দাওয়াতের ক্ষতিকর পদ্ধতি!

শায়খ উসামা মাহমুদ

এবিষয়ে আলোচনা করার আগ্রহ তৈরী হয়েছে ইন্টারনেটে জিহাদের প্রতি দাওয়াত বিষয়ক কিছু পেইজ দেখে। এসকল পেইজের পরিচালকগণ একদিকে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

কারণ তারা এই চতুর্মুখী ফেতনার সময়ে জিহাদের দিকে দাওয়াতের ঝান্ডা উঁচু করে বাতিলের বিরোধিতা করছে। এমনকি তারা এই বাতিল শাসনব্যবস্থা দূর করার উপায় একমাত্র (দাওয়াহ, ইদাদ ও) জিহাদকেই সাব্যস্ত করেছে। এদিক থেকে তাদের যত প্রশংসাই করা হোক না কেন তা কম হবে।

কারণ, বর্তমানে যেখানে ‘যামানার ফেরাউনদের’ অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার এবং তাদের মন জয় করার জন্য বড় বড় ব্যক্তিরাও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সেখানে এই ভাইয়েরা জালেমদের প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে, নিজেদের জান হাতে নিয়ে তাদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে।

সেই সাথে জিহাদের দাওয়াতের বিরোধিতাকারীদেরকে তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া খন্ডন দেখে তাদের ইখলাসেরও প্রমাণ পাওয়া যায়।

এই ভাইদের ইখলাসের সামনে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা ঝুঁকে যায়। কিন্তু তার পরিণতি দেখে অতি আফসোসের সাথে বলতে হয় – এই সম্মানিত ভাইদের কারো কারো দাওয়াতের পদ্ধতি ও খণ্ডনের তরিকা মোটেও সঠিক নয়।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কাফেরদের সাথে পর্যন্ত হেকমত, উত্তম নসিহত ও সর্বোত্তম পদ্ধতিতে আলোচনা-পর্যালোচনা ও মুনাযারা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফেরাউনের সাথে পর্যন্ত দাওয়াতের ক্ষেত্রে নরম ব্যবহারের তাকিদ করেছেন।

কিন্তু এসমস্ত পেইজে কি আম কি খাস, উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার লোকদের ব্যাপারেও অত্যন্ত কঠিন এবং বিদ্রূপাত্মক কথা লেখা হয়।

যেই সমস্ত মতবিরোধকারীদেরকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টার দরকার ছিলো, তাদেরকে এমনভাবে সম্বোধন করা হয় যাতে কোন ধরনের সহানুভূতি ও কল্যাণকামীতার ঘ্রাণও থাকে না।

যে কোন মুসলমানকেই নিন্দা করা, বিদ্রূপ করা, অভিশাপ দেয়া হারাম। কিন্তু দেখে মনে হয় যেন এটাই এক্ষেত্রে দাওয়াতের আসল পদ্ধতি। যে ব্যক্তি একশতে একশ আমার মত সমর্থন করবে সে আমার আপন, আর যে সামান্য একটু বিরোধিতা করবে সেই দুশমন!!! তার মুসলমান হওয়ার ব্যাপারেই সন্দেহ!

তাকফিরে মুআয়্যিন (তথা নির্দিষ্টভাবে কাউকে কাফের আখ্যায়িত করা) এর কাজ যা গভীর ইলমের অধিকারী, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞার অধিকারী আলেমদের কাজ, এখানে তা খুব হালকাভাবে দেখা হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের উপর খুব সহজেই কুফুরির ফতোয়া দিয়ে দেয়া হয়।

এখানে বিরোধিতাকারী দ্বীনদারদের প্রতি কল্যাণকামীতা নেই, কোন হারাম কাজে সতর্ক করেই ক্ষান্ত হওয়া নেই। আছে শুধু গালিগালাজ, নিন্দা, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার হুমকি এবং তাদেরকে সরাসরি ক্ষতি করার চেষ্টা।

তাদের ব্যাপারে এমন এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা মুখে আনাও অসম্ভব। নব্য মুরজিয়া, ধর্মীয় হিজড়া এমন আরও অশ্রাব্য কথাবার্তা!!

হে আল্লাহ! এ কেমন দাওয়াত!!? এরা কীভাবে মনে করে যে, তাদের দ্বারা ইসলামের কোন খেদমত হতে পারে! দাওয়াতের এ পদ্ধতি আইএস এর আত্মপ্রকাশের পূর্বেও অনেক জোরেশোরে চালু ছিলো।

যখন আইএস আত্মপ্রকাশ করল তখন জিহাদের পথে আহবানকারী এই সকল দা’য়ীগণ এই ফেতনায় জড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে এর প্রভাবে প্রভাবিত ব্যক্তিরাও এই ফেতনায় লিপ্ত হয়ে গেলো। খুব কম সংখ্যক লোকই প্রকাশ্যে এই খারেজীদের দলভুক্ত হওয়া থেকে মুক্ত ছিল।

বাস্তবতা হলো দাওয়াত ও জিহাদের সফরে কলব যখন ইনসাফ থেকে সরে যায় – তখন বিনয় অহংকারে, ভাষার শালীনতা অশালীনতায় রূপান্তরিত হয়।

এবং অন্তরের নম্রতা কাঠিন্যতার রুপ ধারণ করে। তারপর সে ব্যক্তি নিজেও গোমরাহীর পথে চলে এবং অন্যকেও গোমরাহীর পথ প্রদর্শন করে।

আমি অত্যান্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছি, এই ভাইরা বিষয়টি বুঝুক আর আর না বুঝুক, ইতিহাস সাক্ষী এই ধরণের দাওয়াতের দ্বারা জিহাদের খুব কমই ফায়দা হয়েছে।

কারণ এখানে দাওয়াত কম আর লোকদেরকে জিহাদ থেকে বিমুখ করা হয় বেশি। এ ধরণের দাওয়াত জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরকেও অনেক সময় পথভ্রষ্ট করে দেয়। এবং তাদেরকে সীমালঙ্ঘন ও তাকফিরের অন্ধকারে নিমজ্জিত করার মাধ্যম হয়।

আমি আবারও বলছি, উল্লেখিত ভাইদের ইখলাস নিয়ে কোন কথা বলছি ন। কিন্তু শুধুমাত্র ইখলাস মোটেও যথেষ্ট নয়। ইখলাসের সাথে সাথে আমাদের ফিকির ও আমল সুন্নত অনুযায়ী হওয়া উচিৎ।

আল্লাহর কাছে যেই ইখলাস গ্রহণযোগ্য তা হলো, আমরা হক্ক জেনে তার সামনে আমাদের মাথা ঝুঁকিয়ে দিব। আত্মসমালোচনা হবে আমাদের মূলভিত্তি। আমাদের কথা ও কাজ যেন শরীয়ত অনুযায়ী হয়, সেজন্য সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু এর বিপরীতে আমরা যদি ওইসমস্ত কাজকে সঠিক বলি, যাকে আমাদের অন্তর সঠিক বলে – তাহলে তা ওই ইখলাস নয় যা আল্লাহর নিকট নাজাতের মাধ্যম। বরং এটা হবে নফসের চাহিদা পূরণ – যা সমস্ত খারাবির মূল। নফসের অনুসরণ মানুষকে গোমরাহী ও অপবিত্রতার এমন গভীরে পৌঁছে দেয়, যার পরিণতি দুনিয়াতে পশুত্ব এবং আখেরাতে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুন।

আল্লাহ আমাদেরকে নফসের চাহিদা অনুযায়ী চলা থেকে হেফাযত করুন। দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে শরীয়তের অনুগামী করে রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সুতরাং জিহাদের পথে আহবানকারী দা’য়ীগণের জন্য জরুরী হল, আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দাওয়াতের পদ্ধতি বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহর মনোনীত পদ্ধতিতেই জিহাদের খেদমত হতে হবে। অতএব দাওয়াতের ওই পদ্ধতি থেকে বেঁচে থাকতে হবে যা দাওয়াতের কোন পদ্ধতিই নয়, এবং যার দ্বারা জিহাদের খেদমতের চাইতে ক্ষতিই বেশি হয় ।

(Visited 1,610 times, 1 visits today)