দাওয়াতের সঠিক পথ ও পন্থা!

শায়খ উসামা মাহমুদ 

আল্লাহ তা’আলা যেখানেই দাওয়াতের আদেশ করেছেন (ادع الى سبيل ربك) অর্থাৎ দ্বীন ও দ্বীনের কাজের প্রতি দাওয়াতের কথা বলেছেন, সেখানে তার পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। এ পদ্ধতি হলো হেকমত, উত্তম ওয়াজ নসিহত এবং আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে মুনাযারা করা। 

আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা:

‬‏ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬

অর্থ: “আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।” [সুরা নাহল ১৬:১২৫] ‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬

আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে বলেন: 

“এই আয়াতে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, কীভাবে আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে।”

এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তিনটি পদ্ধতির কথা বলেছেন –

১. হেকমত

২. মাওয়ায়েযে হাসানা

৩. জিদালে হাসানা। 

প্রত্যেকটির বিবরণ নিম্মে উল্লেখ করা হল:

১. হেকমত:

হেকমত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো – খুব মজবুত বিষয়ও অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে, প্রজ্ঞার সাথে উপস্থাপন করা। যা শুনে বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ ও ইলম পিপাসু আলেমগণ মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। জাগতিক দর্শন তার সামনে ম্লান হয়ে যায়। হেকমত দ্বারা ওহী থেকে প্রাপ্ত কোন বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা বুঝায়, যেন জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে কোন ধরনের খুত কেউ ধরতে না পারে। 

২. মাওয়ায়েযে হাসানা:

অন্তর নরমকারী ও প্রভাব বিস্তারকারী নসিহতকে মাওয়ায়েযে হাসানা বলে। এর মধ্যে ভাষামাধুর্য থাকবে, সেই সাথে অন্তরবিগলিত করার মতো প্রাণও থাকতে হবে।

ইখলাস, সহমর্মিতা, দয়া ও উত্তম আখলাকের সাথে সুন্দরভাবে কৃত নসিহত দ্বারা পাথরের মত শক্ত অন্তরও মোমের মত গলে যায়। মৃতও প্রাণ ফিরে পায়, নিরাশাগ্রস্ত জাতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ায়। উৎসাহ ও ভীতিপ্রদর্শনমূলক ওয়াজ শুনে জান্নাতের দিকে অস্থির চিত্তে দৌড়ানো শুরু করে।

বিশেষ করে যাদের অন্তর হক্কের জযবায় ভরপুর, কিন্তু উঁচু চিন্তা-চেতনা ও বেশি মেধার অধিকারী নয়, তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী ওয়াজ নসিহত দ্বারা আমলের জন্য এমন এক আগ্রহ তৈরি করা যায় যা উঁচু স্তরের গবেষণালব্ধ ইলমী তাহকিকের মাধ্যমে সম্ভব নয়। 

তবে, দুনিয়াতে একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা সবসময় সব বিষয়ে নাক গলায়। এরা প্রত্যেক কথায় প্যাঁচ ধরে আর অযথা তর্ক করে। এসমস্ত লোকেরা হেকমতপূর্ণ কথা শোনে না, ওয়াজ নসিহতও কবুল করে না। তারা চায় সব বিষয়েই তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকুক। 

৩. জিদালে হাসানা:

অনেক সময় বুঝমান, সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিকেও সন্দেহ ঘিরে ধরে। আলোচনা ছাড়া তারও এতমিনান হয়না। তাদের জন্য হল জিদালে হাসানা। যা আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ অর্থাৎ যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে ভদ্রতা, সঠিক দিকনির্দেশনা ও ইনসাফের সাথে মুনাযারা করবে। প্রতিপক্ষকে কোন অভিযোগ দিলে উত্তম পদ্ধতিতে দিবে।

অযথা অন্তরে আঘাতকারী কথাবার্তা বলে ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি করবে না। বিষয়টি এমনভাবে পেশ করতে হবে যেন অনেক দূর পর্যন্ত না গড়ায়। লোকদেরকে বুঝানো ও সত্য প্রতিষ্ঠা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। কঠোরতা, খারাপ ব্যবহার, চাপাবাজি ও গোয়ার্তুমি দ্বারা কোন ফায়দা হয় না। 

মুফতি শফি রহিমাহুল্লাহ দাওয়াতের পদ্ধতির ক্ষেত্রে আম্বিয়ায়ে কেরামের তরীকার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

“আল্লাহর পথে আহবান মূলত নবীগণের কাজ। উলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করেন নবীদের নায়েব বা প্রতিনিধি হিসেবে। এজন্য জরুরী হলো দাওয়াতের পদ্ধতি ও আদবও নবীদের থেকে শিখে নেওয়া।

যে দাওয়াত তাদের তরীকার উপর থাকবে না, তা দাওয়াতই না, বরং তা লড়াই বা ঝগড়ার কারণ হয়ে দাড়াবে। নববী দাওয়াতের মূলনীতি কেমন সেটা আমরা মুসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে আল্লাহ যে নির্দেশ দিয়েছেন তা থেকে শিখে নিতে পারি। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى

অর্থাৎ ফেরাউনের সাথে নরম কথা বল, হয়ত সে বুঝবে অথবা ভীত হবে। [সুরা ত্বা-হা ২০:৪৪] 

প্রত্যেক দাঈর সর্বদা এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিৎ যে, ফেরাউনের মত অহংকারী কাফের, যার মৃত্যুও আল্লাহর ইলম অনুযায়ী কুফর অবস্থায়ই হবে – তার ক্ষেত্রেও আল্লাহ নিজের দাঈকে নরম ব্যবহারের উপদেশ দিয়ে বলেছেন “নরমভাবে দাওয়াত দিবে”। 

বর্তমানে আমরা যাদেরকে দাওয়াত দিই, তারা কেউ ফেরাউনের চেয়ে বড় গোমরাহ নয়। আর আমাদের কেউ মূসা ও হারুন আলাইহিস সালামের মত পথপ্রদর্শকও নই। তো যেই অধিকার আল্লাহ তা’আলা তাঁর দুই নবীকে দেননি যে, “মাদউর সাথে শক্ত ব্যবহার করবে, তাকে অপমান করবে” – সে অধিকার আমাদের কোথা থেকে অর্জন হয়ে গেলো?!!!

কুরআনে কারীমে নবীগণের দাওয়াত ও তাবলীগ এবং কাফেরদের সাথে মুনাযারার আলোচনা অনেক আছে। কোথাও দেখা যায় না যে, ইসলামের বিরোধিতাকারীদের জবাবে কোন নবী কখনও কোন শক্ত ভাষা ব্যবহার করেছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এবিষয়েও খেয়াল রাখতেন যে, মাদউর অপমানও যেন না হয়। তাই কাউকে যদি তিনি কোন ভুল বা অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখতেন, তখন তাকে কিছু না বলে সাধারণ মজলিসে বলতেন – “লোকদের কি হলো যে, তারা এমন এমন করে?”।

এই সাধারণ সম্বোধনে যাকে শোনানোর উদ্দেশ্য সেও শুনতো এবং নিজের সংশোধনের ফিকিরে লেগে যেত। 

সাধারণত নবীগণের অভ্যাস ছিলো শ্রোতাকে লজ্জা থকে বাঁচানো। তাই অনেক সময় যে কাজ শ্রোতার দ্বারা সংঘটিত হতো তা নিজের দিকে নিসবত করে সংশোধনের চেষ্টা করতেন। সূরা ইয়াসীনের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَا لِي لاَ أَعْبُدُ الَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

আমার কি হল যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে, আমি তাঁর এবাদত করবো না? [সুরা ইয়া-সীন ৩৬:২২] 

এটা তো জানা কথা যে, (আয়াতে উল্লেখিত এই দূত সর্বদা আল্লাহর ইবাদতেই লিপ্ত থাকতো, শুধু কাফের শ্রোতাকে শুনানোর উদ্দেশ্যই এই কাজকে নিজেদের দিকে নিসবত করে বলেছেন।”

দাওয়াতের উদ্দেশ্য শুধু অন্যের সমালোচনা করা নয়, বরং অন্যকে নিজের কাছে ডেকে আনা। আর এই ডাকা তখন কার্যকর হবে যখন বক্তা-শ্রোতা উভয়ের মাঝে কোন একটি বিষয়ে একাত্মতা থাকবে।

এজন্য পবিত্র কুরআনে নবীগণের দাওয়াতের অধিকাংশই يا قوم ‘ইয়া কওম’ (হে আমার সম্প্রদায়!) শিরোনামে এসেছে।  নবীগণ “হে আমার সম্প্রদায়” এই শব্দের দ্বারা প্রথমেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কথা উল্লেখ করেছেন।

এরপর তাদের সংশোধনের আলোচনা করেছেন যে, – “আমরা তো ভ্রাতৃত্বের দিক থেকে একই জাতের মানুষ, আমাদের মাঝে তো কোন দূরত্ব নেই”। একথা বলেই তাদের সংশোধনের কাজ শুরু করতেন। 

রসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমের বাদশার নামে যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে তাকে ‘আযীমুর রোম’ তথা রোমের সম্মানিত বাদশা উপদিতে সম্বোধন করেছেন। এখানে তাকে “রোমের সম্মানিত বাদশা” বলে সম্মান করেছেন।

আর এই ‘আযীমুর রোম’ শব্দটি আল্লাহর রাসুল রোমের বাদশার জন্য ব্যবহার করে তার সম্মানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার এই সম্মানের স্বীকৃতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমের অধিবাসীদের জন্য দিয়েছেন, নিজের জন্য নয়। তারপর কোরআনের নিম্মোক্ত আয়াতাংশটি শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করে দাওয়াত দিয়েছেন। 

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ

অর্থ: `হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবো না। [সুরা ইমরান ৩:৬৪] 

এখানে প্রথমে পরস্পরের একমত হওয়ার একটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর খ্রিস্টানদের ভুলগুলো আলোচনা করা হয়েছে। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের সীরাহ নিয়ে যদি ফিকির করা হয়, তাহলে তালীম ও দাওয়াতের এধরণের অনেক আদাব ও উসুল পাওয়া যায়। বর্তমানে তো দাওয়াত ও ইসলাহ এবং আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকারের কোন খেয়ালই নেই।

আর যারা দাওয়াতের কাজে লিপ্ত আছে, তারা শুধু বাহাস-মুনাযারা, তর্ক-বিতর্ক, প্রতিপক্ষকে অভিযোগ করা, কথায় আটকানো এবং তাকে অপমান করাকেই দাওয়াত বানিয়ে নিয়েছে। যা সুন্নতের খেলাফ হওয়ার কারণে কখনই প্রভাব বিস্তারকারী ও উপকারী হয়না।

তারা মনে করে আমরা ইসলামের অনেক খেদমত করে ফেলেছি। বাস্তবে তারা মানুষকে দূরে সরানোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

উক্ত আয়াতের তাফসীর থেকে জানা যায় যে, ইসলামের আসল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া। আর এই দাওয়াতের মূলনীতি দুইটি – হেকমত এবং মাওয়ায়েযে হাসানা। তর্ক যদি করতে বাধ্য হয় তাহলে সেখানে ‘আহসান’ তথা উত্তম পন্থায় করার শর্তসহ জায়েজ বলেছেন। কিন্তু এটি দাওয়াতের কোন স্বতন্ত্র বিভাগ নয়, বরং এটি দাওয়াতের নেতিবাচক দিকেরই একটি প্রচেষ্টা;

এক্ষেত্রে কুরআনে কারীমে بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ এর শর্ত লাগিয়ে একথা বলে দিয়েছেন যে, দাওয়াত কোমলতার সাথে কল্যাণকামীতা ও সহমর্মিতার আগ্রহ নিয়ে হওয়া উচিৎ। সেই সাথে শ্রোতার অবস্থা অনুযায়ী স্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে হওয়া উচিৎ। শ্রোতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে পরিপূর্ণ বেঁচে থাকতে হবে। 

এরপর দাওয়াত ‘আহসান’(সর্বোত্তম) হওয়ার জন্য জরুরী হলো বিষয়টি বক্তার জন্য ক্ষতিকর না হওয়া। অর্থাৎ দাওয়াতের মধ্যে বদ-আখলাক তথা হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, পদমর্যাদার লোভ ইত্যাদির মিশ্রণ থাকতে পারবে না, যা বাতেনি কবিরা গুনাহ।

আর বর্তমানে খুব কম মানুষই আছে যারা বাহাস-মুনাযারার মধ্যে এ সমস্ত খারাবী থেকে বেঁচে থাকতে পারে। অধিকাংশই বেঁচে থাকতে পারে না।

ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহ বলেন:

“যেমনিভাবে মদ পান করা সমস্ত খারাবীর মূল – নিজের আত্মিক খারাবী এবং বহু শারীরিক খারাবীর জন্ম দেয়, তেমনিভাবে তর্ক বিতর্কের মধ্যে যদি উদ্দেশ্য থাকে অপর পক্ষের উপর বিজয়ী হওয়া, নিজের ইলমকে অন্যের সামনে প্রকাশ করা, তাহলে এটাও অন্তরের সমস্ত খারাবীর মূল। কারণ এর দ্বারা অন্তরে অনেক রোগ সৃষ্টি হয়। হিংসা, বিদ্বেষ অহঙ্কার, গিবত, অন্যের দোষ তালাশ করা, অন্যের দুঃখে খুশি হওয়া, অন্যে সুখে কষ্ট পাওয়া, সত্য গ্রহণে অহঙ্কার পোষণ ইত্যাদি গোনাহের সৃষ্টি হয়।

এছাড়াও এই জাতীয় রোগে আক্রান্ত লোকেরা অপরপক্ষের কথায় চিন্তা-ফিকির বাদ দিয়ে পাল্টা উত্তর দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয় – তাতে কুরআন হাদীসের যত তাবীলই করা লাগুক না কেন, তাই করে বসে।

এটা তো এমন ধ্বংসাত্মক বিষয় যাতে মর্যাদাবান আলেমরাও লিপ্ত হয়ে পড়ে, এরপর বিষয়টি যখন তাদের অনুসারীদের পর্যন্ত পৌঁছে তখন তা ঝগড়া-ফাসাদ ও মারামারির রুপ ধারণ করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন। 

আল্লাহ তা’আলা বলেন – 

ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ ﴿١٢٥

অর্থ: আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। [সুরা নাহল ১৬;১২৫]

ইমাম রাজি রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের অধীনে বলেন:

“এই আয়াতের উদ্দেশ্য হলো তোমরা শুধু এই তিন তরীকায় দাওয়াত দেয়ার জন্য আদিষ্ট। মানুষের হেদায়াত দেয়া তোমাদের কাজ নয়। আল্লাহই ভালো জানেন কে গোমরাহ, আর কে হেদায়াত গ্রহণকারী।

আমার মতে নফস বা অন্তর সত্তাগতভাবে বিভিন্ন ধরণের হয়। প্রথমত কিছু নফস বা অন্তর নূরে পরিপূর্ণ ও পাক পবিত্র, যা বস্তুর দিকে কম ধাবিত হয়, আর রুহানিয়াতের দিকে বেশি ধাবিত হয়।

আর কিছু অন্তর অন্ধকারে পরিপূর্ণ – যা বস্তুর প্রতি আগ্রহী বেশি, আর রুহানিয়াতের দিকে ধাবিত হয় কম। সুতরাং যার অন্তরাত্মা যেমন সে তার বিপরীতটা খুব কমই গ্রহণ করে।

এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলেন – তোমরা তিন তরীকায় দাওয়াত দাও। আর সব মানুষের হেদায়াতের পিছনে পরে থেক না। আল্লাহ পথভ্রষ্টদের গোমরাহী এবং পবিত্র অন্তরের পবিত্রতা সম্পর্কে ভালো জানেন।” 

শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ বলেন:

“আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকারের জন্য মানুষের সাথে মুহাব্বত সৃষ্টি কারী লোকের প্রয়োজন। এমন লোক যার মন বড় ও জবান পবিত্র।

কোন মুসলমানকে কোন খারাপ কাজ করতে দেখলে একথা বলবেনা যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ঘৃণা করি, কারণ তুমি এই এই খারাপ কাজ কর। আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করো না।

বরং তাকে এভাবে বল; আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি, কিন্তু তোমার অমুক কাজটা খারাপ, তা পরিত্যাগ করা উচিৎ।”

শহীদে উম্মাত শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছেন:

জিহাদি মিডিয়ায় এমন শব্দ, বাক্য ও কথা, বলা এবং লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে যা একজন মুসলমানের শানের খেলাফ। যে কোন মুসলমানের সাথেই ঘৃণা, গালিগালাজ, ভাষার ভুল ব্যবহার উচিৎ নয়।

মিডিয়ায় লেখা বা বলার সময় শরয়ী নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী। এ বিষয়টি দেখতে হবে যে, আমাদের এই কথা দ্বারা জিহাদের ফায়দা হবে? না ক্ষতি হবে?

আপনারা খুব ভালো করেই জানেন যে, মুজাহিদদের জন্য এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখা কত জরুরী। আমার খেয়াল হলো এখনই আমাদের সমস্ত মিডিয়াগুলোকে কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে।

কারণ এই মিডিয়াই উম্মত পর্যন্ত আমাদের আওয়াজ পৌঁছায় এবং উম্মতের সাথে আমাদের সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম। এই মিডিয়াই আমাদেরকে উম্মতের সামনে তুলে ধরে। এজন্য জরুরী হলো আমাদের মিডিয়া উম্মতের বুঝ অনুযায়ী হবে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশায় সহানুভূতি জানাবে।

তেমনিভাবে আরেকটি বিষয় মিডিয়ার ভাইদের জন্য জরুরী, তাদের প্রকাশনাগুলো যেন সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে হয়। উম্মাহকে অন্ধকারের গভীরতা থেকে বের করে নিয়ে আসার ফিকির তাদের মধ্যে থাকতে হবে।”

মুজাহিদ আলেমে দ্বীন শায়েখ আতিয়াতুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন:

“মুজাহিদ নেতাদের জন্য জরুরী হলো নিজেরা এই গুণ অর্জন করবে, এবং নিজ সাথীদেরকে এমন তরবিয়ত করবে যে, তারা যেন মানুষের উপর দয়াকারী ও সহজকারী হয়। তাদের ভুল-ত্রুটি ও অন্যায় দেখে শাস্তি, হত্যা ও প্রতিশোধের হুমকি প্রদানকারী না হয়।

বরং কোমলতা ও নমনীয়তার সাথে ধীরে ধীরে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন জামাত পাঠাতেন বা কাউকে কোন দলের আমীর বানাতেন তখনই নসিহত করতেন: 

يسِّروا ولا تعسِّروا، وبشِّروا ولا تنفِّروا متفق عليه

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না এবং (লোকদেরকে) সুসংবাদ দাও। তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।’’ [বুখারি ৬৯, ৬১২৫, মুসলিম ১৭৩৪, আহমদ ১১৯২৪, ১২৭৬৩] 

আমরা কি কখনও এটা নিয়ে চিন্তা করেছি? এর উপর আমল করেছি?”

আল্লাহ এ সমস্ত উলামায়ে কেরাম ও জিহাদের নেতাদেরকে সমস্ত উম্মতের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রতিদান দান করুন। এবং আমরা যেন সুন্নত অনুযায়ী দাওয়াতের কাজ করতে পারি সে তাওফিক দান করুন। আমীন।

প্রিয় ভাইয়েরা আমার!

আমরা মুজাহিদগণ দ্বীন ও জিহাদের দা’য়ী। জিহাদও আমাদের ময়দান, একই সাথে দাওয়াতও আমাদের ময়দান। যে সমস্ত শক্তিধর ব্যক্তিরা অস্ত্র দিয়ে আমাদের উপর কুফুরী শাসণব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আছি, এবং মুসলিম জাতিকে আমাদের সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার প্রতি আহবানও জানাচ্ছি।

জিহাদের ময়দানের চাহিদা ভিন্ন, আর দাওয়াতের নিয়মনীতিও ভিন্ন। রাসূল সাল্লাল্লা্হু আলাইহি ওয়াসল্লাম জিহাদের ময়দানে কঠোরতা করেছেন, রক্ত প্রবাহিত করেছেন, হত্যা করা ও নিহত হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লা্হু আলাইহি ওয়াসল্লামের সিরাত সাক্ষী যে, দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর তরীকায় কোনো কঠোরতা নেই বরং কোমলতা। কারণ হলো দাওয়াত ও জিহাদ উভয়টির মাধ্যম, পদ্ধতি ও টার্গেট ভিন্ন ভিন্ন। জিহাদের মধ্যে শক্তিকে শক্তির মাধ্যমে দমন করতে হয়। অস্ত্র বহন করা, রক্ত প্রবাহিত করা, শরীরের অঙ্গ উড়িয়ে দেয়া টার্গেট হয়।

এজন্য জিহাদে অত্যন্ত কঠোরতা দরকার। জিহাদ তো এই কঠোরতারই নাম, এটা ব্যতিত জিহাদ জিহাদই থাকে না। আর এখানে কঠোরতার মধ্যেই সাওয়াব। এটা ভিন্ন কথা যে, শরীয়ত এক্ষেত্রেও সীমারেখা ও আদাবের উল্লেখ করেছে। কিন্তু এটি কঠোরতারই ময়দান। এখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য কঠিন শব্দ, কঠোর আচরণ জরুরী।

কিন্তু এই কঠোরতা যদি দাওয়াতের ক্ষেত্রে চলে আসে, এখানেও যদি কথা ও ভাব এমন গ্রহণ করা হয় যে, যাতে শ্রোতার মন-মস্তিষ্ক উদ্বুদ্ধ না হয়ে, বরং হিংসা, শত্রুতা, প্রতিশোধের প্রতি ধাবিত হয়, তাহলে এর দ্বারা দাওয়াতের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায়। জিহাদি আন্দোলনের দুর্ভাগ্যই হবে যদি জিহাদের পদ্ধতি দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ শুরু হয়। 

একদিকে জিহাদ অন্তরের রাগ-গোস্বা দমনের জায়গা। সেখানে আক্রমণ করে জালিম অহংকারীদের মস্তিষ্ক চূর্ণ করা হয়। আর তাদের বস্তুগত শক্তি খতম করে তাদের যুদ্ধ করার শখ মিটিয়ে দেয়া হয়।

অন্যদিকে দাওয়াতের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে রাগ ও গোস্বা প্রকাশ না করে বরং দমন করা হয়। শ্রোতাকে নিচু করা অপমান করা মূল উদ্দেশ্য না। তাকে আগ্রহী করা, নিকটবর্তী করা, তার মনে জায়গা করা হল উদ্দেশ্য।

দলিলভিত্তিক আলোচনা, ধৈর্য, সহনশীলতা, ক্ষমা, কোমলতা, এহসান ও দয়াই হলো দাওয়াতের ময়দানের চাহিদা। দাওয়াতের ময়দানে জরুরী হলো নিজে যথাযথ আমল করবে। কিন্তু শ্রোতাকে হক বুঝানো, হক বুঝের যোগ্য হওয়া ও গ্রহণীয় হওয়ার জন্য (শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে) যথেষ্ট চেষ্টা করবে।

এই কারণে দাওয়াতের মধ্যে সুন্দর সুন্দর কথা, সুন্দর তরীকার প্রতি লক্ষ রাখা হয়। শ্রোতা যদি শত্রুতা ও বিরোধিতার প্রকাশ করে তাহলে দাঈ শত্রুতা করবে না, বরং সে (সর্বোত্তমভাবে মুনাযারা) এর উপর আমল করবে। 

ঝগড়া- ফাসাদের জায়গায়ও তাকে এই আয়াত রাস্তা দেখায়। ভালো খারাপ এক হতে পারে না। আপনি শক্ত কথার জবাব এমনভাবে দিবেন যা খুব ভালো।

এমন করার দ্বারা দেখবেন যে, যার সাথে শত্রুতা ছিলো সে কেমন যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে। আর ধৈর্যশীলরাই এটা অর্জন করতে পারে, ভাগ্যবানদেরই এটি অর্জিত হয়। সুতরাং প্রচণ্ড বাকবিতন্ডার মধ্যেও দাঈর দৃষ্টি দলিল থেকে সরে না। এই অবস্থায়ও সে সুন্দর কথা সুন্দর ব্যবহার করে, খারাপ আচরণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে।

এমনিতেই যখন খারাপ আচরণের জবাব ভালো আচরণ দ্বারা দেয়া হয়, বাড়াবাড়ির জবাব ক্ষমা, ইনসাফ ও দয়া দ্বারা দেয়া হয়, তখন শ্রোতার পাথরের মত শক্ত অন্তরও মোমের মত গলে যায়। শত্রুতার আগুন ঠান্ডা হয়ে যায়। এভাবেই দাঈর জানের দুশমনও তার রক্ষক হয়ে যায়।  

দাওয়াতের মানহাজ ও পদ্ধতি

 দাঈর সফলতা অর্জনে তিনটি বিষয় ঠিক রাখা জরুরী। 

১) ওই দৃষ্টিভঙ্গি বা আকীদা-বিশ্বাস যার দিকে সে দাওয়াত দিচ্ছে। 

২) দাঈর কথা ও কাজ তার দাওয়াত অনুযায়ী থাকা।

৩) দাওয়াতের পদ্ধতির মধ্যে সে কোন আখলাকের সাথে দাওয়াত দিচ্ছে। 

এমনিতেও এই তিনটি বিষয় পরস্পর একটি আরেকটির সাথে মিল আছে। 

কারণ দৃষ্টিভঙ্গি যা হবে, ফিকির ও আমলের তরীকায়ও তারই প্রভাব পড়বে, তারই ঘ্রাণ দাওয়াতের মধ্যেও পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছু জায়গায় এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। যেমন ফিকির ও প্রভাব ভালো কিন্তু দাওয়াতের মধ্যে কঠোরতা থাকে।

সুতরাং দাঈর ফরজ তখনই আদায় হবে, যখন এই তিনটি বিষয় বাড়বাড়ি ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত হবে। এমন যদি হয় তাহলে দাঈ আল্লাহর কাছে কামিয়াব হবে, আল্লাহ যদি চান তাহলে তার দাওয়াত কার্যকর হয়ে শ্রোতাদের অন্তরে প্রবেশ করবে।

এর বিপরীতে দাঈ যদি এমন তরীকা অবলম্বন করে, যা তার দাওয়াতের সাথে মিলে না – তাহলে সে নিজের ধারণায় যদিও হকের দাওয়াত দিচ্ছে, কিন্তু তরীকা সুন্নত অনুযায়ী না হওয়ার কারণে, তার শক্ত ব্যবহারের কারণে খুব কম মানুষই ফায়দা পাবে।

এই ধরণের দাওয়াত মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ হয়। কোন দাওয়াত ব্যর্থ হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট যে, দাওয়াত প্রদানকারী নিজেই দাওয়াতের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাড়ায়। 

আল্লাহ তা’আলা বলেন – 

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ ﴿١﴾ قُمْ فَأَنذِرْ ﴿٢﴾ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ ﴿٣﴾ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ﴿٤﴾ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ ﴿٥﴾ وَلَا تَمْنُن تَسْتَكْثِرُ ﴿٦﴾ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ ﴿٧

অর্থ: হে চাদরাবৃত! (1) উঠুন, সতর্ক করুন, (2) আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন, (3) আপন পোশাক পবিত্র করুন (4) এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন। (5) অধিক প্রতিদানের আশায় অন্যকে কিছু দিবেন না। (6) এবং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে সবর করুন। (7) [সুরা মুদ্দাসসির ৭৪;১-৭]

মুমিনের জন্য নিজের কথাবার্তার সংশোধন খুব জরুরী। কারণ কথাবার্তার সংশোধনের মাধ্যমেই অন্তর ও আমলের সংশোধন হয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলা নিজের বান্দাদেরকে খুব সুন্দর ভাষায় কথা বলার আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوًّا مُّبِينًا ﴿٥٣

অর্থ: আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধায়। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।  [সুরা আল-ইসরা ১৭;৫৩] 

আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে কথা বলার ক্ষেত্রে ইনসাফ ও ভদ্রতা বজায় রাখতে বলেছেন, কথায় যাতে জুলুম না থাকে।

আল্লাহ মুমিনদেরকে আদেশ করেছেন –

وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُواْ

অর্থ: যখন তোমরা কথা বল তখন ইনসাফের সাথে বল। [সুরা আন-আনআম ৬;১৫২] 

তাই আমরা যখন কথা বলবো তখন ইনসাফের সাথে বলবো। এই দ্বীনের দাঈর গুণ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে যে, সে এই ঘোষণা দেয়; কেউ এই দ্বীনের চাহিদা পূরণ করুক বা না করুক আমিই সবার পূর্বে পূরণ করবো। 

আল্লাহ তা’আলা বলেন:

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

 অর্থ: আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতি পালক আল্লাহরই জন্যে।তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।

[সুরা আন-আনআম ৬;১৬২]

সুতরাং দাঈ সর্বদা চেষ্টা করবে নিজের ফিকির ও মানহাজও যেন সুন্নত অনুযায়ী হয়। কর্ম ও দাওয়াতের পদ্ধতিও যেন সুন্নত অনুযায়ী হয়।

যেই হকের দাওয়াত দিচ্ছে তার কাজের মধ্যে তার নমুনা যেন পাওয়া যায়। আর তার দাওয়াতের মধ্যেও যেন সর্বদা তার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ফিকির ও আমলের মানহায এবং কর্ম ও দাওয়াতের পদ্ধতি যদি হক ও এক হয় তখন দাওয়াতে সফলতা আসবে ইনশা আল্লাহ। 

জিহাদের দাঈ কখন নিরাপদ থাকে

জিহাদের দাঈ যেই বিপদ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকে, খুব কম মানুষই এমন বিপদের মধ্যে থাকে। মাধ্যম, অস্ত্র, সংখ্যা সবদিক থেকেই নিজের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়।

অনেকসময় যাদেরকে শত্রুর মোকাবেলায় নিজের সাথে রাখতে চায় তারাই বিরোধিতা শুরু করে, তখন খুব ধৈর্য ও হেকমতের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া জিহাদের সফরে পদে পদে এমনসব বিষয় উপস্থিত হয়, যেখানে সামান্য ভুলও বড় ধরণের বিপদের কারণ হয়ে দাড়ায়।

অনেকসময় জযবা হুশের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। এধরনের পরিস্থিতিতে আল্লাহর দয়া না থাকলে দাঈ ও মুজাহিদ সঠিক রাস্তা থেকে সরে যেতে পারে, এবং নিজেই জিহাদের দাওয়াতের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।

এই ক্ষতি থেকে দাঈ তখন বাঁচতে পারে যখন তার ফিকির ও মানহাজ সুন্নত অনুযায়ী হবে। তার কাজ-কর্ম ও দাওয়াত রাসূল সাল্লা্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহিনের মত হবে।

আর এটা তো তখন হবে যখন সে সুন্নতের অনুসরণের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে, এবং এই ভয় করবে যে, আল্লাহ না করুন আমার কোন ত্রুটির কারণে আমার থেকে হেদায়াত ছিনিয়ে না নেয়া হয়। 

এই নেয়ামতকে সিনার সাথে লাগানোর মাধ্যম হলো উলামায়ে কেরামের অনুসরণ ও নেককারদের সোহবত।

দ্বীনের দা’ঈর ফিকির ও মানহাজ তখনই হেফাজতে থাকবে যখন এমন উলমায়ে কেরাম থেকে নিজের দ্বীনকে গ্রহণ করবে যাদের তাকওয়া-আখলাক, ইলম-ইনসাফ, ফিকহ-বুঝ, অভিজ্ঞতা ও সুস্থ রুচিসম্পন্ন হওয়া অন্যান্য উলমায়ে কেরামের নিকট স্বীকৃত। তারা স্বজনপ্রীতি, প্রতিশোধ, রাগ বা নফসের চাহিদা অনুযায়ী ফতোয়া দেবে না, বরং কথা ও কাজে আল্লাহর ভয় প্রকাশ পাবে। তারা শরয়ী নীতিমালার উপর পারদর্শী হবে। আর এইসব গুণ ওই সকল আলেমদের মাঝেই পাওয়া যাবে, যারা জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের ইজতেহাদ অনুযায়ী ফতোয়া দেয় না।

বরং এক্ষেত্রে নিজের থেকে ভালো অগ্রগামী আলেমদের অনুসরণ করে এবং সমসাময়িক আলেমদের সাথে পরামর্শ করে। 

এমন উলামায়ে কেরাম আজও বিদ্যমান আছে। যদি জিহাদের দাঈ নিজের ফিকির, কাজ-কর্ম ও দাওয়াতের পদ্ধতিতে এই উলামায়ে কেরামের অনুসরণ করে তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাকে গোমরাহ করবেন না। এবং সে দ্বীন ও জিহাদের খেদমতও করতে পারবে।

এখানে একথাটিও বলে দিই – ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের বিগত তিন দশকের সফলতা ও জিহাদী অভিজ্ঞতা হোক, অথবা খোরাসান থেকে ইয়েমেন, মালি বা শাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক জিহাদী অভিজ্ঞতা হোক, এই সকল অভিজ্ঞতা উম্মতকে খুব দামি একটি সবক দিয়েছে। সেটি হচ্ছে হক উলামায়ে কেরামের অনুসরণেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।

উম্মতের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে – এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জিহাদি বিষয় সম্ভবত একটিও এমন নেই, যে বিষয়ে জিহাদি নেতারা বিচক্ষণতার সাথে সমাধান দেননি।

সুতরাং আমরা যদি এই উলাময়ে কেরাম ও জিহাদের নেতাদের দরসগুলো থেকে সবক নিতে থাকি তাহলে এই সফর খুব ভালোভাবে হেফাযত থাকবে এবং বারবার ধাক্কা খাওয়া লাগবে না ইনশাআল্লাহ।

(Visited 3,797 times, 1 visits today)