শায়খ হারিস আন-নাজ্জারি
ডাউনলোড
যাকে আল্লাহ তা’আলা এই দ্বীনের কোন বিষয়ের দায়িত্বশীল বানান অথবা মুসলমানদের কোন কাজের যিম্মাদারি দেন তার কথা শোনা ও মানা একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী হয়।
তাই আমিরের আনুগত্যকে ইবাদত বলে নামকরণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবো।
আমিরের কথা শোন ও মানা ইবাদত হওয়ার ব্যাপারে অনেক আয়াত ও হাদীস রয়েছে। তার সাথে রয়েছে ইজমাও। ইজমা বর্ণনা করেছেন ইমাম নববী রহ: ও অন্যান্য ইমামগণ, এই বিষয়ে যে,
যাকে আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন তার কথা শোনা ও মানা ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ: ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণনা করেন। তিনি রাসূল সা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা: বলেন:
“মুসলিম ব্যক্তির উপর, সে যা পছন্দ করে ও যা অপছন্দ করে উভয় বিষয়ে শোনা ও মানা আবশ্যক, যতক্ষণ না তাকে গুনাহের আদেশ করা হয়। যখন গুনাহের আদেশ করা হবে তখন আর শোনা ও মানা আবশ্যক নয়।”
এই হাদিসটি থেকে এবং এছাড়াও আরো হাদিস থেকে শোনা ও মানার বিষয়ে কতগুলো মূলনীতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমিরের আনুগত্যের ব্যাপারে কিছু মূলনীতি রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল: আনুগত্য হবে ন্যায়সঙ্গত বিষয়ে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, সহীহ বুখারীর মধ্যে এসেছে, আলি ইবনে আবি তালিব রা: থেকে বর্ণিত: “নিশ্চয়ই আনুগত্য হয় কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।”
এটা হল প্রথম মূলনীতি। অর্থাৎ আনুগত্য হবে ন্যায়সঙ্গত কাজে, গুনাহের মধ্যে নয়। স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য বৈধ নয়।
এটি একটি সূত্র, এটি হাদিস নয়। এই কথাটি একটি সূত্র বা মূলনীতি। হাদীস হল: আনুগত্য কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে। এটি হল প্রথম মূলনীতি।
দ্বিতীয় মূলনীতি হল: আদেশ আদিষ্ট ব্যক্তির সক্ষমতার সীমার মধ্যে কার্যকর হবে। তাই যে বিষয়ে আপনার সাধ্য নেই তা আপনার দায়িত্ব নয়।
এটা আল্লাহ তা’আলার কিতাবের সাধারণ দলীলগুলো থেকেই প্রমাণিত হয়। আল্লাহ সুবাহনাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আল্লাহ তা’আলা কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব চাপান না।”
যখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেই তার বান্দাদের উপর কেবল এমন দায়িত্ব অর্পন করা হয়, যা তাদের করার সাধ্য আছে, তখন মানুষের পরস্পরের ব্যাপারগুলোও এই ভিত্তিতেই হতে হবে। অর্থাৎ অসম্ভব বিষয় বা যে বিষয় আপনি করতে সক্ষম নন, এমন বিষয়ে আনুগত্য আবশ্যক নয়।
শোনা ও মানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর মধ্যে একটি, এর ব্যাপারে অবশ্যই সজাগ হতে হবে।
ইজতিহাদী বিষয়সমূহে আমিরের আনুগত্য করা হবে। উক্ত আদেশটি শরয়ী আদেশ হওয়া শর্ত নয়।
যেমন: সে কোন শরয়ী ওয়াজিবের ব্যাপারে আদেশ করল না, বরং কোন মুস্তাহাব বিষয়ে আদেশ করল অথবা মুবাহ বিষয়ে আদেশ করল, তাহলে এক্ষেত্রে কি তার আনুগত্য করা হওয়াজিব হবে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ এক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব হবে।
অথবা কোন ইজতিহাদী বিষয়ে মামুরের ইজাতিহদ আমিরের ইজতিহাদের বিপরীত হল, মামুর মনে করল, বিষয়টি মুস্তাহাব নয়, আর আমির মনে করল, বিষয়টি মুস্তাহাব, সেক্ষেত্রে মামুর স্বীয় ইজতিহাদ পরিত্যাগ করবে এবং আমিরের কথাই শুনবে ও মানবে।
তাই মামুরের উপর শোনা ও মানা আবশ্যক ইজতিহাদী বিষয়ে, যে বিষয়ে কোন স্পষ্ট বর্ণনা প্রমাণিত নেই।
পক্ষান্তরে যে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, তার ব্যাপারে এই মূলনীতি প্রযোজ্য হবে: ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য চলে না।’
এছাড়া এ অর্থের অন্যান্য হাদিসগুলো প্রযোজ্য হবে।
আমিরের আনুগত্যের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পাবে সে সময়, যখন একজন ব্যক্তি একটি বিষয় অপছন্দ করে, সে একটি বিষয়কে ভালবাসে না, তা তার নিকট অপছন্দনীয়। এজন্যই আনুগত্য পছন্দে ও অপছন্দে।
যেমন সহীহ মুসলিমে এসেছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন:
“তোমার উপর আনুগত্য করা আবশ্যক তোমার বিপদে ও সুখে, পছন্দে ও অপছন্দে এবং তোমার উপর কাউকে প্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও।”
পছন্দের সময় আনুগত্য করা সহজ। কিন্তু অপছন্দের সময়, যখন কোন বিষয়কে সে ভালবাসে না, তার প্রতি তার আগ্রহ ও আসক্তি নেই, সে সময় ফুটে উঠে প্রকৃত আনুগত্য এবং আমিরের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর স্পষ্ট ইবাদত।
যেখানে নিজের কোন আসক্তি নেই, নেই নিজের কোন আগ্রহ। বরং মন তাকে কঠিন মনে করে।
ইমাম নববী রহ: শরহে সহীহ মুসলিমে বলেন:
“হাদীসের অর্থের ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বলেন, এর অর্থ হল, দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করা ওয়াজিব যে বিষয় কঠিন মনে হয় এবং যেটাকে অন্তর অপছন্দ করে বা এধরণের বিষয়ে, যেটা গোনাহের অন্তর্ভূক্ত নয়। যদি গোনাহের আদেশ হয় তাহলে তা শোনা বা মানা আবশ্যক নয়।”
শোনা ও মানা অর্থাৎ আনুগত্য করার ফলাফল ও বিধানাবলী সুপ্রসিদ্ধ। এখানে শুধু আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় স্মরণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়টি সবার জানা যে, আমিরের অবাধ্যতা সৈন্যবাহিনীর পরাজয় বরণ ও যুুুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ। এই শিক্ষা পেয়েছে মুসলমানগণ উহুদ যুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ সা: একটি আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা তা লঙ্ঘন করেছিলেন।
যারা আদেশের বিপরীত করেছিলেন তারা ছিলেন কম। পুরো সৈন্যবাহিনী এমনটি করেনি। যারা বিপরীত করেছিলেন তারা ছিল সকলের মধ্যে অল্প সংখ্যক, কিন্তু তা সত্ত্বেও সকলের উপর শাস্তি এসেছিল, কয়েকজনের ভিন্নতা করার কারণে।
আল্লামা ইবনে হাজার রহ: ফাতহুল বারীতে গাযওয়ায়ে উহুদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
এর থেকে অনেক শিক্ষা পাওয়া যায় । তার মধ্যে একটি হল নিষিদ্ধ বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি। বুঝা গেল, এর ক্ষতি যারা এতে লিপ্ত হয়নি তাদেরকেও শামিল করে। ভিন্নতা পাওয়া গেছে সাহাবায়ে কেরামের অল্প সংখ্যক থেকে। কিন্তু শাস্তি সবার উপর এসেছে।
যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “এবং ভয় কর এমন শাস্তির, যা কেবল তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
তাহলে শাস্তি শুধু জালিমদের নিকটই আসবে না, বরং তাদের নিকটও আসবে, অন্যদের নিকটও আসবে।”
এ হল ইবনে হাজার রহ: এর কথা।
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আল আদহাম বলেন:
তাই সাবধান! সাবধান হে আল্লাহর রাস্তার পথিক! তুমি যেন মুহাম্মদ সা: এর উম্মতের জন্য বা যে দলের সাথে মিলে তুমি যুদ্ধ করছো তাদের জন্য অশুভ পরিণতির কারণ না হও। কারণ ইমামের বা আমিরের অবাধ্যতা সর্ব প্রকার অনিষ্ট নিয়ে আসে। তাই আনুগত্যই কাম্য, অবাধ্যতা বা বিরোধিতা কাম্য নয়।
আনুগত্যের উপর অতিরিক্ত আরেকটি বিষয় হল আমিরকে সম্মান করা, তাকে মর্যাদা দেওয়া ও তার কদর করা। এটিও একটি শরীয়তসম্মত বিষয়।
আবু মুসা আসআরী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন:
“আল্লাহ তা’আলাকে সম্মান করার মধ্যে একটি হল, মুসলমান বয়োবৃদ্ধ লোককে এবং কুরআনের এমন বাহককে সম্মান করা, যে তাতে সীমলঙ্ঘন করেনি ও তার নাফরমানিও করেনি এবং ইনসাফগার শাসককে সম্মান করা।”
ইনসাফগার শাসককে সম্মান করা, অর্থাৎ তাকওয়াবান মুমিন শাসককে সম্মান করা।
উস্তাদ আব্দুল্লাহ আলআদহাম ঐ সমস্ত বিষয়ের একটি তালিকা উল্লেখ করেছেন,
“যেগুলোর মাধ্যমে আমিরের সম্মান করা হয়। মোটামোটি নয়টি উপায় উল্লেখ করেছেন: আমিরের বা শাসকের সম্মান করা হয়-
প্রথমত: তার জন্য দুআ করার মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ত: এমনভাবে তার সামনে বেড়ে না যাওয়া, যেটা সে অপছন্দ করে, বিশেষত: জনসমাবেশের মাঝে।
তৃতীয়ত: তার সাথে কথা বলার মাঝে আওয়ায উচু না করা।
চতূর্থত: তার সহযোগীতা করা, আল্লাহ তা’আলা তার উপর যে যিম্মাদারি দিয়েছেন তার মধ্যে।
পঞ্চমত: গোনাহ ব্যতীত অন্যান্য কাজে তার আনুগত্য করা।
ষষ্টত: উদাসিনতার সময় তাকে সজাগ করে দেওয়া ও তার স্খলন ও বিচ্যুতিগুলো গোপন করা।
সপ্তমত: তার ব্যাপারে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, যে সকল লোক তার ব্যাপারে অনিহ তাদের অন্তর তার দিকে ফিরানোর চেষ্টা করা।
অষ্টমত: তাকে জুলুম থেকে বাঁধা দেওয়া এমন পন্থায়, যেটা সর্বোত্তম।
নবমত: তাকে হিতোপদেশ দেওয়া গোপনে।
শায়খ আতিয়্যাতুল্লাহ এই শেষোক্ত প্রকারটি তথা ‘আমিরকে হিতোপদেশ দেওয়া গোপনে’ এর সাথে সংযুক্ত করে বলেন:
তবে এমন কোন কারণ থাকলে, যা সাধারণ অবস্থার বিপরীত দাবি করে, তখন তাকে প্রকাশ্যে উপদেশ দেওয়া ও তার কাজের প্রতিবাদ করা জায়েয আছে। যখন এটাই অবস্থার দাবি হয় এবং কল্যাণ এর মধ্যেই থাকে।
সাহাবা ও তাদের পরবর্তী সালাফগণ এমনটা করেছেন। একারণে আমরা বলি, শাসকবর্গকে হিতোপদেশ দেওয়া গোপনে, এটাই প্রকৃত নিয়ম। তবে অবস্থা বিবেচনায় প্রকাশ্যে ও সর্বসম্মুখেও জায়েয আছে।
আর আমিরকে তুচ্ছ ও অসম্মানিত করা হয় কয়েকটি পন্থায়। এখানে তিনি উল্লেখ করছেন, কোন্ কোন্ বিষয়গুলোর দ্বারা আমিরের সম্মান হয় এবং কোন কোন বিষয়গুলো দ্বারা আমিরের অসম্মান হয়। যাতে এগুলো করা যায়, আর ঐ গুলো বর্জন করা যায়।
সেগুলো হচ্ছে যেমন: অন্যদের নিকট তার নিন্দা করা, তার দোষ চর্চা করা, তার ভুলগুলো মানুষের মাঝে ছড়ানো, তাকে হালকা করা ও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা- যেগুলো খুবই মন্দ অভ্যাস, সে যা আদেশ করে তা না মানা, মানুষকে তার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ করে তোলা,
আল্লাহ তা’আলা তাকে যে মুসলমানদের যিম্মাদারি দিয়েছেন তাতে তাকে সহযোগীতা না করা, প্রকাশ্যে তার কাজের প্রতিবাদ করা এবং এধরণের অন্যান্য কাজগুলো করা, যা অত্যন্ত ঘৃণিত ও গর্হিত।
এ সমস্ত বিষয়গুলো শায়খ উল্লেখ করলেন, যার দ্বারা জানা গেল, কিভাবে আমিরকে সম্মান করা যায় এবং কিভাবে তাকে অসম্মান ও হালকা করা থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হল, শোনা ও মানার উপর অতিরিক্ত বিষয়।
তাই আমিরের কথা শোনা ও মানাই কাম্য। এটা ইবাদত, এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এবং তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করাও ইবাদত, যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব, যখন তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার সময় আমি আল্লাহর নিকট সাওয়াব ও পরকাল লাভের আশা রাখব।
ইনশাআল্লাহ মানুষ এর বিনিময় লাভ করবে, যখন তা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য ও রাসূলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ অনুসরণের জন্য হবে।
আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে তার ইবাদত করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের থেকে তার অবাধ্যতার বিষয়গুলোকে ফিরিয়ে রাখুন! আমীন!
ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।