বিদআতি ও বিরোধীদের সাথে আচরণনীতি (০)

শায়খ খালিদ বাতারফি

বিদআতিদের সাথে বিবাদের ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখার জন্য আমাদের জানা আবশ্যক যে, বিদআত কী জিনিস?

মূল বিষয় এটাই যে, আমরা জানবো- বিদআত কাকে বলে?

ইমাম শাতিবী রহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-ই’তিসাম কিতাবে বলেন- 

طريقة في الدين مخترعة، تضاهي الشرعية، يقصد بالسلوك عليها: المبالغة في التعبد لله سبحانه وتعالى

“দ্বীনের ব্যাপারে নব উদ্ভাবিত পন্থা, যা শরীয়াহর সাথে বিরোধপূর্ণ হয় এবং এর উপর আমল করার দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদতের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা”।

উপরোক্ত সংজ্ঞা প্রয়োগ হবে কেবল ইবাদতের মাঝে বিদআতের বেলায়। 

আর যখন এর মাঝে কৃষ্টি-কালচার প্রবেশ করবে, তখন অর্থ হবে- দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত পন্থা, যা শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক হয় এবং এ পথে চলাকে শরিয়তের উপর চলা মনে করা হয়। এই অর্থ তখনই হবে, যখন এর মধ্যে আদত ও অভ্যাস (স্বভাব-কালচার) অন্তর্ভুক্ত হয়।

অপরদিকে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহর মতে,

هي ما خالفت الكتاب والسنة أو إجماع سلف الأمة في الاعتقادات والعبادات.

“আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদতের ক্ষেত্রে যা কুরআন-সুন্নাহ কিংবা পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের ঐক্যমত্যের বিপরীত হবে, তাই বিদআত”।

অর্থাৎ, সেসব সামাজিক রীতিনীতিকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা, সবই বিদআত।

শাইখুল ইসলাম রহিমাহুল্লাহ অন্যত্র আরো ব্যাপক অর্থে বলেছেন- 

ما لم يشرعه الله من الدين، فكل من دان بشيء لم يشرعه الله، فذاك بدعة وإن كان مُتأولا فيه.

“যেসব বিষয়কে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি, যা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুমোদিত নয় – এমন প্রত্যেক বিষয় বিদআত বলে গণ্য হবে; যদিও সেটার পক্ষে কোনো প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়”।

এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিষয়ক আলোচনা শীঘ্রই আসবে।

কখনো কেউ বিদআতে লিপ্ত হয়, তবে সে এক্ষেত্রে অপারগ থাকে। 

অনেক সময় একজন লোক বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা বিদআতি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়, কিন্তু এসব সে অক্ষম ও অপারগ হয়েই করতে বাধ্য হয়। সামনে এই সংক্রান্ত আলোচনা আসছে।

বিদআত বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। তার মানে, সব বিদআতিই এক বরাবর নয়। ঠিক তদ্রূপ, আমাদের বিরোধী সকলেই এক সমান নয়। 

যেমন, শিয়া ইসনা আশারিয়াহদেরকে আমরা খারেজীদের মতো মনে করি না। আবার খারেজীদেরকে আশআরিদের সমপর্যায়ের বলি না। অনুরূপ বর্তমান সময়ে যারা আমাদের বিরোধী মতাদর্শ লালন করে থাকে – উদাহরণস্বরূপ ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে সুরুরিদের অবস্থানে অথবা সালাফি দায়ীদেরকে তাবলিগের দায়ীদের অবস্থানে রাখি না। বিষয়টি এমনই।

বিদআতের এই শ্রেণীবিন্যাসের কারণ হল – কিছু বিদআত অপরাপর বিদআতের তুলনায় অধিক ভ্রান্ত। কিছু বিদআত কুফরি, কিছু ফাসেকি। অর্থাৎ, কিছু কিছু বিদআত এমন রয়েছে, যাতে নিপতিত ব্যক্তি কুফরিতে লিপ্ত। কেউ কেউ ফাসেকিতে লিপ্ত। এমন ব্যক্তি নির্বিশেষে হয়তো তাবিলকারী হবে অথবা জাহেল অথবা এমন কিছু, অথবা মাজুর হবে বা মাজুর হবে না। 

এখানে কোন শর্ত নেই। অর্থাৎ এটাই মূলনীতি যে, যে কেউই কুফরি-ফাসেকি বিদআতে লিপ্ত হবে, এতে করে সে স্বয়ং কাফের-ফাসেকে পরিণত হবে। কখনো সে কোনো বুজুর্গ  ব্যক্তি হতে পারে; অবশ্য সে ব্যাখ্যার আশ্রয়গ্রহণকারী ইত্যাদিও হতে পারে। এর বিবরণ সামনেই আচরণনীতিতে আসছে ইনশাআল্লাহ।

এখানে এই বিদআতের প্রসঙ্গ আলোচনার পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ-এর একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর অধিকাংশ ইমামগণই তাদের সাথে বিবাদের ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফের ধারকবাহক ছিলেন- এ সম্পর্কে একটি বক্তব্য। 

তিনি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন-

وأئمة السنة والجماعة وأهل العلم والإيمان فيهم العلم والعدل والرحمة فيعلمون الحق الذي يكونون به موافقين للسنة سالمين من البدعة ويعدلون على من خرج عنها ولو ظلمهم.. .

كما قال تعالى (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ ۖ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ) (المائدة: 8) ويرحمون الخلق فيريدون لهم الخير والهدى والعلم.

لا يقصدون الشر لهم ابتداء بل إذا عاقبوهم وبينوا خطأهم وجهلهم وظلمهم كان قصدهم بذلك بيان الحق ورحمة الخلق …

  • يعني هذا مقاصد أهل السنة في عدلهم في أهل البدعة والمخالف أنهم يرحمونه ويريدون له الهدى والعلم.

لا يقصدون الشر لهم ابتداء، بل إذا عاقبوهم وبيّنوا خطأهم وجهلهم وظلمهم كان قصدهم بذلك بيان الحق ورحمة الخلق والأمر بالمعروف والنهي عن المنكر وأن يكون الدين كله لله وأن تكون كلمة الله هي العليا.

“অর্থঃ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর ইমাম ও উলামায়ে কেরামের মাঝে ইলম, ইনসাফ, দয়ার্দ্রতা ছিলো। ফলে তাঁরা সেই সত্য সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন। তাঁরা সুন্নাহর অনুগামী (মোয়াফেক) ও বিদআত থেকে নিরাপদ ছিলেন। এই পথ থেকে যারা বিচ্যুত হয়ে গেছে, তাদের সাথে তাঁরা (বিবাদের ক্ষেত্রে) ইনসাফ বজায় রাখতেন, যদিও তারা (বিদআতিরা) তাঁদের ওপর জুলম ও অবিচার করতো।

ঠিক যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى

“অর্থঃ হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলী পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী”। (সূরা মায়েদা ৫:৮)

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ-এর ইমাম ও উলামায়ে কেরাম সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল। ফলে তাঁরা বিদআতিদের জন্য কল্যাণ, হিদায়াত ও ইলম-ই কামনা করেন।

শুরুতেই তাঁরা তাদের জন্য অকল্যাণের ইচ্ছা রাখেন না। বরং যখন তারা তাঁদেরকে কষ্ট দেয়, তাঁদের দোষ বর্ণনা করে বেড়ায়, তাঁদেরকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে ও জুলম-অত্যাচার চালায়, তখনই কেবল তাঁরা মুখ খুলতে বাধ্য হন। এর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে, সত্যকে প্রকাশ করা এবং সৃষ্টির প্রতি দয়াপরবশ হওয়া”।

অর্থাৎ, বিদআতি ও বিরুদ্ধবাদীদের সাথে আহলুস সুন্নাহর ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্দেশ্য এটাই যে, তাঁরা তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে থাকেন এবং তারা হিদায়াত পেয়ে যাক ও সঠিক বিষয় অবগত হোক- এমনটাই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।

তাঁরা প্রথমেই কখনো অকল্যাণের প্রত্যাশা করেন না। তবে যখন এই বিদআতিরা আহলুস সুন্নাহর উলামায়ে কেরাম ও এর অনুসারীদের পিছে লাগে, তাঁদের দোষ-ত্রুটি বলে বেড়ায়, তাঁদের গালমন্দ ও জুলম-নির্যাতন করতে থাকে, তখনই তাঁরা ওদের ভ্রান্তি তুলে ধরেন। বলাবাহুল্য, এর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য- সত্য প্রকাশ করা, সৃষ্টির প্রতি সহমর্মিতা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা এবং পুরো দ্বীন যেন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যাওয়া। শুধুমাত্র আল্লাহর কালিমাই যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে।

এটাই হচ্ছে মৌলিক কথা। অর্থাৎ, এটা কোন আত্মপক্ষ সমর্থন নয়। আর এর মধ্যেই রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রমাধুর্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনস্বরূপ কোন কথা বলতেন না। তিনি তো ছিলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার হুকুম আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে সর্বাপেক্ষা কঠোর।

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দ্বীনের সমর্থন ও সহযোগিতা করে যেতেন। নিজের পক্ষ সমর্থনে তিনি কখনোই কিছু বলেননি। এই মূলনীতির অনুসরণ – বিদআতি ও বিরোধীদেরকে বিদআত ও বিরোধিতা থেকে হেদায়েত ও হকের দিকে বের করে নিয়ে আসবেই এমন নয়, বরং শিরক ও কুফর থেকে ইসলামমুখী করবে ইনশাআল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এই ব্যবহারনীতির কারণে – যা তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ মুশরিকদের সাথে করতেন – কখনোই তাদের ওপর জুলম করতেন না, অত্যাচার-নির্যাতন করতেন না। বরং তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেছেন- 

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ (107)

আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্ববাসীর প্রতি অনুগ্রহ করে। (সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭)

এতক্ষণ বিদআতিদের সাথে আচার-ব্যবহারের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভূমিকাস্বরূপ কিছু আলোচনা উপস্থাপন করা হলো। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় অচিরেই আমরা বিদআতি ও বিরুদ্ধবাদীদের সাথে আচার-আচরণের মৌলিক নীতিমালা উল্লেখ করবো। এই নীতিমালার ওপর ছিলেন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এবং সালাফগণ। তারা এই নীতিমালাকে ধারণ করেছিলেন ঐসব লোকদের সাথে আচরণের বেলায়। 

সেই সাথে কিছু উদ্ধৃতিও আমরা উল্লেখ করবো; যার অধিকাংশই ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ-এর। কেমন যেন তিনি সালাফগণের ও তাদের অনুসৃত মতাদর্শের মাঝে এবং খালাফ তথা পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ও শাইখুল ইসলাম ও তাঁর পূর্বেকার ইমামগণের থেকে যে মতাদর্শ তারা গ্রহণ করেছেন, তাদের মাঝে তিনি পার্থক্যকারী।

সুতরাং, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর মানহাজের ওপর আল্লাহর পর যেসকল আইম্মায়ে কেরামের সবিশেষ অবদান রয়েছে, তাদের মাঝে অন্যতম হলেন – শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ। তিনি তাঁর সমকালীন ও তৎপরবর্তী যুগ থেকে নিয়ে আমাদের এই যুগ পর্যন্ত সময়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ-এর বিস্মৃত হওয়া ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বহু জ্ঞানের পুনর্জাগরণে অবদান রেখেছেন। এজন্যই বিদআতিদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর বক্তব্যকে আমাদের জন্য দলীল ও নির্ভরযোগ্য নিরূপণ করেছি।

 

[এই পুস্তিকাটি ‘জামাআত কায়িদাতুল জিহাদ ফি জাজিরাতুল আরব’ (AQAP) এর আমীর শাইখ খালিদ বাতারফি হাফিযাহুল্লাহ’র অনবদ্য সিরিজ দরস أصول التعامل مع أهل البدع والمخالفين  এর ভুমিকার সরল বাংলা অনুবাদ। এটির অন্যান্য দরসগুলো ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ প্রকাশিত হবে ইনশা আল্লাহ।]

 

*********

(Visited 160 times, 1 visits today)