সংঘাতের স্বরূপ

শায়খ ডক্টর সামী আল উরাইদি

এ সময়ে বিভিন্ন ময়দানে কাফের, যিন্দিক, মুলহিদ ও ধর্মদ্রোহীদের লড়াই ও ষড়যন্ত্রের তীব্রতা উপর্যপুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসবের মধ্য দিয়ে সকলের কাছেই সংশয়াতীতভাবে মুসলমানদের ও অন্যান্য কুফুরি ও ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠীর মাঝে চলমান লড়াইয়ের এই প্রকৃতি ফুটে উঠছে যে, তা একটি ধর্মীয় সংঘাত ও লড়াই। দিনদিন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, যুগ যুগ ধরে হক ও বাতিলের মাঝে চলমান লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতা সমকালের এই সংঘাত।

বর্তমান সময়ে ইসলামের শত্রুদের কিছু কিছু সুস্পষ্ট বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড আমাদের সম্মুখে এই সংঘাতের স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে। আর তাদের অন্তর যা গোপন করে তা তো আরও অধিক ন্যক্কারজনক ও জঘন্য।

সমকালীন কাফের রাষ্ট্রগুলো মহান ধর্ম ইসলামের ব্যাপারে যেভাবে আঙ্গুল তুলছে, ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে যেভাবে অপবাদ রটনা করছে, সাধারণভাবে গোটা মুসলিম উম্মাহ এবং বিশেষত উলামায়ে কেরাম, ইসলামের দায়ী, সমাজ সংস্কারক ও মুজাহিদদের ব্যাপারে যেরূপ যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করছে, তাদের অনুচর ও তাবেদার তাগুতি সরকারগুলোকে যেভাবে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপ্লব মোকাবেলায় তাদেরকে যেভাবে শক্তি সরবরাহ করছে, এর দ্বারা আমাদের সামনে একথা প্রতীয়মান হয়ে যায় যে – বর্তমানে কুফরি শক্তি তাদেরই পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে – যারা কিনা বলেছিল – “তোমরা ইসলামকে ধ্বংস করো এবং মুসলমানদেরকে উচ্ছেদ করো”।

যদিও তারা কিছুকাল ধরে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এই লড়াইয়ের প্রকৃতি ও স্বরূপ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিল এবং বলে যাচ্ছিল – তাদের লড়াই সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে।

কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালার সুন্নাহ ও ঐশী নিয়মের দাবি হল – হক-বাতিলের মাঝে চলমান লড়াইয়ের অনেকগুলো পর্যায় থাকবে। তেমনই একটি পর্যায় হলো – সত্য-মিথ্যা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সত্যের শিবির ও মিথ্যার শিবির আলাদা হয়ে যাবে।

তো বর্তমান সময়ে চলমান লড়াইয়ের স্বরূপ কেবল তাদের কাছেই অস্পষ্ট থাকতে পারে যাদের অন্তর্দৃষ্টি আল্লাহ তায়ালা কেড়ে নিয়েছেন এবং যাদের অন্তরকে তিনি অন্ধত্বের পর্দা দ্বারা আবৃত করে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আফিয়াত ও সালামত কামনা করি!!

কেমন করে আমাদের মাঝে এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকতে পারে? অথচ আমাদের রব সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাঁর কিতাবুল কারীমের অসংখ্য জায়গায় এবং তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর বিভিন্ন স্থানে বহুবার এ বাস্তবতা তুলে ধরে এ বিষয়ে সব রকম ধোঁয়াশা ও অস্পষ্টতা দূর করে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ইরশাদ করেন—

وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ ٱلْيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ

“অর্থঃ ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন”। (সূরা আল বাকারা 2:১২০)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আরো ইরশাদ করেন—

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ۚ فَإِنِ انتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‎﴿٣٩﴾‏ 

“অর্থঃ আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনা শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন”। (সূরা আল আনফাল 8:৩৯)

তিনি আরও ইরশাদ করেন—

 إِن يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً وَيَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ وَأَلْسِنَتَهُم بِالسُّوءِ وَوَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ ‎﴿٢﴾‏  

“অর্থঃ তোমাদেরকে করতলগত করতে পারলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং মন্দ উদ্দেশ্যে তোমাদের প্রতি বাহু ও রসনা প্রসারিত করবে এবং চাইবে যে, কোনরূপে তোমরাও কাফের হয়ে যাও”। (সূরা আল মুমতাহিনা ৬০:০২)

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন—

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ الْمُسْنَدِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو رَوْحٍ الْحَرَمِيُّ بْنُ عُمَارَةَ، قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ وَاقِدِ بْنِ مُحَمَّدٍ، قَالَ سَمِعْتُ أَبِي يُحَدِّثُ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ ‏”

ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আদিষ্ট হয়েছে, যতক্ষন না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্‌র রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়। তারা যদি এ কাজগুলো করে, তবে আমার পক্ষ থেকে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারন থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহ্‌র ওপর ন্যাস্ত। (সহীহ বুখারী, হাদিস নাম্বারঃ ২৪, হাদিসের মানঃ সহিহ)

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন—

عَنِ ابنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم بُعِثْتُ بِالسَّيْفِ حَتَّى يُعْبَدَ اللهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَجُعِلَ رِزْقِي تَحْتَ ظِلِّ رُمْحِي وَجُعِلَ الذِّلَّةُ وَالصَّغَارُ عَلَى مَنْ خَالَفَ أَمْرِي وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি (কিয়ামতের পূর্বে) তরবারি-সহ প্রেরিত হয়েছি, যাতে শরীকবিহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত হয়। আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে। অপমান ও লাঞ্ছনা রাখা হয়েছে আমার আদেশের বিরোধীদের জন্য। আর যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।” (আহমাদ ৫১১৪-৫১১৫, ৫৬৬৭, শুআবুল মান ৯৮, সঃ জামে’ ২৮৩১ নং)

শরিয়তের এসব দ্ব্যর্থহীন বর্ণনা সন্দেহাতীতভাবে মুসলমানদের ও কাফের-মুলহিদ গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান লড়াইয়ের বাস্তবতা তুলে ধরেছে। এসব বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, এ লড়াই হক-বাতিলের চিরন্তন সংঘাতেরই ধারাবাহিকতা। তাই বিকৃতি সাধন করে, প্রতারণা করে, মিথ্যার পসরা সাজিয়ে এ বাস্তবতা ঢেকে রাখা যাবে না। আপসকামী লোকদের পরাজিত মানসিকতা এবং আল্লাহর সুন্নাহ পরিবর্তনের অপচেষ্টায় লিপ্ত লোকেরা এ সত্য আড়াল করতে পারবে না। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন —

ولا يزالون يقاتلونكم حتى يردوكم عن دينكم إن استطاعوا،

“অর্থ: বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়”। (সূরা আল বাকারা ২:২১৭)

তো যুগে যুগে কাফের, মুলহিদ ও ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠী বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে আসছে। কলমের মাধ্যমে, অর্থ-সম্পদ দিয়ে এবং অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা তারা মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তারা কোন মুসলমানকেই ছাড়বে না। বিশেষত যদি মুসলমানদের জাতীয় জীবনে কারো কোনো ইতিবাচক ভূমিকা ও প্রভাব থাকে তবে অবশ্যই এমন ব্যক্তিকে নিজের ধর্ম থেকে মুরতাদ বানাতে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে। তারা তো সাইয়েদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের ইচ্ছা ছিল, যে সত্য নিয়ে তিনি আগমন করেছেন, তা থেকে নবীজিকে তারা বিচ্যুত করে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে অটল-অবিচল রেখেছিলেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে আমাদের রব্বে কারীম তাঁর কিতাবে ইরশাদ করেন—

وَإِن كَادُوا۟ لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ ٱلَّذِىٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ لِتَفْتَرِىَ عَلَيْنَا غَيْرَهُۥ وَإِذًا لَّٱتَّخَذُوكَ خَلِيلًا وَلَوْلَآ أَن ثَبَّتْنَٰكَ لَقَدْ كِدتَّ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْـًٔا قَلِيلًا

“অর্থঃ তারা তো আপনাকে হটিয়ে দিতে চাচ্ছিল যে বিষয় আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে যা প্রেরণ করেছি তা থেকে। আপনার পদস্খলন ঘটানোর জন্যে তারা চূড়ান্ত চেষ্টা করেছে, যাতে আপনি আমার প্রতি কিছু মিথ্যা সম্বন্ধযুক্ত করেন। এতে সফল হলে তারা আপনাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিত। (73) আমি আপনাকে দৃঢ়পদ না রাখলে আপনি তাদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকেই পড়তেন।“ (সূরা আল ইসরা ১৭:৭৩-৭৪)

শাইখ সাইয়েদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেন,

“কাফের মুশরিক গোষ্ঠীর যেসব অপচেষ্টা থেকে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেফাজত করেছিলেন, প্রতি যুগে আল্লাহর দ্বীনের দায়ীদের ব্যাপারে ক্ষমতাশীলরা সেসব অপচেষ্টাতেই লিপ্ত হয়ে থাকে। তাদের ইচ্ছা থাকে, কিছু মাত্র হলেও যেন দাওয়াতের মূল আবেদন ও অনমনীয়তা থেকে দায়ীকে বিচ্যুত করা যায়। তারা একটি আপসরফা ও সহাবস্থানের পরিবেশে সত্যের দিকে আহবানকারীদের আটকে ফেলতে চায় এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুত অঢেল গনিমত থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে”।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দায়ীদের মাঝে অনেকেই এসব প্রতারণার কারণে নিজেদের দাওয়াত থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। কারণ সামান্য বিচ্যুতিকে তারা হালকা ব্যাপার মনে করেন। আর ক্ষমতাশীলরাও প্রথমদিকে দায়ী ব্যক্তিদেরকে পুরো দাওয়াত ত্যাগ করতে বলেনা। তারা দাওয়াতের মাঝে কিছুটা পরিমার্জন ও সংস্কার আনার কথা বলে যাতে করে একটি সহাবস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। আর এই সুযোগটাই দায়ীদের ব্যাপারে শয়তান ভালোভাবে গ্রহণ করে। দায়ীদের মনে এ ধারণা সঞ্চার করা হয় যে, দাওয়াতের স্বার্থেই ক্ষমতাশীলদেরকে কাছে টানতে হবে যদিও তা কিছুটা বিচ্যুতি মেনে নিয়েও হয়।

কিন্তু সরল পথের শুরুতে কয়েক ডিগ্রী এই দিক পরিবর্তনই অনেক দূর পথ চলার পর গন্তব্য থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। দায়ী ব্যক্তি দাওয়াতের অতিসামান্য অংশের ব্যাপারেও যদি আপোষ করেন তবে পরবর্তীতে তিনি না পারেন প্রথমবারের গৃহীত অবস্থান ধরে রাখতে আর না পারেন প্রথমবার ছেড়ে আসা অংশ পুনরুদ্ধার করতে। কারণ তার আপোষ ও নমনীয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে – যদি মাত্র একবার তিনি পেছনে পা ফেলেন।

এখানে মূলত ঈমানের প্রশ্ন; দাওয়াতের সর্বাংশের প্রতি ঈমান। অতএব যে ব্যক্তি সামান্য অংশ হলেও ছেড়ে দিবে, অতি সামান্য একটি অঙ্গ হলেও পরিত্যাগ করবে, সে কখনোই নিজের দাওয়াতের প্রতি যথার্থরূপে পূর্ণ ঈমানদার বলে বিবেচিত হবে না।

শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরি হাফিযাহুল্লাহ’র বক্তব্য-

“তৃতীয় সত্য হল – জিহাদ ছাড়া অন্য যেকোন উপায় কেবল আমাদের ক্ষতি এবং ব্যর্থতার পাল্লা ভারী করবে। যারা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অথবা ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার মত ‘চুক্তি’র মাধ্যমে ইসলামের ভূমিগুলোকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে – তারা ফিলিস্তিনের এক দানা বালুও পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।

এসকল কাজের দ্বারা তারা কেবল জিহাদের ক্ষতিই করবে এবং মুজাহিদিনদের কাজে বাধার সৃষ্টি করবে। তারা এসকল প্রক্রিয়াতে তাদের কৌশল ও কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও বিচক্ষণতা প্রয়োগের চেষ্টা করলেও তা কখনোই পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কেননা তারা যেটা চায় সেটি আমাদের রব আমাদের আগেই বলে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন –  

وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ

“অর্থঃ ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন”। (সূরা আল-বাকারা ২:১২০)

(শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরি হাফিযাহুল্লাহ’র বক্তব্য এখানেই শেষ)

ক্ষমতাশীলরা দায়ীদের ব্যাপারে এ সুযোগেরই সন্ধান করে। কেউ যখন দাওয়াতের প্রাণ বস্তুর সামান্য অংশ হলেও পরিত্যাগ করে তখনই ক্ষমতাশীলদের অন্তর থেকে তাদের প্রভাব দূরীভূত হয়ে যায় এবং তাদের আদর্শিক দুর্গ ভেঙ্গে পড়ে। তাগুত গোষ্ঠী বুঝে যায়, আমরা যদি দর কষাকষি চালিয়ে যেতে পারি এবং উত্তরোত্তর আদর্শ ক্রয়ের মূল্য বৃদ্ধি করতে থাকি তাহলে পুরোপুরিভাবে তাদেরকে থামিয়ে দেয়া সম্ভব হবে এবং তাদের আদর্শিক পুঁজি কেড়ে নেয়া যাবে। 

দাওয়াতের স্বার্থরক্ষার অজুহাতেই ক্ষমতাশীলদেরকে কাছে ভেড়ানোর জন্য দাওয়াতের প্রাণ বস্তুতে হস্তক্ষেপ করা মূলত আদর্শিক এক পরাজয়। কারণ তাতে দাওয়াতকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ক্ষমতাশীলদের ওপর নির্ভর করা হয়। অথচ বিজয় দানের জন্য মুমিনদের পক্ষে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা-ই যথেষ্ট, যিনি তাদের দাওয়াতকে বিজয়ী করবেন। অমোঘ এ রহস্যের অন্তর্মূলে যখন পরাজয় সূচিত হয় তখন সে পরাজয় কখনোই বিজয়ের রূপ পায় না। আমরা আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আফিয়াত ও সালামত কামনা করছি!

এই কারণেই প্রতিটি মুসলমানের কাছে দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের দাবি এটাই থাকবে যে – ইসলামের শত্রুদের সাজানো মিথ্যায়, পরাজিত মানসিকতার লোকদের আপসকামিতায় কখনোই যেন সে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত না হয়। কুচক্রীরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করতে এবং এ সংঘাতের প্রকৃত বাস্তবতা ঢেকে রাখতে চেষ্টা করবেই। কিন্তু দাওয়াতি আন্দোলনের কর্মীকে অবশ্যই এ সংঘাতের মূল প্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে এবং এই আন্দোলনে নিজ অবস্থানে থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। আলেম তার নিজ অঙ্গনে; মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে; লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরা লেখনীর অঙ্গনে; ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তিবিদ ও টেকনিশিয়ানরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে। তাদের দিক থেকে যেন ইসলামের ওপর কোনোরূপ আঘাত না আসে সেটা তারাই নিশ্চিত করবে।

আল্লাহ তা’য়ালা শায়খ উসামা বিন লাদেনকে রহম করুন! তিনি বলেছিলেনঃ

“কোন অবস্থাতেই চলমান এসব লড়াই ও রণাঙ্গনকে বিচ্ছিন্ন কোন লড়াই ও রণাঙ্গন মনে করা উচিত নয়। বরং এগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা বিরাট এক লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা। সে লড়াইয়ের নাম হল ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা তুমুল যুদ্ধ। ন্যক্কারজনক জঘন্য এক তীব্র লড়াই। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত এ যুদ্ধে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’র পতাকাতলে ছায়া গ্রহণ করা।”

মুসলমানরা যদি যথার্থভাবে এ লড়াইয়ের প্রকৃতি ও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় তাহলেই আল্লাহর ইচ্ছায় তারা শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে এবং কোন অবস্থাতেই তাদের মিষ্টি কথা ও চটকদার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে তারা বিভ্রান্ত হবে না। এই উপলব্ধি তাদেরকে শঠতা, ধোঁকা, প্রতারণা ও মিথ্যা প্রণোদনার চোরাবালি ও পাতানো ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে।

এমনিভাবে এই উপলব্ধি বৈপ্লবিক পরিক্রমায় আমাদেরকে এমন অনেক চোরা গলি এড়িয়ে চলতে সহায়তা করবে, মুসলিম হিসেবে বিপ্লবের সরল রাজপথ থেকে বিমুখ হয়ে যেগুলোর দিকে ধাবিত হবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ এসব অলিগলির যেটাই আমরা গ্রহণ করি না কেন সেখানেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ত্যাগ দিয়ে যেতে হবে। আর এতে সময় বিলম্বিত হবে। আরব মাতৃভূমির তরে আত্মত্যাগের নামে, ফিলিস্তিনি অথবা সিরীয় জাতীয়তার তরে আত্মদানের নামে আমাদের কতগুলো বছর ব্যয় হয়ে গিয়েছে!!!

আমাদের কত রক্ত ঝরেছে… কত অর্থ সম্পদ ব্যয় হয়েছে… কত সময় নষ্ট হয়েছে…। ফিলিস্তিনি, সিরিয় অথবা মিশরীয় রক্তের স্লোগান মুখে তুলে দিয়ে এই উম্মাহর কত প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে..। এমনই বিভিন্ন স্লোগান আর পতাকা বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে কত লোককে সংঘাতের মূল বাস্তবতার ব্যাপারে অজ্ঞতার মাঝে রাখা হয়েছে…!!!

এমনিভাবে সংঘাতের এই মূল প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক উপলব্ধির দ্বারা আমরা বুঝতে পারবো, আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীর শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা কেবলই একপথে রেখেছেন। এখানে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। একক সেই পথ হলো, পৃথিবীতে হকের মাধ্যমে বাতিলের প্রতিরোধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ইরশাদ করেন—

وَلَوْلَا دَفْعُ ٱللَّهِ ٱلنَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ ٱلْأَرْضُ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى ٱلْعَٰلَمِينَ

“অর্থঃ আল্লাহ যদি একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে গোটা দুনিয়া বিধ্বস্ত হয়ে যেত। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই দয়ালু, করুণাময়”। (সূরা আল বাকারা ২:২৫১)

কবি সত্যই বলেছেন—

ইনসাফ তখনই হয় যখন শক্তির ভারসাম্য আসে

সন্ত্রাসের মোকাবেলা হবে তো সন্ত্রাস দিয়েই

সংঘাতের এই মূল প্রকৃতি সম্বন্ধে উপলব্ধির দ্বারা ব্যক্তি সত্য ও সত্যপন্থীদের সাহায্যে এবং বাতিল ও বাতিলপন্থীদের প্রতিরোধে তার পক্ষ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারবে। এ পথে যদি ব্যক্তি নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে এগিয়ে আসে অতঃপর আল্লাহর রাস্তায় নিজের প্রাণ, শ্রম ও সম্পদ ব্যয় করে তবেই তো সে আল্লাহর সৌভাগ্যশালী সৈনিকদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ইরশাদ করেন—

ٱلَّذِينَ امَنُوا۟ يُقَٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُقَٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱلطَّٰغُوتِ فَقَٰتِلُوٓا۟ أَوْلِيَآءَ ٱلشَّيْطَٰنِ إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَٰنِ كَانَ ضَعِيفًا

“অর্থঃ যারা ঈমানদার তারা জিহাদ করে আল্লাহর রাহেই। পক্ষান্তরে যারা কাফের তারা লড়াই করে শয়তানের পক্ষে। সুতরাং তোমরা জিহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষালম্বনকারীদের বিরুদ্ধে, (দেখবে) শয়তানের চক্রান্ত একান্তই দুর্বল”। (সূরা আন নিসা ৪:৭৬)

অতএব এখানে দুটো শিবির; তৃতীয় কোনো শিবির নেই। হয় রহমানের সৈনিক দলের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে নয়তো শয়তানের বাহিনীর।

এটাই হলো এই সংঘাতের মূল বাস্তবতা। আর তারই কিছু লক্ষণ আমরা মুসলিম ভাই-বোনদের সামনে তুলে ধরলাম। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডার ও জায়নিস্টদের যৌথ আগ্রাসনের মুখে এ বিষয়ে সচেতন থাকা আমাদের জন্য বাঞ্ছনীয়।

কারণ এ লড়াইয়ে আমাদের প্রত্যেককেই তার পক্ষ থেকে সেরা ভূমিকাটি পালন করতে হবে। আর এর জন্য কিছুতেই কোন প্রকার ষড়যন্ত্র, শঠতা, প্রতারণা, মিথ্যা আশ্বাস, আপসকামিতা ও বিকৃতির পেছনে পড়া যাবে না।

হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে আপনার সৈনিক ও সাহায্যকারীদের দলভুক্ত করুন! আমাদের জীবনকে আপনার দ্বীনের জন্য কবুল করুন! আপনার পথে আমাদেরকে শাহাদাত নসিব করুন!

و صلى الله و سلم و بارك على نبينا محمد و على الأنبياء والرسل أجمعين

 

*********

(Visited 232 times, 1 visits today)