আল-কায়েদা ও সমরবিদ্যা

শায়খ আবু উবাইদা আল কুরাইশী

আমরা সকলেই জানি, অতীতে চীনা সভ্যতার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল দীর্ঘকাল। মানবজাতির জাগতিক কল্যাণ ও ইহকালীন উন্নয়নে যেসব সভ্যতা বিরাট অবদান রেখেছে, চীনা সভ্যতা তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সে সকল অবদানের মধ্যে অন্যতম হল — সমর বিষয়ক গ্রন্থাবলী রচনা। যেমন প্রাচীন চৈনিক সমরবিদ সান জু রচিত “فن الحرب – ফান্নুল হারব” বা “দ্যা আর্ট অফ ওয়ার”, “سبع قضايا عسكرية كلاسيكية – সাব’উ ক্বাযাইয়া ‘আসকারিয়্যা ক্লাসেকিয়্যাহ্”, ” استراتيجيات غير التقليدية – ইসতিরাতিজিয়্যাত গাইর আত্ তাক্বলিদিয়্যাহ”।

এই সবগুলো গ্রন্থই  চৈনিক সমরবিদদের নিকট থেকে পাওয়া।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। যুগের আবর্তনে হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের আমূল পরিবর্তন। কিন্তু তা সত্ত্বেও চায়নার সমরবিদদের সুপ্রাচীন রচনাসম্ভারের কিছু কিছু আজও প্রাসঙ্গিক।

যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া মার্কিন সেনাবাহিনীর রীতি ছিলোনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের বিজয়, এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছিল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে  আমেরিকান সেনাবাহিনীর দর্প চূর্ণ হয়। তারপর নিজেদের হিসাব-নিকাশ নতুন করে কষতে শুরু করে দাম্ভিক মার্কিন বাহিনী। নতুন করে যুদ্ধের স্বতঃসিদ্ধ যাবতীয় রীতি-নীতি ও নিয়মাবলী শিখতে শুরু করে। মার্কিন সমর বিশ্লেষকেরা ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলীর অধ্যয়নে মনোযোগ দেয়। চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় আলোচনায় উঠে আসে চৈনিক সমরবিদ সান জু রচিত কালজয়ী গ্রন্থ – “দ্যা আর্ট অফ ওয়ার”।

ঐতিহাসিক এই গ্রন্থ গভীরভাবে মার্কিন বিশ্লেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এ গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে সমরবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি করে ওরা।

কিন্তু মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধে বিজয়ের পর মার্কিনীরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। অতীত যুদ্ধসমূহ থেকে শিক্ষালাভের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে তারা নারাজ। এর বদলে তারা যুদ্ধ জয়ের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রযুক্তিকে। তাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধজয়ের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কোন বিকল্প নেই।

এই হঠকারী মনোভাবের কারণে আমেরিকাকে হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো চড়া মূল্য দিতে হবে। কারণ আফগানিস্তানে মুসলিম জাতির ওপর তাদের আগ্রাসন শুরু হবার পর এটি সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, অতীত থেকে শিক্ষা লাভ এবং অভিজ্ঞতা অর্জনে আমাদের মুজাহিদ ভাইয়েরা তাদের শত্রুদের চাইতে অনেক এগিয়ে। এটি এমন এক বিষয়, যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এর পক্ষে অজস্র উদাহরণ আনা যায়। কিন্তু এখানে আমরা প্রাচীন চীনা সামরিক ঐতিহ্যের আলোকে মুজাহিদদের যুদ্ধকৌশলের ওপর সামান্য আলোকপাত করে ক্ষান্ত দিব।  এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে:

 ১. আমেরিকা প্রাচীন চীনা সমরবিদ্যার গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেছে। আর খুব সম্ভবত তারা বেশ ভালোভাবেই এগুলো আত্মস্থ করেছে।

২. উপরের গ্রন্থগুলো সব শ্রেণীর লোক পাঠ করে থাকে। কাজেই এগুলো দিয়ে উদাহরণ দেয়া হলে আমাদের মুজাহিদ ভাইদের কৌশলগত গোপনীয়তা ফাঁস হবার সম্ভাবনা নেই।

অতীত থেকে লব্ধ সামরিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার – ব্যাপক অনুশীলনের বিষয়টি বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে আফগানিস্তানের মাটিতে। মুজাহিদদের মাধ্যমে।  কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক: সান জু স্বীয় গ্রন্থ “দ্যা আর্ট অফ ওয়ার”-এ লিখেছিল:

“সর্বাধিক সফল যুদ্ধ হলো সেটি, যেখানে একটা সময় পর্যন্ত শত্রুকে সফল হবার সুযোগ করে দিয়ে হঠাৎ শত্রুর পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়া হয়।”

আমরা দেখতে পেয়েছি, মুজাহিদ ভাইয়েরা যথাযথভাবে এই কৌশলটির প্রয়োগ করেছেন। আমেরিকা নিজ কৌশল নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করা শুরু করতে না করতেই তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে বসেন মুজাহিদ ভাইয়েরা। মার্কিন বাহিনী ধরে নিয়েছিল, মুজাহিদরা শহরে অবস্থান করবে। এই সুযোগে বিমান হামলা করে তাদের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু মুজাহিদ ভাইয়েরা শহর ছেড়ে চলে যান। মার্কিনীদের পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

একইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, “ইসতিরাতিজিয়্যাত গাইর আত্ তাক্বলিদিয়্যাহ” বা “অপ্রচলিত কৌশল” গ্রন্থে বর্ণিত আরো একটি কৌশল নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন মুজাহিদরা। কৌশলটি হলো—

“যখন সংখ্যায় বড় এবং ব্যাপক প্রস্তুতি সমৃদ্ধ কোন বাহিনীর মুখোমুখি হবে, তখন কার্যকরী কোন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তা হতে পারে পাহাড়ে, পর্বতে কিংবা কোন দূর্গম গিরিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার মাধ্যমে।”

এই কৌশলটি বিমান এবং ট্যাঙ্কবিধ্বংসী অস্ত্র আবিস্কারের পরও পূর্বের ন্যায় সমান কার্যকর। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি আফগানিস্থানে। আমাদের ভাইয়েরা সফলভাবে এটি বাস্তবায়ন করে নিজেদের সৈন্যদল, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয়, দুর্গম পাহাড়ে পর্বতে ভাইদের এভাবে আশ্রয় গ্রহণের কৌশলটি আরো একটি সমর কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়। ঐতিহাসিক সমরবিদরা বলেছে—

প্রস্তুতি সম্পন্ন এবং মনোবল চাঙ্গা, শত্রুবাহিনী এমন হলে, শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান ত্যাগ করতে হবে। দুই বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আগে সময়ক্ষেপণের জন্য দীর্ঘক্ষণ আত্মগোপন করে থাকতে হবে। যেন এ সময়ের মধ্যে শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে যায়। এমনটি করা হলে বিজয়ের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে”।

মুজাহিদদের প্রথম ধাপে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া এবং দ্বিতীয় ধাপে পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আশ্রয় নেয়াতে আরো একটি উদ্দেশ্য হাসিল হয়। তা হলো, বাহিনীকে সম্মিলিত অবস্থায় না রেখে তা খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলতে আমেরিকাকে বাধ্য করা। এই কৌশলটির কথাও সান জু রচিত ‘দ্যা আর্ট অফ ওয়ার’ গ্রন্থে এসেছে। বলা হচ্ছে-

“অধিক জনবলের অধিকারী শত্রুকে বাধ্য করতে হবে, যাতে সে নিজ বাহিনী বিন্যাসে এমন পন্থা অবলম্বন করে, যা তার চাইতে তোমার বেশি অনুকূলে থাকে। পাশাপাশি শত্রুর প্রতিটি খণ্ডদলের মোকাবেলার জন্য তোমার নিজ বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে”।

এভাবে শত্রুপক্ষ যখন নিজ বাহিনীকে ভাগ করে ফেলবে, তখন তার সৈন্য সংখ্যা কমে যাবে। কার্যকারিতা হারাবে। তার অস্তিত্বের একেকটি বিন্দুর ওপর আলাদা-আলাদাভাবে আঘাত হানার সুযোগ তৈরি হবে। এটি শত্রুবাহিনীকে সমূলে নিঃশেষ করে দিতে সহায়তা করবে। আমরা আগেও বলেছি, ১৯৫৪ সালে Dien Bien Phu এর যুদ্ধে ভিয়েতনামী যোদ্ধারা এই কৌশলটি কাজে লাগিয়েছিল। আর এর ফলে সেসময় ফ্রান্স তার নিকট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় বরণ করেছিল। ১৯৬৪ সালে Nam Dong যুদ্ধে এই কৌশল খাটিয়ে ভিয়েতনামী যোদ্ধারা আমেরিকাকে বিরাট মাশুল গুনতে বাধ্য করেছিল। মুজাহিদদের দ্বারা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ২০০১ সালে তোরাবোরা যুদ্ধে।

দাম্ভিকতার কারণে আমেরিকানদের বড় রকমের ধোঁকা খাওয়ার একটি উদাহরণ হল কান্দাহারের খোলা ময়দানে ঘাঁটি স্থাপন করা।  আমেরিকানরা মুজাহিদদেরকে নির্বোধ ভেবেছিল। আর তাই কান্দাহার থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে বিস্তৃত খোলা ময়দানে নিজেদের সেনা ছাউনি স্থাপন করেছিল। এর মাধ্যমে মুজাহিদদের সামনে একটা টোপ ফেলেছিলো। আশা করে বসে ছিল, এতে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের তৃষ্ণায় কাতর মুজাহিদ বাহিনীকে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধে টেনে আনতে সক্ষম হবে তারা। আর যুদ্ধে তাদের বিজয়ের নিশ্চয়তা তো শতভাগ। কিন্তু তাদের আশায় গুড়ে বালি দিয়ে মুজাহিদ কমান্ডাররা ‘দ্যা আর্ট অব ওয়ার’ গ্রন্থের একটি কৌশল অবলম্বন করেন—

“সর্বাবস্থায় তুমি পাহাড়ের মত অটল থাকবে।”

‘দ্যা আর্ট অব ওয়ার’ গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে—

“তুমি শত্রুকে প্ররোচিত করো কিন্তু তার প্ররোচনার ফাঁদে পা দিও না।”

মুজাহিদ কমান্ডাররা শত্রুর প্ররোচণায় উত্তেজিত না হয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।  অনুকূল আবহাওয়া এবং ভৌগোলিক অবস্থান নিশ্চিত করার পর যুদ্ধে জড়ান।

যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই হতভম্ব হয়ে পড়ে আমেরিকানরা। মার্কিন বাহিনী মুজাহিদদের ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিল। আর এ বিষয়টি মুজাহিদদের সাফল্য বাড়িয়ে দেয়। মুজাহিদদের  ব্যাপারে তথ্য পাবার বিষয়টা নির্দিষ্ট এক পদ্ধতির মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আমেরিকা  বিরাট অংকের অর্থ খরচ করেও বিকল্প কোন উপায় খুঁজে বের করতে পারেনি। আর তাই আমেরিকা আজও মুজাহিদদের সঠিক সংখ্যা বের করতে পারেনি। নির্ভুলভাবে জানতে পারেনি মুজাহিদদের সামরিক ব্যবস্থাপনা, অবস্থানস্থল এবং অস্ত্রশস্ত্রের ধরণ সম্পর্কে।

বরং একধাপ এগিয়ে এ কথাও বলা যায়, আমেরিকা আফগানিস্তানে যে  মুজাহিদ-বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছে তার প্রকৃতি সম্পর্কে জানবার সুযোগ কখনোই পাবে না।

মুজাহিদরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা এমন এক বিশেষ দল, যারা শত্রুদেরকে (মার্কিন বাহিনী) তাদের মিত্রদের (আফগানের মার্কিনপন্থী সরকার) উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও হতবুদ্ধি করে দেবার সামর্থ্য রাখে।

এসকল দুঃসাহসী যোদ্ধারা বস্তুবাদী জীবনের হাতছানি ও অনুপ্রেরণা ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে প্রস্তুত। সদা প্রস্তুত জীবন উৎসর্গ করতে। এই যোদ্ধারা কষ্টকর জীবন-যাপনে আশ্চর্যরকমভাবে তুষ্ট থাকেন।

অপরদিকে পুরোপুরি বিপরীত চিত্র দেখা যায় মার্কিন বাহিনীতে। তারা মোটা অংকের বেতনের চাকরি করে। রসদ সামগ্রী এবং আরাম-আয়েশের উপকরণ বহনে তারা এমন বাড়তি চাপ স্বীকার করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক চলাফেরার সুযোগকে ব্যাহত করে।

এরপর আছে নিজেদের অলসতা, সর্বদাই হা-হুতাশ আর অভিযোগ করা। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ হল – খোদ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের একটা বিবৃতি।

বিবৃতি দিয়ে কর্মকর্তারা জানাচ্ছে- রয়েল ফোর্সের একটি পদাতিক ডিভিশনকে ফিল্ডে নামার মাত্র তিন মাসের মাথায় এয়ারফোর্সের ১০১ ব্রিগেড দ্বারা পরিবর্তন করা দরকার!

রয়েল ফোর্সকে  মার্কিন বাহিনীর গর্ব মনে করা হয়। এদের অবস্থায় যদি এমন হয় তাহলে এর নিম্নস্তরগুলোর অবস্থা কেমন হবে তা অনুমান করে নিতে কষ্ট হবার কথা না।

আমেরিকা, মুজাহিদদের সঙ্গে তাদের নেতৃবৃন্দের যোগাযোগের পরিধি সম্পর্কেও একেবারেই অন্ধকারে। মুজাহিদরা আল্লাহর প্রতি  দৃঢ় ঈমান রাখেন। তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে অগাধ আস্থা রাখেন।

পাশাপাশি নিজেদের নেতৃবৃন্দের সততার প্রতিও শতভাগ আস্থাশীল তাঁরা। তাঁদের নেতৃবৃন্দ প্রতিমুহূর্তে লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের সঙ্গে থাকেন। “التعليمات الست السريةগ্রন্থে ময়দানের লড়াইয়ের চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। লেখক সেখানে বলেছে:

“যদি তুমুল ও বিভীষিকাময় কোনো যুদ্ধে অফিসার এবং সৈন্যদেরকে নির্ভীকচিত্তে, বেপরোয়াভাবে মরণপণ লড়াই করতে দেখা যায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে, কমান্ডারদের উপর সৈনিকদের দৃঢ় আস্থার কারণেই এমনটি সম্ভব হয়েছে।”

এখানে যে আস্থার কথা লেখক বোঝাতে চেয়েছে, তা হলো নেতৃত্বের প্রতি আস্থা; লেখকের দৃষ্টিতে যা অর্জনের একমাত্র উপায় হল, সৈন্যদের সঙ্গে সামরিক অফিসারগণের সততা, পারস্পরিক হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ এবং অঙ্গীকার পূরণ করা। সান জু এটার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছে:

কমান্ডার তার সৈন্যের দিকে এমনভাবে তাকাবে, যেন পিতা পুত্রের দিকে তাকিয়েছে। এমন আচরণই পারে সৈন্যকে কমান্ডারের নির্দেশে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে।

এসব নিয়ম-নীতির আলোকে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ বিচার করা যাক – মার্কিন কমান্ডাররা রণাঙ্গন থেকে বহুদূরে নিরাপদ স্থানে বসে সেনা পরিচালনা করে থাকে। একারণে মার্কিন বাহিনীর নেতৃবৃন্দের প্রতি সৈন্যদের আস্থাহীনতা অনেক বেশি।

আর লড়াইয়ের ময়দানে পরাজয় বরণ করাসহ যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির কারণে সৈন্যদের প্রতি নেতৃবৃন্দ বীতশ্রদ্ধ। এ কারণেও অনেক সময় মার্কিন সেনা সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তারা দেখতে পায়, বৃথাই তাদের জীবন দিতে হচ্ছে। তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়, নেতৃবৃন্দের কাছে তাদের জীবনের কোনই মূল্য নেই।

এবারে আলোচনা করা যাক, মুজাহিদদের সংখ্যার ব্যাপারে আমেরিকার অজ্ঞতা সম্পর্কে। আসলে এটা এমন এক বাস্তবতা যা আমেরিকা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবেনা।

যুদ্ধের প্রথম দিকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমেরিকা প্রথমে দাবি করেছিল, কান্দাহারে মুজাহিদদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। কিন্তু এর অল্প সময় পর প্রায় ২ হাজার মুজাহিদ অন্যত্র চলে যান। সাতশো’র মত বন্দি হন।  কিন্তু আমেরিকা দাবী করেছিলো মুজাহিদদের সংখ্যা ২০ হাজার!

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ২০ হাজারের এই সংখ্যা সম্পূর্ণ অমূলক। একই চিত্র পুনরায় ফুটে ওঠে তোরাবোরা ঘটনায়। মার্কিন প্রশাসন সেসময় অবাস্তব এক সংখ্যা উল্লেখ করেছিল।

 এ কথা সকলেরই জানা যে, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সম্পর্কে অজ্ঞতা পরাজয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এ কারণেই সচেতন, বুদ্ধিমান বাহিনী নিজেদের সংখ্যা প্রকাশে আগ্রহী হয়না। “استراتيجيات غير تقليديةগ্রন্থে এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে লেখক লিউশী বলেছে:

“যখন শত্রু সংখ্যায় অনেক হবে এবং একাধিক ফ্রন্টের যুদ্ধ হবে, তখন যেকোনো মূল্যে শত্রুকে ধোঁকায় ফেলতে হবে, যাতে সে তোমার সেনাদের প্রকৃত সংখ্যা না জানে। এমনটি করা গেলে শত্রু কখনোই আগ বাড়িয়ে আক্রমণের দুঃসাহস দেখাবে না।”

মুজাহিদরা নিজেদের টার্গেট বেছে নিতে নিপুণতার সাথে এই কৌশলটির ব্যবহার করেছেন। উপরোক্ত কৌশলের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়ে তারা আরো এমন একটি কৌশলের অবতারণা করেছেন, যা দেখে আমাদের হতবাক হয়ে যেতে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই উক্তিরই প্রতিফলন:

যুদ্ধ হলো ধোঁকা।

এই শেষ কৌশলটির প্রয়োগ সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে বিগত সপ্তাহগুলোতে, যখন মুজাহিরা দূর্বলতার ভান করেছে, আর শত্রু এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে সামনে এগিয়ে ধ্বংসমুখে পতিত হয়েছে। সান জু কৌশলটিকে এভাবে উল্লেখ করেছে:

“শক্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্বলতা প্রকাশ করো”।

এই কৌশলের অংশ হিসেবে মুজাহিদ ভাইয়েরা খবর প্রচার করেছেন, ‘আমরা পাহাড়ে আশ্রয় নেবার জন্য শহর ছেড়ে যাবো না।’ শত্রু এটাকে সুযোগ মনে করেছে। তারা ধরে নিয়েছিল, মুজাহিদরা তোরাবোরা থেকে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর মুজাহিদদের চুপিসারে প্রস্তুতি-কার্যক্রম সত্ত্বেও এক মুহূর্তের জন্য সে অঞ্চলে তাদের কাজের ক্ষিপ্রতার কারণে খবর সত্য হওয়ার ব্যাপারে আমেরিকা আরো বেশী নিশ্চিত হয়ে যায়। সে নিশ্চয়তার উপর ভিত্তি করে যেই তারা অগ্রসর হয়, অমনি আবু হামজা গামেদীর ব্যাটালিয়নের হাতে তাদের ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। ব্যাটালিয়নটি চারটি মার্কিন বিমান ভূপাতিত করার পাশাপাশি পুরো আমেরিকান ব্যাটালিয়নকে শেষ করে দেয়।

এসমস্ত কৌশল কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই নয়, তদন্ত-অনুসন্ধান ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রয়োগের সমান সুযোগ রয়েছে। আমরা জোরালোভাবেই এ দাবি করতে পারি যে, আমাদের সর্বাধিনায়ক শাইখ উসামা বিন লাদেনের (রহিমাহুল্লাহ) সর্বশেষ অডিও ক্লিপটিও এ কৌশলেরই আওতাভুক্ত।

শাইখকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের উদ্দেশ্যে কথা বলতে হত। এদের মাঝে কেউ কেউ সরাসরি মুজাহিদদের কাতারের। শাইখ, তাঁদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন তাঁদেরকে কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ এবং উৎসাহ প্রদানের জন্য। আবার কেউ কেউ এমন রয়েছে, যারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। শাইখ, আমেরিকার বর্বরতা এবং নৃশংসতার ব্যাপারে তাদের দ্বিধা কাটানোর জন্য বিশেষভাবে তাদেরকে সম্বোধন করতেন। আরেক শ্রেণী হল তাঁর শত্রু (বর্তমানে আমেরিকা)। শাইখ তাদেরকে বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনায় নিজের কিছুটা দূর্বলতা দেখিয়ে সম্বোধন করতেন। যদিও তিনি চাইলে বিপরীতটাও করতে পারতেন। আমরা ‘দ্যা আর্ট অফ ওয়ার’ গ্রন্থে শাইখের এমন অবস্থানের ব্যাখ্যা খুঁজে পাই। লেখক সেখানে উল্লেখ করেন:

“যখন শত্রু বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অনেক হবে এবং যুদ্ধের ফলাফল অস্পষ্ট হবে, তখন শত্রুকে আত্মপ্রবঞ্চনায় ফেলে দেবার জন্য কিছুটা নমনীয়তা ও দুর্বলতা প্রকাশ করবে। কারণ তা শত্রুকে অমনোযোগিতা, বেপরোয়া ভাব এবং তড়িৎ সিদ্ধান্তের পথে নিয়ে যায়। আর এর ফলে শেষ পর্যন্ত শত্রু এমন ফাঁদে পা দেয়, যা সে কল্পনাও করতে পারেনি”।

এই ছিল আফগান রণাঙ্গনে সমরবিদ্যা এবং রণশিল্পের বাস্তব প্রয়োগের কিছু উদাহরণ। এখানে আমরা উল্লেখ করতে চাই, কেউ যদি সমর-নীতি সম্পর্কে জানতে চান উপরোল্লিখিত কয়েকটি গ্রন্থ দ্বারা কখনোই পরিতৃপ্ত হতে পারবেন না। কারণ সেগুলোতে খুব বেশি কিছু নেই।

তাছাড়া, প্রাচীন চীনা সামরিক ঐতিহাসিক সংকলনের প্রশংসা করা আমার এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের ভাইয়েরা যে দুই হাজার বছরের অধিককাল ধরে চর্চা হয়ে আসা নানা সমরকৌশল এবং অভিজ্ঞতা-সম্ভারের ওপর বিরাট দখল ও গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন এবং সেগুলো দ্বারা উপকৃত হয়েছেন, তা তুলে ধরাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই যখন বাস্তবতা, তখন আমরা আস্থা রাখতেই পারি যে, আমাদের ভাইয়েরা সবরকম আধুনিক যুদ্ধরীতি সম্পর্কে অধিক বিজ্ঞ। যেকোনো পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন “আল-কায়েদা” নামটি সমরবিদ্যায় একটি স্বীকৃত ‘কায়দা’ বা স্বতঃসিদ্ধ মূলনীতি হয়ে সামরিক অভিধানগুলোতে স্থান পাবে। আল্লাহর কাছে কামনা, তিনি যেন আমাদের ভাইদেরকে আরো বেশি দৃঢ়তা ও সাহায্য দান করেন! আমীন।

সুত্র- আল আনসার ম্যাগাজিন, ১ম সংখ্যা, ১লা যিলকা’দাহ ১৪২২ হিজরি, ১৫ জানুয়ারি ২০০২ ইংরেজি, পৃষ্ঠা-১০-১৫

**********************

(Visited 854 times, 1 visits today)