মুসিবত ব্যাতীত মর্যাদা নেই!

উস্তাদ হাসান আব্দুস সালাম

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলার অনুগ্রহ ও সাহায্যে আজ এই দ্বীন আর তার অনুসারীদের উপর প্রবল আস্থা আর সুনিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছে, যা ইতিপূর্বে ছিল না।

শেষ জমানায় এসেও এই মহান দ্বীন আপন মহিমা ছড়াচ্ছে তার অনুসারীদের মাঝে।
আল্লাহর কসম! আমাদের উপর আবশ্যক হলো, আমরা যেন প্রতিনিয়ত প্রিয় হাবীব সাঃ এর বক্তব্যের বাস্তবায়ন ঘটাই।

তিনি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক বার কিয়ামুল লাইলে বলেছেন “হে প্রভূ! আপনার ওয়াদাই সত্য।”

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলার ওয়াদা সত্য, যার মাঝে কোন পরিবর্তন নেই। বর্তমান সময়ে এই ওয়াদার বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করার জন্য রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট সুন্নাহ, যার মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই।

সেই ওয়াদার মহত্ত্ব কেবল কস্ট-ক্লেশ আর মেহনতের সাথেই অর্জন হয়, অন্য কোন পন্থায় নয়। দুঃখ-বেদনার পর আসে সুখ। আর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে লাভ হয় মহা মূল্যবান পুরস্কার। আর এটাই সফলতার গোপন রহস্য।

সফলতার এই গোপন রহস্য তথা অক্লান্ত পরিশ্রম আর দুঃখ-কস্ট না থাকলে মুল্যবান পুরস্কারের কোন মূল্য বা গুরুত্ব কোনোটাই থাকত না। যদি গতানুগতিক পথে যে কেউই পুরস্কার লাভ করতো, তাহলে দেখা যেত মহান প্রতিদানসমূহের মান-মর্যাদা আর বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়ে যেত।

হে আল্লাহর বান্দা! আসুন আজ আপনাকে মানবেতিহাসের এক মহাজাগতিক নিদর্শনের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। এই নিদর্শনের প্রতি যারা ইমান এনেছে এবং সত্য বলে মেনে নিয়েছে তা ছিল তাদের জন্য রহমত। আর যারা কুফরি করেছে তাদের জন্য তা ছিল আযাব।

এই মহান নিদর্শন আর কেউ নন। তিনি হলেন, আল্লাহর নবী ইসা আঃ। যিনি দুঃখ-বেদনা ভরা এক নির্মম বাস্তবতার সাথে এ দুনিয়ায় আগমন করেন। তার সম্মানিত মাতা মারইয়াম আঃ ফজলে ইলাহীর কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি না হতে চাইলেও পারতেন। তিনি ছিলেন পূতপবিত্র, স্বাধীন রমনী, যিনি ইসা আঃ কে জন্মদানের সময় বলেছিলেন,

“হায়! এর পূর্বেই যদি আমি মরে যেতাম। হায়! আমি যদি মানুষের মাঝ থেকে চিরতরে বিস্মৃত হয়ে যেতাম।”

এটি এমন একটি বাক্য, যার মাঝে আসন্ন কস্ট ক্লেশ আর ভয় ভীতির সব রকমের অর্থ নিহিত রয়েছে। তিনি কীভাবে এমন কথা না বলে থাকতে পারতেন? তিনি তো জানতেন অচিরেই মানুষ তার সম্পর্কে কস্টদায়ক কথাবার্তায় লিপ্ত হবে।

তার যমানায় অপবাদ দানকারী এবং মিথ্যাবাদী লোকজনের অভাব ছিল না, যারা ছিলো ইয়াহুদী। এই নাপাক লোকগুলো এই মহান নারীর পবিত্র চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করতে থাকে।

তার নামে বিভিন্ন অপবাদ দিতে থাকে।
অথচ তিনি ছিলেন বরকতময়, পবিত্রা এক নারী। তিনি ভুলেও কখনো যিনার ধারে কাছে ও যাননি।

আমাদের রব্ব অন্য যে কারো পরিবর্তে তাঁকেই মর্যাদা দানের জন্য মনোনীত করেছেন। তাঁকে দিয়েছেন এক মহা নিদর্শন। কিন্তু সেই মহানিদর্শনের নিয়ামত লাভের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল মহাবিপদ।

রব্বানী অনুগ্রহ আর পুরস্কারপ্রাপ্তির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত রয়েছে আল্লাহর এই সুন্নাহ।
গুনাহ থেকে বিরত থাকা এই মহান সত্তাগণ চাইলে নিরাপত্তা লাভ করতে পারতেন।

কিন্তু তারা বেছে নিয়েছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলার রহমতকে। আর রহমত অর্জন হয় বালা-মুসিবত আর এত কিছু সত্ত্বেও প্রচন্ড মেহনতে লেগে থাকার মাধ্যমে।

অনুরূপ আমাদের সম্মানিত আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) এর সাথেও অপবাদ আরোপের ঘটনা ঘটেছিলো।
উনার উপর দিয়ে এক ভয়াবহ মুসিবত অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা ‘আলা সুরা নুরে ইরশাদ করেন,

لَا تَحۡسَبُوۡہُ شَرًّا لَّکُمۡ ؕ بَلۡ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ
“তোমরা এটাকে অকল্যাণকর মনে করো না। বরং এই ঘটনায় তোমাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ।”

এই মুসীবতগ্রস্থ আয়েশা রাঃ সম্পর্কেই কুরআনুল কারীমে আয়াত নাজিল হয়েছে। যা কিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত হতে থাকবে।
এসম্পর্কে আয়েশা রাঃ বলেন,

“আমি ধারণা ও করতে পারিনি যে আমার সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলা ওহী নাযিল করবেন। বরং আমি ভেবেছিলাম যে, হয়তো রাসুলুল্লাহ সাঃ কে স্বপ্নের মাঝে আমার পবিত্রতা সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়া হবে।”

যারা বালা-মুসিবতের সম্মুখীন হওয়া ব্যাতীত কল্যাণ লাভ করতে চাই তারা ভ্রমের মাঝে রয়েছে।
এই সকল লোক যেন স্বপ্নের মাঝে মরিচিকা আর বালুর প্রাসাদ বানাতে ব্যস্ত।

এমতাবস্থায় কিছু লোক রয়েছে যাদের অন্তরে আখিরাতের কোন ফিকির নেই, যাদের সামনে শুধুই ধ্বংসশীল দুনিয়া, যারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা আ’লা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে, যাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা আ’লা মুনাফিকের হৃদয় আর ক্ষতিকর বাকপটু যবান দিয়েছেন।

তারা দীনদারদের সাথে কিছু ঘটলে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাড় করাতে থাকে। তারা মৃত বা নিহত ব্যক্তির জন্য জাহেলি মানুষদের মত আফসোস করতে থাকে।

তারা মনে করতে থাকে আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকারকারীর দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। এদের কাছে এই দুনিয়াই সব কিছু। তাদের অবস্থা এমন, যেন এই দুনিয়ার পর আর কিছুই নেই।

আল্লাহর রাস্তায় গ্রেফতারী, কস্ট-ক্লেশ আর শাহাদাত মূলত একজন মুমিনের জন্য চূড়ান্ত হাদিয়াস্বরূপ। হকপন্থীদের এসবে আপতিত হতে দেখে মুনাফিকদের উত্তরসূরীরা বলতে থাকে,

لَّوۡ کَانُوۡا عِنۡدَنَا مَا مَاتُوۡا وَ مَا قُتِلُوۡا
“তারা যদি আমাদের সাথে থাকতো তাহলে তারা মৃত্যু বরণ করতো না, নিহত হতো না।”

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলা যেন তাদের অন্তরের এই আফসোসকে তাদের ধ্বংসের কারণ বানিয়ে দেন।
.
এরা আসলে দেখতে পায়না, বরং এরা অন্ধ। দুঃখ কস্টের মাধ্যমে মানুষের পরিশুদ্ধ হওয়া, মানুষের অন্তর কল্যাণ লাভের জন্য প্রস্তুত হওয়া- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা বেখবর।

নিশ্চয়ই আগুনে পোড়া ব্যাতীত সোনা খাটি হয়না।
আর বালা-মুসিবত নেককারদের জন্য ফিতনাস্বরুপ, বালা-মুসিবতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হন।

আল্লাহ সুবঃ তার নেক বান্দাদের দুয়া, আশ্রয় প্রার্থনা, কাকুতিমিনতি আর চোখের পানি প্রচন্ড ভালোবাসেন। বান্দার চোখের পানি দেখে আল্লাহ তা ‘আলা খুশি হোন।

আর এর মাধ্যমেই তো মূলত বান্দা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা আ’লার দরবারে সাহায্য চেয়ে থাকে। এই দামী অশ্রু আর কাকুতিমিনতির মাধ্যমেই তারা নাজাত, আল্লাহর সন্তুষ্টি আর কবুলিয়ত কামনা করে।

কেনই বা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা বান্দার অশ্রুপাতে খুশি হবেন না?

এই অশ্রু বর্ষণকারী বান্দাদের ইমাম তো হলেন ইবরাহীম আঃ। যিনি ছিলেন বিপদগ্রস্ত আর মেহনতী জনতার ইমাম। যিনি কুরবানীকারীদের অনুপম দৃষ্টান্ত।
এই মহান নবী সম্পর্কে আরশে আযীমের রব প্রশংসা করে বলেছেন-

اِنَّ اِبۡرٰہِیۡمَ لَحَلِیۡمٌ اَوَّاہٌ مُّنِیۡبٌ
নিশ্চয় ইবরাহীম অত্যন্ত সহনশীল, কোমল-হৃদয়, সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী।

অন্তরের দিক দিয়ে কষ্ট-ক্লেশের মাঝে থাকা এই ব্যাক্তিবর্গ স্বচ্ছ না হলে, তাহলে আর কারা?
নাকি সেই সমস্ত লোক, যারা সবরকমের নিয়ামত প্রাপ্ত, যাদের পেট সবসময় পূর্ণ থাকে। নাকি আরো বেশি বেশি দুনিয়া চায় তারা?!

সুবহানআল্লাহ! তারা তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলার সামনে এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলে না। তারা কখনো অনুভবও করে না যে, আল্লাহর দরবারে তাদের কোন প্রয়োজন পেশ করতে হবে।

তাদের পক্ষে আল্লাহর দরবারে ইউনুস আঃ এর ন্যায় সাহায্য প্রার্থনা করা সম্ভব না, যার সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা ‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

“সে অন্ধকারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা আলাকে ডেকে বলেন, আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি মহা পবিত্র। নিশ্চয়ই! আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।”

কবি বলেন,
‘আহবান শব্দটি কেবল আশার প্রদীপ জ্বালায়,

যা প্রচন্ড প্রয়োজনের সময় আহবানকারীর পথ দেখায়।’

এসকল আফসোসকারী তো আসলে সেই সম্প্রদায়, যারা আহলে কিতাব আর কাফির মুশরিকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। ঈমানদারদের উপর বালা-মুসিবত আপতিত হলে যারা বিভিন্ন রকমের কথা বলে থাকে।

এদের সম্পর্কেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,
{لتبلون في أموالكم وأنفسكم ولتسمعن من الذين أوتوا الكتا من قبلكم ومن الذين اشركوا أذى كثيرا وإن تصبروا وتتقوا فإن ذلك من عزم الأمور}.

এমন কথা কেবল তাদের জন্য ই প্রযোজ্য
{سلقوكم بألسنة حداد أشحة على الخير}
“এদের কেবল ক্ষতিকারক যবানই আছে।”

অথচ কত ভালো হতো যদি অন্তত জনৈক কবির এই আহবানেও তারা সাড়া দিত-

“তোমার নিকট হাদিয়া দেয়ার মত কোন মাল না থাকলেও, অন্তত একটু উত্তম কথা বল।”

فحسبنا الله ونعم الوكيل

(শায়খ আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনির লেখা থেকে পরিমার্জিত)

(Visited 429 times, 1 visits today)