বিশুদ্ধ চেতনাঃ পরিচয় ও প্রয়োজনীয়তা

শায়খ খালিদ বাতারফি

আমাদের জাতি ক্রমাগত বিপদ, সংকট ও ফেতনার মধ্য দিয়ে কাল অতিক্রম করছে। চারিদিকে অন্ধকার রাত্রির ন্যায় ফেতনা, যা সহনশীলকেও অস্থির করে তোলে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি মুমিন মুসলমান ও মুজাহিদের জন্য নিজ আচরণের ক্ষেত্রে, নিজের সকল সামাজিক আচরণবিধির ক্ষেত্রে, বিশেষত: জিহাদি জীবনের আচরণের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

কারণ বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ বিভক্তির ফেতনায় জর্জরিত। উম্মতের মাঝে বিভক্তি, দলসমূহের মাঝে বিভক্তি, মাযহাবসমূহের মাঝে বিভক্তি। এছাড়াও আরো নানান ধরনের বিভক্তি আমাদের মুসলিম জাতিকে নানান দলে এবং গ্রুপে বিভক্ত করে রেখেছে।

এ সকল দল, গ্রুপ ও মাযহাব নিয়ে এমন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে নিজ দলের বুঝ আর বিশুদ্ধ ইসলামের বুঝের পার্থক্য দেখে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের অপ্রতুলতা একটি প্রধান কারণ। মুসলিম ও মুজাহিদগণকে সঠিক বুঝ ও ইসলামের সঠিক চেতনা শিক্ষা দিবেন এমন উপযুক্ত শিক্ষকের কমতি রয়েছে।

আরবি وعي শব্দের অর্থ চেতনা।  আল মুজামুল ওয়াসিত অভিধানে وعي অর্থ হল: সংরক্ষণ, মূল্যায়ন, বুঝ ও নিখুঁত উপলব্ধি। الوعيّ অর্থ হল: চতুর ও বুঝমান।

‘তাহযীবুল লুগাহ’ এর মধ্যে এসেছে, ভাষাবিদ লাইস বলেন: وعي অর্থ হল, অন্তর কর্তৃক কোন কিছুকে সংরক্ষণ করা।

ইবনে মানযুর ‘লিসানুল আরবে’ বলেন: وعي হল অন্তর কর্তৃক কোন কিছুকে সংরক্ষণ করা। কোন কিছুকে বা কথাকে وعي করেছে মানে হল, তাকে মুখস্থ করেছে, বুঝেছে ও গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন হাদিসের মধ্যে এসেছে: “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার কথা শুনেছে, অতঃপর তা وعي (সংরক্ষণ বা মুখস্থ) করেছে। কারণ যাদের নিকট পৌঁছানো হয়, তাদের মধ্যে অনেক এমন আছে, যারা সরাসরি শ্রোতা থেকেও অধিক সচেতন, বুঝমান।”

স্বভাবতই وعي এর যে অর্থগুলো আমরা পেলাম, এগুলো মুমিনদের জন্য, বিশেষত: মুজাহিদগণের জন্য, বিশেষ করে যারা এ যুগে বসবাস করছে, তাদের খুব প্রয়োজন।

যে যুগে বহু ধরণের ফেতনা, বিপদ ও সংকট বিরাজ করছে, মানুষ দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তখন আমরা এ ধরণের শিক্ষার আসরগুলো থেকে যে বিষয়গুলোর আশা করি, তা হল:

১- মুসলিম যুবকদের মাঝে সচেতনতার হার বৃদ্ধি করা। যেন সে তার কর্মময় জীবনে সঠিকভাবে চলতে পারে। এমনিভাবে আমরা তাকে ইসলামের ব্যাপারে বিশুদ্ধ চেতনা ও বিশুদ্ধ বুঝ দেয়ার চেষ্টা করবো, যাতে সে অন্য মানুষের সাথে – চাই সে মুসলিম হোক বা কাফের – আচার-আচরণের পদ্ধতি বুঝতে ও জানতে পারে। যেমন সহীহুল বুখারীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু  থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ.

“আল্লাহ যার ব্যাপারে কল্যাণ চান, তাকেই দ্বীনের বুঝ দান করেন।” (সহীহুল বুখারী ৭১, মুসলিম ১০৩৭, ইবনু মাজাহ ২২১, আহমাদ ১৬৩৯২, মুওয়াত্তা মালিক ১৬৬৭, দারেমী ২২৪, ২২৬)

সুতরাং মানুষ শুধু কুরআন-সুন্নাহর মূলপাঠগুলো শিখবে- এতটুকুই কর্তব্য নয়, বরং তার সাথে সাথে তাকে মূল পাঠের অর্থ বুঝতে হবে এবং বাস্তব জীবনে এ সমস্ত পাঠগুলোর প্রয়োগ জানতে হবে। এভাবেই বিশুদ্ধ বুঝ তৈরি হবে ইনশা আল্লাহ।

২- আমরা আরো চাই যে, এসকল শিক্ষার আসরগুলো থেকে একজন মুসলিম, বিশেষ করে মুজাহিদরা আমাদের বর্তমান জামানার নব উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে বুঝা ও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করা শিখতে পারবে। জানতে পারবে কীভাবে ফেতনাসমূহের মোকাবেলা করতে হবে এবং কীভাবে বিভক্তি ও দল কেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যাতে করে নিজের দল বা জামাতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব অন্তরে না আসে। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ ইসলামের পক্ষপাতিত্বই যেন করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ  

“হে মুমিনগণ! (কোন বিষয়ে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের থেকে আগে বেড়ে যেও না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।” (সূরা হুজরাত ৪৯:১)

এমনিভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِه. رَوَاهُ فى المُوَطَّا

“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দু’টি জিনিস আঁকড়ে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার অবর্তমানে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল: আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক রহ. হাদিস নং ১৬০৪)

স্বভাবতই এ সকল পাঠগুলোর পদ্ধতি হবে: পুণ্যবান পূর্বসূরিদের বুঝের আলোকে কুরআন-সুন্নাহ বুঝা। আমরা আলেমদের (বিশেষত: সমসাময়িক আলেমদের) বক্তব্য ও মতামতগুলোর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করতে চাই না। শুধুমাত্র যেটা সালাফে সালিহীনদের (আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন) বুঝের অনুকূল হবে, সেটাই গ্রহণ করা হবে। 

মহান আরশের অধিপতি মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ ও বিশুদ্ধ চেতনা দান করুন!

আমাদেরকে সেসকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা কথা শ্রবণ করে, অতঃপর তার মধ্য হতে উত্তম কথাটির অনুসরণ করে। আমাদেরকে সেসকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা নিজেদের দ্বীনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। নিশ্চয়ই তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং তিনি দু’আ কবুল করেন।

আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক । 

(Visited 412 times, 1 visits today)