কি পথ সম্পর্কেও তারা কোনো সহায় সম্বল খুঁজে পায় না, এদের আল্লাহ ক্ষমার আশ্বাস দিচ্ছেন, বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাশীল ও পাপ মোচনকারী”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৯৭-৯৯]

অনুরূপ আল্লাহর বাণী,

﴿يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ أَرۡضِي وَٰسِعَةٞ فَإِيَّٰيَ فَٱعۡبُدُونِ ٥٦﴾ [العنكبوت: ٥٦]

“হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয় আমার যমীন প্রশস্ত। অতএব, তোমরা একমাত্র আমারই বান্দেগী করতে থাক” [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫৬]

ইমাম বাগাভী রহ. বলেন, “এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ এই যে, যে সব মুসলিম হিজরত না করে মক্কায় রয়েছে, আল্লাহ তাদের ঈমানের সম্বোধন করে আহ্বান করেছেন।”

হিজরতের সমর্থনে হাদীস থেকে প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী,

«لَا تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتَّى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ، وَلَا تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا»

“তাওবা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবে না আর সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত না হওয়া পর্যন্ত তওবার দ্বারও বন্ধ হবে না।”[5]

অতঃপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান সম্পন্ন করেন তখন অন্যান্য আদেশগুলো প্রাপ্ত হন; যথা যাকাত, সাওম, হজ, আযান, জিহাদ, ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ ইত্যাদি ইসলামী শরী‘আতের বিধানসমূহ।

হিজরতের পরের দশ বছর তিনি মদীনায় অতিবাহিত করেন। এরপর তিনি মারা যান (আল্লাহর যাবতীয় সালাত ও সালাম তার ওপর অজস্র ধারায় বর্ষিত হোক) এমতাবস্থায় যে, তাঁর প্রচারিত দীন তখন বর্তমান ছিল, আর এখনও যে দীন রয়েছে সেটা তাঁরই। তিনি তাঁর উম্মতকে যাবতীয় সৎকর্ম সম্পর্কে অবহিত করেন আর যাবতীয় অপকর্ম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। সর্বোত্তম যে পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন তা হচ্ছে তাওহীদের পথ, আর দেখিয়েছেন সেই পথ যা আল্লাহর নিকট প্রিয় এবং তাঁর পছন্দনীয়। পক্ষান্তরে সর্ব নিকৃষ্ট বস্তু যা থেকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন তা’ হচ্ছে শির্ক এবং এমন সব কাজ যা আল্লাহ অপছন্দ করেন।

আল্লাহ নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এই নিখিল ধরণীর সকল মানুষের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং সকল জিন্ন ও মানুষের পক্ষে তার আনুগত্য অপরিহার্য করে দিয়েছেন।

এর প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী,

﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا﴾

“বল (হে নবী) হে মানুষ, আমি (আল্লাহ কর্তৃক) তোমাদের সকলের জন্য প্রেরিত রাসূল।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]

মহান আল্লাহ স্বীয় নবীর মাধ্যমে তাঁর এই দীনকে পূর্ণতা প্রদান করেছেন। এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣]

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম, তোমাদের ওপর আমার নি‘আমতকে সুসম্পন্ন করলাম আর ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মারা গেছেন তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّكَ مَيِّتٞ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ ٣٠ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ عِندَ رَبِّكُمۡ تَخۡتَصِمُونَ ٣١﴾ [الزمر: ٣٠،  ٣١]

“(হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার মৃত্যু হবে এবং তাদেরকেও মরতে হবে। তারপর তোমরা সকলে তোমাদের রবের নিকটে বিবাদ বিসম্বাদ করবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩১-৩২]

আর মানুষ যখন মারা যাবে, তখন তাকে অবশ্যই (কিয়ামতের দিন) পুনরুত্থিত করা হবে। এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿مِنۡهَا خَلَقۡنَٰكُمۡ وَفِيهَا نُعِيدُكُمۡ وَمِنۡهَا نُخۡرِجُكُمۡ تَارَةً أُخۡرَىٰ ٥٥﴾ [طه: ٥٥]

“আমরা তোমাদেরকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছি আর তার মাধ্যেই তোমাদের প্রত্যাবর্তিত করব এবং তার থেকেই একদিন আবার তোমাদেরকে বের করে আনব।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ৫৫]

আল্লাহর অপর বাণী,

﴿وَٱللَّهُ أَنۢبَتَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ نَبَاتٗا ١٧ ثُمَّ يُعِيدُكُمۡ فِيهَا وَيُخۡرِجُكُمۡ إِخۡرَاجٗا ١٨﴾ [نوح: ١٧،  ١٨]

“আল্লাহ তোমাদের যমীন হতে উদ্ভুত করেছেন এক বিশেষ প্রণালীতে। এরপর তিনি তোমাদেরকে আবার তাতে প্রত্যাবর্তিত করাবেন এবং (এর মধ্য থেকে) বের করবেন যথাযথভাবে।” [সূরা নূহ, আয়াত: ১৭-১৮]

আর পুনরুত্থানের পর প্রত্যেক (জিন্ন ও ইনসান) থেকে তার কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব-নিকেশ নেওয়া হবে এবং তাদের আমল অনুযায়ী পুরস্কার অথবা শাস্তি প্রদান করা হবে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَلِلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ لِيَجۡزِيَ ٱلَّذِينَ أَسَٰٓـُٔواْ بِمَا عَمِلُواْ وَيَجۡزِيَ ٱلَّذِينَ أَحۡسَنُواْ بِٱلۡحُسۡنَى ٣١﴾ [النجم: ٣١]

“আর নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে অবস্থিত সব কিছু একমাত্র আল্লাহরই। যাতে তিনি দুষ্কর্মকারীদেরকে তাদের কর্মানুসারে উপযুক্ত প্রতিফল প্রদান করেন, পক্ষান্তরে যারা ইহসান (যথাযথভাবে সুচারুরূপে সম্পন্ন) করেছে তাদেরকে পুণ্যফল দিবেন জান্নাতের মাধ্যমে।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩১]

আর যারা পুনরুত্থান দিবসে মিথ্যারোপ করে, তারা কাফের। এর প্রমাণ মহান আল্লাহর বাণী,

﴿زَعَمَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَن لَّن يُبۡعَثُواْۚ قُلۡ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتُبۡعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلۡتُمۡۚ وَذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧﴾ [التغابن: ٧]

“কাফেররা মনে করে যে, তাদের পুনরুত্থিত করা হবে না। (হে রাসূল), তুমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দাও, অবশ্যই হাঁ, আমার রবের শপথ, নিশ্চয় তোমাদের উত্থিত করা হবে, তখন তোমাদের জ্ঞাত করানো হবে, আর আল্লাহর নিকট এ কাজ অতি সহজ।” [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৭]

আল্লাহ তা‘আলা সব নবীদের প্রেরণ করেছেন জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রদানার্থে আর জাহান্নাম থেকে সতর্ক করার জন্য। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿رُّسُلٗا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ﴾ [النساء: ١٦٥]

“এই রাসূলগণকে (আমরা প্রেরণ করেছিলাম) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে যেন রাসূলগণের আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানবকূলের পক্ষে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো কিছুই না থাকে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৫]

রাসূলদের মধ্যে নূহ ‘আলাইহিসসালাম প্রথম আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ। আর তিনি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্বারাই নবী-রাসূল প্রেরণের ধারা সমাপ্ত হয়েছে।

নূহ ‘আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম রাসূল। এর প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ﴾ [النساء: ١٦٣]

“নিশ্চয় আমরা অহী প্রেরণ করেছি তোমার প্রতি যেমন অহী প্রেরণ করেছিলাম নূহের প্রতি ও তাঁর পরবর্তী নবীগণের প্রতি”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৩]

নূহ ‘আলাইহিসসালাম থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যত জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকেই তাদের উম্মতদের নির্দেশ দিতেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তাগুতের পূজা থেকে বিরত থাকতে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾

“আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি যেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং সকল প্রকার তাগুতকে পরিহার কর।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৩৬]

আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষের ওপর তাগুতকে অস্বীকার করা এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন করা ফরয করে দিয়েছেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “তাগুত” বলতে এমন কিছুকে বুঝায়, কোনো বান্দা যাকে নিয়ে (দাসত্বের) সীমা অতিক্রম করেছে; হতে পারে তা কোনো উপাস্য অথবা অনুসৃত ব্যক্তি অথবা আনুগত্যকৃত সত্তা। বস্তুত তাগুতের সংখ্যা অনেক। তবে এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে পাঁচটি:

(১) শয়তান (তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ নিপতিত হোক)।

(২) যার উপাসনা করা হয় এবং সে উক্ত উপাসনায় সম্মত।

(৩) যে নিজের উপাসনার দিকে মানুষদের আহ্বান জানায়।

(৪) যে ব্যক্তি গায়েবী জ্ঞান আছে বলে দাবী করে।

(৫) যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত বিচার ফয়সালা করে। এর প্র্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦﴾ [البقرة: ٢٥٦]

“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো প্রকার জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ নেই। নিশ্চয় হিদায়াত থেকে বিভ্রান্তি স্পষ্টরূপে পৃথক হয়ে গেছে। তাই যে ব্যক্তি “তাগুতকে” অমান্য করল এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনল, নিশ্চয় সে এমন একটি সুদৃঢ় বন্ধন বা অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরল যা কোনো দিন ছিন্ন হবার নয়। বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]

এটাই হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ ও তাৎপর্য।

আর হাদীসে এসেছে,

«رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ»

“দীনের শীর্ষে রয়েছে ইসলাম, এর স্তম্ভ হচ্ছে সালাত, আর এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জিহাদ”[6]

আর আল্লাহই হচ্ছেন সর্বজ্ঞ।

তুমি আল্লাহকে জেনেছ? তার দীনকে? রিসালাত নিয়ে যিনি প্রেরিত হয়েছেন তোমাদের নিকট, চেন তাকে? পরজগতের দীর্ঘ সফরের সূচনায় ব্যক্তি সর্বপ্রথম যে বাস্তবতার মুখোমুখী হবে, তা এই তিনটি প্রশ্ন ও তার উত্তর। প্রশ্নগুলো কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ইসলামের তিন মূলনীতি।

[1] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭১, তবে তার সনদ দুর্বল। এর সমর্থনে সহীহ হাদীস হচ্ছে, «الدُّعَاءُ هُوَ العِبَادَةُ» “দো‘আই হচ্ছে ইবাদাত”। যা তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭২ বর্ণনা করেছেন।

[2] তিরমিযী, হাদীস নং ২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ ১/২৯৩; হাদীস নং ২৬৬৯।

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭৮।

[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০।

[5] আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৭৯।

[6] তিরমিযী, হাদীস নং ২৬১৬।

ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ!

শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ

ডাউনলোড

জেনে রাখুন, ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয় দশটি:

Continue reading

সূরা ফাতিহার তাফসীর!

সূরা ফাতিহার তাফসীর

শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন 

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

 

সূরা আল-ফাতিহা-এর তাফসীর

শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রহ.

অনুবাদঃ মুহাম্মাদ রকীবুদ্দীন হুসাইন

কৃতজ্ঞতায় – ইসলাম হাউজ

সূচীপত্র

এক নজরে শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব তামীমী রহ. 4

ইন্তে’আযা’ (আউযুবিল্লাহর তাফসীর) 11

“বাসমালাহ’ (বিসমিল্লাহ-এর তাফসীর) 12

সূরা আল-ফাতিহা-এর তাফসীর 13

এক নজরে শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব তামীমী রহ.

শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. হিজরি দ্বাদশ শতাব্দীর এক অন্যতম ধর্ম সংস্কারক ছিলেন। তিনি ১১১৫ হিজরি মোতাবেক ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে সউদী আরবের নাজদ এলাকায় আল-‘উয়াইনা নামক শহরে এক ধর্মপ্রাণ ও সম্মানিত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আল ‘উয়াইনা শহরটি সউদী আরবের বর্তমান রাজধানী রিয়াদের প্রায় ৭০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাবের পিতা ছিলেন আল-‘উয়াইনার একজন বিচারপতি। বংশগত দিক দিয়ে তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ তামীম গোত্রীয়। হাম্বালী মাযহাবের তৎকালীন একজন খ্যাতনামা আলেম হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বার বৎসর বয়সে পদার্পণ করার আগেই পবিত্র কুরআন মাজীদ হিফয করেন। এরপর তার পিতাসহ স্থানীয় উলামাদের কাছে ফিকহ, তাফসীর ও হাদিস শাস্ত্রের অধ্যয়ন শুরু করেন। তারপর তিনি আরো অধিক বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে সফরে বের হন। প্রথমে হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামা গমন করেন। সেখানে থেকে মদিনা মুনাওয়ারা যিয়ারতে যান এবং সেখানকার আলেমগণের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেন।

মদিনায় থাকাকালীন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর ও বাকী’য়ে গারকাদ (বাকী গোরস্থান) কে কেন্দ্র করে কিছু লোকের বিদ’আত ও অবৈধ ক্রিয়া-কর্মের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেন এবং তাদের এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নসিহত করেন।

অতঃপর তিনি স্বীয় এলাকা নাজদে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছু দিন পর তিনি বসরা সফরে বের হন। সেখানে বিদ’আত ও কুসংস্কার যা দেখতে পেলেন তা ছিল মদিনা মুনাওয়ারায় সংঘটিত কুসংস্কারের চেয়েও অধিক ও মারাত্মক। সেখানে ছিল সজ্জিত কবরসমূহ, কিছু লোক এগুলোর তাওয়াফ করত এবং বরকত লাভের উদ্দেশ্যে মাসেহ (স্পর্শ) করত। এতদ্ব্যতীত ছিল আরো অনেক বিদ’আত ও কুসংস্কার, যা দেখে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং সেখানকার লোকদের এ জাতীয় কাজ করতে নিষেধ করেন।

কিন্তু শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাবের বিদ’আত বিরোধী এ ভূমিকা সেখানকার লোকেরা গ্রহণ করতে পারে নি। তারা তাকে বসরা থেকে বের করে দিল। শূন্যপথ, শূন্যহাত ও নগ্নমস্তকে অসহায় অবস্থায় গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মাঝে তিনি বসরা থেকে বের হয়ে পড়েন। পথিমধ্যে পিপাসায় মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠেছিল। আল্লাহর রহমতে জুবায়র বাসীরা তাকে আশ্রয় দিয়ে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করে।

কথিত আছে যে, তিনি বসরা ত্যাগের পর সিরিয়া অভিমুখে যাওয়ার মনস্থ করেছিলেন; কিন্তু আর্থিক অসুবিধার জন্য সেদিকে না গিয়ে আল-আহসার পথে নাজদ প্রত্যাবর্তন করেন।

দেশে ফিরে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব হারীমলা নামক শহরে পিতার সাথে অবস্থান শুরু করেন। ইতিপূর্বে তার পিতা আল-‘উয়াইনা থেকে হারীমলায় বদলি হয়ে যান। হিজরি ১১৫৩ সনে তার পিতা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি একাই দাওয়াত ও সংস্কারের কাজে সমূহ বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে থাকেন। এ সময়ে তিনি তাওহীদের ওপর বই লিখা শুরু করেন।

বিভিন্ন দিক থেকে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তার সুনাম ও দাওয়াতের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হারীমলাবাসীরা তার দাওয়াত ও সংস্কারমূলক কাজে একমত হতে না পেরে তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে দেয়। এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাকে রক্ষা করেন।

এরপর তিনি আল- ‘উয়াইনায় উপস্থিত হন। সেখানকার শাসক তাকে স্বাগত জানান এবং তার প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন সমাধির উপর তৈরি অনেক গম্বুজ ও নানাবিধ কুসংস্কারের কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করেন এবং খাঁটি তাওহীদের বার্তা লোক সমাজে প্রচার করতে থাকেন।

এখানেও শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব হিংসুক ও সংস্কার বিরোধী লোকদের ষড়যন্ত থেকে রেহাই পান নি। অবশেষে এখান থেকেও তাকে বিদায় নিতে হলো। অতঃপর তিনি রিয়াদের নিকবর্তী দার’ইয়া নামক শহরে উপনীত হন। সেখানকার শাসক আমীর ‘মুহাম্মাদ ইবন সউদ’ তাকে স্বাগত জানান এবং দীনে হকের প্রচার এবং সুন্নাতে রাসূলকে জীবন্ত ও বিদ’আত নির্মূল অভিযানে সব রকমের সাহায্য-সহায়তার নিশ্চয়তা প্রদান করেন।

এমনিভাবে দার’ইয়া শহরকে কেন্দ্র করে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব দীনের দাওয়াত পূর্ণোদ্দমে শুরু করেন। নিকটবর্তী ও দূরবর্তী এলাকার শাসক, গোত্রীয় প্রধান ও আলেমবর্গের প্রতি দাওয়াত ও সংস্কারের কাজে তার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য পত্র লিখে আহ্বান জানান। ফলে অনেকেই তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংস্কার ও দাওয়াতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এখানে উল্লেখ্য, দার’ইয়া আগমনের পর আমীর ‘মুহাম্মাদ ইবন সউদ’ ও শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহহাবের মধ্যে হিজরি ১১৫৭ সনে দাওয়াত ও সংস্কারের ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতা ও সাহায্যের যে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা “দার’ইয়া চুক্তি” নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এ চুক্তিটি সংস্কারমূলক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জাগরণে গোটা আরব উপদ্বীপ তথা আধুনিক মুসলিম বিশ্বে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।

নির্মল তাওহীদ ও শরী’আতের বিধি-বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তনের এ আহ্বান নাজদ এলাকায় এক ধর্মীয় পুনঃ জাগরণের প্রবাহ সৃষ্টি করে। যথাযথভাবে সালাত প্রতিষ্ঠা হয়, বিদ’আত, কুসংস্কার, শিরক ও অবৈধ কর্মাদি বিলুপ্ত হয় এবং দিকে দিকে খাঁটি তাওহীদের বাণী ছড়িয়ে পড়ে।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব ইত্যবসরে ইবাদাত, তা’লীম ও ওয়াজ নসীহতে মনোনিবেশ করেন এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে তাওহীদ, ঈমান, ফাযাইলে ইসলাম, কাশফুশ শুবুহাত ও মাসাইলে জাহেলিয়া ছিল অন্যতম।

প্রকৃত তাওহীদের বার্তাবাহক, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দুর্জয় সেনা ও শরী’আতের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের আপোষহীন সংগ্রামী এ মহান ধর্মীয় নেতা শাইখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. ১২০৬ হিজরি সনে দার’ইয়ায় ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তা’আলা তার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আমীন।

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

প্রিয় পাঠক! (আল্লাহ তা’আলা আপনাকে তাঁর আনুগত্যের পথে পরিচালিত করুন, আপনাকে তাঁর হিফাযতের আওতায় পরিবেষ্টিত রাখুন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি আপনার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করুন।) জেনে রাখুন, সালাতের প্রাণ অর্থাৎ মূল উদ্দেশ্যে হলো এর মধ্যে অন্তরকে আল্লাহ তা’আলার প্রতি নিবিষ্ট রাখা । সুতরাং যদি কোনো সালাত উপস্থিত ও নিবিষ্ট অন্তর ব্যতিরেকে আদায় করা হয় তাহলে তা হবে প্রাণহীন দেহের মতো অসার। এর প্রমাণ আল্লাহ তা’আলার বাণী:

فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ

 الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلاتِهِمْ سَاهُونَ

“সেই সব মুসল্লীদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য, যারা তাদের সালাত সম্পর্কে উদাসীন।”[1]

এখানে السهو (উদাসীনতা) এর ব্যাখ্যায় যারা বলা হয়; নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায়ে উদাসীনতা, সালাতের মধ্যে পালনীয় ওয়াজিব সম্পর্কে উদাসীনতা এবং সালাতে আল্লাহর প্রতি অন্তর হাযির ও নিবিষ্টতা করতে উদাসীনতা। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিস উপরোক্ত ব্যাখ্যা প্রমাণ করে। উক্ত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

এটা মুনাফিকের সালাত, এটা মুনাফিকের সালাত, এটা মুনাফিকের সালাত, সে সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে, যখনই সূর্য অস্ত যাওয়ার সন্ধিক্ষণে শয়তানের শিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে, তখন সে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে চার রাকাত সালাত এমন ভাবে পড়ে নেয় যার মধ্যে সে আল্লাহর জিকির অল্পই করে থাকে [2]

এখানে (সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে) দ্বারা সময়ের অপচয়, (তড়িঘড়ি করে চার রাকাত সালাত পড়া) দ্বারা সালাতের রুকনগুলো সঠিকভাবে পালন না করা এবং (সে আল্লাহর জিকির অল্পই করে থকে) দ্বারা নিবিষ্ট ও স্থিরচিত্ত না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একথা অনুধাবনের পর পাঠক মহোদয় সালাতের অন্তর্ভুক্ত এক বিশেষ রুকন ও ইবাদাত উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন, আর তা হলো “সূরা আল-ফাতিহা” পড়া, যাতে আল্লাহ তা’আলা আপনার সালাত বহুগুণ সাওয়াব বিশিষ্ট পাপ মোচনকারী মকবুল সালাতের মধ্যে গণ্য করে নেন।

সূরা আল-ফাতিহা সঠিকভাবে অনুধাবনের পথ উন্মুক্ত করার এক সর্বোত্তম সহায়ক হলো সহীহ মুসলিমে সংকলিত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি বিশুদ্ধ হাদিস। তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’আলা বলেন: আমি সালাত (সূরা আল-ফাতিহা) আমার ও আমার বান্দাদের মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছি, আর আমার বান্দা যা চাইবে তা-ই তাকে দেওয়া হবে) বান্দা যখন বলে:

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য৷” [3]

আল্লাহ তা’আলা তখন বলেন: (আমার বান্দা আমার প্রশংসা করলো।)

যখন বান্দা বলে:

الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

“পরম করুণাময় অতি দয়ালু।” [4]

তখন আল্লাহ বলেন: (আমার বান্দা আমার গুণগান করলো ।)

যখন বান্দা বলে:

مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ

“প্রতিফল দিবসের মালিক।” [5]

তখন আল্লাহ বলেন: (আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করলো।)

যখন বান্দা বলে:

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

“আমরা তোমারই ইবাদাত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।[6]

তখন আল্লাহ বলেন: (এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত এবং বান্দার জন্য তা-ই রয়েছে যা সে চাইবে ।)

অতঃপর যখন বান্দা বলে:

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

 صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلا الضَّالِّينَ

“আমাদের সরল পথ দেখাও।

তাদের পথ যাদের তুমি নিআমত দিয়েছ, তাদের পথ নয় যারা গযবপ্রাপ্ত এবং পথভ্রষ্ট।” [7]

তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন: (এসব তো আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা যা চাইবে তার জন্য তা-ই রয়েছে।)[8]

(হাদিস সমাপ্ত)

বান্দা যখন একথা চিন্তা করবে এবং জানতে পারবে যে, সূরা আল-ফাতিহা দু’ভাগে বিভক্ত, প্রথম ভাগ إياك نعبد পর্যন্ত আল্লাহর জন্য, আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ তার পর থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত, যা বলে বান্দা দো’আ করে, তার নিজের জন্য এবং একথাও যখন সে চিন্তা করবে যে, যিনি এ দো’আ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হলেন কল্যাণময় মহান আল্লাহ।

তিনি তাকে এ দো’আ পড়ার এবং প্রতি রাকাতে তা বারবার ব্যক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা দয়া ও করুণাবশতঃ এ দো’আ কবুলের নিশ্চয়তাও দিয়েছেন, যদি বান্দা নিষ্ঠা ও উপস্থিত চিত্তে তা করে থাকে, তখন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, অধিকাংশ লোক অবহেলা ও উদাসীনতার ফলে সালাতে নিহিত কি মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে থাকে!

কবিতা:

قد هيؤك لأمر لو فطنت له

فاربأ بنفسك أن ترعى مع الهمل

وأنت في غفلة عما خلقت له

وأنت في ثقة من وثبة الأجل

فزك بنفسك مما قد يدنسها

واختر لها ما ترى من خالص العمل

أأنت في سكرة ام أنت منتبها

অর্থ: তোমাকে তো মহৎ কাজের জন্য তৈরি করেছে, হায়! তুমি যদি তা আঁচ করে নিতে অতএব, এসব অবাঞ্ছিত লোকদের থেকে নিজেকে দূরে রাখ।

“তুমি তোমার সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদাসীন এবং অহেতুক বিশ্বাস কর যে, মৃত্যু তোমাকে সহজে পাকড়াও করবে না।

“যা তোমার আত্মাকে কলুষিত করতে পারে তা থেকে তুমি উহা পবিত্র রাখ এবং এর মঙ্গলের জন্য খালেছ নেক আমল অর্জন কর।

“তুমি কি বিভোর না সতর্ক? নিরাপদ তোমায় প্রবঞ্চনা দিল, না অভিলাষ তোমাকে অমনোযোগী করে ফেলেছে?”

 

প্রিয় পাঠক! আমি এ মহান সূরার কিছু মর্মার্থ এখানে পেশ করছি। আশা করি, আপনি উপস্থিত চিত্তে সালাত পড়বেন এবং মুখে যা ব্যক্ত করেন তা যেন আপনার অন্তর উপলব্ধি করে থাকে৷ কেননা মুখে যা উচ্চারিত হয় তা যদি অন্তর বিশ্বাস না করে তাহলে এটা কোনো নেক কাজ হিসেবে পরিগণিত হয় না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَقُولُونَ بِأَلْسِنَتِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ

“তারা মুখে মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই।” [9]

এখন সংক্ষিপ্তাকারে প্রথমে ‘ইন্তে’আযা’ (আউযুবিল্লাহ) এবং পরে ‘বাসমালাহ’ (বিসমিল্লাহ)-এর অর্থগত বর্ণনা দিয়ে সূরা আল-ফাতিহা-এর বর্ণনা শুরু করছি:

ইন্তেআযা‘ (আউযুবিল্লাহর তাফসীর)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ .

“আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে”

এর অর্থ হলো: আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাঁর দরবারে নিরাপত্তা কামনা করি এ মানব শত্রু বিতাড়িত শয়তানের অনিষ্ট থেকে, যাতে সে আমার ধর্মীয় বা পার্থিব কোনো ক্ষতি সাধন করতে না পারে, আমি যে বিষয়ে আদিষ্ট তা সম্পাদনে সে যেন আমাকে বাধা দিতে না পারে এবং যা নিষিদ্ধ তার প্রতি সে যেন আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারে। কেননা যখন বান্দা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত বা অন্য কোনো কল্যাণকর কাজের ইচ্ছা পোষণ করে থাকে, তখন এ শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে।

আর তা এ জন্য যে, আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা ব্যতিরেকে আপনার পক্ষে শয়তানকে দূর করার কোনো উপায় নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لا تَرَوْنَهُمْ

“সে (শয়তান) ও তার দলবল তোমাদের এমনভাবে দেখতে পায় যে, তোমরা তাদের দেখতে পাও না।” [10]

সুতরাং আপনি যখন আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন এবং তাঁকে আঁকড়ে ধরবেন তখন তা সালাতের মধ্যে আপনার আন্তরিক উপস্থিতি বা একাগ্রচিত্ত হওয়ার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, আপনি এ বাক্যের মর্মার্থ ভালোভাবে অনুধাবন করবেন এবং অধিকাংশ লোকের ন্যায় শুধু মুখে মুখে তা ব্যক্ত করে ক্ষান্ত হবেন না।

“বাসমালাহ‘ (বিসমিল্লাহ-এর তাফসীর)

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে) এর অর্থ হলো: আমি এ কাজে – পড়া, দো’আ বা অন্য কিছুই হোক নিয়োজিত হলাম আল্লাহর নামে, আমার শক্তি সামর্থ্যের বলে নয়, বরং এ কাজ সম্পাদন করতে যাচ্ছি আল্লাহ তা’আলার সাহায্যে, তাঁর কল্যাণময় ও মহান নামের বরকত কামনা করে।

দীনি ও পার্থিব প্রতিটি কাজের প্রারম্ভে এ “বাসমালাহ’ পড়তে হয়। সুতরাং যখন আপনি মনে করবেন যে, আপনার এ পড়া কেবল আল্লাহরই সাহায্য নিয়ে শুরু হচ্ছে, স্বীয় শক্তি সামর্থ্যের তোয়াক্কা করে নয়, তখন তা আপনার অন্তরের উপস্থিতি ও যাবতীয় কল্যাণ লাভের পথে সমূহ প্রতিবন্ধক দূরীকরণে প্রধান সহায়ক হয়ে থাকবে।

الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

“পরম করুণাময় অতি দয়ালু।”

রহমত থেকে উদ্ভূত গুণবাচক দুটি নাম। তন্মধ্যে একটি অপরটির চেয়ে অধিকতর অর্থবহ। যেমন, সর্বজ্ঞ ও অতি জ্ঞানী। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এ গুণবাচক নাম দুটি অতি সূক্ষ্ম, তন্মধ্যে একটি অপরটির চেয়ে অধিকতর সূক্ষ্ম অর্থাৎ অধিক রহমত সম্পন্ন ।

সূরা আল-ফাতিহা-এর তাফসীর

সূরা আল-ফাতিহা সাতটি আয়াতের সমষ্টি। প্রথম তিন আয়াতে ও চতুর্থ আয়াতের প্রথমার্ধ আল্লাহর জন্য এবং চতুর্থ আয়াতের দ্বিতীয়ার্ধসহ শেষ তিন আয়াত বান্দার জন্য। সূরার প্রথম আয়াত:

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব।”

জেনে রাখুন, ٱلۡحمۡدُ এর অর্থ ঐচ্ছিক উপকার সাধনের উপর মৌখিক প্রশংসা ব্যক্ত করা। মৌখিক প্রশংসা বলে কাজের মাধ্যমে যে প্রশংসা হয় তা পৃথক করে দেওয়া হলো। কাজের মাধ্যমে প্রশংসা যাকে লিসানুল হাল বা অবস্থার ভাষা বলা হয়, মূলত তা কৃতজ্ঞতারই এক প্রকার। ঐচ্ছিক উপকার বলে এমন কাজই বুঝানো হয়েছে যা মানুষ আপন ইচ্ছায় করে থাকে । আর যে উপকার বা উত্তম কাজে মানুষের কোনো হাত নেই, যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইত্যাদি, এমন বিষয়ের ওপর প্রশংসা করাকে হামদ না বলে মাদহ বলা হয়ে থাকে।

হামদ এবং শোকর এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো: হামদের মধ্যে গুণাবলী বর্ণনাসহ প্রশংসা করা, তা প্রশংসাকারীর প্রতি কোনো ইহসানের বিনিময়ে সাধিত হোক অথবা বিনিময় ছাড়া হোক। আর শোকর কেবল কৃতজ্ঞের প্রতি ইহসানের বিনিময়ই হয়ে থাকে। এ দিক দিয়ে শোকরের চেয়ে হামদ ব্যাপক। কেননা হামদ এর মধ্যে গুণাবলী ও ইহসান উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।

তাই আল্লাহ তা’আলার হামদ করা হয় তাঁর সর্ব সুন্দর নামসমূহ এবং পূর্বাপর তাঁর সমূহ সৃষ্টির ওপর। এ জন্য আল্লাহ তা’আলা বলেন:

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا

“আল্লাহ তাআলারই সকল প্রশংসা যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি।” [11]

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ

“আল্লাহ তাআলারই সকল প্রশংসা যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।” [12]

এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।

শোকর কেবল দান বা অনুগ্রহের বিনিময়েই হয়ে থাকে। তাই এদিক দিয়ে এর প্রয়োগ উক্ত হামদের চেয়ে সীমিত। তবে তার প্রয়োগ অন্তর, হাত ও ভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত হতে পারে। এ জন্য আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

اعْمَلُوا آَلَ دَاوُودَ شُكْرًا

“হে দাউদ বংশধরগণ! কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তোমরা নেক কাজ করে যাও।” [13]

পক্ষান্তরে হামদ কেবল অন্তর এবং ভাষার মাধ্যমেই ব্যক্ত করা হয়। এদিক দিয়ে শোকর তার বিভিন্ন প্রকার অনুসারে অধিকতর ব্যাপক এবং হামদ তার উপলক্ষের দিক দিয়ে অধিকতর ব্যাপক।

ٱلۡحمۡدُ এর আলিফ ও লাম সার্বিক বা বর্গীয় অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ সর্ববিধ প্রশংসা এর অন্তর্গত এবং সবই আল্লাহ তা’আলার জন্য, অন্য কারো জন্য নয়। এমন সব কাজ যাতে মানুষের কোনো হাত নেই, যেমন মানুষ সৃষ্টি, চক্ষু, অন্তর ইত্যাদি সৃষ্টি, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং জীবিকারাজি প্রদান ইত্যাদি – এ জাতীয় কাজের ওপর আল্লাহর প্রশংসা স্পষ্ট।

আর যেসব কাজের ওপর মাখলুক প্রশংসা কুড়ায়, যেমন নেক বান্দা ও নাবী-রাসূলগণ যে সব কাজের জন্য প্রশংসিত হন, এভাবে কেউ কোনো মঙ্গল কাজ করলে, বিশেষ করে তা যদি আপনার উদ্দেশ্যে করে থাকে, এ সমস্ত প্রশংসাও আল্লাহ তা’আলার প্রাপ্য। তা এ অর্থে যে, আল্লাহ তা’আলাই এ কর্তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে এ কাজ করার উপকরণ প্রদান করেছেন এবং তাকে এ কাজের ওপর আগ্রহী ও সমর্থ করেছেন। এ ছাড়া আরো অনেক অনুগ্রহ দান করেছেন যার কোনো একটির অবর্তমানে এ কর্তা ব্যক্তি প্রশংসিত হতে পারে না। এ দৃষ্টিতেই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।

لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“আল্লাহর জন্য যিনি সৃষ্টিকুলের রব।”

‘আল্লাহ’ আমাদের মহান ও কল্যাণময় প্রতিপালকের নাম। এর অর্থ: ইলাহ অর্থাৎ মা’বুদ (উপাস্য)।

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ

“এবং তিনিই আল্লাহ আকাশমন্ডলীতে ও পৃথিবীতে।” [14]

অর্থাৎ তিনি মা’বুদ আকাশমন্ডলীতে এবং মা’বুদ এ পৃথিবীতে। তিনি অন্যত্র বলেন:

إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلا آَتِي الرَّحْمَنِ عَبْدًا

 لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدًّا

“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর নিকট বান্দা রূপে উপস্থিত হবে না। তিনি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন এবং তাদেরকে বিশেষভাবে গণনা করে রেখেছেন।” [15]

رب এর অর্থ প্রভু, প্রতিপালক, নিয়ন্তা। العالمين একবচনে العالم মহান কল্যাণময় আল্লাহ বাদে সব কিছুকে ‘আলম নামে আখ্যায়িত করা হয়। আল্লাহ বাদে প্রত্যেক বাদশাহ, নবী, মানুষ, জিন ইত্যাদি প্রতিপালিত, বশবর্তী, নিয়ন্ত্রিত, ফকীর ও মুখাপেক্ষী। সবই এক মহান সত্তার প্রতি সম্পর্কিত – এতে তার কোনো শরীক নেই। তিনিই একমাত্র পরমুখাপেক্ষীবিহীন সত্তা এবং তাঁরই প্রতি সর্ববিষয় সম্পর্কিত। [16]

এরপর আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করেন: مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ অন্য ক্বিরাতে আছে: مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ এখানে দ্রষ্টব্য যে, আল্লাহ তা’আলা কুরআনের প্রথম সূরার একই স্থানে যেভাবে উলুহিয়্যাহ, রুবুবিয়্যাহ ও মুলকের বা আধিপত্যের উল্লেখ করেছেন, সেভাবে কুরআনের শেষ সূরায় এগুলোর উল্লেখ করে তিনি বলেন:

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ

 مَلِكِ النَّاسِ

 إِلَهِ النَّاسِ

 “বলুন (হে রাসুল) আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের রবের, মানুষের অধিপতির, মানুষের মাবুদের।” [17]

মহান কল্যাণময় আল্লাহ কুরআনের প্রথম দিকে এক স্থানে তাঁর এ তিনটি গুণের উল্লেখ করেছেন, আবার এ গুণাত্রয় কুরআনের শেষাংশে এক স্থানে একত্রে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের মঙ্গল চায় তার উচিৎ এ স্থানদ্বয়ের প্রতি মনোযোগ প্রদান করা এবং এ সম্পর্কে গবেষণা ও পর্যালোচনায় সচেষ্ট হওয়া। তার আরো জানা উচিৎ যে, মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা’আলা কুরআনের প্রথমে, আবার কুরআনের শেষাংশে একত্রে এগুলোর উল্লেখ একসাথে করেছেন। কেবল এ উদ্দেশ্যে যে, এগুলোর মর্মার্থ অনুধাবন করা এবং এগুলোর পরস্পরের মধ্যে অর্থগত ব্যবধান সম্পর্কে বান্দার অবগত হওয়া অতীব প্রয়োজন। প্রতিটি গুণের একটা নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে যা অন্যটির মধ্যে নেই। যেমন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তিনটি গুণ, আল্লাহর রাসূল, সর্বশেষ নবী এবং আদম সন্তান। মোটকথা: এর প্রত্যেকটির এক একটি অর্থ রয়েছে যা অন্যটি থেকে ভিন্ন।

যখন এ কথা জানা হলো যে, ‘আল্লাহ’ অর্থ ‘ইলাহ’ এবং ইলাহ যিনি তিনিই মা’বুদ। অতঃপর তুমি তাকে ডাকো তাঁর নামে কুরবানি করো বা তাঁর নামে মান্নত করো, তখন সত্যিকারভাবে তুমি বিশ্বাস করলে যে, তিনিই আল্লাহ।

আর যদি কোনো সৃষ্টিকে ডাকো ভালো হউক আর মন্দ হউক বা তাঁর নামে কুরবানি বা তাঁর নামে মান্নত করো তাহলে তোমার বিশ্বাস হলো যে এটাই তোমার আল্লাহ । এভাবে যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, সে তার জীবনের ক্ষণিকের জন্য হলেও “শামসান”[18] অথবা “তাজ”[19] কে আল্লাহ হিসেবে বিশ্বাস করেছে, তাহলে সে বনী ইসরাঈলের পর্যায়ে পতিত হবে, যখন তারা গো বৎসের পূজা করেছিল। অতঃপর যখন তাদের কাছে তাদের ভ্রান্তি ধরা পড়লো তখন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত ও অনুতপ্ত হয়ে যা বলেছিল আল্লাহ তা’আলা কুরআনে তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন:

وَلَمَّا سُقِطَ فِي أَيْدِيهِمْ وَرَأَوْا أَنَّهُمْ قَدْ ضَلُّوا قَالُوا لَئِنْ لَمْ يَرْحَمْنَا رَبُّنَا وَيَغْفِرْ لَنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অতঃপর যখন তারা অনুতপ্ত হলো এবং বুঝতে পারল যে, আমরা নিশ্চিতই গোমরাহ হয়ে পড়েছি, তখন বলতে লাগল, আমাদের প্রতি যদি আমাদের রব ক্ষমা ও করুণা না করেন তাহলে অবশ্যই আমরা ধ্বংস (সর্বনাশগ্রস্ত) হয়ে যাবো।” [20]

رب এর অর্থ হলো মালিক, নিয়ন্ত। আল্লাহ তা’আলা সব কিছুর মালিক এবং তিনি সব কিছুর নিয়ন্তা – এটি ধ্রুব সত্য। যাদের বিরুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করেছেন, সেই প্রতিমাপূজকরা আল্লাহর এ গুণ স্বীকার করত। আল্লাহ তা’আলা এ সম্পর্কে কুরআন মাজিদের একাধিক স্থানে বর্ণনা করেছেন। যেমন, সূরা ইউনুসের এক আয়াতে বলেন:

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ

“(হে রাসূল) আপনি জিজ্ঞেস করুন, কে রিজিক দান করেন তোমাদেরকে আকাশ থেকে ও পৃথিবী থেকে? কিংবা কে তোমাদের কান বা চোখের মালিক? কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন, কে-ইবা মৃতকে জীবিতদের মধ্য থেকে বের করে? কে করে কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ। তখন আপনি বলুন, তারপরও কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে না।” [21]

সুতরাং যে ব্যক্তি বিপদ মুক্তি ও প্রয়োজন সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহকে ডাকে এবং পরে এ উদ্দেশ্যে কোনো মাখলুককেও ডাকে, বিশেষ করে মাখলুককে ডাকার সাথে তার ইবাদাতের সাথে নিজের সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট করে ফেলে, যেমন সে ডাকার সময় বলে, অমুক তোমার বান্দা বা অলীর বান্দা বা নবীর বান্দা অথবা যুবাইরের বান্দা, তখন এর দ্বারা সে সেই মাখলুকের রুবুবিয়্যাত স্বীকার করে নিলো এবং সমগ্র বিশ্বের রব হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করল না; বরং তার রুবুবিয়্যাতের কিছু অংশ অস্বীকার করে বসল।

আল্লাহ তা’আলা সে বান্দাকে রহম করুন, যে নিজেকে নসিহত করে এবং এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবনের চেষ্টা করে আর এ সম্পর্কে সীরাতে মুস্তাকীমের অনুসারী আলেমগণের ভাষ্য জিজ্ঞেস করে। তারা সূরাটির ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন কিনা?

الملك শব্দের ব্যাখ্যা একটু পরে আসছে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ তা’আলার বাণী

مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ “প্রতিফল দিবসের মালিক।” [22] অন্য ক্কিরাতে مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ “প্রতিফল দিবসের অধিপতি ।” [23]

উভয় আকারে সকল ভাষ্যকারদের নিকট এর অর্থ তা-ই যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে ব্যক্ত করেছেন। তা হলো:

وَمَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ

 ثُمَّ مَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ

 يَوْمَ لا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ

“আর, তুমি কর্মফল দিবস সম্পর্কে কি জান? আবার, কর্মফল দিবস সম্পর্কে তুমি কি জান? সেদিন কেউ কারো জন্য কিছু করার ক্ষমতা রাখবে না। সেদিন ক্ষমতা থাকবে শুধু আল্লাহর হাতে।” [24]

যে ব্যক্তি এ আয়াতের ব্যাখ্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করবে এবং জানতে পারবে যে, কর্মফল দিবস ও অন্যান্য দিবসসহ সব কিছুর মালিক আল্লাহ তা’আলা হওয়া সত্ত্বেও এ দিনের (কিয়ামতের) অধিকারকে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন সে উপলব্ধি করতে পারবে যে, এখানে সেই মহান বিষয়টিকেই খাঁচ করে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, যা অনুধাবন করে যে জান্নাতে যাওয়ার সে এবং যা পরিজ্ঞাত না হয়ে যে জাহান্নামে যাওয়ার সে যাবে।

বিষয়টি অর্থাৎ “কিয়ামতের দিন সম্পর্কে অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলার” এ অর্থ কত-ই না মহান, যার ওপর বিশ বছর ধরে চিন্তা-ভাবনা করলেও এর যথাযথ হক আদায় সম্ভব হবে না। কোথায় সে মর্মার্থ ও এর প্রতি বিশ্বাস এবং কুরআন কর্তৃক স্পষ্টভাবে ব্যক্ত বিষয়ের ওপর ঈমান আর কোথায় এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: (হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতেমা! আমি আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাকে একটুও বাঁচাতে পারব না।) কোথায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এ কথা, আর কোথায় সে তথাকথিত ‘কাসীদা বুরদা’[25] নামক গাঁথাতে আসা কবি বূসিরীর উক্তি:

ولن يضيق رسول الل جاهك بي …… إذا الكريم تحلى باسم منتقم

فإن لي ذمة منه بتسميتي …… محمدا وهو أوفى الخلق بالذمم

إن لم تكن في معادي آخذا بيدي ……. فضلا وإل فقل يا زلة القدم

“হে রাসূলাল্লাহ! তোমার মর্যাদা আমার জন্য সংকোচিত হবে না, যখন আল্লাহ কারীম আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবেন। মুহাম্মাদ নামকরণে আমার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে তার ওপর। আর তিনিই হলেন সর্বাধিক দায়িত্ব পূরণকারী।

দয়া করে যদি তিনি হাতে ধরে আমায় উদ্ধার না করেন তাহলে আমার পদস্খলন নিশ্চিত।”

নিজের মঙ্গল কামনাকারীর পক্ষে উপরোক্ত কবিতাগুচ্ছ ও তার অর্থ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ। যে সকল সাধারণ মানুষ ও তথাকথিত আলেমবর্গ যারা এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট এবং কুরআন মাজিদের পরিবর্তে এগুলোর যারা আবৃত্তি করে, তাদেরও এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে দেখা উচিৎ। কোনো বান্দার অন্তরে কি এ কবিতাগুচ্ছের প্রতি বিশ্বাস আর আল্লাহ তা’আলার বাণী:

يَوْمَ لا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ

“যেদিন কেউ কারো উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।” [26]

এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস: “হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কন্যা ফাতেমা! আমি আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাকে একটুও বাঁচতে পারব না।” এর প্রতি বিশ্বাস একত্রিত হতে পারে? আল্লাহর শপথ, তা হতে পারে না, আল্লাহর শপথ, তা হতে পারে না, আল্লাহর শপথ, তা হতে পারে না। যেমন একত্রিত হতে পারে না এ কথা বলা যে, মুসা আলাইহিস সালাম সত্য, অনুরূপ ফিরা’উনও সত্য। তদ্রূপ একথা কথা বলা যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু “আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আবার আবু জাহলও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

কবিতা:

لا والله ما استويا ولن يتلاقيا …حتى تشيب مفارق الغربان.

“আল্লাহর শপথ, বিষয় দুটি সমান নয়। তা একত্রিত হতে পারে না, যতক্ষণ না কাকের মাথা শুভ্র বর্ণের হবে।”

সুতরাং যে ব্যক্তি এ বিষয়টি অনুধাবন করবে এবং বুরদার কবিতা ও এর আসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করবে, সে ভালো করেই ইসলামের অসহায়তা উপলব্ধি করতে পারবে। এটিও উপলব্ধি করতে পারবে যে, শত্রুতা এবং আমাদের জানমাল ও নারীদের হালাল মনে করা প্রকৃতপক্ষে আমাদের পক্ষ থেকে তাদের কাফির বলা বা তাদের সাথে যুদ্ধ করার কারণে নয়; বরং তারাই (বিরোধীরা) আমাদের ওপর যুদ্ধ ও কুফুরী ফাতওয়া শুরু করেছে। শুরু করেছে তখনই যখন আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণী তুলে ধরা হলো। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا

“সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেকো না।” [27]

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:

أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ

“তারা যাদের আহ্বান করে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতম হতে পারে।” [28]

তিনি আরো বলেন:

لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ

সত্যের আহ্বান তাঁরই, যারা তাঁকে ব্যতীত অপরকে আহ্বান করে তাদের কোনোই সাড়া দেয় না ওরা।” [29]

এ হলো মুফাসসিরগণের ঐকমত্যে আল্লাহর বাণী مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ এর মর্মার্থের কিয়দাংশ। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং এ আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সূরা ইনফিতারের কয়েকটি আয়াতে, যা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রিয় পাঠক! (আল্লাহ আপনাকে তার আনুগত্যের পথে পরিচালিত করুন) জেনে রাখুন, সর্বদা অসত্যের সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। আরবিতে বলা হয়: وبضدها تتبين الاشياء অর্থাৎ সকল বস্তু তার বিপরীত বস্তুর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে।

প্রিয় পাঠক! উপরে যা বলা হলো সে বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন, নিশ্চয় আপনি সঠিকভাবে জানতে পারবেন, আপনার প্রপিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মিল্লাত ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীন। ফলে, সে পথে চলে তাদের উভয়ের সাথে কিয়ামতের দিন একত্রিত হবেন এবং এ পৃথিবীতে সত্য পথ থেকে দূরে থাকার কারণে কর্মফল দিবসে হাওযে কাওসার থেকে বিদূরিত হবেন না, যেমন বিদূরিত হবে সেই ব্যক্তি যে তাদের পথে লোকদের বাধা প্রদান করেছিল।

আশা করি, আপনি কিয়ামতের দিন পুলসিরাতের উপর দিয়ে নিরাপদে পার হবেন। আপনার পদস্খলন ঘটবে না, যেমন ঘটবে এ ব্যক্তির পৃথিবীতে তাদের (ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ এর) সীরাতে মুস্তাকীম থেকে যার পদস্খলন ঘটে থাকবে। সুতরাং আপনার কর্তব্য সর্বদা ভয় ও উপস্থিত চিত্তে এ ফাতিহার দো’আ পাঠ করা।

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

“(হে আল্লাহ!) আমরা শুধু তোমারই ইবাদাত করি এবং তোমারই সাহায্য কামনা করি।” [30]

ইবাদতের অর্থ পূর্ণ মহব্বত, চরম বিনয়, ভয় ও অবচয়। এখানে কর্মকে ক্রিয়ার পূর্বে (অর্থাৎ نعبدُ এর পূর্বে إياك শব্দকে নিয়ে আসা) এবং দ্বিতীয়বার (إياك শব্দকে পুনরায়) উল্লেখ করার উদ্দেশ্য ক্রিয়ার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান এবং ক্রিয়াকে কর্মের মধ্যে সীমিত রাখা। অর্থাৎ অন্য কারো নয় কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমার ওপরই ভরসা করি إِيَّاكَ نَعْبُدُ অর্থাৎ ইবাদাতে কেবল তোমারই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করি।

এর অর্থ: আপনি আপনার রবের সাথে ওয়াদা ও চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন যে, আপনি তাঁর সাথে তাঁর ইবাদাতে কাউকে শরীক করবেন না, হোক না সে ফিরিশতা বা নবী বা অন্য কেউ। যেমন, সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে:

وَلا يَأْمُرَكُمْ أَنْ تَتَّخِذُوا الْمَلائِكَةَ وَالنَّبِيِّينَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُمْ بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

এবং সে তোমাদের নির্দেশ দেয় না যে, তোমরা ফিরিশতা ও নবীগণকে নিজেদের রব হিসেবে গ্রহণ করে নাও। তোমরা মুসলিম হবার পর সে কি তোমাদের কুফুরী শিখাবে?” [31]

আয়াতটি অনুধাবন করুন এবং স্মরণ করুন, পূর্বে রুবুবিয়্যাত সম্পর্কে আলোচনায় যা বলেছিলাম। তাজ ও শামসানের প্রতি আরোপিত কু-বিশ্বাস ও কুসংস্কার জাতীয় কাজ যদি সাহাবীগণ রাসূলগণের সাথে করলে মুসলিম হওয়ার পর কাফের হয়ে যেত, তাহলে যে লোক এরূপ কাজ তাজ বা তার অনুরূপ লোকের সাথে করে সে কি হতে পারে?

وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

এবং আমরা শুধু তোমারই সাহায্য কামনা করি।” [32]

وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ এর মধ্যে দুটি বিষয় রয়েছে, প্রথম বিষয়- আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা আর তা হলো তওয়াককুল করা এবং স্বীয় শক্তি সামর্থ্যের অহমিকা থেকে বিমুক্ত হওয়া। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো- বাস্তবে আল্লাহর নিকট থেকে সাহায্য লাভের তলব পেশ করা। উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ সাহায্য প্রার্থনা বান্দার ভাগে পড়ে।

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

“(হে আল্লাহ!) আমাদের সরল-সহজ পথে চালাও।” [33]

এটিই হলো, আল্লাহর নিকট বান্দার স্পষ্ট দো’আ, যা বান্দার ভাগে রয়েছে। এর অর্থ বিনয়, নম্র, অবিচল হয়ে আল্লাহর নিকট এ প্রার্থনা করা যে, তিনি যেন প্রার্থনাকারীকে এ মহান মতলব (সিরাতে মুস্তাকীম) দান করেন। এটি এমন মতলব, দুনিয়া ও আখেরাতে এর চেয়ে উত্তম কিছু আল্লাহ কাউকে দান করেন নি। আল্লাহ তা’আলা হুদায়বিয়ার সন্ধি নামক বিজয়ের পর তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অনুগ্রহের উল্লেখ করে বলেন:

وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا

“(যাতে তোমার) রব তোমাকে সিরাতে মুস্তকীমের পথে পরিচালিত করেন।” [34]

এখানে الهداية বলতে তাওফিক ও পথ প্রদর্শন বুঝনো হয়েছে।

বান্দার পক্ষে উচিৎ উপরোক্ত বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা। কেননা সিরাতে মুস্তাকীমের প্রতি হিদায়াতের মধ্যে ফলপ্রসূ জ্ঞান ও নেক আমল অন্তর্ভুক্ত, যাতে বান্দা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) পর্যন্ত এর ওপর সঠিকভাবে পরিপূর্ণ পদ্ধতিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে।

الصراط এর অর্থ স্পষ্ট পথ। আর المسقيم এর অর্থ এমন পথ যার মধ্যে কোনো বক্রতা নেই। সিরাতে মুস্তাকীম দ্বারা সেই দীন বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের ওপর নাযিল করেছেন এবং এটিই তাদের পথ যাদের ওপর আল্লাহ নি’আমত দান করেছেন। আর তারা হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রিয় সাহাবীগণ।[35]

প্রিয় পাঠক! আপনি সর্বদা প্রতি রাকাতে এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দো’আ করছেন, তিনি যেন আপনাকে নি’আমতপ্রাপ্তদের পথে পরিচালিত করেন। আপনার ওপর কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার এ কথা সত্য বলে স্বীকার করা যে, এ পথই হলো সিরাতে মুস্তাকীম। তাই যখনই কোনো পদ্ধতি, জ্ঞান বা ইবাদাত এ পথের পরিপন্থী হবে তা সিরাতে মুস্তাকীম হতে পারে না, বরং তা হবে বক্র ও বিভ্রান্ত।

এটিই উক্ত আয়াতের প্রথম দাবী এবং একে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেই হবে। প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই শয়তানের এ প্রবঞ্চনা ও ধোঁকা থেকে বাঁচতে হবে, আর তা হচ্ছে এটা মনে করা যে, উপরোক্ত বিষয়ে মোটামুটিভাবে বিশ্বাস রেখে বিস্তারিত জানা পরিত্যাগ করা চলে, এ বিশ্বাস থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

কেননা সবচেয় বড় কাফের মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ব্যক্তিরাও এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যা তাঁর বিরোধী হবে তা বাতিল। এরপর তাদের সামনে এমন কিছু আসে যা তাদের প্রবৃত্তি চায় না, তখন তারা ওদের মতো হয়ে যায়, যাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন:

لَقَدْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَأَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ رُسُلًا كُلَّمَا جَاءَهُمْ رَسُولٌ بِمَا لا تَهْوَى أَنْفُسُهُمْ فَرِيقًا كَذَّبُوا وَفَرِيقًا يَقْتُلُونَ

“তখন তারা এক দলকে অবিশ্বাস করে এবং এক দলকে তারা হত্যা করে।” [36]

আল্লাহর বাণী:

غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلا الضَّالِّينَ

“তাদের পথে নয় যাদের ওপর তোমার গযব পড়েছে এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।” [37]

الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ যাদের উপর গযব পড়েছে তারা হল এসব আলেম যারা তাদের ইলম মোতাবেক আমল করে নি এবং الضَّالِّينَ পথভ্রষ্ট ওরাই যারা ইলম ব্যতিরেকে আমল করে। প্রথমটি হলো ইয়াহুদীদের বৈশিষ্ট্য আর দ্বিতীয়টি হলো খৃষ্টানদের বৈশিষ্ট্য।

অনেক লোকের অবস্থা হলো, তারা যখন তাফসীরে দেখে ইয়াহুদীরা গযবপ্রাপ্ত আর খৃষ্টানরা পথভ্রষ্ট, তখন সেই জাহেল লোকদের ধারণা হয় যে, উপরোক্ত গুণাবলী ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের বেলায়ই প্রযোজ্য এবং এ কথাও তারা স্বীকার করে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর ফরয করে দিয়েছেন যেন তারা এ দোআ করে এবং উপরোক্ত গুণ বিশিষ্ট লোকদের পথ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে।

সুবহানাল্লাহ! কীভাবে সে ধারণা করে যে, তাকে আল্লাহ তা’আলা এ শিক্ষা দিলেন এবং তার জন্য পছন্দ করে তার ওপর ফরয করে দিলেন যেন সে সর্বদা এ দো’আ করে অথচ তার ওপর এ কাজের কোনো ভয় নেই। এমনকি সে চিন্তাও করে না যে, সে এমন কাজ করতে পারে। এটি আল্লাহর ওপর তার কু-ধারণার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহই সর্বাধিক জানেন। (সূরা ফাতিহা-এর ব্যাখ্যা এখানেই শেষ)

উল্লেখ্য যে, আমীন শব্দটি সূরা আল-ফাতিহা-এর অংশ নয়। এটি দো’আর ওপর সমর্থন সূচক শব্দ। এর অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর।” জাহেল লোকদের এ বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য, যাতে তারা এ ধারণা পোষণ না করে যে, এ শব্দটি আল্লাহর কালামের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

পরিশেষে, দুরূদ ও সালাম জানাই আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের প্রতি।

সমাপ্ত

এখানে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে যা শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রহ. সূরা ফাতিহা থেকে চয়ন করেছেন:

১ – إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ এতে আল্লাহর তাওহীদ সাব্যস্ত হয়েছে।

২ – اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ এতে রাসূলের আনুগত্যের বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে।

৩ – দীনের তিনটি রুকন রয়েছে। ভালোবাসা, আশা ও ভয়। প্রথম আয়াতে রয়েছে ভালোবাসা, দ্বিতীয়টিতে রয়েছে আশা, আর তৃতীয়টিতে রয়েছে ভয়।

৪ – অধিকাংশ মানুষ প্রথম আয়াতের অর্থ জানা না থাকার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অর্থাৎ যাবতীয় হামদ (প্রশংসা) ও যাবতীয় রুবুবিয়াত বা প্রভুত্ব কেবল জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত না করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে।

৫ – প্রথম যারা নি’আমতপ্রাপ্ত তাদের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, প্রথম যারা রোষানলে পড়েছে ও পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের সম্পর্কে জানা।

৬ – নি’আমতপ্রাপ্তদের উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক তাদের সম্মানিত করা ও প্রশংসা করা হয়েছে।

৭ – রোষানলপ্রাপ্ত ও পথভ্রষ্টদের উল্লেখ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর অপার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির বিষয়টি প্রকাশ লাভ করল।

৮ – সূরা ফাতিহা হচ্ছে দো’আ, তবে এর সাথে সাথে স্মরণ রাখতে হবে যে আল্লাহ তা’আলা অমনোযোগী অন্তর থেকে দো’আ কবুল করেন না।

৯ – صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ এ আয়াতাংশের মাধ্যমে ইজমা তথা উম্মতের একমত যে প্রমাণ তা সাব্যস্ত হলো।

১০ – উক্ত বাক্য থেকে বুঝা যায় যে, মানুষকে যদি তার নিজের ওপর ন্যস্ত করা হয় তবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।

১১ – এ আয়াতসমূহে তাওয়াককুল তথা আল্লাহর ওপর তাওয়াককুলের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

১২ – এ আয়াতসমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে শিরক অসার বিষয়।

১৩ – এ আয়াতসমূহের মাধ্যমে বিদ’আতের অসারতা প্রমাণিত হলো।

১৪ – সূরা আল-ফাতিহার কোনো একটি আয়াত যদি কেউ ভালোভাবে জানে তবে সে ফক্কীহ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এর প্রতিটি আয়াত নিয়ে আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচিত হতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সবচেয়ে বেশি জানেন।

দারুল ইরফান প্রকাশিত অন্যান্য কিতাবাদি

১/ তাওহিদঃ সকল মূলনীতির চূড়ান্ত মূলনীতি – শায়খ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল মাকদিসি (হাফিজাহুল্লাহ)

২/ তাওহিদের কালিমা – শায়খ হারিস আন নাজ্জারি (রহিমাহুল্লাহ)

৩/ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা – শায়খ আতিয়াতুল্লাহ লিব্বি (রহিমাহুল্লাহ)

8/ তাফসীরনীতি – ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ)

৫/ আকিদা সংক্রান্ত ১০টি মাসআলা – আবনাউত তাওহিদ

৬/ কাব রাদিঃর হাদিসের ব্যাখ্যা – শায়খ আবু আবদুল্লাহ উসামা (রহিমাহুল্লাহ)

৭/ শিরক সংক্রান্ত ৪টি মূলনীতি – শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহিমাহুল্লাহ)

৮/ দিনে-রাতে পালনীয় সহস্রাধিক সুন্নাহ – শায়খ খালিদ আল হুসাইনান (রহিমাহুল্লাহ)

৯/ পরীক্ষা ও সবর – নির্বাচিত আয়াত ও হাদিস

১০/ সংশয় নিরসন (কাশফুশ শুবুহাত) – শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহিমাহুল্লাহ)

১১/ গণতন্ত্র একটি দ্বীন- শায়খ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল মাকদিসি (হাফিজাহুল্লাহ

১২/ ইসলাম বিনষ্টের কারণসমূহ – শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহিমাহুল্লাহ)

১৩/ ইসলামীগণতন্ত্রের সংশয় নিরসন – দার আত তিবইয়ান

১৪/ ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও ভোটাভুটি, – শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনি (হাফিজাহুল্লাহ)

১৫/ উম্মাহর নেতাদের প্রয়োজনীয় গুণাবলী – শায়খ আবু হাফস আল মাকদিসি (হাফিজাহুল্লাহ)

১৬/ যেমন ছিলেন সালফে সালেহিনগণ – শায়খ খালিদ আল হুসাইনান (রহিমাহুল্লাহ)

নতুন ও সকল প্রকাশনা একত্রে দেখতে নিয়মিত ভিজিট করুন

facebook.com/darul.irfan.bn

archive.org/details/@darul_irfan

telegram.me/darul_irfan

[1] সূরা আল-মা’উন, আয়াত: ৪-৫

[2] সহীহ মুসলিম (আল-মাসজিদ); আবু দাউদ (আস-সালাত); তিরমিযী (মাওয়াকীতে সালাত); নাসাঈ (মাওয়াকীতে সালাত) ও মুসনাদে আহমদ

[3] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ২

[4] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৩

[5] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৪

[6] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫

[7] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৬-৭

[8] সহীহ মুসলিম (আস-সালাত); আবু দাউদ (আস-সালাত); তিরমিযী (তাফসীরে কুরআন) এবং নাসাঈ (আল-ইফতেতাহ)।

[9] সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ১১

[10] সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ২৭

[11] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১১১

[12] সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ১

[13] সূরা সাবা, আয়াত: ১৩

[14] সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ৩

[15] সূরা মারয়াম, আয়াত: ৯৩-৯৪

[16] الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ এর অর্থ বিসমিল্লাহ-এর ব্যাখ্যায় দ্রষ্টব্য।

[17] সূরা আন-নাস, আয়াত: ১-৩

[18] শামসান: প্রকৃত নাম মুহাম্মাদ ইবন শামসান। তার ছেলেরা তার নামে মান্নত করার জন্য লোকদের নির্দেশ দিত। লোক তাকে বিশেষ অলী ও শাফা’আতের অধিকারী হিসেবে বিশ্বাস করত।

[19] রিয়াদের অদূরে ‘আল-খারজ’ এলাকার অধিবাসী ছিল। লোক তাকে বিশেষ অলী ও অনেক অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে বিশ্বাস করত। তার নামে মান্নত জমা করা হত। শাসকবৃন্দ তাকে ও তার অনুসারীদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। তাজ ও শামসানের দ্বারা নজদ এলাকায় অনেক লোক বিভ্রান্ত হয়েছিল।

[20] সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৪৯

[21] সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১

[22] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৩

[23] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৩

[24] সূরা ইনফিতার, আয়াত: ১৭-১৯

[25] কাসিদায়ে বুরদা একটি স্তুতিমূলক কবিতার কিতাব। যাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্তুতিবাক্য আলোচনা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও ঈমান বিধ্বংসী কথাও চলে এসেছে। আমাদের দেশে এই কবিতার কিতাবটি বেশ জনপ্রিয়। শায়খ আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ (দা বা) স্বীয় কিতাব ‘ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব’ বইয়ে নবীপ্রেম জাগানোর জন্য বইটি পড়ার কথা বলেছেন। আমরা পাঠকদের কাসিদায়ে বুরদা কিতাব অধ্যয়ন থেকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছি। (দারুল ইরফান)

[26] সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত: ১৯

[27] সূরা আল-জিন, আয়াত: ১৮

[28] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৭

[29] সূরা আর-রা’দ, আয়াত: ১৪

[30] সূরা আর-ফাতিহা, আয়াত: ৫

[31] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮০

[32] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫

[33] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৬

[34] সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২

[35] الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ “তুমি যাদের ওপর নি’আমত দান করেছ” -এর ব্যাখ্যায় এখানে তাফসীর ইবন কাসীরে বর্ণিত আব্দুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলামের তাফসীর অনুসরণ করা হয়েছে। তবে ইবন কাসীরসহ অধিকাংশ মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা- এর তাফসীরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা আয়াতের ব্যাখ্যায় এ আয়াতে পেশ করেন:

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا

“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য করবে সে এসব লোকের সাথী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ পাক অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হলেন, নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল নেক বান্দাগণ। আর তাদের সান্নিধ্য কতই উত্তম। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৯] -অনুবাদক।

[36] সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭০

[37] সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৭

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শুধু মুখে উচ্চারণই যথেষ্ট নয়

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

মূলঃ ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ)

[যারা মনে করে যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে বলাই তাওহীদের জন্য যথেষ্ট, বাস্তবে তার বিপরীত কিছু করলেও ক্ষতি নেই, তাদের উক্তি ও যুক্তির খন্ডন]

মুশরিকদের মনে আর একটা সংশয় বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাহল এই যে, তারা বলে থাকে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমা পাঠ করা সত্ত্বেও হযরত উসামা (রাঃ) যাকে হত্যা করেছিলেন, নবী (ﷺ) সেই হত্যাকান্ডটাকে সমর্থন করেননি।

এইরূপ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এই হাদীসটিও তারা পেশ করে থাকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ “আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে (মুখে উচ্চারণ করে) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।” Continue reading

কাশফুশ শুবুহাত (সংশয় নিরসন)

কাশফুস শুবুহাত

ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

 

﴿ كشف الشبهات ﴾

কাশ্‌ফুশ্‌ শুবহাত (সংশয় নিরসন)

 

প্রথম অধ্যায়

রাসূলগণের প্রথম দায়িত্ব: ইবাদতে আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতিষ্ঠা

প্রথমেই জেনে রাখা প্রয়োজন যে, তাওহীদের অর্থ ইবাদতকে পাক পবিত্র আল্লাহর জন্যই একক ভাবে সুনির্দিষ্ট করা। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণের দ্বীন। যে দ্বীনসহ আল্লাহ তাঁদেরকে প্রেরণ করেছিলেন।

সেই রাসূল-গণের প্রথম হচ্ছেন নূহ ‘আলাইহিস্‌ সালাম। আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর কাওমের নিকট সেই সময় পাঠালেন যখন তারা ওয়াদ্দ, সুওয়া‘, ইয়াগুস, ইয়া‘উক ও নাস্‌র নামীর কতিপয় সৎ লোকের ব্যাপারে অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করে চলেছিল।

আর সর্ব শেষ রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, যিনি ঐ সব নেক লোকদের মুর্তি ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ করেন। আল্লাহ তাঁকে এমন সব লোকের মধ্যে পাঠান যারা ইবাদত করত, হজ্জ করত, দান খয়রাত করত এবং আল্লাহকেও অধিক মাত্রায় স্মরণ করত। কিন্তু তারা কোনো কোনো সৃষ্ট ব্যক্তি ও বস্তুকে আল্লাহ্‌ এবং তাদের মাঝে মাধ্যম রূপে দাঁড় করাত। তারা বলত, তাদের মধ্যস্থতায় আমরা আল্লাহর নৈকট্য কামনা করি, আর আল্লাহর নিকট (আমাদের জন্য) তাদের সুপারিশ কামনা করি। তাদের এই নির্বাচিত মাধ্যমগুলো হচ্ছে: ফেরেশতা, ঈসা, মারইয়াম এবং মানুষের মধ্যে যাঁরা সৎকর্মশীল- আল্লাহ্‌র সালেহ বান্দা।

অবস্থার এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ প্রেরণ করলেন মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের পূর্ব পুরুষ ইব্‌রাহীম আলাহিস্‌ সালাম এর দ্বীনকে তাদের জন্য নব প্রাণ শক্তিতে উজ্জীবিত করার জন্য। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই পথ এবং এই প্রত্যয় একমাত্র আল্লাহরই হক। এর কোনোটিই আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য কোনো ফেরেশতা এবং কোনো প্রেরিত রাসূলের জন্যও সিদ্ধ নয়। অপরাপর লোকেরা তো পরের কথা !

তা ছাড়া ঐ সব মুশরিকগণ সাক্ষ্য দিত যে, আল্লাহই একামাত্র সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিতে তাঁর কোনো শরীক নেই। বস্তুত: তিনিই একমাত্র রেযেকদাতা, তিনি ছাড়া রেযেক দেওয়ার আর কেউ নেই। জীবনদাতাও একমাত্র তিনিই, আর কেউ মৃত্যু দিতে পারে না। বিশ্ব জগতের একমাত্র পরিচালকও তিনিই, আর কারোরই পরিচালনার ক্ষমতা নেই। সপ্ত আকাশ ও যা কিছু তাদের মধ্যে বিরাজমান এবং সপ্ত তবক যমীন ও যা কিছু তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে সব কিছু তাঁরই অনুগত দাসানুদাস, সবই তাঁর ব্যবস্থাধীন এবং সব কিছুই তাঁরই প্রতাপে এবং তাঁরই আয়ত্তাধীনে নিয়ন্ত্রিত।

দ্বিতীয় অধ্যায়

রাসূল যাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন তারা তাওহীদু রবুবিয়াতের স্বীকৃতি দিত এর প্রমাণাদির বর্ণনা

[রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব মুশ্‌রিকের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা তাওহীদে রবুবিয়াত অর্থাৎ আল্লাহ যে মানুষের রব, প্রতিপালক ও প্রভু একথা স্বীকার করত কিন্তু এই স্বীকৃতি ইবাদতে শির্ক এর পর্যায় থেকে তাদেরকে বের করে আনতে পারে নি— আলোচ্য অধ্যায়ে তারই বিশদ বিবরণ রয়েছে]

যে সব কাফেরের সঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ করেছেন তারা তাওহীদে রবুরিয়তের সাক্ষ্য প্রদান করত—এই কথার প্রমাণ যদি তুমি চাও তবে নিম্ন লিখিত আল্লাহ্‌র বাণী পাঠ কর:

﴿ قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ ﴾ [يونس: ٣١] 

“বলুন, ‘কে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, জীবিতকে মৃত থেকে কে বের করেন এবং মৃতকে জীবিত হতে কে বের করেন এবং সব বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন?’ তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ্। সুতরাং বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?’ (সূরা ইউনুস : ৩১)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন :

﴿ قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٤ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٨٥ قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ٨٦ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٨٧ قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٨ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ ٨٩ ﴾ [المؤمنون: ٨٤،  ٨٩] 

“বলুন, ‘যমীন এবং এতে যা কিছু আছে এগুলো(র মালিকানা) কার? যদি তোমরা জান (তবে বল)। অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্র।’ বলুন, ‘তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’ বলুন, ‘সাত আসমান ও মহা-‘আরশের রব কে?’ অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্। বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? বলুন, ‘কার হাতে সমস্ত বস্তুর কর্তৃত্ব? যিনি আশ্রয় প্রদান করেন অথচ তাঁর বিপক্ষে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না , যদি তোমরা জান (তবে বল)। অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্।’ বলুন, ‘তাহলে কোথা থেকে তোমরা জাদুকৃত হচ্ছো? (সূরা মু’মেনুন : ৮৪-৮৯)। অনুরূপ আরও অনেক আয়াত রয়েছে।

যখন এ সত্য স্বীকৃত হলো যে, তারা আল্লাহর রবুবিয়াতের গুণাবলীর স্বীকৃতি দিত, অথচ তাদের সেই ঈমান তাদেরকে সেই তাওহীদে প্রবেশ করায় নি -যার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আর তুমি এটাও অবগত হলে যে, যে তাওহীদকে তারা অস্বীকার করেছিল সেটা ছিল তাওহীদে ইবাদত (ইবাদতে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত করা)— আমাদের যুগের মুশরিকগণ যাকে ‘ই‘তেকাদ” বলে থাকে। তাদের[1] ঐ “ই‘তেকাদের” নমুনা ছিল এই যে, তারা আল্লাহকে দিবানিশি আহবান করত, আর তাদের অনেকেই আবার ফেরেশতাদেরকে এজন্য আহবান করত যে, ফেরেশতাগণ তাদের সৎ স্বভাব ও আল্লাহর নৈকট্যে অবস্থান হেতু তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে; অথবা তারা কোন পূণ্য স্মৃতি ব্যক্তি বা নবীকে ডাকতো যেমন ‘লাত’ বা ঈসা ‘আলাইহিস্‌ সালাম।

আর এটাও তুমি জানতে পারলে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সঙ্গে এই প্রকার শির্কের জন্য যুদ্ধ করেছেন এবং তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন যেন তারা একমাত্র আল্লাহর জন্যই তাদের ইবাদতকে খালেস (নির্ভেজাল) করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন :

﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨] 

“আরও (এই অহী করা হয়েছে) যে, মসজিদগুলো সমস্তই আল্লাহ্‌র (যিকরের) জন্য, অতএব তোমরা আহ্বান করতে থাকবে একমাত্র আল্লাহ্‌কে এবং আল্লাহ্‌র সঙ্গে আর কাওকেও ডাকবে না।” (সুরা জিন :১৮)

এবং তিনি একথাও বলেছেন:

﴿ لَهُۥ دَعۡوَةُ ٱلۡحَقِّۚ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ لَا يَسۡتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيۡءٍ ﴾ [الرعد: ١٤] 

“সমস্ত সত্য আহবান একমাত্র তাঁরই জন্য, বস্তুত: তাঁকে ছেড়ে অন্য যাদেরকেই তারা আহ্বান করে, তারা তাদের সে আহ্বানে কিছুমাত্রও সাড়া দিতে পারে না।” (সূরা রা‘আদ :১৪)

এটাও বাস্তব সত্য যে, মহানবী সাল্লাল্লহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে এই জন্যই যুদ্ধ করেছেন যেন তাদের যাবতীয় প্রার্থনা আল্লাহর কাছেই হয়ে যায়; যাবতীয় কুরবানীও আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হয়, যাবতীয় নযর নেয়াযও আল্লাহর জন্যই উৎসৃষ্ট হয়;  সমস্ত আশ্রয় প্রার্থনা আল্লাহর সমীপেই করা হয় এবং সর্ব প্রকার ইবাদত আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়।

এবং তুমি এটাও অবগত হলে যে, তাওহীদে রবুবিয়ত সম্বন্ধে তাদের স্বীকৃতি তাদেরকে ইসলামের মধ্যে দাখেল করে দেয় নি এবং ফেরেশতা, নবী ও ওলীগণের সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে সুপারিশ লাভের ইচ্ছা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বাসনা এমন মারাত্মক অপরাধ, যা তাদের জান-মালকে মুসলিমদের জন্য হালাল করে দিয়েছিল।

এখন তুমি অবশ্য বৃঝতে পারছ যে, আল্লাহর রাসূলগণ কোন তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন ও মুশরিকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

তৃতীয় অধ্যায়

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর প্রকৃত তাৎপর্যই হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ বা ইবাদতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা

[লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে তাওহীদে ইবাদত। বর্তমান যুগে ইসলামের দাবীদারগণের তুলনায় রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময়ের কাফেরগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর অর্থ বেশী ভাল জানতো। বক্ষমাণ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হচ্ছে।]

কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ ও তাৎপর্য বলতে যা বুঝায় তাই হচেছ তাওহীদে ইবাদত। আর বর্তমান যুগে ইসলামের দাবীদারগণের তুলনায় রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময়ের কাফেরগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর অর্থ বেশী ভাল জানতো। আর যখন তুমি বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তখন এ তাওহীদই তোমার কথার উদ্দেশ্য। কেননা, তাদের[2] নিকট ‘ইলাহ’ হচ্ছেন সেই সত্তা যাকে এ সকল কাজে (বিপদাপদ, নযর নিয়ায, যবেহ, আশ্রয় ইত্যাদিতে) উদ্দেশ্য নেয়া হয়। চাই তা ফেরেশতা, নবী, ওলী, বৃক্ষ, কবর, জিন যা-ই হোক না কেন[3]

তখনকার কাফেরগণ এ (কালেমা দ্বারা) কখনও এটা উদ্দেশ্য নিত না যে, ইলাহ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা, আহার দাতা, সব কিছুর ব্যাবস্থাপক বা পরিচালক। কেননা কাফেররা এটা জানত এবং স্বীকার করত যে, এই সব গুণাবলী অর্থাৎ সৃষ্টি করা, আহার দান এবং ব্যবস্থাপনা একমাত্র একক আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট, আর কারোরই তা করবার ক্ষমতা নেই (এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আমরা পূর্বেই করেছি)।

বরং আরবের তৎকালীন[4] মুশরিকরা “ইলাহ” এর সেই অর্থই বুঝত যা আজ কালের মুশরিকগণ “সাইয়েদ” “মুর্শিদ” ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বুঝে থাকে। এ ধরণের বিশ্বাসের সময়ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকটে কালেমায়ে তাওহীদের আহ্বান নিয়ে আগমন করেছিলেন, সেটা হচ্ছে “লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ”। আর এই কালেমার অর্থই হচ্ছে এর আসল উদ্দেশ্য, শুধুমাত্র এর শব্দগুলি উদ্দেশ্য নয়।

রাসূলের সময়ের অজ্ঞ কাফেররাও এ কথা জানত যে, এই কালেমা থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্য ছিল: যাবতীয় সৃষ্ট বস্তু থেকে সম্পর্কচ্যুত হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরী করা। (কোনো সৃষ্টজীবের ইবাদত থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করা) তাঁকে ছেড়ে আর যাকে বা যে বস্তুকে উপাসনা করা হয় তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা এবং তা থেকে বিমুক্ত থাকা। কেননা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা বল: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”— ‘আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো হক্ক মা‘বুদ নেই’, তখন তারা বলে উঠল,

﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥] 

“এই লোকটি কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করছে? এ তো ভারী এক আশচর্য্য ব্যাপার !” (সূরা সাদ : ৫)

যখন তুমি জানতে পারলে যে, অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরগণও কালেমার অর্থ বুঝে নিয়েছিল, তখন এটা কত বড় আশ্চর্য্যের বিষয় যে, অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরগণও কালেমার যে অর্থ বুঝতে পেরেছিল, ইসলামের (বর্তমান) দাবীদারগণ তাও বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না!

বরং এরা মনে করছে কালেমার আক্ষরিক উচ্চারণই যথেষ্ট, তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে অন্তর দিয়ে প্রত্যয় পোষণ করার প্রয়োজন নেই। বর্তমানকালের মুসলিম নামধারীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান (বুদ্ধিজীবী কিংবা দার্শনিক) বলে পরিচিত, তারা এ কালেমার অর্থ করে থাকে যে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, কোনো রুযীদাতা নেই এবং একমাত্র তিনিই সব কিছুর পরিচালক, তিনিই সব বিষয়ের ব্যবস্থাপক। (অথচ এ অর্থটি এ কালেমার সঠিক অর্থ নয়)

তাহলে এটা সাব্যস্ত হচ্ছে যে এমন মুসলিম নামধারী লোকের মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই যার চেয়ে (তৎকালীন আরবের) অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরও কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র এর অর্থ বেশী জানত।

চতুর্থ অধ্যায়

তাওহীদের জ্ঞানলাভ আল্লাহর এক বিরাট নে‘আমত

[একজন মুমিনের এটা জানা যে, তাওহীদ সম্পর্কে মু’মিনের জ্ঞান লাভ তার প্রতি আল্লাহর এমন এক নে‘আমত যে জন্য আনন্দ প্রকাশ করা এবং এটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকা তার অবশ্য কর্তব্য]

যা বর্ণিত হয়েছে (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ হচ্ছে, ইবাদতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা), যখন তুমি মন থেকে তা বুঝতে সক্ষম হলে।

আরও বুঝতে পারলে আল্লাহর সাথে (কিভাবে) শির্ক (হয় সেটা) সম্পর্কে, যে শির্ক (এর পরিণতি) সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ﴾ [النساء: ٤٨، 116] 

“নিশ্চয় আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করার যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্য যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্চা মাফ করে দিবেন।” (সূরা নেসা : ৪৮, ১১৬)

আর সে দ্বীনকেও জানতে পারলে, যে দ্বীন নিয়ে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত রাসূলগণকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন এবং যে দ্বীন ছাড়া আল্লাহ অন্য কোন দ্বীনই কবুল করবেন না।

তাছাড়া অধিকাংশ মানুষের মধ্যে যেভাবে অজ্ঞতা-মূর্খতা ছেয়ে গেছে তাও সম্যক জানতে ও বুঝতে পারলে, তখন তুমি দু’টি উপকার লাভ করবে, 

এক: আল্লাহর দয়া ও তাঁর রহমতের উপর খুশি হবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ﴾ [يونس: ٥٨] 

“বল ! আল্লাহ এই যে ইন’আম এবং তাঁর এই যে রহমত (তোমরা পেয়েছ) এর জন্য সকলের উৎফুল্ল হওয়া উচিত, তারা যা পুঞ্জীভূত করে তা অপেক্ষা তা কতই না উত্তম।” (সূরা ইউনুস : ৫৮)

দুই : আর তোমার মধ্যে (তা) ভীষণ ভয়েরও উদ্রেক করবে। কারণ, যখন তুমি বুঝতে পারলে যে, মানুষ তার মুখ থেকে বের হওয়া কোনো একটি কথার জন্য কুফরি করে ফেলতে পারে। এমন কি যদিও সে উক্ত কথাটি অজ্ঞতা বশত বলে ফেলে তবুও; আর তার অজ্ঞতা ওযর হিসেবে বিবেচিত হবে না[5]। অথবা হতে পারে সে এ কথাটি বলেছে এমতাবস্থায় যে সে মনে করেছে যে এটা তাকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য এনে দেবে, যেমন মুশরিকরা মনে করত; (কিন্তু সেটাও তাকে কুফরিতে নিপতিত করতে পারে)। বিশেষত: যখন কুরআনে বর্ণিত মুসা ‘আলাইহিস সালামের ঘটনাটি আল্লাহ তা‘আলা তোমার মনে উদয় করিয়ে দিবেন, যে ঘটনায় মূসার কওম সৎ ও জ্ঞানী গুণী হওয়া সত্ত্বেও বলেছিল :

﴿ٱجۡعَل لَّنَآ إِلَٰهٗا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةٞۚ﴾ [الاعراف: ١٣٨] 

 “আমাদের জন্যও একটি উপাস্য (মূর্তি) স্থির করে দিন, যেমন তাদের জন্য রয়েছে বহু  উপাস্য মুর্তি !” (সূরা আ‘রাফ : ১৩৮)।

যখন এ ঘটনাটি উপলব্ধি করতে পারবে, তখন (কুফর, শির্কের) ভয় তোমার কাছে বৃহৎ হয়ে দেখা দিবে এবং এ জাতীয় বিষয় (কুফর, শির্ক) ও অনুরূপ বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য জন্য তোমার আগ্রহ বেড়ে যাবে।

পঞ্চম অধ্যায়

নবী ও ওলীদের সাথে মানুষ ও জিনদের শত্রুতা :
আল্লাহর হিকমতের চাহিদা হচ্ছে যে তিনি তাঁর নবী ও ওলীদের বিপক্ষে মানুষ ও জিন শত্রুদেরকে ক্রিয়াশীল রাখেন

জেনে রাখ, পাক-পবিত্র আল্লাহর অন্যতম হিকমত এই যে, তিনি এই তাওহীদের নিশান বরদাররূপে এমন কোনো নবী প্রেরণ করেন নি যাঁর পিছনে দুশমন দাঁড় করিয়ে দেন নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا شَيَٰطِينَ ٱلۡإِنسِ وَٱلۡجِنِّ يُوحِي بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ زُخۡرُفَ ٱلۡقَوۡلِ غُرُورٗاۚ ﴾ [الانعام: ١١٢] 

“আর এভাবেই আমরা মানব ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একে অপরকে চমকপ্রদ বাক্যের কুমন্ত্রণা দেয়।” (সূরা আন‘আম : ১১২)

আবার কখনও তাওহীদের শত্রুদের নিকটে থাকে অনেক বিদ্যা, বহু, কেতাব ও বহু যুক্তি প্রমাণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ فَلَمَّا جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِ فَرِحُواْ بِمَا عِندَهُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ﴾ [غافر: ٨٣] 

“অতঃপর যখন তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল তাদের কাছে, তখন তারা নিজেদের (পৈতৃক) বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়েই উৎফুল্ল হয়ে রইল।” (সুরা গাফের: ৮৩)

 

ষষ্ঠ অধ্যায়

কিতাব ও সুন্নাহর অস্ত্রসজ্জা

[শত্রু পক্ষের সৃষ্ট সন্দেহাদি নিরসনে কুরআন ও সুন্নাহর অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত (জ্ঞানে জ্ঞানী) থাকতে হবে।]

যখন তুমি এটা (নবী ও ওলীদের পিছনে দুশমন দল নিয়োজিত রয়েছে) জানতে পারলে, আর এ কথাও জানতে পারলে যে, আল্লাহর পথের মোড়ে উপবিষ্ট দুশমনগণ হয়ে থাকে কথাশিল্পী, বিদ্যাধর এবং যুক্তিবাগীশ, তখন তোমার জন্য অবশ্য কর্তব্য হবে আল্লাহর দ্বীন থেকে সেই সব বিষয় শিক্ষা করা যা তোমার জন্য হয়ে উঠবে এমন এক কার্যকর অস্ত্র যে অস্ত্র দ্বারা তুমি ঐ শয়তানদের মুকাবেলা এবং সংগ্রাম করতে সক্ষম হবে, যাদের অগ্রদূত ও তাদের পূর্বসূরী তোমার মহান ও মহীয়ান প্রভু পরওয়ারদেগারকে বলেছিল :

﴿لَأَقۡعُدَنَّ لَهُمۡ صِرَٰطَكَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ١٦ ثُمَّ لَأٓتِيَنَّهُم مِّنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيهِمۡ وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ وَعَنۡ أَيۡمَٰنِهِمۡ وَعَن شَمَآئِلِهِمۡۖ وَلَا تَجِدُ أَكۡثَرَهُمۡ شَٰكِرِينَ ١٧ ﴾ [الاعراف: ١٦،  ١٧] 

“নিশ্চয় আমি তোমার সরল সুদৃঢ় পথের উপর গিয়ে বসব, অতঃপর আমি তাদের নিকট গিয়ে উপনীত হব তাদের সম্মুখের দিক থেকে ও তাদের পশ্চাতের দিক থেকে এবং তাদের দক্ষিণের দিক থেকে ও তাদের বামের দিক থেকে। আর তাদের অধিকাংশকে আপনি কৃতজ্ঞ পাবেন না।” (সুরা আ‘রাফ :১৬-১৭)

কিন্তু যখন তুমি আল্লাহর পানে অগ্রসর হবে ও আল্লাহর দীল প্রমাণাদির প্রতি তোমার হৃদয়-মন ও চোখ-কানকে ঝুঁকিয়ে দেবে, তখন তুমি হয়ে উঠবে নির্ভীক ও নিশ্চিন্ত। কারণ তখন তুমি তোমার জ্ঞান ও যুক্তি প্রমাণের মুকাবেলায় শয়তানকে দুর্বল দেখতে পাবে। এ সম্বদ্ধে আল্লাহ বলেন:

﴿إِنَّ كَيۡدَ ٱلشَّيۡطَٰنِ كَانَ ضَعِيفًا ٧٦ ﴾ [النساء: ٧٦] 

“নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত ও কুট-কৌশল হচ্ছে অতি দুর্বল।” (সূরা নেসা :৭৬)

একজন সাধারণ মুওয়াহ্‌হিদ (একত্ববাদী) ব্যক্তি হাজার মুশরিক পণ্ডিতের উপর জয় লাভের সামর্থ রাখে। কুরআন বজ্রগম্ভীর ভাষায় ঘোষণা করছে:

﴿ وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ ٱلۡغَٰلِبُونَ ١٧٣ ﴾ [الصافات: ١٧٣] 

“আর আমাদের যে ফওজ, নিশ্চয় বিজয়ী হবে তারাই।” (সুরা সাফফাত : ১৭৩)

আল্লাহর ফওজগণ যুক্তি ও কথার বলে জয়ী হয়ে থাকেন, যেমন তারা জয়ী হয়ে থাকেন তলওয়ার ও অস্ত্র বলে। ভয় ঐসব মুওয়াহ্‌হিদদের জন্য যাঁরা বিনা অস্ত্রে পথ চলেন।

অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন এক কেতাব দ্বারা অনুগৃহীত করেছেন যার ভিতর তিনি প্রত্যেক বিষয়ের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে কেতাবটি হচ্ছে “স্পষ্ট ব্যাখ্যা যা পথ-নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ আত্মসর্ম্পণকারীদের জন্য।” ফলে বাতেলপন্থীগণ যে কোনো দলীল নিয়েই আসুক না কেন তার খন্ডন এবং তার অসারতা প্রতিপাদন করার মত যুক্তি প্রমান খোদ কুরআনেই বিদ্যমান রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ وَلَا يَأۡتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ وَأَحۡسَنَ تَفۡسِيرًا ٣٣ ﴾ [الفرقان: ٣٢] 

 “আর যে কোন প্রশ্নই তারা তোমার নিকট নিয়ে আসে (সে সম্বন্ধে ওহীর মাধ্যমে) আমি সত্য ব্যাপার এবং (তার) সুসঙ্গত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আপনাকে জানিয়ে দেই।” (সূরা ফুরকান : ৩৩)

 এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কতিপয় মুফাস্‌সির বলেছেন : “কিয়ামত পর্যন্ত বাতিলপন্থীগণ যে যুক্তিই উপস্থাপিত করুক, এই আয়াত মাসগ্রিক ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, কুরআন পাক তা খণ্ডনের শক্তি রাখে।”

সপ্তম অধ্যায়

বাতিলপন্থীদের দাবীসমূহের খন্ডন

(সংক্ষিপ্তাকারে ও বিস্তারিতভাবে)

 আমাদের সমসাময়িক যুগের মুশরিকগণ আমাদের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করে থাকে আমি তার প্রত্যেকটির জওয়াবে সেই সব কথাই বলব যা আল্লাহ্‌ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

বাতেলপন্থীদের কথার জওয়াব আমরা দুই পদ্ধতিতে প্রদান করব : ১ সংক্ষিপ্তাকারে, ২.তাদের দাবীসমূহ বিশ্লেষণ করে বিশদভাবে।

১. সংক্ষিপ্ত জওয়াব

সংক্ষিপ্ত হলেও এটা হবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত কল্যাণবহ সেই সব ব্যক্তির জন্য যাদের প্রকৃত বোধ শক্তি আছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,

﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ مِنۡهُ ءَايَٰتٞ مُّحۡكَمَٰتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ وَأُخَرُ مُتَشَٰبِهَٰتٞۖ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمۡ زَيۡغٞ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَٰبَهَ مِنۡهُ ٱبۡتِغَآءَ ٱلۡفِتۡنَةِ وَٱبۡتِغَآءَ تَأۡوِيلِهِۦۖ وَمَا يَعۡلَمُ تَأۡوِيلَهُۥٓ إِلَّا ٱللَّهُۗ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِي ٱلۡعِلۡمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧ ﴾ [ال عمران: ٧]   

“তিনিই তো সেই সত্ত্বা, যিনি আপনার প্রতি নাযিল করেছেন এই কিতাব; যার কতক আয়াত হচ্ছে মুহকাম— স্পষ্ট অর্থবহ, সে গুলি হচ্ছে কেতাবের মুলাধার; আর কতকগুলি হচ্ছে মোতাশাবেহ— অস্পষ্ট অর্থসম্পন্ন, ফলে যাদের অন্তরে আছে বক্রতা তারা অনুসরণ করে থাকে তার মধ্য হ’তে মোতাশাবেহ— অস্পষ্ট অর্থসম্পন্ন আয়াতগুলির, ফিৎনা সৃষ্টির মতলবে এবং (অসঙ্গত) তাৎপর্য্য বের করার উদ্দেশ্যে, অথচ এর প্রকৃত তাৎপর্য কেউই জানে না আল্লাহ্ ব্যতীত।” (সূরা আলে ইমরান :৭)

 নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতেও এটা সাব্যস্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন:

«فَإِذَا رَأَيْتِ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ فَأُولَئِكِ الَّذِينَ سَمَّى اللَّهُ فَاحْذَرُوهُمْ»

“যখন তুমি ঐ সমস্ত লোকদের দেখবে যারা দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট আয়াতগুলির অনুসরণ করছে তখন বুঝে নেবে এরা সেই সব লোক যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন, সুতরাং তোমরা ঐসব লোকদের ব্যাপারে হুশিয়ার থাক।” (বুখারী: ৪৫৪৭ ও মুসলিম: ২৬৬৫)

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে মুশরেকদের মধ্যে কতক লোক বলে থাকে :

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [يونس: ٦٢] 

“দেখ ! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধু তারা, যাদের ভয়-ভীতির কোনই আশঙ্কা নেই এবং কখনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না তারা।” (সূরা ইউনুস : ৬২)

তারা আরও বলে: নিশ্চয় সুপারিশের ব্যাপারটি অবশ্যই সত্য। অথবা বলে: আল্লাহর নিকটে নবীদের একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কিংবা নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এমন কিছু কথায় তারা উল্লেখ করবে, যা থেকে তারা তাদের বাতিল বক্তব্যের পক্ষে দলীল পেশ করতে চাইবে, অথচ তুমি বুঝতেই পারবে না যে, যে কথার তারা অবতারণা করেছে তার অর্থ কি ?

এরূপ ক্ষেত্রে তার জবাব এই ভাবে দিবে :

আল্লাহ তাঁর কেতাবে উল্লেখ করেছেন : “যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারা মুহকাম (স্পষ্ট অর্থবোধক) আয়াতগুলো বর্জন করে থাকে, আর মুতাশাবেহ্ (অস্পষ্ট অর্থবোধক) আয়াতের পিছনে ধাবিত হয়।” আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘মুশরিকগণ আল্লাহর রবূবিয়াতের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, তবু আল্লাহ তাদেরকে কাফেররূপে অভিহিত করেছেন এজন্যই যে, তারা ফেরেশতা, নবী ও ওলীদের সঙ্গে ভ্রান্ত সম্পর্ক স্থাপন করে বলে থাকে :

﴿هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨] 

“এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” (সূরা ইউনুস : ১৮ আয়াত)

এটি একটি মুহকাম আয়াত, যার অর্থ পরিষ্কার। এর অর্থ বিকৃত করার সাধ্য কারোরই নেই।

আর হে মুশরিক! তুমি কুরআন অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী থেকে যা আমার নিকট পেশ করলে তার অর্থ আমি বুঝি না, তবে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, আল্লাহর কালামের মধ্যে কোন পরস্পর-বিরোধী কথা নেই, আর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথাও আল্লাহর কালামের বিরোধী হতে পারে না।

এই জবাবটি অতি উত্তম ও সর্বতোভাবে সঠিক। কিন্তু আল্লাহ যাকে তাওফীক দেন সে ছাড়া আর কেউ এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। এই জওয়াবটি তুমি তুচ্ছ মনে করো না, দেখ! আল্লাহ স্বয়ং এরশাদ করেন :

﴿ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُواْ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٖ ٣٥ ﴾ [فصلت: ٣٥] 

“বস্তুত: যারা ধৈর্য ধারণে অভ্যস্ত তারা ব্যতীত আর কেউই এই মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না, অধিকন্তু মহা ভাগ্যবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কেউই এটা লাভে সমর্থ হয় না”। (সূরা হা’মীম আস-সাজদা: ৩৫)

২. বিস্তারিত জওয়াব

সত্য দ্বীন থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আল্লাহর দুশমনগণ নবী রাসূলদের প্রচারিত শিক্ষার বিরুদ্ধে যে সব ওযর আপত্তি ও বক্তব্য পেশ করে থাকে তার মধ্যে একটি এই যে, তারা বলে থাকে:

“আমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করি না বরং আমরা সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে, কেউই সৃষ্টি করতে, রুযী দিতে, উপকার এবং অপকার সাধন করতে পারে না একমাত্র একক এবং লা-শরীক  আল্লাহ ছাড়া— আর (আমরা এ সাক্ষ্যও দিয়ে থাকি যে,) স্বয়ং মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামও নিজের কোনো কল্যাণ এবং অকল্যাণ সাধন করতে সক্ষম নন। আবদুল কাদের জিলানী ও অন্যান্যরা তো বহু দুরের কথা। কিন্তু একটি কথা এই যে, আমি একজন গুনাহগার ব্যক্তি, আর যারা আল্লাহর নেককার বান্দা তাদের রয়েছে আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদা, তাই তাঁদের মধ্যস্থতায় আমি আল্লাহ্‌র নিকট তাঁর করুণা প্রার্থী হয়ে থাকি।

 যখন তারা এ ধরনের কথা বলে, তখন তার উত্তর তা দিয়ে প্রদান করবে যা পূর্বে গত হয়েছে, আর তা হচ্ছে এই :

যাদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ ‘সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ করেছেন তারাও তুমি যে কথার উল্লেখ করলে তা স্বীকার করত, আর এ কথাও তারা স্বীকার করত যে, প্রতিমাগুলো কোনো কিছুই পরিচালনা করে না। তারা তো কেবল তাদের নিকট মর্যাদা (র দোহাই) ও শাফা‘আতই কামনা করত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা উল্লেখ করেছেন এবং বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন সে সব তাদের পড়ে শুনিয়ে দাও।

এখানে সন্দেহকারী যদি (এই কুটতর্কের অবতারণা করে আর) বলে যে, এই সব আয়াত তো মূর্তিপুজকদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে তোমরা কি ভাবে সৎ ব্যক্তিদেরকে ঠাকুর বিগ্রহের সমতুল্য করে নিচ্ছ অথবা নবীগণকে কি ভাবে ঠাকুর বিগ্রহের শামিল করছ? তখন তুমি আগে যা চলে গেছে তা দিয়েই এর জবাব দিবে[6]

কেননা, যখন সে স্বীকার করছে যে, (রাসূলের যুগের) কাফেরগণও আল্লাহর সার্বভৌম রবূবিয়তের সাক্ষ্য প্রদান করত; আর তারা যাদেরকে (নযর নিয়ায প্রভৃতি পেশ অথবা পূজা অর্চনা ইত্যাদি দ্বারা) উদ্দেশ্য করত, তারা তো তাদের থেকে কেবল সুপারিশই চাইত। কিন্তু যদি সে তার কাজ ও পূর্ববর্তী কাফের লোকদের কাজের মধ্যে যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে[7] তা দিয়ে পার্থক্য করার চেষ্টা করে, তা হলে তাকে বলে দাও : কাফেরগণের মধ্যে কতক তো প্রতিমা পূজা করত, কিন্তু আবার কতক তো এমন ছিল যারা ঐ সব আওলিয়াদের আহ্বান করত[8] যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন:

﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ﴾ [الاسراء: ٥٧] 

“এই মুশরিকরা যাদেরকে আহ্বান করে থাকে, তারা (সে সব সৎ লোকেরা) তো নিজেরাই এজন্য তাঁর (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের অবলম্বন খুঁজে বেড়ায় যে, কোন্‌টি নিকটতর?” (সূরা ইসরা : ৫৭)।

আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঈসা ইবন মারইয়াম ও তাঁর মাকে আহ্বান করত। মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ مَّا ٱلۡمَسِيحُ ٱبۡنُ مَرۡيَمَ إِلَّا رَسُولٞ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهِ ٱلرُّسُلُ وَأُمُّهُۥ صِدِّيقَةٞۖ كَانَا يَأۡكُلَانِ ٱلطَّعَامَۗ ٱنظُرۡ كَيۡفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ ٱلۡأٓيَٰتِ ثُمَّ ٱنظُرۡ أَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ . قُلۡ أَتَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗاۚ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ﴾ [المائ‍دة: ٧٥،  ٧٦] 

 “মারইয়ামের পুত্র মসীহ একজন রাসূল ছাড়া তো আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন, আর মসীহের মাতা ছিল একজন সত্যসন্ধ নারী ; তাঁরা উভয়ে (ক্ষুধার সময়) অন্ন ভক্ষণ করতেন, লক্ষ্য কর, কিরূপে আমরা তাদের জন্য প্রমাণগুলিকে বিশদ রূপে বর্ণনা করে দিচ্ছি, অতঃপর আরও দেখ তারা (বিভ্রান্ত হয়ে চলছে) কোন দিকে! জিজ্ঞাসা কর : তোমরা কি আল্লাহকে ছেড়ে এমন কছুর ইবাদত করতে থাকবে যারা তোমাদের অনিষ্ট বা ইষ্টি করার কোনও অধিকার রাখে না ! আর আল্লাহ, একমাত্র তিনিই তো হচ্ছেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা মায়েদা : ৭৫-৭৬)

উল্লেখিত হঠকারীদের নিকটে আল্লাহ্‌ তা‘আলার একথাও উল্লেখ কর :

﴿ وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١ ﴾ [سبا: ٤٠،  ٤١] 

“এবং (স্বরণ করুন সেই দিনের কথা) যে দিন আল্লাহ একত্রে সমবেত করবেন তাদের সকলকে, তারপর ফেরেশতাদিগকে বলবেন : এরা কি বন্দেগী করত তোমাদের? তারা বলবে: পবিত্রতায় সুমহান আপনি! আপনিই তো আমাদের রক্ষক-অভিভাবক, তারা নয়,  কখনই না, বরং অবস্থা ছিল এই যে, এরা পূজা করত জিনদের, এদের অধিকাংশই জিনদের প্রতিই ছিল বিশ্বাসী।”(সূরা সাবা : ৪০-৪১)

অনুরূপভাবে (হঠকারীদের কাছে) আল্লাহর সে বাণীও উল্লেখ কর:

﴿ وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنۡ أَقُولَ مَا لَيۡسَ لِي بِحَقٍّۚ إِن كُنتُ قُلۡتُهُۥ فَقَدۡ عَلِمۡتَهُۥۚ تَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِي وَلَآ أَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ١١٦ ﴾ [المائ‍دة: ١١٦] 

“আর স্মরণ করুন যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা ! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন : তোমরা আমাকে ও আমার মাতাকে আল্লাহ ছাড়াও আর দু’টি ইলাহরূপে গ্রহণ কর? ঈসা বলবেন, মহিমময় আপনি ! যা বলার অধিকার আমার নেই আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব হতে পারে না, আমি ঐ কথা বলে থাকলে আপনি তা নিশ্চয় অবগত আছেন, আমার অন্তরের বিষয় আপনি বিদিত আছেন কিন্তু আপনার অন্তরের বিষয় আমি অবগত নই, নিশ্চয় আপনি, একমাত্র আপনিই তো হচ্ছন সকল গায়েবী বিষয়ের সম্যক পরিজ্ঞাত।” (সূরা মায়েদাহ : ১১৬)

তারপর তাকে বল : তুমি কি (এখন) বুঝতে পারলে যে, আল্লাহ প্রতিমা-পুজকদের যেমন কাফের বলেছেন, তেমনি যারা নেক লোকদের শরণাপন্ন হয় তাদেরকেও কাফের বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে জেহাদও করেছেন।

তারপর যদি সে বলে : কাফেরগণ (আল্লাহ ছাড়া) তাদের নিকট কামনা করে থাকে আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ মঙ্গল অমঙ্গলের মালিক ও সৃষ্টির পরিচালক, আমি তো তাকে ছাড়া অন্য কারোর নিকট কিছুই কামনা করি না। সৎলোকদের এসব বিষয়ে কিছুই করার নেই, তবে আমি তাদের শরণাপন্ন হই এ জন্য যে, তারা আল্লাহর নিকটে সুপারিশ করবে।

এর জবাব হচ্ছে, এ তো কাফেরদের কথার হুবহু প্রতিধ্বনি মাত্র। তুমি তাকে আল্লাহর এই কালাম শুনিয়ে দাও :

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣] 

“আর আল্লাহকে ব্যতীত অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে যারা (তারা বলে) আমরা তো ওদের ইবাদত করি না, তবে (তাদের শরণাপন্ন হই) যাতে তারা সুপারিশ করে আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।” (সূরা যুমার: ৩)

তাছাড়া আল্লাহর এ কালামও তাদের শুনিয়ে দাও :

﴿وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨] 

“তারা (মুশরিকগণ) বলে: এরা হচ্ছে আল্লাহ নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” (সূরা ইঊনুস : ১৮)

আর জেনে রাখ, উপরোক্ত তিনটি শংসয়[9] ও সন্দেহই হচ্ছে তাদের (বর্তমান কালের মুশরিকদের) সবচেয়ে বড় সন্দেহ। যখন তুমি জানতে পারলে যে আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে তাঁর কিতাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, আর তুমি তা সম্যকভাবে বুঝতে পারবে তখন এর পরবর্তী অন্যান্য সন্দেহসমূহের উত্তর দেওয়া আরও সহজ।

অষ্টম অধ্যায়

দোআ ইবাদতের সারৎসার

[যারা মনে করে যে, দো‘আ ইবাদত নয় তাদের প্রতিবাদ]

যদি সে বলে, আমি আল্লাহ ছাড়া কারোর উপাসনা করি না, আর সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের নিকট (বিপদে) আশ্রয় প্রার্থনা, তাদের ডাকা বা আহ্বান করা, তাদের ইবাদত নয়।

তবে তুমি তাকে বল: তুমি কি স্বীকার কর যে, আল্লাহ ইবাদতকে একমাত্র তাঁরই  জন্য খালেস বা বিশুদ্ধ করা তোমার উপর ফরয করেছেন, আর এটা তোমার উপর তাঁর প্রাপ্য হক? যখন সে বলবে হ্যাঁ, আমি তা স্বীকার করি, তখন তাকে বল: এখন আমাকে বুঝিয়ে দাও, কি সেই ইবাদত যা একমাত্র তাঁরই জন্য খালেস করা তোমার উপর তিনি ফরয করেছেন এবং তা তোমার উপর তাঁর প্রাপ্য হক। ইবাদত কাকে বলে এবং তা কত প্রকার তা যদি সে না জানে তবে এ সম্পর্কে তার নিকটে আল্লাহর এই বাণী বর্ণনা করে দাও:

﴿ ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ﴾ [الاعراف: ٥٥] 

“তোমরা ডাক বা আহ্বান কর নিজেদের রবকে বিনীতভাবে ও সংগোপনে”। (সূরা আ‘রাফ : ৫৫)

এটা তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস কর, দো‘আ করা (কাউকে ডাকা বা আহ্বান করা) যে ইবাদত সেটা কি এখন বুঝলে? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ; আর দো‘আই তো হচ্ছে ইবাদতের নির্যাস বা সারবস্তু। তখন তুমি তাকে বল, যখন তুমি স্বীকার করে নিলে যে, দো‘আ হচ্ছে ইবাদত, আর তুমি আল্লাহকে দিবানিশি ডাকছ ভয়ে সন্ত্রস্ত আর আশায় উদ্দীপিত হয়ে, এই অবস্থায় যখন তুমি কোনো নবীকে অথবা অন্য কাউকে ডাকছ ঐ একই প্রয়োজন মিটানোর জন্য, তখন কি তুমি আল্লাহর ইবাদতে অন্যকে শরীক করছ না? সে তখন অবশ্যই বলতে বাধ্য হবে, হ্যাঁ শরীক করছি বটে !

অতঃপর তাকে বল, যখন আমি আল্লাহর এই বাণী:

﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢] 

“অতএব তুমি সালাত পড়বে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং (তাঁর নামেই) নাহর[10]/যবাই কর” (সূরা কাউসার: ২) এর উপর ‘আমল করে আল্লাহর আনুগত্য করে তাঁর নাম নিয়েই তুমি যখন নহর/যবাই করছ তখন সেটা কি ইবাদত নয়? এর জওয়াবে সে অবশ্য বলবে : হ্যাঁ, ইবাদতই বটে। এবার তাকে বল, তুমি যদি কোনো সৃষ্টির জন্য যেমন নবী, জিন বা অন্য কিছুর জন্য কুরবানী কর, তবে কি তুমি এই ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করলে না ? সে অবশ্যই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে এবং বলবে: হ্যাঁ।

তাকে তুমি একথাও বল : যে মুশরিকদের সম্বন্ধে কুরআন (এর নির্দিষ্ট আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছে তারা কি ফেরেশ্‌তা, নেকলোক ও লাত উয্‌যা প্রভৃতির ইবাদত করত? সে অবশ্য বলবে : হ্যাঁ, করত। তারপর তাকে বল, তাদের ইবাদত বলতে তাদেরকে ডাকা বা আহ্বান করা, (তাদের নামে) যবাই করা ও আশ্রয় প্রার্থনা ইত্যাদিই কি নয়? নতুবা তারা তো নিজেদেরকে আল্লাহরই বান্দা ও তাঁরই প্রতাপাধীন বলে স্বীকৃতি দিত। আর একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহই সমস্ত বস্তু ও বিষয়ের পরিচালক। কিন্তু তারা আল্লাহর নিকট তাদের (নেককার লোক, লাত ও উযযা প্রভৃতির) যে মর্যাদা রয়েছে (বলে বিশ্বাস করত) ও সুপারিশ (করার ক্ষমতা) রয়েছে বলে বিশ্বাস করত, সেটার জন্যই তাদের আহ্বান করত বা তাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করত। আর এ বিষয়টি একেবারেই সুস্পষ্ট।

নবম অধ্যায়

শরী‘আতসম্মত শাফা‘আত (সুপারিশ) এবং শিরকী শাফা‘আতের মধ্যে পার্থক্য

যদি সে বলে, তুমি কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আতকে অস্বীকার করছ ও তাঁর থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত মনে করছ? তুমি তাঁকে উত্তরে বলবে : না, অস্বীকার করি না। তাঁর থেকে নিজেকে নির্লিপ্তও মনে করি না।

বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই শাফা‘আতকারী, আর তার শাফা‘আত অবশ্যই কবুল করা হবে। আমিও তাঁর শাফা‘আতের আকাঙ্খী। কিন্তু শাফা’আতের যাবতীয় চাবিকাঠি আল্লাহরই হাতে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ﴾ [الزمر: ٤٤] 

“বলুন, সকল প্রকারের শাফা‘আতের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।” (আয-যুমার : ৪৪) আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো শাফা‘আতই অনুষ্ঠিত হবে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥] 

 তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর হুজুরে সুপারিশ করতে পারে কে আছে এমন ব্যক্তি? (আল বাকারাহ : ২৫৫) আর কারো সম্বন্ধেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা‘আত করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সম্বন্ধে আল্লাহ শাফা‘আতের অনুমতি দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন :

 ﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ﴾ [الانبياء: ٢٨] 

 “আর আল্লাহ মর্জী করেন যার সম্বন্ধে সেই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য তাঁরা সুপারিশ করবে না।” (সুরা আম্বিয়া : ২৮ আয়াত)।

আর (এটা স্বীকৃত কথা যে) আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদ (অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেছে, খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন লোক) ছাড়া কিছুতেই রাজী হবেন না। যেমন তিনি বলেছেন,

﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ ﴾ [ال عمران: ٨٥] 

“বস্তুত ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনও দ্বীনের উদ্দেশ্য করবে যে ব্যক্তি, তার পক্ষ থেকে আল্লাহর হুজুরে তা কখনো গৃহীত হবে না।” (আলে ইমরান : ৮৫)।

সুতরাং যখন সাব্যস্ত হলো যে, সমস্ত শাফা‘আত আল্লাহর অধিকারভুক্ত এবং তা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষ, আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত করতে সক্ষম হবেন না, আর আল্লাহর অনুমতি একমাত্র মুওয়াহ্‌হিদ (তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকারী) দের জন্যই নির্দিষ্ট, তখন তোমার নিকট একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সকল প্রকারের সমস্ত শাফা‘আতের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। (তাহলে কি তুমি অন্য কারও কাছে এ শাফা‘আত চাইতে পার? কখনও না)

অতএব আমি শাফা‘আত আল্লাহরই নিকট চাই এবং বলি, “হে আল্লাহ ! আমাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আত থেকে মাহরূম (বঞ্চিত) করো না। হে আল্লাহ ! তুমি তাঁকে আমার জন্য শাফা‘আতকারী বানিয়ে দাও। অথবা অনুরূপ কিছু বলি।

আর যদি সে বলে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাফা‘আতের অধিকার দেয়া হয়েছে, কাজেই আমি তাঁর নিকটেই ঐ বস্তু চাচ্ছি যা আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন।

তখন তুমি উত্তরে বলবে, আল্লাহ তাঁকে শাফাআত করার অধিকার প্রদান করেছেন, আর সাথে সাথে তিনি তোমাকে তাঁর নিকটে শাফাআত চাইতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন,

﴿ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]   

“অতএব (তোমরা ডাকবে বা আহ্বান করবে একমাত্র আল্লাহকে এবং) আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকেই ডাকবে না[11]।” (জিন: ১৮) সুতরাং যদি তুমি আল্লাহকে এই বলে ডাকবে যে, তিনি যেন তাঁর নবীকে তোমার জন্য সুপারিশকারী করে দেন, তখন তুমি আল্লাহর এই নিষেধ বাণী :

﴿ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]   

“আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকেই ডাকবে না। (সুরা জিন : ১৮) এটাকেও যথাযথভাবে পালন কর[12]

আরও একটি কথা হচ্ছে যে, সুপারিশের অধিকার নবী ব্যতীত অন্যদেরও দেয়া হয়েছে। যেমন, ফেরেশতারা সুপারিশ করবেন, ওলীগণও সুপারিশ করবেন। মা‘সুম বাচ্চারাও (তাদের পিতামাতাদের জন্য) সুপারিশ করবেন।

কাজেই তুমি কি সেই অবস্থায় বলতে পারো যে, যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে সুপারিশের অধিকার দিয়েছেন, কাজেই তাদের কাছেও তোমরা শাফাআত চাইবে? যদি তা চাও তবে তুমি নেক ব্যক্তিদের উপাসনায় শামিল হ’লে

যা আল্লাহ তাঁর কিতাবে (হারাম বা অবৈধ বলে) উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে তুমি যদি বল, ‘না, (তাদের কাছে সুপারিশ চেয়ে বেড়াই না), তবে সেই অবস্থায় তোমার এই কথা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতেল হয়ে যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাকে সুপারিশের অধিকার প্রদান করেছেন এবং আমি তার নিকট সেই বস্তুই চাচ্ছি যা তিনি তাকে দান করেছেন।”

দশম অধ্যায়

[এ কথা সাব্যস্ত করা যে, নেক লোকদের নিকট বিপদে আপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা শির্ক এবং যারা একথা অস্বীকার করে তাদেরকে সেটা মেনে নিতে বাধ্য করা]

যদি সে বলে : আমি আল্লাহর সঙ্গে কোনো বস্তুকেই শরীক করি না— কিছুতেই নয়, কক্ষণও নয়। তবে নেক লোকদের নিকট বিপদে আপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা শির্ক নয়।

এর জওয়াবে তাকে বল, যখন তুমি স্বীকার করে নিয়েছ যে, ব্যভিচার অপেক্ষা শির্ককে আল্লাহ তা‘আলা অধিক গুরুতর হারাম বলে নির্দেশিত করেছেন, আর এ কথাও মেনে নিয়েছ যে, আল্লাহ তা‘আলা এই মহা পাপ ক্ষমা করেন না, তাহলে (তুমি বল) সেটা কি বস্তু যা তিনি হারাম করেছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, তিনি তা ক্ষমা করবেন না? কিন্তু এ বিষয়ের উত্তর সে জানে না।

তখন তাকে তুমি বল, তুমি শির্ক কী তা জানলে না, তখন তা থেকে আত্মরক্ষা কীভাবে করবে? অথবা একথাও জানলে না যে, কেন আল্লাহ তোমার উপর শির্ক হারাম করেছেন আর বলে দিয়েছেন যে, তিনি ঐ পাপ মা’ফ করবেন না। আর তুমি এ বিষয়ে কিছুই জানলে না এবং সেটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাও করলে না। তুমি কি ধারণ করে বসে আছ যে, আল্লাহ এটাকে হারাম করেছেন আর তিনি সেটাকে বর্ণনা ব্যতীতই ছেড়ে দিবেন?

যদি সে বলে, শির্ক হচ্ছে মূর্তিপূজা, আর আমরা তো মূর্তিপূজা করছি না, তবে তাকে বল, মূর্তিপূজা কাকে বলে? তুমি কি মনে কর যে, মুশরিকগণ এই বিশ্বাস পোষণ করত যে এসব কাঠ ও পাথর (নির্মিত মূর্তিগুলো) যারা তাদেরকে আহ্বান করে তাদেরকে সৃষ্টি, রেযেক প্রদান কিংবা তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম? একথা তো কুরআন মিথ্যা বলে ঘোষণা করেছে[13]

যদি সে বলে, শির্ক হচ্ছে যারা কাঠ ও পাথর নির্মিত মূতি বা কবরের উপর নির্মিত সৌধ ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য এদের প্রতি আহ্বান জানায়, এদের উদ্দেশ্যে বলীদান করে এবং বলে যে, এরা সুপারিশ করে আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যাবে, আর এদের বরকতে আল্লাহ আমাদের বিপদ-আপদ দূর করবেন বা আল্লাহ এদের বরকতে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। তবে তাকে বল : হ্যাঁ, তুমি সত্য কথাই বলেছ, আর এটাই তো তোমাদের কর্মকান্ড যা পাথর, কবরের সৌধ প্রভৃতির নিকটে তোমরা করে থাক। ফলত: সে স্বীকার করছে যে, তাদের এই কাজগুলোই হচ্ছে মুর্তিপূজা, আর এটাই তো আমরা চাই[14]

 তাকে একথাও বলা যেতে পারে, তুমি বলছ শির্ক হচ্ছে মূর্তিপূজা, তবে কি তুমি বলতে চাও যে, শুধু মূর্তিপূজার মধ্যেই শির্ক সীমিত, অর্থাৎ এর বাইরে কোনো শির্ক নেই? “নেক লোকদের প্রতি ভরসা করা আর তাদেরকে আহ্বান করা শির্কের মধ্যে কি গণ্য নয়?” (যদি তুমি এরূপ দাবী কর, তবে) তোমার এ দাবী তো আল্লাহ তাঁর কুরআনে খণ্ডন করেছেন; কারণ যারা ফেরেশতা, ঈসা এবং নেক-লোকদের সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করেছে, তাদেরকে তিনি কুফরি করেছে বলে বর্ণনা করেছেন। ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপেই সে তোমার কাছে এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে কোনো নেক বান্দাকে শরীক করে তার সেই কাজকেই কুরআনে শির্ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এইটিই তো আমার উদ্দেশ্য[15]

এই বিষয়ের গোপন রহস্য হচ্ছে,

যখন সে বলে, আমি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করি না,

তখন তুমি তাকে বল, আল্লাহর সঙ্গে শির্কের অর্থ কি? তুমি তার ব্য্যাখ্যা দাও।

যদি সে এর ব্যাখ্যায় বলে, তা হচ্ছে মূর্তিপূজা,

তখন তুমি তাকে আবার প্রশ্ন কর, মূর্তি পূজার মানে কি? তুমি আমাকে তার ব্যাখ্যা প্রদান কর।

যদি সে উত্তরে বলে, আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করি না,

তখন তাকে আবার প্রশ্ন কর, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতেরই বা অর্থ কি? এর ব্যাখ্যা দাও। উত্তরে যদি সে কুরআন যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছে[16] সেই ব্যাখ্যাই দেয় তবেতো আমাদের দাবীই সাব্যস্ত হচ্ছে, আর এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর যদি সে তা না জানে[17], তবে সে কেমন করে এমন বস্তুর দাবী করছে যা সে জানে, তবে সে কেনম করে এমন বস্তুর দাবী করছে যা সে জানে না?

আর যদি সে তার এমন ব্যাখ্যা প্রদান করে যা তার প্রকৃত অর্থ নয়, তখন তুমি তার নিকটে আল্লাহর সঙ্গে শির্ক এবং মূর্তিপূজা সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতগুলো বর্ণনা করে দাও। আরও বর্ণনা করে দাও যে এ কাজটিই হুবহু করে চলেছে এ যুগের মুশরিকগণ। আরও বর্ণনা কর যে, শরীকবিহীন একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের বিষয়টিই তো তারা আমাদের কাছ থেকে মেনে নিতে অস্বীকার করছে এবং শোরগোল করছে, যেমন তাদের পূর্বসূরীরা করেছিল এবং বলেছিল,

﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]

“এই লোকটি কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করছে? এ তো ভারী এক আশচর্য্য ব্যাপার !” (সূরা সাদ : ৫)

অতঃপর সে যদি বলে, ফেরেশতা ও আম্বিয়াদের ডাকার কারণে তাদেরকে তো কাফের বলা হয় নি; বরং ফেরেশতাদেরকে যারা আল্লাহর কন্যা বলেছিল তাদেরকেই কাফের বলা হয়েছিল। আমরা তো আবদুল কাদের বা অন্যদেরকে আল্লাহর পুত্র বলি না।

 তার উত্তর হচ্ছে এই যে, (ফেরেশতা ও আম্বিয়াদেরকে ডাকা অবশ্যই শির্ক। সেটা বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো আয়াতে আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত  করাকে কুফরী বলা হয়েছে; কারণ) সন্তানকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত করাটাই স্বয়ং আলাদা কুফরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ١ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ٢ ﴾ [الاخلاص: ١،  ٢] 

“বল, তিনিই একক আল্লাহ (তিনি ব্যতীত আল্লাহ আর কেউ নেই) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী[18]” (সূরা ইখলাস : ১-২ আয়াত]

“আহাদ” এর অর্থ হ’ল, তিনি একক এবং তার সমতুল্য কেউই নেই। আর “সামাদ” এর অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজনে একমাত্র যার স্মরণ নেয়া হয়। অতএব যে এটাকে অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে[19] -যদিও সে সূরাটিকে অস্বীকার করে না।

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ مَا ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ مِن وَلَدٖ وَمَا كَانَ مَعَهُۥ مِنۡ إِلَٰهٍۚ ﴾ [المؤمنون: ٩١] 

“আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি, আর তাঁর সঙ্গে অপর কোনো ইলাহ্‌ও (উপাস্য) নেই।” (মুমিনুন : ৯১) এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কুফরীর দুটি প্রকরণের উল্লেখ করেছেন, আর তিনি এতদোভয়কেই পৃথক ভাবে কুফরি সাব্যস্ত করেছেন।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ شُرَكَآءَ ٱلۡجِنَّ وَخَلَقَهُمۡۖ وَخَرَقُواْ لَهُۥ بَنِينَ وَبَنَٰتِۢ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ﴾ [الانعام: ١٠٠] 

 “আর এই (অজ্ঞ) লোকগুলো জিনকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে নিয়েছে অথচ ঐ গুলোকে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, আর তাঁর জন্য তারা কতকগুলো পুত্র-কন্যাও উদ্ভাবন করে নিয়েছে কোন জ্ঞান ব্যতিরেকে—কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়া।” (আন‘আম :১০০) এ আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা দুই প্রকারের কুফরীকে পৃথক ভাবে উল্লেখ করেছেন।

এর প্রমাণ এটাও হতে পারে যে, যারা লাতকে আহ্বান করে কাফের হয়ে গিয়েছিল, যদিও লাত ছিল একজন সৎলোক। তারা তাকে আল্লাহর ছেলেও বলেনি। অনুরূপভাবে যারা জিনদের পূজা করে কাফের হয়ে গিয়েছিল তারাও তাদেরকে আল্লাহর ছেলে বলে নি[20]

তদ্রূপ “মুরতাদ” (যারা ঈমান আনার পর কাফের হয়ে যায় তাদের) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে চার মাযহাবের আলেমগণ বলেছেন যে, মুসলিম যদি ধারণা রাখে যে, আল্লাহর ছেলে রয়েছে তবে সে “মুরতাদ” হয়ে গেল। তারাও উক্ত দুই প্রকারের কুফরীর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এটা তো খুবই স্পষ্ট।

 আর যদি সে আল্লাহর এই কালাম পেশ করে :

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [يونس: ٦٢] 

“সাবধান, আল্লাহর ওলী যারা, কোনো আশঙ্কা নেই তাদের এবং কখনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না তারা।” (ইউনুস : ৬২)

তবে তুমি বল : হ্যাঁ, একথা তো অভ্রান্ত সত্য, কিন্তু তাই বলে তাদের পূজা করা চলবে না।

আর আমরা কেবল আল্লাহর সঙ্গে অপর কারো পূজা এবং তার সঙ্গে শির্কের কথাই উল্লেখ (করে তা অস্বীকার) করছি। নচেৎ আওলিয়াদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ও তাদের অনুসরণ করা এবং তাদের কারামতগুলোকে স্বীকার করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্যআর আওলিয়াদের কারামতকে বিদ‘আতী ও বাতিলপন্থীগণ ছাড়া কেউ অস্বীকার করে না।

আল্লাহর দ্বীন দুই প্রান্ত সীমার (অতিরঞ্জন ও কমতি করার) মধ্যস্থলে, আর বিপরীতমুখী ভ্রষ্টতার মাঝখানে হেদায়াত এবং দুই বাতিলের মধ্যপথে অবস্থিত হক।

একাদশ অধ্যায়

[আমাদের যুগে লোকদের শির্ক অপেক্ষা পূ্র্ববর্তী লোকদের শির্ক ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা (দু’দিক থেকে)]

তুমি যখন বুঝতে পারলে যে, যে বিষয়টিকে আমাদের যুগের মুশরিকগণ নাম দিয়েছেন ই‘তেকাদ’—(ভক্তি মিশ্রিত বিশ্বাস)[21] সেটাই হচ্ছে সেই শির্ক; যার বিরুদ্ধে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল যার কারণে লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন। তখন তুমি জেনে রাখ যে, পূর্ববর্তী লোকদের শির্ক ছিল বর্তমান যুগের লোকদের শির্ক অপেক্ষা অধিকতর হালকা বা লঘুতর। আর তার কারণ হচ্ছে দু’টি:

এক. পূর্ববর্তী লোকগণ কেবল সুখ স্বাচ্ছন্দের সময়েই আল্লাহর সঙ্গে অপরকে শরীক করতো এবং ফেরেশতা আওলিয়া ও ঠাকুর-দেবতাদেরকে আহবান জানাতো, কিন্তু বিপদ আপদের সময় একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতো, সে ডাক হ’ত সম্পূর্ণ নির্ভেজাল। যেমন আল্লাহ তাঁর পাক কুরআনে বলেছেন:

﴿ وَإِذَا مَسَّكُمُ ٱلضُّرُّ فِي ٱلۡبَحۡرِ ضَلَّ مَن تَدۡعُونَ إِلَّآ إِيَّاهُۖ فَلَمَّا نَجَّىٰكُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ أَعۡرَضۡتُمۡۚ وَكَانَ ٱلۡإِنسَٰنُ كَفُورًا ٦٧ ﴾ [الاسراء: ٦٧] 

“সাগর বক্ষে যখন কোন বিপদ তোমাদেরকে স্পর্শ করে, আল্লাহ ব্যতীত আর যাদেরকে ডেকে থাক তোমরা, তারা সকলেই তো তখন (মন হ’তে দূরে) সরে যায়, কিন্তু আল্লাহ যখন তোমাদেরকে স্থলভাগে পৌঁছিয়ে উদ্ধার করেন, তখন তোমরা অন্যদিকে ফিরে যাও; নিশ্চয় মানুষ হচ্ছে অতিশয় না অকৃতজ্ঞ।” (বনী ইসরাঈল : ৬৭)

আল্লাহ এ কথাও বলেছেন:

﴿ قُلۡ أَرَءَيۡتَكُمۡ إِنۡ أَتَىٰكُمۡ عَذَابُ ٱللَّهِ أَوۡ أَتَتۡكُمُ ٱلسَّاعَةُ أَغَيۡرَ ٱللَّهِ تَدۡعُونَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٤٠ بَلۡ إِيَّاهُ تَدۡعُونَ فَيَكۡشِفُ مَا تَدۡعُونَ إِلَيۡهِ إِن شَآءَ وَتَنسَوۡنَ مَا تُشۡرِكُونَ ٤١ ﴾ [الانعام: ٤٠،  ٤١] 

“বল, তোমরা নিজেদের সম্বন্ধে বিবেচনা করে দেখ। তোমাদের প্রতি আল্লাহর কোন আযাব যদি আপতিত হয় অথবা কিয়ামত দিবস যদি এসে পড়ে তখন কি তোমরা আহ্বান করবে আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকেও? (উত্তর দাও) যদি তোমরা সত্যবাদী হও। কখনই না, বরং তোমরা আহ্বান করবে তাঁকে, অতঃপর যে আপদের কারণে তাঁকে আহ্বান করছ, ইচ্ছা করলে তিনি সেই আপদগুলো দূর করে দিবেন। (আহ্বানের কারণস্বরূপ আপদগুলো মোচন করে দিবেন) আর তোমরা যা কিছুকে আল্লাহর শরীক করছ তাদেরকে তোমরা তখন ভূলে যাবে।” (আন‘আম :৪০-৪১)

 আল্লাহ তা‘আলা একথাও বলেছেন:

﴿ ۞وَإِذَا مَسَّ ٱلۡإِنسَٰنَ ضُرّٞ دَعَا رَبَّهُۥ مُنِيبًا إِلَيۡهِ ثُمَّ إِذَا خَوَّلَهُۥ نِعۡمَةٗ مِّنۡهُ نَسِيَ مَا كَانَ يَدۡعُوٓاْ إِلَيۡهِ مِن قَبۡلُ وَجَعَلَ لِلَّهِ أَندَادٗا لِّيُضِلَّ عَن سَبِيلِهِۦۚ قُلۡ تَمَتَّعۡ بِكُفۡرِكَ قَلِيلًا إِنَّكَ مِنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلنَّارِ ٨ ﴾ [الزمر: ٨] 

“যখন কোন দু:খ কষ্ট আপতিত হয় মানুষের উপর তখন সে নিজ রবকে ডাকতে থাকে তদ্‌গতভাবে, অতঃপর যখন তিনি তাকে কোনো নেয়ামতের দ্বারা অনুগৃহীত করেন, তখন সে ভুলে যায় সেই বস্তুকে যার জন্য সে পূ্র্বে প্রার্থনা করেছিল এবং আল্লাহর বহু সদৃশ ও শরীক বানিয়ে নেয়; তাঁর পথ থেকে (লোকদেরকে) ভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে। বল, কিছুকাল তুমি নিজের কুফরজনিত সুখ সুবিধা ভোগ করলেও, নিশ্চয় তুমি হচ্ছ জাহান্নামের অধিবাসীদের একজন।” (যুমার : ৮)

আর আল্লাহর এই বাণী :

﴿ وَإِذَا غَشِيَهُم مَّوۡجٞ كَٱلظُّلَلِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ﴾ [لقمان: ٣٢] 

“যখন পর্বতের ন্যায় তরঙ্গমালা তাদের উপর ভেঙ্গে পড়ে, তখন তারা আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে তাঁকে ডাকতে থাকে।” (সূরা লোকমান: ৩২)

 যে ব্যক্তি এই বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হ’ল যা আল্লাহ তাঁর কেতাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন- যার সারৎসার হচ্ছে এই যে, যে মুশরিকদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে করেছিলেন তারা তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার সময়ে আল্লাহকেও ডাকতো আবার আল্লাহ ছাড়া অন্যকেও ডাকতো, কিন্তু বিপদ-বিপর্যয়ের সময় তারা একক ও লা শরীক আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকেই ডাকতো না, তারা  বরং সে সময় অন্য সব মাননীয় ব্যক্তি ও পূজ্য সত্তাদের ভুলে যেতো, সেই ব্যক্তির নিকট পূর্ব যামানার লোকদের শির্ক এবং আমাদের বর্তমান যুগের লোকদের শির্কের পার্থক্যটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন লোক কোথায় পাওয়া যাবে যার হৃদয় এই বিষয়টি উত্তমরূপে ও গভীর ভাবে উপলব্ধি করবে ? একমাত্র আল্লাহই আমাদের সহায় !

দুই. পূর্ব যামানার লোকগণ আল্লাহর সঙ্গে এমন ব্যক্তিদের আহ্বান করতো যারা ছিল আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত, তারা হয় নবী-রাসূলগণ, নয় তো ওলী-আওলীয়া, নতুবা ফেরেশতাগণ। এছাড়া তারা হয়তো পূজা করতো এমন বৃক্ষ অথবা পাথরের যারা আল্লাহর একান্ত বাধ্য ও হুকুমবরদার, কোনোক্রমেই তারা অবাধ্য নয়, আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী নয়।

কিন্তু আমাদের এই যুগের লোকেরা আল্লাহর সঙ্গে এমন লোকদের ডাকে এবং তাদের নিকট প্রার্থনা জানায় যারা নিকৃষ্টতম অনাচারী (ফাসেক), আর যারা তাদের নিকট ধর্ণা দেয় ও প্রার্থনা জানায় তারাই তাদের অনাচারগুলোর কথা ফাঁস করে দেয়, সে অনাচারগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যভিচার, চুরি এবং নামায পরিত্যাগের মত গর্হিত কাজসমূহ। আর যারা নেক লোকদের প্রতি আস্থা রেখে তাদের পূজা করে বা এমন বস্তুর পূজা করে যেগুলো কোন পাপ করে না— যেমন : গাছ, পাথর ইত্যাদি, তারা ঐ সব লোকদের থেকে নিশ্চয় লঘুতর পাপী যারা ঐ লোকদের পূজা করে যাদের অনাচার ও পাপাচারগুলোকে তারা স্বয়ং দর্শন করে থাকে এবং তার সাক্ষ্যও প্রদান করে থাকে[22]

দ্বাদশ অধ্যায়

[‘যে ব্যক্তি দ্বীনের কতিপয় ফরয ওযাজেব অর্থাৎ অবশ্যকরণীয় কর্তব্য পালন করে, সে তাওহীদ বিরোধী কোন কাজ করে ফেললেও কাফের হয়ে যায় না।’ যারা এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, তাদের ভ্রান্তির নিরসন এবং তার বিস্তারিত প্রমাণপঞ্জি]

উপরের আলোচনায় একথা সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, যাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদ করেছেন তারা এদের (আজকের দিনে শির্কী কাজে লিপ্ত নামধারী মুসলিমদের) চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধিমান ছিল এবং তাদের শির্ক অপেক্ষাকৃত লঘু ছিল।

অতঃপর একথাও তুমি জেনে রাখো যে, এরা আমাদের বক্তব্যের ব্যাপারে একটি সংশয় উপস্থাপন করে, যা তাদের অন্যতম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ

অতএব এই ভ্রান্তির  অপনোদন ও সন্দেহের অবসানকল্পে নিম্নের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন।

তারা বলে থাকে: যাদের প্রতি সাক্ষাতভাবে কুরআন নাযিল হয়েছিল (অর্থাৎ মক্কার কাফির মুশরিকগণ) তারা ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বুদ নেই’ একথার সাক্ষ্য প্রদান করে নি, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যা বলেছিল, তারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছিল, তারা কুরআনকে মিথ্যা বলেছিল এবং বলেছিল এটা একটা জাদু-মন্ত্র। কিন্তু আমরা তো সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে, আল্লাহ ছাড়া নেই কোনো মা‘বুদ এবং (এ সাক্ষ্যও দেই যে,) নিশ্চয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল, আমরা কুরআনকে সত্য বলে জানি ও মানি আর পুনরুত্থান এর উপর বিশ্বাস রাখি, আমরা নামায পড়ি এবং রোযাও রাখি, তবু আমাদেরকে এদের (উক্ত বিষয়ে অবিশ্বাসী কাফেরদের) মত মনে কর কেন?

এর জওয়াব হচ্ছে এই যে, এ বিষয়ে সমগ্র ‘আলেম সমাজ তথা শরী‘আতের বিদ্বান মণ্ডলী একমত যে, একজন লোক যদি কোনো কোনো ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য বলে মানে, আর কোনো কোনো বিষয়ে তাঁকে মিথ্যা বলে ভাবে, তবে সে নির্ঘাত কাফের, সে ইসলামে প্রবিষ্টই’ হতে পারে না; এই একই কথা প্রযোজ্য হবে তার উপরেও যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস করল, আর কতক অংশকে অস্বীকার করল, যেমন কেউ তাওহীদকে স্বীকার করল কিন্তু নামায যে ফরয তা মেনে নিল না। অথবা তাওহীদও স্বীকার করল, নামাযও পড়ল কিন্তু যাকাত যে ফরয তা মানল না; অথবা এগুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু রোযাকে অস্বীকার করে বসল কিংবা ঐগুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু একমাত্র হজ্বকে অস্বীকার করল, এরা সবাই হবে কাফের।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানায় কতক লোক হজ্বকে মেনে নিতে চায় নি বলে[23] তাদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন,

﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

“(পথের কষ্ট সহ্য করতে এবং) রাহা খরচ বহনে সক্ষম যে ব্যক্তি সে (শ্রেণির) সমস্ত মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই গৃহের (কা‘বাতুল্লাহর) হজ্ব করা অবশ্য কর্তব্য, আর যে ব্যক্তি তা অমান্য করল (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ হচ্ছেন সমুদয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী” [আলে ইমরান: ৯৭]

কোনো ব্যক্তি যদি এগুলো সমস্তই (অর্থাৎ তাওহীদ, নামায, যাকাত, রামাযানের সিয়াম, হজ্ব) মেনে নেয়, কিন্তু পুনরুত্থানের কথা অস্বীকার করে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের হয়ে যাবে। তার রক্ত এবং তার ধন-দৌলত সব হালাল হবে (অর্থাৎ তাকে হত্যা করা এবং তার ধন-মাল গ্রহণ করা আইন-সিদ্ধ হবে) যেমন আল্লাহ বলেছেন :

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُواْ بَيۡنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٖ وَنَكۡفُرُ بِبَعۡضٖ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيۡنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا ١٥٠ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ حَقّٗاۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ١٥١ ﴾ [النساء: ١٥٠،  ١٥١] 

“নিশ্চয় যারা আমান্য করে আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলদেরকে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের (আনুগত্যের) মধ্যে প্রভেদ করতে চায়, আর বলে কতককে আমরা বিশ্বাস করি অপর কতককে অমান্য করি এবং তারা ঈমানের ও কুফরের মাঝামাঝি একটা  পথ আবিষ্কার করে নিতে চায়— এই যে লোক সত্যই তারা হচ্ছে কাফের, বস্তুত কাফেরদের জন্য আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি এক লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (আন নিসা: ১৫০-১৫১)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাঁর কালামে পাকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের কিছু অংশকে মানবে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করবে, সে সত্যিকারের কাফের এবং তার প্রাপ্য হবে সেই বস্তু (শাস্তি) যা উপরে উল্লিখিত হয়েছে, সেহেতু এ সম্পর্কিত ভ্রান্তিরও অপনোদন ঘটেছে[24]

আর এ বিষয়টি জনৈক ‘আহ্‌সা’-বাসী আমার নিকট প্রেরিত তার পত্রে উল্লেখ করেছেন।

আর তাকে এ-কথাও বলা যাবে, তুমি যখন স্বীকার করছ যে, যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলকে সত্য জানবে আর কেবল নামাযের ফরয হওয়াকে অস্বীকার করবে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের হবে, আর তার জান-মাল হালাল হবে; অনুরূপভাবে সব বিষয় মেনে নিয়ে যদি পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তবুও সে কাফের হয়ে যাবে।

তদ্রূপ সে কাফের হয়ে যাবে যদি ঐ সমস্ত বস্তুর উপর ঈমান আনে, আর কেবলমাত্র রামযানের রোযাকে অস্বীকার করে। এতে কোনো মাযহাবেরই দ্বিমত নেই। আর কুরআনও এ কথাই বলেছে, যেমন আমরা ইতিপূর্বে বলেছি।

আর এটা জানা কথা যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব ফরয কাজ নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে তাওহীদ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় এবং তা নামায, রোযা ও হজ্ব হতেও শ্রেষ্ঠতর।

তাহলে যখন মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আনীত ফরয, ওয়াজিবসমূহের সবগুলোকে মেনে নিয়ে ঐগুলোর একটি মাত্র অস্বীকার করে কাফের হয়ে যায় তখন কি করে সে কাফের না হয়ে পারে যদি সমস্ত রাসূলদের দ্বীনের মূলবস্তু তাওহীদকেই সে অস্বীকার করে বসে? সুবহানাল্লাহ ! কি বিস্ময়কর এই মুর্খতা !

তাকে এ কথাও বলা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ বানু হানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা সাক্ষ্য প্রদান করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ্‌ নেই, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এ ছাড়া তারা আযানও দিত এবং নামাযও পড়ত।

সে যদি বলে যে, তারা তো মুসায়লামা (কায্‌যাব)-কে একজন নবী বলে মেনেছিল। তবে তার উত্তরে বলবে : ঐটিই তো আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা যদি কেউ কোনো ব্যক্তিকে নবীর মর্যাদায় উন্নীত করার কারণে কাফের হয়ে যায় এবং তার জান মাল হালাল হয়ে যায়, এই অবস্থায় তার দু’টি সাক্ষ্য (প্রথম সাক্ষ্য: আল্লাহ ছাড়া নেই অপর কোনো সত্য ইলাহ, দ্বিতীয় সাক্ষ্য: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল) তার কোনই উপকার সাধন করবে না। নামাযও তার কোনো উপকার করতে সক্ষম হবে না। অবস্থা যখন এই, তখন সেই ব্যক্তির পরিণাম কি হবে যে, শামসান, ইউসুফ[25] বা কোনো সাহাবী বা নবীকে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্‌র সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে? পাকপবিত্র তিনি, তাঁর শান-শওকত কত উচ্চ !

﴿ كَذَٰلِكَ يَطۡبَعُ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ ٥٩ ﴾ [الروم: ٥٩] 

“আল্লাহ এ ভাবেই যাদের জ্ঞান নেই, তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।” (সূরা রূম : ৫১)

প্রতিপক্ষকে এটাও বলা যাবে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যাদেরকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন তারা সকলেই ইসলামের দাবীদার ছিল এবং ‘আলীর অনুগামী ছিল, অধিকন্তু তারা সাহাবীগণের নিকটে শিক্ষা লাভ করেছিল। কিন্তু তারা আলীর সম্বন্ধে ঐ রূপ বিশ্বাস রাখত যেমন ইউসুফ, শামসান এবং তাদের মত আরও অনেকের সম্বন্ধে (এখন) বিশ্বাস পোষণ করা হয়

(প্রশ্ন হচ্ছে) তাহলে কি করে সাহাবীগণ তাদেরকে (ঐ ভাবে) হত্যা করার ব্যাপারে এবং তাদের কুফরীর উপর একমত হলেন? তা হলে তোমরা কি ধারণা করে নিচ্ছ যে, সাহাবীগণ মুসলিমকে কাফের রূপে আখ্যায়িত করেছেন? নাকি তোমরা ধারণা করছ যে, ‘তাজ’ এবং তার অনুরূপ অন্যান্যের উপর বিশ্বাস রাখা ক্ষতিকর নয়, কেবল ‘আলীর প্রতি ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখাই কুফরী?

আর এ কথাও বলা যেতে পারে যে, বানু আব্বাসের শাসনকালে যে বানু ওবায়দ আল-কাদ্দাহ মরক্কো প্রভৃতি দেশে ও মিসরে রাজত্ব করেছিল, তারা সকলেই ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” কলেমার সাক্ষ্য দিত— ইসলামকেই তাদের ধর্ম বলে দাবী করত। জুম‘আহ্ ও জামা‘আতে নামাযও আদায় করত। কিন্তু যখন তারা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের চাইতেও লঘু কোনো কোনো বিষয়ে শরী‘আতের বিধি ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণের কথা প্রকাশ করল, তখন তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপর ‘আালেম সমাজ একমত হলেন। আর তাদের দেশকে দারুল হরব বা যুদ্ধের দেশ বলে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করলেন। আর মুসলিমদের শহরগুলোর মধ্যে যেগুলো তাদের হস্তগত হয়েছিল তা পুনরুদ্ধার করে নিলেন।

তাকে আরও বলা যেতে পারে যে, পূর্ব যুগের লোকদের মধ্যে যাদের কাফের বলা হতো তাদের যদি এজন্যই তা বলা হত যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে মিথ্যা জানা এবং পুনরুত্থান প্রভৃতিকে অস্বীকার করা প্রভৃতি (কুফরী কাজ) একত্রে করেছিল— তাহলে “বাবু হুকমিল মুরতাদ” বা “মুরতাদের[26] হুকুম” নামীয় অধ্যায় কী অর্থ বহন করবে, যা সব মাযহাবের আলেমগণ বর্ণনা করেছেন?

সে অধ্যায়ে তারা মুরতাদ্দের বিভিন্ন প্রকরণের উল্লেখ করেছেন, আর প্রত্যেক প্রকারের মুরতাদকে কাফের বলে নির্দেশিত করে তাদের জান এবং মাল হালাল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা অনেকের নিকট কতিপয় সাধারণ বিষয় যেমন অন্তর হতে নয়, মুখ দিয়ে একটা অবঞ্ছিত কথা বলে ফেলল অথবা ঠাট্টা-মশকরার ছলে বা খেল-তামাশায় কোন অবাঞ্ছিত কথা উচ্চারণ করে ফেলল— এমন অপরাধীদেরও মুরতাদ্দ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তাদের এ কথাও বলা যেতে পারে, যে কথা তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন,

﴿ يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُواْ وَلَقَدۡ قَالُواْ كَلِمَةَ ٱلۡكُفۡرِ وَكَفَرُواْ بَعۡدَ إِسۡلَٰمِهِمۡ ﴾ [التوبة: ٧٤]   

অর্থাৎ— “তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলছে যে, তারা কিছুই বলে নি; অথচ কুফরী কথাই তারা নিশ্চয় বলেছে, ফলে ইসলামকে স্বীকার করার পর তারা কাফের হয়ে গিয়েছে।” (সূরা তাওবা :৭৪)

তুমি কি শোন নি, মাত্র একটি কথার জন্য আল্লাহ এক দল লোককে কাফের বলছেন, অথচ তারা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমসাময়িককালের লোক এবং তাঁর সঙ্গে জেহাদ করেছে, নামায পড়েছে, যাকাত দিয়েছে, হজ্ব পালন করেছে এবং তাওহীদের উপর বিশ্বাস রেখেছে?

অনুরূপভাবে ঐ সব লোক, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

﴿قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٦٥،  ٦٦] 

“তুমি বল, তোমরা কি ঠাট্টা তামাশা করছিলে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতগুলোর এবং তাঁর রাসূলের সম্বন্ধে? এখন আর কৈফিয়ত পেশ করো না। তোমরা নিজেদের ঈমান আনার পর কাফের হয়ে গেছ।” (তাওবা: ৬৫-৬৬)

এ-সব লোকদের সম্বন্ধে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা ঈমান আনার পর কাফের হয়েছে। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে তাবুকের যুদ্ধে যোগদান করেছিল, তারা তো মাত্র একটি কথাই বলেছিল এবং সেটাও হাসি-ঠাট্টার ছলে। অতএব তুমি এ সংশয় সম্পর্কে চিন্তা করে দেখ, যাতে তারা বলে, তোমরা মুসলিমদের মধ্যে এমন লোককে কাফের বলছ যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিচ্ছে, তারা নামায পড়ছে, রোযা রাখছে। তারপর তাদের এ সংশয়ের জওয়াবও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ। কেননা, এই পুস্তকের বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে এটাই অধিক উপকারজনক।

এই বিষয়ের আর একটা প্রমাণ হচ্ছে কুরআনে বর্ণিত সেই কাহিনী, যা আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সম্পর্কে বলেছেন। তাদের ইসলাম, তাদের জ্ঞান এবং সত্যাগ্রহ সত্বেও তারা মূসা ‘আলাইহি সালাম-কে বলেছিল :

﴿ٱجۡعَل لَّنَآ إِلَٰهٗا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةٞۚ ﴾ [الاعراف: ١٣٨] 

 আমাদের জন্যও একটা ইলাহ বানিয়ে দাও, যেমন তাদের রয়েছে অনেক ইলাহ। (সূরা আ‘রাফ : ১৩৮)

অনুরূপভাবে সাহাবীগণের মধ্যে কেউ বলেছিলেন :

»اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ«

“আমাদের জন্য লটকানোর জায়গা প্রতিষ্ঠা করে দিন।” তখন নবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলফ করে বললেন, এটা তো বনী ইসরাইলদের মত কথা, যা তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-কে বলেছিল: আমাদের জন্যও একটা ইলাহ্‌ বানিয়ে দাও[27]।”

ত্রয়োদশ অধ্যায়

মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শিরক হতে যারা তওবা করে তাদের সম্বন্ধে হুকুম কি ?

[মুসলিমদের মধ্যে যখন কোনো এক প্রকারের শির্ক অজ্ঞাতসারে অনুপ্রবেশ করে ফেলে তারপর তারা তা হতে তওবা করে, তখন তাদের সম্বন্ধে হুকুম কি ?]

মুশরিকদের মনে একটা সন্দেহের উদ্রেক হয়, যা তারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে বর্ণনা করে, আর তা হচ্ছে এই যে, তারা বলে, বনী ইসরাঈলেরা “আমাদের জন্য উপাস্য দেবতা বানিয়ে দিন” একথা বলে তারা কাফের হয়ে যায় নি। অনুরূপভাবে যারা বলেছিল, “আমাদের জন্য লটকানোর জায়গা প্রতিষ্ঠা করে দিন”, তারাও কাফেরে পরিণত হয় নি।

এর জওয়াব হচ্ছে এই যে, বানী ইসরাঈলেরা যে প্রস্তাব পেশ করেছিল তা তারা কার্যে পরিণত করে নি, তেমনিভাবে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘যাতে আনওয়াত’ (লটকানোর স্থান) প্রতিষ্ঠা করে দিতে বলেছিল তারাও তা করে নি। বানী-ইসরাঈল যদি তা করে ফেলতো, তবে অবশ্যই তারা কাফের হয়ে যেতো। এ বিষয়ে কারো কোন ভিন্ন মত নেই।

একইরূপে এই বিষয়েও কোনো মতভেদ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হুকুম অমান্য করে—নিষেধ অগ্রাহ্য করে ‘যাতে আনওয়াত’ এর প্রতিষ্ঠা করত তাহলে তারাও কাফের হয়ে যেত, আর এটাই হচ্ছে আমাদের বক্তব্য।

এই ঘটনা থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে যে, কোন মুসলিম বরং কোন ‘আলেম কখনও কখনও শির্কের বিভিন্ন প্রকরণে লিপ্ত হয় কিন্তু সে তা উপলব্ধি করতে পারে না, ফলে এত্থেকে বাঁচার জন্য শিক্ষা  ও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। আর জাহেলরা[28] যে বলে— ‘আমরা তাওহীদ বুঝি’, এটা তাদের সবচেয়ে বড় মুর্খতা ও শয়তানের চক্রান্ত[29]

আর এটাও জানা গেল যে, মুজতাহিদ মুসলিমও যখন না জেনে না বুঝে কুফরী কথা বলে ফেলে, তখন তার ভুল সম্বন্ধে অবহিত করা হলে সে যদি সেটা বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে তা হলে সে কাফের হবে না, যেমন বানী ইসরাঈল করেছিল এবং যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ‘যাতে আনওয়াত’ চেয়েছিল।

আর এর থেকে এটাও বুঝা যাচ্ছে যে, তারা কুফরী না করলেও তাদেরকে (তাদের পক্ষ থেকে কুফরী ও শির্ক চাওয়ার কারণে) কঠোর কথা বলতে হবে, যেমন নবী  সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন।

চতুর্দশ অধ্যায়

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলেমা মুখে উচ্চারণই যথেষ্ট নয়

[যারা মনে করে যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে বলাই তাওহীদের জন্য যথেষ্ট, বাস্তবে তার বিপরিত কিছু করলেও ক্ষতি নেই, তাদের উক্তি ও যুক্তির খণ্ডন]

মুশরিকদের মনে আর একটা সংশয় বদ্ধমূল হয়ে আছে, তা হল এই যে, তারা বলে থাকে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কলেমা পাঠ করা সত্ত্বেও উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে হত্যা করেছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই হত্যাকাণ্ডটাকে সমর্থন করেন নি। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীসটিও তারা পেশ করে থাকে যেখানে তিনি বলেছেন, “আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে (মুখে উচ্চারণ করে) “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” তদ্রূপ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণকারীদের হত্যা না করা সম্বন্ধে আরও অনেক হাদীস তারা তাদের মতের সমর্থনে পেশ করে থাকে।

এই মূর্খদের এসব প্রমাণ পেশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যারা মুখে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করবে, তারা যা ইচ্ছা তাই করুক, তাদেরকে কাফের বলা যাবে না, হত্যাও করা যাবে না। এ-সব জাহেল মুশরিকদের বলে দিতে হবে যে, একথা সর্বজনবিদিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদেরকে কয়েদ করেছেন যদিও তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলত।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ বানু হানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন যদিও তারা সাক্ষ্য দিয়েছিল যে, ‘আল্লাহ ছাড়া নেই কোনো ইলাহ এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল; তারা নামাযও পড়তো এবং ইসলামেরও দাবী করত। ঐ একই অবস্থা তাদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য যাদেরকে ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ সব (বর্তমান কালে যারা শির্ক করে সে-সব) জাহেলরা স্বীকার করে যে, যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তারা কাফের হয়ে যায় এবং হত্যারও যোগ্য হয়ে যায়— তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা সত্বেও। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামের রুকনসমূহের যে কোনো একটিকে অস্বীকার করে, সেও কাফের হয়ে যায় এবং সে হত্যার যোগ্য হয় যদিও সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে”।

তা হলে ইসলামের একটি শাখা অঙ্গ অস্বীকার করার কারণে যদি তার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ তার কোনো উপকারে না আসে, তবে রাসূলগণের দ্বীনের মূল ভিত্তি যে তাওহীদ এবং যা হচ্ছে ইসলামের মূখ্য বস্তু, যে ব্যক্তি সেই তাওহীদকেই অস্বীকার করল তাকে ঐ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ কেমন করে বাঁচাতে সক্ষম হবে? কিন্তু আল্লাহর মুশমনরা হাদীসসমূহের তাৎপর্য বুঝে না।

ওসামা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তিনি একজন ইসলামের দাবীদারকে হত্যা করেছিলেন এই ধারণায় যে, সে তার জান ও মালের ভয়েই ইসলামের দাবী জানিয়েছিল।

কোনো মানুষ যখন ইসলামের দাবী করবে তার থেকে ইসলাম বিরোধী কোনো কাজ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সে তার জানমালের নিরাপত্তা লাভ করবে। এ সম্বন্ধে কুরআনের ঘোষণা এই যে,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَتَبَيَّنُواْ ﴾ [النساء: ٩٤] 

“হে মুমিন সমাজ ! যখন তোমরা আল্লাহর রাহে বহির্গত হও, তখন (কাউকেও হত্যা করার পূর্বে) সব বিষয় তদন্ত করে দেখবে।” (সূরা নিসা : ৯৪) অর্থাৎ তার সম্বন্ধে তথ্যাদি নিয়ে দৃঢ়ভাবে সুনিশ্চিত হবে।

এই আয়াত পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, এরূপ ব্যাপারে হত্যা থেকে বিরত থেকে তদন্তের পর স্থির নিশ্চিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য। তদন্তের পর যদি তার ইসলাম বিরোধী হওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় তবে তাকে হত্যা করা হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, (ফাতাবাইয়ানু) অর্থাৎ ‘তদন্ত করে দেখ’। তদন্ত করার পর দোষী সাব্যস্ত হলে হত্যা করতে হবে। যদি এই অবস্থাতে হত্যা না করা হয় তা হলে : ‘ফাতাবাইয়ানু’ অর্থাৎ স্থির নিশ্চিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

 এভাবে অনুরূপ হাদীসগুলোর অর্থও বুঝে নিতে হবে। ঐগুলোর অর্থ হবে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মধ্যে তাওহীদ ও ইসলাম প্রকাশ্যভাবে পাওয়া যাবে তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকতে হবে— যে পর্যন্ত বিপরীত কোন কিছু প্রকাশিত না হবে।

এ কথার দলীল হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি কৈফিয়তের ভাষায় ওসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, “তুমি তাকে হত্যা করেছ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও?” এবং তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি লোকদেরকে হত্যা করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলবে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” সেই রাসূলই কিন্তু খারেজীদের সম্বন্ধে বলেছেন, “যেখানেই তোমরা তাদের পাবে, হত্যা করবে, আমি যদি তাদের পেয়ে যাই তবে তাদেরকে হত্যা করব ‘আদ জাতির মত সার্বিক হত্যা।”[30]  যদিও তারা (খারেজীরা) ছিল লোকদের মধ্যে অধিক ইবাদতগুযার, অধিক মাত্রায় ‘ল-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং সুবহানাল্লাহ্‌’ উচ্চারণকালী।

তাছাড়া খারেজীরা এমন বিনয়-নম্রতার সঙ্গে নামায আদায় করত যে, সাহাবীগণ পর্যন্ত নিজেদের নামাযকে তাদের নামাজের তুলনায় তুচ্ছ মনে করতেন। তারা কিন্তু “ইল্‌ম শিক্ষা করেছিল সাহাবাগণের নিকট হতেই।  কিন্তু কোনই উপকারে আসল না তাদের “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলা, তাদের অধিক পরিমাণ ইবাদত করা এবং তাদের  ইসলামের দাবী করা, যখন তাদের থেকে শরীয়তের বিরোধী বিষয় প্রকাশিত হয়ে গেল।

ঐ একই পর্যায়ের বিষয় হচ্ছে ইয়াহূদীদের হত্যা এবং বানু হানীফার বিরুদ্ধে সাহাবীদের যুদ্ধ ও হত্যাকান্ড। ঐ একই কারণে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানী মুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যখন একজন লোক এসে খবর দিল যে, তারা যাকাত দিবে না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ﴾ [الحجرات: ٦] 

“হে মুমিন সমাজ! যখন কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো গুরুতর সংবাদ নিয়ে তোমাদের নিকট আগমন করে, তখন তোমরা তার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখো।” (সূরা হুজুরাত : ৬) বস্তুত: উপরোক্ত সংবাদদাতা তাদের সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিল।

এইরূপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত হাদীসকে তারা দলীল-প্রমাণরূপে পেশ করে থাকে তার প্রত্যেকটির তাৎপর্য্য তা-ই যা আমরা উল্লেখ করেছি।

পঞ্চদশ অধ্যায়

জীবিত ও মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য কামনার মধ্যে পার্থক্য

[উপস্থিত জীবিত ব্যক্তির নিকট তার আয়াত্তাধীন বিষয়ে সাহায্য কামনা এবং অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট তার ক্ষমতার অতীত বিষয়ে সাহায্য কামনার মধ্যে পার্থক্য]

তাদের (মুশরিকদের) মনে আর একটি সন্দেহ বন্ধ মূল হয়ে আছে আর তা হচ্ছে এই: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, লোক সকল কিয়ামত দিবসে তাদের (হয়রান পেরেশানীর অবস্থায়) প্রথম সাহায্য কামনা করবে আদম ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট, তারপর নূহ আলায়হিস সালাম এর নিকট, তারপর মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট। তারা প্রত্যেকেই তাদের অসুবিধার উল্লেখ করে ‘ওযর পেশ করবেন, শেষ পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গমন করবেন।

তারা বলে, এর থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকটে সাহায্য চাওয়া শির্ক নয়।

আমাদের জওয়াব হচ্ছে : আল্লাহর কি মহিমা ! তিনি তাঁর শত্রুদের হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন।

সৃষ্ট জীবের নিকটে তার আয়ত্বাধীন বস্তুর সাহায্য চাওয়ার বৈধতা আমরা অস্বীকার করি না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মুসা ‘আলাইহিস সালাম এর ঘটনায় বলেছেন:

﴿فَٱسۡتَغَٰثَهُ ٱلَّذِي مِن شِيعَتِهِۦ عَلَى ٱلَّذِي مِنۡ عَدُوِّهِۦ﴾ [القصص: ١٥] 

“তখন তার সম্প্রদায়ের লোকটি তার শত্রুপক্ষীয় লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। (সূরা কাসাস : ১৫)

অনুরূপভাবে মানুষ তার সহচরদের নিকটে যুদ্ধে বা অন্য সময়ে ঐ বস্তুর সাহায্য চায় যা মানুষের আয়ত্বাধীন। কিন্ত আমরা তো ঐরূপ সাহায্য প্রার্থনা অস্বীকার করেছি যা ইবাদতস্বরূপ মুশরিকগণ করে থাকে ওলী-দের কবর বা মাযারে, অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে এমন সব ব্যাপারে তাদের সাহায্য কামনা করে যা মঞ্জুর করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই।

যখন আমাদের এ বক্তব্য সাব্যস্ত হল, তখন নবীদের নিকটে কিয়ামতের দিন এ উদ্দেশ্যে সাহায্য চাওয়া যে, তারা আল্লাহর নিকটে এ প্রার্থনা জানাবেন যাতে তিনি জান্নাতবাসীর হিসাব (সহজ ও শীর্ঘ) সম্পন্ন ক’রে হাশরের ময়দানে অবস্থানের কষ্ট হতে আরাম দান করেন, এ ধরনের প্রার্থনা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই সিদ্ধ। যেমন জীবিত কোনো নেক লোকের নিকটে তুমি গমন কর, সে তোমাকে তার নিকটে বসায় এবং কথা শুনে। তাকে তুমি বল : আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ তাঁর জীবিতকালে তাঁর নিকট অনুরোধ জানাতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবরের নিকট গিয়ে এ ধরনের অনুরোধ কক্ষনো তারা জানান নি। বরং সালাফুস সালেহ বা পূর্ববর্তী মনীষিগণ তাঁর কবরের নিকট গিয়ে আল্লাহকে ডাকতে (এবং সেটাকে অবাঞ্ছিত কাজ মনে করে তাতে সম্মতি দিতে) অস্বীকার করেছেন। অবস্থার এই পেক্ষিতে কি করে স্বয়ং তাঁকেই ডাকা যেতে পারে ?

তাদের মনে আর একটা সংশয় রয়েছে ইব্‌রাহীম আলায়হিস সালাম এর ঘটনায়। যখন তিনি অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হন তখন শুন্যলোক হতে জিব্রীল ‘আলাইহিস সালাম তাঁর নিকট আরয করলেন, আপনার কি কোন প্রয়োজন আছে? তখন ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেন, যদি বলেন, আপনার নিকটে, তবে আমার কোনই প্রয়োজন নেই।

তারা (মুশরিকরা) বলে: জিব্রীলের নিকট সাহায্য কামানা করা যদি শির্ক হতে তাহলে তিনি কিছুতেই ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট উক্ত প্রস্তাব পেশ করতেন না। এর জওয়াব হচ্ছে : এটা প্রথম শ্রেণির সন্দেহের পর্যায়ভুক্ত। কেননা জিব্রীল ‘আলাইহিস সালাম তাঁকে এমন এক ব্যাপারে উপকৃত করতে চেয়েছিলেন যা করার মত ক্ষমতা ছিল তার আয়ত্ত্বাধীন। আল্লাহ স্বয়ং তাঁকে ‘শাদীদুল কুওয়া’ অর্থাৎ  অত্যন্ত শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছেন। ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর জন্য প্রজ্জলিত অগ্নিকুণ্ড এবং তার চারদিকের  জমি ও পাহাড় যা কিছু ছিল সেগুলো ধরে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে নিক্ষেপ করতে যদি আল্লাহ অনুমতি দিতেন তা হলে তিনি তা অবশ্য করতে পারতেন। যদি আল্লাহ ইব্‌রাহীম আলায়হিস সালামকে দুশমনদের নিকট থেকে দূরবর্তী কোথাও স্থানান্তরিত করতে আদেশ দিতেন, তাও তিনি অবশ্যই করতে পারতেন, আর আল্লাহ যদি তাকে আকাশে তুলতে বলতেন, তাও তিনি করতে সক্ষম হতেন।

তাদের সংশয়ের বিষয়টি তুলনীয় এমন একজন বিত্তশালী লোকের সঙ্গে যার প্রচুর ধন দৌলত রয়েছে। সে একজন অভাবগ্রস্ত লোক দেখে তার অভাব মিটানোর জন্য তাকে কিছু অর্থ ঋণস্বরূপ দেওয়ার প্রস্তাব করল অথবা তাকে কিছু টাকা অনুদানস্বরূপ দিয়েই দিল। কিন্তু সেই অভাবগ্রস্ত লোকটি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং কারোর কোনো অনুগ্রহের তোয়াক্কা না করে আল্লাহর রেযেক না পৌঁছা পর্যন্ত ধৈর্য অবলম্বন করল।

তা হলে এটা বান্দার নিকট সাহায্য কামনা এবং শির্ক কেমন করে হ’ল? আহা যদি তারা বুঝত !

ষোড়শ অধ্যায়

অন্তরে, কথায় ও কর্মে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা; যদি না শর্‌য়ী ওযর থাকে

আমি এবার ইনশাআল্লাহু তা‘আলা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করে আমার বক্তব্যের উপসংহার টানব। পূর্ব আলোচনাসমূহে এ বিষয়ের উপর আলোকপাত হয়েছে বটে কিন্তু তার বিশেষ গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং তৎসম্পর্কে অধিক ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হওয়ার ফলে আমি উক্ত বিষয়ে এখানে পৃথকভাবে কিছু আলোচনার প্রয়াস পাব।

এ বিষয়ে কোনই দ্বিমত নেই যে, তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি হতে হবে অন্তর দ্বারা, জিহ্বা দ্বারা এবং কর্মে তার বাস্তবায়ন দ্বারা। এর থেকে যদি কোনো ব্যক্তির কিছুমাত্র বিচ্যুতি ঘটে, তবে সে মুসলিম বলে বিবেচিত হবে না।

যদি কোনো ব্যক্তি তাওহীদ কী— তা হৃদয়ঙ্গম করে কিন্তু তার উপর ‘আমল না করে, তবে সে হবে হঠকারী কাফের, তার তুলনা হবে ফির‘আউন, ইবলীস প্রভৃতির সঙ্গে। এখানেই অধিক সংখ্যক লোক বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত হয়। তারা বলে থাকে, এটা সত্য, আমরা এটা বুঝেছি এবং তার সত্যতার সাক্ষ্যও দিচ্ছি। কিন্তু আমরা তা কার্যে পরিণত করতে সক্ষম নই। আর আমাদের দেশবাসীদের নিকট তা সিদ্ধ নয়- কিন্তু যারা তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণকারী (তারা ছাড়া)। এই সব ওযুহাত এবং অন্যান্য ওযর আপত্তি তারা পেশ করে থাকে।

আর এই হতভাগারা বুঝে না যে, অধিকাংশ কাফের নেতা সত্য জানত কিন্তু জেনেও তা প্রত্যাখ্যান করত শুধু কতিপয় ‘ওযর আপত্তির জন্য। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ٱشۡتَرَوۡاْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ ثَمَنٗا قَلِيلٗا﴾ [التوبة: ٩]

“আল্লাহর আয়াতগুলিকে তারা বিক্রয় করে ফেলেছে নগণ্য মূলের বিনিময়ে।” (আত-তাওবা : ৯০)। অনুরূপ অন্যান্য আয়াতে বলা হয়েছে :

﴿ يَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا يَعۡرِفُونَ أَبۡنَآءَهُمۡۖ ﴾ [البقرة: ١٤٦] 

“তারা তাঁকে (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বা হককে) ঠিক সেই ভাবেই চিনে যেমন তারা চিনে তাদের পুত্রদিগকে।” (বাকারা : ১৪৬)

আর কেউ যদি তাওহীদ না বুঝে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে তার উপর আমল করে, অথবা সে যদি অন্তরে বিশ্বাস না রেখে আমল করে তবে তো সে মুনাফিক; সে নিরেট কাফের থেকেও মন্দ। স্বয়ং আল্লাহ মুনাফিকদের পরিণতি সম্বন্ধে বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ فِي ٱلدَّرۡكِ ٱلۡأَسۡفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ ﴾ [النساء: ١٤٥] 

‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ অবস্থান করবে জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে।’ (সূরা আন নিসা: ১৪৫)

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, অতীব দীর্ঘ ও ব্যাপক, তোমার নিকটে এটা প্রকাশ হবে যখন জনসাধারণের আলোচনার উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে দেখবে, তখন তুমি দেখবে সত্যকে জেনে বুঝেও তারা তার উপরে আমল করে না এই আশঙ্কায় যে, তাদের পার্থিব ক্ষতি হবে অথবা কারও সম্মানের হানি হবে কিংবা সম্পর্কের ক্ষতি হবে।

তুমি আরও দেখতে পাবে যে, কতক লোক প্রকাশ্যভাবে কোন কাজ করছে কিন্তু তাদের অন্তরে তা নেই। তাকে তার অন্তরের প্রত্যয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে দেখবে যে, সে তাওহীদ কি তা বুঝে না।

অবস্থার এই প্রেক্ষিতে মাত্র দু’টি আয়াতের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা তোমার কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। প্রথমটি হচ্ছে :

﴿ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٦٦] 

“এখন তোমরা আর কৈফিয়ত পেশ করো না, ঈমান আনয়নের পরও তো তোমরা কুফরী কাজে লিপ্ত রয়েছ।” (সূরা তাওবা :  ৬৬)

যখন এটা সাব্যস্ত হয়েছে যে, কতিপয় সাহাবী যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে রোমানদের বিরুদ্ধে (তাবুকের) যুদ্ধে গমন করেছিল তারা ঠাট্টাচ্ছলে কোনো একটি কথা বলার ফলে কাফের হয়ে গিয়েছিল; তখন তোমার কাছে সুস্পষ্ট হবে যে, হাসি ঠাট্টার সঙ্গে কোনো কথা বলার চেয়ে অধিক গুরুতর সেই ব্যক্তির অবস্থা, যে কুফরী কথা বলে অথবা কুফরী ‘আমল করে ধনদৌলতের ক্ষতির আশঙ্কায় কিংবা সম্মানহানি অথবা সম্পর্কের ক্ষতির ভয়ে।

দ্বিতীয় আয়াতটি হচ্ছ :

﴿ مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا عَلَى ٱلۡأٓخِرَةِ ﴾ [النحل: ١٠٦،  ١٠٧] 

“কেউ তার ঈমান স্থাপনের পর আল্লাহর সাথে কুফরী করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয় যাকে সত্য প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত বিশ্বাসে অবিচলিত। এটা এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়।” (সূরা নাহ্‌ল : ১০৬-১০৭)

আল্লাহ এদের কারোরই ‘ওযর আপত্তি কবুল করেন নি; তবে কবূল করেছেন শুধু তাদের ‘ওযর যাদের অন্তর ঈমানের উপরে স্থির ও প্রশান্ত রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে। এরা ব্যতীত উপরোল্লিখিত ব্যক্তিরা তাদের ঈমানের পর কুফরী করেছে। চাই তারা ভয়েই তা করে থাকুক অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় তা হোক কিংবা গোত্র অথবা ধন-দৌলতের প্রতি আকর্ষণের জন্যই হোক অথবা হাসি-ঠাট্টার ছলেই কুফরী কালাম উচ্চারণ করুক অথবা এ ছাড়া অন্য যে কোনো উদ্দেশ্য হাসেলের জন্য তা করে থাকুক— শুধু বাধ্য হওয়া ব্যতীত। সুতরাং বর্ণিত আয়াতটি এই অর্থই বুঝিয়ে থাকে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে—

প্রথমত: আল্লাহর বাণীতে বলা হয়েছে : ﴿إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ﴾ “কিন্তু যদি তাকে বাধ্য করা হয়ে থাকে”, আল্লাহ বাধ্যকৃত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোন ব্যতিক্রমের সুযোগ রাখেন নি। একথা সুবিদিত যে, মানুষকে একমাত্র কথা অথবা কাজেই বাধ্য করা যায়। কিন্তু অন্তরের প্রত্যয়ে কাউকে বাধ্য করা চলে না।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর এই বাণী :

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا عَلَى ٱلۡأٓخِرَةِ﴾ [النحل: ١٠٧] 

“এটি এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়।” (নাহ্‌ল: ১০৭)

এ আয়াতটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই কুফরী ও তার শাস্তি তাদের বিশ্বাস, মূর্খতা, দ্বীনের প্রতি বিদ্বেষ বা কুফরীর প্রতি অনুরাগের কারণে নয়, বরং এর কারণ হচ্ছে দুনিয়া থেকে কিছু অংশ হাসিল করা, যে জন্য সে দুনিয়াকে দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে।

পাক-পবিত্র ও মহান আল্লাহই এ সম্পর্কে অধিক অবহিত রয়েছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং তাঁর পরিবার ও সহচরবর্গের উপর, আর তাঁদের সকলের উপর শান্তি অবতীর্ণ করুন। (আমীন!)

—সমাপ্ত—

[1] রাসূলের যুগের আরবের মুশরিকদের।

[2] রাসূলের যুগের আরবের মুশরিকদের নিকট।

[3] অর্থাৎ ফেরেশতা, নবী, ওলী, বৃক্ষ, কবর, জিন যাদেরকেই ঐ সকল কাজে আহ্বান জানানো হয়, তারাই ‘ইলাহ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যাবে। এটা রাসূলের সময়কার আরবের মুশরিকরা ভালোভাবেই জানত।

[4] রাসূলের যুগের।

[5] সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া অজ্ঞতা ওজর হিসেবে বিবেচিত হবে না। সঙ্গত কারণের মধ্যে রয়েছে, লোকালয়ে না থাকা, যেখানে কেউ তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করার নেই সেখানে অবস্থান করা, দেশে মূর্খতা ছেয়ে যাওয়া। কিন্তু জানা-শুনার সুবিধা থাকা সত্বেও যদি অজ্ঞতার দোহাই দেওয়া হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যাপারটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি হিসেবে ভিন্ন হতে বাধ্য। [সম্পাদক]

[6] অর্থাৎ পূর্বেকার মুশরিকরাও আল্লাহর রবুবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিত এবং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তারা মুশরিক হয়েছিল, কারণ তারা মাধ্যম গ্রহণ করেছিল। তবে এটা সত্য যে তারা সত্যিকার অর্থে রুবুবিয়্যাতের হক আদায় করত না। কারণ, রুবুবিয়্যাতের হক আদায় করলে ইবাদত একমত্র আল্লাহরই করত। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬২]

[7] অর্থাৎ পূর্বেকার মুশরিকরা তো মূর্তিপূজা করত, সে তো আর মূর্তিপূজা করছে না। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬২]

[8] অর্থাৎ এটা বলে দাও যে, পূর্ববর্তী কাফের, মুশরিকরা যে শুধু মূর্তিপূজা করত, তা কিন্তু নয়, বরং তারা নেককার বান্দা ও নবী-রাসূলদেরও পূজা করত। পরবর্তী বাক্যে এর প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। [সম্পাদক]

[9] সন্দেহগুলো সংক্ষিপ্তভাবে:

১. তাওহীদুর রবুবিয়্যাহর স্বীকৃতি দেওয়ার পর শির্ক কীভাবে সম্ভব?

২. শির্ক বলতে তো কেবল মূর্তিপূজাকে বুঝায়।

৩. আগেকার মুশরিকরা তো যাদের পূজা বা ইবাদত করত, তাদের কাছেই কোনো কিছু চাইত, কিন্তু সে তো আর তাদের কাছে কিছু চাচ্ছে না, সে তো শুধু তাদের সুপারিশই কামনা করে। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬৭]

[10] উটের জন্য সুন্নাত হচ্ছে, নাহর করা। নাহর বলা হয়, দাঁড়ানো অবস্থায় উটের গণ্ডদেশে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করা।

[11] কারণ, কারও কাছে কিছু চাইতে হলে, তাকে আহ্বান করতে হয়। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ চাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে ডাকা, যা আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। [সম্পাদক]

[12] অর্থাৎ এটাকে যথাযথভাবে পালন করলে আর নবীর কাছে শাফা‘আত চাইতে পারবে না। কারণ, চাওয়া তো কেবল আল্লাহর কাছে। এটাই তো উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে।

[13] অর্থাৎ কুরআন তো বলছে যে তৎকালীন আরবের মুশরিকরা কখনও এসব কাঠ, পাথর ইত্যাদিকে সৃষ্টি, রিযিক কিংবা নিয়ন্ত্রক দাবী করত না। তাহলে তোমার দাবী কুরআনের ঘোষণার বিপরীত হচ্ছে, সুতরাং তোমার কথা মিথ্যা।

[14] অর্থাৎ তোমরা নিজেরাই তোমাদের কথায় আমাদের বক্তব্য প্রকারান্তরে মেনে নিলে যে তোমরা শির্ক করে যাচ্ছ। আর এভাবেই আমাদের উদ্দেশ্য সাব্যস্ত হচ্ছে, সেটা হচ্ছে, তার কাছ থেকে হকের স্বীকৃতি আদায় করা। তার সন্দেহ দূর করা, আমাদের উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে তার সন্দেহ দূরীভূত হলো, তার প্রমাণাদি খণ্ডিত হলো, তার ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৭৯]

[15] অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে, সৎলোকদেরকে আহ্বান করা, তাদের উপর ভরসা করাও শির্ক, কারণ তা কুরআন তা বর্ণনা করেছে; আর তোমার কথা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তার সন্দেহ দূরীভূত হলো, তার প্রমাণাদি খণ্ডিত হলো। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৮০]

[16] অর্থাৎ অপর কারও ইবাদত করা যাবে না, কাউকে ডাকা যাবে না, কারও উপর ভরসা করা যাবে না ইত্যাদি।

[17] অর্থাৎ শির্ক কী? মুশরিক কে? মূর্তিপূজা কী, মূর্তিপূজা ও অন্যকিছুর মধ্যে পার্থক্য না জানে তবে তো সে অজ্ঞ, তার সাথে তর্ক না করে তাকে জ্ঞান দিতে হবে। বর্তমান কালের অধিকাংশ মানুষ এ শ্রেণির। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৮১]

[18] সুতরাং তার সন্তান সাব্যস্ত করা হবে, তখন সেটার প্রতি আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। সুতরাং আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা কুফরী। কারণ এটি ‘সামাদ’ এর বিপরীত।

[19] অর্খাৎ আল্লাহর সামাদ বা সন্তান থেকে অমুখাপেক্ষীতা অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে।

[20] অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে কাফের বলেছেন, অথচ তারা আল্লাহর জন্য পুত্র কিংবা সন্তান সাব্যস্ত করেনি। সুতরাং তোমাদের পূর্বোক্ত দাবী অসার, যাতে তোমরা দাবী করেছিলে যে, তাদেরকে সন্তান সাব্যস্ত করার জন্যই কেবল কাফের বলা হয়েছে, সৎলোকদের আহ্বানের জন্য নয়। বস্তুত: যারা লাতকে আহ্বান করে কাফের হয়েছিল কিংবা জিনদের ইবাদত করে কাফের হয়েছে, তারা তো আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত না করেও কাফের হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সন্তান সাব্যস্ত করলে যেমন কুফরী করা হয়, তেমনি আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে আশ্রয়ের জন্য আহ্বানও কুফরিতে নিমজ্জিত করে। [সম্পাদক]

[21] অর্থাৎ তারা ওলি, কবর, মাযার বা পীরদের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি বা ওসীলা গ্রহণের যে বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। [সম্পাদক]

[22] তবে এটা সত্য যে উভয়টিই শির্ক। উভয় গোষ্ঠীই জাহান্নামের অধিবাসী, যদি না তাওবাহ করে, এখানে গ্রন্থকার শুধু দু’যুগের শির্কের পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। [সম্পাদক]

[23] শাইখের এ বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার একটি প্রেক্ষাপট এটি। কিন্তু এ কথার সমর্থনে দলীল পাওয়া যায় নি। (ইবন উসাইমীন, শারহু কাশফিশ শুবুহাত, পৃ. ৯১)।

[24] সুতরাং কিছু কিছু বস্তুর ঈমান থাকার পরও কুফরী কিংবা শির্ক করার কারণে তারা ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে। [সম্পাদক]

[25] নিকট অতীতে (গ্রন্থকারের সময়কালে) নাজদে এদের উদ্দেশ্যে পূজা করা হত।

[26] মুরতাদ্দ হচ্ছে সেই মুসলিম, যে ইসলাম গ্রহণের পর কূফরীতে ফিরে যায। [অনুবাদক]

[27] তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮০।

[28] বর্তমানেও কোনো কোনো ইলমের দাবীদারকে তাওহীদ সম্পর্কে বলতে গেলে বলে যে আমারা তাওহীদের উপর আছি, তুমি কি আমাদেরকে তাওহীদ শিক্ষা দিচ্ছ? তোমার তাওহীদ নিয়ে তুমি থাক, ইত্যাদি। বাস্তবে তারা তাওহীদ নিয়ে কখনও চিন্তা গবেষণা করেনি। তারা অনেক জ্ঞানের অধিকারী হলেও তাওহীদ বুঝে না। নিঃসন্দেহে তারা অহংকারবশত আল্লাহর তাওহীদকে না জেনে কখনও কখনও শির্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে। [সম্পাদক]

[29] কারণ তারা তাওহীদ না বুঝেও বুঝার দাবী করছে, ফলে শির্কে নিপতিত হচ্ছে। যদি তারা সত্যিকার তাওহীদ নিয়ে গবেষণা করত এবং তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করত, তবে কখনই শির্কে পতিত হতো না, কিন্তু শয়তান চায় না তারা তাওহীদ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে শির্কমুক্ত হয়ে যাক। [সম্পাদক]

[30] (বুখারী ও মুসলিম) অনুবাদক।

শিরকঃ চারটি মূলনীতি

শিরক সংক্রান্ত চারটি মূলনীতি

ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আত তামিমি রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

﴿القواعد الأربع﴾

« باللغة البنغالية »

شيخ الإسلام محمد بن عبد الوهاب رحمه الله
ترجمة: عبد الرقيب ومحمد عبد الهادي
অনুবাদ কৃতজ্ঞতাঃ ইসলাম হাউজ

 

শিরক সংক্রান্ত চারটি মূলনীতি

আরশে আযীমের রব মহান আল্লাহর নিকট দো‘আ করি, তিনি যেন আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন, আপনাকে বরকতময় করেন আপনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, আপনাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাকে কিছু প্রদান করা হলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, পরীক্ষায় পড়লে ধৈর্য ধারণ করে এবং গুনাহ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কারণ এ তিনটি বিষয় হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক।

জেনে নিন- আল্লাহ আপনাকে তাঁর আনুগত্যের পথ দেখাক- নিষ্ঠার উপর প্রতিষ্ঠিত দীন তথা মিল্লাতে ইব্রাহীম হচ্ছে, আপনি কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবেন তার জন্য আনুগত্যকে নির্ভেজাল করে। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে এরই আদেশ করেছেন এবং এর কারণে তাদের সৃষ্টি করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]

“আমি তো জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি” [সূরা আয-যারিয়াত/৫৬]

অতঃপর যখন জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তখন এটাও জেনে নিন যে, তাওহীদ ব্যতীত কোনো ইবাদতই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় না, যেমন পবিত্রতা ব্যতীত কোনো সালাতই সালাত হিসেবে গণ্য হয় না। সুতরাং ইবাদতে শির্ক প্রবেশ করলে তা তেমনি নষ্ট হয়ে যায় যেমনিভাবে পবিত্রতা অর্জনের পর বায়ু নির্গত হলে তা বিনষ্ট হয়।

অতঃপর যখন জানলেন যে, যখন ইবাদতে শির্কের সংমিশ্রণ হয় তখন শির্ক সে ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং যাবতীয় আমল ধ্বংস করে ফেলে এবং সে ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তখন আপনি বুঝতে পারলেন যে, এ বিষয়টির জানাই হচ্ছে আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যাতে করে আল্লাহ আপনাকে এ বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেন, আর তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা তথা শির্কের বেড়াজাল। যার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ ﴾ [النساء: ٤٨]

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করাকে ক্ষমা করবেন না, আর এর চেয়ে ছোট যা আছে তা তিনি যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [সূরা আন-নিসা/৪৮]

আর এটা (অর্থাৎ শির্কের বেড়াজাল থেকে মুক্তি) কেবল চারটি নীতি জানার মাধ্যমে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন,

প্রথম নীতি:  জানা প্রয়োজন যে, ঐ সমস্ত কাফের যাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করেছিলেন, তারা স্বীকার করত যে আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা এবং সবকিছুর পরিচালক। তবুও এ স্বীকারোক্তি তাদেরকে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় নি। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী:

﴿ قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ ﴾ [يونس: ٣١]

“তুমি বল : তিনি কে, যিনি তোমাদেরকে আসমান ও জমিন হতে রিজিক দিয়ে থাকেন? অথবা কে তিনি, যিনি কর্ণ ও চক্ষুসমূহের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন? আর তিনি কে, যিনি জীবন্তকে প্রাণহীন হতে বের করেন, আর প্রাণহীনকে জীবন্ত হতে বের করেন? আর তিনি কে যিনি সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন? তখন অবশ্যই তারা বলবে যে, আল্লাহ। অতএব, তুমি বল: তবে কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?” (সূরা ইউনুস: ৩১)

দ্বিতীয় নীতি: আরবের মুশরিকরা বলত: আমরা তো তাদেরকে কেবল নৈকট্য এবং সুপারিশ পাওয়ার আশায় আহ্বান জানাই এবং তাদের স্মরণাপন্ন হই।

তারা যে (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের প্রত্যাশা করে তাদের (মা‘বুদদের) আহ্বান করত তার প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣ ﴾ [الزمر: ٣]

“আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, (তারা বলে) আমরা তো এদের ইবাদত এজন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন না।” [সূরা আয-যুমার/৩]

আর তারা যে (আল্লাহর কাছে এসব মা‘বুদদের) শাফা‘আত বা সুপারিশ প্রত্যাশা করে তাদের (মা‘বুদদের) আহ্বান করত তার প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুসমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোনো অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে: এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” [সূরা ইউনুস/১৮]

বস্তুত সুপারিশ বা শাফাআত দু প্রকার ক) অস্বীকৃত খ) স্বীকৃত।

ক- অস্বীকৃত শাফা‘আত বা সুপারিশ হচ্ছে, যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট চাওয়া হয়, যা করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নেই। যেমন আল্লাহ বলেন :

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡمٞ لَّا بَيۡعٞ فِيهِ وَلَا خُلَّةٞ وَلَا شَفَٰعَةٞۗ وَٱلۡكَٰفِرُونَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٥٤ ﴾ [البقرة: ٢٥٤]

“হে যারা ঈমান এনেছ! আমরা তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি, তা হতে সে দিন আসার পূর্বেই ব্যয় কর; যাতে থাকবে না কোনো ক্রয়-বিক্রয়, কিংবা বন্ধুত্ব অথবা সুপারিশ, আর কাফেররাই তো অত্যাচারী।” [সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৫৪]

খ- স্বীকৃত সুপারিশ হচ্ছে, যা কেবল আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়[1]। বস্তুত সুপারিশকারীর কাছে সুপারিশ চাওয়ার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হয়। আর যার জন্য সুপারিশ করা হবে সে তো হতে হবে এমন ব্যক্তি যার কথা ও কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট। আর তাও সংঘটিত হবে অনুমতির পরে। যেমন আল্লাহ তাআ’লা বলেন:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

“এমন কে আছে যে অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?”  [সূরা আল-বাক্বারাহ/২৫৫]

তৃতীয় নীতি: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমন ঘটে এমন লোকদের মাঝে যারা তাদের ইবাদতে শতধা বিভক্ত ছিল; তাদের মধ্যে কেউ ফেরেশতার ইবাদত করতো, কেউ নবী ও সৎ লোকদের ইবাদত করতো, কেউ গাছ-পালা ও পাথরের পূজা করতো এবং কেউ সূর্য ও চন্দ্রের ইবাদত করতো। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মধ্যে কোনো প্রকার তারতম্য বা পার্থক্য করা ছাড়াই এদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর প্রমাণে আল্লাহর বাণী:

﴿ وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ﴾ [الانفال: ٣٩]

“আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যেই হয়ে যায়।” [সূরা আল-আনফাল/৩৯]

  • তারা যে সূর্য ও চন্দ্রের ইবাদত করত, তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُۚ لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ٣٧ ﴾ [فصلت: ٣٧]

“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত কর।” [সূরা ফুসসিলাত/৩৭]

  • তারা যে ফেরেশতার ইবাদত করত তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًاۗ ﴾ [ال عمران: ٨٠]

“আর তিনি আদেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতাগণ ও নবীগণকে প্রতিপালকরূপে গ্রহণ কর।” [সূরা আলে ইমরান/৮০]

  • মক্কার কাফেররা যে নবীগণের ইবাদতও করত তার দলীল হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿ وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنۡ أَقُولَ مَا لَيۡسَ لِي بِحَقٍّۚ إِن كُنتُ قُلۡتُهُۥ فَقَدۡ عَلِمۡتَهُۥۚ تَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِي وَلَآ أَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ١١٦ ﴾ [المائ‍دة: ١١٦]

“আর যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে মা’বূদ বানিয়ে নাও? ঈসা নিবেদন করবেন আমি তো আপনাকে পবিত্র মনে করি; আমার পক্ষে কোনক্রমেই শোভনীয় ছিল না যে, আমি এমন কথা বলি যা বলবার আমার কোনই অধিকার নেই; যদি আমি বলে থাকি, তবে অবশ্যই আপনার জানা থাকবে; আপনি তো আমার অন্তরের কথাও জানেন, পক্ষান্তরে আপনার অন্তরে যা রয়েছে আমি তা জানি না; সমস্ত গায়েবের বিষয় আপনিই জ্ঞাত।” [সূরা আল-মায়েদা/১১৬]

  • মক্কার লোকরা যে নেককার লোকদের ইবাদতও করত তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী :

﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ﴾ [الاسراء: ٥٧]

“তারা যাদের আহ্বান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে বেড়ায় যে তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।” [সূলা আল-ইসরা/৫৭]

  • তৎকালীন মক্কার লোকেরা যে গাছ-পালা ও পাথরের ইবাদতও করত তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ ﴾ [النجم: ١٩،  ٢٠]

“তোমরা আমাকে জানাও লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?” [সূরা আন-নাজম/১৯-২০]

অনুরূপভাবে আবু ওয়াকিদ আল-লায়সী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসও এর প্রমাণ, তিনি বলেন:

«خرجنا مع النبي صلى الله عليه وسلم إلى حنين ونحن حدثاء عهد بكفر، وللمشركين سدرة يعكفون عندها وينوطون بها أسلحتهم يقال لها ذات أنواط. فمررنا بسدرة فقلنا: يا رسول الله اجعل لنا ذات أنواط، كما لهم ذات أنواط». الحديث.

আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে হুনাইনের যুদ্ধে বের হলাম, আমরা তখন নূতন মুসলিম ছিলাম। সেকালে মুশরিকদের একটি কুল-বৃক্ষ ছিল, যার পার্শ্বে তারা অবস্থান করতো এবং তাতে তাদের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। ওটাকে বলা হত ‘যাতু আন্ওয়াত্’ (বরকতের গাছ)। আমরা এই ধরনের এক কুল-গাছের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। আমরা আল্লাহর রাসূলকে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের জন্যও একটি ঝুলিয়ে রাখার বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন যেমন তাদের রয়েছে ..[2]। আল-হাদীস[3]

চতুর্থ নীতিঃ আমাদের যুগের শির্ককারীদের শির্ক পূর্বের যুগের শির্ককারীদের থেকে অধিক কঠোর। কারণ পূর্বের লোকেরা সুখ-সচ্ছলতার সময় শির্ক করতো আর দুঃখের সময় একান্তভাবে আল্লাহকেই ডাকতো। কিন্তু আমাদের যুগের শির্ককারীরা সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে শির্ক করে।

এর দলীল, আল্লাহর বাণী,

﴿ فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥ ﴾ [العنكبوت: ٦٥]

“অতঃপর তারা যখন নৌকায় আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধ চিত্তে খাঁটিভাবে আল্লাহকে ডাকে; অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদের উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।” [সূরা আল-আনকাবূত/৬৫]

সমাপ্ত

আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম পেশ করুন মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকলসাথীদের প্রতি।

[1] কোনো সৃষ্টির কাছে চাওয়া হয় না। যেমন বলা হয়, হে আল্লাহ আপনি আমার ব্যাপারে আপনার নবীকে সুপারিশকারী বানিয়ে দিন। অথবা হে আল্লাহ আপনি আমার জন্য আপনার বন্ধুদেরকে সুপারিশকারী বানিয়ে দিন। এভাবে সরাসরি আল্লাহর কাছে চাওয়া। [সম্পাদক]

[2] হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, কাফেররা গাছ পূজা করত। [সম্পাদক]

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮০।

রাসুল সাঃ ও নেক লোকদের কাছে দু’আ করা শিরক

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

সত্য দ্বীন থেকে মানুষকে দূরে হটিয়ে রাখার জন্য আল্লাহর দুশমনগণ নবী রাসূলদের (আলায়হিমুস সালাম) প্রচারিত শিক্ষার বিরুদ্ধে যে সব ওযর আপত্তি ও বক্তব্য পেশ করে থাকে তার মধ্যে একটি এইঃ Continue reading