৯/১১ হামলার দশ দিক!

উস্তাদ ইয়াহিয়া আব্দুল হাফিজ

গতো বিশ বছরে এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে যা সত্যিকার অর্থে যুগান্তকারী। একটি ঘটনা এখনো চলমান – করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী।

অন্য ঘটনাটি হল ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় জর্জ বুশ ঘোষণা দেয় ‘ওয়ার অন টেরর’ বা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর।

পরবর্তী দুই দশক জুড়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এই যুদ্ধ। পালটে দেয় সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সামাজিক প্রেক্ষাপটের নানা সমীকরণ। আজ ৯/১১ হামলার ১০টি দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

১) ক্রিয়া নয় প্রতিক্রিয়াঃ-

ইতিহাস ৯/১১/২০০১ (নাইন-ইলেভেন পড়তে হবে) এ শুরু হয়নি। অনেকেই ৯/১১কে বিচ্ছিন্ন একটি হামলা মনে করেন। যেন ৯/১১ হামলার কারণে বাধ্য হয়ে আমেরিকা মুসলিম বিশ্বে আগ্রাসন চালিয়েছে। বাস্তবতা এর উল্টো।
পশ্চিমের সাথে মুসলিমদের বিশ্বের সংঘাত চলছে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী জুড়ে।

১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পায়তারা এবং ১৯২৪ সালে খিলাফতের পতনের শুরু হয় পশ্চিমের সাথে মুসলিমদের সংঘাতের এক নতুন অধ্যায়। ৯/১১ এই সংঘাতেরই একটি অংশ মাত্র।
ঔপনিবেশিক যুগে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো থেকে ইসলামী শাসন অপসারণ করে পশ্চিমা শক্তিগুলো। স্থাপন করে মানবরচিত আইনের ধর্মনিরপেক্ষ শাসন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শেষ হয় সামরিক দখলদারিত্বের যুগ। পশ্চিমা হানাদারের ফিরে যায়। কিন্তু যাবার আগে শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন দিয়ে যায় তাদের অনুগত লোকেদের হাতে। মুসলিম বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন অত্যাচারী ও নৃশংস সরকারকে সহায়তা দিয়ে যায় পশ্চিমা বিশ্ব। যাতে মুসলিমদের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা যায় এবং যেকোন মূল্যে ঠেকানো যায় ইসলামী শাসনের উত্থান।
সেই সাথে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব রকমের সহায়তা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলা হয় যায়নিস্ট রাজ্য ইস্রায়েল। যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য মাসজিদুল আকসা ভেঙ্গে তৃতীয় মন্দির নির্মান, এবং ফোরাত নদী থেকে নীলনদ পর্যন্ত ইস্রায়েল রাষ্ট্রের বিস্তৃতি।

নব্য দখলদারিত্বের এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমেরিকা। প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপে কারণে প্রাণ দিতে হয় লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে।
শুধু নব্বইয়ের দশকে ইরাকেই প্রায় ২০ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে আমেরিকা। যার মধ্যে ৫ লক্ষ ছিল মুসলিম শিশু। উল্লেখ্য শুধু মুসলিম বিশ্বে না, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর আরো অনেক অঞ্চলেও আমেরিকাকে দেখা গেছে এই ভূমিকায়।

আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন ইসলামী দল আমেরিকাকে চিহ্নিত করে ইস্রায়েল এবং মুসলিম বিশ্বের দালাল শাসকদের পেছনে মূল শক্তি এবং মুসলিম উম্মাহর প্রধান শত্রু হিসাবে। আর এই প্রেক্ষাপটেই চালানো হয় ২০০১ এর হামলা। ৯/১১ ক্রিয়া নয়, বরং পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া।

২) ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ-

৯/১১ এর পর আমেরিকা ঘোষনা দেয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের। আসলে এটি ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বহু বছর আগে থেকেই এ যুদ্ধ চালিয়ে আসছিলো আমেরিকা। কিন্তু ৯/১১ এর ফলে আমেরিকা বাধ্য হয় পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে নিজের আসল চেহারা প্রকাশ করতে।

মিথ্যা অভিযোগ আর বানোয়াট তথ্য সাজিয়ে ২০০৩-এ আমেরিকা হামলা করে ইরাকে। আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে আমেরিকার যুদ্ধবাজ চেহারা।
সন্ত্রাস দমনের নামে ইসলামের বিধিবিধানকে সন্ত্রাস নাম দেয় আমেরিকা তার মিত্ররা। বন্দী মুসলিম নারী ও পুরুষদের উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন।
আমেরিকার সত্যিকারের চেহারা দেখা যায় গুয়ান্তানামো বে, বাঘরাম আর আবু গ্রাইব কারাগারের আয়নায়। ৯/১১ প্রকাশ করে দেয় ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে চালানো মার্কিন লড়াইয়ের বাস্তবতা।

৩) আল কায়েদার ফাঁদঃ-

৯/১১ এর মাধ্যমে আমেরিকাকে দুটি ফাঁদে ফেলে আল-কায়েদা। প্রথমে আফগানিস্তানে এবং পরে ইরাকে ভয়ংকর ও দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধে আটকে ফেলা হয় আমেরিকাকে।
অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত করে আমেরিকা বাধ্য করে তার সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে। ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব জুড়ে নানা অঞ্চলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা।
একটু পরই আমরা দেখবো কিভাবে এই ফাঁদ আমেরিকাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে।

৪) বৈশ্বিক মন্দা:-
৯/১১ হামলা ও এর প্রতিক্রিয়া প্রভাব ফেলে মার্কিন অর্থনীতির ওপর। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য খরচ করা হয় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগসাজসে ওয়ালস্ট্রিট থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার হাতিয়ে নেয় রাঘব বোয়ালেরা। ফাঁপা হয়ে আসে মার্কিন অর্থনীতি।

ফলে ২০০৭-০৮ এ দেখা দেয় মন্দা, যা একসময় বৈশ্বিক মন্দায় পরিণত হয়। এ মন্দায় দুর্বল হয়ে উঠে মার্কিন অর্থনীতি, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমেরিকার মধ্যবিত্তরা। বাড়তে থাকে মার্কিন অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা।

৯/১১ হামলায় আল কায়েদার খরচ হয়েছিলো ৫ লক্ষ ডলারের মতো। অন্যদিকে অ্যামেরিকার ক্ষতি হয় ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি মার্কিন মধ্যবিত্ত শ্রেনী।

৫) এককেন্দ্রিক থেকে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা:-

যুদ্ধে ব্যস্ত আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিকভাবে পাল্লা দিতে শুরু করে চীন। মার্কিন ভোক্তা থেকে শুরু করে মার্কিন শিল্পগুলো নির্ভরশীল হয়ে উঠে চীনা কাঁচামাল ও কারখানাগুলোর ওপর। ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে চীন। নতুন করে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে শুরু করে রাশিয়াও।

গত ১০ বছরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করে আরো নানান আঞ্চলিক শক্তি এককেন্দ্রিক বিশ্ব থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন শুরু হয়- multipolar – বা বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোযোগ দিতে গিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থার ওপর একাধিপত্য হারায় আমেরিকা।

৬) মার্কিন সামরিক ও কূটনৈতিক নীতির পরিবর্তন:-

একসময় ইরাকে পরাজিত হয়ে সেনা প্রত্যাহার করে আমেরিকা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক – সব দিকেই ইরাক যুদ্ধ আমেরিকার জন্য মহা ব্যর্থতা প্রমাণ হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মুসলিম বিশ্বে পারতপক্ষে আর সরাসরি হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা।

ড্রোন এবং মিসাইল হামলা চালালেও, মুসলিম বিশ্বে সেনা মোতায়নে আর রাজি না আমেরিকা। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশেও এখন আর নিজে থেকে নাক গলাতে চায় না, আমেরিকা।
এ নিয়ন্ত্রন তারা ছেড়ে দেয় দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতের হাতে। অর্থাৎ ৯/১১ ও পরবর্তী যুদ্ধের প্রভাবে, বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার সক্রিয় ও দীর্ঘমেয়াদী সামরিক হস্তক্ষেপের সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এক কালের সুপার পাওয়ার পরিণত হয় অতীতের ছায়াতে।

৭) ভাবমূর্তির পতনঃ-

৯/১১ এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল, মার্কিন ভাবমূর্তির পতন। মিডিয়ার মায়াজালে আমেরিকার একটি অজেয় ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। গত দুই দশকে তা গুড়িয়ে গেছে।
একসময় হলিউডের রুপালী পর্দায় নিজেকে হিরো হিসাবে উপস্থাপন করা আমেরিকা আজ বিশ্বের চোখে ভিলেন। ২০২০ এ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ব্যার্থতা, ২০২১ এর জানুয়ারিতে মার্কিন কংগ্রেসে জনগনের হামলা এবং সবশেষে আফগানিস্তানে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর আমেরিকার নাগরিক এবং মিত্ররাও মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছে।

৮) ৯/১১ হামলার লক্ষ্যঃ-

৯/১১ এর অপারেশন নিছক আঘাতের বদলে পাল্টা আঘাত ছিলোনা। বরং এই অপারেশন ছিলো সুপার পাওয়ার অ্যামেরিকাকে নিঃশেষ করে দেয়ার এক দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের সূচনা মাত্র।
আল কায়েদা উপলব্ধি করেছিল অসম শক্তির লড়াইয়ে জয়ী হবার অন্যতম কৌশল হচ্ছে শত্রুর শক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়া।

বিশিষ্ট সমরবিদ – সান যু তার কালোত্তীর্ন সমরকৌশল বই আর্ট অফ ওয়ারে বলেছিলো –

“If his forces are united, separate them.”
“শত্রুর বাহিনী যদি এক স্থানে কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দাও।”

৯/১১ এর হামলা সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে তার নিরাপত্তা বলয় থেকে তার সৈন্যদের বের করে আফগানের পাহাড় আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বিক্ষিপ্ত করে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

আল কায়েদা নেতা উসামা বিন লাদেনের মতে ৯/১১ হামলার লক্ষ্য ছিল ৩টিঃ-

ক) আমেরিকাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে জড়িয়ে দুর্বল করে ফেলা। আমেরিকান সামরিক ক্ষমতার অতি-প্রসারণ (strategic overreach) ঘটানো যাতে তারা মুসলিম বিশ্বে সামরিক আগ্রাসনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
খ) আমেরিকান অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেয়া।
গ) আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংহতি নষ্ট করে দেয়া।

বৈশ্বিক মন্দা, ইরাক ও আফগানিস্তানে শোচনীয় পরাজয় এবং উগ্র ডান ও বামপন্থীদের কল্যাণে তৈরি হওয়া আমেরিকার অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক অস্থিরতার আলোকে বলা যায়, এ তিনটি উদ্দেশ্যই অর্জিত হয়েছে।

মার্কিন সাম্রাজ্য পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে, এ কথা বলছেন অনেক মার্কিন বিশ্লেষকরাই।

৯) ইসলামী শক্তির উত্থানঃ-

৯/১১ এর সবচেয়ে বড় এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্ভবত ইসলামী শক্তির উত্থান। আল কায়েদা নেতা উসামা বিন লাদেন মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর আদর্শ অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে আজ আরো বেশি শক্তিশালী।

অন্যদিকে বুশ বেঁচে থাকলেও তার আদর্শ ইরাক, আফগানিস্তান –সব খানেই পরাজিত। ৯/১১ এর পর ইরাক ও আফগানিস্তান – দুটি ভূখণ্ডে পরাজিত হয়ে আমেরিকা পিছু হটেছে।

আমেরিকার আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্য ছোট হয়ে এসেছে। আমেরিকাকে পরাজিত করার পর আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী ইমারত। ইনশাআল্লাহ যা হতে পারে আগামী দিনের খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ

১০) ফলাফল?

৯/১১ এর ২০ বছর পর আমেরিকা আগের চেয়ে দুর্বল, কিন্তু আল কায়েদা আগের চেয়ে শক্তিশালী।
আল কায়েদার পরিকল্পনা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার পর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী ইমারত গড়ে তুলা। তাদের মিত্র তালেবান ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে ইসলামী ইমারত প্রতিষ্ঠা করেছে।

সোমালিয়া, ইয়েমেন এবং সাহারা অঞ্চলেও ইসলামী ইমারত প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আল-কায়েদার বিভিন্ন শাখা। আল কায়েদার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আফগানিস্তানের ইসলামী ইমারত হবে আগামী দিনের ইসলামী খিলাফতের নিউক্লিয়াস।

অন্যান্য অঞ্চলে মুজাহিদিনের হাতে ইসলামী ইমারত গড়ে উঠলে এক সময় তা একত্রিত হয়ে রূপ নিতে পারে ইসলামী খিলাফতে।

আল-কায়েদার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন হয়েছে। পরের ধাপে কী চমক অপেক্ষা করছে বিশ্ববাসীর সময়ই তা বলে দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত ৯/১১ হামলা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হয়েছে।

(Visited 538 times, 1 visits today)