জ্ঞান অর্জনের ধারাবাহিকতা

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

দ্বীন ইসলামের ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ আগে শিখবো।

আগে মূলধন রক্ষা, পরে লাভ করার চেষ্টা – ইসলামের এই মূলনীতির আলোকে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পারছিঃ

  1. A) কিছু কিছু মানুষ চিরজাহান্নামী হবে।
  2. B) কিছু কিছু মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য জাহান্নামে যাবে।
  3. C) বাকীরা সরাসরি জান্নাতে যাবে। কেউ কেউ জান্নাতের উচ্চস্তরে যাবে, কেউবা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে।

Continue reading

কাশফুশ শুবুহাত (সংশয় নিরসন)

কাশফুস শুবুহাত

ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

 

﴿ كشف الشبهات ﴾

কাশ্‌ফুশ্‌ শুবহাত (সংশয় নিরসন)

 

প্রথম অধ্যায়

রাসূলগণের প্রথম দায়িত্ব: ইবাদতে আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতিষ্ঠা

প্রথমেই জেনে রাখা প্রয়োজন যে, তাওহীদের অর্থ ইবাদতকে পাক পবিত্র আল্লাহর জন্যই একক ভাবে সুনির্দিষ্ট করা। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণের দ্বীন। যে দ্বীনসহ আল্লাহ তাঁদেরকে প্রেরণ করেছিলেন।

সেই রাসূল-গণের প্রথম হচ্ছেন নূহ ‘আলাইহিস্‌ সালাম। আল্লাহ্‌ তাঁকে তাঁর কাওমের নিকট সেই সময় পাঠালেন যখন তারা ওয়াদ্দ, সুওয়া‘, ইয়াগুস, ইয়া‘উক ও নাস্‌র নামীর কতিপয় সৎ লোকের ব্যাপারে অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করে চলেছিল।

আর সর্ব শেষ রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, যিনি ঐ সব নেক লোকদের মুর্তি ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ করেন। আল্লাহ তাঁকে এমন সব লোকের মধ্যে পাঠান যারা ইবাদত করত, হজ্জ করত, দান খয়রাত করত এবং আল্লাহকেও অধিক মাত্রায় স্মরণ করত। কিন্তু তারা কোনো কোনো সৃষ্ট ব্যক্তি ও বস্তুকে আল্লাহ্‌ এবং তাদের মাঝে মাধ্যম রূপে দাঁড় করাত। তারা বলত, তাদের মধ্যস্থতায় আমরা আল্লাহর নৈকট্য কামনা করি, আর আল্লাহর নিকট (আমাদের জন্য) তাদের সুপারিশ কামনা করি। তাদের এই নির্বাচিত মাধ্যমগুলো হচ্ছে: ফেরেশতা, ঈসা, মারইয়াম এবং মানুষের মধ্যে যাঁরা সৎকর্মশীল- আল্লাহ্‌র সালেহ বান্দা।

অবস্থার এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ প্রেরণ করলেন মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের পূর্ব পুরুষ ইব্‌রাহীম আলাহিস্‌ সালাম এর দ্বীনকে তাদের জন্য নব প্রাণ শক্তিতে উজ্জীবিত করার জন্য। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই পথ এবং এই প্রত্যয় একমাত্র আল্লাহরই হক। এর কোনোটিই আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য কোনো ফেরেশতা এবং কোনো প্রেরিত রাসূলের জন্যও সিদ্ধ নয়। অপরাপর লোকেরা তো পরের কথা !

তা ছাড়া ঐ সব মুশরিকগণ সাক্ষ্য দিত যে, আল্লাহই একামাত্র সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিতে তাঁর কোনো শরীক নেই। বস্তুত: তিনিই একমাত্র রেযেকদাতা, তিনি ছাড়া রেযেক দেওয়ার আর কেউ নেই। জীবনদাতাও একমাত্র তিনিই, আর কেউ মৃত্যু দিতে পারে না। বিশ্ব জগতের একমাত্র পরিচালকও তিনিই, আর কারোরই পরিচালনার ক্ষমতা নেই। সপ্ত আকাশ ও যা কিছু তাদের মধ্যে বিরাজমান এবং সপ্ত তবক যমীন ও যা কিছু তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে সব কিছু তাঁরই অনুগত দাসানুদাস, সবই তাঁর ব্যবস্থাধীন এবং সব কিছুই তাঁরই প্রতাপে এবং তাঁরই আয়ত্তাধীনে নিয়ন্ত্রিত।

দ্বিতীয় অধ্যায়

রাসূল যাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন তারা তাওহীদু রবুবিয়াতের স্বীকৃতি দিত এর প্রমাণাদির বর্ণনা

[রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব মুশ্‌রিকের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা তাওহীদে রবুবিয়াত অর্থাৎ আল্লাহ যে মানুষের রব, প্রতিপালক ও প্রভু একথা স্বীকার করত কিন্তু এই স্বীকৃতি ইবাদতে শির্ক এর পর্যায় থেকে তাদেরকে বের করে আনতে পারে নি— আলোচ্য অধ্যায়ে তারই বিশদ বিবরণ রয়েছে]

যে সব কাফেরের সঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ করেছেন তারা তাওহীদে রবুরিয়তের সাক্ষ্য প্রদান করত—এই কথার প্রমাণ যদি তুমি চাও তবে নিম্ন লিখিত আল্লাহ্‌র বাণী পাঠ কর:

﴿ قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ ﴾ [يونس: ٣١] 

“বলুন, ‘কে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, জীবিতকে মৃত থেকে কে বের করেন এবং মৃতকে জীবিত হতে কে বের করেন এবং সব বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন?’ তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ্। সুতরাং বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?’ (সূরা ইউনুস : ৩১)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন :

﴿ قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٤ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٨٥ قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ٨٦ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٨٧ قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٨ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ ٨٩ ﴾ [المؤمنون: ٨٤،  ٨٩] 

“বলুন, ‘যমীন এবং এতে যা কিছু আছে এগুলো(র মালিকানা) কার? যদি তোমরা জান (তবে বল)। অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্র।’ বলুন, ‘তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’ বলুন, ‘সাত আসমান ও মহা-‘আরশের রব কে?’ অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্। বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? বলুন, ‘কার হাতে সমস্ত বস্তুর কর্তৃত্ব? যিনি আশ্রয় প্রদান করেন অথচ তাঁর বিপক্ষে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না , যদি তোমরা জান (তবে বল)। অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ্।’ বলুন, ‘তাহলে কোথা থেকে তোমরা জাদুকৃত হচ্ছো? (সূরা মু’মেনুন : ৮৪-৮৯)। অনুরূপ আরও অনেক আয়াত রয়েছে।

যখন এ সত্য স্বীকৃত হলো যে, তারা আল্লাহর রবুবিয়াতের গুণাবলীর স্বীকৃতি দিত, অথচ তাদের সেই ঈমান তাদেরকে সেই তাওহীদে প্রবেশ করায় নি -যার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আর তুমি এটাও অবগত হলে যে, যে তাওহীদকে তারা অস্বীকার করেছিল সেটা ছিল তাওহীদে ইবাদত (ইবাদতে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত করা)— আমাদের যুগের মুশরিকগণ যাকে ‘ই‘তেকাদ” বলে থাকে। তাদের[1] ঐ “ই‘তেকাদের” নমুনা ছিল এই যে, তারা আল্লাহকে দিবানিশি আহবান করত, আর তাদের অনেকেই আবার ফেরেশতাদেরকে এজন্য আহবান করত যে, ফেরেশতাগণ তাদের সৎ স্বভাব ও আল্লাহর নৈকট্যে অবস্থান হেতু তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে; অথবা তারা কোন পূণ্য স্মৃতি ব্যক্তি বা নবীকে ডাকতো যেমন ‘লাত’ বা ঈসা ‘আলাইহিস্‌ সালাম।

আর এটাও তুমি জানতে পারলে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সঙ্গে এই প্রকার শির্কের জন্য যুদ্ধ করেছেন এবং তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন যেন তারা একমাত্র আল্লাহর জন্যই তাদের ইবাদতকে খালেস (নির্ভেজাল) করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন :

﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨] 

“আরও (এই অহী করা হয়েছে) যে, মসজিদগুলো সমস্তই আল্লাহ্‌র (যিকরের) জন্য, অতএব তোমরা আহ্বান করতে থাকবে একমাত্র আল্লাহ্‌কে এবং আল্লাহ্‌র সঙ্গে আর কাওকেও ডাকবে না।” (সুরা জিন :১৮)

এবং তিনি একথাও বলেছেন:

﴿ لَهُۥ دَعۡوَةُ ٱلۡحَقِّۚ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ لَا يَسۡتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيۡءٍ ﴾ [الرعد: ١٤] 

“সমস্ত সত্য আহবান একমাত্র তাঁরই জন্য, বস্তুত: তাঁকে ছেড়ে অন্য যাদেরকেই তারা আহ্বান করে, তারা তাদের সে আহ্বানে কিছুমাত্রও সাড়া দিতে পারে না।” (সূরা রা‘আদ :১৪)

এটাও বাস্তব সত্য যে, মহানবী সাল্লাল্লহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে এই জন্যই যুদ্ধ করেছেন যেন তাদের যাবতীয় প্রার্থনা আল্লাহর কাছেই হয়ে যায়; যাবতীয় কুরবানীও আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হয়, যাবতীয় নযর নেয়াযও আল্লাহর জন্যই উৎসৃষ্ট হয়;  সমস্ত আশ্রয় প্রার্থনা আল্লাহর সমীপেই করা হয় এবং সর্ব প্রকার ইবাদত আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়।

এবং তুমি এটাও অবগত হলে যে, তাওহীদে রবুবিয়ত সম্বন্ধে তাদের স্বীকৃতি তাদেরকে ইসলামের মধ্যে দাখেল করে দেয় নি এবং ফেরেশতা, নবী ও ওলীগণের সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে সুপারিশ লাভের ইচ্ছা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বাসনা এমন মারাত্মক অপরাধ, যা তাদের জান-মালকে মুসলিমদের জন্য হালাল করে দিয়েছিল।

এখন তুমি অবশ্য বৃঝতে পারছ যে, আল্লাহর রাসূলগণ কোন তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন ও মুশরিকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

তৃতীয় অধ্যায়

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর প্রকৃত তাৎপর্যই হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ বা ইবাদতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা

[লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে তাওহীদে ইবাদত। বর্তমান যুগে ইসলামের দাবীদারগণের তুলনায় রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময়ের কাফেরগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর অর্থ বেশী ভাল জানতো। বক্ষমাণ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হচ্ছে।]

কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ ও তাৎপর্য বলতে যা বুঝায় তাই হচেছ তাওহীদে ইবাদত। আর বর্তমান যুগে ইসলামের দাবীদারগণের তুলনায় রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সময়ের কাফেরগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর অর্থ বেশী ভাল জানতো। আর যখন তুমি বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তখন এ তাওহীদই তোমার কথার উদ্দেশ্য। কেননা, তাদের[2] নিকট ‘ইলাহ’ হচ্ছেন সেই সত্তা যাকে এ সকল কাজে (বিপদাপদ, নযর নিয়ায, যবেহ, আশ্রয় ইত্যাদিতে) উদ্দেশ্য নেয়া হয়। চাই তা ফেরেশতা, নবী, ওলী, বৃক্ষ, কবর, জিন যা-ই হোক না কেন[3]

তখনকার কাফেরগণ এ (কালেমা দ্বারা) কখনও এটা উদ্দেশ্য নিত না যে, ইলাহ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা, আহার দাতা, সব কিছুর ব্যাবস্থাপক বা পরিচালক। কেননা কাফেররা এটা জানত এবং স্বীকার করত যে, এই সব গুণাবলী অর্থাৎ সৃষ্টি করা, আহার দান এবং ব্যবস্থাপনা একমাত্র একক আল্লাহর জন্যই সুনির্দিষ্ট, আর কারোরই তা করবার ক্ষমতা নেই (এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আমরা পূর্বেই করেছি)।

বরং আরবের তৎকালীন[4] মুশরিকরা “ইলাহ” এর সেই অর্থই বুঝত যা আজ কালের মুশরিকগণ “সাইয়েদ” “মুর্শিদ” ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বুঝে থাকে। এ ধরণের বিশ্বাসের সময়ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকটে কালেমায়ে তাওহীদের আহ্বান নিয়ে আগমন করেছিলেন, সেটা হচ্ছে “লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ”। আর এই কালেমার অর্থই হচ্ছে এর আসল উদ্দেশ্য, শুধুমাত্র এর শব্দগুলি উদ্দেশ্য নয়।

রাসূলের সময়ের অজ্ঞ কাফেররাও এ কথা জানত যে, এই কালেমা থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্য ছিল: যাবতীয় সৃষ্ট বস্তু থেকে সম্পর্কচ্যুত হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরী করা। (কোনো সৃষ্টজীবের ইবাদত থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করা) তাঁকে ছেড়ে আর যাকে বা যে বস্তুকে উপাসনা করা হয় তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা এবং তা থেকে বিমুক্ত থাকা। কেননা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা বল: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”— ‘আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো হক্ক মা‘বুদ নেই’, তখন তারা বলে উঠল,

﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥] 

“এই লোকটি কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করছে? এ তো ভারী এক আশচর্য্য ব্যাপার !” (সূরা সাদ : ৫)

যখন তুমি জানতে পারলে যে, অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরগণও কালেমার অর্থ বুঝে নিয়েছিল, তখন এটা কত বড় আশ্চর্য্যের বিষয় যে, অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরগণও কালেমার যে অর্থ বুঝতে পেরেছিল, ইসলামের (বর্তমান) দাবীদারগণ তাও বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না!

বরং এরা মনে করছে কালেমার আক্ষরিক উচ্চারণই যথেষ্ট, তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে অন্তর দিয়ে প্রত্যয় পোষণ করার প্রয়োজন নেই। বর্তমানকালের মুসলিম নামধারীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান (বুদ্ধিজীবী কিংবা দার্শনিক) বলে পরিচিত, তারা এ কালেমার অর্থ করে থাকে যে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, কোনো রুযীদাতা নেই এবং একমাত্র তিনিই সব কিছুর পরিচালক, তিনিই সব বিষয়ের ব্যবস্থাপক। (অথচ এ অর্থটি এ কালেমার সঠিক অর্থ নয়)

তাহলে এটা সাব্যস্ত হচ্ছে যে এমন মুসলিম নামধারী লোকের মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই যার চেয়ে (তৎকালীন আরবের) অজ্ঞ-মূর্খ কাফেরও কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র এর অর্থ বেশী জানত।

চতুর্থ অধ্যায়

তাওহীদের জ্ঞানলাভ আল্লাহর এক বিরাট নে‘আমত

[একজন মুমিনের এটা জানা যে, তাওহীদ সম্পর্কে মু’মিনের জ্ঞান লাভ তার প্রতি আল্লাহর এমন এক নে‘আমত যে জন্য আনন্দ প্রকাশ করা এবং এটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় থাকা তার অবশ্য কর্তব্য]

যা বর্ণিত হয়েছে (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ হচ্ছে, ইবাদতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা), যখন তুমি মন থেকে তা বুঝতে সক্ষম হলে।

আরও বুঝতে পারলে আল্লাহর সাথে (কিভাবে) শির্ক (হয় সেটা) সম্পর্কে, যে শির্ক (এর পরিণতি) সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ﴾ [النساء: ٤٨، 116] 

“নিশ্চয় আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করার যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্য যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্চা মাফ করে দিবেন।” (সূরা নেসা : ৪৮, ১১৬)

আর সে দ্বীনকেও জানতে পারলে, যে দ্বীন নিয়ে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত রাসূলগণকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন এবং যে দ্বীন ছাড়া আল্লাহ অন্য কোন দ্বীনই কবুল করবেন না।

তাছাড়া অধিকাংশ মানুষের মধ্যে যেভাবে অজ্ঞতা-মূর্খতা ছেয়ে গেছে তাও সম্যক জানতে ও বুঝতে পারলে, তখন তুমি দু’টি উপকার লাভ করবে, 

এক: আল্লাহর দয়া ও তাঁর রহমতের উপর খুশি হবে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ﴾ [يونس: ٥٨] 

“বল ! আল্লাহ এই যে ইন’আম এবং তাঁর এই যে রহমত (তোমরা পেয়েছ) এর জন্য সকলের উৎফুল্ল হওয়া উচিত, তারা যা পুঞ্জীভূত করে তা অপেক্ষা তা কতই না উত্তম।” (সূরা ইউনুস : ৫৮)

দুই : আর তোমার মধ্যে (তা) ভীষণ ভয়েরও উদ্রেক করবে। কারণ, যখন তুমি বুঝতে পারলে যে, মানুষ তার মুখ থেকে বের হওয়া কোনো একটি কথার জন্য কুফরি করে ফেলতে পারে। এমন কি যদিও সে উক্ত কথাটি অজ্ঞতা বশত বলে ফেলে তবুও; আর তার অজ্ঞতা ওযর হিসেবে বিবেচিত হবে না[5]। অথবা হতে পারে সে এ কথাটি বলেছে এমতাবস্থায় যে সে মনে করেছে যে এটা তাকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য এনে দেবে, যেমন মুশরিকরা মনে করত; (কিন্তু সেটাও তাকে কুফরিতে নিপতিত করতে পারে)। বিশেষত: যখন কুরআনে বর্ণিত মুসা ‘আলাইহিস সালামের ঘটনাটি আল্লাহ তা‘আলা তোমার মনে উদয় করিয়ে দিবেন, যে ঘটনায় মূসার কওম সৎ ও জ্ঞানী গুণী হওয়া সত্ত্বেও বলেছিল :

﴿ٱجۡعَل لَّنَآ إِلَٰهٗا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةٞۚ﴾ [الاعراف: ١٣٨] 

 “আমাদের জন্যও একটি উপাস্য (মূর্তি) স্থির করে দিন, যেমন তাদের জন্য রয়েছে বহু  উপাস্য মুর্তি !” (সূরা আ‘রাফ : ১৩৮)।

যখন এ ঘটনাটি উপলব্ধি করতে পারবে, তখন (কুফর, শির্কের) ভয় তোমার কাছে বৃহৎ হয়ে দেখা দিবে এবং এ জাতীয় বিষয় (কুফর, শির্ক) ও অনুরূপ বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য জন্য তোমার আগ্রহ বেড়ে যাবে।

পঞ্চম অধ্যায়

নবী ও ওলীদের সাথে মানুষ ও জিনদের শত্রুতা :
আল্লাহর হিকমতের চাহিদা হচ্ছে যে তিনি তাঁর নবী ও ওলীদের বিপক্ষে মানুষ ও জিন শত্রুদেরকে ক্রিয়াশীল রাখেন

জেনে রাখ, পাক-পবিত্র আল্লাহর অন্যতম হিকমত এই যে, তিনি এই তাওহীদের নিশান বরদাররূপে এমন কোনো নবী প্রেরণ করেন নি যাঁর পিছনে দুশমন দাঁড় করিয়ে দেন নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا شَيَٰطِينَ ٱلۡإِنسِ وَٱلۡجِنِّ يُوحِي بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ زُخۡرُفَ ٱلۡقَوۡلِ غُرُورٗاۚ ﴾ [الانعام: ١١٢] 

“আর এভাবেই আমরা মানব ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একে অপরকে চমকপ্রদ বাক্যের কুমন্ত্রণা দেয়।” (সূরা আন‘আম : ১১২)

আবার কখনও তাওহীদের শত্রুদের নিকটে থাকে অনেক বিদ্যা, বহু, কেতাব ও বহু যুক্তি প্রমাণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ فَلَمَّا جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِ فَرِحُواْ بِمَا عِندَهُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ﴾ [غافر: ٨٣] 

“অতঃপর যখন তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল তাদের কাছে, তখন তারা নিজেদের (পৈতৃক) বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়েই উৎফুল্ল হয়ে রইল।” (সুরা গাফের: ৮৩)

 

ষষ্ঠ অধ্যায়

কিতাব ও সুন্নাহর অস্ত্রসজ্জা

[শত্রু পক্ষের সৃষ্ট সন্দেহাদি নিরসনে কুরআন ও সুন্নাহর অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত (জ্ঞানে জ্ঞানী) থাকতে হবে।]

যখন তুমি এটা (নবী ও ওলীদের পিছনে দুশমন দল নিয়োজিত রয়েছে) জানতে পারলে, আর এ কথাও জানতে পারলে যে, আল্লাহর পথের মোড়ে উপবিষ্ট দুশমনগণ হয়ে থাকে কথাশিল্পী, বিদ্যাধর এবং যুক্তিবাগীশ, তখন তোমার জন্য অবশ্য কর্তব্য হবে আল্লাহর দ্বীন থেকে সেই সব বিষয় শিক্ষা করা যা তোমার জন্য হয়ে উঠবে এমন এক কার্যকর অস্ত্র যে অস্ত্র দ্বারা তুমি ঐ শয়তানদের মুকাবেলা এবং সংগ্রাম করতে সক্ষম হবে, যাদের অগ্রদূত ও তাদের পূর্বসূরী তোমার মহান ও মহীয়ান প্রভু পরওয়ারদেগারকে বলেছিল :

﴿لَأَقۡعُدَنَّ لَهُمۡ صِرَٰطَكَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ١٦ ثُمَّ لَأٓتِيَنَّهُم مِّنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيهِمۡ وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ وَعَنۡ أَيۡمَٰنِهِمۡ وَعَن شَمَآئِلِهِمۡۖ وَلَا تَجِدُ أَكۡثَرَهُمۡ شَٰكِرِينَ ١٧ ﴾ [الاعراف: ١٦،  ١٧] 

“নিশ্চয় আমি তোমার সরল সুদৃঢ় পথের উপর গিয়ে বসব, অতঃপর আমি তাদের নিকট গিয়ে উপনীত হব তাদের সম্মুখের দিক থেকে ও তাদের পশ্চাতের দিক থেকে এবং তাদের দক্ষিণের দিক থেকে ও তাদের বামের দিক থেকে। আর তাদের অধিকাংশকে আপনি কৃতজ্ঞ পাবেন না।” (সুরা আ‘রাফ :১৬-১৭)

কিন্তু যখন তুমি আল্লাহর পানে অগ্রসর হবে ও আল্লাহর দীল প্রমাণাদির প্রতি তোমার হৃদয়-মন ও চোখ-কানকে ঝুঁকিয়ে দেবে, তখন তুমি হয়ে উঠবে নির্ভীক ও নিশ্চিন্ত। কারণ তখন তুমি তোমার জ্ঞান ও যুক্তি প্রমাণের মুকাবেলায় শয়তানকে দুর্বল দেখতে পাবে। এ সম্বদ্ধে আল্লাহ বলেন:

﴿إِنَّ كَيۡدَ ٱلشَّيۡطَٰنِ كَانَ ضَعِيفًا ٧٦ ﴾ [النساء: ٧٦] 

“নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত ও কুট-কৌশল হচ্ছে অতি দুর্বল।” (সূরা নেসা :৭৬)

একজন সাধারণ মুওয়াহ্‌হিদ (একত্ববাদী) ব্যক্তি হাজার মুশরিক পণ্ডিতের উপর জয় লাভের সামর্থ রাখে। কুরআন বজ্রগম্ভীর ভাষায় ঘোষণা করছে:

﴿ وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ ٱلۡغَٰلِبُونَ ١٧٣ ﴾ [الصافات: ١٧٣] 

“আর আমাদের যে ফওজ, নিশ্চয় বিজয়ী হবে তারাই।” (সুরা সাফফাত : ১৭৩)

আল্লাহর ফওজগণ যুক্তি ও কথার বলে জয়ী হয়ে থাকেন, যেমন তারা জয়ী হয়ে থাকেন তলওয়ার ও অস্ত্র বলে। ভয় ঐসব মুওয়াহ্‌হিদদের জন্য যাঁরা বিনা অস্ত্রে পথ চলেন।

অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন এক কেতাব দ্বারা অনুগৃহীত করেছেন যার ভিতর তিনি প্রত্যেক বিষয়ের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে কেতাবটি হচ্ছে “স্পষ্ট ব্যাখ্যা যা পথ-নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ আত্মসর্ম্পণকারীদের জন্য।” ফলে বাতেলপন্থীগণ যে কোনো দলীল নিয়েই আসুক না কেন তার খন্ডন এবং তার অসারতা প্রতিপাদন করার মত যুক্তি প্রমান খোদ কুরআনেই বিদ্যমান রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ وَلَا يَأۡتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ وَأَحۡسَنَ تَفۡسِيرًا ٣٣ ﴾ [الفرقان: ٣٢] 

 “আর যে কোন প্রশ্নই তারা তোমার নিকট নিয়ে আসে (সে সম্বন্ধে ওহীর মাধ্যমে) আমি সত্য ব্যাপার এবং (তার) সুসঙ্গত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আপনাকে জানিয়ে দেই।” (সূরা ফুরকান : ৩৩)

 এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কতিপয় মুফাস্‌সির বলেছেন : “কিয়ামত পর্যন্ত বাতিলপন্থীগণ যে যুক্তিই উপস্থাপিত করুক, এই আয়াত মাসগ্রিক ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, কুরআন পাক তা খণ্ডনের শক্তি রাখে।”

সপ্তম অধ্যায়

বাতিলপন্থীদের দাবীসমূহের খন্ডন

(সংক্ষিপ্তাকারে ও বিস্তারিতভাবে)

 আমাদের সমসাময়িক যুগের মুশরিকগণ আমাদের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করে থাকে আমি তার প্রত্যেকটির জওয়াবে সেই সব কথাই বলব যা আল্লাহ্‌ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

বাতেলপন্থীদের কথার জওয়াব আমরা দুই পদ্ধতিতে প্রদান করব : ১ সংক্ষিপ্তাকারে, ২.তাদের দাবীসমূহ বিশ্লেষণ করে বিশদভাবে।

১. সংক্ষিপ্ত জওয়াব

সংক্ষিপ্ত হলেও এটা হবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত কল্যাণবহ সেই সব ব্যক্তির জন্য যাদের প্রকৃত বোধ শক্তি আছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী,

﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ مِنۡهُ ءَايَٰتٞ مُّحۡكَمَٰتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ وَأُخَرُ مُتَشَٰبِهَٰتٞۖ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمۡ زَيۡغٞ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَٰبَهَ مِنۡهُ ٱبۡتِغَآءَ ٱلۡفِتۡنَةِ وَٱبۡتِغَآءَ تَأۡوِيلِهِۦۖ وَمَا يَعۡلَمُ تَأۡوِيلَهُۥٓ إِلَّا ٱللَّهُۗ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِي ٱلۡعِلۡمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧ ﴾ [ال عمران: ٧]   

“তিনিই তো সেই সত্ত্বা, যিনি আপনার প্রতি নাযিল করেছেন এই কিতাব; যার কতক আয়াত হচ্ছে মুহকাম— স্পষ্ট অর্থবহ, সে গুলি হচ্ছে কেতাবের মুলাধার; আর কতকগুলি হচ্ছে মোতাশাবেহ— অস্পষ্ট অর্থসম্পন্ন, ফলে যাদের অন্তরে আছে বক্রতা তারা অনুসরণ করে থাকে তার মধ্য হ’তে মোতাশাবেহ— অস্পষ্ট অর্থসম্পন্ন আয়াতগুলির, ফিৎনা সৃষ্টির মতলবে এবং (অসঙ্গত) তাৎপর্য্য বের করার উদ্দেশ্যে, অথচ এর প্রকৃত তাৎপর্য কেউই জানে না আল্লাহ্ ব্যতীত।” (সূরা আলে ইমরান :৭)

 নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতেও এটা সাব্যস্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন:

«فَإِذَا رَأَيْتِ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ فَأُولَئِكِ الَّذِينَ سَمَّى اللَّهُ فَاحْذَرُوهُمْ»

“যখন তুমি ঐ সমস্ত লোকদের দেখবে যারা দ্ব্যর্থবোধক ও অস্পষ্ট আয়াতগুলির অনুসরণ করছে তখন বুঝে নেবে এরা সেই সব লোক যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন, সুতরাং তোমরা ঐসব লোকদের ব্যাপারে হুশিয়ার থাক।” (বুখারী: ৪৫৪৭ ও মুসলিম: ২৬৬৫)

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে মুশরেকদের মধ্যে কতক লোক বলে থাকে :

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [يونس: ٦٢] 

“দেখ ! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধু তারা, যাদের ভয়-ভীতির কোনই আশঙ্কা নেই এবং কখনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না তারা।” (সূরা ইউনুস : ৬২)

তারা আরও বলে: নিশ্চয় সুপারিশের ব্যাপারটি অবশ্যই সত্য। অথবা বলে: আল্লাহর নিকটে নবীদের একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কিংবা নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এমন কিছু কথায় তারা উল্লেখ করবে, যা থেকে তারা তাদের বাতিল বক্তব্যের পক্ষে দলীল পেশ করতে চাইবে, অথচ তুমি বুঝতেই পারবে না যে, যে কথার তারা অবতারণা করেছে তার অর্থ কি ?

এরূপ ক্ষেত্রে তার জবাব এই ভাবে দিবে :

আল্লাহ তাঁর কেতাবে উল্লেখ করেছেন : “যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারা মুহকাম (স্পষ্ট অর্থবোধক) আয়াতগুলো বর্জন করে থাকে, আর মুতাশাবেহ্ (অস্পষ্ট অর্থবোধক) আয়াতের পিছনে ধাবিত হয়।” আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘মুশরিকগণ আল্লাহর রবূবিয়াতের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, তবু আল্লাহ তাদেরকে কাফেররূপে অভিহিত করেছেন এজন্যই যে, তারা ফেরেশতা, নবী ও ওলীদের সঙ্গে ভ্রান্ত সম্পর্ক স্থাপন করে বলে থাকে :

﴿هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨] 

“এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” (সূরা ইউনুস : ১৮ আয়াত)

এটি একটি মুহকাম আয়াত, যার অর্থ পরিষ্কার। এর অর্থ বিকৃত করার সাধ্য কারোরই নেই।

আর হে মুশরিক! তুমি কুরআন অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী থেকে যা আমার নিকট পেশ করলে তার অর্থ আমি বুঝি না, তবে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, আল্লাহর কালামের মধ্যে কোন পরস্পর-বিরোধী কথা নেই, আর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথাও আল্লাহর কালামের বিরোধী হতে পারে না।

এই জবাবটি অতি উত্তম ও সর্বতোভাবে সঠিক। কিন্তু আল্লাহ যাকে তাওফীক দেন সে ছাড়া আর কেউ এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। এই জওয়াবটি তুমি তুচ্ছ মনে করো না, দেখ! আল্লাহ স্বয়ং এরশাদ করেন :

﴿ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُواْ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٖ ٣٥ ﴾ [فصلت: ٣٥] 

“বস্তুত: যারা ধৈর্য ধারণে অভ্যস্ত তারা ব্যতীত আর কেউই এই মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না, অধিকন্তু মহা ভাগ্যবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কেউই এটা লাভে সমর্থ হয় না”। (সূরা হা’মীম আস-সাজদা: ৩৫)

২. বিস্তারিত জওয়াব

সত্য দ্বীন থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আল্লাহর দুশমনগণ নবী রাসূলদের প্রচারিত শিক্ষার বিরুদ্ধে যে সব ওযর আপত্তি ও বক্তব্য পেশ করে থাকে তার মধ্যে একটি এই যে, তারা বলে থাকে:

“আমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করি না বরং আমরা সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে, কেউই সৃষ্টি করতে, রুযী দিতে, উপকার এবং অপকার সাধন করতে পারে না একমাত্র একক এবং লা-শরীক  আল্লাহ ছাড়া— আর (আমরা এ সাক্ষ্যও দিয়ে থাকি যে,) স্বয়ং মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামও নিজের কোনো কল্যাণ এবং অকল্যাণ সাধন করতে সক্ষম নন। আবদুল কাদের জিলানী ও অন্যান্যরা তো বহু দুরের কথা। কিন্তু একটি কথা এই যে, আমি একজন গুনাহগার ব্যক্তি, আর যারা আল্লাহর নেককার বান্দা তাদের রয়েছে আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদা, তাই তাঁদের মধ্যস্থতায় আমি আল্লাহ্‌র নিকট তাঁর করুণা প্রার্থী হয়ে থাকি।

 যখন তারা এ ধরনের কথা বলে, তখন তার উত্তর তা দিয়ে প্রদান করবে যা পূর্বে গত হয়েছে, আর তা হচ্ছে এই :

যাদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ ‘সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ করেছেন তারাও তুমি যে কথার উল্লেখ করলে তা স্বীকার করত, আর এ কথাও তারা স্বীকার করত যে, প্রতিমাগুলো কোনো কিছুই পরিচালনা করে না। তারা তো কেবল তাদের নিকট মর্যাদা (র দোহাই) ও শাফা‘আতই কামনা করত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা উল্লেখ করেছেন এবং বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন সে সব তাদের পড়ে শুনিয়ে দাও।

এখানে সন্দেহকারী যদি (এই কুটতর্কের অবতারণা করে আর) বলে যে, এই সব আয়াত তো মূর্তিপুজকদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে তোমরা কি ভাবে সৎ ব্যক্তিদেরকে ঠাকুর বিগ্রহের সমতুল্য করে নিচ্ছ অথবা নবীগণকে কি ভাবে ঠাকুর বিগ্রহের শামিল করছ? তখন তুমি আগে যা চলে গেছে তা দিয়েই এর জবাব দিবে[6]

কেননা, যখন সে স্বীকার করছে যে, (রাসূলের যুগের) কাফেরগণও আল্লাহর সার্বভৌম রবূবিয়তের সাক্ষ্য প্রদান করত; আর তারা যাদেরকে (নযর নিয়ায প্রভৃতি পেশ অথবা পূজা অর্চনা ইত্যাদি দ্বারা) উদ্দেশ্য করত, তারা তো তাদের থেকে কেবল সুপারিশই চাইত। কিন্তু যদি সে তার কাজ ও পূর্ববর্তী কাফের লোকদের কাজের মধ্যে যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে[7] তা দিয়ে পার্থক্য করার চেষ্টা করে, তা হলে তাকে বলে দাও : কাফেরগণের মধ্যে কতক তো প্রতিমা পূজা করত, কিন্তু আবার কতক তো এমন ছিল যারা ঐ সব আওলিয়াদের আহ্বান করত[8] যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন:

﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ﴾ [الاسراء: ٥٧] 

“এই মুশরিকরা যাদেরকে আহ্বান করে থাকে, তারা (সে সব সৎ লোকেরা) তো নিজেরাই এজন্য তাঁর (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের অবলম্বন খুঁজে বেড়ায় যে, কোন্‌টি নিকটতর?” (সূরা ইসরা : ৫৭)।

আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঈসা ইবন মারইয়াম ও তাঁর মাকে আহ্বান করত। মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ مَّا ٱلۡمَسِيحُ ٱبۡنُ مَرۡيَمَ إِلَّا رَسُولٞ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهِ ٱلرُّسُلُ وَأُمُّهُۥ صِدِّيقَةٞۖ كَانَا يَأۡكُلَانِ ٱلطَّعَامَۗ ٱنظُرۡ كَيۡفَ نُبَيِّنُ لَهُمُ ٱلۡأٓيَٰتِ ثُمَّ ٱنظُرۡ أَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ . قُلۡ أَتَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗاۚ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ﴾ [المائ‍دة: ٧٥،  ٧٦] 

 “মারইয়ামের পুত্র মসীহ একজন রাসূল ছাড়া তো আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন, আর মসীহের মাতা ছিল একজন সত্যসন্ধ নারী ; তাঁরা উভয়ে (ক্ষুধার সময়) অন্ন ভক্ষণ করতেন, লক্ষ্য কর, কিরূপে আমরা তাদের জন্য প্রমাণগুলিকে বিশদ রূপে বর্ণনা করে দিচ্ছি, অতঃপর আরও দেখ তারা (বিভ্রান্ত হয়ে চলছে) কোন দিকে! জিজ্ঞাসা কর : তোমরা কি আল্লাহকে ছেড়ে এমন কছুর ইবাদত করতে থাকবে যারা তোমাদের অনিষ্ট বা ইষ্টি করার কোনও অধিকার রাখে না ! আর আল্লাহ, একমাত্র তিনিই তো হচ্ছেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা মায়েদা : ৭৫-৭৬)

উল্লেখিত হঠকারীদের নিকটে আল্লাহ্‌ তা‘আলার একথাও উল্লেখ কর :

﴿ وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١ ﴾ [سبا: ٤٠،  ٤١] 

“এবং (স্বরণ করুন সেই দিনের কথা) যে দিন আল্লাহ একত্রে সমবেত করবেন তাদের সকলকে, তারপর ফেরেশতাদিগকে বলবেন : এরা কি বন্দেগী করত তোমাদের? তারা বলবে: পবিত্রতায় সুমহান আপনি! আপনিই তো আমাদের রক্ষক-অভিভাবক, তারা নয়,  কখনই না, বরং অবস্থা ছিল এই যে, এরা পূজা করত জিনদের, এদের অধিকাংশই জিনদের প্রতিই ছিল বিশ্বাসী।”(সূরা সাবা : ৪০-৪১)

অনুরূপভাবে (হঠকারীদের কাছে) আল্লাহর সে বাণীও উল্লেখ কর:

﴿ وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنۡ أَقُولَ مَا لَيۡسَ لِي بِحَقٍّۚ إِن كُنتُ قُلۡتُهُۥ فَقَدۡ عَلِمۡتَهُۥۚ تَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِي وَلَآ أَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ١١٦ ﴾ [المائ‍دة: ١١٦] 

“আর স্মরণ করুন যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা ! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন : তোমরা আমাকে ও আমার মাতাকে আল্লাহ ছাড়াও আর দু’টি ইলাহরূপে গ্রহণ কর? ঈসা বলবেন, মহিমময় আপনি ! যা বলার অধিকার আমার নেই আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব হতে পারে না, আমি ঐ কথা বলে থাকলে আপনি তা নিশ্চয় অবগত আছেন, আমার অন্তরের বিষয় আপনি বিদিত আছেন কিন্তু আপনার অন্তরের বিষয় আমি অবগত নই, নিশ্চয় আপনি, একমাত্র আপনিই তো হচ্ছন সকল গায়েবী বিষয়ের সম্যক পরিজ্ঞাত।” (সূরা মায়েদাহ : ১১৬)

তারপর তাকে বল : তুমি কি (এখন) বুঝতে পারলে যে, আল্লাহ প্রতিমা-পুজকদের যেমন কাফের বলেছেন, তেমনি যারা নেক লোকদের শরণাপন্ন হয় তাদেরকেও কাফের বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে জেহাদও করেছেন।

তারপর যদি সে বলে : কাফেরগণ (আল্লাহ ছাড়া) তাদের নিকট কামনা করে থাকে আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ মঙ্গল অমঙ্গলের মালিক ও সৃষ্টির পরিচালক, আমি তো তাকে ছাড়া অন্য কারোর নিকট কিছুই কামনা করি না। সৎলোকদের এসব বিষয়ে কিছুই করার নেই, তবে আমি তাদের শরণাপন্ন হই এ জন্য যে, তারা আল্লাহর নিকটে সুপারিশ করবে।

এর জবাব হচ্ছে, এ তো কাফেরদের কথার হুবহু প্রতিধ্বনি মাত্র। তুমি তাকে আল্লাহর এই কালাম শুনিয়ে দাও :

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣] 

“আর আল্লাহকে ব্যতীত অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে যারা (তারা বলে) আমরা তো ওদের ইবাদত করি না, তবে (তাদের শরণাপন্ন হই) যাতে তারা সুপারিশ করে আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।” (সূরা যুমার: ৩)

তাছাড়া আল্লাহর এ কালামও তাদের শুনিয়ে দাও :

﴿وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨] 

“তারা (মুশরিকগণ) বলে: এরা হচ্ছে আল্লাহ নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” (সূরা ইঊনুস : ১৮)

আর জেনে রাখ, উপরোক্ত তিনটি শংসয়[9] ও সন্দেহই হচ্ছে তাদের (বর্তমান কালের মুশরিকদের) সবচেয়ে বড় সন্দেহ। যখন তুমি জানতে পারলে যে আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে তাঁর কিতাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, আর তুমি তা সম্যকভাবে বুঝতে পারবে তখন এর পরবর্তী অন্যান্য সন্দেহসমূহের উত্তর দেওয়া আরও সহজ।

অষ্টম অধ্যায়

দোআ ইবাদতের সারৎসার

[যারা মনে করে যে, দো‘আ ইবাদত নয় তাদের প্রতিবাদ]

যদি সে বলে, আমি আল্লাহ ছাড়া কারোর উপাসনা করি না, আর সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের নিকট (বিপদে) আশ্রয় প্রার্থনা, তাদের ডাকা বা আহ্বান করা, তাদের ইবাদত নয়।

তবে তুমি তাকে বল: তুমি কি স্বীকার কর যে, আল্লাহ ইবাদতকে একমাত্র তাঁরই  জন্য খালেস বা বিশুদ্ধ করা তোমার উপর ফরয করেছেন, আর এটা তোমার উপর তাঁর প্রাপ্য হক? যখন সে বলবে হ্যাঁ, আমি তা স্বীকার করি, তখন তাকে বল: এখন আমাকে বুঝিয়ে দাও, কি সেই ইবাদত যা একমাত্র তাঁরই জন্য খালেস করা তোমার উপর তিনি ফরয করেছেন এবং তা তোমার উপর তাঁর প্রাপ্য হক। ইবাদত কাকে বলে এবং তা কত প্রকার তা যদি সে না জানে তবে এ সম্পর্কে তার নিকটে আল্লাহর এই বাণী বর্ণনা করে দাও:

﴿ ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ﴾ [الاعراف: ٥٥] 

“তোমরা ডাক বা আহ্বান কর নিজেদের রবকে বিনীতভাবে ও সংগোপনে”। (সূরা আ‘রাফ : ৫৫)

এটা তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস কর, দো‘আ করা (কাউকে ডাকা বা আহ্বান করা) যে ইবাদত সেটা কি এখন বুঝলে? সে অবশ্যই বলবে, হ্যাঁ; আর দো‘আই তো হচ্ছে ইবাদতের নির্যাস বা সারবস্তু। তখন তুমি তাকে বল, যখন তুমি স্বীকার করে নিলে যে, দো‘আ হচ্ছে ইবাদত, আর তুমি আল্লাহকে দিবানিশি ডাকছ ভয়ে সন্ত্রস্ত আর আশায় উদ্দীপিত হয়ে, এই অবস্থায় যখন তুমি কোনো নবীকে অথবা অন্য কাউকে ডাকছ ঐ একই প্রয়োজন মিটানোর জন্য, তখন কি তুমি আল্লাহর ইবাদতে অন্যকে শরীক করছ না? সে তখন অবশ্যই বলতে বাধ্য হবে, হ্যাঁ শরীক করছি বটে !

অতঃপর তাকে বল, যখন আমি আল্লাহর এই বাণী:

﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢] 

“অতএব তুমি সালাত পড়বে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং (তাঁর নামেই) নাহর[10]/যবাই কর” (সূরা কাউসার: ২) এর উপর ‘আমল করে আল্লাহর আনুগত্য করে তাঁর নাম নিয়েই তুমি যখন নহর/যবাই করছ তখন সেটা কি ইবাদত নয়? এর জওয়াবে সে অবশ্য বলবে : হ্যাঁ, ইবাদতই বটে। এবার তাকে বল, তুমি যদি কোনো সৃষ্টির জন্য যেমন নবী, জিন বা অন্য কিছুর জন্য কুরবানী কর, তবে কি তুমি এই ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করলে না ? সে অবশ্যই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে এবং বলবে: হ্যাঁ।

তাকে তুমি একথাও বল : যে মুশরিকদের সম্বন্ধে কুরআন (এর নির্দিষ্ট আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছে তারা কি ফেরেশ্‌তা, নেকলোক ও লাত উয্‌যা প্রভৃতির ইবাদত করত? সে অবশ্য বলবে : হ্যাঁ, করত। তারপর তাকে বল, তাদের ইবাদত বলতে তাদেরকে ডাকা বা আহ্বান করা, (তাদের নামে) যবাই করা ও আশ্রয় প্রার্থনা ইত্যাদিই কি নয়? নতুবা তারা তো নিজেদেরকে আল্লাহরই বান্দা ও তাঁরই প্রতাপাধীন বলে স্বীকৃতি দিত। আর একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহই সমস্ত বস্তু ও বিষয়ের পরিচালক। কিন্তু তারা আল্লাহর নিকট তাদের (নেককার লোক, লাত ও উযযা প্রভৃতির) যে মর্যাদা রয়েছে (বলে বিশ্বাস করত) ও সুপারিশ (করার ক্ষমতা) রয়েছে বলে বিশ্বাস করত, সেটার জন্যই তাদের আহ্বান করত বা তাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করত। আর এ বিষয়টি একেবারেই সুস্পষ্ট।

নবম অধ্যায়

শরী‘আতসম্মত শাফা‘আত (সুপারিশ) এবং শিরকী শাফা‘আতের মধ্যে পার্থক্য

যদি সে বলে, তুমি কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আতকে অস্বীকার করছ ও তাঁর থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত মনে করছ? তুমি তাঁকে উত্তরে বলবে : না, অস্বীকার করি না। তাঁর থেকে নিজেকে নির্লিপ্তও মনে করি না।

বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই শাফা‘আতকারী, আর তার শাফা‘আত অবশ্যই কবুল করা হবে। আমিও তাঁর শাফা‘আতের আকাঙ্খী। কিন্তু শাফা’আতের যাবতীয় চাবিকাঠি আল্লাহরই হাতে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ﴾ [الزمر: ٤٤] 

“বলুন, সকল প্রকারের শাফা‘আতের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।” (আয-যুমার : ৪৪) আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো শাফা‘আতই অনুষ্ঠিত হবে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥] 

 তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর হুজুরে সুপারিশ করতে পারে কে আছে এমন ব্যক্তি? (আল বাকারাহ : ২৫৫) আর কারো সম্বন্ধেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা‘আত করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সম্বন্ধে আল্লাহ শাফা‘আতের অনুমতি দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন :

 ﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ﴾ [الانبياء: ٢٨] 

 “আর আল্লাহ মর্জী করেন যার সম্বন্ধে সেই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য তাঁরা সুপারিশ করবে না।” (সুরা আম্বিয়া : ২৮ আয়াত)।

আর (এটা স্বীকৃত কথা যে) আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদ (অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেছে, খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন লোক) ছাড়া কিছুতেই রাজী হবেন না। যেমন তিনি বলেছেন,

﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ ﴾ [ال عمران: ٨٥] 

“বস্তুত ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনও দ্বীনের উদ্দেশ্য করবে যে ব্যক্তি, তার পক্ষ থেকে আল্লাহর হুজুরে তা কখনো গৃহীত হবে না।” (আলে ইমরান : ৮৫)।

সুতরাং যখন সাব্যস্ত হলো যে, সমস্ত শাফা‘আত আল্লাহর অধিকারভুক্ত এবং তা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষ, আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া শাফা‘আত করতে সক্ষম হবেন না, আর আল্লাহর অনুমতি একমাত্র মুওয়াহ্‌হিদ (তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকারী) দের জন্যই নির্দিষ্ট, তখন তোমার নিকট একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সকল প্রকারের সমস্ত শাফা‘আতের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। (তাহলে কি তুমি অন্য কারও কাছে এ শাফা‘আত চাইতে পার? কখনও না)

অতএব আমি শাফা‘আত আল্লাহরই নিকট চাই এবং বলি, “হে আল্লাহ ! আমাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফা‘আত থেকে মাহরূম (বঞ্চিত) করো না। হে আল্লাহ ! তুমি তাঁকে আমার জন্য শাফা‘আতকারী বানিয়ে দাও। অথবা অনুরূপ কিছু বলি।

আর যদি সে বলে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাফা‘আতের অধিকার দেয়া হয়েছে, কাজেই আমি তাঁর নিকটেই ঐ বস্তু চাচ্ছি যা আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন।

তখন তুমি উত্তরে বলবে, আল্লাহ তাঁকে শাফাআত করার অধিকার প্রদান করেছেন, আর সাথে সাথে তিনি তোমাকে তাঁর নিকটে শাফাআত চাইতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন,

﴿ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]   

“অতএব (তোমরা ডাকবে বা আহ্বান করবে একমাত্র আল্লাহকে এবং) আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকেই ডাকবে না[11]।” (জিন: ১৮) সুতরাং যদি তুমি আল্লাহকে এই বলে ডাকবে যে, তিনি যেন তাঁর নবীকে তোমার জন্য সুপারিশকারী করে দেন, তখন তুমি আল্লাহর এই নিষেধ বাণী :

﴿ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]   

“আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকেই ডাকবে না। (সুরা জিন : ১৮) এটাকেও যথাযথভাবে পালন কর[12]

আরও একটি কথা হচ্ছে যে, সুপারিশের অধিকার নবী ব্যতীত অন্যদেরও দেয়া হয়েছে। যেমন, ফেরেশতারা সুপারিশ করবেন, ওলীগণও সুপারিশ করবেন। মা‘সুম বাচ্চারাও (তাদের পিতামাতাদের জন্য) সুপারিশ করবেন।

কাজেই তুমি কি সেই অবস্থায় বলতে পারো যে, যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে সুপারিশের অধিকার দিয়েছেন, কাজেই তাদের কাছেও তোমরা শাফাআত চাইবে? যদি তা চাও তবে তুমি নেক ব্যক্তিদের উপাসনায় শামিল হ’লে

যা আল্লাহ তাঁর কিতাবে (হারাম বা অবৈধ বলে) উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে তুমি যদি বল, ‘না, (তাদের কাছে সুপারিশ চেয়ে বেড়াই না), তবে সেই অবস্থায় তোমার এই কথা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতেল হয়ে যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাকে সুপারিশের অধিকার প্রদান করেছেন এবং আমি তার নিকট সেই বস্তুই চাচ্ছি যা তিনি তাকে দান করেছেন।”

দশম অধ্যায়

[এ কথা সাব্যস্ত করা যে, নেক লোকদের নিকট বিপদে আপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা শির্ক এবং যারা একথা অস্বীকার করে তাদেরকে সেটা মেনে নিতে বাধ্য করা]

যদি সে বলে : আমি আল্লাহর সঙ্গে কোনো বস্তুকেই শরীক করি না— কিছুতেই নয়, কক্ষণও নয়। তবে নেক লোকদের নিকট বিপদে আপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা শির্ক নয়।

এর জওয়াবে তাকে বল, যখন তুমি স্বীকার করে নিয়েছ যে, ব্যভিচার অপেক্ষা শির্ককে আল্লাহ তা‘আলা অধিক গুরুতর হারাম বলে নির্দেশিত করেছেন, আর এ কথাও মেনে নিয়েছ যে, আল্লাহ তা‘আলা এই মহা পাপ ক্ষমা করেন না, তাহলে (তুমি বল) সেটা কি বস্তু যা তিনি হারাম করেছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, তিনি তা ক্ষমা করবেন না? কিন্তু এ বিষয়ের উত্তর সে জানে না।

তখন তাকে তুমি বল, তুমি শির্ক কী তা জানলে না, তখন তা থেকে আত্মরক্ষা কীভাবে করবে? অথবা একথাও জানলে না যে, কেন আল্লাহ তোমার উপর শির্ক হারাম করেছেন আর বলে দিয়েছেন যে, তিনি ঐ পাপ মা’ফ করবেন না। আর তুমি এ বিষয়ে কিছুই জানলে না এবং সেটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাও করলে না। তুমি কি ধারণ করে বসে আছ যে, আল্লাহ এটাকে হারাম করেছেন আর তিনি সেটাকে বর্ণনা ব্যতীতই ছেড়ে দিবেন?

যদি সে বলে, শির্ক হচ্ছে মূর্তিপূজা, আর আমরা তো মূর্তিপূজা করছি না, তবে তাকে বল, মূর্তিপূজা কাকে বলে? তুমি কি মনে কর যে, মুশরিকগণ এই বিশ্বাস পোষণ করত যে এসব কাঠ ও পাথর (নির্মিত মূর্তিগুলো) যারা তাদেরকে আহ্বান করে তাদেরকে সৃষ্টি, রেযেক প্রদান কিংবা তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম? একথা তো কুরআন মিথ্যা বলে ঘোষণা করেছে[13]

যদি সে বলে, শির্ক হচ্ছে যারা কাঠ ও পাথর নির্মিত মূতি বা কবরের উপর নির্মিত সৌধ ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে নিজেদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য এদের প্রতি আহ্বান জানায়, এদের উদ্দেশ্যে বলীদান করে এবং বলে যে, এরা সুপারিশ করে আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যাবে, আর এদের বরকতে আল্লাহ আমাদের বিপদ-আপদ দূর করবেন বা আল্লাহ এদের বরকতে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। তবে তাকে বল : হ্যাঁ, তুমি সত্য কথাই বলেছ, আর এটাই তো তোমাদের কর্মকান্ড যা পাথর, কবরের সৌধ প্রভৃতির নিকটে তোমরা করে থাক। ফলত: সে স্বীকার করছে যে, তাদের এই কাজগুলোই হচ্ছে মুর্তিপূজা, আর এটাই তো আমরা চাই[14]

 তাকে একথাও বলা যেতে পারে, তুমি বলছ শির্ক হচ্ছে মূর্তিপূজা, তবে কি তুমি বলতে চাও যে, শুধু মূর্তিপূজার মধ্যেই শির্ক সীমিত, অর্থাৎ এর বাইরে কোনো শির্ক নেই? “নেক লোকদের প্রতি ভরসা করা আর তাদেরকে আহ্বান করা শির্কের মধ্যে কি গণ্য নয়?” (যদি তুমি এরূপ দাবী কর, তবে) তোমার এ দাবী তো আল্লাহ তাঁর কুরআনে খণ্ডন করেছেন; কারণ যারা ফেরেশতা, ঈসা এবং নেক-লোকদের সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করেছে, তাদেরকে তিনি কুফরি করেছে বলে বর্ণনা করেছেন। ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপেই সে তোমার কাছে এ সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে কোনো নেক বান্দাকে শরীক করে তার সেই কাজকেই কুরআনে শির্ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এইটিই তো আমার উদ্দেশ্য[15]

এই বিষয়ের গোপন রহস্য হচ্ছে,

যখন সে বলে, আমি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করি না,

তখন তুমি তাকে বল, আল্লাহর সঙ্গে শির্কের অর্থ কি? তুমি তার ব্য্যাখ্যা দাও।

যদি সে এর ব্যাখ্যায় বলে, তা হচ্ছে মূর্তিপূজা,

তখন তুমি তাকে আবার প্রশ্ন কর, মূর্তি পূজার মানে কি? তুমি আমাকে তার ব্যাখ্যা প্রদান কর।

যদি সে উত্তরে বলে, আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করি না,

তখন তাকে আবার প্রশ্ন কর, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতেরই বা অর্থ কি? এর ব্যাখ্যা দাও। উত্তরে যদি সে কুরআন যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছে[16] সেই ব্যাখ্যাই দেয় তবেতো আমাদের দাবীই সাব্যস্ত হচ্ছে, আর এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর যদি সে তা না জানে[17], তবে সে কেমন করে এমন বস্তুর দাবী করছে যা সে জানে, তবে সে কেনম করে এমন বস্তুর দাবী করছে যা সে জানে না?

আর যদি সে তার এমন ব্যাখ্যা প্রদান করে যা তার প্রকৃত অর্থ নয়, তখন তুমি তার নিকটে আল্লাহর সঙ্গে শির্ক এবং মূর্তিপূজা সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতগুলো বর্ণনা করে দাও। আরও বর্ণনা করে দাও যে এ কাজটিই হুবহু করে চলেছে এ যুগের মুশরিকগণ। আরও বর্ণনা কর যে, শরীকবিহীন একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের বিষয়টিই তো তারা আমাদের কাছ থেকে মেনে নিতে অস্বীকার করছে এবং শোরগোল করছে, যেমন তাদের পূর্বসূরীরা করেছিল এবং বলেছিল,

﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]

“এই লোকটি কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করছে? এ তো ভারী এক আশচর্য্য ব্যাপার !” (সূরা সাদ : ৫)

অতঃপর সে যদি বলে, ফেরেশতা ও আম্বিয়াদের ডাকার কারণে তাদেরকে তো কাফের বলা হয় নি; বরং ফেরেশতাদেরকে যারা আল্লাহর কন্যা বলেছিল তাদেরকেই কাফের বলা হয়েছিল। আমরা তো আবদুল কাদের বা অন্যদেরকে আল্লাহর পুত্র বলি না।

 তার উত্তর হচ্ছে এই যে, (ফেরেশতা ও আম্বিয়াদেরকে ডাকা অবশ্যই শির্ক। সেটা বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো আয়াতে আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত  করাকে কুফরী বলা হয়েছে; কারণ) সন্তানকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত করাটাই স্বয়ং আলাদা কুফরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ١ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ٢ ﴾ [الاخلاص: ١،  ٢] 

“বল, তিনিই একক আল্লাহ (তিনি ব্যতীত আল্লাহ আর কেউ নেই) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী[18]” (সূরা ইখলাস : ১-২ আয়াত]

“আহাদ” এর অর্থ হ’ল, তিনি একক এবং তার সমতুল্য কেউই নেই। আর “সামাদ” এর অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজনে একমাত্র যার স্মরণ নেয়া হয়। অতএব যে এটাকে অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে[19] -যদিও সে সূরাটিকে অস্বীকার করে না।

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ مَا ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ مِن وَلَدٖ وَمَا كَانَ مَعَهُۥ مِنۡ إِلَٰهٍۚ ﴾ [المؤمنون: ٩١] 

“আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি, আর তাঁর সঙ্গে অপর কোনো ইলাহ্‌ও (উপাস্য) নেই।” (মুমিনুন : ৯১) এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কুফরীর দুটি প্রকরণের উল্লেখ করেছেন, আর তিনি এতদোভয়কেই পৃথক ভাবে কুফরি সাব্যস্ত করেছেন।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ شُرَكَآءَ ٱلۡجِنَّ وَخَلَقَهُمۡۖ وَخَرَقُواْ لَهُۥ بَنِينَ وَبَنَٰتِۢ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ﴾ [الانعام: ١٠٠] 

 “আর এই (অজ্ঞ) লোকগুলো জিনকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে নিয়েছে অথচ ঐ গুলোকে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, আর তাঁর জন্য তারা কতকগুলো পুত্র-কন্যাও উদ্ভাবন করে নিয়েছে কোন জ্ঞান ব্যতিরেকে—কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়া।” (আন‘আম :১০০) এ আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা দুই প্রকারের কুফরীকে পৃথক ভাবে উল্লেখ করেছেন।

এর প্রমাণ এটাও হতে পারে যে, যারা লাতকে আহ্বান করে কাফের হয়ে গিয়েছিল, যদিও লাত ছিল একজন সৎলোক। তারা তাকে আল্লাহর ছেলেও বলেনি। অনুরূপভাবে যারা জিনদের পূজা করে কাফের হয়ে গিয়েছিল তারাও তাদেরকে আল্লাহর ছেলে বলে নি[20]

তদ্রূপ “মুরতাদ” (যারা ঈমান আনার পর কাফের হয়ে যায় তাদের) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে চার মাযহাবের আলেমগণ বলেছেন যে, মুসলিম যদি ধারণা রাখে যে, আল্লাহর ছেলে রয়েছে তবে সে “মুরতাদ” হয়ে গেল। তারাও উক্ত দুই প্রকারের কুফরীর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এটা তো খুবই স্পষ্ট।

 আর যদি সে আল্লাহর এই কালাম পেশ করে :

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [يونس: ٦٢] 

“সাবধান, আল্লাহর ওলী যারা, কোনো আশঙ্কা নেই তাদের এবং কখনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না তারা।” (ইউনুস : ৬২)

তবে তুমি বল : হ্যাঁ, একথা তো অভ্রান্ত সত্য, কিন্তু তাই বলে তাদের পূজা করা চলবে না।

আর আমরা কেবল আল্লাহর সঙ্গে অপর কারো পূজা এবং তার সঙ্গে শির্কের কথাই উল্লেখ (করে তা অস্বীকার) করছি। নচেৎ আওলিয়াদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ও তাদের অনুসরণ করা এবং তাদের কারামতগুলোকে স্বীকার করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্যআর আওলিয়াদের কারামতকে বিদ‘আতী ও বাতিলপন্থীগণ ছাড়া কেউ অস্বীকার করে না।

আল্লাহর দ্বীন দুই প্রান্ত সীমার (অতিরঞ্জন ও কমতি করার) মধ্যস্থলে, আর বিপরীতমুখী ভ্রষ্টতার মাঝখানে হেদায়াত এবং দুই বাতিলের মধ্যপথে অবস্থিত হক।

একাদশ অধ্যায়

[আমাদের যুগে লোকদের শির্ক অপেক্ষা পূ্র্ববর্তী লোকদের শির্ক ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা (দু’দিক থেকে)]

তুমি যখন বুঝতে পারলে যে, যে বিষয়টিকে আমাদের যুগের মুশরিকগণ নাম দিয়েছেন ই‘তেকাদ’—(ভক্তি মিশ্রিত বিশ্বাস)[21] সেটাই হচ্ছে সেই শির্ক; যার বিরুদ্ধে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল যার কারণে লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন। তখন তুমি জেনে রাখ যে, পূর্ববর্তী লোকদের শির্ক ছিল বর্তমান যুগের লোকদের শির্ক অপেক্ষা অধিকতর হালকা বা লঘুতর। আর তার কারণ হচ্ছে দু’টি:

এক. পূর্ববর্তী লোকগণ কেবল সুখ স্বাচ্ছন্দের সময়েই আল্লাহর সঙ্গে অপরকে শরীক করতো এবং ফেরেশতা আওলিয়া ও ঠাকুর-দেবতাদেরকে আহবান জানাতো, কিন্তু বিপদ আপদের সময় একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতো, সে ডাক হ’ত সম্পূর্ণ নির্ভেজাল। যেমন আল্লাহ তাঁর পাক কুরআনে বলেছেন:

﴿ وَإِذَا مَسَّكُمُ ٱلضُّرُّ فِي ٱلۡبَحۡرِ ضَلَّ مَن تَدۡعُونَ إِلَّآ إِيَّاهُۖ فَلَمَّا نَجَّىٰكُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ أَعۡرَضۡتُمۡۚ وَكَانَ ٱلۡإِنسَٰنُ كَفُورًا ٦٧ ﴾ [الاسراء: ٦٧] 

“সাগর বক্ষে যখন কোন বিপদ তোমাদেরকে স্পর্শ করে, আল্লাহ ব্যতীত আর যাদেরকে ডেকে থাক তোমরা, তারা সকলেই তো তখন (মন হ’তে দূরে) সরে যায়, কিন্তু আল্লাহ যখন তোমাদেরকে স্থলভাগে পৌঁছিয়ে উদ্ধার করেন, তখন তোমরা অন্যদিকে ফিরে যাও; নিশ্চয় মানুষ হচ্ছে অতিশয় না অকৃতজ্ঞ।” (বনী ইসরাঈল : ৬৭)

আল্লাহ এ কথাও বলেছেন:

﴿ قُلۡ أَرَءَيۡتَكُمۡ إِنۡ أَتَىٰكُمۡ عَذَابُ ٱللَّهِ أَوۡ أَتَتۡكُمُ ٱلسَّاعَةُ أَغَيۡرَ ٱللَّهِ تَدۡعُونَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٤٠ بَلۡ إِيَّاهُ تَدۡعُونَ فَيَكۡشِفُ مَا تَدۡعُونَ إِلَيۡهِ إِن شَآءَ وَتَنسَوۡنَ مَا تُشۡرِكُونَ ٤١ ﴾ [الانعام: ٤٠،  ٤١] 

“বল, তোমরা নিজেদের সম্বন্ধে বিবেচনা করে দেখ। তোমাদের প্রতি আল্লাহর কোন আযাব যদি আপতিত হয় অথবা কিয়ামত দিবস যদি এসে পড়ে তখন কি তোমরা আহ্বান করবে আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকেও? (উত্তর দাও) যদি তোমরা সত্যবাদী হও। কখনই না, বরং তোমরা আহ্বান করবে তাঁকে, অতঃপর যে আপদের কারণে তাঁকে আহ্বান করছ, ইচ্ছা করলে তিনি সেই আপদগুলো দূর করে দিবেন। (আহ্বানের কারণস্বরূপ আপদগুলো মোচন করে দিবেন) আর তোমরা যা কিছুকে আল্লাহর শরীক করছ তাদেরকে তোমরা তখন ভূলে যাবে।” (আন‘আম :৪০-৪১)

 আল্লাহ তা‘আলা একথাও বলেছেন:

﴿ ۞وَإِذَا مَسَّ ٱلۡإِنسَٰنَ ضُرّٞ دَعَا رَبَّهُۥ مُنِيبًا إِلَيۡهِ ثُمَّ إِذَا خَوَّلَهُۥ نِعۡمَةٗ مِّنۡهُ نَسِيَ مَا كَانَ يَدۡعُوٓاْ إِلَيۡهِ مِن قَبۡلُ وَجَعَلَ لِلَّهِ أَندَادٗا لِّيُضِلَّ عَن سَبِيلِهِۦۚ قُلۡ تَمَتَّعۡ بِكُفۡرِكَ قَلِيلًا إِنَّكَ مِنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلنَّارِ ٨ ﴾ [الزمر: ٨] 

“যখন কোন দু:খ কষ্ট আপতিত হয় মানুষের উপর তখন সে নিজ রবকে ডাকতে থাকে তদ্‌গতভাবে, অতঃপর যখন তিনি তাকে কোনো নেয়ামতের দ্বারা অনুগৃহীত করেন, তখন সে ভুলে যায় সেই বস্তুকে যার জন্য সে পূ্র্বে প্রার্থনা করেছিল এবং আল্লাহর বহু সদৃশ ও শরীক বানিয়ে নেয়; তাঁর পথ থেকে (লোকদেরকে) ভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে। বল, কিছুকাল তুমি নিজের কুফরজনিত সুখ সুবিধা ভোগ করলেও, নিশ্চয় তুমি হচ্ছ জাহান্নামের অধিবাসীদের একজন।” (যুমার : ৮)

আর আল্লাহর এই বাণী :

﴿ وَإِذَا غَشِيَهُم مَّوۡجٞ كَٱلظُّلَلِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ﴾ [لقمان: ٣٢] 

“যখন পর্বতের ন্যায় তরঙ্গমালা তাদের উপর ভেঙ্গে পড়ে, তখন তারা আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে তাঁকে ডাকতে থাকে।” (সূরা লোকমান: ৩২)

 যে ব্যক্তি এই বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হ’ল যা আল্লাহ তাঁর কেতাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন- যার সারৎসার হচ্ছে এই যে, যে মুশরিকদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে করেছিলেন তারা তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার সময়ে আল্লাহকেও ডাকতো আবার আল্লাহ ছাড়া অন্যকেও ডাকতো, কিন্তু বিপদ-বিপর্যয়ের সময় তারা একক ও লা শরীক আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকেই ডাকতো না, তারা  বরং সে সময় অন্য সব মাননীয় ব্যক্তি ও পূজ্য সত্তাদের ভুলে যেতো, সেই ব্যক্তির নিকট পূর্ব যামানার লোকদের শির্ক এবং আমাদের বর্তমান যুগের লোকদের শির্কের পার্থক্যটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন লোক কোথায় পাওয়া যাবে যার হৃদয় এই বিষয়টি উত্তমরূপে ও গভীর ভাবে উপলব্ধি করবে ? একমাত্র আল্লাহই আমাদের সহায় !

দুই. পূর্ব যামানার লোকগণ আল্লাহর সঙ্গে এমন ব্যক্তিদের আহ্বান করতো যারা ছিল আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত, তারা হয় নবী-রাসূলগণ, নয় তো ওলী-আওলীয়া, নতুবা ফেরেশতাগণ। এছাড়া তারা হয়তো পূজা করতো এমন বৃক্ষ অথবা পাথরের যারা আল্লাহর একান্ত বাধ্য ও হুকুমবরদার, কোনোক্রমেই তারা অবাধ্য নয়, আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী নয়।

কিন্তু আমাদের এই যুগের লোকেরা আল্লাহর সঙ্গে এমন লোকদের ডাকে এবং তাদের নিকট প্রার্থনা জানায় যারা নিকৃষ্টতম অনাচারী (ফাসেক), আর যারা তাদের নিকট ধর্ণা দেয় ও প্রার্থনা জানায় তারাই তাদের অনাচারগুলোর কথা ফাঁস করে দেয়, সে অনাচারগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যভিচার, চুরি এবং নামায পরিত্যাগের মত গর্হিত কাজসমূহ। আর যারা নেক লোকদের প্রতি আস্থা রেখে তাদের পূজা করে বা এমন বস্তুর পূজা করে যেগুলো কোন পাপ করে না— যেমন : গাছ, পাথর ইত্যাদি, তারা ঐ সব লোকদের থেকে নিশ্চয় লঘুতর পাপী যারা ঐ লোকদের পূজা করে যাদের অনাচার ও পাপাচারগুলোকে তারা স্বয়ং দর্শন করে থাকে এবং তার সাক্ষ্যও প্রদান করে থাকে[22]

দ্বাদশ অধ্যায়

[‘যে ব্যক্তি দ্বীনের কতিপয় ফরয ওযাজেব অর্থাৎ অবশ্যকরণীয় কর্তব্য পালন করে, সে তাওহীদ বিরোধী কোন কাজ করে ফেললেও কাফের হয়ে যায় না।’ যারা এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, তাদের ভ্রান্তির নিরসন এবং তার বিস্তারিত প্রমাণপঞ্জি]

উপরের আলোচনায় একথা সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, যাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদ করেছেন তারা এদের (আজকের দিনে শির্কী কাজে লিপ্ত নামধারী মুসলিমদের) চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধিমান ছিল এবং তাদের শির্ক অপেক্ষাকৃত লঘু ছিল।

অতঃপর একথাও তুমি জেনে রাখো যে, এরা আমাদের বক্তব্যের ব্যাপারে একটি সংশয় উপস্থাপন করে, যা তাদের অন্যতম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ

অতএব এই ভ্রান্তির  অপনোদন ও সন্দেহের অবসানকল্পে নিম্নের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন।

তারা বলে থাকে: যাদের প্রতি সাক্ষাতভাবে কুরআন নাযিল হয়েছিল (অর্থাৎ মক্কার কাফির মুশরিকগণ) তারা ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বুদ নেই’ একথার সাক্ষ্য প্রদান করে নি, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যা বলেছিল, তারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছিল, তারা কুরআনকে মিথ্যা বলেছিল এবং বলেছিল এটা একটা জাদু-মন্ত্র। কিন্তু আমরা তো সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে, আল্লাহ ছাড়া নেই কোনো মা‘বুদ এবং (এ সাক্ষ্যও দেই যে,) নিশ্চয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল, আমরা কুরআনকে সত্য বলে জানি ও মানি আর পুনরুত্থান এর উপর বিশ্বাস রাখি, আমরা নামায পড়ি এবং রোযাও রাখি, তবু আমাদেরকে এদের (উক্ত বিষয়ে অবিশ্বাসী কাফেরদের) মত মনে কর কেন?

এর জওয়াব হচ্ছে এই যে, এ বিষয়ে সমগ্র ‘আলেম সমাজ তথা শরী‘আতের বিদ্বান মণ্ডলী একমত যে, একজন লোক যদি কোনো কোনো ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য বলে মানে, আর কোনো কোনো বিষয়ে তাঁকে মিথ্যা বলে ভাবে, তবে সে নির্ঘাত কাফের, সে ইসলামে প্রবিষ্টই’ হতে পারে না; এই একই কথা প্রযোজ্য হবে তার উপরেও যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস করল, আর কতক অংশকে অস্বীকার করল, যেমন কেউ তাওহীদকে স্বীকার করল কিন্তু নামায যে ফরয তা মেনে নিল না। অথবা তাওহীদও স্বীকার করল, নামাযও পড়ল কিন্তু যাকাত যে ফরয তা মানল না; অথবা এগুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু রোযাকে অস্বীকার করে বসল কিংবা ঐগুলো সবই স্বীকার করল কিন্তু একমাত্র হজ্বকে অস্বীকার করল, এরা সবাই হবে কাফের।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানায় কতক লোক হজ্বকে মেনে নিতে চায় নি বলে[23] তাদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন,

﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

“(পথের কষ্ট সহ্য করতে এবং) রাহা খরচ বহনে সক্ষম যে ব্যক্তি সে (শ্রেণির) সমস্ত মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই গৃহের (কা‘বাতুল্লাহর) হজ্ব করা অবশ্য কর্তব্য, আর যে ব্যক্তি তা অমান্য করল (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ হচ্ছেন সমুদয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী” [আলে ইমরান: ৯৭]

কোনো ব্যক্তি যদি এগুলো সমস্তই (অর্থাৎ তাওহীদ, নামায, যাকাত, রামাযানের সিয়াম, হজ্ব) মেনে নেয়, কিন্তু পুনরুত্থানের কথা অস্বীকার করে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের হয়ে যাবে। তার রক্ত এবং তার ধন-দৌলত সব হালাল হবে (অর্থাৎ তাকে হত্যা করা এবং তার ধন-মাল গ্রহণ করা আইন-সিদ্ধ হবে) যেমন আল্লাহ বলেছেন :

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُواْ بَيۡنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٖ وَنَكۡفُرُ بِبَعۡضٖ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيۡنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا ١٥٠ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ حَقّٗاۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ١٥١ ﴾ [النساء: ١٥٠،  ١٥١] 

“নিশ্চয় যারা আমান্য করে আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলদেরকে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের (আনুগত্যের) মধ্যে প্রভেদ করতে চায়, আর বলে কতককে আমরা বিশ্বাস করি অপর কতককে অমান্য করি এবং তারা ঈমানের ও কুফরের মাঝামাঝি একটা  পথ আবিষ্কার করে নিতে চায়— এই যে লোক সত্যই তারা হচ্ছে কাফের, বস্তুত কাফেরদের জন্য আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি এক লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (আন নিসা: ১৫০-১৫১)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাঁর কালামে পাকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের কিছু অংশকে মানবে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করবে, সে সত্যিকারের কাফের এবং তার প্রাপ্য হবে সেই বস্তু (শাস্তি) যা উপরে উল্লিখিত হয়েছে, সেহেতু এ সম্পর্কিত ভ্রান্তিরও অপনোদন ঘটেছে[24]

আর এ বিষয়টি জনৈক ‘আহ্‌সা’-বাসী আমার নিকট প্রেরিত তার পত্রে উল্লেখ করেছেন।

আর তাকে এ-কথাও বলা যাবে, তুমি যখন স্বীকার করছ যে, যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলকে সত্য জানবে আর কেবল নামাযের ফরয হওয়াকে অস্বীকার করবে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের হবে, আর তার জান-মাল হালাল হবে; অনুরূপভাবে সব বিষয় মেনে নিয়ে যদি পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তবুও সে কাফের হয়ে যাবে।

তদ্রূপ সে কাফের হয়ে যাবে যদি ঐ সমস্ত বস্তুর উপর ঈমান আনে, আর কেবলমাত্র রামযানের রোযাকে অস্বীকার করে। এতে কোনো মাযহাবেরই দ্বিমত নেই। আর কুরআনও এ কথাই বলেছে, যেমন আমরা ইতিপূর্বে বলেছি।

আর এটা জানা কথা যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব ফরয কাজ নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে তাওহীদ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় এবং তা নামায, রোযা ও হজ্ব হতেও শ্রেষ্ঠতর।

তাহলে যখন মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আনীত ফরয, ওয়াজিবসমূহের সবগুলোকে মেনে নিয়ে ঐগুলোর একটি মাত্র অস্বীকার করে কাফের হয়ে যায় তখন কি করে সে কাফের না হয়ে পারে যদি সমস্ত রাসূলদের দ্বীনের মূলবস্তু তাওহীদকেই সে অস্বীকার করে বসে? সুবহানাল্লাহ ! কি বিস্ময়কর এই মুর্খতা !

তাকে এ কথাও বলা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ বানু হানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা সাক্ষ্য প্রদান করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ্‌ নেই, আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এ ছাড়া তারা আযানও দিত এবং নামাযও পড়ত।

সে যদি বলে যে, তারা তো মুসায়লামা (কায্‌যাব)-কে একজন নবী বলে মেনেছিল। তবে তার উত্তরে বলবে : ঐটিই তো আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা যদি কেউ কোনো ব্যক্তিকে নবীর মর্যাদায় উন্নীত করার কারণে কাফের হয়ে যায় এবং তার জান মাল হালাল হয়ে যায়, এই অবস্থায় তার দু’টি সাক্ষ্য (প্রথম সাক্ষ্য: আল্লাহ ছাড়া নেই অপর কোনো সত্য ইলাহ, দ্বিতীয় সাক্ষ্য: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল) তার কোনই উপকার সাধন করবে না। নামাযও তার কোনো উপকার করতে সক্ষম হবে না। অবস্থা যখন এই, তখন সেই ব্যক্তির পরিণাম কি হবে যে, শামসান, ইউসুফ[25] বা কোনো সাহাবী বা নবীকে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্‌র সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে? পাকপবিত্র তিনি, তাঁর শান-শওকত কত উচ্চ !

﴿ كَذَٰلِكَ يَطۡبَعُ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ ٥٩ ﴾ [الروم: ٥٩] 

“আল্লাহ এ ভাবেই যাদের জ্ঞান নেই, তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।” (সূরা রূম : ৫১)

প্রতিপক্ষকে এটাও বলা যাবে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যাদেরকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন তারা সকলেই ইসলামের দাবীদার ছিল এবং ‘আলীর অনুগামী ছিল, অধিকন্তু তারা সাহাবীগণের নিকটে শিক্ষা লাভ করেছিল। কিন্তু তারা আলীর সম্বন্ধে ঐ রূপ বিশ্বাস রাখত যেমন ইউসুফ, শামসান এবং তাদের মত আরও অনেকের সম্বন্ধে (এখন) বিশ্বাস পোষণ করা হয়

(প্রশ্ন হচ্ছে) তাহলে কি করে সাহাবীগণ তাদেরকে (ঐ ভাবে) হত্যা করার ব্যাপারে এবং তাদের কুফরীর উপর একমত হলেন? তা হলে তোমরা কি ধারণা করে নিচ্ছ যে, সাহাবীগণ মুসলিমকে কাফের রূপে আখ্যায়িত করেছেন? নাকি তোমরা ধারণা করছ যে, ‘তাজ’ এবং তার অনুরূপ অন্যান্যের উপর বিশ্বাস রাখা ক্ষতিকর নয়, কেবল ‘আলীর প্রতি ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখাই কুফরী?

আর এ কথাও বলা যেতে পারে যে, বানু আব্বাসের শাসনকালে যে বানু ওবায়দ আল-কাদ্দাহ মরক্কো প্রভৃতি দেশে ও মিসরে রাজত্ব করেছিল, তারা সকলেই ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” কলেমার সাক্ষ্য দিত— ইসলামকেই তাদের ধর্ম বলে দাবী করত। জুম‘আহ্ ও জামা‘আতে নামাযও আদায় করত। কিন্তু যখন তারা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের চাইতেও লঘু কোনো কোনো বিষয়ে শরী‘আতের বিধি ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণের কথা প্রকাশ করল, তখন তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপর ‘আালেম সমাজ একমত হলেন। আর তাদের দেশকে দারুল হরব বা যুদ্ধের দেশ বলে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমগণ যুদ্ধ করলেন। আর মুসলিমদের শহরগুলোর মধ্যে যেগুলো তাদের হস্তগত হয়েছিল তা পুনরুদ্ধার করে নিলেন।

তাকে আরও বলা যেতে পারে যে, পূর্ব যুগের লোকদের মধ্যে যাদের কাফের বলা হতো তাদের যদি এজন্যই তা বলা হত যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে মিথ্যা জানা এবং পুনরুত্থান প্রভৃতিকে অস্বীকার করা প্রভৃতি (কুফরী কাজ) একত্রে করেছিল— তাহলে “বাবু হুকমিল মুরতাদ” বা “মুরতাদের[26] হুকুম” নামীয় অধ্যায় কী অর্থ বহন করবে, যা সব মাযহাবের আলেমগণ বর্ণনা করেছেন?

সে অধ্যায়ে তারা মুরতাদ্দের বিভিন্ন প্রকরণের উল্লেখ করেছেন, আর প্রত্যেক প্রকারের মুরতাদকে কাফের বলে নির্দেশিত করে তাদের জান এবং মাল হালাল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা অনেকের নিকট কতিপয় সাধারণ বিষয় যেমন অন্তর হতে নয়, মুখ দিয়ে একটা অবঞ্ছিত কথা বলে ফেলল অথবা ঠাট্টা-মশকরার ছলে বা খেল-তামাশায় কোন অবাঞ্ছিত কথা উচ্চারণ করে ফেলল— এমন অপরাধীদেরও মুরতাদ্দ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তাদের এ কথাও বলা যেতে পারে, যে কথা তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন,

﴿ يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُواْ وَلَقَدۡ قَالُواْ كَلِمَةَ ٱلۡكُفۡرِ وَكَفَرُواْ بَعۡدَ إِسۡلَٰمِهِمۡ ﴾ [التوبة: ٧٤]   

অর্থাৎ— “তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলছে যে, তারা কিছুই বলে নি; অথচ কুফরী কথাই তারা নিশ্চয় বলেছে, ফলে ইসলামকে স্বীকার করার পর তারা কাফের হয়ে গিয়েছে।” (সূরা তাওবা :৭৪)

তুমি কি শোন নি, মাত্র একটি কথার জন্য আল্লাহ এক দল লোককে কাফের বলছেন, অথচ তারা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমসাময়িককালের লোক এবং তাঁর সঙ্গে জেহাদ করেছে, নামায পড়েছে, যাকাত দিয়েছে, হজ্ব পালন করেছে এবং তাওহীদের উপর বিশ্বাস রেখেছে?

অনুরূপভাবে ঐ সব লোক, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

﴿قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٦٥،  ٦٦] 

“তুমি বল, তোমরা কি ঠাট্টা তামাশা করছিলে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতগুলোর এবং তাঁর রাসূলের সম্বন্ধে? এখন আর কৈফিয়ত পেশ করো না। তোমরা নিজেদের ঈমান আনার পর কাফের হয়ে গেছ।” (তাওবা: ৬৫-৬৬)

এ-সব লোকদের সম্বন্ধে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা ঈমান আনার পর কাফের হয়েছে। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে তাবুকের যুদ্ধে যোগদান করেছিল, তারা তো মাত্র একটি কথাই বলেছিল এবং সেটাও হাসি-ঠাট্টার ছলে। অতএব তুমি এ সংশয় সম্পর্কে চিন্তা করে দেখ, যাতে তারা বলে, তোমরা মুসলিমদের মধ্যে এমন লোককে কাফের বলছ যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিচ্ছে, তারা নামায পড়ছে, রোযা রাখছে। তারপর তাদের এ সংশয়ের জওয়াবও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ। কেননা, এই পুস্তকের বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে এটাই অধিক উপকারজনক।

এই বিষয়ের আর একটা প্রমাণ হচ্ছে কুরআনে বর্ণিত সেই কাহিনী, যা আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের সম্পর্কে বলেছেন। তাদের ইসলাম, তাদের জ্ঞান এবং সত্যাগ্রহ সত্বেও তারা মূসা ‘আলাইহি সালাম-কে বলেছিল :

﴿ٱجۡعَل لَّنَآ إِلَٰهٗا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةٞۚ ﴾ [الاعراف: ١٣٨] 

 আমাদের জন্যও একটা ইলাহ বানিয়ে দাও, যেমন তাদের রয়েছে অনেক ইলাহ। (সূরা আ‘রাফ : ১৩৮)

অনুরূপভাবে সাহাবীগণের মধ্যে কেউ বলেছিলেন :

»اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ«

“আমাদের জন্য লটকানোর জায়গা প্রতিষ্ঠা করে দিন।” তখন নবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলফ করে বললেন, এটা তো বনী ইসরাইলদের মত কথা, যা তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-কে বলেছিল: আমাদের জন্যও একটা ইলাহ্‌ বানিয়ে দাও[27]।”

ত্রয়োদশ অধ্যায়

মুসলিম সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শিরক হতে যারা তওবা করে তাদের সম্বন্ধে হুকুম কি ?

[মুসলিমদের মধ্যে যখন কোনো এক প্রকারের শির্ক অজ্ঞাতসারে অনুপ্রবেশ করে ফেলে তারপর তারা তা হতে তওবা করে, তখন তাদের সম্বন্ধে হুকুম কি ?]

মুশরিকদের মনে একটা সন্দেহের উদ্রেক হয়, যা তারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে বর্ণনা করে, আর তা হচ্ছে এই যে, তারা বলে, বনী ইসরাঈলেরা “আমাদের জন্য উপাস্য দেবতা বানিয়ে দিন” একথা বলে তারা কাফের হয়ে যায় নি। অনুরূপভাবে যারা বলেছিল, “আমাদের জন্য লটকানোর জায়গা প্রতিষ্ঠা করে দিন”, তারাও কাফেরে পরিণত হয় নি।

এর জওয়াব হচ্ছে এই যে, বানী ইসরাঈলেরা যে প্রস্তাব পেশ করেছিল তা তারা কার্যে পরিণত করে নি, তেমনিভাবে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ‘যাতে আনওয়াত’ (লটকানোর স্থান) প্রতিষ্ঠা করে দিতে বলেছিল তারাও তা করে নি। বানী-ইসরাঈল যদি তা করে ফেলতো, তবে অবশ্যই তারা কাফের হয়ে যেতো। এ বিষয়ে কারো কোন ভিন্ন মত নেই।

একইরূপে এই বিষয়েও কোনো মতভেদ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হুকুম অমান্য করে—নিষেধ অগ্রাহ্য করে ‘যাতে আনওয়াত’ এর প্রতিষ্ঠা করত তাহলে তারাও কাফের হয়ে যেত, আর এটাই হচ্ছে আমাদের বক্তব্য।

এই ঘটনা থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে যে, কোন মুসলিম বরং কোন ‘আলেম কখনও কখনও শির্কের বিভিন্ন প্রকরণে লিপ্ত হয় কিন্তু সে তা উপলব্ধি করতে পারে না, ফলে এত্থেকে বাঁচার জন্য শিক্ষা  ও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। আর জাহেলরা[28] যে বলে— ‘আমরা তাওহীদ বুঝি’, এটা তাদের সবচেয়ে বড় মুর্খতা ও শয়তানের চক্রান্ত[29]

আর এটাও জানা গেল যে, মুজতাহিদ মুসলিমও যখন না জেনে না বুঝে কুফরী কথা বলে ফেলে, তখন তার ভুল সম্বন্ধে অবহিত করা হলে সে যদি সেটা বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে তা হলে সে কাফের হবে না, যেমন বানী ইসরাঈল করেছিল এবং যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ‘যাতে আনওয়াত’ চেয়েছিল।

আর এর থেকে এটাও বুঝা যাচ্ছে যে, তারা কুফরী না করলেও তাদেরকে (তাদের পক্ষ থেকে কুফরী ও শির্ক চাওয়ার কারণে) কঠোর কথা বলতে হবে, যেমন নবী  সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন।

চতুর্দশ অধ্যায়

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলেমা মুখে উচ্চারণই যথেষ্ট নয়

[যারা মনে করে যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে বলাই তাওহীদের জন্য যথেষ্ট, বাস্তবে তার বিপরিত কিছু করলেও ক্ষতি নেই, তাদের উক্তি ও যুক্তির খণ্ডন]

মুশরিকদের মনে আর একটা সংশয় বদ্ধমূল হয়ে আছে, তা হল এই যে, তারা বলে থাকে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কলেমা পাঠ করা সত্ত্বেও উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে হত্যা করেছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই হত্যাকাণ্ডটাকে সমর্থন করেন নি। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীসটিও তারা পেশ করে থাকে যেখানে তিনি বলেছেন, “আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে (মুখে উচ্চারণ করে) “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” তদ্রূপ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণকারীদের হত্যা না করা সম্বন্ধে আরও অনেক হাদীস তারা তাদের মতের সমর্থনে পেশ করে থাকে।

এই মূর্খদের এসব প্রমাণ পেশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যারা মুখে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করবে, তারা যা ইচ্ছা তাই করুক, তাদেরকে কাফের বলা যাবে না, হত্যাও করা যাবে না। এ-সব জাহেল মুশরিকদের বলে দিতে হবে যে, একথা সর্বজনবিদিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদেরকে কয়েদ করেছেন যদিও তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলত।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ বানু হানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন যদিও তারা সাক্ষ্য দিয়েছিল যে, ‘আল্লাহ ছাড়া নেই কোনো ইলাহ এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল; তারা নামাযও পড়তো এবং ইসলামেরও দাবী করত। ঐ একই অবস্থা তাদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য যাদেরকে ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ সব (বর্তমান কালে যারা শির্ক করে সে-সব) জাহেলরা স্বীকার করে যে, যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তারা কাফের হয়ে যায় এবং হত্যারও যোগ্য হয়ে যায়— তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা সত্বেও। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামের রুকনসমূহের যে কোনো একটিকে অস্বীকার করে, সেও কাফের হয়ে যায় এবং সে হত্যার যোগ্য হয় যদিও সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে”।

তা হলে ইসলামের একটি শাখা অঙ্গ অস্বীকার করার কারণে যদি তার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ তার কোনো উপকারে না আসে, তবে রাসূলগণের দ্বীনের মূল ভিত্তি যে তাওহীদ এবং যা হচ্ছে ইসলামের মূখ্য বস্তু, যে ব্যক্তি সেই তাওহীদকেই অস্বীকার করল তাকে ঐ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ কেমন করে বাঁচাতে সক্ষম হবে? কিন্তু আল্লাহর মুশমনরা হাদীসসমূহের তাৎপর্য বুঝে না।

ওসামা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তিনি একজন ইসলামের দাবীদারকে হত্যা করেছিলেন এই ধারণায় যে, সে তার জান ও মালের ভয়েই ইসলামের দাবী জানিয়েছিল।

কোনো মানুষ যখন ইসলামের দাবী করবে তার থেকে ইসলাম বিরোধী কোনো কাজ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সে তার জানমালের নিরাপত্তা লাভ করবে। এ সম্বন্ধে কুরআনের ঘোষণা এই যে,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَتَبَيَّنُواْ ﴾ [النساء: ٩٤] 

“হে মুমিন সমাজ ! যখন তোমরা আল্লাহর রাহে বহির্গত হও, তখন (কাউকেও হত্যা করার পূর্বে) সব বিষয় তদন্ত করে দেখবে।” (সূরা নিসা : ৯৪) অর্থাৎ তার সম্বন্ধে তথ্যাদি নিয়ে দৃঢ়ভাবে সুনিশ্চিত হবে।

এই আয়াত পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, এরূপ ব্যাপারে হত্যা থেকে বিরত থেকে তদন্তের পর স্থির নিশ্চিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য। তদন্তের পর যদি তার ইসলাম বিরোধী হওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় তবে তাকে হত্যা করা হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, (ফাতাবাইয়ানু) অর্থাৎ ‘তদন্ত করে দেখ’। তদন্ত করার পর দোষী সাব্যস্ত হলে হত্যা করতে হবে। যদি এই অবস্থাতে হত্যা না করা হয় তা হলে : ‘ফাতাবাইয়ানু’ অর্থাৎ স্থির নিশ্চিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

 এভাবে অনুরূপ হাদীসগুলোর অর্থও বুঝে নিতে হবে। ঐগুলোর অর্থ হবে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মধ্যে তাওহীদ ও ইসলাম প্রকাশ্যভাবে পাওয়া যাবে তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকতে হবে— যে পর্যন্ত বিপরীত কোন কিছু প্রকাশিত না হবে।

এ কথার দলীল হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি কৈফিয়তের ভাষায় ওসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, “তুমি তাকে হত্যা করেছ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও?” এবং তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি লোকদেরকে হত্যা করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলবে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” সেই রাসূলই কিন্তু খারেজীদের সম্বন্ধে বলেছেন, “যেখানেই তোমরা তাদের পাবে, হত্যা করবে, আমি যদি তাদের পেয়ে যাই তবে তাদেরকে হত্যা করব ‘আদ জাতির মত সার্বিক হত্যা।”[30]  যদিও তারা (খারেজীরা) ছিল লোকদের মধ্যে অধিক ইবাদতগুযার, অধিক মাত্রায় ‘ল-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং সুবহানাল্লাহ্‌’ উচ্চারণকালী।

তাছাড়া খারেজীরা এমন বিনয়-নম্রতার সঙ্গে নামায আদায় করত যে, সাহাবীগণ পর্যন্ত নিজেদের নামাযকে তাদের নামাজের তুলনায় তুচ্ছ মনে করতেন। তারা কিন্তু “ইল্‌ম শিক্ষা করেছিল সাহাবাগণের নিকট হতেই।  কিন্তু কোনই উপকারে আসল না তাদের “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলা, তাদের অধিক পরিমাণ ইবাদত করা এবং তাদের  ইসলামের দাবী করা, যখন তাদের থেকে শরীয়তের বিরোধী বিষয় প্রকাশিত হয়ে গেল।

ঐ একই পর্যায়ের বিষয় হচ্ছে ইয়াহূদীদের হত্যা এবং বানু হানীফার বিরুদ্ধে সাহাবীদের যুদ্ধ ও হত্যাকান্ড। ঐ একই কারণে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানী মুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যখন একজন লোক এসে খবর দিল যে, তারা যাকাত দিবে না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ﴾ [الحجرات: ٦] 

“হে মুমিন সমাজ! যখন কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো গুরুতর সংবাদ নিয়ে তোমাদের নিকট আগমন করে, তখন তোমরা তার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখো।” (সূরা হুজুরাত : ৬) বস্তুত: উপরোক্ত সংবাদদাতা তাদের সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিল।

এইরূপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত হাদীসকে তারা দলীল-প্রমাণরূপে পেশ করে থাকে তার প্রত্যেকটির তাৎপর্য্য তা-ই যা আমরা উল্লেখ করেছি।

পঞ্চদশ অধ্যায়

জীবিত ও মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য কামনার মধ্যে পার্থক্য

[উপস্থিত জীবিত ব্যক্তির নিকট তার আয়াত্তাধীন বিষয়ে সাহায্য কামনা এবং অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট তার ক্ষমতার অতীত বিষয়ে সাহায্য কামনার মধ্যে পার্থক্য]

তাদের (মুশরিকদের) মনে আর একটি সন্দেহ বন্ধ মূল হয়ে আছে আর তা হচ্ছে এই: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, লোক সকল কিয়ামত দিবসে তাদের (হয়রান পেরেশানীর অবস্থায়) প্রথম সাহায্য কামনা করবে আদম ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট, তারপর নূহ আলায়হিস সালাম এর নিকট, তারপর মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট। তারা প্রত্যেকেই তাদের অসুবিধার উল্লেখ করে ‘ওযর পেশ করবেন, শেষ পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গমন করবেন।

তারা বলে, এর থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকটে সাহায্য চাওয়া শির্ক নয়।

আমাদের জওয়াব হচ্ছে : আল্লাহর কি মহিমা ! তিনি তাঁর শত্রুদের হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন।

সৃষ্ট জীবের নিকটে তার আয়ত্বাধীন বস্তুর সাহায্য চাওয়ার বৈধতা আমরা অস্বীকার করি না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মুসা ‘আলাইহিস সালাম এর ঘটনায় বলেছেন:

﴿فَٱسۡتَغَٰثَهُ ٱلَّذِي مِن شِيعَتِهِۦ عَلَى ٱلَّذِي مِنۡ عَدُوِّهِۦ﴾ [القصص: ١٥] 

“তখন তার সম্প্রদায়ের লোকটি তার শত্রুপক্ষীয় লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। (সূরা কাসাস : ১৫)

অনুরূপভাবে মানুষ তার সহচরদের নিকটে যুদ্ধে বা অন্য সময়ে ঐ বস্তুর সাহায্য চায় যা মানুষের আয়ত্বাধীন। কিন্ত আমরা তো ঐরূপ সাহায্য প্রার্থনা অস্বীকার করেছি যা ইবাদতস্বরূপ মুশরিকগণ করে থাকে ওলী-দের কবর বা মাযারে, অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে এমন সব ব্যাপারে তাদের সাহায্য কামনা করে যা মঞ্জুর করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই।

যখন আমাদের এ বক্তব্য সাব্যস্ত হল, তখন নবীদের নিকটে কিয়ামতের দিন এ উদ্দেশ্যে সাহায্য চাওয়া যে, তারা আল্লাহর নিকটে এ প্রার্থনা জানাবেন যাতে তিনি জান্নাতবাসীর হিসাব (সহজ ও শীর্ঘ) সম্পন্ন ক’রে হাশরের ময়দানে অবস্থানের কষ্ট হতে আরাম দান করেন, এ ধরনের প্রার্থনা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই সিদ্ধ। যেমন জীবিত কোনো নেক লোকের নিকটে তুমি গমন কর, সে তোমাকে তার নিকটে বসায় এবং কথা শুনে। তাকে তুমি বল : আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ তাঁর জীবিতকালে তাঁর নিকট অনুরোধ জানাতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কবরের নিকট গিয়ে এ ধরনের অনুরোধ কক্ষনো তারা জানান নি। বরং সালাফুস সালেহ বা পূর্ববর্তী মনীষিগণ তাঁর কবরের নিকট গিয়ে আল্লাহকে ডাকতে (এবং সেটাকে অবাঞ্ছিত কাজ মনে করে তাতে সম্মতি দিতে) অস্বীকার করেছেন। অবস্থার এই পেক্ষিতে কি করে স্বয়ং তাঁকেই ডাকা যেতে পারে ?

তাদের মনে আর একটা সংশয় রয়েছে ইব্‌রাহীম আলায়হিস সালাম এর ঘটনায়। যখন তিনি অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হন তখন শুন্যলোক হতে জিব্রীল ‘আলাইহিস সালাম তাঁর নিকট আরয করলেন, আপনার কি কোন প্রয়োজন আছে? তখন ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেন, যদি বলেন, আপনার নিকটে, তবে আমার কোনই প্রয়োজন নেই।

তারা (মুশরিকরা) বলে: জিব্রীলের নিকট সাহায্য কামানা করা যদি শির্ক হতে তাহলে তিনি কিছুতেই ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর নিকট উক্ত প্রস্তাব পেশ করতেন না। এর জওয়াব হচ্ছে : এটা প্রথম শ্রেণির সন্দেহের পর্যায়ভুক্ত। কেননা জিব্রীল ‘আলাইহিস সালাম তাঁকে এমন এক ব্যাপারে উপকৃত করতে চেয়েছিলেন যা করার মত ক্ষমতা ছিল তার আয়ত্ত্বাধীন। আল্লাহ স্বয়ং তাঁকে ‘শাদীদুল কুওয়া’ অর্থাৎ  অত্যন্ত শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছেন। ইব্‌রাহীম ‘আলাইহিস সালাম এর জন্য প্রজ্জলিত অগ্নিকুণ্ড এবং তার চারদিকের  জমি ও পাহাড় যা কিছু ছিল সেগুলো ধরে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে নিক্ষেপ করতে যদি আল্লাহ অনুমতি দিতেন তা হলে তিনি তা অবশ্য করতে পারতেন। যদি আল্লাহ ইব্‌রাহীম আলায়হিস সালামকে দুশমনদের নিকট থেকে দূরবর্তী কোথাও স্থানান্তরিত করতে আদেশ দিতেন, তাও তিনি অবশ্যই করতে পারতেন, আর আল্লাহ যদি তাকে আকাশে তুলতে বলতেন, তাও তিনি করতে সক্ষম হতেন।

তাদের সংশয়ের বিষয়টি তুলনীয় এমন একজন বিত্তশালী লোকের সঙ্গে যার প্রচুর ধন দৌলত রয়েছে। সে একজন অভাবগ্রস্ত লোক দেখে তার অভাব মিটানোর জন্য তাকে কিছু অর্থ ঋণস্বরূপ দেওয়ার প্রস্তাব করল অথবা তাকে কিছু টাকা অনুদানস্বরূপ দিয়েই দিল। কিন্তু সেই অভাবগ্রস্ত লোকটি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং কারোর কোনো অনুগ্রহের তোয়াক্কা না করে আল্লাহর রেযেক না পৌঁছা পর্যন্ত ধৈর্য অবলম্বন করল।

তা হলে এটা বান্দার নিকট সাহায্য কামনা এবং শির্ক কেমন করে হ’ল? আহা যদি তারা বুঝত !

ষোড়শ অধ্যায়

অন্তরে, কথায় ও কর্মে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা; যদি না শর্‌য়ী ওযর থাকে

আমি এবার ইনশাআল্লাহু তা‘আলা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করে আমার বক্তব্যের উপসংহার টানব। পূর্ব আলোচনাসমূহে এ বিষয়ের উপর আলোকপাত হয়েছে বটে কিন্তু তার বিশেষ গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং তৎসম্পর্কে অধিক ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হওয়ার ফলে আমি উক্ত বিষয়ে এখানে পৃথকভাবে কিছু আলোচনার প্রয়াস পাব।

এ বিষয়ে কোনই দ্বিমত নেই যে, তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি হতে হবে অন্তর দ্বারা, জিহ্বা দ্বারা এবং কর্মে তার বাস্তবায়ন দ্বারা। এর থেকে যদি কোনো ব্যক্তির কিছুমাত্র বিচ্যুতি ঘটে, তবে সে মুসলিম বলে বিবেচিত হবে না।

যদি কোনো ব্যক্তি তাওহীদ কী— তা হৃদয়ঙ্গম করে কিন্তু তার উপর ‘আমল না করে, তবে সে হবে হঠকারী কাফের, তার তুলনা হবে ফির‘আউন, ইবলীস প্রভৃতির সঙ্গে। এখানেই অধিক সংখ্যক লোক বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত হয়। তারা বলে থাকে, এটা সত্য, আমরা এটা বুঝেছি এবং তার সত্যতার সাক্ষ্যও দিচ্ছি। কিন্তু আমরা তা কার্যে পরিণত করতে সক্ষম নই। আর আমাদের দেশবাসীদের নিকট তা সিদ্ধ নয়- কিন্তু যারা তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণকারী (তারা ছাড়া)। এই সব ওযুহাত এবং অন্যান্য ওযর আপত্তি তারা পেশ করে থাকে।

আর এই হতভাগারা বুঝে না যে, অধিকাংশ কাফের নেতা সত্য জানত কিন্তু জেনেও তা প্রত্যাখ্যান করত শুধু কতিপয় ‘ওযর আপত্তির জন্য। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ٱشۡتَرَوۡاْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ ثَمَنٗا قَلِيلٗا﴾ [التوبة: ٩]

“আল্লাহর আয়াতগুলিকে তারা বিক্রয় করে ফেলেছে নগণ্য মূলের বিনিময়ে।” (আত-তাওবা : ৯০)। অনুরূপ অন্যান্য আয়াতে বলা হয়েছে :

﴿ يَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا يَعۡرِفُونَ أَبۡنَآءَهُمۡۖ ﴾ [البقرة: ١٤٦] 

“তারা তাঁকে (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বা হককে) ঠিক সেই ভাবেই চিনে যেমন তারা চিনে তাদের পুত্রদিগকে।” (বাকারা : ১৪৬)

আর কেউ যদি তাওহীদ না বুঝে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে তার উপর আমল করে, অথবা সে যদি অন্তরে বিশ্বাস না রেখে আমল করে তবে তো সে মুনাফিক; সে নিরেট কাফের থেকেও মন্দ। স্বয়ং আল্লাহ মুনাফিকদের পরিণতি সম্বন্ধে বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ فِي ٱلدَّرۡكِ ٱلۡأَسۡفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ ﴾ [النساء: ١٤٥] 

‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ অবস্থান করবে জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে।’ (সূরা আন নিসা: ১৪৫)

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, অতীব দীর্ঘ ও ব্যাপক, তোমার নিকটে এটা প্রকাশ হবে যখন জনসাধারণের আলোচনার উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে দেখবে, তখন তুমি দেখবে সত্যকে জেনে বুঝেও তারা তার উপরে আমল করে না এই আশঙ্কায় যে, তাদের পার্থিব ক্ষতি হবে অথবা কারও সম্মানের হানি হবে কিংবা সম্পর্কের ক্ষতি হবে।

তুমি আরও দেখতে পাবে যে, কতক লোক প্রকাশ্যভাবে কোন কাজ করছে কিন্তু তাদের অন্তরে তা নেই। তাকে তার অন্তরের প্রত্যয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে দেখবে যে, সে তাওহীদ কি তা বুঝে না।

অবস্থার এই প্রেক্ষিতে মাত্র দু’টি আয়াতের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা তোমার কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। প্রথমটি হচ্ছে :

﴿ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٦٦] 

“এখন তোমরা আর কৈফিয়ত পেশ করো না, ঈমান আনয়নের পরও তো তোমরা কুফরী কাজে লিপ্ত রয়েছ।” (সূরা তাওবা :  ৬৬)

যখন এটা সাব্যস্ত হয়েছে যে, কতিপয় সাহাবী যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে রোমানদের বিরুদ্ধে (তাবুকের) যুদ্ধে গমন করেছিল তারা ঠাট্টাচ্ছলে কোনো একটি কথা বলার ফলে কাফের হয়ে গিয়েছিল; তখন তোমার কাছে সুস্পষ্ট হবে যে, হাসি ঠাট্টার সঙ্গে কোনো কথা বলার চেয়ে অধিক গুরুতর সেই ব্যক্তির অবস্থা, যে কুফরী কথা বলে অথবা কুফরী ‘আমল করে ধনদৌলতের ক্ষতির আশঙ্কায় কিংবা সম্মানহানি অথবা সম্পর্কের ক্ষতির ভয়ে।

দ্বিতীয় আয়াতটি হচ্ছ :

﴿ مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا عَلَى ٱلۡأٓخِرَةِ ﴾ [النحل: ١٠٦،  ١٠٧] 

“কেউ তার ঈমান স্থাপনের পর আল্লাহর সাথে কুফরী করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয় যাকে সত্য প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত বিশ্বাসে অবিচলিত। এটা এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়।” (সূরা নাহ্‌ল : ১০৬-১০৭)

আল্লাহ এদের কারোরই ‘ওযর আপত্তি কবুল করেন নি; তবে কবূল করেছেন শুধু তাদের ‘ওযর যাদের অন্তর ঈমানের উপরে স্থির ও প্রশান্ত রয়েছে, কিন্তু তাদেরকে জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে। এরা ব্যতীত উপরোল্লিখিত ব্যক্তিরা তাদের ঈমানের পর কুফরী করেছে। চাই তারা ভয়েই তা করে থাকুক অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় তা হোক কিংবা গোত্র অথবা ধন-দৌলতের প্রতি আকর্ষণের জন্যই হোক অথবা হাসি-ঠাট্টার ছলেই কুফরী কালাম উচ্চারণ করুক অথবা এ ছাড়া অন্য যে কোনো উদ্দেশ্য হাসেলের জন্য তা করে থাকুক— শুধু বাধ্য হওয়া ব্যতীত। সুতরাং বর্ণিত আয়াতটি এই অর্থই বুঝিয়ে থাকে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে—

প্রথমত: আল্লাহর বাণীতে বলা হয়েছে : ﴿إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ﴾ “কিন্তু যদি তাকে বাধ্য করা হয়ে থাকে”, আল্লাহ বাধ্যকৃত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোন ব্যতিক্রমের সুযোগ রাখেন নি। একথা সুবিদিত যে, মানুষকে একমাত্র কথা অথবা কাজেই বাধ্য করা যায়। কিন্তু অন্তরের প্রত্যয়ে কাউকে বাধ্য করা চলে না।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহর এই বাণী :

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا عَلَى ٱلۡأٓخِرَةِ﴾ [النحل: ١٠٧] 

“এটি এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়।” (নাহ্‌ল: ১০৭)

এ আয়াতটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই কুফরী ও তার শাস্তি তাদের বিশ্বাস, মূর্খতা, দ্বীনের প্রতি বিদ্বেষ বা কুফরীর প্রতি অনুরাগের কারণে নয়, বরং এর কারণ হচ্ছে দুনিয়া থেকে কিছু অংশ হাসিল করা, যে জন্য সে দুনিয়াকে দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিয়েছে।

পাক-পবিত্র ও মহান আল্লাহই এ সম্পর্কে অধিক অবহিত রয়েছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এবং তাঁর পরিবার ও সহচরবর্গের উপর, আর তাঁদের সকলের উপর শান্তি অবতীর্ণ করুন। (আমীন!)

—সমাপ্ত—

[1] রাসূলের যুগের আরবের মুশরিকদের।

[2] রাসূলের যুগের আরবের মুশরিকদের নিকট।

[3] অর্থাৎ ফেরেশতা, নবী, ওলী, বৃক্ষ, কবর, জিন যাদেরকেই ঐ সকল কাজে আহ্বান জানানো হয়, তারাই ‘ইলাহ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যাবে। এটা রাসূলের সময়কার আরবের মুশরিকরা ভালোভাবেই জানত।

[4] রাসূলের যুগের।

[5] সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া অজ্ঞতা ওজর হিসেবে বিবেচিত হবে না। সঙ্গত কারণের মধ্যে রয়েছে, লোকালয়ে না থাকা, যেখানে কেউ তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করার নেই সেখানে অবস্থান করা, দেশে মূর্খতা ছেয়ে যাওয়া। কিন্তু জানা-শুনার সুবিধা থাকা সত্বেও যদি অজ্ঞতার দোহাই দেওয়া হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যাপারটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি হিসেবে ভিন্ন হতে বাধ্য। [সম্পাদক]

[6] অর্থাৎ পূর্বেকার মুশরিকরাও আল্লাহর রবুবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিত এবং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তারা মুশরিক হয়েছিল, কারণ তারা মাধ্যম গ্রহণ করেছিল। তবে এটা সত্য যে তারা সত্যিকার অর্থে রুবুবিয়্যাতের হক আদায় করত না। কারণ, রুবুবিয়্যাতের হক আদায় করলে ইবাদত একমত্র আল্লাহরই করত। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬২]

[7] অর্থাৎ পূর্বেকার মুশরিকরা তো মূর্তিপূজা করত, সে তো আর মূর্তিপূজা করছে না। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬২]

[8] অর্থাৎ এটা বলে দাও যে, পূর্ববর্তী কাফের, মুশরিকরা যে শুধু মূর্তিপূজা করত, তা কিন্তু নয়, বরং তারা নেককার বান্দা ও নবী-রাসূলদেরও পূজা করত। পরবর্তী বাক্যে এর প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। [সম্পাদক]

[9] সন্দেহগুলো সংক্ষিপ্তভাবে:

১. তাওহীদুর রবুবিয়্যাহর স্বীকৃতি দেওয়ার পর শির্ক কীভাবে সম্ভব?

২. শির্ক বলতে তো কেবল মূর্তিপূজাকে বুঝায়।

৩. আগেকার মুশরিকরা তো যাদের পূজা বা ইবাদত করত, তাদের কাছেই কোনো কিছু চাইত, কিন্তু সে তো আর তাদের কাছে কিছু চাচ্ছে না, সে তো শুধু তাদের সুপারিশই কামনা করে। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ. ৬৭]

[10] উটের জন্য সুন্নাত হচ্ছে, নাহর করা। নাহর বলা হয়, দাঁড়ানো অবস্থায় উটের গণ্ডদেশে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করা।

[11] কারণ, কারও কাছে কিছু চাইতে হলে, তাকে আহ্বান করতে হয়। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ চাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে ডাকা, যা আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। [সম্পাদক]

[12] অর্থাৎ এটাকে যথাযথভাবে পালন করলে আর নবীর কাছে শাফা‘আত চাইতে পারবে না। কারণ, চাওয়া তো কেবল আল্লাহর কাছে। এটাই তো উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে।

[13] অর্থাৎ কুরআন তো বলছে যে তৎকালীন আরবের মুশরিকরা কখনও এসব কাঠ, পাথর ইত্যাদিকে সৃষ্টি, রিযিক কিংবা নিয়ন্ত্রক দাবী করত না। তাহলে তোমার দাবী কুরআনের ঘোষণার বিপরীত হচ্ছে, সুতরাং তোমার কথা মিথ্যা।

[14] অর্থাৎ তোমরা নিজেরাই তোমাদের কথায় আমাদের বক্তব্য প্রকারান্তরে মেনে নিলে যে তোমরা শির্ক করে যাচ্ছ। আর এভাবেই আমাদের উদ্দেশ্য সাব্যস্ত হচ্ছে, সেটা হচ্ছে, তার কাছ থেকে হকের স্বীকৃতি আদায় করা। তার সন্দেহ দূর করা, আমাদের উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে তার সন্দেহ দূরীভূত হলো, তার প্রমাণাদি খণ্ডিত হলো, তার ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৭৯]

[15] অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে, সৎলোকদেরকে আহ্বান করা, তাদের উপর ভরসা করাও শির্ক, কারণ তা কুরআন তা বর্ণনা করেছে; আর তোমার কথা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তার সন্দেহ দূরীভূত হলো, তার প্রমাণাদি খণ্ডিত হলো। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৮০]

[16] অর্থাৎ অপর কারও ইবাদত করা যাবে না, কাউকে ডাকা যাবে না, কারও উপর ভরসা করা যাবে না ইত্যাদি।

[17] অর্থাৎ শির্ক কী? মুশরিক কে? মূর্তিপূজা কী, মূর্তিপূজা ও অন্যকিছুর মধ্যে পার্থক্য না জানে তবে তো সে অজ্ঞ, তার সাথে তর্ক না করে তাকে জ্ঞান দিতে হবে। বর্তমান কালের অধিকাংশ মানুষ এ শ্রেণির। [মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আলে আশ-শাইখ, শারহু কাশফিশ শুবহাত, পৃ.৮১]

[18] সুতরাং তার সন্তান সাব্যস্ত করা হবে, তখন সেটার প্রতি আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। সুতরাং আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা কুফরী। কারণ এটি ‘সামাদ’ এর বিপরীত।

[19] অর্খাৎ আল্লাহর সামাদ বা সন্তান থেকে অমুখাপেক্ষীতা অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে।

[20] অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে কাফের বলেছেন, অথচ তারা আল্লাহর জন্য পুত্র কিংবা সন্তান সাব্যস্ত করেনি। সুতরাং তোমাদের পূর্বোক্ত দাবী অসার, যাতে তোমরা দাবী করেছিলে যে, তাদেরকে সন্তান সাব্যস্ত করার জন্যই কেবল কাফের বলা হয়েছে, সৎলোকদের আহ্বানের জন্য নয়। বস্তুত: যারা লাতকে আহ্বান করে কাফের হয়েছিল কিংবা জিনদের ইবাদত করে কাফের হয়েছে, তারা তো আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত না করেও কাফের হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সন্তান সাব্যস্ত করলে যেমন কুফরী করা হয়, তেমনি আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে আশ্রয়ের জন্য আহ্বানও কুফরিতে নিমজ্জিত করে। [সম্পাদক]

[21] অর্থাৎ তারা ওলি, কবর, মাযার বা পীরদের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি বা ওসীলা গ্রহণের যে বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। [সম্পাদক]

[22] তবে এটা সত্য যে উভয়টিই শির্ক। উভয় গোষ্ঠীই জাহান্নামের অধিবাসী, যদি না তাওবাহ করে, এখানে গ্রন্থকার শুধু দু’যুগের শির্কের পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। [সম্পাদক]

[23] শাইখের এ বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার একটি প্রেক্ষাপট এটি। কিন্তু এ কথার সমর্থনে দলীল পাওয়া যায় নি। (ইবন উসাইমীন, শারহু কাশফিশ শুবুহাত, পৃ. ৯১)।

[24] সুতরাং কিছু কিছু বস্তুর ঈমান থাকার পরও কুফরী কিংবা শির্ক করার কারণে তারা ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে। [সম্পাদক]

[25] নিকট অতীতে (গ্রন্থকারের সময়কালে) নাজদে এদের উদ্দেশ্যে পূজা করা হত।

[26] মুরতাদ্দ হচ্ছে সেই মুসলিম, যে ইসলাম গ্রহণের পর কূফরীতে ফিরে যায। [অনুবাদক]

[27] তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮০।

[28] বর্তমানেও কোনো কোনো ইলমের দাবীদারকে তাওহীদ সম্পর্কে বলতে গেলে বলে যে আমারা তাওহীদের উপর আছি, তুমি কি আমাদেরকে তাওহীদ শিক্ষা দিচ্ছ? তোমার তাওহীদ নিয়ে তুমি থাক, ইত্যাদি। বাস্তবে তারা তাওহীদ নিয়ে কখনও চিন্তা গবেষণা করেনি। তারা অনেক জ্ঞানের অধিকারী হলেও তাওহীদ বুঝে না। নিঃসন্দেহে তারা অহংকারবশত আল্লাহর তাওহীদকে না জেনে কখনও কখনও শির্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে। [সম্পাদক]

[29] কারণ তারা তাওহীদ না বুঝেও বুঝার দাবী করছে, ফলে শির্কে নিপতিত হচ্ছে। যদি তারা সত্যিকার তাওহীদ নিয়ে গবেষণা করত এবং তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করত, তবে কখনই শির্কে পতিত হতো না, কিন্তু শয়তান চায় না তারা তাওহীদ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে শির্কমুক্ত হয়ে যাক। [সম্পাদক]

[30] (বুখারী ও মুসলিম) অনুবাদক।

পরীক্ষা ও সবর – নির্বাচিত আয়াত ও হাদিস

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

 

الإبتلاء والصبر

পরীক্ষা ও সবর

পরীক্ষা ও সবর: নির্বাচিত আয়াত ও হাদীস

 

পরীক্ষা

يا مخنث العزم اين انت والطريق طريق تعب فيه آدم وناح لا جله نوح ورمى في النار الخليل واضجع للذبح اسماعيل وبيع يوسف بثمن بخس ولبث في السجن بضع سنين ونشر بالمنشار زكريا وذبح السيد الحصور يحيى وقاسى الضر أيوب وزاد على المقدار بكاء داود وسار مع الوحش عيسي وعالج الفقر وأنواع الأذى محمد تزهي انت باللهو واللعب

ওহে ! দুর্বল সংকল্পের অধিকারী তুমি কোথায়?

আরে এটিতো সে পথ,

যে পথে চলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন আদাম,

ক্রন্দন করতে হয়েছে নুহ কে।

আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে খালিলুল্লাহ ইব্রাহিমকে।

জবেহ করতে চিৎ করে শোয়ানো হয়েছে ইসমাঈলকে।

খুব সল্প মূল্যে বিক্রয় করা হয়েছে ইউসুফকে।

কারাগারে কাটাতে হয়েছে জীবনের দীর্ঘ কয়েকটি বছর।

করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে জাকারিয়াকে।

জবেহ করা হয়েছে সাইয়্যেদ ইয়াহইয়াকে,

দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করেছেন আইয়ুব।

অনেক অনেক বেশি ক্রন্দন করেছেন দাউদ।

বন্য প্রাণীর ন্যায় জীবন যাপন করেছেন ঈসা

[আলইহিমুস স্বলাতু ওয়াস সালাম]

নানা ধরনের কষ্ট সহ্য করেছেন মুহাম্মাদ আর তুমি খেল তামাশায় মত্ত!!!

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ

 

ﺑﺴــــــــــﻢﷲﺍﻟﺮﺣﻤﻦﺍلرﺣﻴﻢ

الٓمٓ (1) أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوٓا أَن يَقُولُوٓا ءَامَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ (2) وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكٰذِبِينَ (3(

১) আলিফ-লাম-মীম।

২) মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?

৩) আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথুকদেরকে। (সূরা আনকাবুত, ১-৩)

 

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَزُلْزِلُوا حَتّٰى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ ءَامَنُوا مَعَهُۥ مَتٰى نَصْرُ اللَّهِ ۗ أَلَآ إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ

তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট।

আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী। (সূরা বাকারা,২১৪)।

 

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جٰهَدُوا مِنكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِن دُونِ اللَّهِ وَلَا رَسُولِهِۦ وَلَا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ

তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নেবেন তোমাদের কে যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত। (সুরা তাওবা,১৬)

لَتُبْلَوُنَّ فِىٓ أَمْوٰلِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتٰبَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوٓا أَذًى كَثِيرًا ۚ وَإِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

অবশ্য ধন-সম্পদে এবং জনসম্পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং মুশরেকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং পরহেযগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহ ব্যাপার। (সূরা আলে ইমরান, ১৮৬)

 

إِذْ جَآءُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصٰرُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا۠ (10) هُنَالِكَ ابْتُلِىَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا (11(

যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কষ্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে। সে সময়ে মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে প্রকম্পিত হচ্ছিল। (সূরা আহজাব, ১০-১১)

 

فقد صح أن رجلاً أتى إلى انبي فقال: والله يا رسول الله إني أحبك، فقال له رسول الله :” إن البلايا أسرع إلى من يحبني من السيل إلى منتهاه “.

বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত , জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে বলল : হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন; স্রোত গন্তব্যের দিকে যত দ্রুত ধাবিত হয়, যারা আমাকে ভালবাসে, তাদের দিকে বিপদাপদ তার চেয়েও দ্রুত ধাবিত হয়। (ইবনে হিব্বান আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ: ১৫৮৬)

وأكثر الناس حبا الله تعالى وللنبيه أكثرهم بالاء في الله .. وأكثرهم اتباعا لمنهاجه وسنته وسيرته، وتخلقاً ، كما قال تعالى: قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِى يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ

আর যারা আল্লাহ ও তার নবীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, তারাই আল্লাহর পথে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয় এবং তারাই তাঁর নীতি, আদর্শ ও জীবনীর সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে এবং সবচেয়ে বেশি তার চরিত্রে চরিত্রবান হয়। যেমনটা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসো, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন।”

 

وقال:” أشد الناس بلاء الألنبياء ثم الأمثل فلأمثل، يبتلى الرجل على حسب دينه فإن كان في دينه صلباً اشتد بلاؤه، وإن كان في دينه رقة ابتلي على حسب دينه، فما يبرح البلاء بالعبد حتى يتركه يمشي على الأرض ما عليه خطيئة “.

রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বলেন:

“মানুষের মধ্যে সর্বাধিক বিপদাপদের সম্মুখীন হন নবীগণ, তারপর তাদের সর্বাধিক অনুসরণকারীগণ, তারপর তারপরের স্তরের লোকগণ… এভাবে। প্রতিটি লোককে তার দ্বীনদারি অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। তাই কেউ যদি স্বীয় দ্বীনে মজবুত হয়, তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়।

আর কেউ যদি স্বীয় দ্বীনে দুর্বল হয়, তাকে তার দ্বীন অনুযায়ীই পরীক্ষা করা হয়। এভাবে একজন বান্দার উপর বিপদাপদ আসতে থাকে, যতক্ষণ না তাকে এ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সে পৃথিবীর উপর এমনভাবে হাটতে থাকে, যে তার কোন গুনাহই থাকে না।” (তিরমিজি, সিলসিলাতুস সাহিহা ১৪৩)

وقال :عن نفسه:”ما أوذي أحد ما أوذيت في الله عز وجل “.

তিনি নিজের ব্যাপারে বলেন, আমাকে আল্লাহর পথে যত কষ্টের শিকার দেওয়া হয়েছে, কেউ এত কষ্টের শিকার হয়নি। (সিলসিলাতুস সাহিহা ২২২২২)

وقال :”كما يضاعف لنا الأجر، كذلك يضاعف علينا البلأ “.

তিনি আরও বলেন: যেমনিভাবে আমাদের বিনিময় বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়, তেমনিভাবে আমাদের বিপদাপদও বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। (সিলসিলাতুস সহিহা ২০৪৭)

وقال  :” إن الصالحين يشدد عليهم، وإنه لا يصيب مؤناً نكبة من شوكة فما فوق ذلك، إلا حُطت بها عنه خطيئة، ورفع بها درجة “.

তিনি আরও বলেন; “নিশ্চয়ই নেককারদের উপর কঠিন বিপদ দেওয়া হয়। আর মুমিন বান্দার উপর কাঁটা বা তার চেয়ে নগণ্য পিরমাণ মত বিপদ আসে, তার প্রতিটির জন্য তার গুনাহ ক্ষমা করা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।” (তাবারানি, সিলসিলাতুস সাহিহা ১৬১০)

ِ وقال :”إن عظم الجزاء مع عظم البلأ، وإن الله إذا أحب قوماً ابتلاهم، فمن رضي فله الرضى ومن سخط فله السخط

তিনি আরও বলেন; নিশ্চয়ই বড় প্রতিদান বড় পরীক্ষার সাথেই। আল্লাহ যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। অতঃপর যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য থাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি, ইবনে মাযাহ, সিলসিলাতুস সাহিহা ১৪৬)

 

সবর

الابتالأ هو فرق بين المؤمن والمنافق:

বিপদ আপদই মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্যকারী

 

إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُۥ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ ءَامَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَآءَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظّٰلِمِينَ

তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। (সুরা আলে ইমরান, ১৪০)

 

وَمَآ أَصٰبَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ

আর যেদিন দু’দল সৈন্যের মোকাবিলা হয়েছে; সেদিন তোমাদের উপর যা আপতিত হয়েছে তা আল্লাহ’র হুকুমেই হয়েছে এবং তা এজন্য যে, তাতে ঈমানদারদিগকে জানা যায়। এবং তাদেরকে যাতে সনাক্ত করা যায় যারা মুনাফিক ছিল। (সুরা আলে ইমরান, ১৬৬)

 

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَآ أُوذِىَ فِى اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِن جَآءَ نَصْرٌ مِّن رَّبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِى صُدُورِ الْعٰلَمِينَ (10) وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ ءَامَنُوا اتَّبِعُوا سَبِيلَنَا وَلْنَحْمِلْ خَطٰيٰكُمْ وَمَا هُم بِحٰمِلِينَ مِنْ خَطٰيٰهُم مِّن شَىْءٍ ۖ إِنَّهُمْ لَكٰذِبُونَ (11(

কতক লোক বলে, আমরা আল্লাহ’র উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি; কিন্তু আল্লাহ’র পথে যখন তারা নির্যাতিত হয়, তখন তারা মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহ’র আযাবের মত মনে করে। যখন আপনার পালনকর্তার কাছ থেকে কোন সাহায্য আসে তখন তারা বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তরে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন?

আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং নিশ্চয় জেনে নেবেন যারা মুনাফেক। (সুরা আনকাবুত, ১০-১১)

 

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّٰى نَعْلَمَ الْمُجٰهِدِينَ مِنكُمْ وَالصّٰبِرِينَ وَنَبْلُوَا أَخْبَارَكُمْ

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জিহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থানসমূহ যাচাই করি। (সূরা মুহাম্মাদ, ৩১)

 

وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوٰلِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرٰتِ ۗ وَبَشِّرِ الصّٰبِرِينَ (155) الَّذِينَ إِذَآ أَصٰبَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوٓا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيْهِ رٰجِعُونَ (156) أُولٰٓئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوٰتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (157(

এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগককে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।

যখন তারা বিপলে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জনা এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।

তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ্’র অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। (সুরা বাকারা , ১৫৫-১৫৭)

 

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقٰمُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (13) أُولٰٓئِكَ أَصْحٰبُ الْجَنَّةِ خٰلِدِينَ فِيهَا جَزَآءًۢ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (14(

নিশ্চয় যারা বলে , আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করত, এটা তারই প্রতিফল। (সুরা আহকাফ, ১৩-১৪)

 

ﺑﺴــــــــــﻢﷲﺍﻟﺮﺣﻤﻦﺍلرﺣﻴﻢ

وَٱلْعَصْرِ (1) إِنَّ ٱلْإِنسَٰنَ لَفِى خُسْرٍ  (2)  إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلصَّبْرِ (3(

“সময়ের শপথ; নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের। (সুরা আসর, ১-৩)

 

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقٰمُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِى كُنتُمْ تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَآؤُكُمْ فِى الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَفِى الْءَاخِرَةِ ۖ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِىٓ أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31(

নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন। ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু।

সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্যে আছে তোমরা দাবী কর। (সুরা ফুসসিলাত, ৩০-৩১)

 

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِىٍّ قٰتَلَ مَعَهُۥ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَآ أَصَابَهُمْ فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الصّٰبِرِينَ (146) وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّآ أَن قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِىٓ أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِينَ (147) فَـَٔاتٰىهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْءَاخِرَةِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (148(

আর বহু নবী ছিলেন, যাঁদের সঙ্গী-সাথীরা তাঁদের অনুবর্তী হয়ে জিহাদ করেছে; আল্লাহর পথে-তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্ত ও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা সবর করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।

তারা আর কিছুই বলেনি-শুধু বলেছে, হে আমাদের পালনকর্তা! মােচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদিগকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদিগকে সাহায্য কর।

অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখেরাতের সওয়াব। আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। (সুরা আলে-ইমরান, ১৪৬-১৪৮)

 

وَإِذِ ابْتَلٰىٓ إِبْرٰهِۦمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمٰتٍ فَأَتَمَّهُنَّ ۖ قَالَ إِنِّى جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا ۖ

যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাক মানবজাতির নেতা করব। (সুরা বাকারা, ১২৪)

 

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَعْبُدُ اللَّهَ عَلٰى حَرْفٍ ۖ فَإِنْ أَصَابَهُۥ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِۦ ۖ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلٰى وَجْهِهِۦ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْءَاخِرَةَ ۚ ذٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহ’র এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি। (সুরা হাজ্জ, ১১)

 

ومن قصة أصحاب الألخدود، أن الطاغية لما رأى الناس قد آمنوا باللّٰه رب العالمين، وحصل ما كان يخشاه ويكرهه ”  أمر بالأخدود بأفواه السكك فخدت وأضرم فيها النيران،

وقال: من لم يرجع عن دينه فاقحموه فيها، أو قيل له: اقتحم، ففعلوا حتى جاءت امرأة ومعها صبي لها فتقاعست أن تقع فيها، فقال لها الغلام: يا أمه اصبري فإنك على الحق ” مسلم.

আসহাবুল উখদুদের কাহিনীতে রয়েছে, তাগুত শাসক যখন দেখল, মানুষ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনে ফেলেছে এবং সে যার আশংকা করছিল ও যা অপছন্দ করছিল তা-ই ঘটে গেছে, তখন সে সড়কের মুখে মুখে গর্ত খননের আদেশ করল। কথামত গর্ত খুড়ে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হল। তারপর বলল; যে দ্বীন থেকে ফিরে না আসবে, তাকে তাতে নিক্ষেপ করবে। ফলে তার সৈন্যবাহিনী তাই করতে লাগল।

এক পর্যায়ে একজন মহিলার পালা আসল, তার সাথে ছিল তার ছোট্ট শিশু। তাই মহিলাটি তাতে নিক্ষিপ্ত হতে গড়িমসি করছিল। তখন উক্ত শিশু বলে উঠল: হে মা! অবিচল থাকুন, কারণ আপনি হকের উপর আছেন। (মুসলিম)

এদের ব্যাপারে এবং এদের মত অন্যান্য লোকদের ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা বলেন:

فيهم وفي أمثالهم يقول تعالى: وَمِنَ النَّاسِ مَن يَعْبُدُ اللَّهَ عَلٰى حَرْفٍ ۖ فَإِنْ أَصَابَهُۥ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِۦ ۖ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انقَلَبَ عَلٰى وَجْهِهِۦ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْءَاخِرَةَ ۚ ذٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে ইবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি। (সূরা হাজ্জ, ১১)

 

وفي الحديث عن جابر بن عبد الله، قال: كنا جلوسا عند النبي ، فخط خطا هكذا أمامه، فقال: ”هذا سبيل اهلل عز وجل “، وخط خطا عن يمينه، وخط خطأ عن شماله، وقال:” هذه سبل الشيطان ” ثم وِأنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيماً فَاتَّبِعُوهُ وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ وضع يده في الخط الأوسط ثم تال هذه الآية: فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হাদিসে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে: আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট বসা ছিলাম। তিনি তার সামনে একটি রেখা আঁকলেন এভাবে। তারপর বললেন; এটা হল আল্লাহর পথ। তারপর তার ডান দিকে একটি রেখা টানলেন এবং বাম দিকে একটি রেখা টানলেন। অতঃপর বললেন; এগুলো হল শয়তানের পথ। তারপর মাঝের রেখাটিতে তার হাত রেখে তেলাওয়াত করলেন;

 অর্থ: “নিশ্চয়ই এটাই আমার সরল পথ। তাই তোমরা এরই অনুসরণ করো। অন্যান্য বহু পথের অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তিনি তোমাদেরকে এই উপদেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা ভয় করো।

 

وقال تعالى: [إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسْتَقَٰمُوا۟] قال أبو بكر الصديق (رض.): فلم يلتفتوا عنه يمنة ولا يسرة.

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন: “নিশ্চয়ই যারা বলেছে আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর অটল থেকেছে… আবু বকর সিদ্দিক রা: বলেন; অতঃপর তার থেকে ডানে বামে ঘাড় ফিরায়নি। (আল-মুতাওয়া, ৩২/২৮)

 

ومن الانبياء. عليهم الصلاة والسلام . من استمر في دعوته السنين الطوال فما آمن معه  إلال قليل من الناس، كما قال تعالى عن نوح ، الذي ظل يدعو قومه ما يزيد عن تسعمائة عام، فكانت النتيجة كما قال تعالى: [وَمَآ ءَامَنَ مَعَهُۥٓ إِلَّا قَلِيلٌ] هود: بل إن من الانبياء من لا يؤمن به إلا الرجل الواحد، كما قال: ”إن من الأنبياء نبياً ما يصدقه من أمته إلا رجل واحد

নবীদের মধ্যে এমন অনেক নবীও অতিবাহিত হয়েছেন, যারা দীর্ঘ বছর দাওয়াত চালিয়ে যান। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোকই তাদের সাথে ঈমান আনে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা নূহ আ: সম্পর্কে বলেন; যিনি তার কওমকে ৯ শত বৎসরের অধিক দাওয়াত দেন। কিন্তু ফলাফল ছিল যেমনটি আল্লাহ ﷻ বলেন , তার সাথে অল্পসংখ্যক লোকই ঈমান এনেছিল। বরং এমন নবীও অতিবাহিত হয়েছেন, যার সাথে মাত্র এক ব্যক্তি ঈমান এনেছে। যেমন নবী ﷺ বলেছেন; এমন নবীও আছেন, যাকে তার উম্মতের মাত্র একজন বিশ্বাস করেছে। (মুসলিম, সহিহ আল-জামে)

وقال: ”أشد الناس بلاءً الأنبياء ثم الصالحون، وإنكان أحدهم يفرح بالبلاء كما يفرح أحدكم بالرخاء“.

তিনি আরও বলেন; মানুষের মধ্যে সর্বাধিক পরীক্ষার সম্মুখীন হন নবীগণ, তারপর নেককারগণ। আর তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে যতটা আনন্দিত হও, তারা বিপদাপদে ততটা আনন্দিত হয়। (ইবনে মাজাহ, সিলসিলাতুস সাহিহা, ১৪৪)

 

وَلَمَّا رَءَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْأَحْزَابَ قَالُوا۟ هَٰذَا مَا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَصَدَقَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥۚ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّآ إِيمَٰنًا وَتَسْلِيمًا

যখন মুমিনরা শত্রুবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। (সুরা আহযাব, ২২)

 

ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدْ جَمَعُوا۟ لَكُمْ فَٱخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَٰنًا وَقَالُوا۟ حَسْبُنَا ٱللَّهُ وَنِعْمَ ٱلْوَكِيلُ

যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাজ সরঞ্জাম; তাদের ভয় কর। তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; কতই না চমৎকার কামিয়াবী দানকারী। (সুরা আলে-ইমরান, ১৭৩)

 

দৈনন্দিনের সহস্রাধিক সুন্নাহ – শায়খ খালিদ আল হুসাইনান রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন 

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

সহস্রাধিক সুন্নাহ

শহীদ শাইখ খালেদ আল হুসাইনান রহ.

পরিবেশনায়

 

بسم الله الرحمن الرحيم

আলহামদুল্লিাহ, ওয়াস-সালাতু ওয়াস-সালামু ’আলা রাসূলিল্লাহ, ওয়া আলা আ-লিহি ওয়া আসহাবিহী ওয়ামান তাবিয়াহু বি ইহসানিন ইলা ইয়মিদ্দীন।

আল্লাহ তা‘আলার মহব্বত (ভালবাসা) পেতে হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে তাঁর সুন্নাত মাফিক জীবন পরিচালনা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِى يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

অর্থাৎঃ- ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। (সূরা আল ইমরান: ৩১)

আমরা প্রতিদিন ১০০০ সুন্নতের উপর আমল করলে, ১ মাসে ৩০০০ সুন্নাতের উপর আমল করা হয়ে যায়। যারা এই সুন্নাত সম্পর্কে জানেনা, অথবা জানে কিন্তু মানেনা, তারা কতইনা অসংখ্য নেকী ও সাওয়াব হতে নিজেদেরকে বঞ্চিত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত সম্পর্কে জানার এবং মানার তাওফিক দান করুন। আমিন!

সুন্নাতের উপর সর্বদা আমল করলে যে উপকার হয়:

  • ঈমানদারব্যক্তিকে আল্লাহর মহব্বত লাভের স্তরে পৌঁছে দিবে, যেই স্তরে পৌছলে ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর মহব্বত লাভ করতে সক্ষম হবে।
  • ফরয আমলের ঘাটতি সুন্নাত দ্বারা পূরণ হয়।
  • সুন্নাতের উপর আমল করলে বিদআত হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
  • সুন্নাতের উপর আমল মানেই আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনকে সম্মান করা।

যিকরের ফযিলত

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَالذّٰكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذّٰكِرٰتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’ (আল আহযাবঃ ৩৫)

হাদীস শরীফে রয়েছে,

عن أبي هريرة رضي الله عنه ، قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم : (يقول الله تعالى : أنا عند ظن عبدي بي، و أنا معه إذا ذكر لي ، فإن ذكري نفسه ذكرته في نفسي ، وإن ذكرني في ملأ ذكرته في ملا خير منهم ، وإن تقرب إلي بشبر تقربت إليه ذراعا ، وإن تقرب إلي ذراعا تقربت إليه باعا ، وإن أتاني يمشي أتيته هرولة . ( الصحيح البخاري –۷۶.۵(

অথাৎঃ- ‘আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমনি ধারণা করে তেমনি। সে যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথে থাকি। সে যদি মনে মনে আমাকে স্মরন করে, আমিও আমার মনের মধ্যে তাকে স্মরণ করি। আর যদি কোন সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, আমি তাকে এর চাইতে উত্তম সমাবেশে স্মরণ করি। আর সে যদি আমার দিকে অর্ধহাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি। আর সে যদি আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দুহাত এগিয়ে আসি এবং সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌঁড়ে আসি।’[1] (সহীহ আল-বুখারী: ৭৪০৫)

হাদীস শরীফে রয়েছে,

عن أبي الدرداء ، قال : قال النبي صلى الله عليه و سلم : ألا أنبئكم بخير أعمالكم ، وأزكاها عند مليككم ، وأرفعها في درجاتكم رخير لكم من إبفاق الذهب و الورق ، وخير لكم من أن تلقوا عدوكم فتضربوا أعناقهم أعناقكم؟ قالوا : بلى . قال : ذكر الله تعالى .

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমি কি তোমাদেরকে উত্তম আমলের কথা জানাব না, যা তোমাদের প্রভুর কাছে অতি পবিত্র, তোমাদের জন্য (ইসলামের মধ্যে) অধিক মর্যাদা বৃদ্ধিকারী, স্বর্ণ-রুপা ব্যয় করা অপেক্ষা উত্তম এবং তোমরা তোমাদের (ইসলামের) শত্রুদের মুখোমুখী হয়ে তাদেরকে কতল (হত্যা) করার চাইতেও অধিক শ্রেষ্ঠ? সাহাবাগণ বললেনঃ হ্যা, তিনি বললেনঃ

আল্লাহ তা‘আলার যিকির।’[2]

নিদ্রা হতে জাগ্রত হওয়ার পরের সুন্নাতসমূহ:

১। হাত দ্বারা মুখমন্ডল মুছে ঘুমের ভাব দূর করা। হাদীস শরীফে আছেঃ

استيقظ رسول الله -صلى الله عليه وسلم- فجلس يمسح النوْم عن وجهه بيده

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে হাত দ্বারা মুখমন্ডল মুছে ঘুমের ভাব দূর করতেন।’ –মুসলিম

২। দোআ পাঠ করা:

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ

অর্থাৎ: সমস্ত প্রসংশা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদিগকে মৃত্যুর পর জীবিত করেছেন। আর তাঁর নিকটই আমাদের সকলের পূণরুত্থান হবে। – বুখারী: ৬৩১২

৩। মেসওয়াক করা। হাদীস শরীফে আছে,

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا قام من الليل ، يشوص فاه بالسواك

অর্থাৎ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের নিদ্রা হতে যখনই জেগে উঠতেন তখনই মেসওয়াক করতেন। -বুখারী: ২৪৫, মুসলিম: ২৫৫

* ঘুম থেকে জেগে মেসওয়াকের রহস্য:

১। মেসওয়াকের একটি গুন হল, তা শরীরে উদ্যমতা ফিরিয়ে আনে।

২। মেসওয়াক মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।

ইস্তেঞ্জাখানায় প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সুন্নাত সমূহ:

১। ইস্তেঞ্জাখানায় প্রবেশের সময় বাম পা দিয়ে প্রবেশ করা।

২। ইস্তেঞ্জাখানায় প্রবেশের পূর্বে দোআ পাঠ করা-

اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبَائِثِ

অর্থাৎ: ‘হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট পুরুষ ও স্ত্রী শয়তানের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই।’ – বুখারী: ৬৩২২, মুসলিম: ৩৭৫ (কেননা, ইস্তেঞ্জাখানা শয়তানদের আবাসস্থান।)

৩। ইস্তেঞ্জাখানা থেকে বের হওয়ার পর দোআ পাঠ করা। দোয়াটি হলে–

غُفْرَانَك الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنِّي الأَذَى وَعَافَانِي.

অর্থাৎ: ‘হে আল্লাহ, আপনার নিকট ক্ষমা চাই। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তা‘আলার যিনি আমার থেকে কষ্ট দুর করেছেন এবং আমাকে ক্ষমা করেছেন। ’ আবূ দাউদ: ৩০

ওযুর সুন্নাতসমূহ:

১। ওযুর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা।

২। দু’হাতের কব্জী পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা।

৩। কুলি করা।

৪। নাকে পানি দিয়ে বাম হাত দ্বারা নাক পরিষ্কার করা। হাদীসে আছে

فغسل كفيه ثلاث مرات ، ثم مضمض واستر ثلاث مرات ، ثم غسل وجهه ثلاث مرات

অর্থাৎ, অতঃপর রাসূল ﷺ তিনবার হাতের কব্জি পর্যন্ত ধৌত করলেন। অতঃপর কুলি করলেন। এর পরে তিনবার নাকে পানি দিলেন। এরপর তিনবার সমস্ত মুখমন্ডল ধৌত করলেন। -বুখারী, মুসলিম।

৫। রোযাদার ব্যতীত অন্যদের জন্য গড়গড়া সহকারে কুলি করা এবং নাকের ভিতরে যথাযথভাবে পানি দিয়ে নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وبالغ في الاستنشاق ، إلا أن تكون صائما

অর্থাৎ: তুমি নাকের ভিতর ভালোভাবে পানি ঢুকিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার কর, তবে তুমি রোযাদার হলে অতিরঞ্জিত করবে না। -নাসায়ী: ৮৭, আবু দাউদ: ২৩৬৬

বিঃ দ্রঃ- المبالغة في المضمضة এর উদ্দেশ্য হল, মুখের ভিতর নিয়ে এমনভাবে নাড়াচড়া করা যাতে মুখের ভিতরের অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়। আর

المبالغة في الإستنشاق এর উদ্দেশ্য হল, নাকের ভিতর দিয়ে খুব ভালভাবে নাক পরিষ্কার করা।  অর্থাৎ এমনভাবে নাকের ভিতরে পানি প্রবেশ করানো যাতে নাকের নরম জায়গার শেষ পর্যন্ত পানি পৌঁছে যায়।

৬। মেসওয়াক করা, ওযুর মধ্যে কুলি করার সময় মেসওয়াক করতে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء

অর্থাৎ: আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য হওয়ার আশঙ্কা না হলে আমি তাদের প্রত্যেক ওযুর সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম। – নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ: ৯৯২৮

৭। মুখ ধোয়ার সময় ঘন দাঁড়িকে হাত দ্বারা খিলাল করা। হাদীস শরীফে এসেছে,

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يخلل لحيته .

অর্থাৎ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করার সময় দাঁড়ি খিলাল করতেন। -তিরিমিযী

৮। নিম্নোক্ত নিয়মে মাথা মাসেহ করা সুন্নাত।

মাথার সামনের অংশ হতে মাসেহ শুরু করতঃ মাথার পিছনের অংশ পর্যন্ত নিয়ে আবার পিছন দিক হতে মাসেহ শুরু করে সামনের অংশে গিয়ে মাসেহ শেষ করা। হাদীস শরীফে আছে,

فمسح براسه فاقبل بيديه وأدبر بهما

‘এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার সামনের অংশ হতে মাসেহ শুরু করতঃ পিছনের অংশে গিয়ে মাসেহ করার পর পুনরায় পিছন দিক হতে সামনের অংশে গিয়ে মাসেহ শেষ করলেন।’ -বুখরী: ১৯২, মুসলিম: ২৩৫

৯। উভয় হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করা। হাদীস শরীফে রয়েছে,

أسبغ الوضوء  وخلل بين الاصابع

ওযুর প্রত্যেকটি অঙ্গ অতি উত্তম ও যথাযথভাবে ধৌত করে ওযু কর এবং আঙ্গুলসমূহ খিলাল কর। -তিরমিযী: ৭৮৮, নাসায়ী: ৮৭, ইবনে মাযাহ: ৪৪৩

১০। ডান দিক হতে ওযু শুরু করা। অর্থাৎ, হাত-পা ধৌত করার সময় প্রথমে ডান হাত, পরে বাম হাত, অনুরূপ প্রথমে ডান পা এর পরে বাম পা ধৌত করা। হাদীস শরীফে এসেছে, আম্মাজান আয়শা -রাযিয়াল্লাহু আনহা- বলেন,

كان رسول الله صلي الله عليه وسلم-يعجبه التيمن في تنعله و ترجله و طهوره, وفي شأنه كله.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সকল কাজ ডান দিক দিয়ে শুরু করা পছন্দ করতেন, যেমন, ওযু করা, চুল-দাঁড়ি আঁচড়ানো ও জুতা পরিধান করা ইত্যাদি। -বুখারী: ১৬৮, মুসলিম: ২৬৮

১১। মুখমন্ডল ও হাত-পা তিনবার করে ধৌত করা।

১২। ওযুর শেষে নিম্নোক্ত দোআ পাঠ করা,

أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ

অর্থাৎ: ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তার কোন শরীক নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

ফজিলত: যে ব্যক্তি ওযু করার পর এই দোয়াটি পাঠ করবে তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজা খুলে দেওয়া হবে। কেয়ামতের দিন সে উক্ত আটটি দরজার যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। (মুসলিম: ২৩৪)

১৩। বাড়ি হতে ওযু করে মসজিদে যাওয়া। হাদীস শরীফে আছে,

من تطهر في بيته ثم مشي الي بيت من بيوت الله ليقضي فريضة من فرائض الله كانت خطوتاه احداهما تحط  خطيئة والاخري ترفع درجة

যে ব্যক্তি পবত্রিতা অর্জন করে ফরজ নামায আদায় করার জন্য মসজিদের দিকে রওয়ানা হল তার প্রতিটি কদমে একটি একটি করে গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, আরেকটিতে তার জন্য একটি করে দরজা বুলন্দ হবে। -মুসলিম: ৬৬৬

১৪। ওযুর প্রত্যেকটি অঙ্গ পানি দেওয়ার সময় বা পানি দেওয়ার পর ভাল করে ধৌত করা, যাতে অঙ্গের প্রতিটি লোমের গোড়ায় পানি পৌঁছে।

১৫। ওযুর পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া। হাদীস শরীফে এসেছে,

كان رسول الله –صلي الله عليه وسلم-   يتوضأ بالمد

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমুদ (এক ধরণের পরিমাপ, আধারসের পরিমাণ) পরিমাণ পানি দ্বারা ওযু করতেন। -বুখারী: ২০১

১৬। হাত-পা ধোয়ার সময় তার ফরজ সীমার চেয়ে সামান্য পরিমাণ অতিরিক্ত ধৌত করা। ইমাম মুসলিম রহ. তার সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. হতে বর্ননা করেন যে, তিনি যখন ওযু করেন তখন হাত ধোয়ার সময় বাহুতেও পানি দিয়ে ধৌত করলেন। অনরূপ যখন পা ধৌত করেন তখন টাখনুর উপরেও পানি দিয়ে ধৌত করলেন। অতঃপর বললেন, আমি এভাবেই রাসূল ﷺকে ধৌত করতে দেখেছি।

১৭। ওযুর পর দু’রাকাত নামায পড়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من توضأ وضوئي هذا ثم صلي ركعتين لايحدث  فيهما نفسه غفر له ما

تقدم من ذنبه

যে ব্যক্তি আমার দেখানো এই পদ্ধতিতে ওযু করে মনের মধ্যে অন্য কোন কিছুর চিন্তা করা ব্যতীত দুই রাকাত নামায পড়বে, তার পূর্বের সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। -বুখারী: ১৫৯ ও মুসলিম: ২২৬

মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় আছে, ঐ ব্যক্তির জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে যাবে।

১৮। إسباغ الوضوءপরিপূর্ণভাবে ওযু বলতে প্রত্যেক অঙ্গকে এমনভাবে ধৌত করা যে, কোথাও যেন সামান্য পরিমাণও শুকনো না থাকে। একজন মুসলমনের জন্য দৈনিক বহুবার ওযু করার প্রয়োজন হয়। কেউ কেউ দৈনিক পাঁচবার ওযু করে। আবার কেউ কেউ যখন পাঁচওয়াক্ত ছাড়াও চাশতের নামায, তাহাজ্জুদের নামায আদায় করে, তখন তার আরও অনেকবার ওযু করার প্রয়োজন হয়। এভাবে একজন মুসলমান ব্যক্তি বারবার ওযুর মাধ্যমে উপরোক্ত সুন্নাতসমূহ আদায় করলে তার আমলনামায় অধিক পরিমাণে সওয়াব লেখা হয়।

উত্তমভাবে ওযু করার বহু ফযিলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من توضأ فأحسن الوضوء  خرجت خطاياه من جسده حتي تخرج من تحت أظفاره.

যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে তার সমস্ত শরীর হতে গুনাহসমূহ বের হয়ে যায়, এমনকি তার নখের নিচে থাকা (সুপ্ত) গুনাহও বের হয়ে যায়। -মুসলিম: ২৪৫

মেসওয়াক সম্পর্কিত জরুরী আলোচনা:

একজন মুসলমানের জন্য দিনে রাতে অনেক বারই ওযু করার প্রয়োজন হয়। আর হাদীসের মধ্যে প্রত্যেক ওযুর সময় মেসওয়াকের অনেক তাগিদ এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لولا أن أشق علي أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء

‘আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য হওয়ার আশঙ্কা না হলে, তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।’ নাসায়ী, আহমাদ: ৯৯২৮

একজন মুসলমানের দিনে-রাতে অনেক বার মেসওয়াক করতে হয়। এমনকি হিসাব করলে তা বিশবারেরও অধিক হয়। যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য, চাশতের নামাযের জন্য, বিতরের নামাযের জন্য, বাড়িতে প্রবেশের পর ইত্যাদি বিভিন্ন সময় ।

সহীহ মুসলিমে বর্ণনা আছে যে, আম্মাজান আয়েশা রাযি. বলেন,

كان اذا دخل بيته بدأ بالسواك

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই মেসওয়াক করতেন।’ – মুসলিম: ২৫৩

অন্য যেসব সময় মেসওয়াক করতে হয়, সেসব সময় হল, কোরআন তেলাওয়াতের সময়, মুখে দূর্গন্ধ অনুভূত হলে, ঘুম থেকে উঠার পর এবং ওযুর সময় মেসওয়াক করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

السواك مطهرة للفم مرضاة للرب

মেসওয়াক হচ্ছে মুখের পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। -বুখারী, নাসায়ী: ৫

মেসওয়াকের ফায়দা:

১. বান্দা মেসওয়াকের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়।

২. মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। মুখ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।

জুতা পরিধানের সুন্নাত:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا انتعل أحدكم فليبدأ باليمني واذا خلع فليبدأ بالشمال ولينعلهما جميعا أو ليخلعهما جميعا

তোমাদের কেউ যখন জুতা পরিধান করবে তখন ডান পায়ে আগে পরিধান করবে, আবার যখন খুলবে, বাম পায়ের জুতা আগে খুলবে। আর জুতা পরিধান করলে উভয় পায়ে জুতা পরিধান করবে আবার খুলে রাখলে উভয় পায়ের জুতা খুলে রাখবে। শুধু এক পায়ে জুতা পরিধান করে হাটবে না। -মুসলিম: ২০৯৭

একজন মুমিনের জীবনে প্রতিদিন এই সুন্নাতটি বহুবার আদায় করতে হয়। যেমন, মসজিদে যাওয়ার সময়, মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়, ইস্তেঞ্জায় যাওয়ার সময়। অনূরূপভাবে বিভিন্ন কাজে বাড়ীর বাইরে যেতে বহুবার জুতা পরতে ও খুলতে হয়। যখন মুমিন ব্যক্তি সুন্নাত পালনের নিয়তে জুতা পরিধান করে ও খোলে তার জন্য রয়েছে অনেক সওয়াব। এভাবে আমাদের যাবতীয় চলাফেরা সুন্নাত মাফিক হতে পারে।

পোশাক পরিধানের সুন্নাতসমূহ:

১। “বিসমিল্লাহ” বলে পোশাক পরিধান করা এবং “বিসমিল্লাহ” বলেই খুলে রাখা। আল্লামা নববী রহ. বলেন, সকল কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা মোস্তাহাব।

২। দোআ পড়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন পোশাক, চাদর অথবা পাগড়ী পরিধান করতেন তখন বলতেন,

اللّٰهُمَّ اِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِهِ وَخَيْرِ مَا صُنِعَ لَهُ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا هُوَ لَهُ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! এই পোশাকের সমস্ত কল্যাণ আমি আপনার নিকট চাই। আর এই পোশাক যে কল্যাণের জন্য তৈরী হয়েছে, সেসব কল্যাণ আমি আপনার নিকট চাই। আর এই পোশাকের যাবতীয় অকল্যাণ হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাই এবং এই পোশাকের সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় অকল্যাণ হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। -আবূ দাউদ

৩। পোশাক পরিধানের সময় ডান দিক থেকে শুরু করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا لبستم واذا توضأتم فابدئوا بأيامنكم

যখন তোমরা পোশাক পরিধান বা ওযু করবে প্রথমে ডান দিক হতে শুরু করবে। -আবু দাউদ: ৪১৪১

৪। যাবতীয় পোশাক খুলে রাখার সময় বাম দিক থেকে খোলা।

ঘরে প্রবেশ ও ঘর হতে বের হওয়ার সময় সুন্নাতসমূহ:

আল্লামা নববী রহ.বলেছেন, ঘরে প্রবেশের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলা, অধিক পরিমাণে আল্লাহর নাম স্মরণ করা এবং ঘরে যারা রয়েছে তাদেরকে সালাম দেওয়া মুস্তাহাব।

১। ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহকে স্মরণ করা। হাদীস শরীফে আছে,

اذا دخل الرجل بيته فذكر الله عند دخوله وعند طعامه قال الشيطان : لامبيت ولا عشاء

যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর নাম নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করল অতঃপর খাওয়ার সময়ও আল্লাহর নাম নিল তখন শয়তান বলে, তোমাদের এখানে রাত কাটানো ও রাতের আহার করার কোন সুযোগই রইল না।” -মুসলিম: ২০১৮

২। ঘরে প্রবেশের সময় এই দোআ পড়া,

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ خَيْرَ الْمَوْلِجِ وَخَيْرَ الْمَخْرَجِ بِسْمِ اللَّهِ وَلَجْنَا وَبِسْمِ اللَّهِ خَرَجْنَا وَعَلَى اللَّهِ رَبِّنَا تَوَكَّلْنَا.

অর্থাৎঃ হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট চাই প্রবেশের উত্তম স্থান এবং বের হওয়ার উত্তম স্থান, আল্লাহর নামে আমি ঘরে প্রবেশ করলাম এবং আল্লাহর নামে আমি ঘর থেকে বের হব। আর আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। – আবু দাউদ: ৫০৯৬

এভাবে বান্দা যদি ঘরে প্রবেশ ও ঘর হতে বের হওয়ার সময় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে তাহলে সর্বদাই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক থাকে।

৩। মেসওয়াক করা। রাসূল ﷺ সর্বদা ঘরে ঢুকে প্রথমে মেসওয়াক করতেন।

হাদীসে আছে,

كان اذا دخل بيته بدأ بالسواك

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বাড়িতে প্রবেশের পর প্রথমে মেসওয়াক করতেন।

৪। সালাম দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّـهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً ۚ

‘……অতঃপর তোমরা যখন ঘৃহে প্রবেশ কর তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।’ সূরা আন-নূর: ৬১নং আয়াতাংশ

দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কোন মুসলমান ব্যক্তি মসজিদে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের পর তার গৃহে প্রবেশ করে। তখন সে এই পাঁচটি সুন্নাত আদায় করলে প্রতিদিন তার বিশটি সুন্নাত আদায় হয়ে গেল।

৫। ঘর থেকে বের হওয়ার দোআ:

بِسْمِ اللّٰهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللّٰهِ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللّٰهِ

অর্থাৎ: আল্লাহর নামে তাঁর উপর ভরসা করে ঘর থেকে বের হচ্ছি। (কারণ) আল্লাহ ছাড়া আমার কোন উপায় এবং শক্তি নেই।

ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এই দোআ পাঠ করলে পাঠকারীকে বলা হয়,

هديت ,وكفيت,ووقيت,فتنحي له الشياطين.

তুমি সঠিক পথ-নির্দেশনা পেয়েছ। তোমার জন্য এটা যথেষ্ট হয়েছে। যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পেরেছ। শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। -তিরমিযী: ৩৪২৬ , আবু দাউদ: ৫০৯৫

আমরা দিনে-রাতে বহুবার ঘর থেকে বের হই। কখনো নামাযের জন্য, কখনো বা নিজের কাজে, কখনো ঘরের কাজে। যখনই বের হই তখনই আমরা এই সুন্নাতটি আদায় করলে বিশাল সওয়াব অর্জন করতে পারব।

ঘর থেকে বের হওয়ার উক্ত সুন্নাতটি পালনে ৩টি সুফল রয়েছে:

১। বান্দা এই সুন্নাত আদায় করলে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা হতে মুক্তি পাবে।

২। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অনিষ্টতা, অকল্যাণ ও অহীতকর যাবতীয় বিষয় হতে নিজকে রক্ষা করতে সামর্থ্য হবে। সে অনিষ্টতা মানুষ অথবা জ্বীন যে কারো তরফ হতে আসুক না কেন।

৩। এই সুন্নাত পালনের মাধ্যমে বান্দা দুনিয়া আখেরাতের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে সঠিক সিদ্ধান্তের সন্ধান পাবে।

 

মসজিদে যাওয়ার সুন্নাতসমূহ:

১। নামাযের আযান দেওয়ার পর দেরী না করে আগে আগে মসজিদে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لو يعلم الناس ما في النداء والصف الاول ثم لم يجدوا الا أن يستهموا عليه لاستهموا ولو يعلمون ما في التهجير لاستبقوا اليه, ولو يعلمون ما في العتمة والصبح لاتوهما ولو حبوا

আযান ও প্রথম কাতারে নামায পড়ার ফযিলত যদি মানুষ জানত, এমনকি তা যদি লটারী ব্যতীত পাওয়া দুষ্কর হত তবুও তারা তা পাওয়ার জন্য লটারীর মাধ্যমে হলেও পাওয়ার চেষ্টা করত। আগে আগে মসজিদে আসার যে ফযিলত তা যদি মানুষ জানত তাহলে তারা তার জন্য প্রতিযোগিতা করত। এশা ও ফজরের নামায জামাতে আদায়ের যে ফযিলত তা যদি মানুষ জানত তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করত -বুখারী: ৬৫১, মুসলিম: ৪৩৭

২। মসজিদে যাওয়ার সময় এই দোআ পড়া,

اللّٰهُمَّ اجْعَلْ فِيْ قَلْبِيْ نُوْراً، وَفِيْ لِسَانِيْ نُوْراً، وَفِيْ سَمْعِيْ نُوْراً، وَفِيْ بَصَرِيْ نُوْراً، وَمِنْ فَوْقِيْ نُوْراً، وَمِنْ تَحْتِيْ نُوْراً، وَعَنْ يَّمِيْنِيْ نُوْراً، وَعَنْ شِمَالِيْ نُوْراً، وَمِنْ أَمَامِيْ نُوْراً، وَمِنْ خَلْفِيْ نُوْراً، وَاجْعَلْ فِيْ نَفْسِيْ نُوْراً، وَأَعْظِمْ لِيْ نُوْراً، وَعَظِّمْ لِيْ نُوْراً، وَاجْعَلْ لِيْ نُوْراً، وَاجْعَلْنِيْ نُوْراً، اللّٰهُمَّ أَعْطِنِيْ نُوْراً، وَاجْعَلْ فِيْ عَصَبِيْ نُوْراً، وَفِيْ لَحْمِيْ نُوْراً، وَفِيْ دَمِيْ نُوْراً، وَفِيْ شَعْرِيْ نُوْراً، وَفِيْ بَشَرِيْ نُوْراً،

অর্থাৎ: হে আল্লাহ আমার অন্তরে আপনি নূর দান করুন, আমার জিহ্বার মধ্যে নূর দান করুন, আমার কর্ণে নূর দান করুন, আমার দৃষ্টিশক্তিতে নূর দিন। আমার সামনে ও পিছনে নূর দান করুন। আমার উপরে ও নীচে নূর দান করুন। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করুন। – মুসলিম: ৭৬৩

৩। প্রশান্ত ও ভাবগাম্ভীর্য্যের সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

اذا سمعتم الاقامة فامشوا الي الصلاة وعليكم بالسكينة والوقار ولاتسرعوا وماأدركتم فصلوا وما فاتكم فأتموا

তোমরা যখন নামাযের একামত শুনবে তখন ধীরস্থিরভাবে প্রশান্তচিত্তে নামাযের দিকে গমন করবে। তাড়াহুড়ো করবে না, যতটুকু জামায়াতের সাথে পাবে, তা পড়ে নিবে। আর যেটুকু ছুটে যাবে তা আদায় করে নিবে। -বুখারী: ৬৩৬

৪। পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া।

ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন যে, ধীরস্থিরভাবে ও ছোট ছোট কদমে মসজিদে যাওয়া সুন্নাত। এতে কদমের আধিক্যের কারণে সাওয়াবও বেশি হবে ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ألا أدلكم علي ما يمحو الله به الخطايا ويرفع به الدرجات>>. قالوا بلي يا رسول الله. قال اسباغ الوضوء علي المكاره  وكثرة الخطا الي المساجد.

আমি কি তোমাদেরকে এমন আমলের কথা বলব না, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং মর্যাদা বুলন্দ করে দেবেন? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! রাসূল স. বললেন, কষ্টের সময় উজু করা, হেটে হেটে অধিক পরিমাণে মসজিদে যাওয়া। -মুসলিম: ২৫১

৫। মসজিদে প্রবেশের সময় প্রথমে দুরুদ পাঠ করা,

اللهم صل على محمد

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর রহমত বর্ষণ করুন। তারপর এই দোআ পাঠ করা:

اللّٰهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اذا دخل أحدكم المسجد فليسلم علي النبي – صلي الله عليه وسلم-ثم ليقل اللهم افتح لي أبواب رحمتك

তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করতে আসে, তখন যেন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করে এবং বলে, ‘হে আল্লাহ আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিন।’ -ইবনে মাযাহ: ৭৭২, ইবনে হিব্বান: ২০৫০, ইবনে খুযাইমা: ৪৫২

৬। ডান পা দিয়ে প্রবেশ করা।

প্রখ্যাত সাহাবী আনাস বিন মালিক রাযি. হতে বর্ণিত,

من السنة اذا دخلت المسجد أن تبدأ برجلك اليمني , واذا خرجت أن تبدأ برجلك اليسري.

সুন্নাত হল, যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবে আর যখন তুমি মসজিদ থেকে বের হবে তখন বাম পা দিয়ে বের হবে। -মুস্তাদরাকে হাকিম: ৭৯১

৭। প্রথম কাতারে নামায আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لو يعلم الناس ما في النداء والصف الاول ثم لم يجدوا الا أن يستهموا عليه لاستهموا

অর্থাৎ: আযান ও প্রথম কাতারে নামায পড়ার ফযিলত যদি মানুষ জানত, এমনকি তা যদি লটারী ব্যতীত পাওয়া দুষ্কর হত তবুও তারা তা পাওয়ার জন্য লটারীর মাধ্যমে হলেও পাওয়ার চেষ্টা করত। -বুখারী, মুসলিম।

৮। মসজিদ হতে বের হওয়ার সময় প্রথমে দুরুদ পাঠ করা,

اللهم صل على محمد

তারপর এই দোআ পড়া,

اللَّهُمَّ إنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ.

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমি আপনার অনুগ্রহ চাই।

৯। মসজিদ হতে বের হওয়ার সময় বাম পা দিয়ে বের হওয়া।

১০। তাহিয়্যাতুল মসজিদ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا دخل أحدكم المسجد فلا يجلس حتي يصلي ركعتين.

তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দুইরাকত নামায আদায় করা ব্যতীত বসবে না।–মুসলিম:৭১৪

মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য বারবার যাওয়া আসা করলে প্রতিদিন পঞ্চাশটি সুন্নাত আদায় হয়ে যায়।

আযানের সুন্নাতসমূহ:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. যাদুল মাআ‘দ কিতাবে বলেন, আযানের সুন্নাত পাঁচটি।

১। যখন মুয়ায্যিন আযান দেয় তখন তার মতো আযানের বাক্যগুলো বলা। তবে যখন সে حى على الصلاةএবং  حي على الفلاح  বলবে তার জবাবে لاحولولا قوة إلا بالله বলবে।

ফযিলত: রাসূল ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি আযানের জবাব দিবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। -মুসলিম

২। আযানের পর এই দোআ পড়া,

أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، رَضِيْتُ بِاللّٰهِ رَبَّاً، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلاً، وَبِالْإِسْلاَمِ دِيْنَاً

অর্থাৎ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা’বুদ নাই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নাই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল। আল্লাহকে প্রতিপালক পেয়ে আর ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।’ মুসলিম: ৩৮৬

অন্য এক বর্ণনায়– أشهد এর স্থলে وأنا اشهد  উল্লেখ আছে।

যে ব্যক্তি এই সুন্নাত আমলটি করবে তার (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। -মুসলিম: ৩৮৬-মুসলিম: ৩৮৬

৩। আযানের জবাব দেওয়ার পর দুরুদ শরীফ পড়া। তবে দুরুদে ইব্রাহিমী পড়া ভাল। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول,ثم صلوا علي,فانه من صلي علي صلاة صلي الله عليه بها عشرا,

মুয়ায্যিনের আযান শুনে তোমরাও তার মত করে বল, এরপর আমার উপর দুরুদ পড়। কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরুদ পড়ে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন। -মুসলিম: ৩৮৪

৪। আযানের দোআ পড়া।

اللّٰهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ، آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيْلَةَ، وَابْعَثْهُ مَقَامَاً مَحمُوْداً الَّذِيْ وَعَدْتَهُ،

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বান এবং এই প্রতিষ্ঠিত নামাযের তুমিই প্রভু। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান কর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান এবং সুমহান মর্যাদা। আর তাকে প্রতিষ্ঠিত কর প্রশংসিত স্থানে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দিয়েছ। -বুখারী: ৬১৪

৫। এরপর নিজের জন্য দোআ করবে। আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ চাইবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তার দোআ তখন কবুল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

قل كما يقولون فاذا انتهيت فسل تعطه

মুয়াযযিন আযানে যা বলে তুমিও তার অনুরূপ বলবে। এরপর আল্লাহ তা‘আলার নিকট চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। -আবু দাউদ: ৫২৪

প্রতি ওয়াক্ত আযানে পাঁচটি সুন্নাত হলে প্রতিদিন আযানে সর্বমোট পঁচিশটি সুন্নাত হয়।

ইকামাতের সুন্নাতসমূহ:

পূর্বে বর্ণিত আযানের প্রথম ৪টি সুন্নাত ইকামাতের সময়েও সুন্নাত । এভাবে পাঁচওয়াক্ত নামাযের ইকামাতে বিশটি সুন্নাত পাওয়া যায়। আযান ও ইকামাতের সুন্নাতে এবং তার সওয়াবে পূর্ণতা অর্জনের জন্য নিম্মোক্ত বিষয়গুলোর প্রতিও

যত্নবান হওয়া কাম্য।

১। আযান-ইকামাতের সময় কিবলার দিকে মুখ করা।

২। দাঁড়িয়ে আযান-ইকামাত দেওয়া।

৩। পবিত্র অবস্থায় আযান-ইকামাত দেওয়া। ইকামাতের জন্য পবিত্রতা আবশ্যক। অপবিত্র অবস্থায় ইকামাত দেওয়া যায় না।

৪। আযান-ইকামাতের সময় ওযুভঙ্গের কোন কারণে লিপ্ত না হওয়া। বিশেষ করে ইকামাত এবং নামাযের মধ্যে তাতে লিপ্ত না হওয়া।

৫। الله শব্দটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা।

৬। আযানের সময় উভয় কানে শাহাদাত আঙ্গুল দেওয়া।

৭। উচ্চস্বরে আযান দেওয়া। তার চেয়ে কম আওয়াজে ইকামাত দেওয়া।

৮। আযান ও ইকামাতের মধ্যে কিছু সময় দেরী করা। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আযান ও ইকামাতের মধ্যে দুই রাকাত নামাযের সময় পরিমাণ দেরী করা। তবে মাগরিবের সময় দেরী না করলেও কোন অসুবিধা নেই।

১০। ইকামাতের সময় মুয়াযযিনের অনুরূপ বলবে। তবে قدقامت الصلاة এর জবাবে لاحول ولاقوة إلا بالله  বলবে।

নামাযে সুতরা ব্যবহার করা সুন্নাত:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا صلي أحدكم فليصل الي سترة وليدن منها ولايدع أحدا يمر بين يديه

তোমাদের কেউ যখন নামায আদায় করবে, সে যেন সামনে সুতরা দিয়ে নামায আদায় করে (অর্থাৎ- নামাযীর সামনে যদি চলাচল করার জায়গা থাকে অথবা মানুষ চলাচল করার সম্ভাবনা থাকে)

আর নামাযী ব্যক্তি যেন ঐ সুতরার নিকটবর্তী হয়ে নামাযে দাঁড়ায় এবং তার ও সুতরার মধ্য হতে কাউকে চলাচল করতে না দেয়। – আবূ দাউদ: ৬৯৮

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নামাযে সুতরা ব্যবহার করা পুরুষ-মহিলা সবার জন্যই সুন্নাত। চাই সে মসজিদে নামায পড়ুক বা ঘরে পড়ুক। ইমাম সুতরা ব্যাবহার করলে তা মুক্তাদিদের জন্যও যথেষ্ট হবে। তাদের জন্য আলাদা সুতরার

প্রয়োজন নেই। সব ধরণের নামাযেই আমরা সুতরা ব্যবহার করতে পারি। যেমন, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, নফল ইত্যাদি। আমরা অনেকেই সুতরা ব্যবহার না করে এই সুন্নাত আমল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

সুতরা সম্পর্কিত কিছু মাসআলা :

১। কেবলার দিকে কোন আড়াল থাকলে তার দ্বারা সুতরার সুন্নাত আদায় হয়ে যায়। যেমন, দেয়াল, লাঠি, খুটি ইত্যাদি।

২। মুসল্লী আর সুতরার মাঝে তিন হাতের দূরত্বই যথেষ্ট। অর্থাৎ, সেজদার দূরত্ব পরিমাণ দূরে থাকাই যথেষ্ট।

৩। মুক্তাদির জন্য সুতরার প্রয়োজন নেই, বরং ইমাম এবং মুনফারিদ সুতরা ব্যবহার করবে। তাই প্রয়োজনের খাতিরে মুক্তাদির সামনে দিয়ে চলাচল করা যাবে।

সুতরা ব্যবহারের ফায়দা:

১। সুতরা দ্বারা নামাযের সুরক্ষা হয়। কারণ, নামাযের সামনে দিয়ে কেউ চলাচল করলে একাগ্রতা নষ্ট হয় এবং ত্রুটিযুক্ত হয়।

২। নামাযী ব্যক্তির দৃষ্টিসীমা সুতরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এতে করে নামাযের দিকেই বেশী মনোনিবেশ হয় এবং অন্যদিকে মন উড়ে বেড়ায় না।

৩। চলাচলকারীর জন্য পথ উম্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সে মস্তবড় গুনাহ হতে রক্ষা পায়।

দৈনন্দিন সুন্নাত ও নফল নামাজসমূহ:

১। ফরয নামাযের আগে ও পরে বার রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা:

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عن أم حبيبة زوج النبي صلي الله عليه وسلم أنها قالت: سمعت رسول الله صلي الله عليه وسلم يقول : ما من عبد مسلم يصلي لله كل يوم ثنتي عشرة ركعة تطوعا غير فريضة الا بني الله له بيتا في الجنة . أو الا بني بيت له في الجنة”,

যদি কোন মুসলমান বান্দা প্রতিদিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ফরয ব্যতীত বার রাকাত নামায আদায় করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ী তৈরী করে দিবেন। – মুসলিম: ৭২৮

সুন্নাতগুলো হল:যোহরের আগে চার রাকাত, যোহরের পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পরে দুই রাকাত, এশার পরে দুই রাকাত, ফজরের আগে দুই রাকাত।

২। সালাতুদ্ দোহা صلاةالضحى বা চাশতের নামায:

মানুষের শরীরে ৩৬০টি জোড়া রয়েছে প্রতিদিনই প্রত্যেকটি জোড়ার পক্ষ হতে সদকা করার নির্দেশ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।সাথে সাথে এটাও বলা হয়েছে যে, সালাতুদ্ দোহা নামাযে ৩৬০টি সদকা করার সমান সওয়াব রয়েছে। তাছাড়া এর মাধ্যমে শরীরের এসব জোড়াসমূহের জন্য আল্লাহর শোকরও আদায় হয়ে যাবে।

মুসলিম শরীফে আছে , হযরত আবূ যার গিফারী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন,

يصبح علي كل سلامي من أحدكم صدقة .فكل تسبيحة صدقة .وكل تحميدة  صدقة. وكل تهليلة صدقة.وكل تكبيرة .وأمر بالمعروف صدقة. ونهي عن المنكر صدقة.ويجزئ  من ذلك ركعتان يركعهما من الضحي

তেমাদের শরীরের প্রতিটি জোড়ার জন্য প্রতিদিন সদকা করবে। এই সদকা আদায়ের জন্য তোমাদের প্রতিটি তাসবিহই সদকা হিসেবে গন্য করা হবে। প্রতিটি ভাল কাজের নির্দেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ সদকা হিসেবে গন্য করা হবে। তবে দুই রাকাত সলাতুদ দোহা সবগুলো সদকার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। -মুসলিম: ৭২০

অনুরূপ আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

أوصاني خليلي – صلي الله عليه وسلم- بثلاث بصيام ثلاثة أيام من كل شهر ,وركعتي الضحي وأن أوتر قبل أن أرقد .

আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করেছেন। ১. প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখবে। ২. দুই রাকাত সালাতুদ দোহা আদায় করবে। ৩. ঘুমের পূর্বে বিতরের নামায আদায় করবে। -বুখারী:১১৭৮, মুসলিম: ৭২১

বিঃ দ্রঃ- সালাতুদ দোহার (চশতের নামায) সময় শুরু হয় সূর্যোদয়ের ১৫মিনিট পর হতে। আর শেষ সময় যোহরের ১৫মিনিট আগ পর্যন্ত। সূর্যের তাপ যখন প্রখড় হয় তখন এ নামাযটি পড়া বেশী উত্তম। এ নামাযের পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই রাকাত আর সর্বোচ্চ আট রাকাত। অন্য এক বর্ণনা অনুপাতে এর কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।

২। যোহরের আগে চার রাকাত এবং যোহরের পরে দুই রাকাত সুন্নাত।

৩। আছরের নামাযের ফরযের আগে চার রাকাত সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

رحم الله امرأ صلي قبل العصر أربعا

আল্লাহ তা‘আলা তার উপর রহমত বর্ষণ করুন! যে আছরের ফরযের পূর্বে চার রাকাত নামায পড়ে। – আবু দাউদ: ১২৭১, তিরমিযী: ৪৩০

৪। এশার (ফরযের) আগে চার রাকাত সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

بين كل أذانين صلاة – قالها ثلثا قال في الثالثة – لمن شاء

প্রত্যেক দুই আযানের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ে নামায পড়। এ কথাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন বার বললেন। তিনি তৃতীয় বারে বলেন, لمن شاء যদি ইচ্ছা হয়। – বুখারী: ৬২৪ ও মুসলিম: ৮৩৮

আল্লামা নববী রহ. বলেন দুই আযান বলতে, আযান ও ইকামাত বুঝানো হয়েছে।

তাহাজ্জুদ নামাযের সুন্নাতসমূহ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم وأفصل الصلاة بعد الفريضة صلاة الليل .

রমযানের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে মুহাররম মাসের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বেত্তম নামায হল রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদ নামায। -মুসলিম: ১১৬৩

১। বিতরের নামাযসহ রাতের নফলের সর্বোত্তম সংখ্যা ১১ রাকাত অথবা ১৩ রাকাআত। দীর্ঘ কেরাত ও রুকু-সেজদা সহকারে এই নামায আদায় করা ভাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই আমল করতেন। আয়শা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كان يصلي احدي عشرة ركعة كانت تلك صلاته .

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে ১১রাকাত পড়তেন। এমনই ছিল তাঁর নামায। -বুখারী: ৯৯৪

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাতের নফল নামায রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১১ রাকাত পড়তেন। অন্য বর্ণনায় আছে,

كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يصلي بالليل ثلاث عشرة

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে ১৩ রাকাত নাময পড়তেন। -বুখারী: ১১৭০

২। সুন্নাত হলো, রাতের নফল আদায়ের জন্য ঘুম হতে জেগে প্রথমে মিসওয়াক করা এবং সূরা আলে ইমরানের ১৯০নং আয়াত হতে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করা।

৩। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত দোআ পাঠ করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা। যেমন,

اللهم لك الحمد أنت قيم السموات والأرض ومن فيهن ولك الحمد أنت نور السموات والأرض ومن فيهن ولك الحمد أنت ملك السموات والأرض ومن فيهن ولك الحمد أنت الحق ووعدك الحق ولقاؤك حق وقولك حق والجنة حق والنار حق والنبيون حق

হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা আপনারই জন্য, আকাশ ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, আপনিই এসব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। সমস্ত প্রশংসা আপনারই জন্য। আকাশ ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে আপনি এসব কিছুর আলো (জ্যোতি)। সমস্ত প্রশংসা আপনারই জন্য, আকাশ ও পৃথিবী এবং যা কিছু এর মাঝে আছে আপনিই এ সব কিছুর মালিক। আপনি সত্য, আপনার অঙ্গীকার সত্য, আপনার বাণী সত্য, আপনার সাক্ষাৎ সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীগণ সত্য। – বুখারী: ১১২০, মুসলিম: ৭৬৯

৪। রাতের নফল নামায প্রথমে দুই রাকাত ছোট কেরাতে আদায় করা, যাতে বেশি করে নফল নামায পড়ার আগ্রহ ও স্পৃহা জাগে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اذا قام أحدكم من الليل فليفتتح صلاته بركعتين خفيفتين

তোমাদের কেউ রাতে নফল নামায আদায় করতে উঠলে সে যেন প্রথমে সংক্ষেপে দুই রাকাত নামায দ্বারা শুরু করে। – মুসলিম: ৭৬৮

৫। প্রথমে এই দোয়াটি পড়া:

اللهم رب جبریل و میکائیل و إسرافيل فاطر السموات و الأرض عالم الغيب و الشهادة أنت تحكم بين عبادك فيما كانوا فيه يختلفون ، اهدني لما اختلف فيه من الحق بإذنك إنك أنت تهدي من تشاء إلى صراط مستقيم.

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! হে জীবরীল, মীকাঈল ও ঈসরাফীলের প্রতিপালক, আসমান এবং যমীনের সৃষ্টিকর্তা, গোপন-প্রকাশ্য সব কিছু সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞাত সত্তা! আপনি আপনার বান্দাদের মাঝে সেসব বিষয়ের ফয়সালা করে দিন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধে লিপ্ত। যে বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে সে বিষয়ে আপনার অনুগ্রহে আমাদেরকে সত্যের সন্ধান দিন। আপনি-ই যাকে ইচ্ছা সরল পথের দিশা দান করেন। -আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী

৬। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রাতের নফল নামায আদায় করা সুন্নাত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, সর্বোত্তম নামায কোনটি? তিনি বললেন, যে নামায দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আদায় করা হয়। -মুসলিম: ৭৫৬

৭। যেসব আয়াতে আযাবের বর্ণনা রয়েছে সেসব আয়াত তেলাওয়াত করার সময় আল্লাহর নিকট আযাব হতে পানাহ চাওয়া সুন্নাত। তখন আশ্রয় চেয়ে বলবে,

أَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ عَذَابِ للّٰهِ

অর্থাৎ: আল্লাহর কাছে আল্লাহর আযাব হতে আশ্রয় চাই।

আর রহমতের বর্ণনা সম্বলিত আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করার সময় আল্লাহর নিকট রহমত প্রার্থনা করে বলবে,

اللَّهُمَّ إنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ.

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি আপনার অনুগ্রহ চাই।

আর যেসব আয়াতে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়েছে সেসব আয়াত তেলাওয়াতের সময় সুবহানাল্লাহ পাঠ করবে।

يقرأ مترسلا اذا مر بأية فيها تسبيح سبح واذا مر بسؤال سأل واذا مر بتعوذ تعوذ

কোরআন পাঠ করবে ধীরস্থিরভাবে। যেসব আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়েছে, সেসব আয়াত তেলাওয়াতের সময় “সুবহানাল্লাহ” পাঠ করবে। যেসব আয়াতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনার বর্ণনা রয়েছে সেসব আয়াত তেলাওয়াতের সময় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে। আর যেসব আয়াতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়ার বর্ণনা রয়েছে সেগুলো তেলাওয়াতের সময় আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবে। -মুসলিম: ৭৭২

বিতরের নামাযের সুন্নাতসমূহ:

১। তিন রাকাআত বিতরের নামায আদায়ে কেরাতের মধ্যে সুন্নাত হল প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর সূরা আল আ‘লা (سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى) পাঠ করবে এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরূন (قُلْ يٰٓأَيُّهَا الْكٰفِرُونَ) এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) পাঠ করবে। -আবূ দাউদ, তিরমিযী

২। বিতরের নামায হতে সালাম ফিরিয়ে তিনবারسُبْحَانَ المَلِكِ القُدُّوْس বলা সুন্নাত। -আবূ দাউদ, ১৪৩০

৩।  ِسُبْحَانَ المَلِكِ القُدُّوْس এর সাথে স্পষ্ট ও দীর্ঘ আওয়াজে বলবে, رَبِّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوْحِ (সুনানে দারাকুতনী)

এই অতিরিক্ত অংশ বলবে অতি প্রকাশ্য ও লম্বা করে। শায়খ আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। -আবূ দাউদ, নাসায়ী

ফজরের নামাযের সুন্নাতসমূহ:

ফজরের নামাযের কয়েকটি বিশেষ সুন্নাত রয়েছে।

১। সংক্ষেপে দু’রাকাত ফজরের সুন্নাত পড়া:

كان النبي صلي الله عليه وسلم يصلي ركعتين خفيفتين بين النداء والاقامة من صلاة الصبح

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের আযান ও ইকামাতের মধ্যবর্তী সময়ে সংক্ষেপে দু’রাকাত নামায আদায় করতেন। -বুখারী: ৬১৯ ও মুসলিম: ৭২৩

২। নামাযের ফজরের দুই রাকাত সুন্নাতে কোন আয়াত পাঠ করা সুন্নাত এ বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় আছে,

كان يقرأ في ركعتي الفجر في الأولي منهما : قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا ﴿البقرة: ١٣٦﴾

الاية التي في البقرة , وفي الاخرة منهما : آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ ﴿آل‌عمران: ٥٢﴾

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের সুন্নাত নামাযের প্রথম রাকাতে সূরা বাকারার ১৩৬ নং আয়াত পড়তেন। আর শেষ রাকাতে পড়তেন সূরা আল ইমরানের ৫২নং আয়াত। -মুসলিম: ৭২৭

অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ রাকাতে সূরা আলে ইমরানের ৬৮নং আয়াত পড়তেন।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি ফজরের সুন্নাত নামাযের প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরূন আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়তেন। -মুসলিম: ৭২৬

৩। ফজরের সুন্নাতের পর কিছু সময় ডান কাত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া সুন্নাত।

كان النبي صلي الله عليه وسلم اذا صلي ركعتي الفجر اضطجع علي شقه الايمن

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের সুন্নাত আদায় করার পর ডান কাত হয়ে শুয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন। -বুখারী: ১১৬০

প্রিয় মুসলিম ভাই! আপনি ফজরের সুন্নাত আদায় করার পর কয়েক মিনিটের জন্য হলেও ডান কাত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে এই সুন্নাতটি আদায় করতে পারেন।

ফজরের নামাযের পর নামাযের জায়গায় অপেক্ষা করা

 হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে,

أن النبي صلي الله عليه وسلم كان  اذا صلي الفجر جلس في مصلاه حتي تطلع الشمس حسنا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের পর সূর্য পরিপূর্ণভাবে উঠার আগ পর্যন্ত আপন স্থানে বসে থাকতেন। -মুসলিম: ৬৭০

নামাযে পঠনীয় সুন্নাতসমূহ:

১। তাকবীরে তাহরীমার পরে ছানা পড়া।

سُبْحانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، وَتَبارَكَ اسْمُكَ، وَتَعَالَى جَدُّكَ، وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি কতইনা পবিত্র! আপনার প্রশংসা করছি। আপনার নাম বরকতময়, আপনার প্রতিপত্তি মহান, আপনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন মাবুদ নাই। -মুসলিম:৩৯৯

অথবা, এই দোআ পড়বে,

اللّٰهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِيْ وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللّٰهُمَّ نَقِّنِيْ مِنْ خَطَايَايَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الْأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اللّٰهُمَّ اغْسِلْنْي مِنْ خَطَايَايَ، بِالثَّلْجِ وَالْمْاءِ وَالْبَرَدِ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি আমার এবং আমার গুনাহসমূহের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করুন যেমনি দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে পরিচ্ছন্ন করে দিন, যেমন সাদা কাপড় ধৌত করে পরিচ্ছন্ন করা হয়। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার পাপসমূহ থেকে পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত করে পরিচ্ছন্ন করে দিন।’ – বুখারী: ৭৪৪, মুসলিম: ৫৯৮

২। সূরা পাঠের আগে أَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِপড়া

৩। অতঃপরبِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ পড়া।

৪। সূরা ফাতিহার পর (আ-মী-ন) آمين বলা।

৫। রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ  বলার পর নিম্নোক্ত দোআটি পড়া।

مِلْءَ السَّمَوَاتِ وَمِلْءَ الأَرْضِ، وَمَا بَيْنَهُمَا، وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيءٍ بَعْدُ، أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ، أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْدُ، وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ، اللّٰهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الجَدِّ مِنْكَ الجَدُّ

অর্থাৎঃ- ইয়া আল্লাহ ! আপনার জন্য ঐ পরিমাণ প্রশংসা যা আসমান ও যমীন পূর্ণ করে দেয় এবং যা এ দুই এর মধ্যবর্তী খালি স্থানকে পূর্ণ করে দেয় এবং এইগুলি ব্যতীত আপনি অন্য যা কিছু চান তা পূর্ণ করে দেয়। প্রশংসা ও সম্মানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ! বান্দা যা প্রশংসা করে আপনি তার চেয়েও বেশী প্রশংসার হকদার। আমরা প্রত্যেকেই আপনার বান্দা। হে আল্লাহ! আপনি যা দান করেন তা রোধ করার কেউ নেই এবং আপনি যা রোধ করেন তা দান করার কেউ নেই। আর কোন প্রভাবশালীর প্রভাব আপনার নিকট থেকে কোন উপকার আদায় করে দিতে পারেনা। -মুসলিম: ৪৭৭

৬। রুকু এবং সিজদার তাসবিহ একাধিক বার পাঠ করা।

৭। দুই সেজদার মাঝখানে বসে رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِيْ একাধিকবার পাঠ করা।

৮। শেষ বৈঠকে নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করা:

اللّٰهُــمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ، وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি জাহান্নামের শাস্তি থেকে, কবরের আযাব থেকে, জীবন ও মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষা থেকে এবং মাসীহ দাজ্জালের ফিতনার অনিষ্ট থেকে। -বুখারী, মুসলিম: ৫৮৮

*সিজদার তাসবীহের সাথে অন্যান্য দোআ করা মুস্তাহাব, যেহেতু হাদীসে রয়েছেঃ

أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد , فأكثروا الدعاء

সিজদারত অবস্থায় বান্দা তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার খুবই কাছে অবস্থান করে। অতএব, সেসময় আল্লাহর নিকট অধিক পরিমাণে দোআ কর। -মুসলিম: ৪৮২

এ ছাড়া অন্যান্য দোয়াও পড়া। উক্ত দোয়াগুলো সংগ্রহ করার জন্য আল্লামা কাহতানী প্রণীত ‘হিসনুল মুসলিম’ নামক ছোট কিতাবটি দেখা যেতে পারে। (এটিকে বাংলাসহ বিভিন্ন ভষায় অনুবাদ করা হয়েছে।) এভাবে পাঁচওয়াক্ত ফরজ নামাযের সর্বমোট ১৭রাকাতে পঠনিক সুন্নাতগুলোর পরিমাণ দাড়ায় ১৩৬টিতে, যদি প্রতি রাকাতে ৮টি করে সুন্নাত ধরা হয়। দিনে ও রাতে ২৫ রাকাত নফল

নামাযের মধ্যে ১৭৫টি সুন্নাত রয়েছে। কখনো কখনো এই সুন্নাতের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। যেমন, তাহাজ্জুদের নামাযের এবং চাশতের নামাযের সুন্নাতসমূহ। আর মুখে পাঠ করার এমন সুন্নাতও রয়েছে যেগুলো শুধু মাত্র একবারই নামাযে পাঠ করতে হয়। সে গুলো হলো, নামাযে হাত বাঁধার পর যে দোআ পড়া হয় এবং তাশাহহুদ অর্থাৎ “আত্তাহিয়্যাতু”এর পরে যেসকল দোআ পাঠ করার কথা হাদীসে রয়েছে। এ গুলো পড়াও সুন্নাত। এভাবে যেকোন ১টি ফরজ নামাযে মুখে পাঠ করার ১০টি সুন্নাত রয়েছে।

নামাযে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুন্নাতসমূহ:

অর্থাৎ: যেসব সুন্নাত শুধু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করতে হয়, সেগুলো হল:

১। তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় দু’হাত উপরের দিকে উঠানো।

২। দু’হাত উত্তোলনের সময় নামানোর সময় হাতের আঙ্গুলগুলো পরষ্পর মিলিয়ে রাখা।

৩। তাকবীরে তাহরীমার সময় দু’হাতের আঙ্গুলগুলো প্রশস্ত করে হাতের তালুকে কিবলামুখি করা।

৪। দু’হাতের আঙ্গুল গুলোকে দু’কাঁধ বরাবর বা দু’কানের লতি বরাবর উপরে উঠানো।

৫। হাত বাধার সময় ডান হাতকে বাম হাতের উপরে রাখা অথবা ডান হাত দ্বারা বাম হাতের কব্জিকে আঁকড়ে ধরা।

৬। সিজদার স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকা।

৭। দাড়ানো অবস্থায় দু’পায়ের মাঝে সামান্য ফাঁক রাখা।

৮। বিশুদ্ধভাবে তাজবীদের সাথে কোরআন পাঠ করা এবং কোরআনের আয়াতের মর্মবাণী উপলদ্ধি করা।

রুকুর সুন্নাতসমূহ:

১। রুকুতে হাতের আঙ্গুল ফাঁকা ফাঁকা রেখে হাঁটুকে ধরে রাখা।

২। রুকুতে পিঠ আগাগোড়া সমান রাখা।

৩। রুকুতে মাথা ও পিঠ সমান রাখা।

৪। উভয় বাহুকে শরীর থেকে আলাদা রাখা।

সিজদার সুন্নাতসমূহ:

১। সিজদায় উভয় বাহুকে শরীর থেকে আলাদা করে রাখা।

২। পেটের দুই পাশ রান থেকে আলাদা রাখা।

৩। রান পায়ের নালা থেকে আলাদা রাখা।

৪। সিজদায় এক হাটুকে অন্য হাটু থেকে আলাদা রাখা।

৫। উভয় পা খাড়া করে রাখা।

৬। উভয় পায়ের আঙ্গুল মাটির উপর রাখা।

৭। সিজদারত অবস্থায় উভয় পা মিলিয়ে রাখা।

৮। সিজদায় দু’হাত কাঁধ বরাবর অথবা কান বরাবর রাখা।

৯। সিজদায় দু’হাতের তালু ও আঙ্গুলগুলোকে বিছিয়ে রাখা।

১০। হাতের আঙ্গুলগুলোকে মিলিয়ে রাখা।

১১। আঙ্গুলগুলোকে কিবলামুখি করে রাখা।

সিজদায় উপরোক্ত কাজগুলো করা সুন্নাত।

দুই সিজদার মাঝখানের সুন্নাত:

দুই সিজদার মধ্যখানে দুই ত্বরীকার এক তরীকায় বসা।

ক. ইকআ‘- অর্থাৎ, দু’পাকে খাড়া রেখে পায়ের গোড়ালির উপর বসা।

খ. ইফতিরাশ- অর্থাৎ, ডান পাকে খাড়া রেখে বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসা।

শেষ বৈঠকের সুন্নাতসমূহ

১। ডান হাতকে ডান রানের উপর এবং বাম হাতকে বাম রানের উপর রাখা এবং হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে হাতের তালু এবং আঙ্গুলকে প্রশস্ত করে রাখা।

২। তাশাহ্হুদের সময় শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা।

৩। সালাম ফিরানোর সময় ডানে-বামে তাকানো ।

নামাযে প্রতি রাকাতে আদায় করতে হয় এমন সুন্নাত ২৫ টি। সব সুন্নাতগুলো যোগ করলে ফরজ নামাযে মোট সুন্নাতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৫টি। আর ২৫ রাকাত নফলের মধ্যে সুন্নাতের সর্বমোট সংখ্যা হবে ৬২৫টি। অনেক আমলকারী ব্যক্তি চাশত ও তাহাজ্জুদের রাকাত বেশি সংখ্যক আদায় করে থাকেন। এভাবে অধিক পরিমাণে নামায পড়লে সুন্নাতের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।

ফরয নামাযের পর মাসনূন দোআসমূহ:

১। তিন বার أَسْتَغْفِرُاللّٰهَ পড়া। তারপর এই দোআ পড়া,

اللّٰهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ، وَمِنْكَ السَّلاَمُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি শান্তিময়, আর আপনার নিকট হতেই শান্তির আগমন, আপনি কল্যাণময়, হে মহামহিম ও মর্যাদাবান!

২। ফরয নামাযের পর নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করা:

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، اللّٰهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الجَدُّ

অর্থাৎ: আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই। তার জন্যই রাজত্ব, তার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ! আপনি যা দান করেন তা রোধ করার কেউ নেই এবং আপনি যা রোধ করেন তা দানকরার কেউ নেই। আর কোন প্রভাবশালীর প্রভাব আপনার নিকট থেকে কোন উপকার আদায় করে দিতে পারে না বরং আপনিই একমাত্র দাতা।-বুখারী:৮৪৪, মুসলিম: ৫৯৩

৩। ফরয নামাযের পর নিম্নোক্ত দোআটি পড়া:

لَا إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللّٰهِ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ، وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ، لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لَا إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ وَلَوْ كَرِهَ الكَافِرُوْنَ

অর্থাৎ: আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব একমাত্র তারই, তার জন্যই সমস্ত প্রসংশা। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত গুনাহ হতে বিরত থাকা ও (তাঁর আদেশ) আদায় করার ক্ষমতা লাভ করা যায় না। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আমরা তাঁর ইবাদত ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। একমাত্র তাঁর কাছেই সমস্ত নিয়ামত, তাঁরই জন্য সমস্ত সম্মান-মর্যাদা, আর তাঁরই জন্য উত্তম প্রশংসা, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই, আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠভাবে (তাঁর দেওয়া) বিধানসমূহ আদায় করি, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। -মুসলিম: ৫৯৪

৪। ফরয নামাযের পর নিম্নোক্ত তাসবীহগুলো পাঠ করা।

সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩বার, আল্লাহু আকবার ৩৩ বার, এরপর একবার পড়বে: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ । -মুসলিম:৫৯৪

৫। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর পড়বে:

اللّٰهُمَّ أَعِنِّيْ عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমাকে আপনার যিকির, আপনার শোকর এবং সুন্দরভাবে ইবাদত করার শক্তি দান করুন। -আবু দাউদ:১৫২২, নাসায়ী

৬। ফরয নামাযের পর পড়বে:

اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ أَنْ أُرَدَّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الْقَبْرِ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই ভীরুতা (কাপুরুষতা) থেকে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই নির্ষ্কমা (অত্যধিক দুর্বল) বয়সে উপনীত হওয়া থেকে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুনিয়াবী যাবতীয় ফিতনা থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে। -বুখারী: ২৮২২

৭। ফরয নামাযের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের দিকে ফিরে এই দোয়া পড়তেন:

رب قني عذابك يوم تبعث عبادك.

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! যেদিন আপনার বান্দাদিগকে কবর থেকে উঠাবেন, তখন আমাকে আপনার আযাব থেকে রক্ষা করুন।

এই হাদীসটি মুসলিম শরীফের মধ্যে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, বারা ইবনুল আযিব রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে নামায আদায় করার সময় কাতারের ডানদিকে দাঁড়াতে ভালবাসতাম, যাতে (নামাযের পর তিনি যখন আমাদের দিকে ফিরে ডান দিকে মুখ করে বসবেন তখন) আমরা তাঁকে ভালভাবে দেখতে পারি। (তিনি যখন নামায শেষে আমাদের দিকে ফিরে বসতেন তখন আমরা)

رب قني عذابك يوم تبعث عبادكবলতে শুনেছি। -মুসলিম: ৭০৯

৮। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর পড়বে:

১বার সূরা ইখলাস, ১বার সূরা ফালাক, ১বার সূরা নাস পাঠ করবে। তবে ফজর ও মাগরিবের নামাযের পর এই ৩টি সূরার প্রত্যেকটি ৩বার করে পড়বে।

৯। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর আয়াতুল কুরসী পড়বে:

ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْحَىُّ ٱلْقَيُّومُۚ لَا تَأْخُذُهُۥ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌۚ لَّهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِۗ مَن ذَا ٱلَّذِى يَشْفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذْنِهِۦۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَىْءٍ مِّنْ عِلْمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَۖ وَلَا يَـُٔودُهُۥ حِفْظُهُمَاۚ وَهُوَ ٱلْعَلِىُّ ٱلْعَظِيمُ

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সেসবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।–বাকারা: ২৫৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পরে আয়াতুল করসী পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ছাড়া আর কোন বাধা থাকবে না। -নাসায়ী: আস-সুনানুল কুবরা: ৯৮৪৮

১০। এই দোআটি ফজর ও মাগরিবের পরে ১০বার করে পড়বে।

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

অর্থাৎ: আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তার জন্যই রাজত্ব, তার জন্যই সমস্ত প্রসংশা। তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। -তিরমিযী: ৩৫৩৪

১১। উপরে বর্ণিত তাসবীহসমূহ হাতের আঙ্গুলে পড়া। অন্য এক হাদীসে রয়েছে, ডান হাতে গুণে পড়া উত্তম।

১২। তাসবীহগুলো নামাযের স্থানে বসে পড়া। কোন প্রয়োজন ব্যতীত নামাযের স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র আদায় করবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাসবীহ পাঠের সময় তাঁর নামাযের জায়গা ত্যাগ করতেন না।

এভাবে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর প্রায় ৫৫টি সুন্নাত রয়েছে। আর ফজর ও মাগরিবে তো আরো অধিক হতে পারে।

উপরোক্ত সুন্নাতসমূহ আদায়ের ফযিলাত

১। যদি কোন মুসলিম প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর উপরোক্ত তাসবীহগুলো পড়ে, তার জন্য ৫০০ সদকার সাওয়াব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ان بكل تسبيحة صدقة, وبكل تكبيرة صدقة, وبكل تحميدة صدقة, وبكل تهليلة صدقة,

প্রতিবার ‘সুবহানাল্লাহ’ এর বিনিময় একটি সদকার সাওয়াব, তদ্রুপ প্রতিবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এর বিনিময় একটি সদকার সাওয়াব, আর প্রতিবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর বিনিময় একটি সদকার সাওয়াব রয়েছে………..। -মুসলিম: ১০০৬

এভাবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ১০০ বার করে পড়লে পাঁচশত সদকার সমান সাওয়াব পাওয়া যাবে।

২। এই তাসবীহসমূহ পাঠকারীর জন্য জান্নাতে ৫০০ গাছ রোপণ করা হবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা আবূ হুরায়রা রাযি. গাছ লাগাচ্ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ হুরায়রা রাযি. এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন: হে আবু হুরায়রা! আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম পদ্ধতি জানিয়ে দিব না? আবু হুরায়রা রাযি. বললেন: হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অবশ্যই জানিয়ে দিন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বল,

سُبْحَانَ اللّٰهِ، وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ، وَاللّٰهُ أَكْبَرُ

বিনিময়ে তোমার জন্য বেহেশতে একটি করে গাছ রোপন করা হবে। -ইবনে মাযাহ: ৩৮০৭

৩। ঐ ব্যক্তি মৃত্যুর সাথে সাথেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে।

৪। যে ব্যক্তি উপরোক্ত তাসবীহসমূহ নিয়মিত পাঠ করবে, তার (সগীরা) গুনাহ যদি সাগরের ফেনারাশির মতও হয়, তবুও আল্লাহ তা‘আলা মাফ করে দিবেন। -মুসলিম

৫। প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে উপরোক্ত যিকিরসমূহ নিয়মিত আমলকারী ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে নিরাপদ থাকবে। রাসূল ﷺ বলেন,

معقبات لايخيب قائلهن أو فاعلهن دبر كل صلاة مكتوبة: ثلاثا وثلاثين تسبيحة, ثلاثا وثلاثين تحميدة, أربعا وثلاثين تكبيرة,

কিছু সঞ্চিত তাসবীহ আছে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর যারা সেগুলো পাঠ করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে কখনো ক্ষতিগ্রস্থ এবং বঞ্চিত হবে না। সেগুলো হল, সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩বার, আল্লাহু আকবার ৩৪ বার । -মুসলিম:৫৯৬

৬। ফরয ইবাদতে কোন ত্রুটি বা ঘাটতি থাকলে উপরোক্ত যিকিরসমূহ দ্বারা তা পুরণ করে দেওয়া হবে।

সকাল-সন্ধ্যার যিকিরসমূহ

১। আয়াতুল কুরসী পাঠ করা।

যে ব্যক্তি সকালে আয়াতুল কুরসী পড়বে সন্ধ্যা পর্যন্ত জ্বিন-শয়তানের কবল হতে সে হেফাজতে থাকবে। আর যদি সন্ধ্যায় পড়ে, সকাল পর্যন্ত সে জ্বীন-শয়তানের কবল হতে হেফাজতে থাকবে। – নাসায়ী

২। সকাল-সন্ধ্যায় যে ব্যক্তি সূরা ইখলাছ ৩বার, সূরা ফালাক্ক ৩বার, সূরা নাস ৩বার করে পড়বে সে যাবতীয় অনিষ্টকারীর অনিষ্ট হতে নিরাপদ থাকবে। -আবু দাউদ: হাদীস নং-৫০৫৬

৩। এবং নিম্নের দোয়াটি সকালে পড়বে:

أَصْبَحْنَا وَأَصْبَحَ الْمُلْكُ لِلّٰهِ، وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ، لاَ إِلَهَ إلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، رَبِّ أَسْأَلُكَ خَيْرَ مَا فِيْ هَذَا الْيَوْمِ وَخَيْرَ مَا بَعْدَهُ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا فِيْ هَذَا الْيَوْمِ وَشَرِّ مَا بَعْدَهُ، رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَسُوءِ الْكِبَرِ، رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابٍ فِيْ النَّارِ وَعَذَابٍ فِيْ الْقَبْرِ

অর্থাৎ, সকাল হল আমাদের জীবনে, আমরা ও সকল বিশ্বরাজ্যের সবকিছু আল্লাহর জন্য দিনের মাঝে প্রবেশ করলাম। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআালার। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার কাছে চাচ্ছি এই দিনের এবং এই দিনের পরবর্তী সকল কল্যাণ ও মঙ্গল। আর আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি এই দিনের এবং এই দিনের পরবর্তী সকল অকল্যাণ ও অমঙ্গল হতে। হে আমার প্রভু! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি অলসতা ও বার্ধক্যের দুঃসাধ্য কষ্ট থেকে। হে আমার প্রভু! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি জাহান্নামের শাস্তি থেকে এবং কবরের শাস্তি থেকে।

আর সন্ধ্যায় পড়বে:

أَمْسَيْنَا وَ أَمْسَىا الْمُلْكُ لِلّٰهِ، وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ، لاَ إِلَهَ إلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، رَبِّ أَسْأَلُكَ خَيْرَ مَا فِيْ هَذِهِ اللَّيْلَةِ وَخَيْرَ مَا بَعْدَهَا، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا فِيْ هَذِهِ اللَّيْلَةِ وَشَرِّ مَا بَعْدَهَا، رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَسُوءِ الْكِبَرِ، رَبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابٍ فِيْ النَّارِ وَعَذَابٍ فِيْ الْقَبْرِ

অর্থাৎ: সন্ধ্যা হল আমাদের জীবনে, আমরা ও সকল বিশ্বরাজ্যের সবকিছু আল্লাহর জন্য রাতের মাঝে প্রবেশ করলাম। সকল প্রশংসা আল্লাহ তআালার। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার কাছে চাচ্ছি এই রাতের এবং এই রাতের পরবর্তী সকল কল্যাণ ও মঙ্গল। আর আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি এই রাতের এবং এই রাতের পরবর্তী সকল অকল্যাণ ও অমঙ্গল হতে। হে আমার প্রভু! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি অলসতা ও বার্ধক্যের দুঃসাধ্য কষ্ট থেকে। হে আমার প্রভু! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি জাহান্নামের শাস্তি থেকে এবং কবরের শাস্তি থেকে। -মুসলিম: ২৭২৩

৪। এবং সকালে পড়বে:

اللّٰهُمَّ بِكَ أَصْبَحْنَا، وَبِكَ أَمْسَيْنَا، وَبِكَ نَحْيَا، وَبِكَ نَمُوْتُ وَإِلَيْكَ النُّشُوْرُ

অর্থাৎ: ‘হে আল্লাহ, আপনার অনুগ্রহে আমাদের সকাল হয়েছে, এবং আপনার অনুগ্রহে আমাদের সন্ধ্যা হয়েছে, আপনার করুণায়ই জীবন লাভ করি এবং আপনার ইচ্ছায় আমরা মৃত্যুবরণ করি। আর কিয়ামত দিবসে আপনার কাছেই পুনরুত্থিত হবো। -আবু দাউদ: ৫০৬৮

সন্ধ্যায় পড়বে:

اللّٰهُمَّ بِكَ أَمْسَيْنَا، وَبِكَ أَصْبَحْنَا، وَبِكَ نَحْيَا، وَبِكَ نَمُوْتُ، وَإِلَيْكَ الْمَصِيْرُ.

অর্থাৎ: হে আল্লাহ, আপনার অনুগ্রহে আমাদের সন্ধ্যা হয়েছে, এবং আপনার অনুগ্রহে আমাদের সকাল হবে, আপনার করুণায়ই জীবন লাভ করি এবং আপনার ইচ্ছায়ই আমরা মৃত্যুবরণ করি। আপনার কাছেই আমরা ফিরে যাবো। তিরমিযী: ৩৩৯১

৫। নিম্নের দোআটি সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে:

اللّٰهُمَّ أَنْتَ رَبِّيْ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، خَلَقْتَنِيْ وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ بِذَنْبِيْ، فَاغْفِرْ لِيْ فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ،

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন ইলাহ (মা’বুদ) নাই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি আপনার বান্দা এবং যথাসাধ্য আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির উপর থাকব। আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই। আমার প্রতি আপনার নেয়ামত স্বীকার করছি এবং আপনার দরবারে আমার গুনাহের স্বীকারোক্তিও দিচ্ছি। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কেননা আপনি ছাড়া পাপ মোচন করার কেউ নেই। -বুখারী: ৬৩০৬

এটিকে ‘সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার’ বলে।

সওয়াব ও ফযিলত:

ومن قالها من النهار موقنا بها فمات من يومه قبل أن يمسي فهو من أهل الجنة , ومن قالها من الليل وهو موقن بها فمات قبل أن يصبح

যে ব্যক্তি এই ইস্তেগফার সাওয়াবের আশায়, দৃঢ় বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে সকাল-সন্ধ্যায় একবার করে পাঠ করবে, যদি সকালে পাঠ করার পর দিনের বেলায় তার মৃত্যু হয় অথবা সন্ধ্যায় পাঠ করার পর রাতে তার মৃত্যু হয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে । -বুখারী: হাদীস নং-৫৯৪৭

৬। নিম্নের দোয়াটি সকাল-সন্ধ্যায় চার বার করে পাঠ করবে:

اللّٰهُمَّ إِنّيْ أَصْبَحْتُ (أَمْسَيْتُ) أُشْهِدُكَ، وَأُشْهِدُ حَمَلَةَ عَرْشِكَ، وَمَلاَئِكَتِكَ، وَجَمِيْعَ خَلْقِكَ، أَنَّكَ أَنْتَ اللّٰهُ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ وَحْدَكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُوْلُكَ

আর সন্ধ্যার সময় ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আমছাইতু উশহিদুকা’….হতে…….ওয়া রাসূলুকা’ পর্যন্ত বলবে।

অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আপনার অনুগ্রহে (রাত অতিক্রম করে) আমি সকালে উপনীত হয়েছি, আপনাকে সাক্ষী রাখছি, আপনার আরশ বহনকারীগণ, ফেরেশতাকুল এবং আপনার সমস্ত সৃষ্টিজগতকে সাক্ষী রেখে বলছি, নিশ্চয় আপনি আল্লাহ, আপনি ছাড়া সত্য কোন মা‘বুদ নাই । আপনি এক, আপনার কোন শরীক নাই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আপনার বান্দা ও রাসূল। -আবু দাউদ: ৫০৭৮

সাওয়াব ও ফযিলত: যে ব্যক্তি এই দোআটি একবার পাঠ করবে তার এক চতুর্থাংশ আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিবেন। যে দ্ইুবার পড়বে তার অর্ধেক ক্ষমা করে দিবেন। যে তিনবার পড়ব তার তিন চতুর্থাংশ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে চার বার পড়বে তাকে পূর্ণ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

৭। নিম্নের দোয়াটি সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে:

اللّٰهُمَّ مَا أَصْبَحَ  بِيْ مِنْ نِعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ فَمِنْكَ وَحْدَكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشُّكْرُ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমার সাথে যে নেয়ামত সকালে উপনীত হয়েছে বা আপনার সৃষ্টি জগতের কারো সাথে, এর সবই এককভাবে আপনার পক্ষ হতে। আপনার কোন শরীক নাই। সুতরাং কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসামাত্রই আপনার জন্য। – নাসায়ী

আর সন্ধ্যার সময়ঃ ما اصبح بيএর পরিবর্তে  ‘ما امس بي বলবে।

সওয়াব ও ফযিলত: যে ব্যাক্তি এই দোআ সকালে একবার পাঠ করবে তার ঐ দিনের শুকরিয়া আদায় হয়ে যাবে। আর সন্ধ্যায় একবার পাঠ করলে ঐ রাতের শুকরিয়া আদায় হয়ে যাবে। -আবু দাউদ: ৫০৭৩

৮। নিম্নের দোয়াটি সকাল-সন্ধ্যায় তিন বার করে পাঠ করবে:

اللّٰهُمَّ عَافِنِيْ فِيْ بَدَنِي، اللّٰهُمَّ عَافِنِيْ فِيْ سَمْعِي، اللّٰهُمَّ عَافِنِيْ فِيْ بَصَرِي، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ، وَالفَقْرِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে শারীরিক ভাবে পুর্ণ সুস্থতা দান করুন, আমার শ্রবন শক্তি ও দৃষ্টি শক্তিকে পূর্ণ সুস্থ রাখূন। আপনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্ (মাবুদ) নাই। হে আল্লাহ ! আমি আপনার নিকট কুফরী ও দারিদ্রতা হতে আশ্রয় চাই এবং কবরের আযাব হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। আপনি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোন সত্যি ইলাহ (মাবুদ)নাই। আবু দাউদ: ৫০৯০, আহমাদ: ২০৪৩০

৯। নিম্নের দোয়াটি সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবেন,

حَسْبِيَ اللّٰهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ

অর্থাৎ: আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তার উপর ভরসা করছি, তিনি মহান আরশের অধিপতি।

এই যিকিরটি সকাল সন্ধ্যায় ৭ বার করে পাঠ করা।

ফযিলত: আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা হতে রক্ষা করবেন। -ইবনুস সুন্নী

১০। সাহাবী ইবনে উমর রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ নিচের দোয়াটি সর্বদা সকালে ও সন্ধ্যায় পাঠ করতেনঃ

اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِيْ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِيْ دِيْنِيْ وَدُنْيَايَ وَأَهْلِي، وَمَالِي، اللّٰهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِي، وَآمِنْ رَوْعَاتِي، اللّٰهُمَّ احْفَظْنِيْ مِنْ بَيْنِ يَدَيَّ، وَمِنْ خَلْفِي، وَعَنْ يَّمِيْنِي، وَعَنْ شِمَالِي، وَمِنْ فَوْقِي، وَأَعُوْذُ بِعَظَمَتِكَ أَنْ أُغْتَالَ مِنْ تَحْتِيْ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমি আমার গুনাহ মাফ চাই এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় রোগব্যাধি ও বিপদাপদ হতে আমাকে নিরাপদে রাখুন। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আমার দ্বীন, দুনিয়া পরিবার-পরিজন এবং সম্পদের নিরাপত্তা চাই। আর আমি আপনারর নিকট চাই বিপদাপদমুক্ত জীবন। হে আল্লাহ! আমার দোষত্রæটি গোপন রাখুন এবং আমাকে ভয়ভীতি হতে নিরাপদ রাখুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হিফাযত করুন আমার সামনের দিক থেকে, পিছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে এবং উপর দিক থেকে। আমি আমার পায়ের নিচের দিক হতে হঠাৎ (মাটি ধসে বা অন্য কোনভাবে) মৃত্যুবরণ হতে আপনার মহত্বের ওসিলা দিয়ে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। -আবু দাউদ: ৫০৭৪, ইবনে মাজাহ: ৩৮৭১

১১। সকাল ও সন্ধ্যায় এই দোআ পড়বে,

اللّٰهُمَّ عَالِمَ الغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَّمَلِيْكَهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِي، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطانِ وَ شِرْكِهِ ، وَأَنْ أَقْتَرِفَ عَلَى نَفْسِيْ سُوءًا، أَوْ أَجُرَّهُ إِلَى مُسْلِمٍ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ আপনি গোপন প্রকাশ্য সবকিছু জানেন, আপনি আসমান-যমিনের সৃষ্টিকর্তা। আপনি সকল কিছুর প্রতিপালক, সবকিছুরই মালিক, আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমার নিজের উপর ক্ষতিকর কিছুর অনিষ্টতা থেকে এবং শয়তান ও তার সহযোগীদের অনিষ্টতা থেকে এবং নিজের উপর ক্ষতিকর কোন কিছু প্রয়োগ করা থেকে এবং কোন মুসলমানকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপণ থেকে। আবু দাউদ, তিরমিযী।

১২। নিম্নের দোআ সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে:

بِسْمِ اللّٰهِ الَّذِيْ لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِيْ الْأَرْضِ وَلاَ فِيْ السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ

অর্থাৎ, সেই আল্লাহর নামে (দিন অথবা রাত্র শুরু করছি) যার নামের গুণের কারণে আসমান এবং যমীনের কোন কিছু কোন ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

ফযিলত: হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

من قالها في أول يومه أو في أول ليلته بِسْمِ اللّٰهِ الَّذِيْ لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِيْ الْأَرْضِ وَلاَ فِيْ السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ثلاث مرات لم يضره شيئ في ذلك اليوم أو  في تلك الليلة

যে ব্যক্তি এই দেআ সকালে তিন বার ও বিকলে তিন বার পাঠ করবে, দুনিয়ার কোন কিছুই তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। -আবু দাউদ: ৫০৮৮

১৩। এই দোআটি সকাল-সন্ধ্যায় তিন বার করে পাঠ করবে:

رَضِيْتُ بِاللّٰهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلاَمِ دِيْنًا وَّبِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيًّا

অর্থাৎ: আমি আল্লাহকে প্রতিপালক এবং ইসলামকে ধর্ম এবং মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী ও রাসূল হিসাবে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলাম।

ফযিলত: যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় তিন বার এই দোআ পড়বে, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিন সন্তুষ্ট করে দিবেন। -আবু দাউদ

১৪। এই দোআ সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে:

يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ أَصْلِحْ لِيْ شَأْنِيَ كُلَّهُ وَلاَ تَكِلْنِيْ إِلَى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ

অর্থাৎঃ- হে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী! আপনার রহমতের উসিলা দিয়ে ফরিয়াদ করছি যে, আপনি আমার সব কিছু পরিশুদ্ধ করে দিন এবং এক পলকের জন্যও আমার দায়িত্ব আমার নিজের উপর ছেড়ে দিবেন না।

১৫। অথবা, নিম্নের দোআ সকালে পাঠ করবে:

أَصْبَحْنَا عَلَى فِطْرَةِ الْإِسْلاَمِ، وَعَلَى كَلِمَةِ الْإِخْلاَصِ، وَعَلَى دِيْنِ نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَعَلَى مِلَّةِ أَبِيْنَا إِبْرَاهِيْمَ، حَنِيْفًا مُسْلِمًا وَّمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ

অর্থ্যাৎঃ- আপনার অনুগ্রহে আমি সকালে উপনীত হয়েছি ইসলামের আদর্শের উপর, একনিষ্ঠ বাণীর উপর, আমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর মিল্লাতের উপর। তিনি একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন, তিনি মুশরিকদের অর্ন্তভুক্ত ছিলেন না। মুসনাদে আহমাদ: ১৫৩৬৭

১৬। অথবা নিম্নের দোআ সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে:

سُبْحَانَ اللّٰهِ وَبِحَمْدِهِ

অর্থ্যাৎঃ- আল্লাহর প্রশংসার সমেত তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।

ফযিলত: এতে দুটি ফযিলত রয়েছে:

১। তার যাবতীয় গুনাহ মুছে দেয়া হবে, যদিও গুনাহসমূহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়ে থাকে।

২। যে ব্যক্তি সকালে ১০০ বার এবং সন্ধ্যায় ১০০ বার এই তাসবীহ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন যে তার অনুরূপ অথবা তার চেয়ে বেশি এই তাসবীহ পড়বে, সে ব্যতীত অন্য কেউ তার চেয়ে উত্তম আমল নিয়ে আসতে পারবে না

১৭। অথবা নিম্নের দোআ পাঠ করবে:

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

অর্থাৎ: আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তার কোন শরীক নাই। তার জন্যই রাজত্ব, তার জন্যই সমস্ত প্রসংশা। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান।

ফযিলত: যে ব্যক্তি দৈনিক এই দোআ একশত বার পাঠ করবে তার জন্য বড় বড় চারটি পুরস্কার রয়েছে,

১৮। অথবা দৈনিক ১০০ বার এই দোআ পাঠ করবে:

أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তার কাছে তাওবা করছি।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি প্রতিদিন আল্লাহর নিকট ১০০ বার তাওবা ও ইস্তিগফার করি। -ইবনে মাযাহ: ৯২৫

১৯। নিম্নের দোআ সকালে পাঠ করবে:

اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا، وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا

অর্থাৎঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে দান করুন উপকারী জ্ঞান, হালাল ও পবিত্র রিযিক এবং এমন আমল যা আপনি কবুল করবেন। -ইবনে মাজাহ।

২০। নিম্নের দোআটি সকালে তিনবার পাঠ করবে:

سُبْحَانَ اللّٰهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ، وَرِضَا نَفْسِهِ، وَزِنَةَ عَرْشِهِ، وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ

অর্থাৎ: আল্লাহর প্রশংসা সমেত তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, তার সৃষ্টির সমপরিমাণ, তার সন্তুষ্টির সমপরিমাণ, তার আরশের ওজনের সমপরিমাণ। তার বাণী লেখার কালি সমপরিমাণ। -মুসলিম:২৭২৬

২১। নিম্নের দোআটি সন্ধ্যায় তিনবার পাঠ করবে:

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللّٰهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

অর্থাৎ: আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীসমূহের মাধ্যমে তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি সৃষ্টির সকল প্রকারের অনিষ্ট থেকে। -মুসলিম: ২৭০৮

উপরোক্ত যিকির সমূহ থেকে যে কোন একটি যিকির আদায় করলেই একটি সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। অতএব, প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানের উচিৎ সকাল-সন্ধ্যায় উপরোক্ত যিকিরসমূহ পাঠ করা, যাতে সুন্নাতের উপর আমল করে সীমাহীন সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।

এ ছাড়াও, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী যেন উপরোক্ত যিকির সমূহের উপর একীন রেখে, ইখলাস সহকারে সেগুলো পাঠ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই যিকিরগুলোর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে। যাতে নিজেদের জীবনে এক নতুন আলো উদ্ভাসিত হয়।

মানুষের সাথে সাক্ষাতের সুন্নাতসমূহ

১। সালাম দেওয়া-নেওয়াঃ

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে,

أن رجلا سأل النبي صلي الله عليه وسلم أي الاسلام خير قال تطعم الطعام و تقرأ السلام علي من عرفت ومن لم تعرف

(ক) সে দশ জন কৃতদাস মুক্ত করার সাওয়াব পাবে।

(খ) তার আমলনামায় ১০০টি নেকী লেখা হবে।

(গ) তার ১০০টি গুনাহ মাফ করা হবে।

(ঘ) ঐ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে শয়তানের অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ রাখা হবে। -বুখারী: ৩২৯৩

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ইসলামের কোন কাজটি সর্বোত্তম? রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইসলামের সবচেয়ে ভাল কাজ হল, ক্ষুধার্তকে আহার দেওয়া এবং পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া। -বুখারী:১২ ও মুসলিম: ৩৯

অন্য হাদীসে আছে,

عن عمران بن حصين رضي الله عنهما ,قال: جاء رجل الي النبي صلي الله عليه وسلم, فقال ألسلام عليكم ,فرد عليه , ثم جلس , فقال النبي صلي الله عليه وسلم: “عشر”. ثم جاء أخر فقال : السلام عليكم ورحمة الله, فرد عليه فجلس فقال: “عشرون: ثم جاء أخر فقال : السلام عليكم ورحمة الله وبركاته , فرد عليه فجلس فقال: “ثلاثون”

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, السلام عليكم  রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম সালামের জবাব দিলেন, এরপর লোকটি বসলে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,- ১০ নেকী। এরপর অন্য এক ব্যক্তি এসে বলল,  السلام عليكم ورحمة الله রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম তার সালামের জবাব দিলেন, এরপর লোকটি বসল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ২০ নেকী। এরপর আরো এক ব্যক্তি আগমন করলো এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে সালাম দিলো, السلام عليكم ورحمة الله وبركاته রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম লোকটির সালামের জবাব দিলেন। লোকটি বসার পর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ৩০ নেকী। – আবু দাউদ: ৫১৯৫, তিরমিযী

* পরিপূর্ণ সালাম

অনেকে السلام عليكم ورحمة الله وبركاته না বলে শুধু মাত্র السلام বা السلام عليكم বলে থাকেন। এভাবে তারা ৩০টি নেকী অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। নেকীর মূল্য অনেক। কারণ, প্রতিটি নেকী সর্বনিম্ন ১০ নেকীতে রুপান্তরিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَنْ جَاءَ بِالٔحَسَنَةِ فله عشر أمثالها

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি একটি ভাল কাজ নিয়ে আসবে তার জন্য তার দশগুণ।

এই ভাবে প্রতিটি নেকীকে ১০ গুন করে বাড়িয়ে দেয়া হলে, সে ৩০০ নেকীর অধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে এর চেয়েও বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিতে পারেন।

* প্রিয় ভাই! আপনি সালাম দেওয়ার সময় পরিপূর্ণভাবে  السلام عليكم ورحمة الله وبركاته বলবেন। কেবল মাত্র السلام عليكم অথবা   السلام عليكم ورحمة الله বলেই শেষ করবেন না। যাতে পূর্ণ ৩০ নেকী অর্জন করতে পারেন।

* একজন মুমিন-মুসলমান ব্যক্তির সাথে অন্য মুসলমানের দৈনন্দিন বহুবার সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। যেমন, মসজিদে প্রবেশের সময় মুসল্লিদের সাথে বাড়িতে প্রবেশের সময় নিজ পরিবারের সাথে। এসব সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করলে সুন্নাত আদায়ের সাথে সাথে নেকীও অর্জন হবে।

* কোন মুসলিম ভাইয়ের নিকট হতে বিদায় নেওয়ার সময় পরির্পূণভাবে সালাম দেওয়া। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عن أبي هريرة قال قال رسول الله- صلي الله عليه وسلم- اذا انتهي أحدكم الي المجلس فليسلم فاذا أراد أن يقوم فليسلم فليست الاولي أحق من الاخرة.

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বণিত, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, তোমাদের কেউ কোন মজলিসে পৌঁছলে সালাম দিবে। আবার যখন সেই মজলিস ত্যাগ করে চলে যাবে তখনও সালাম দিবে। কেননা, প্রথম সালাম শেষ সালামের জন্য যথেষ্ট নয়। -আবু দাউদ: ৫২০৮, তিরমিযী: ২৭০৬

* প্রতিদিন ঘরে প্রবেশ ও বাহির হওয়া এবং মাসজিদে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় কমপক্ষে ২০ বার সালাম দেওয়ার সুযোগ হয়। আমরা যখন কাজের জন্য বের হই এবং রাস্তায় কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়, বা টেলিফোন-মোবাইলে কথা বলি, সে সময়ও অনেক বার সালাম দেওয়া নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

২। মুচকি হাঁসি:

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لاتحقرن من المعروف شيئا ولو أن تلقي أخاك بوجه طلق.

সামান্যতম ভাল কাজকেও অবহেলা করবে না; যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করার মত সাধারণ কাজ হয়ে থাকে। -মুসলিম: ২৬২৬

৩। মুসাফাহা:

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

قال رسول الله- صلي الله عليه وسلم: ” ما من مسلمين يلتقيان فيتصافحان , الات غفر لهما قبل أن يتفرقا “.

দুজন মুসলমান পরষ্পর সাক্ষাতের সময় হাত মিলায়, (অর্থাৎ মুসাফাহ করে) তারা পৃথক হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মাফ করে দেন। -আবু দাউদ: ৫২১২

ইমাম নববী রহ. বলেন, প্রত্যেক বার সাক্ষাতে মুসাফাহ করা মুস্তাহাব। অতএব, সালাম দিয়ে হাসি মুখে মুসাফাহ করলে আপনি ৩টি সুন্নাত একই সময়ে আদায় করতে পারলেন।

৪। ভালো কথা বলা:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَقُل لِّعِبَادِى يَقُولُوا الَّتِى هِىَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطٰنَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطٰنَ كَانَ لِلْإِنسٰنِ عَدُوًّا مُّبِينًا

অর্থাৎ, আর আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন উত্তম কথাই বলে, নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধায়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। -সূরা আল ইসরা: ৫৩

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন

ألكلمة الطيبة صدقة.

ভালো কথা বলাও সদকাহ। বুখারী, হাদীস নং-২৮২৭, মুসলিম।

ভালো কথা হল, যে কোন যিকির, দোআ, সালাম দেওয়া-নেওয়া এবং সত্য প্রশংসা, উত্তম-উন্নত চরিত্র ও আচার-ব্যবহার বা ভাল কথা বার্তা, দ্বীনি আলোচনা, প্রশংসনীয় ও সুন্দর আদাব (শিষ্টাচার) এবং সুন্দরতম সকল কাজকর্ম। উত্তম বা ভাল কথা-বার্তা মানুষের মধ্যে যাদুর মত কাজ কর, মানুষের অন্তরকে আনন্দ দেয় এবং আত্মাকে প্রশান্ত ও শীতল করে। অতঃএব, আপনি সকাল থকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনার পূর্ণ সময়টুকু ভাল কথাবার্তা দ্বারা সাজিয়ে নিয়েছেন কি? সুন্দর আচার-ব্যবহার দ্বারা জীবন পরিচালনা করছেন কি? আপনার স্বামী/স্ত্রী, সন্তানরা, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবগণ এবং আপনার বাসা-বাড়ীর কাজের লোকের সাথে আপনি কি সুন্দর আচার ব্যবহার করছেন, যারা আপনার নিকট হতে সুন্দর ও উত্তম ব্যবহারের আশা করে?

পানাহারের সুন্নাতসমূহ

* খানা খাওয়ার পূর্বের ও খানা খাওয়ার সময়ের সুন্নাতসমূহ:

১। বিসমিল্লাহ বলা।

২। ডান হাত দ্বারা খাওয়া।

৩। পাত্র থেকে নিজের সামনের দিক হতে শুরু করা।

সহীহ মুসলমি শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন আবূ সালামাকে পানাহারের আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্য বললেন:

يا غلام سم الله وكل بيمينك وكل مما يليك .

হে বালক! তুমি বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে খাও এবং নিজের সামনের দিক হতে খাও। মুসলমি: ২০২২

৪। হাত থেকে লোকমা পড়ে গেলে পরষ্কিার করে খাওয়া।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا سقطت من  أحدكم اللقمة فليمط ما كان بها من أذي ثم ليأكلها

তোমাদের কারো হাত থেকে লোকমা পড়ে গেলে সে যেন তা পরিষ্কার করে খেয়ে নেয়।-মুসলমি: হাদীস নং-২০৩৩

৫। তিন আঙ্গুল দ্বারা খাওয়া:

হাদীসে বর্ণিত আছে:

كان رسول الله- صلي الله عليه وسلم – يأكل بثلاث أصابع

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন আঙ্গুল দ্বারা খানা খেতেন। -মুসলমি: হাদীস নং-২০৩২

৬। খাওয়ার সময় বসার দুটি পদ্ধতি:

ক. দুই হাটু এবং দুই পায়ের পিঠের উপর নতজানু হয়ে বসা।

খ. ডান পা খাড়া করে বাম পায়ের উপর বসা।

হাফেজ ইবনে হাজার আল আসাকালানী “ফাতহুল বারী”তে এটিকে মুস্তাহাব বলেছেন।

* খানা খাওয়ার পরের সুন্নাতসমূহ:

১। খানা খাওয়ার পর পাত্র এবং আঙ্গুল চেটে খাওয়া।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাওয়ার পর হাতের আঙ্গুলসমূহ এবং প্লেট চেটে খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন,

انكم لاتدرون في أيها البركة.

বরকত কোথায় রয়েছে তা তোমাদের জানা নেই। -মুসলিম: ২০৩৩

২। খাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসায় “আলহামদুলিল্লাহ” বলা। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ان الله ليرضي عن العبد أن يأكل الأكلة فيحمده عليها

বান্দা যখন আহার করে তখন আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করলে তিনি বান্দার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। মুসলিম: হাদীস নং- ২৭৩৪

৩। খানা খাওয়ার পর এই দোআ পড়া। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খানা খাওয়ার পর পড়তেন,

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنِيْ هَذَا، وَرَزَقَنِيْهِ، مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّيْ وَلاَ قُوَّةٍ

অর্থাৎ: সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি আমাকে আহার করিয়েছেন এই খাদ্য এবং আমার কোন প্রকার শক্তি ও সামর্থ্য ছাড়াই আমাকে এই রিযিক দিয়েছেন। -মুসলিম: ৭১০৮

এই দোয়ার ফযিলত: যে ব্যক্তি এই দোআ পাঠ করবে তাকে সুসংবাদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

غفر له ما تقدم من ذنبه

আল্লাহ তা‘আলা তার পূর্বের সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দিবেন। -আবূ দাউদ: ৪০২৩

আমাদের প্রতদিন প্রায় তিন বেলা আহার করার প্রয়োজন হয়। তখন এই সুন্নাতগুলো আদায় করলে দৈনিক কমপক্ষে ১৫ টি সুন্নাত আদায় হয়ে যায়। আর যদি এই তিন বেলার পাশাপাশি মাগরিবের পর বা আসরের পর অথবা অন্য সময়ে হালকা কিছু খাওয়ার অভ্যাস থাকে, সেক্ষেত্রে ১৫টির চেয়েও অধিক সুন্নাত আদায় করার সুযোগ রয়েছে।

* পান করার সুন্নাতসমূহ

১। বিসমিল্লাহ পাঠ করা।

২। ডান হাতে পান করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন আবূ সালামাকে সম্বোধন করে বলেন-

يا غلام سم الله وكل بيمينك وكل مما يليك .

হে বালক! তুমি বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে খাও এবং নিজের সামনের দিক হতে খাও। মুসলিম: ২০২২

৩। পান করার সময় নিঃশ্বাস পাত্রের বাইরে ফেলা। তিন বার হালকা নিঃশ্বাস ফেলে পান করা অর্থাৎ একবারে পান না করা। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

كان رسول الله – صلي الله عليه وسلم- يتنفس في الشراب ثلاثا

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন বার হালকা নিঃশ্বাস ফেলে পান করতেন। -মুসলিম: ২০২৮

৪। বসে পান করা। হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لايشربن أحد منكم قائما

তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। মুসলিম: ২০২৬

৫। পান করার পর الحمد للهবলা। রাসূল ﷺ বলেন,

ان الله ليرضي عن العبد أن يأكل الأكلة فيحمده عليها  أو  يشرب الشربة فيحمده عليها

বান্দা যখন আহার করে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করে, তিনি বান্দার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। তদ্রুপ পানীয় পান করার পর আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করলে তিনি তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।-মুসলিম: ২৭৩৪

পান করার সময় দৈনন্দিন আমরা কমপক্ষে ২০ টি সুন্নাত আদায় করতে পারি। কখনো কখনো সুন্নাত আরো বেড়ে যায়, যখন আমরা যাবতীয় ঠান্ডা ও কোমল পানীয় পান করে থাকি। অবহেলার কারণে যেন আমাদের কাছ থেকে এসব সুন্নাত ছুটে না যায়।

আপন ঘরে নফল নামায আদায় করা

১। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

فان خير صلاة المرء في بيته الا الصلاة المكتوبة

ফরজ ব্যতীত অন্য নামায ঘরে আদায় করা উত্তম । -বুখারী: ৬১১৩, মুসলিম: ৭৮১

২। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

عن ابن صهيب عن أبيه صهيب رضي الله عنه, قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم : صلاة الرجل تطوعا حيث لايراه الناس تعدل صلاته علي أعين الناس خمسا وعشرين

মানুষের মাঝে নফল নামায আদায় করার চেয়ে আড়ালে আদায় করার সাওয়াব ২৫ গুণ বেশী। আল-মাত্বালিবুল আলিয়া: ৫৭৪

৩। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

فضل صلاة الرجل في بيته علي صلاته حيث يراه الناس , كفضل المكتوبة علي النافلة

জনসমাগমে নামায পড়ার চেয়ে আড়ালে নামায পড়ার তেমন ফজিলাত যেমন ফরযের ফজিলাত নফলের উপর। -তাবারানী

ফরয নামাযের আগে ও পরের সুন্নাতসমূহ, চাশতের, বিতরের, এ ধরণের আরো যেসব নফল নামায আছে, সেগুলো আমরা ঘরে আদায় করে সীমাহীন সওয়াবের অধিকারী হতে পারি। এতে সুন্নাতের উপরও আমল হয়ে যায়।

* বাড়ীতে নফল আদায় করার ফায়দা:

ক. পরিপূর্ণ নম্রতা الخشىع (একনিষ্ঠতা) إخلاص একাগ্রচিত্তে আদায় করা সম্ভব হয় এবং রিয়া (ইবাদতে লোক দেখানো ভাব) আসে না।

খ. বাড়ীতে নফল নামায আদায় করলে বাড়িতে রহমত নাযিল হয় এবং বাড়ী হতে শয়তান দূর হয়।

গ. দ্বিগুণ হতে বহুগুণ সাওয়াব হাছিল করা যায়, যেমন মসজিদে ফরয আদায় করলে বহুগুণ সাওয়াব পাওয়া যায়।

মজলিস হতে উঠার সুন্নাত

মজলিস হতে উঠার সময় নিম্নোক্ত দোআটি পাঠ করা সুন্নাত। এটিকে কাফফারাতুল মজলিসও বলা হয়–

سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনার প্রশংসা সমেত পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত প্রকৃত কোন মাবু’দ নেই। আপনার কাছে ক্ষমা চাই এবং আপনার নিকট তাওবা করছি। -আবু দাউদ: ৪৮৫৯

আমরা অনেক সময়েই বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হয়ে থাকি। যেমন খাওয়া-দাওয়া, সভা-সমাবেশ, পরিচিত লোকের সাথে একান্তে কথা বলা, অনেক দিনের বন্ধুর সাথে আলাপচারিতা, শিক্ষাপ্রদানের মজলিস, আপন পরিবারের সাথে একত্রে খোশগল্প, চলার পথে পরিচিত জনের সাথে কথা-বার্তা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে আমরা জমায়েত হয়ে থাকি। এক্ষত্রে আমরা এ সুন্নাতটি আদায় করে অনেক সওয়াবের অধিকারী হতে পারি।

দোআটির নিগুঢ় রহস্য:

“সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা” অর্থ, ‘পবিত্রতা বর্ণনা করছি হে আল্লাহ! আপনার প্রশংসা সমেত’। এতে আপনি আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলেন। এর সঙ্গে সঙ্গে আপনি তাওবা ও ইস্তিগফারকে নবায়ন করার জন্য পড়লেন “আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুউবু ইলাইকা” অর্থ, ‘আপনার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাওবা করছি।’এতে আপনি আপন অপরগতার কারণে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আর আপনি যখন “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আন্তা” বললেন, তখন আপনি আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ ও তাওহীদকে স্বীকার করে ভবিষ্যতের জন্য সরল পথের পথিক হলেন। এভাবে আপনি আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের স্বীকারোক্তি ও তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে সারাদিনে সংঘটিত হওয়া যাবতীয় গুনাহ ও ভুল-ত্রুটি মাফ চেয়ে নেওয়া এবং পরিশুদ্ধ হওয়ার এক মহা সুযোগ গ্রহণ করলেন।

নিদ্রা যাওয়ার সময়ের সুন্নাতসমূহ

১। ঘুমের আগে এই দোয়াটি পড়বে:

بِاسْمِكَ اللّٰهُمّ  أَمُوْتُ وَأَحْيَا

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আপনার নামে মৃত্যুবরণ করছি এবং আপনার নামেই জীবিত হব। -বুখারী: ৬৩১২

২। সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক সূরা নাস পাঠ করে দুই হাতের তালুতে করে ফুঁক দিবে, এরপর মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত শরীরের যতটুকু সম্ভব হয় হাত দ্বারা মুছে নিবে। এভাবে তিনবার করবে। -আবু দাউদ:

৩। আয়াতুল কুরসী পাঠ করা। -বুখারী: ৩২৭৫

আয়াতুল কুরসী পাঠ করার ফযিলত:

ক. সর্বদা তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে এক জন হেফাজতকারী (নিরাপত্তারক্ষী) তাকে পাহারা দিবে।

খ. শয়তান তার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না।

৪। অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে:

بِاسْمِكَ رَبِّيْ وَضَعْتُ جَنْبِي، وَبِكَ أَرْفَعُهُ، فَإِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِيْ فارْحَمْهَا، وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا، بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِيْنَ

অর্থাৎ: হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার নামেই আমার পার্শ্বদেশ বিছানায় রাখছি এবং আপনার নামেই তা উঠাব। যদি ঘুমের মধ্যে আমার প্রাণবায়ু নিয়ে নেন তাহলে আপনি তার প্রতি রহম করুন। আর যদি ফিরিয়ে দেন তাহলে তাকে আপনি হেফাজত করুন। যেভাবে আপনার নেককার বান্দাদের রূহকে হেফাযত করে থাকেন।-বুখারী: ৬৩২০, মুসলিম: ২৭১৪

৫। অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে:

اللّٰهُمَّ خَلَقْتَ نَفْسِيْ وَأَنْتَ تَوَفَّاهَا، لَكَ مَمَاتُهَا وَمَحْيَاهَا، إِنْ أَحْيَيْتَهَا فَاحْفَظْهَا، وَإِنْ أَمَتَّهَا فَاغْفِرْ لَهَا، اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ العَافِيَةَ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি আমার রূহকে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনি তাকে মৃত্যু দান করবেন। এর জীবন-মরণ সবই আপনার জন্য। যদি তাকে জীবিত রাখেন তাহলে তাকে হেফাজত করুন, আর যদি তাকে মৃত্যুদান করেন তবে তাকে মাফ করে দিন। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আমার নিরাপত্তা চাই। -মুসলিম: ২৭১২

৬। শোয়ার পর ডান হাত গালের নিচে রেখে তিনবার এই দোআটি পড়বে:

اللّٰهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ

অর্থ: হে আল্লাহ! যেদিন আপনি আপনার বান্দাদের পুনঃজীবিত করবেন সেদিনের আজাব হতে আমাকে বাঁচান। -আবু দাউদ: ৫০৪৫ ও তিরমিযী: ৩৩৯৮

৭। শোয়ার সময় সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহাদুলিল্লাহ ৩৩ বার, আল্লাহু আকবার ৩৪ বার পড়বে। – বুখারী: ৫৩৬২ ও মুসলিম: ২৭২৮

৮। অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে:

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَكَفَانَا، وَآوَانَا، فَكَمْ مِمَّنْ لاَ كَافِيَ لَهُ وَلاَ مُؤْوِيَ

অর্থাৎ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি আমাদেরকে খাওয়ান, পান করান, আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। অথচ দুনিয়াতে বহু মানুষ এমন রয়েছে, যাদের দয়া প্রদর্শনকারী এবং কোন আশ্রয় দানকারী নেই। -মুসলিম: ২৭১৫

৯। অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি ১বার পড়বে:

اللّٰهُمَّ عَالِمَ الغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَّمَلِيْكَهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِي، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطانِ وَشِرْكِهِ، وَأَنْ أَقْتَرِفَ عَلَى نَفْسِيْ سُوءًا، أَوْ أَجُرَّهُ إِلَى مُسْلِمٍ

অর্থাৎ, হে আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা, গোপন ও প্রাকাশ্য সব কিছুর জ্ঞানের অধিকারী- আল্লাহ! আপনি ব্যতীত আর কোন মা‘বুদ নেই। আপনি সব কিছুর প্রতিপালক, সবকিছুরই মালিক, আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আপন প্রবৃত্তি থেকে, শয়তান ও তার সহযোগীদের অনিষ্ট থেকে এবং নিজের উপর ক্ষতিকর কোন কিছু প্রয়োগ করা থেকে এবং কোন মুসলমানকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপণ থেকে। তিরমিযি: হাদীস নং-৩৫৯৮, আবু দাউদ।

0অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে:

اللّٰهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِيْ إِلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أَمْرِيْ إِلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِيْ إِلَيْكَ، وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِيْ إِلَيْكَ، رَغْبَةً وَّرَهْبَةً إِلَيْكَ، لاَ مَلْجَأَ وَلاَ مَنْجَا مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِيْ أَنْزَلْتَ، وَبِنَبِيِّكَ الَّذِيْ أَرْسَلْتَ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার দেওয়া যাবতীয় বিধানের কাছে সঁপে দিলাম। আমার সকল বিষয় আপনার কাছে সোপর্দ করলাম। আমার পৃষ্ঠকে আপনার দিকে ঝুঁকিয়ে দিলাম। এসব কিছু করলাম আপনার শাস্তির ভয়ে এবং আপনার রহমতের আশায়। আপনি ছাড়া কোন আশ্রয় নেই এবং মুক্তিরও উপায় নেই । আপনি যে কিতাব নাযিল করেছেন এবং যে নবীকে প্রেরণ করেছেন তার প্রতি ঈমান আনলাম। -বুখারী: ৬৩১৩, মুসলিম: ২৭১০

1অথবা নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে:

اللّٰهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الأَرْضِ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ، فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى، وَمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ، وَالْفُرْقَانِ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ، اللّٰهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُوْنَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ

অর্থাৎ: হে আল্লাহ! সাত আসমান, যমীন এবং আরশে আযীমের প্রতিপালক! হে সমগ্র জগতের প্রতিপালক! বীজ ও শস্যদানা হতে উদ্ভিদ সৃষ্টিকারী! তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআন অবতীর্ণকারী! আমি আপনার নিকট আপনার হাতের মুঠোয় আয়ত্বাধীন প্রতিটি সৃষ্টির অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আপনি সর্বপ্রথম, আপনার পূর্বে কিছুই নেই এবং ছিল না, আপনিই সর্বশেষ বিরাজমান থাকবেন, আপনিই প্রভাবশালী, আপনার উপর আর কেউ নেই, আর আপনিই প্রকাশ্য, আপনিই গোপন। আপনি আমাদের ঋণ হতে পরিত্রাণ দান করুন এবং দারিদ্রতা দূর করে দিন।

১১। সূরা বাকারার শেষ দু’ আয়াত পাঠ করবে:

ءَامَنَ الرَّسُولُ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِۦ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ ءَامَنَ بِاللَّهِ وَمَلٰٓئِكَتِهِۦ وَكُتُبِهِۦ وَرُسُلِهِۦ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِۦ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ ۝ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَآ إِن نَّسِينَآ أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَآ إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُۥ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِۦ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَآ ۚ أَنتَ مَوْلٰىنَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِينَ ۝

অর্থাৎ, রাসূল বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে, যা তাঁর আদায়কর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমুহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের আদায়কর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। সে তা-ই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তার উপর তাই বর্তায় যা সে করে। হে আমাদের আদায়কর্তা! আমাদের উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর করেছেন। হে আমাদের প্রভূ! আমাদের দ্বারা সেই বোঝা বহন করাবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন করুন। আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই আমাদের প্রভ‚। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। -সূরা বাকারা: ২৮৫-২৮৬

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من قرأ بهما من ليلة كفتاه

যে ব্যক্তি এই দুই আয়াত রাতে পাঠ করবে, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হবে। -বুখারী, হাদীস নং- ৪৭৫৩, মুসলিম।

উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সূরা বাকারার শেষ দু’আয়াত যে ব্যক্তি রাতে পাঠ করবে আয়াত দু’টি ঐ রাতের যাবতীয় বিপদাপদ ও শয়তানী অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে তার জন্য যথেষ্ট হবে। -বুখারী: ৫০০৯, মুসলিম: ৮০৭

ইমাম নববী বলেন, আলেমগণ ‘যথেষ্ট হবে’ কথাটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন: কেউ বলেছেন, আয়াত দুটি ঐ রাতের তহাজ্জুদ নামায আদায়ের স্থলাভিসিক্ত হবে। আবার কেউ বলেছেন, এই আয়াত দুটি পাঠ করলে আল্লাহর হুকুমে যাবতীয় অনিষ্টতা ও বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। আবার কেউ বলেছন, এখানে উভয়টি উদ্দেশ্য।

১২। ওযু অবস্থায় ঘুমাবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

اذا أخذت مضجعك فتوضأ وضوءك للصلاة

‘তুমি যখন শয্যাস্থলে ঘুমাতে আসবে তখন নামাযের ওযুর মত ওযু করে নিবে।’ -মুসলিম: ২৭১০

১৩। ডান কাত হয়ে ঘুমাবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

ثم اضطجع علي شقه الأيمن

‘অতঃপর তুমি ডান কাত হয়ে শুবে।’ -বুখারী: ২৪৭, মুসলিম: ২৭১০

১৪। ডান হাতটিকে ডান গালের নিচে রেখে ঘুমাবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

أن رسول الله صلي الله عليه وسلم كان اذا أراد أن يرقد وضع يده اليمني تحت خده

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমাবার সময় ডান হাতকে ডান গালের নিচে রাখতেন। -আবু দাউদ: ৫০৪৫

1৬। বিছানা ঝেড়ে নেওয়ারাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اذا أوي أحدكم الي فراشه فليأخذ داخلة ازاره فلينفض بها فراشه وليسم الله فانه لايعلم ما خلفه بعده علي فراشه

তোমাদের কেউ বিছানায় গেলে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে চাদরের (বা যে কোন কাপড়ের) আচল দ্বারা বিছানা ভালভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিবে। কেননা, সে তো জানেনা যে, তার বিছানা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কোন ধুলোবালি বা ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ বিছানায় এসেছে কিনা? -বুখারী: ৬৩২০ ও মুসলিম: ২৭১৪

1৭। সূরা কা-ফিরূন পাঠ করা।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

فانها براءة من الشرك

এ সূরায় শিরিক থেকে সম্পর্ক ছিন্নতার ঘোষণা রয়েছে। -আবু দাউদ: ৫০৫৫

ইমাম নববী রহ. বলেন, উত্তম হল, উপরোক্ত দোআসমূহের সবগুলো পাঠ করা। যদি সম্ভব না হয় তবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দোআসমূহ পাঠ করবে। মানুষের অভ্যাস অনুযায়ী দেখা যায় যে, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ দিনে ও রাতে দুইবার ঘুমিয়ে থাকে। উপরে বর্ণিত সুন্নাত মাফিক দোআসমূহ বা কিছু সংখ্যক দোআ দুই বার পাঠ করবে। কেননা, উপরে বর্ণিত দোআসমূহ শুধুমাত্র রাতের ঘুমের সময়ই পাঠ করতে হবে, এমনটি নয়; বরং দিনের বেলায় ঘুমালেও এই দোআগুলো পাঠ করা সুন্নাত। কেননা, উপরে বর্ণিত দোআ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ শুধুমাত্র রাতে ঘুমানোর পূর্বে পাঠের জন্য নির্ধারিত নয়; বরং যে কোন সময়ে নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে দোআগুলো যথাসাধ্য পাঠ করার চেষ্টা করবে।

 

উপরে বর্ণিত দোআসমূহ পাঠ করার ফায়দা

১। ঘুমানোর সময় উপরোক্ত তাসবীহসমূহ পাঠ করলে আমল নামায় ১০০ সাওয়াব লেখা হবে।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

أو ليس قد جعل الله لكم ما تصدقون ان بكل تسبيحة صدقة وكل تكبيرة صدقة وكل تحميدة صدقة وكل تهليلة صدقة .

আল্লাহ তা‘আলা কি তোমাদের জন্য এমন বিষয় নির্ধারণ করেন নি, যার মাধ্যমে তোমরা সদকা করবে? নিশ্চয়ই প্রতিবার ‘সুবহানাল্লাহ’ পড়লে একটি সদকার সাওয়াব, তদ্রুপ প্রতিবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়লে একটি সদকার সাওয়াব আর প্রতিবার ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ পড়লে একটি সদকার সাওয়াব রয়েছে। -মুসলিম: ১০০৬

* আল্লামা নববী রহ. বলেন, ঘুমের পূর্বে উপরোক্ত তাসবীহ পাঠকারীর জন্যও অনুরূপ সাওয়াব রয়েছে।

২। যে ব্যক্তি নিয়মিত ঘুমের পূর্বে উপরোক্ত তাসবীহসমূহ পাঠ করবে জান্নাতে তার জন্য ১০০টি গাছ রোপণ করা হবে। (এ সম্পর্কিত হাদীস পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।)

৩। যে ব্যক্তি ঘুমানোর আগে উপরোক্ত দোআসমূহ পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিফাযতে রাখবেন, তার কাছ থেকে শয়তান দূর হয়ে যাবে এবং যাবতীয় শয়তানী অনিষ্টতা ও বিপদাপদ হতে সে নিরাপদ থাকবে।

৪। ঘুমানোর আগে তাসবীহাত আদায় করা মানে- বান্দা যেন তার এ দিনটি আল্লাহর যিকির, তাঁর আনুগত্য, তাঁর উপর ভরসা, তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা এবং তাঁর একত্ববাদের (তাওহীদের) স্বীকৃতি দিয়ে শেষ করল।

সর্বকাজে সাওয়াবের নিয়ত করা।

যে কোন বৈধ, শরীয়ত অনুমোদিত কাজ এবং ভাল কাজ সওয়াবের নিয়তে করা।

জেনে রাখুন! আমরা ঘুম, খাওয়া, পান করা, রিযিকের সন্ধানে কাজকর্মসহ যাবতীয় দুনিয়াবী স্বাভাবিক কাজ-কর্ম (যেগুলিকে আমাদের শরীয়তে মুবাহ তথা বৈধ বলা হয়) সেগুলো করার সময় আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য ও রেজামন্দি লাভের নিয়ত করলেই অসংখ্য অগণিত নেকী লাভ করতে পারি। কারণ সওয়াবের নিয়তের দরুণ যাবতীয় দুনিয়াবী কাজকর্ম ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

انما الأعمال بالنيات وانما لكل  لامرئ ما نوي

যাবতীয় কর্মের ফলাফল নিয়ত অনুযায়ী হয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করবে তদনুযায়ী তার ফলাফল ভোগ করবে। বুখারী: ১, মুসলিম: ১৯০৭

মনে করুন: ফজরের নামায অথবা শেষরাতে উঠে নামায পড়ার জন্য যদি কোন ব্যক্তি এশার নামাযের পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ঘুম ইবাদতে পরিণত হবে অর্থাৎ তার এই তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য সে যতক্ষণ ঘুমের মধ্যে থাকে ততক্ষণ তার আমলনামায় সাওয়াব লেখা হবে। যদিও ঘুম একটি মুবাহ কাজ ও দুনিয়াবী কাজ তবুও ভাল নিয়ত ও নামাযের নিয়ত করে তাড়াতাড়ি নিদ্রা যাওয়াতে এই নিদ্রায়ও সাওয়াব অর্জন হবে।

একই সময় একটি ইবাদতের সাথে আরও কয়েকটি ইবাদত সংযুক্ত করা

যারা সময়ের প্রতি যত্নবান হন ও সময়ের মূল্যায়ন করেন তারাই কেবল এক সময়ে একাধিক ইবাদতের প্রতি আগ্রহী ও নিবেদিত হয়। আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করতে পারি। যেমন,

* মসজিদে যাওয়া একটি ইবাদত। এই ইবাদতে রয়েছে বিশাল সওয়াব। এস্থলে দুই বা তদোর্ধ ইবাদত করা যায়:

(ক) আপনি মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলেন, এটি একটি ইবাদত।

(খ) অপরদিকে চলতে চলতে আল্লাহ তা‘আলার যিকির করলেন অথবা তসবীহ, তাহমীদ, তাকবীর বা তাহলীল পাঠ করতে করতে মসজিদের দিকে চললেন, এতে একটি ইবাদতের সাথে আরো কিছু ইবাদত একই সঙ্গে একই সময়ে আদায় করে বিশাল সওয়াবের অধিকারী হতে পারলেন।

* কোন ওয়ালীমা অনুষ্ঠানে কোন মুসলমান ভাই হাজির হলে ২ বা তদোর্ধ ইবাদত করা যায়:

(ক) ওলীমা অনুষ্ঠানে হাজির হওয়াটা একটি ইবাদত।

(খ) ওলীমা অনুষ্ঠানে আপনি যতক্ষণ উপস্থিত থাকবেন, ততক্ষণ মানুষের মাঝে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন এবং মানুষ যাতে আল্লাহর দ্বীনে পরিপূর্ণ ভাবে দীক্ষিত হতে পারে সে জন্য দাওয়াতী কাজ করতে পারেন। অথবা আপনি অধিক পরিমাণে তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল, তাকবীর পড়তে পারেন। এতে একটি ইবাদত করার সময় আপনি একাধিক ইবাদত করে আপনার মূল্যবান সময়কে কাজে লাগাতে পারেন। এমন আরো অনেক পদ্ধতি হতে পারে।

সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার যিকির করা

১। আল্লাহর ইবাদতের মূল ভিত্তিই হল আল্লাহর যিকির। কেননা সবসময় ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্কের পরিচয় হল যিকির। আঈশা রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ

كان النبي صلي الله عليه وسلم يذكر الله علي كل أحيانه

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার যিকির করতেন। -মুসলিম: ৩৭৩

অতঃএব, আল্লাহর সাথে সর্বদা সম্পর্ক রাখাই প্রকৃত জীবন। বিপদ-আপদ, সুস্থ-অসুস্থ সকল অবস্থায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনার মধ্যেই রয়েছে মুক্তি। আল্লাহর নৈকট্য লাভের মধ্যেই রয়েছে তাঁর সন্তুষ্টি ও সফলতা। আর আল্লাহ তা‘আলা হতে দূরে থাকা ভ্রষ্টতা ও উভয় জাহানে নিজেকে সমূহ ক্ষতির দিকে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর।

২। মুমিন ও মুনাফিকের মধ্যে পার্থক্যকারী বস্তুই হল আল্লাহর যিকির। মুমিন বান্দা আল্লাহর যিকির করে আর মুনাফিক আল্লাহর যিকির করে না।

৩। শয়তান কোন মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তবে যখন মানুষ আল্লাহর যিকির হতে গাফেল হয় তখন মানুষকে শয়তান বিপথগামী করে।

৪। ইহকাল ও পরকালের সৌভাগ্য অর্জনের পথ হল আল্লাহর যিকির। আল্লাহ তা‘আলা বলেন

الَّذِينَ ءَامَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

অর্থাৎ: (আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিজের দিকে পথ দেখান) যারা ঈমান আনে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রেখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরে প্রশান্তি অর্জন হতে পারে। সূরা রা‘দ: ২৮

৫। যিকিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এটি সদা-সর্বদা করার সুযোগ রয়েছে। জান্নাতবাসীরা কোন কিছুর জন্যই আফসোস করবে না; তবে সে সময়টুকুর জন্য আফসোস করবে, যে সময়টুকু তাদের দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর যিকির ছাড়া কেটেছে। সদা সর্বদা যিকির করা মানে সদা-সর্বদা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা।

ইমাম নববী রহ. বলেন: ফকীহগণ একমত হয়েছেন যে, ঋতুবর্তী মহিলা ও প্রসুতি নারী এবং যাদের উপর গোসল ফরয হয়েছে অথবা ওযুর প্রয়োজন হয়েছে তাদের সবার জন্য অন্তরে অন্তরে অথবা আওয়াজ করে আল্লাহর যিকির বা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দুরুদ পড়তে পারেন। এমন কি দোয়াও করতে পারবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার যিকির করে আল্লাহ তা‘আলাও ঐ ব্যক্তিকে স্মরণ করেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاذْكُرُونِىٓ أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِى وَلَا تَكْفُرُونِ

অর্থাৎ: অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব…। -সূরা বাকারাঃ ১৫২

পৃথিবীর রাজা বাদশাদের কেউ যদি কোন মানুষের কথা তার রাজদরবারে আলোচনা করে এবং তার প্রশংসা করে, তাহলে সে সীমাহীন খুশি হয়, তাহলে যিনি মালিকুলমুলক, রাজাধিরাজ তিনি যদি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম দরবারে কারো প্রশংসাসুচক আলোচনা করেন তাহলে তার খুশীর আর কি কোন সীমা থাকার কথা?

* আল্লাহর মহত্ত্ব উপলদ্ধি না করে, উদাসীন হয়ে কোন শব্দ বা বাক্যকে বারবার মুখে উচ্চারণ করার নাম যিকির নয়; বরং মৌখিক যিকিরের সাথে সাথে তার অর্থের প্রতি ধ্যান-খেয়াল করাও আবশ্যক। যাতে অন্তরে উক্ত যিকিরের নূর প্রতিম্বিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاذْكُر رَّبَّكَ فِى نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْءَاصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ الْغٰفِلِينَ

অর্থাৎ: আর আপনি মনে মনে আপন আদায়কর্তাকে স্মরণ করতে থাকুন, সকাল-সন্ধ্যায়, বিনম্র ও ভয়-ভিতি নিয়ে, মৌখিক যিকিরে অনুচ্চস্বরে। আর আপনি গাফেলদের অর্ন্তভুক্ত হবেন না। (আল আ‘রাফ: ২০৫)

 

আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়া

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

تفكروا في ألاء الله, ولا تتفكروا في الله

‘তোমারা আল্লাহর নেয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা কর, আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বাকে নিয়ে নয়। -তাবারানী

একজন মুমিনের জীবনে আল্লাহর নেয়ামত নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার সুযোগ সর্বক্ষণই বিরাজমান। বহু ক্ষেত্রে, বহু স্থানে, বহু পরিস্থিতিতে, বহু পর্যায়ে সে আল্লাহর নেয়ামত লাভ করে এবং এমন সব নেয়ামত লাভ করে যার কোন শেষ নেই। আমাদের জন্য আবশ্যক হল, তাঁর নেয়ামতের ব্যাপারে চিন্তা-ফিকির করা, তাঁর প্রশংসা করা এবং তাঁর শোকর আদায় করা।

উদাহরণত:

১। আপনি যখন মসজিদের দিকে যান তখন আপনার এই যাওয়াটা একটা নেয়ামত। কারণ আপনার পাশের লোকটিকে দেখতে পাচ্ছেন যে, সে এই নেয়ামত হতে বঞ্চিত। বিশেষ করে ফজরের নামাযের সময়, আপনার আশ-পাশের মানুষগুলো মরা মানুষের মত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে মসজিদে যাওয়ার নেয়ামত দান করেছেন। একটু ভেবে দেখুন তো!

২। রাস্তায় চলছেন, তখন অতি মনোরম ও সুন্দর সুশোভিত দৃশ্য দেখে কি আল্লাহর নেয়ামত উপলদ্ধি করবেন না? আপনি চলন্ত অবস্থায় দেখছেন যে, অমুক ব্যক্তির গাড়ী উল্টে গেছে বা আহত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার দেহ। আর আপনি নিরাপদ। এমন মহান নেয়ামত নিয়ে একটু ভেবে দেখুন তো!

৩। আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তো সে-ই যার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের স্মরণ সর্বদা বিরাজমান। চাই সে সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ, বিপদগ্রস্থ বা বিপদমুক্ত। অথবা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে যে অবস্থায় রেখেছেন।

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কোন বিপদ ও রোগ ব্যধিগ্রস্থ মানুষকে দেখলে বলবে,

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ عَافَانِيْ مِمَّا ابْتَلاَكَ بِهِ، وَفَضَّلَنِيْ عَلَى كَثِيْرٍ مِمَّنْ خَلَقَ تَفْضِيْلاً

অর্থাৎ: আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি তোমাকে যে বিপদে পরীক্ষা করছেন, ঐ বিপদ হতে আমাকে পূর্ণ সুস্থ রেখেছেন এবং তার বহুসংখ্যক সৃষ্টির মধ্যে হতে আমাকে (সুস্বাস্থ্যের) নেয়ামতের জন্য প্রাধান্য দিয়েছেন।

রাসূল ﷺ বলেন, এই দোআপাঠ কারী ব্যক্তি কখনো এমন বিপদে আক্রান্ত হবে না। -তিরমিযী: ৩৪৩২

প্রত্যেক মাসে কোরআন খতম করা

হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ বিন আমার রাযি. কে বলেন,

اقرأ القرأن في كل شهر

অর্থাৎ: প্রত্যেক মাসে কোরআন খতম করো। -বুখারী: ১৯৭৮

প্রতি মাসে কোরআন খতম করার সহজ পদ্ধতি: প্রত্যেক নামাযের আনুমানিক ১০ মিনিট আগে মসজিদে এসে দুই পাতা (৪ পৃষ্টা) কোরআন তেলাওয়াত করুন। নামাযের আগে শেষ করতে না পারলে নামাযের পরে শেষ করুন। এভাবে প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ১০ পাতা তথা ২০ পৃষ্ঠার এক পারা কোরআন তেলাওয়াত হয়ে যাবে। এভাবে প্রতি মাসে আপনি খুব সহজেই কোরআন শরীফ খতমে সক্ষম হবেন।

وختاما أسأل الله أن يحيينا على سنت رسولنا محمد صلى الله عليه وسلم وأن يميتنا عليها، آخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থন করছি যে, তিনি যেন আমাদেরকে রাসূল ﷺ এর সুন্নাতের উপর জীবিত রাখেন এবং তার সুন্নাতের উপরই মৃত্যু দান করেন। আমীন!!!

[1]সহীহ আল-বুখারী: ৭৪০৫

[2]তিরমিযী, ইবন মাযাহ, আহমাদ

কাব বিন মালিক রাদিঃ ঘটনা থেকে শিক্ষা – শায়খ আবু আবদুল্লাহ রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

কা‘ব বিন মালেক রাযি. এর

ঘটনা থেকে শিক্ষা

 

শায়খ আবু আব্দুল্লাহ উসামা রহ.

 

পরিবেশনায়

অর্পণ

যারা যুগের জাহিলিয়াতের কাছে নতিস্বীকার না করে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর পথে জিহাদকে পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী/স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, উপার্জিত ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঘর-বাড়ীর চেয়ে অধিক ভলোবেসে সাহাবায়ে কেরামের মত মুসলিম হবার পথে এগিয়ে চলেছেন, তাঁদের বরকতময় হাতে।

সূচীপত্র

হযরত কাব ইবনে মালিক রাযি. বর্ণিত হাদীসের শিক্ষা.. 7

উম্মাহর বর্তমান বেদনাময় চিত্র. 7

সাহাবায়ে কেরামগণের আদর্শই মুক্তির পথ. 8

হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর শিক্ষণীয় ঘটনা. 8

আসুন! নিজের নফসের চিকিৎসা করি. 8

হযরত কা‘ব রাযি. এর মর্যাদা. 8

সৎ লোকদেরকে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য নফসের চক্রান্ত. 9

বিলাসিতা ও নফসের ধোঁকা থেকে নির্ভয়তা. 10

বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন. 10

এসব নির্বোধদের জন্য কি আমরা জান্নাত ছেড়ে দিব 12

ইলমের সাথে সাথে আমলও শিক্ষা দিন. 12

যদি আমি চলেই যেতাম! 13

ইলমের ব্যাপারে সালাফদের রীতি. 13

জিহাদের পথের পবিত্র ধূলিকণা. 14

প্রকৃত বিপদের চিন্তা করুন! 15

মুনাফিকরাই পিছনে রয়ে গিয়ে ছিল. 15

জিহাদ পরিত্যাগকারীর সমালোচনা করা বৈধ 16

স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গরম সহ্য করেছেন আর আমি …..?. 17

তোমাকে কোন জিনিস পিছনে রেখেছে?. 18

জিহাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য. 19

নিজের ভুল স্বীকার প্রভুর ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায় 20

সত্যবাদী উলামাদের কর্মরীতি. 20

ভুল স্বীকার 21

নফস তো মিথ্যার উপর উৎসাহিত করে থাকে.. 21

সত্য পথের একটি বড় বাঁধা সামাজিক চাপ. 22

হযরত কা‘ব রাযি. এর অবশিষ্ট দুই সাথীর আচরণ 22

শুধুমাত্র একটি যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন. 23

জনবল বৃদ্ধি নয়, ফরজ আদায়ই কাম্য. 23

ঈমান ও জিহাদের গভীর সম্পর্ক. 24

জিহাদ পরিত্যাগের পর ভালবাসার দাবীও সন্দেহপূর্ণ 25

স্ত্রীদের থেকে আলাদা হওয়ার নির্দেশ এবং হযরত কা‘ব রাযি. এর অনুপম আনুগত্য.. 25

বার্ধক্য সত্ত্বেও এত কঠিন পাকড়াও! 26

জিহাদ থেকে পশ্চাতে থেকে যাওয়ার কারণে অঝোর ধারায় কান্না. 27

ধন্য হও হে কা’ব! 28

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মজলিসে উপস্থিতি. 28

তাওবার অসাধারণ গুরুত্ব. 29

জিহাদের পথে অতিবাহিত একটি মুহূর্ত. 29

সত্যের মাঝেই মুক্তি.. 30

জিহাদের আয়াত সমূহ নিয়ে একটু ভাবুন. 30

বিত্তবান মুনাফিকদের চিত্র. 30

কোথায় সা’দ ও মুসান্না রাযি. এর উত্তরসূরিরা?. 31

মুমিন ও মুনাফিকদের অবস্থানের বৈপরীত্য! 32

আমি জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকা এবং মিথ্যা বলা, দুই গুনাহ একত্র করতে পারবো না. 33

নিজে বের হচ্ছিনা অন্যকেও বাধা দিচ্ছি.. 34

ঈমান, জিহাদ এবং সততা ঈমানদারদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য. 35

মানুষের দেখাদেখি নিজের আখেরাত নষ্ট করবেন না. 36

জিহাদের মাসআলা মুজাহিদ ওলামাগণকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ 38

আগে জিহাদের ময়দানে আসুন পরে ফতওয়া দিন. 39

ভুল ফতোয়া দিয়ে কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে.. 40

জিহাদে গড়িমসি করার উপর আল্লাহর ভর্ৎসনা. 40

গড়িমসির কারণ দুনিয়ার ভালোবাসা ও মৃত্যুকে অপছন্দ করা. 41

সাইয়্যেদুনা জাফর রাযি. এর কবিতা.. 43

সাইয়্যেদুনা আসেম বিন ছাবিত রাযি. এর কবিতা.. 44

নিজেদের পবিত্র ভূখণ্ডগুলোর আযাদীর জন্য জেগে উঠুন! 45

 

হযরত কা‘ব ইবনে মালিক রাযি. বর্ণিত হাদীসের শিক্ষা

সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাই এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা নিজেদের নফসের যাবতীয় অনিষ্ট এবং নিজেদের আমলসমূহের সকল খারাবী থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করি। যাকে আল্লাহ হেদায়েত দেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারেনা এবং যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন পথ প্রদর্শনকারী থাকে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা এবং রাসূল।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلا تَمُوتُنَّ إِلا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

‘হে মুমিন গণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণ কারী না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর না’ [1]

উম্মাহর বর্তমান বেদনাময় চিত্র

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে – মুসলিম উম্মাহর বর্তমান দুরবস্থা। সকলেই জানেন যে, কাফেরদের আগ্রাসন, তাগুতের কর্তৃত্ব এবং পবিত্র ভূমিগুলোর উপর তাদের দখলদারিত্বের ফলে এ উম্মাহ আজ বিপদগ্রস্ত। ফিলিস্তিনের উপর নাসারা তারপর ইহুদীদের দখলদারিত্ব আট দশকের বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এমনিভাবে আমেরিকার নেতৃত্বে পবিত্র ভূমি মক্কা মদিনার দেশে ক্রুসেডারদের দখলদারিত্বের দশ বছরের (শায়েখ যখন আলোচনা করেছিলেন তখন কার কথা) অধিককাল অতিবাহিত হয়ে গেছে! لا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ

এতসব সীমাহীন মুসীবত ও বিপদ-আপদ সত্ত্বেও মানুষ এখনো পর্যন্ত উদাসীন হয়ে আছে এবং দ্বীনের সাহায্যের জন্য কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সুতরাং আমরা আল্লাহরই কাছে ফরিয়াদ করি আর শক্তি ও সামর্থ্যের মালিক তো শুধু আল্লাহ তাআলাই।

অপরদিকে অপব্যাখ্যাকারীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। যারা অসংখ্য মনগড়া দলীল দিয়ে জিহাদ ছেড়ে বসে থাকা বৈধ করে নিয়েছে। ফলস্বরূপ, সত্য দ্বীনের কটাক্ষ করা হচ্ছে এবং দয়াময় রহমানের শরীয়াহকে জীবনাচার থেকে দূর করে দেয়া হয়েছে। বান্দাদের উপর তাদের রবের জীবন-বিধান কোথাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানুষের জীবনাচার শরীয়াহর বিধান থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ লাঞ্ছনা ও অপমানকে দূর করার ক্ষেত্রে নবী কারীম সা-এর. মানহাজ ও কর্মপদ্ধতি থেকে হাজার মাইল দূরে পড়ে রয়েছে।

সাহাবায়ে কেরামগণের আদর্শই মুক্তির পথ

সুতরাং দ্বীন বিজয়ের সঠিক কর্মপদ্ধতি বুঝার সর্বোত্তম উপায় হল, আমরা আমাদের আসলাফদের বরকতময় যুগের স্মৃতিগুলো আলোচনা করবো এবং দেখবো যে, সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর জীবনাচার কেমন ছিল? তাহলে ইনশাআল্লাহ সত্য মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর শিক্ষণীয় ঘটনা

আমি সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর পূণ্যময় সীরাতের মাঝে গভীর ভাবে লক্ষ্য করেছি। তখন এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত হিসাবে হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর হাদিসকে অধিক সুস্পষ্ট পেয়েছি। এ হাদিসটি সহীহাইন (বুখারী ও মুসলিম) ছাড়াও হাদিসের অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। এ সুদীর্ঘ হাদিসে এই মহান সাহাবী রাযি. নিজের মানবীয় স্বভাব ও দুর্বলতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। মিথ্যা কসমকারীদের মত কোন ধরণের অনর্থক ও বানোয়াট কাহিনীর আশ্রয় নেন নি। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ক্রোধ সেসব বানোয়াট ও মিথ্যা প্রলাপকারীর উপরই পতিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে এমন কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন যা অন্য কারো ব্যাপারে ব্যবহার করেন নি।

আসুন! নিজের নফসের চিকিৎসা করি

আসুন আমরা সত্য ও স্পষ্ট ভাষণের মূর্ত প্রতীক এ শব্দগুলো একটু দেখি। তাহলে আমরা সেসব লোকদের স্বভাব প্রকৃতি বুঝতে পারব যারা জিহাদ ছেড়ে বসে আছে। সাথে সাথে আত্মসংশোধনের চেষ্টা করতে পারব এবং মুজাহিদীন, আলেম-উলামা ও নিজেদেরকে উপদেশ দিতে পারব। আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি যে, তিনি যেন আমাদেরকে এর উপর সর্বোত্তম আমলের তাওফীক দান করেন!

হযরত কা‘ব রাযি. এর মর্যাদা

কা‘ব বিন মালিক রাযি. এ হাদীস তাবুক যুদ্ধের প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন। তিনি এ যুদ্ধে ‘যাচ্ছি করে’ আর যেতে পারেননি। অথচ তিনি পূর্ববর্তী অগ্রগামী আনসারদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং সেই মহান লোকদের একজন ছিলেন যারা ‘বাইয়াতে আকাবা’ এর দিন রাসূলুল্লাহ সা-এর. বরকতময় হাতে বাইআত করার সৌভাগ্য লাভ করে ছিলেন। এটা সেই মহান বাইআত যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহর অনুগ্রহে মদীনা মুনাওয়ারায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমরাও তো সেই বরকতময় ফলসমূহের একটি ফল।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে তাবুকের যুদ্ধেই আমি তাঁর পিছনে রয়ে গিয়ে ছিলাম (অংশ গ্রহণ করতে পারিনি)। তবে বদর যুদ্ধেও শরীক হতে পারিনি। কিন্তু বদর যুদ্ধে যারা শরীক হয়নি তাঁদেরকে তিনি তিরস্কার করেন নি। অর্থাৎ, তিনি বীর বাহাদুর ছিলেন। বদর ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে সকল যুদ্ধে শরীক ছিলেন, এবং তিনি তাদের একজন ছিলেন, যারা রণাঙ্গনে বীরত্বের সাথে লড়াই করত এবং দ্বীনের জন্য স্বীয় কুরবানি পেশ করত।

সৎ লোকদেরকে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য নফসের চক্রান্ত

তবে মানুষ, মানুষই। কখনো শয়তান পথভ্রষ্ট করে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সে নিজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার নফস তাকে প্রতারণায় ফেলে দেয়। সাইয়্যেদুনা কা‘ব বিন মালিক রাযি. এই বিষয়টিকে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সময় যুদ্ধের ডাক দিলেন যখন গরমের মৌসুম যৌবনকাল অতিক্রম করছিল। এবং লোকেরা অধিকাংশ সময় খেজুর বৃক্ষের ছায়ায় সময় কাটাত। খেজুর পরিপক্ব হয়ে পাকতে শুরু করেছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমি এই ঠাণ্ডা ছায়া এবং ফলের প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিলাম।’এই হল মানবীয় আত্মার সেই ভয়ানক প্রতারণা যার উপস্থিতি আমরা ঐ মহান ব্যক্তিদের মাঝেও দেখতে পাই (রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)। সুতরাং যদি এ মহান ব্যক্তিদের মাঝে (জিহাদ থেকে) পিছিয়ে থাকার ব্যাপারে নফসানি প্রতারণা কাজ করতে পারে যাদের ঈমানের সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন, তাহলে আজকে কিছু ভালো মানুষ জিহাদ না করলে কেনই বা আশ্চর্য লাগবে?

বুখারী ও মুসলিমের এ হাদিস সুস্পষ্টভাবে আমাদেরকে বলছে যে, ঐ মহান ব্যক্তিরাও (জিহাদ থেকে) পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন, যারা আমাদের চেয়ে এবং আজকের ঐ ভালো লোকদের তুলনায় অনেক অনেক বেশী মর্যাদাবান ছিলেন।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘লোকেরা (তাবুক যুদ্ধের) প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল। আমিও আমার প্রস্তুতির চিন্তা করলাম কিন্তু প্রথম দিন অতিবাহিত হয়ে গেল আমি কোন প্রস্তুতি নিলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, আগামীকাল প্রস্তুতি নিয়ে নিব, কিন্তু পরের দিনও কোন প্রস্তুতি নিতে পারলাম না। অতঃপর আমি ভাবলাম যে, (কোন ব্যাপার না!) আমি এখনো সহজেই তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সক্ষমতা রাখি।’

লক্ষ্য করুন! নফস কিভাবে মানুষকে প্রতারণায় ফেলে দেয়। যেহেতু তিনি জিহাদে অভ্যস্ত ছিলেন এজন্য নফস তাকে একথা বুঝিয়েছে যে, জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ তো আপনার জন্য সাধারণ ব্যাপার, আপনি এখনো সহজেই বের হওয়ার সক্ষমতা রাখেন।

তিনি বলেন, ‘আমি এই (দোদুল্যমান) অবস্থায়ই ছিলাম, অপরদিকে বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেছে। এবং মর্যাদা ও মহত্মের বাহক সে কাফেলা গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। যার সেনা প্রধান ছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত আবু বকর রাযি., হযরত উমর রাযি. এবং অন্যান্য মহান সাহাবীগণ।’ অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, এ সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি ছিল।

এক্ষেত্রে সকল মুসলমানকে নফসের ধোঁকার ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। কারণ দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে কত লোকই না ঘরে বসে আছে। যাদেরকে নফস এই ধোঁকায় ফেলে রেখেছে যে, সে ইচ্ছা করলেই জিহাদে বের হতে পারবে। অথবা তার পিতা, তার অভিভাবক বা তার মুরব্বি চাইলেই সে বের হতে পারবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের না হওয়াই ইসলামের জন্য মাসলাহাত ও কল্যাণ।

অথচ এটা বাস্তব কথা নয়। শুধু তাদের ধারণা মাত্র। আর নিঃসন্দেহে সৎ ও পুণ্য কাজের ক্ষমতা এবং মন্দ কাজ থেকে বাঁচার তাওফিক শুধু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই আসে।

বিলাসিতা ও নফসের ধোঁকা থেকে নির্ভয়তা

সুতরাং এ মহান ব্যক্তিকে তাঁর নফস ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে। অথচ তিনি বহুবার নিজেকে যুদ্ধ এবং রণাঙ্গনে পরখ করে দেখেছেন। আর আনসারগণ তো এমনিতেও যুদ্ধবাজ লোক ছিলেন; যুদ্ধ-বিগ্রহের বৈশিষ্ট্য তাঁরা বংশ পরম্পরায় লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর নফস তাঁকে ধোঁকায় ফেলে দিল। অতএব, নিজেরাই চিন্তা করুন, যখন তাঁদের (সাহাবাদের) ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে, তাহলে সেসব লোকদের পরিণতি কি হতে পারে যারা কখনো আল্লাহর পথে লড়াইয়ের জন্য বের হয়নি? এমন লোকদের নফসের ধোঁকায় পড়ে থাকা কি আরও সহজ ব্যাপার নয়? তাদের (সাহাবীদের) জীবন তো এমনিতেও দুঃখ-কষ্টে ভরা ছিল! না বিদ্যুৎ ছিল, না ছিল অন্য কোন ভোগ সামগ্রী। শুধুমাত্র খেজুর পরিপক্ব হওয়ার উপক্রম ছিল। এ বিষয়টিই তাকে অলস বানিয়েছিল। জিহাদ থেকে বিরত রেখেছিল।

তাহলে সেসব লোক কিভাবে নফসের ফাঁদে পা দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে যাদের কাছে ভোগ-বিলাসের সামগ্রী ভরপুর। এমনকি তারা বৈধতার সীমা পেরিয়ে বিলাসিতার সীমায় অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে! একটু নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করুন! কিভাবে সম্ভব যে, এমন লোক নফসের ধোঁকা থেকে বেঁচে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে রক্ষা করতে চান তার কথা ভিন্ন।

মোট কথা, অন্য সকল সাহাবীগণ বের হয়ে পড়লেন। এবং হযরত কা‘ব রাযি. থেকে এই ত্রুটি হয়ে গেল। তিনি দ্বীনের সাহায্য থেকে পিছনে রয়ে গেলেন।

বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন

প্রচণ্ড গরমের মৌসুম ছিল, অন্য এক বর্ণনায় হযরত উমর রাযি. এই গরমের প্রচণ্ডতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,

‘আমাদের কেউ যখন তার বাহনের নিকট যেত তখন তার কাছে মনে হত যে, বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হওয়া এবং গরমের তীব্রতার কারণে তার গর্দান নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’

এমন মুহূর্তে অভ্যাস অনুযায়ী দুনিয়াদাররা ঐসব কথাই বলেছে যা আজও তারা বলে থাকে। কুরআনে হাকিম তাদের একথা বর্ণনা করেছে,

وَقَالُوا لا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ

“এবং তারা বলতে লাগল যে, (এমন প্রচণ্ড) গরমে অভিযানে যেও না।“

কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে এর চেয়ে বড় বাস্তবতা উল্লেখ করেছেন,

قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ

“বলে দিন, জাহান্নামের আগুন এর চেয়ে অধিক গরম! হায়! তারা যদি একথা বুঝত।“ [2]

এ দুনিয়াদাররা তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস শুনত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খুতবাতে উপস্থিত হত এবং ভাল করেই জানত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে তাদের ভাষায়ই কথা বলতেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তারপরও বলছেন যে, হায় যদি তারা একথার মর্ম বুঝত! কেন? কেননা, প্রকৃত বুঝ অন্তরের অনুধাবন এবং ভয়কে বলা হয়। এই প্রকৃত বুঝ থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। বাহ্যিকভাবে তো একথাগুলোর পূর্ণজ্ঞান তাদের ছিল। কিন্তু যদি তারা প্রকৃত বুঝ রাখত, তাহলে একথা বিশ্বাস করত যে, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার এই গরম এবং কষ্ট থেকে প্রচণ্ড তীব্র।

আজ আমাদের ভাইদেরকে কি বলা হয়? তাদের একথা বলা হয় যে, যখন তোমরা জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসবে তখন ’বেত্রাঘাত’ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। এবং তাগুতী কয়েদ খানার চাবুকগুলো অনেক শক্ত হয়ে থাকে! তাদের কাছে বলা হয় যে, বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সি তোমাদের পিছনে লেগে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরাও তাদেরকে এ কথাই বলবো যে,

قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ

অর্থাৎ, “জাহান্নামের আগুন এর চেয়ে প্রচণ্ড তীব্র গরম! হায় যদি তারা এ কথার বুঝ রাখত।“ [3]

আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি যে, তিনি আমাদের সবাইকে সহীহ ইলম এবং বুঝ শক্তি দান করুন!

এসব নির্বোধদের জন্য কি আমরা জান্নাত ছেড়ে দিব

এ জীবন তো কয়েক দিনের খেলা মাত্র। সুতরাং আমরা কি এসব লোকদের কথার কারণে আমাদের পালনকর্তার জান্নাত ছেড়ে দিব? আল্লাহর কসম! এটা হতে পারেনা! যার এই বিশ্বাস আছে যে, মৃত্যুর সময় নির্ধারিত, সেটার আগপিছ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এবং যার এই নিশ্চিত বিশ্বাস আছে যে, রিযিকের পরিমাণ নির্ধারিত। যার মাঝে কমবেশি করণের কোন সুযোগ নেই। সে এসব কথা কখনো মনে নিবেনা। এক হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. কে বললেন,

عن عبد الله بن عباس رضي الله عنهما قال: كنت خلف النبي صلى الله عليه وسلم فقال: (يا غُلامُ إنِّي أعلِّمُكَ كلِماتٍ، احفَظِ اللَّهَ يحفَظكَ، احفَظِ اللَّهَ تَجِدْهُ تجاهَكَ، إذا سأَلتَ فاسألِ اللَّهَ، وإذا استعَنتَ فاستَعِن باللَّهِ، واعلَم أنَّ الأمَّةَ لو اجتَمعت علَى أن ينفَعوكَ بشَيءٍ لم يَنفعوكَ إلَّا بشيءٍ قد كتبَهُ اللَّهُ لَكَ، وإن اجتَمَعوا على أن يضرُّوكَ بشَيءٍ لم يَضرُّوكَ إلَّا بشيءٍ قد كتبَهُ اللَّهُ عليكَ، رُفِعَتِ الأقلامُ وجفَّتِ الصُّحفُ).[رواه الترمذي]

 ‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দিচ্ছি, আল্লাহর বিধানাবলীর হেফাজত করো আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহর হকসমূহের হেফাজত করো, তাঁকে তোমার সামনে পাবে। যখন কিছু চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে! এবং যখন সাহায্য কামনা করবে আল্লাহ তাআলার কাছেই কামনা করবে! এবং মনে রেখ! যদি সকল মানবজাতি মিলেও তোমার কোন উপকার করতে চায় তাহলে তারা তোমার কোন উপকার করতে পারবেনা। তবে ততটুকুই পারবে যা আল্লাহ তোমার ব্যাপারে লিখে দিয়েছেন। এবং তারা সবাই মিলেও যদি তোমার ক্ষতি করতে চায় তাহলে তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে দিয়েছেন। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে।’[4]

ইলমের সাথে সাথে আমলও শিক্ষা দিন

এই হাদিস আজও মুসলিমদের শিক্ষা দেওয়া হয়। আজও এই শব্দেই পাঠ করা হয়। এটা আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। কিন্তু মুসলিম যুব সমাজের দরকার এ হাদিসের শিক্ষার সাথে তার বাস্তব প্রশিক্ষণ। এবং দরকার لا اله الا الله এর দাবীকে প্রকাশ্যে ঘোষণার শিক্ষা দান। তবেই সমস্যার সমাধান চুড়ান্ত হবে। আর যদি ইলম মোতাবেক আমল না কর। তবে এই ইলম তোমার বিপক্ষে যাবে।

ইলমের দুইটি উদ্দেশ্য,

  • ইলম অর্জন ।
  • তার উপর আমল।

আমলের ফল হল, আল্লাহর ভয়। ইলমের ফল নবীর দেখানো পন্থায় আমল।

যদি আমি চলেই যেতাম!

অবশেষে বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেল। হযরত কা‘ব রাযি. বলেন,

‘আমি এখন তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার জন্য তা আর সম্ভব হয়নি।’

ঐ মুহুর্তে তার অন্তর থেকে এই ‘আহ’ শব্দ বের হল,” يا ليتني فعلت” ‘হায় আমি যদি চলেই যেতাম!’ এ মহান ও মুবারক যুদ্ধ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপটের কারণে তাতে অংশগ্রহণের এ মহান সুযোগ তাঁর হাত ছাড়া হয়ে গেল। যার কারণে তিনি বলেন, ‘হায় যদি আমি চলেই যেতাম! ’

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিজের সুস্থতা, অবসর এবং যৌবনকে গনিমত মনে করুন। এই তো জান্নাতের ময়দান আপনাদের সামনে উন্মুক্ত পড়ে রয়েছে। এক সহীহ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

إنَّ أبْوابَ الجَنَّةِ تَحْتَ ظِلالِ السُّيُوفِ

‘নিশ্চয়ই জান্নাতের দরজাসমূহ তরবারির ছায়াতলে।’ [5]

ইলমের ব্যাপারে সালাফদের রীতি

যখন হযরত আবু মূসা আশআ‘রী রাযি. উপরে উল্লেখিত হাদিস বর্ণনা করলেন তখন এক ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু মূসা! আপনি কি নিজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একথা বলতে শুনেছেন?

একটু এই লোকদের বুঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন! তাঁরা ইলমকে শুধু আমলের জন্য অর্জন করতে চাইতেন, শুধু ইলমের আধিক্যের জন্য নয়। যাতে সেই ইলম তাদের বিপক্ষে না দাঁড়ায়। ইলমের সাথে আমল আবশ্যক, তাই হাদিসের সঠিকতার উপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি নিজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একথা বলতে শুনেছেন?’

হযরত আবু মূসা রাযি. বললেন, ‘হ্যাঁ’

এটা শুনে সেই ব্যক্তি তার সম্প্রদায়ের নিকট গিয়ে, বিদায়ী সালাম জানালো এবং নিজের তরবারির খাপ ভেঙ্গে ফেলে ময়দানে চলে গেল। এবং লড়াই করতে করতে শাহাদাতবরণ করল। আল্লাহ তাআলা তাঁদের উপর অগণিত করুণা বর্ষণ করুন। লক্ষ্য করুন! এই হল সাহাবায়ে কেরাম এবং আমাদের আসলাফদের কর্মনীতি।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ” يا ليتني فعلت” ‘হায়! আমি যদি চলেই যেতাম’।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! এখনও আপনাদের সুযোগ আছে, আপনারা জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সত্যের সাহায্যে বেরিয়ে পড়ন। এমন যেন না হয় যে, একসময় আপনাকেও এই আফসোস করতে হয়, ‘হায়, আমি যদি চলেই যেতাম!’

জিহাদের পথের পবিত্র ধূলিকণা

এক বর্ণনায় রয়েছে যে, একজন নেককার আলেম মৃত্যু শয্যায় ছিলেন। তখন তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অথচ তিনি তাকওয়া এবং ইলমে মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠতর ব্যক্তি ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা কর হল, আপনি কেন কাঁদছেন? তখন তিনি তার পদযুগলের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘এজন্য কাঁদছি যে, আমি যে এই কদম কখনো আল্লাহর পথে ধুলোমলিন করিনি।’

নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিস মুবারক তো আপনারা জেনে থাকবেন যার মাঝে তিনি বলেছেন,

«ما اغْبَرَّتْ قَدَمَا عَبْدٍ في سَبِيل الله فَتَمَسَّهُ النَّار».

‘যে বান্দার কদম আল্লাহর পথে ধূলিমলিন হবে, তাকে আগুন স্পর্শ করতে পারেনা।’[6]

আল্লাহু আকবার! এটা এমন ইবাদত, যার শুধু ধুলাবালি আপনাকে আগুন থেকে মুক্তি দান করতে পারে। তাহলে সে ব্যক্তির মর্যাদা কেমন হবে, যে নিজের জীবন ও ধন-সম্পদ সব কিছু নিয়ে বের হয়েছে এবং সবকিছু এ পথেই কুরবানি করে দিয়েছে?

প্রকৃত বিপদের চিন্তা করুন!

নিঃসন্দেহে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন,

رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بنَفْسِهِ ومَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ بشيءٍ.

‘ঐ ব্যক্তির আমল সর্বশ্রেষ্ঠ যে জিহাদ ফী সাবীলিল্লায় বের হয়ে নিজের জীবন ও ধন সম্পদকে আশংকায় ফেলে দিয়েছে এবং কোন কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি।‘ [7]

আজকে আমাদের অধিকাংশ ভাই আমাদেরকে বিপদ-আপদের ভয় দেখায়। কিন্তু জেনে রাখুন! প্রকৃত বিপদ তো কবরে। প্রকৃত ভয় তো জীবনের হিসাবের এবং শেষ বিচার দিনের যা নিশ্চিত প্রতিষ্ঠিত হবে! এমন যেন না হয় যে, দুনিয়ার এই বিপদ-আপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে আপনি ঐ দিনের বিপদের মাঝে পড়ে গেলেন। আপনার জীবন আয়ু শেষ হয়ে গেল। অথবা অহেতুক কথাবার্তায় আপনার মূল্যবান সময় ফুরিয়ে গেল। দ্বীনের সাহায্য করা আপনার ভাগ্যে জুটল না।

মুনাফিকরাই পিছনে রয়ে গিয়ে ছিল

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যাবলীর নিকটবর্তী হতে সর্তক করেছেন। মুনাফিকদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য না করে পিছনে বসে থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَجَاءَ الْمُعَذِّرُونَ مِنَ الْأَعْرَابِ لِيُؤْذَنَ لَهُمْ وَقَعَدَ الَّذِينَ كَذَبُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ

“আর ছলনাকারী বেদুঈন লোকেরা এলো, যাতে তাদের অব্যাহতি লাভ হতে পারে এবং নিবৃত্ত থাকতে পারে তারা যারা আল্লাহ ও রাসূলের সাথে মিথ্যা বলে ছিল। তাদের উপর শীঘ্রই আসবে বেদনাদায়ক আযাব যারা কাফের।“ [8]

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর এবং তার রাসূলের সাহায্য না করার অশুভ মনোভাব থেকে রক্ষা করুন। একটু ঐ আসলাফদের দিকে লক্ষ্য করুন! হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘বাহিনী চলে যাওয়ার পর যখন আমি শহরে বের হতাম, তখন আমাকে সব চেয়ে বেশী এই বিষয়টি পেরেশান করত যে, শহরের অলিগলিতে ‘নিফাকে’ নিমজ্জিত মুনাফিক এবং অপারগ লোক ছাড়া অন্য কাউকে দেখতাম না।’

এই হল আমাদের আসলাফগণ! যখন সংবাদ আসল যে, রোমানরা মুসলমানদের উপর আক্রমণের ব্যাপারে ভাবছে। তখনো ইসলামী ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। শুধু আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর এসেছে। তখন আমাদের নেতা ও পথপ্রদর্শক মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের মাঝে ঘোষণা দিলেন,

يا خيلَ اللهِ اركَبي

হে আল্লাহর পথের অশ্বারোহীগণ! অভিযানে বের হয়ে পড়।

তখন মুনাফিক এবং অপারগ ব্যক্তি ছাড়া কেউ বসে থাকেনি। আল্লাহর বান্দাগণ! যদি তোমরা নাজাতের প্রত্যাশী হও তাহলে ঐ মহান ব্যক্তিদের অনুসরণ করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাথীদের অনুসরণ করো! আল্লাহ তাআলার বাণী,

مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ

‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহর রাসূল, এবং যারা তাঁর সাথী তাঁরা কাফিরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি মেহেরবান, কোমল।’ [9]

পূর্ণ অনুসরণকেই অনুসরণ বলে, চাই সেই বিষয় আপনার পছন্দ হোক কিংবা অপছন্দ। যেমন উবাদা বিন সামিত রাযি. এর হাদিসে বর্ণিত আছে,

بايَعْنا رسولَ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّم على السمعِ والطاعةِ، في اليُسْرِ والعُسْرِ، والمَنْشَطِ والمَكْرَهِ

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এ মর্মে বাইআত করলাম যে, আমরা কথা শুনবো এবং আনুগত্য করবো চাই সচ্ছল অবস্থা হোক কিংবা অসচ্ছল অবস্থা এবং চাই (সেই বিষয়) আমাদের পছন্দ হোক কিংবা অপছন্দ। [10]

অতএব, লোকেরা জিহাদ অপছন্দ করলেও আপনার তা আদায় করা কর্তব্য। যেহেতু আপনার উপরও সে জিম্মাদারি আছে।

জিহাদ পরিত্যাগকারীর সমালোচনা করা বৈধ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাবুক পৌঁছলেন তখন বললেন,

ما فعل كعب

কা‘ব বিন মালিকের কি অবস্থা?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার কথা উল্লেখ করলেন, তখন বনু সালামা গোত্রের একজন সাহাবী রাযি. বললেন, ‘তাকে তাঁর দামী কাপড় এবং আত্মতুষ্টি বিরত রেখেছে।’ সেই সাহাবী রাযি. হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর নিন্দা করলেন। কেননা তিনি এই নাযুক মুহূর্তে দ্বীনের সাহায্য থেকে পিছনে রয়ে গেছেন। উক্ত সাহাবীর দৃষ্টিতে হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর থেকে এমন ত্রুটি প্রকাশ পেয়েছে যা কোনভাবেই ইমানদারদের জন্য সঙ্গত নয়। তখন হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাযি. হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর আত্মপক্ষ অবলম্বন করে বললেন, ‘তুমি অত্যন্ত মন্দ কথা বলেছ, আল্লাহর কসম! আমরা তাঁর মাঝে শুধু কল্যাণকর দিকই দেখেছি।’

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বনু সালামা গোত্রের সাহাবীর কথার পর্যালোচনা করে বলেন, ‘আমি বলি যে, (এই কথা এ বিষয়ের দলীল যে) যে ব্যক্তি জিহাদ থেকে পিছনে বসে থাকবে তার সমালোচনা করা বৈধ হয়ে যায়। কেননা, দ্বীনের সাহায্য একটি মহান দায়িত্ব।’

আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি, আমাদের প্রাণ এ অবস্থায় বের হোক যে, আমরা দ্বীনের সাহায্যের জিম্মাদারি আদায় করার কাজে রত এবং আমরা আমাদের মালিকের সাথে এ অবস্থায় মিলিত হই যে, তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট!

স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গরম সহ্য করেছেন আর আমি …..?

তখনও কথোপকথন চলছিল, ইতোমধ্যে এক সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিকে মরু প্রান্তর থেকে আসতে দেখা গেল। এ ব্যক্তি অনেক দূর থেকে আসছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূর থেকে দেখেই বলেন, ‘এ আবু খাইছামা হবে।’

অতঃপর দেখা গেল, সে আবু খাইছামা আনসারী রাযি. ই ছিলেন। তিনি বাহিনী রওয়ানা হওয়ার পর চলা শুরু করেন। এবং একাকীই এসে উপস্থিত হন। তিনি মুনাফিকদের মাঝে থাকা পছন্দ করেননি। শয়তান এই মহান সাহাবীকে বাধা প্রদানের জন্যও অনেক চেষ্টা করেছে। ইবনে হাজার রহ. ফাতহুল বারীতে আবু খাইছামা রাযি. এর ঘটনা প্রসঙ্গে কোন কোন যুদ্ধাভিযান বিশারদের কথা বর্ণনা করেছেন যে, আবু খাইছামা রাযি. বর্ণনা করেনে, ‘আমি আমার গৃহে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, বিছানার উপর পানির সিঞ্চন করা হয়েছে।’

আপনারা ভাল করেই জানেন যে, গরমের মৌসুমে বিছানার উপর পানির বিচ্ছুরণ কেমন আরামদায়ক অনুভূত হয়।

তিনি (আবু খাইছামা রাযি.) বলেন, ‘আমি দেখলাম, বিছানায় পানির বিচ্ছুরণ রয়েছে, এরপর আমার স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম এবং বলে উঠলাম। আল্লাহর কসম! এটা কেমন ইনসাফ! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যের তাপ এবং গরম সহ্য করবেন আর আমি এখানে ছায়া ও আরাম আয়েশ ভোগ করব।’

ঈমানদারগণের প্রতি একটু লক্ষ্য করুন! দেখুন, তারা কি সঠিক আকীদা ও মজবুত বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন!

সুতরাং আবু খাইছামা রাযি. নিজের বাহন এবং অল্প কিছু খেজুর নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গিয়ে মিলিত হলেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি জন্য ঘর থেকে বের হয়ে ছিলেন? তিনি কি কালিমার সাহায্যের জন্য বের হননি? তাহলে আজকে আমাদের কি হয়ে গেল যে, আমরা ঐ কালিমার সাহায্য ছেড়ে পিছনে বসে রয়েছি। এবং ধারনা করছি যে, আমরা এই কালিমার সাহায্যের হক আদায় করে ফেলেছি। অথচ এই কালিমার শাসন আজ দুনিয়া থেকে মুছে গেছে।

তোমাকে কোন জিনিস পিছনে রেখেছে?

এখানে আমরা কা‘ব রাযি. এর হাদিসের কিছু শিক্ষণীয় বিষয়ের উপর চিন্তা ফিকির করবো কেননা, এ মুহূর্তে হাদিসের সকল শিক্ষণীয় বিষয়ের উপর আলোচনা করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। ইমাম নববী রহ. ইবনে হাজার রহ. এবং অন্যান্য হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ এই হাদিসের উপর পূর্বেই যথেষ্ট আলোচনা করেছেন।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যাবর্তন করলেন তখন আমি অত্যন্ত দুঃখ ও প্রচণ্ড চিন্তায় পড়ে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে কি বলবো? যখন আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলাম তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চেহারায় রাগ নিয়ে মুচকি হাসলেন।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত কা‘ব রাযি. এর প্রতি রাগান্বিত ছিলেন। ইবনে হাজার রহ. কতিপয় যুদ্ধাভিযান বিশারদদের কথা বর্ণনা করেছেন যে, হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন তখন আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার থেকে কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন?

আল্লাহর কসম! আমি তো মুনাফিক নই, সন্দেহের মধ্যে পড়িনি এবং আমার অবস্থার মাঝেও কোন পরিবর্তন আসেনি।

দ্বীনের সাহায্যকে ছেড়ে দেওয়া কোন ছোট ব্যাপার ছিল না। হযরত কা‘ব রাযি. এর এ কথার উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কম্পন সৃষ্টিকারী একটি কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,? ماخلفك কোন জিনিস তোমাকে পিছিয়ে রেখেছে?

এ প্রশ্নটি আজও জিহাদ পরিত্যাগকারীদের করা চাই যে ‘তোমাদেরকে কোন জিনিস পিছনে বসিয়ে রেখেছে?’

আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাদের আলেমদের বক্ষকে এই বিষয়টির জন্য উন্মুক্ত করে দিন। তারা যেন আমাদের আসলাফদের সীরাত থেকে সবক গ্রহণ করেন এবং উম্মাহকে জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার ফতওয়া দেন!

উলামায়ে সালাফ সকলে এ বিষয়ে একমত যে, জিহাদ কোন কোন পরিস্থিতিতে ফরজে আইন হয়ে যায়। যার মধ্যে প্রথম পরিস্থিতি হল, শত্রুদের ইসলামী ভূখণ্ডে প্রবেশ করা। অথচ আজকে শত্রুরা ইসলামী ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে কয়েক দশক হয়ে গেছে, لا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ

দ্বীনের সাহায্য কে করবে? যদি আমরা প্রত্যেকেই ওজর পেশ করে বসে থাকি, তাহলে এ মহান দায়িত্ব কে আঞ্জাম দিবে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দ্বীনের উপর কি এভাবেই হামলা হতে থাকবে আর আমরা হামলার জবাব না দিয়ে বসে থাকবো? আমাদের কর্তব্য হলো, নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে আমরা ফিরে আসবো এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অনুগ্রহে হককে প্রতিষ্ঠিত করেই তবে ক্ষান্ত হব।

ভুলের ক্ষেত্রে মুমিনের রীতি গোঁড়ামি বা অহেতুক বাক্য খরচ নয়, বরং ভুল স্বীকার করে নেয়া।

হযরত কা‘ব রাযি. এর স্বীয় ত্রুটি স্পষ্টভাবে স্বীকারোক্তির মাঝে জ্ঞানী লোকদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমি যদি আপনার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিবর্তে দুনিয়ার অন্য কোন ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি কোন ওজর পেশ করে তাঁর ক্রোধ থেকে বেচে যেতাম, কেননা, আমি বাকবিতণ্ডায় বেশ পটু।’

আজকেও অসংখ্য লোক দলীল-প্রমাণহীন আলোচনা করার অনেক দক্ষতা রাখে। কিতাবুল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর স্পষ্ট ভাষ্যকে আসল ও সঠিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়। আর বলে, এখনোও জিহাদের সময় আসেনি। আমি জিজ্ঞাসা করি, যদি এখনও সময় না আসে তাহলে কবে আসবে?

ইসলামী রাষ্ট্র স্পেন আমাদের হাত ছাড়া হওয়ার পাঁচ শতাব্দীর বেশী হয়েছে। তবুও কি তা উদ্ধার করার সময় আসেনি। মূলত এসব লোক সর্বদা স্পষ্ট আয়াত ও হাদিসকে অস্পষ্ট অর্থের দিকে ফিরিয়ে বলে, এখনো জিহাদের সময় আসেনি।

জিহাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য

তবে কি জিহাদের এসব আয়াত এবং বিধি বিধান এজন্য অবতীর্ণ হয়ে ছিল যে, এগুলোকে তার আসল ও সঠিক অর্থ থেকে সরিয়ে অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে দেয়া হবে? এটা তো সেই মহান ইবাদত যার মাধ্যমে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত লোকদেরকে স্বীয় রবের ইবাদতে ফিরিয়ে আনা হবে। যেমন সহীহাইনের বর্ণনা রয়েছে,

أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله، وأن محمداً رسول الله، ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة

‘আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে যে, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকব যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করবে।’[11]

যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবের ইবাদত ব্যাপক করার জন্য কিতালের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেখানে আমরা কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ কর্মপদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে লোকদেরকে ইবাদতের দিকে নিয়ে আসবো?! বিশেষ করে যখন ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে চলছে নাস্তিকতার সয়লাব। এবং প্রকাশ্যে অস্বীকার করা হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে।

সুতরাং এসব ব্যাপারে তর্ক বিতর্ক থেকে বিরত থাকুন এবং মানুষকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে সেসব আসলাফদের অনুসরণ করা উচিৎ যাদের নেতা ও সর্দার স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

নিজের ভুল স্বীকার প্রভুর ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায়

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! যদি আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কারো সামনে বসতাম তবে কোন ওজর পেশ করে তার ক্রোধ থেকে বেচে যেতাম। কেননা আমি কথাবার্তায় বেশ পটু। কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি জানি, যদি কোন মিথ্যা বলে দেই এবং আপনাকে সন্তুষ্ট করে দেইও, তবে আল্লাহ তাআলা আপনাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অচিরেই আমার ব্যাপারে জানিয়ে দিবেন।’

আজকে যখন আপনার কাছে আপনার কোন ভাই জিজ্ঞেস করে যে, তুমি কেন জিহাদে বের হচ্ছনা। তখন আপনার নফস আপনাকে ধোঁকায় ফেলে দেয় এবং আপনি নিজের ভুল স্বীকারের পরিবর্তে সেই ভাইকে মিথ্যা বাহানা শুনিয়ে শুনিয়ে শান্ত করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ক্রোধের কারণে জনসাধারণকে আপনার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট করে দিবেন এবং নিশ্চয়ই তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘যদি আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মিথ্যা বলে দেই। এবং তিনি ঐ সময় আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। কিন্তু অচিরেই আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আমার ব্যাপারে অসন্তুষ্টি করে দিবেন। আর যদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে সত্য বলার কারণে তিনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, সেক্ষেত্রে আমার আশা হল যে, আল্লাহ তাআলা এর পরিণাম ভাল করে দিবেন।’

সত্যবাদী উলামাদের কর্মরীতি

আজ থেকে প্রায় বিশ বৎসর পূর্বের কথা, যখন আমি আমাদের আলেম এবং মাশাইখগণের খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে জিহাদে বের হওয়ার দাওয়াত দিতাম। সেই সময় রুশদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা হয়ে গিয়েছিল। সেসব আলেমদের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন যারা জবাবে অসংখ্য ওজর-আপত্তি পেশ করত। তাদের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক এমন লোক ছিলেন যারা হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর মানহাজ-রীতির নিকটবর্তী ছিলেন। আমি অধিকাংশ সময় তাঁদের কতকের এ বাক্য বর্ণনা করে থাকি, ‘হে উসামা! আল্লাহর প্রদত্ত পূণ্যময় এ পথে অবিচল থাকবে! যে পথে তুমি চলছো হকের পথ এবং সঠিক পথ। আমাদের ব্যাপার হলো, আমরা কখনো এ পথে চলে দেখিনি। এজন্যই এই পথকে ভয় পাই, কিন্তু আমরা কখনো তার বিরোধিতা করি না এবং সর্বদাই মানুষ অজানা বিষয়কে ভয় করে থাকে।’

মূলত এই উলামায়ে কেরামগণ জিহাদের ইবাদতের সাথে একেবারে অপরিচিত ছিলেন। কেননা ঐ সময়কাল অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে এজন্যই সমাজে জিহাদকারী লোকের খুব অভাব ছিল।

ভুল স্বীকার

অতঃপর হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার কোন ওজর ছিলনা।’

তিনি আল্লাহর কসম করে বলছেন, তার কোন ওজর ছিলনা। আজও যারা কা‘ব রাযি. এর মানহাজ ও নীতির নিকটবর্তী, তারা ওজর পেশ করার পরিবর্তে নিজের দুর্বলতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার কোন ওজর ছিলনা। আল্লাহর কসম! আমি ইতঃপূর্বে কখনই এত পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ও শক্তিশালী ছিলাম না যখন আপনার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে পিছনে রয়ে গিয়েছিলাম।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,أَمَّا هَذَا فَقَدْ صَدَقَ، ‘যতদূর বুঝি! সে সম্পূর্ণ সত্য বলেছে।’

নফস তো মিথ্যার উপর উৎসাহিত করে থাকে

হযরত কা‘ব বিন মালিক রাযি. এর উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি সত্য বলার উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

কিন্তু তিনি নিজেই বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসার সংবাদ পেলাম, তখন ‘আমি বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা বানাতে শুরু করে দিয়ে ছিলাম।’

হযরত কা‘ব রাযি. এর স্বীকারোক্তি মানবাত্মার স্বভাব জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজকাল অধিকাংশ লোকের অবস্থা এই যে, তারা অন্যদের সামনে নিষ্পাপ সেজে বলে, আপনি প্রকৃত ব্যাপার জানেন না! আমার ব্যাপার জিহাদ থেকে পলায়ন নয়! বরং বাস্তবে যদি এ সময়ে জিহাদের গুরুত্ব থাকত তাহলে আমি অবশ্যই বেরিয়ে পড়তাম।

এই মহান সাহাবী যিনি অগ্রগামী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সহীহাইনের উক্ত হাদিসে তাকে স্পষ্টভাবে এ স্বীকার করতে দেখা যায় যে, তিনিও সেই নফসানি আকর্ষণের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। তাহলে আজকে আমাদের মত লোকদের অবস্থা কেমন হবে মানুষকে ঘায়েল করার জন্য নফসের অনেক অস্ত্র আছে। আর শয়তান তো বনী আদমের রগরেখায় চলাচল করে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার অনিষ্ট থেকে তাঁর আশ্রয়ে রাখেন! কিন্তু আল্লাহ তাআলার তাওফিকে হযরত কা‘ব সততার প্রতিজ্ঞা করেছেন। যা পরিশেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অনুগ্রহে তাঁর মুক্তির উপায় হয়েছে। যার আলোচনা আমরা ইনশাআল্লাহ সামনে করব।

সত্য পথের একটি বড় বাঁধা সামাজিক চাপ

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন যে, ‘যখন আমি রাসূলের কাছ থেকে বের হলাম তখন আমার গোত্র বনু সালামার কিছু লোক এসে আমাকে তিরস্কার করতে লাগল।’তারা তাঁকে এ বলে তিরস্কার করছিল, তুমি ভুল স্বীকার করতে গেলে কেন? যদি তুমি কোন ওজর পেশ করতে তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর রাসূলের ক্ষমা প্রার্থনা করাই যথেষ্ট হয়ে যেত।

তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে ক্রমাগত তিরস্কার করছিল, এমনকি এক পর্যায়ে আমি ইরাদা করে ফেললাম যে, দ্বিতীয় বার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে নিজের পিছনের কথাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করব।’

চিন্তা করুন! মানবীয় আত্মার এই স্বভাবজাত দুর্বলতা একজন সাহাবীর এখানেও স্থান করে নিয়েছে। সমাজ, পরিবার-পরিজন এবং আশ-পাশের চাপ এত কঠিন হয়ে থাকে যে, কখনো কখনো সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর মত নির্বাচিত ব্যক্তিগণও সাময়িক ভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সুতরাং ভাবা যেতে পারে যে, বর্তমানে এ চাপ কত কঠিন হবে যখন পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে। লোকদের অধিকাংশই জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে আছে। তবে এ পরিস্থিতিতেও একটি দল এমন আছে যাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর রাহে জিহাদের তাওফিক দান করেছেন। এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার দয়া ও অনুগ্রহ। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি, তিনি আমাদের অবিচলতা দান করুন এবং এই নিয়ামত দানে সৌভাগ্যমণ্ডিত করুন। এমনকি যখন আমরা আমাদের মালিকের সাথে মিলিত হবো তখন তিনি আমাদের প্রতি যেন সন্তুষ্ট থাকেন।

হযরত কা‘ব রাযি. এর অবশিষ্ট দুই সাথীর আচরণ

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, অতঃপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য কারো সাথেও কি এমন আচরণ হয়েছে যা আমার সাথে হয়েছে?

তখন তারা বলল, ‘হ্যাঁ! তোমার সাথে আরও দুজন লোক রয়েছে। তারাও তেমনি বলেছে যা তুমি বলেছ, ফলে তাদের তা-ই বলা হয়েছে যা তোমাকে বলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তারা দু’জন মুরারা ইবনে রাবী রাযি. এবং হিলাল ইবনে উমাইয়া রাযি.। যারা সত্যবাদী মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন। এটা শুনে আমি প্রশান্তি লাভ করলাম এবং আমি আমার পূর্বের অবস্থানে অবিচল রইলাম।’

শুধুমাত্র একটি যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন

অতঃপর সম্পর্ক ছিন্ন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার নির্দেশও এসে গেল। শুধু একটিবার দ্বীনের সাহায্য ত্যাগ করার কারণে। তিনি বলেন, ‘আমার জন্য সমগ্র পৃথিবী সম্পূর্ণ পাল্টে গেল, এটা আর সেই পৃথিবী থাকল না যাকে আমি চিনতাম। এবং আমার নিজ সত্ত্বা পর্যন্ত আমার জন্য অপরিচিত হয়ে গেল।’

আল্লাহর বান্দারা! একটু ভাবুন! এই জিহাদ পরিত্যাগ করার জন্য কে তাঁর থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করছে?               মানবকুল সর্দার, রাসূলুল্লাহ সাঃ যদি কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যান তাহলে আসমান জমিনের মালিকও তার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে যান। এটা কত গুরুতর ব্যাপার!

জনবল বৃদ্ধি নয়, ফরজ আদায়ই কাম্য

ত্রিশ হাজারের বাহিনী থেকে মাত্র তিনজন পশ্চাতে থেকে যাওয়ায় কি জনবলের দিক থেকে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে? কিন্তু কথা আসলে অন্তরাত্মার, প্রকৃত ব্যাপার ঈমানের! এ অন্তর কিভাবে দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে বসে থাকতে প্রস্তুত হয়ে গেল? তাদের পিছনে থেকে যাওয়া বাহিনীতে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা, সেটা কোন বিষয় নয়।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ তাআলা আপনার উপর একটি অতি গুরুত্ব পূর্ণ আমানত এবং ফরজ বিধান আরোপ করেছেন যা আদায় করা আপনার অবশ্য কর্তব্য।

সুতরাং তাঁর থেকে সম্পর্ক ছিন্নের নির্দেশ এসে গেল এবং পৃথিবী তার জন্য পাল্টে গেল, এমনকি আপন সত্ত্বাও তাঁর কাছে অপরিচিত হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ‘আমার থেকে যখন মুসলমানদের সম্পর্ক ছিন্নের ব্যাপারটি দীর্ঘ হয়ে গেল তখন গাসসানের বাদশাহর পক্ষ থেকে এক দূত আমার কাছে এলো।’

আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, গাসসানবাসীরা কাইলা বংশোদ্ভূত, বনী আউস, খাজরাজ এবং তাদের মাঝে বংশীয় সম্পর্ক ছিল। কারণ, তাদের মা এক ও অভিন্ন ছিল। সুতরাং গাসসানবাসীদের পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছে গেলে, তাদের বাদশাহ এই সংবাদ পাঠাল, ‘আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন। আমরা সম্পদ দিয়ে আপনার সহযোগিতা করব। লাঞ্ছনা ও অপমানের ভূমি ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসুন।’ তিনি বলেন, ‘কাফের মুশরিকরাও আমার ব্যাপারে ঘৃণ্য আশা করতে শুরু করেছিল।

জিহাদ পরিত্যাগকারীদের অবস্থা এমনি হয়ে থাকে। ঘাতক শাসকবর্গ ও আমলারাও তাদের কাছে মন্দ আশা করে। দ্বীনের সাহায্য থেকে তাদেরকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لا تُنْصَرُونَ

“তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড় না। নতুবা তোমাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে[12]

তিনি বলেন, আমি গাসসান বাদশাহর সেই পত্র চুলায় নিক্ষেপ করলাম।

ঈমান ও জিহাদের গভীর সম্পর্ক

যখন পরিস্থিতি তাঁর উপর সংকীর্ণ হয়ে গেল সেই সময়ের কথা বলেন, আমি আমার চাচাত ভাই আবু কাতাদা রাযি. এর বাগানে দেয়াল টপকে প্রবেশ করলাম। তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমি তাকে বললাম, হে আবু কাতাদা! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জানোনা যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ভালবাসি?

আল্লাহর বান্দারা! একটু ঈমান এবং জিহাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে চিন্তা করুন।

পৃথিবী তাঁর উপর সংকীর্ণ হয়ে গেল। নিজেকে তাঁর অপরিচিত মনে হল। এখন নিজের চাচাত ভাইয়ের পক্ষ থেকেও বিমুখতা প্রদর্শন। এমনিতেই যখন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিয়েছেন, তখন কিভাবে সম্ভব যে, পৃথিবী তার জন্য প্রশস্ত থাকবে? কিভাবে তাঁর আত্মা নিশ্চিন্ত থাকবে?

তিনি চাচ্ছিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভালবাসার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করবেন। এজন্য তিনি আবু কাতাদা রাযি. কে বললেন, হে আবু কাতাদা! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জানোনা, আমি আল্লাহ ও তার রাসূল সাকে. ভালবাসি?

জিহাদ পরিত্যাগের পর ভালবাসার দাবীও সন্দেহপূর্ণ

আল্লাহু আকবার! দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে পশ্চাতে বসে থাকা কত বড় অপরাধ। একটু চিন্তা করুন!

আমাদের অন্তরের নূর কি এর কারণে নয়? এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, আমরা দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে মহিলাদের সাথে বসে থাকবো। আবার এ কল্পনাও করতে থাকবো যে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ভালবাসি? হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘তিনি আমাকে কোন জবাব দিলেন না।’

কেননা, সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা ছিল। সম্পর্ক ছিন্নের ব্যাপার এত কঠিন ছিল যে, তিনি এই ঘটনার শুরুতে বলেন, ‘আমি তাকে সালাম দিলাম কিন্তু তিনি আমার সালামের জবাব পর্যন্ত দিলেন না।’

অথচ তিনি তাঁর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ত্যাগকারীর উপর শাস্তি বাস্তবায়নকারী নির্দেশকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশ্য এরপরে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে স্বীয় রহমত দ্বারা ঢেকে নিয়েছেন। তাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘আমি তাকে দ্বিতীয় বার কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ভালবাসি? তিনি তখনও কোন জবাব দিলেন না। অতঃপর আমি তৃতীয় বার কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি জানোনা, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ভালবাসি? তখন তিনি জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই ভাল জানেন।’ হযরত কা‘ব রাযি. বলেন যে, ‘একথা শুনে আমি সেখান থেকে ফিরে এলাম আর আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল।’

তিনি কান্না শুরু করলেন। কারণ, মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এবং তাঁদের ভালবাসা। অথচ এ ব্যাপারে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাথীও সত্যায়ণ করতে অস্বীকার করল। তাহলে আর কি মূল্য থাকে এ জীবনের? হযরত আবু কাতাদা রাযি. হযরত কা‘ব রাযি. এর কথাকে না সত্যায়ণ করলেন না অস্বীকার করলেন। বরং বললেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই ভাল জানেন।’

স্ত্রীদের থেকে আলাদা হওয়ার নির্দেশ এবং হযরত কা‘ব রাযি. এর অনুপম আনুগত্য

এরপর হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, যখন আমাদের উপর এ বয়কট অবস্থার চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বার্তাবাহক এসে বলল, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তোমাদের বিবিদের থেকে আলাদা হয়ে যাও! ’

আল্লাহর বান্দাগণ! চিন্তা করুন! দুনিয়াবি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তার ঘর এবং তার স্ত্রী হয়ে থাকে। এখন তাঁর জীবনসঙ্গিনী স্ত্রী কে ও আলাদা হওয়ার নির্দেশ এসে গেল। কিন্তু এ কঠিন নির্দেশের সামনে হযরত কা‘ব রাযি. এর মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়া এ বাস্তবতা স্পষ্ট করে যে, জীবিত আত্মার উপর যদি কখনও উদাসীনতার পর্দাও পড়ে যায় তখন সাথে সাথে তার স্মৃতি জেগে উঠে এবং সে সত্যের দিকে ফিরে আসে। দ্বীনের সাহায্যকে পরিত্যাগের অপরাধবোধ তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে। সুতরাং হযরত কা‘ব রাযি. আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তালাক দিয়ে দিব না কি করব? অর্থাৎ, তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সন্তুষ্টির জন্য নিজের স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বার্তা বাহক জবাব দিল, ‘না! তার নিকটে যাওয়ার অনুমতি নেই।’

সুতরাং হযরত কা‘ব রাযি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের নিকট চলে যাও, যতক্ষণ না আল্লাহ তাআলা আমাদের এ ব্যাপারে কোন ফায়সালা করে দেন।’

আল্লাহ তাআলার কালাম এবং তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুবারক সুন্নাতের ভিত্তিতেই আমরা নিজেদের স্ত্রীদেরকে হালাল জেনেছি। আমাদের রব তাদেরকে আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ তাআলার বাণী,

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لايَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘এবং তাঁর নিদর্শনাবলী থেকে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তিতে থাকতে পারো।’ [13]

এই স্ত্রী তোমার জন্য আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ তার গঠন-প্রকৃতি ও বন্ধনে রয়েছে একধরণের স্বস্তি প্রশান্তি ও ভালোবাসা। সুতরাং কিভাবে তুমি সে দ্বীনের সাহায্য ত্যাগ করতে পার যার মাধ্যমে তোমার উপর সব নেয়ামত বর্ষিত হয় এবং কিভাবে তোমার রবের দ্বীনের সাহায্য ত্যাগ করতে পার যিনি তোমাকে শূন্য থেকে অস্তিত্বে নিয়ে এসেছেন!

বার্ধক্য সত্ত্বেও এত কঠিন পাকড়াও!

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, তিন হাজারের মাঝে আমি সবচেয়ে জোয়ান ছিলাম, আমার অপর দুই সাথী তো একেবারে বেহাল হয়ে নিজের ঘরে বসে বসে ক্রন্দন করছিলেন।’

জীবিত অন্তরাত্মা সম্পন্ন লোকদের যখন স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় তখন তারা জাগ্রত হয়ে যায়। এ জন্যই তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্রন্দন করেছেন। অতঃপর তাদের নিকট বার্তা পাঠানো হয় যে, স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে যাও।

তখন হযরত হেলাল ইবনে উমাইয়্যা রাযি. এর স্ত্রী রাসূলাল্লাহ সা, এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! হেলাল তো অত্যন্ত বৃদ্ধ মানুষ, আপনি কি অপছন্দ করবেন যদি আমি তার খেদমত করি?

হে আল্লাহর বান্দারা! চিন্তা করুন, তিনি বয়োবৃদ্ধ ছিলেন এবং বয়সের ভারে ছিলেন দুর্বল। কিন্তু এই বার্ধক্য সত্ত্বেও যখন তিনি জিহাদের ময়দান থেকে পশ্চাতে ছিলেন তখন তাঁকে পরিপূর্ণ শাস্তি দেয়া হয়েছে। কেননা তিনি এই সক্ষমতা তো রাখতেন, ময়দানে বের হয়ে, ইসলামী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন এবং মুজাহিদীনদের মাল-সামগ্রীর হেফাজত করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীকে জবাবে বললেন, ‘খেদমত অপছন্দ করিনা, তবে সে যেন তোমার কাছে না আসে।’ তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তার মাঝে তো (বার্ধক্যের কারণে) পূর্ব থেকে এমন কোন চাহিদা নেই।’

হে তরুণ ভায়েরা! একটু চিন্তা করুন। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনাদের এমন কি উত্তর আছে, যার কারণে দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে বসে আছেন? এখানে এত বয়োবৃদ্ধ আল্লাহর রাসূলের সাহাবীদেরকে কোন ছাড় দেয়া হয়নি। অথচ আল্লাহ আপনাদেরকে সুস্থতা, দৃষ্টিশক্তি, বিবেক এবং সম্পদ, সকল নিয়ামত দ্বারা ভরপুর করে রেখেছেন!

আপনারা দুনিয়াবি ধান্ধার জন্য সারা দুনিয়া চষে বেড়াতে পারেন, তাহলে কি নিজের স্রষ্টা ও মালিকের সাহায্যের জন্য ঘর থেকে বের হতে পারবেন না? হঠাৎ মৃত্যু আসার আগেই নিজের সুস্থতা, সম্পদ এবং জীবনকে গনিমত মনে করুন।

জিহাদ থেকে পশ্চাতে থেকে যাওয়ার কারণে অঝোর ধারায় কান্না

এরপর হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, হযরত হিলাল রাযি. এর স্ত্রী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল! যেদিন থেকে তাঁর এ ঘটনা ঘটেছে, সেদিন থেকেই তিনি ঘরে বসে অনবরত ক্রন্দন করছেন।’

অন্যায় ও পাপকর্ম পরিশুদ্ধ আত্মাকে হত্যা করে। আর চোখের পানি পাপ রাশিকে ধুয়ে ফেলে। তাবুক যুদ্ধের যাত্রাকালে কিছু গরীব সাহাবী রাসূলের কাছে আসলেন এবং যুদ্ধে যাবার জন্য বাহনের আবদার করলেন। কিন্তু রাসূলের কাছে এমন কোন বাহন ছিল না, যাতে তাদেরকে আরোহণ করাবেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের কাছে ওজর পেশ করলেন, তখন তারা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর কিতাবে তাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,

تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ

‘উহারা অশ্রু বিগলিত চোখে ফিরে গেল এ দুঃখে যে তাদের কাছে আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য কিছু ছিলনা।’

শুধু এক যুদ্ধে চেষ্টা সত্ত্বেও যেতে না পেরে যদি সাহাবীদের এই অবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাহলে সে ব্যক্তির কত বেশী কাঁদা উচিৎ যার দুটি পা কবরে চলে গেছে। কিন্তু সে না কখনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পথে কোন যুদ্ধে শামিল হয়েছে, না মুসলমানদের বিপদ আপদে অশ্রু ঝরিয়েছে। না এসব বিপদ আপদের কারণে কখনো তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়েছে! لا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ

ধন্য হও হে কা’ব!

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, আমি এই অবস্থায়ই ছিলাম, ইতোমধ্যে এক ব্যক্তিকে উচ্চ আওয়াজে বলতে শুনলাম, يَا كَعْبُ بْنَ مَالِكٍ أَبْشِرْ، হে কা‘ব! সুসংবাদ গ্রহণ কর।

যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর তাঁদের তাওবা কবুলে আয়াত নাযিল হল তখন সাথে সাথে এক সাহাবী রাযি. সালা’ পাহাড়ে আরোহণ করলেন এবং সুউচ্চ কণ্ঠে হযরত কা‘ব রাযি. কে এই সুসংবাদ দিতে লাগলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর তওবা কবুল করে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি তাওবা কবুলের আনন্দে অশ্রু বিগলিত হয়ে সেজদায় পড়ে গেলাম।’ অন্য এক সাহাবী রাযি. তাঁর দিকে ঘোড়া ছুটলেন এবং অন্যরা সুসংবাদ দেওয়ার জন্য দৌড়ে আসলেন। এই ছিল সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর নিজের ভাইয়ের তাওবা কবুল হওয়ার আনন্দের প্রকাশ!

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মজলিসে উপস্থিতি

তিনি বলেন, ‘যখন সে সুসংবাদদাতা আমার কাছে পৌঁছল, ‘যার আওয়াজ আমি শুনেছিলাম’ তখন তাকে আমার কাপড় দুটি খুলে দিয়ে দিলাম এবং এক প্রতিবেশী থেকে পোশাক ধার নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলাম। আল্লাহর কসম! সেদিন আমি এই এক পোশাক ছাড়া অন্য কোন বস্তুর মালিক ছিলাম না।’

একটু লক্ষ্য করুন নিজেদের আসলাফদের দিকে!

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘লোকেরা দলে দলে আমাকে মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। সর্বপ্রথম তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাযি. তীব্র গতিতে অগ্রসর হলেন এবং আমার সাথে মুসাফা করে আমাকে মুবারকবাদ জানালেন।’

হযরত কা‘ব রাযি. সাইয়্যেদুনা তালহা রাযি. এর এ আচরণ সারা জীবন ভুলতে পারেন নি। অতঃপর তিনি বলেন, আমি উপস্থিত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সালাম করলাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা মুবারক খুশিতে ঝলমল করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাওবা কবুলের বিষয়টি আপনার পক্ষ থেকে, নাকি মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষে থেকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘না, বরং মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে।’

তাওবার অসাধারণ গুরুত্ব

হযরত কা‘ব রাযি. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার তাওবা এটা ব্যতীত পূর্ণ হবেনা যে, আমি নিজের সমুদয় সম্পদ থেকে রিক্তহস্ত হবো এবং এগুলো আল্লাহর রাহে সাদাকা করে দেব।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এক তৃতীয়াংশ সম্পদ সাদাকা করা তোমার জন্য যথেষ্ট।’

এই ঘটনা থেকে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর জীবনে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর গুরুত্ব আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। হযরত কা‘ব রাযি. প্রায় সব যুদ্ধে শরীক হয়ে ছিলেন। শুধুমাত্র একবার পিছনে থেকে গিয়ে ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি কাফফারা স্বরূপ সমস্ত সম্পদ সাদাকা করে দিতে চেয়েছেন।

আজ আপনার সমুদয় সম্পদও চাওয়া হচ্ছেনা। অথচ তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলারই সম্পদ! সুতরাং সুযোগের এইমুহুর্ত গুলোকে গনিমত মনে করে আল্লাহর রহে বেরিয়ে পড়ুন, – মৃত্যু আসার পূর্বেই সুযোগ গ্রহণ করুন। অতীত জীবনে ধোঁকায় পড়ে ছিলেন-এ অনুভূতি হওয়ার পূর্বেই আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুন।

জিহাদের পথে অতিবাহিত একটি মুহূর্ত

সহীহ হাদিসে রয়েছে যে, নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

قِيامُ ساعةٍ في الصَّفِّ للقتالِ في سبيلِ اللهِ خيرٌ من قيامِ سِتِّينِ سَنَةً

আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের কাতারে এক মুহূর্ত অবস্থান করা ষাট বছর ইবাদতের চেয়ে উত্তম। [14]

হে তরুণ! দ্বীনের সাহায্যে ইহুদী, খৃস্টান ও তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে কিছু সময় জিহাদের ময়দানে যেতে পার। আল্লাহর মেহেরবানিতে এখনও পথ খোলা। প্রশিক্ষণ প্রস্তুতিও সহজ। অথচ তুমি বসে আছ। এর চেয়ে নির্বুদ্ধিতা আর হতে পারে?

এই ফজিলত তো ফরজে কেফায়া অবস্থায়। অথচ আজকে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের উপর ফরজে আইন হয়ে রয়েছে।

অপর এক হাদিসে এসেছে

,رباطُ شَهرٍ خيرٌ من صيامِ دَهرٍ

‘এক মাস রিবাত করা (ইসলামী ভূখণ্ডের সীমানা পাহারা দেয়া) সারা জীবন রোজা রাখার চেয়ে উত্তম।’ [15]

সুতরাং এই ফজিলতসমূহ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় দয়া ও অনুগ্রহ। শুধুমাত্র নির্বোধরাই এই ফজিলত থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

সত্যের মাঝেই মুক্তি

এরপর হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি খায়বারে প্রাপ্ত গণিমত রেখে দিচ্ছি (এবং অবশিষ্ট সম্পদ সাদাকা করে দিচ্ছি) এবং আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আমাকে সত্য বলার কারণে মুক্তি দিয়েছেন। এজন্য আমার তাওবা কবুল হওয়ার দাবী এটাও যে, আমি ভবিষ্যতে সর্বদা সত্যের উপর অবিচল থাকবো।’

এখানে তিনি নিজের উপর আল্লাহ তাআলার এই অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে সত্য বলার তাওফিক দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা তাঁর প্রতি আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তাআলার মহান অনুগ্রহ ছিল এবং এই সততাই তাঁকে ধ্বংস এবং রববাদীর গর্ত থেকে রক্ষা করেছে। যার মাঝে অন্যরা পড়ে গিয়েছে। এইসব মিথ্যা প্রলাপকারীদের ব্যাপারে তো আল্লাহ তাআলা এমন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা অন্য কারো জন্য ব্যবহার করেননি। কেননা, এরা দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে পিছনে বসেছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা তাওবার আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করে তাদের অবস্থা, তাদের গুণাবলী কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এবং তাদের নিফাক, কপটতার গোপন রহস্য প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাই এ সূরাকে চিন্তা-ফিকিরের সাথে পড়া চাই!

জিহাদের আয়াত সমূহ নিয়ে একটু ভাবুন

আপনাদের প্রত্যেকেই যেন কুরআনে হাকিম, বিশেষত জিহাদ ও যুদ্ধের আয়াতের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করে। তখন যেন লক্ষ্য করে, সে কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরিকার উপর আছে, নাকি তার তরিকা থেকে দূরে সরে জিহাদ ত্যাগকারীদের কাছে চলে গেছে এবং সর্বাবস্থায় নেক কাজের তাওফিক এবং মন্দ কাজ থেকে বাঁচার তাওফিক তো আল্লাহ তাআলারই পক্ষে হয়।

বিত্তবান মুনাফিকদের চিত্র

আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য থেকে সর্তক করে বলেন,

وَإِذَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ أَنْ آَمِنُوا بِاللَّهِ وَجَاهِدُوا مَعَ رَسُولِهِ اسْتَأْذَنَكَ أُولُو الطَّوْلِ مِنْهُمْ وَقَالُوا ذَرْنَا نَكُنْ مَعَ الْقَاعِدِينَ

‘এবং যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় এ মর্মে যে, আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করো এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে জিহাদ কর তখন তাদের বিত্তবান লোকেরা আপনার কাছে (জিহাদে না যাওয়ার) অনুমতি চায় এবং বলে, আমাদেরকে ওজরগ্রস্তদের সাথে থাকতে দিন।’ [16]

বিত্তবান ভাইয়েরা! যাদের আল্লাহ তাআলা সম্পদ, সুস্থতা, শক্তি, বিবেক, দৃষ্টিশক্তি তথা সকল নিয়ামত দ্বারা ভূষিত করেছেন, তাদের উচিৎ জিহাদ ত্যাগকারীদের দলভুক্ত না হওয়া।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন,

رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ

“তারা পেছনে পড়ে থাকা লোকদের সাথে থেকে যেতে পেরে আনন্দিত হয়েছে।“ [17]

এ সকল লোকেরা মহিলাদের সাথে বসে থাকতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। অথচ মহিলাদের দায়িত্বে জিহাদ নাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোবারকবাণী অনুযায়ী তাদের দায়িত্বে এমন জিহাদ রয়েছে যাতে অস্ত্র ব্যবহার লাগেনা অর্থাৎ, হজ্জ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের থেকে শুধুমাত্র ইসলামের উপর বাইয়াত নিয়ে ছিলেন। মহিলা এবং গোলামদের থেকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধুমাত্র ইসলামের উপর বাইয়াত নিতেন। পক্ষান্তরে স্বাধীন পুরুষদের থেকে ইসলাম এবং জিহাদ উভয়ের উপর বাইয়াত নিতেন। সুতরাং আপনিও যদি নিজের ঘরে বসে থাকেন তাহলে আপনার আর মহিলাদের মাঝে পার্থক্য কোথায়?

কোথায় সা’দ ও মুসান্না রাযি. এর উত্তরসূরিরা?

আরব ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষার জন্য এবং সা’দ মুসান্নার উত্তরসূরিদের রক্ষার জন্য আমরা ইহুদী-খৃস্টানদের জাজিরাতুল আরবে নিয়ে এসেছি। এমনকি তাদের নারীদেরকেও নিয়ে এসেছি। তবে কি জাজিরাতুল আরবে কোন পুরুষ নেই? আল্লাহর শপথ! জাহিলিয়্যাতের যুগেও আমাদের পূর্বপুরুষরা এমন লাঞ্ছনা সহ্য করেনি। কিন্তু আজ আমরা সহ্য করে বসে আছি। অথচ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ মহান দ্বীন ও সিরাতে মুস্তা‌ক্বীম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। উম্মাহর এ করুণ পরিণতি আল্লাহর কাছেই পেশ করছি। لا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ

মুমিন ও মুনাফিকদের অবস্থানের বৈপরীত্য!

মুনাফিকদের এ সকল বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হলো, যেন আমরা তা থেকে বেঁচে থাকতে পারি। কুরআন হাকিমের মাঝে তাদের এই অবস্থা ‘রিযা’ সন্তুষ্টি শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ

“তারা পেছনে পড়ে থাকা লোকদের সাথে থেকে যেতে পেরে আনন্দিত হয়েছে। এবং মোহর এতে দেওয়া হয়েছে তাদের অন্তরসমূহের উপর বস্তুত: তারা বোঝে না।“ [18]

অতঃপর সত্যিকার ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন,

لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“কিন্তু রাসূল এবং সেসব লোক যারা ঈমান এনেছে, তাঁর সাথে তারা যুদ্ধ করেছে নিজেদের জান ও মালের দ্বারা। তাদেরই জন্য নির্ধারিত রয়েছে কল্যাণসমূহ এবং তারাই মুক্তির লক্ষ্যে উপনীত হয়েছে।“ [19]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিহাদকারীদের সফলতা এবং তাদের পথ পদ্ধতিকে সঠিক হওয়ার সাক্ষী দিচ্ছেন। সুতরাং আপনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আসলাফদের অনুসারী হয়ে থাকলে আপনার পথও এটাই। যা উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট। এখানে মুমিনদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পশ্চাতে উপবিষ্টদের সাথে বসে থাকার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা সঠিক পথ বর্ণনা করে বলেন,

لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا

‘কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে।’ [20]

অর্থাৎ, যদি আপনি মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আসলাফদের সত্যিকার অনুসরণকারী হন, তাহলে তাদের পথ জেনে নিন তারা নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করেছেন।

‘তারা নিজেদের সম্পদ, জীবন সহ জিহাদ করেছেন।’ [21]

পক্ষান্তরে মুনাফিকরা পশ্চাতে বসে রয়েছে, তাদের নফস তাদেরকে প্রতারণায় ডুবিয়ে রেখেছে এবং তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে মিথ্যা বলেছে।

আমি জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকা এবং মিথ্যা বলা, দুই গুনাহ একত্র করতে পারবো না

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, তিনি এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট কৃতজ্ঞ যে, তার সাথে সে আচরণ করা হয়নি যা মুনাফিকদের সাথে করা হয়েছে। যদি তিনিও অন্যদের মত মিথ্যা বলতেন তাহলে ধ্বংস হয়ে যেতেন।

ইতোপূর্বে যখন তাকে বলা হয়েছিল যে, কোন বাহানা পেশ করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্ষমা দ্বারা তোমার ক্ষমা লাভ হয়ে যাবে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে মিথ্যা বলা, দুই গুনাহ একত্র করতে পারবো না।

এটা সেসব লোকদের জন্য চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র, যারা শুধু জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকিনি। বরং এর সাথে সরলমনা আল্লাহর বান্দাদেরকে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ থেকে বাধা প্রদানের মত জঘন্য কাজ করছে! এরা নিজেরাও কৃপণতা করছে আবার অন্যদেরকে কৃপণতার দাওয়াত দিচ্ছে। এগুলো এমন ভয়ানক বৈশিষ্ট্য যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠোর নিন্দা করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলার বাণী,

الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ

‘যারা (নিজেরাও) কার্পণ্য করে এবং অন্যদেরকে কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়।’

কৃপণতা একটি বিপদ। যদি আপনি কৃপণতা কিংবা কাপুরুষতার রোগে আক্রান্ত হোন তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কিন্তু প্রশ্ন হলও এই, আপনি অন্যদেরকেও কার্পণ্যের হুকুম দেন কেন? লোকদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে না দিয়ে আপনার কি লাভ হবে? লোকেরা নিজেদের ‘দ্বীন’ রক্ষায় অগ্রসর না হলে আপনার কোন স্বার্থ হাসিল হবে? আসল কথা হচ্ছে, এই যুগটাই হল শয়তানের ছড়ানো সংশয় ও কুমন্ত্রণার। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

‘প্রকৃত পক্ষে এই ব্যক্তি শয়তান, সে মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। তাই তোমরা তাদের ভয় না করে আমাকে ভয় কর। যদি তোমরা মুমিন হেয় থাকো।’ [22]

আজও যদি মুষ্টিমেয় কয়েক হাজার লোক আল্লাহর রাহে খাঁটি নিয়তে জিহাদে বের হয় তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হতে পারে। এবং এ কথা আমি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায় এই পথে এবং ময়দানে বিশ বছরের অধিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। নিশ্চয় যাবতীয় অনুগ্রহ ও দয়া আল্লাহ তাআলারই পক্ষ থেকে।

নিজে বের হচ্ছিনা অন্যকেও বাধা দিচ্ছি

আজকের সমস্যা গুলোর মাঝে একটি জটিল সমস্যা হল, অনেক লোক ভিত্তিহীন ওজর আপত্তি পেশ করে। মূলত শয়তানই তাদের মস্তিষ্কে এসব অলিক কল্পনা ঢেলে দেয় এবং সেগুলোকে সুসজ্জিত করে দেখায়। এ জাতীয় লোককে সব সময় আপনি এক ধরনের বাহানা পেশ করতে দেখবেন। যেমন কখনো আপনাকে বলবে, যদি সবাই জিহাদে বেরিয়ে যায় তাহলে দ্বীনের অন্য কাজগুলো কে করবে। ফলস্বরূপ সাধারণ জনগণ এ সকল সংশয়ের শিকার হয়ে বসে থাকে। এ লোকেরা তাদের গুনাহের বোঝা বহন করেও মনে মনে ভাবতে থাকে যে, তারা নিজের উপর আরোপিত দ্বীনের নুসরাতের ফরজ দায়িত্ব আদায় করে ফেলেছে। অতএব, হে আল্লাহর বান্দারা! জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকার সাথে জিহাদে বাধা প্রদান এবং এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার গুণাহ থেকে সাবধান হোন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنْكُمْ وَالْقَائِلِينَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا وَلا يَأْتُونَ الْبَأْسَ إِلا قَلِيلًا

‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার সেসব লোকদেরকে খুব ভাল করে জানেন যারা (তার পথে) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।’[23]

সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তাআলা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে ভালভাবে অবগত আছেন। অতএব, নিজের নফসের পরীক্ষা গ্রহণ করুন! সে কোথাও আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছেনা তো। যেমন সাইয়্যেদুনা কা‘ব রাযি. এবং তার সাথীদের নফস তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছিল।

হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই জন্য যিনি আমাকে সত্যের দিকে পরিচালিত করেছেন এবং আমাকে এ অনুগ্রহে ভূষিত করেছেন। ইসলাম গ্রহণের পর আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হল, আমি মিথ্যা থেকে বেঁচে গেছি। নতুবা আমিও সেসব লোকদের মত ধ্বংস হয়ে যেতাম যারা মিথ্যা বলেছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের নিন্দা বর্ণনায় এমন কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন যা অন্য কারো ক্ষেত্রে করেন নি।’

মিথ্যা বাহানা সৃষ্টি কারীদেরকে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত কঠোর ভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন, সুতরাং ইরশাদ হয়েছে,

سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ

“যখন তোমরা তাদের কাছে (যুদ্ধ শেষে) ফিরে যাবে তখন তোমাদের সামনে আল্লাহর নামে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের থেকে পাশ কেটে যাও। সুতরাং তোমরা তাদেরকে পাশ কেটে যাও, নিঃসন্দেহে তারা অপবিত্র এবং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম তাদের কর্মের প্রতিফলস্বরূপ। এরা তোমাদের সামনে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো অবাধ্য সম্প্রদায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।“ [24]

এই হাদিসে কা‘ব বিন মালেক রাযি. নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। অতএব নিজেকে যাচাই করার এবং আত্ম সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের আদর্শ। তিনি আমাদের মাপকাঠি।

ঈমান, জিহাদ এবং সততা ঈমানদারদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য

সামনে আল্লাহ তাআলা উম্মাহর আসলাফদের আদর্শ বর্ণনা করে বলেন,

لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে, তাঁরা জিহাদ করেছে।“ [25]

ঐ সময় জিহাদ থেকে শুধুমাত্র সেই মরুবাসী বেদুইনরাই পিছনে থাকত যাদের দ্বীনের কোন বুঝ ছিল না। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যাপারে ধারণা রাখতো যে, তারা মুমিন। সুতরাং যখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে অনুগ্রহ প্রকাশের ছলে বলল, আমরা ঈমান নিয়ে এসেছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন,

قَالَتِ الْأَعْرَابُ آَمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ لا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“মরুবাসীরা বলে যে, আমরা ঈমান নিয়ে এসেছি। বলে দিন, তোমরা ঈমান আনয়ন করনি। বরং বলও, আমরা (বাহ্যিক ভাবে) অনুগত হয়েছ। অথচ এখনো তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি।“ [26]

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাবলি এবং তাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ

“মুমিন তো সেসব লোক, যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ঈমান আনয়ন করে অতঃপর কোন সংশয়ে পড়েনা এবং আল্লাহর পথে নিজের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করে। তারাই ঈমানে সত্যবাদী।“ [27]

আল্লাহু আকবার! বিবেকবানদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। যদি কেউ মুমিন হতে চায়, তবে তো আল্লাহ তাআলা তার সামনে তার ঈমানের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে দিয়েছে। তা হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি সংশয়হীন ঈমান ও বিশ্বাস এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে তাঁর পথে জিহাদ। জিহাদের পরই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সততার কথা উল্লেখ করেছেন। এবং এটাই সেই বৈশিষ্ট্য যার বদৌলতে হযরত কা‘ব রাযি. এর মুক্তি লাভ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুবারক বাণী,

فإن الصدق يهدي إلى البر،وإنَّ البرَّ يهدي إلى الجنةِ وإنه يعني الرجلَ ليصدقُ ويتحرى الصدقَ حتى يُكتبَ عندَ اللهِ صدِّيقًا

নিশ্চয় সত্য কথা মানুষকে সৎকর্মের দিকে নিয়ে যায়। আর সৎকর্ম তাকে জান্নাতে নিয়ে যায়। মানুষ যখন সত্য কথা বলতে থাকে এবং সত্য বলতে সন্ধানী হয়। তখন, এক সময় সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী বলে গণ্য হয়। [28]

অতএব, সততার হাতল মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরুন! এবং অবাধ্যতা ও পাপাচার থেকে দূরে থাকুন! দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে সততার বৈশিষ্ট্য দান করুন। এবং আমাদেরকে সত্যবাদীদের দলভুক্ত করুন!

মানুষের দেখাদেখি নিজের আখেরাত নষ্ট করবেন না

আমি আমার সকল মুসলমান ভাইকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিস দ্বারা নসিহত করবো,

لا تكونوا إمَّعةً تقولون إن أحسَن النَّاسُ أحسنَّا وإن ظلموا ظلمنا

তোমরা অন্ধ অনুসারী হয়ে এমন বলা শুরু করনা, যদি মানুষ ভাল হয় তাহলে আমরাও ভাল হয়ে যাব আর যদি মানুষ মন্দ চরিত্রের অধিকারী হয় তাহলে আমরাও মন্দ চরিত্র গ্রহণ করবো।’ [29]

কেয়ামতের দিন আপনাকে একাকী উঠানো হবে। কবরে আপনি একাকী থাকবেন এবং আল্লাহর দরবারে হিসাবের জন্যও আপনাকে একাকী সম্মুখীন হতে হবে। ঐ সময় যখন আপনাকে দ্বীনের নুসরাতের জন্য জিজ্ঞাসা করা হবে তখন আপনি কি জবাব দিবেন?

আল্লাহ তাআলার বাণী,

إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ وَهُمْ أَغْنِيَاءُ رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطَبَعَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَعْلَمُونَ

“তিরস্কার তো সেসব লোককে করা হবে যারা সম্পদশালী হয়েও আপনার কাছে অনুমতি চায়। তার এতে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে যে, পশ্চাতে উপবিষ্টদের সাথে বসে থাকবে এবং আল্লাহ তাদের অন্তঃকরণে মহর এঁটে দিয়েছেন ফলে তারা বোধ শক্তি রাখে না।“ [30]

আজ উম্মাহর বিপদ হলো তারা আজ কয়েক দশক ধরে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছেড়ে বসে আছে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়ুন। নেক ও পূণ্যের কাজে প্রতিযোগিতার সাথে এগিয়ে চলুন। অন্ধকার রাত্রির মত ফেতনা ছড়িয়ে পড়েছে। অতএব সুযোগকে গনিমত হিসাবে গ্রহণ করুন। জান্নাতের খোলা দরজার দিকে দ্রুত বেগে ছুটে চলুন। নবীজি কি চমৎকার করে বলেছেন,

إنَّ السيفَ محَّاءُ الخطايا،

‘নিশ্চয় তরবারি পাপসমুহ মুছে দেয়।’

শহীদের সব কিছু ক্ষমা করে দেওয়া হয় ঋণ ছাড়া। সুতরাং সেই মহা মানবের অনুসরণ করুন। যাকে প্রেরণ করা হয়েছে আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্যে। আমাদের ইলমের উৎস কি তাঁর ইলমের ঝরণা ধারা নয়? জিবরাইল আ. তাঁর কাছে কোন ভাষায় ওহী নিয়ে আসতেন? সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়ই তো নিয়ে আসতেন। আল্লাহ কি আমাদেরকে আরবি বোঝার শক্তি দান করেন নি? তবে তাঁর কাছে আর কি ওজর পেশ করব।

সহীহাইনের হাদিসে চিরসত্য ও সত্যায়িত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কসম খেয়ে বলেছেন,

والَّذي نفسي بيدِه لولا أنْ أشُقَّ على المسلِمين ما قعَدْتُ خَلفَ سَريَّةٍ تغزو في سبيلِ اللهِ

ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ। যদি মুসলমানদের উপর (প্রতিটি যুদ্ধে যাওয়া) কষ্টকর মনে না করতাম। তবে আমি আল্লাহর রাস্তায় প্রেরিত কোন সেনাদল থেকে কখনই পিছে থাকতাম না। [31]

আপনি কি এই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন কথা বোঝার যোগ্যতা রাখেন না? সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার কসম করে বলেছেন যে, উম্মাহর জন্য কষ্ট মনে না করলে, তিনি কখনো আল্লাহর রাহে কোন যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকতেন না। অথচ আজ উম্মাহর অবস্থা হল, যেন তারা জিহাদের চেয়েও কোন শ্রেষ্ঠ কাজে ব্যস্ত রয়েছে!

অতীতে যখনই কোন রণক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে উলামায়ে কেরাম জিহাদ ফরজ হওয়ার ফতওয়া প্রদান করেছেন। রাশিয়া যখন আফগানিস্তানে হামলা করে বসে, তখন উম্মাহর উলামাদের একটি বিরাট সংখ্যা জিহাদ ফরজ হওয়ার ফতওয়া প্রকাশ করেছে। এরপর আপনার নিকট বের না হওয়ার কি প্রমাণ রয়েছে? কি দলীল আপনার কাছে রয়েছে? এটা শুধু নফসের ধোঁকা! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একথা বলেছেন যে, ‘ঐ সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! যদি মুসলমানদের উপর প্রতিটি যুদ্ধে যাওয়া কষ্টকর মনে না করতাম, তাহলে আমি আল্লাহর পথে কোন যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকতাম না।’

এটা কিভাবে সম্ভব যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুহব্বত-ভালবাসা এবং আনুগত্যের দাবী করবে কিন্তু আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য কখনো বের হবেনা

জিহাদের মাসআলা মুজাহিদ ওলামাগণকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ

এ যুগে যখন জিহাদ ফরজে আইন হয়ে রয়েছে। তখন কিভাবে আমরা এমন আলেম থেকে জিহাদের বুঝ পেতে পারি যে নিজেই হাত গুটিয়ে বসে আছে? শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. একজন আলেমে রাব্বানী এবং মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ ছিলেন। তিনি স্বয়ং তাতারিদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ফিকহুল জিহাদ (বা জিহাদের মাসআলা অনুধাবন) প্রসঙ্গে বলেন,

الواجب أن يُعتبر في أمور الجهاد برأي أهل الدين الصحيح الذين لهم خبرة بما عليه أهل الدنيا دون أهل الدنيا الذين يغلب عليهم النظر في ظاهر الدين؛ فلا يؤخذ برأيهم ولا برأي أهل الدين الذين لا خبرة لهم في الدنيا

‘আবশ্যকীয় কর্তব্য হল যে, জিহাদের বিষয়ে কেবল সেই সত্যিকার আলেমদের মতামতকে গ্রহণ করা হবে যারা দুনিয়াদারদের সমসাময়িক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অভিজ্ঞতা রাখে। সেই সকল দুনিয়াদার লোকদের (বুদ্ধিজীবী) মতামত গ্রহণ করা হবে না, যারা দ্বীনের ব্যাপারে ভাসাভাসা জ্ঞান রাখে এবং সেসব আলেমের মতামতও গ্রহণ করা হবে না। যারা দ্বীনের বুঝ রাখে। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারনা রাখে না।’ [32]

আপনাদের সামনে এর একটি সহজ উদাহরণ পেশ করছি, শুধু তর্কের খাতিরে কিছু তর্কবাজ আলেম বলে, ‘বর্তমানে আমরা আমেরিকা ও তার সেনাবাহিনীর সাথে মোকাবেলার সামর্থ্য রাখি না। তাই বর্তমানে জিহাদ ফরজ না।’ এমন ফতোয়া দেওয়ার কারণ হচ্ছে, সে মুফতি হওয়ার আবশ্যকীয় শর্তাবলীর ধারে কাছেও নেই। একজন মুফতির অপরিহার্য শর্ত হলো, দ্বীনের গভীর বুঝ থাকার সাথে সাথে সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখা। একথা বিজ্ঞ আলেমগণ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. তার জগত বিখ্যাত গ্রন্থ “اعلام الموقعين ” এ বলেন,

‘মুফতি এবং বিচারকদের জন্য আবশ্যক হলো, তারা প্রকৃত ঘটনা নিরীক্ষণ করবেন। ঘটনার বিভিন্ন আলামত ও লক্ষণ অনুসন্ধান, এরপর তা যাচাই করে ঘটনার ফলাফল বের করা। অতঃপর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল, তার সেই অবস্থা ও ঘটনা প্রসঙ্গে ফিকহুল ওয়াজিব জানা থাকা, অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সেই বিধান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা যা এই ঘটনার উপর প্রয়োগ হবে। মোটকথা, এসব বিষয়ের উপস্থিতির পরই তিনি ফতওয়া দিবেন।’

আগে জিহাদের ময়দানে আসুন পরে ফতওয়া দিন

আপনি বর্তমানে চলমান লড়াইসমূহে কখনো অংশগ্রহণ করেননি। আপনি জানেন না কিভাবে কাফেরদের দাপট চূর্ণ করতে হয়। কিভাবে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিছু হালকা অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে অল্প সংখ্যক আল্লাহ বিশ্বাসী যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে। আল্লাহর কাছে যা আছে তা সবকিছু থেকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করে এবং তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহর সাথে তাদের মিলিত হতে হবে।

সুতরাং এসকল লোক ফতোয়ার অত্যাবশ্যকীয় শর্তাবলীর পূর্ণতা ছাড়াই ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে। এরা আপনাকে বলবে, যুবকদের সংখ্যা কম। আমরা অস্ত্রের ব্যবহার ভালভাবে জানিনা। এবং আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্রও নেই। হে আল্লাহর বান্দারা! এসকল মাসআালায় তো আপনাদের মতামতের কোন গ্রহণযোগ্যতাই নেই! ফতওয়া দেওয়া তো অনেক ভারী দায়িত্ব। কিন্তু জিহাদের মূল রহস্য জানা ও কোন ধরনের কার্যত অভিজ্ঞতা ছাড়াই জিহাদের বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন?

সহীহ হাদিসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক সাহাবী কোন এক সম্প্রদায়ের নিকট গেলেন। তাঁর মাথায় বড় ধরনের জখম ছিল এবং এ অবস্থায় তার স্বপ্নদোষ হয়। তিনি এই মাসআলার হুকুম জিজ্ঞাসা করলে ঐ লোকেরা বলল, তোমার জন্য গোসল করা আবশ্যক। তারা ফতওয়া দিল, অথচ এ বিষয়ে না তাদের শরয়ী জ্ঞান ছিল, না তারা অসুস্থের প্রতি লক্ষ্য করেছে। যখন সেই সাহাবী গোসল করলেন তখন সাথে সাথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন, ‘قتلوه, قتلهم الله’ ‘তারা তো তাকে হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন।’ [33]

ভুল ফতোয়া দিয়ে কে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তারা তাকে হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। তবে সেই ব্যক্তির অবস্থা কেমন হবে, যে ফতোয়া দিচ্ছে জিহাদ ফরজে আইন হয়নি। অথচ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় আমাদের লক্ষ লক্ষ মা বোনদের ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠিত হয়েছে। চেচনিয়ায় আমাদের শত সহস্র ভাইকে পিষে ফেলা হয়েছে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান দিয়ে। ইন্দোনেশিয়ায় আমাদের ভাইদের মসজিদে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। ফিলিস্তিনে আমাদের অসহায় নারী-শিশু ইহুদীদের হাতে নিকৃষ্ট মত নির্যাতনের শিকার আর সে বসে বসে ফতোয়া দিচ্ছে জিহাদের শর্ত পাওয়া যায়নি।

أنّ نظرت إلى الإسلام في بلد

تجـده كالطيـر مقصوصـا جناحـاه

আজ তুমি যে ভূখণ্ডেই ইসলামের খবর নেবে

সেখানেই পাবে তাকে ডানা কর্তিত পাখি রূপে।

জিহাদে গড়িমসি করার উপর আল্লাহর ভর্ৎসনা

আমি এ বরকতময় হাদিসের আলোচনা শেষ করব একটি আয়াত উল্লেখ করে। যেখানে আল্লাহ তাআলা কিছু সাহাবীদের ভর্ৎসনা করেছেন। যখন তারা জিহাদের ব্যাপারে গড়িমসি করছিলেন। অথচ মক্কায় নির্যাতিত অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম জিহাদের আবেদন করেছিলেন। কারণ, তারা ভালো করে জানতেন, কাফেরদের জবাব দিতে না পারলে তাদের নিঃস্ব করে ফেলবে।

তাদের আবেদন, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলেছেন এবং সংযত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং তাদের বলেন, আমি এখনো যুদ্ধের আদেশপ্রাপ্ত হয়নি।

অতঃপর যখন তাদের উপর জিহাদ ফরজ করা হল। তখন কিছু সাহাবী গড়িমসি করতে লাগলেন। তাই আল্লাহ তাআলা তাদের সম্বন্ধে বলেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةً وَقَالُوا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا الْقِتَالَ لَوْلا أَخَّرْتَنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآَخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا

“আপনি কি তাদের দেখেননি, যাদেরকে (জিহাদের আবেদন করার কারণে) বলা হয়েছিল, নিজেদের হস্ত সংযত রাখ। নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর। পরবর্তীতে যখন তাদের উপর জিহাদ ফরজ করা হল। তখন তাদের একটি দল মানুষকে আল্লাহর মত ভয় করতে লাগল অথবা তার চেয়ে বেশী। আর বলতে লাগল, হে আমাদের রব! কেন আমাদের উপর জিহাদ ফরজ করলেন। কেন আমাদেরকে আরো কিছু কাল সময় দিলেন না।“ [34]

আল্লাহর বান্দাগণ! কিছু সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে যদি এমন কঠিন তিরস্কার আসতে পারে, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে? তাই আল্লাহকে ভয় করুন। নিজের হিসাব নিন। রাসূলের সোহবতপ্রাপ্ত লোকদের ব্যাপারে এমন ধমকি, তবে আমরা কিভাবে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে?

এটা নিশ্চিত নফসের ধোঁকা। পার্থিব জীবনের চাহিদা। তুমি কিসের আশা করছ। কিসের জন্যে বিলম্ব করছ। দুনিয়ার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। বরং মানবীয় চাহিদা জীবনের চেয়েও দীর্ঘ হয়।

গড়িমসির কারণ দুনিয়ার ভালোবাসা ও মৃত্যুকে অপছন্দ করা

এরপর আল্লাহ তাআলা এই রোগের চিকিৎসা বর্ণনা করে বলেন,

قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا

“বলুন, পার্থিব ভোগ বিলাস অতি অল্প। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করে তার জন্য পরকালই উত্তম। এবং তোমাদের প্রতি সামান্য জুলুম করা হবেনা।’

আল্লাহ তাআলা তাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জিহাদে গড়িমসির মূল কারণ হচ্ছে, নফসের কুমন্ত্রণা। যার সম্পর্ক এই নগণ্য ভোগ সামগ্রীর সাথে। এবং বলেন, এই ভোগ সামগ্রী বেশী নয়। অল্প কিছু মাত্র। এরপর তাদেরকে চিরস্থায়ী কল্যাণের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা সিদ্ধান্তমূলক ভঙ্গিতে তাদেরকে সর্তক করে দিয়েছেন যে,

أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكُكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ

‘তোমরা যেখানেই থাকনা কেন মৃত্যু তোমাদের আসবেই, যদিও তোমরা মজবুত দুর্গে অবস্থান কর না কেন।’ [35]

শয়তান তোমাকে ধোঁকা দিবে। তোমাকে তার বন্ধুদের ভয় দেখাবে। তোমাকে বলবে, জিহাদে গেলে মারা পড়বে। তাই বসে থাক। এর জবাবে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকনা কেন মৃত্যু তোমাদের আসবেই, যদিও তোমরা মজবুত দুর্গে অবস্থান কর না কেন।’ আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি, তিনি মুমিনদের বক্ষকে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর জন্য উন্মুক্ত করে দিন এবং আমাদের সকলকে সব বিষয়ে নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মানহাজে চলার এবং তাঁর সকল সুন্নাতের অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।

সাইয়্যেদুনা জাফর রাযি. এর কবিতা

পরিশেষে, আমি নিজেকে এবং সকল মুসলমানকে কতিপয় কবিতার মাধ্যমে উৎসাহিত করতে চাই, যাতে আমরা এই পথে পূর্ণ একাগ্রতার সাথে লেগে থাকি। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. যুদ্ধের ময়দানে কবিতা আবৃতি করতেন। এগুলোর মাঝে হযরত জাফর রাযি. এর কয়েকটি কবিতা রয়েছে। তাঁর অন্তর এই কবিতা আবৃতি করে সেসব কিছুই দেখত যা হযরত আনাস বিন নাদার রাযি. উহুদের যুদ্ধে দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, হযরত আনাস রাযি. হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ রাযি. কে বললেন,

واها لريح الجنة أجده دون أحد

‘হে সাদ! কি চমৎকার ……. এই তো জান্নাতের সুঘ্রাণ! আমি তা উহুদের পাদদেশ থেকে উপলব্ধি করছি।’ [36]

তিনি তখনও মদিনায়ই ছিলেন। কিন্তু ঈমানের দৃঢ়টা ছিল এমন যে, তিনি জান্নাতের সুঘ্রাণ শুকে ফেলেছেন। মুতার যুদ্ধে যখন লোকেরা যুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন তরবারির ঝন-ঝনানি এবং ধুলা-বালির অন্ধকারে হযরত জাফর রাযি. বিশ্বাসের নূরে নূরান্বিত হয়ে এই কবিতা গুলো আবৃতি করতে লাগলেন,

يا حبذا الجنة واقترابها

طيبة وبارد شرابها

والروم روم قد دنا عذابها

علي ان لاقيتها ضرابها

 

নয়নাভিরাম জান্নাত এবং তাঁর নৈকট্যের কথা আমি কি বলব এবং তার ঠাণ্ডা সুপেয় পানীয়ের কি বা বর্ণনা দিব

এখন রোমকদের উপর শাস্তি আপতিত হওয়ার সময় হয়ে গেছে

আমি তাদেরকে নির্ভয়ে ও নিঃসঙ্কোচে আক্রমণ করতেই থাকব অতঃপর

তাদেরকে খুঁজে খুঁজে প্রহার করতে থাকবো।

সাইয়্যেদুনা আসেম বিন ছাবিত রাযি. এর কবিতা

সাইয়্যেদুনা আসেম বনি ছাবিত ইবনে আকদাহ রাযি. যখন দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে হুযাইল গোত্রের শাখা বনী লাহইয়ানের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন বনু লাহইয়ানের লোকেরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তাঁরা দশজন ছিলেন, এর বিপরীতে লাহইয়ানের লোকেরা প্রায় একশত ছিল। বনু লাহইয়ানের লোকেরা তাঁকে বলল, তোমরা নিজেদেরকে আমাদের কাছে সপে দাও,

হযরত আসেম রাযি. বললেন যে,

‘আমি নিজেকে কোন কাফেরের আশ্রয়ে দিতে পারি না।’

তারা তাঁকে জীবিত পাকড়াও করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু আসেম রাযি. অস্বীকার করতে থাকেন এবং কবিতা আবৃতি করতে থাকেন।

ما علتي وأنا جَلْدُ نابل * والقوس فيها وتر عنابل

تزل عن صفحتها المعابل * الموت حق والحياة باطل

إن لم أقاتلكم فأمي هابل

আমার যুদ্ধ করতে কি অন্তরায় আছে

অথচ আমি বীর বাহাদুর এবং সুদক্ষ তীরন্দাজ,

মৃত্যু সত্য এবং এই ক্ষণস্থায়ী জীবন মিথ্যা,

যদি আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করি তাহলে এই জীবন কিসের জন্য?

আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই সকল সাহাবীদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান!

নিজেদের পবিত্র ভূখণ্ডগুলোর আযাদীর জন্য জেগে উঠুন!

আজ আমাদের পবিত্র ভূখণ্ডগুলো ইহুদী ও খৃষ্টানরা দখল করে আছে। বস্তুত যার অন্তরে ঈমানের হালকা ঝলকও বাকী রয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না।

আমি আমার আলোচনার সমাপ্তি টানবো ইহুদী ও খৃষ্টানদের দ্বারা বেষ্টিত বাইতুল মুকাদ্দাস এবং বাইতুল্লাহ সম্পর্কিত এই কবিতা আবৃতির মাধ্যমে,

أهالي فلسطين احتسوا أكؤس الشجى *** وجرح حجاز فيك ما عاد يضمر

وليس بنو الإسلام إلا نجائب *** لفقدك أضنتها المصيبة ضمر

ولكنهم رغم الجراح يقينهم *** بعودة أمجاد الخلافة يكبر

وقد أقسموا بالله أن جهادهم *** سيمضي ولو كسرى تحدى وقيصر

 

ফিলিস্তিন কবে থেকে খুনের ঢোক গিলছে হিজাযের জখম তো এখনও আমাদের হৃদয়ে লেগে রয়েছে ইসলামের প্রতিটি সন্তান আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রতীক এবং এসব জখমের চিন্তা তাদের নিদ্রা হারাম করে রেখেছে

কিন্তু জখম স্বত্বেও খিলাফার পূণঃপ্রতিষ্ঠার উপর তাদের বিশ্বাস অটল অবিচল

তারা আল্লাহর নামে শপথ করে ফেলেছে যে,

তাদের জিহাদ অব্যাহত থাকবে চাই কিছরা চোখ রাঙিয়ে তাকাক কিংবা কায়ছার মোকাবেলায় এসে যাক।

 

আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদের শহীদদের কবুল করে নেন!

আমাদেরকে যেন তাঁর পথে নিহত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন যাতে তাঁর কালিমা সুউচ্চ হয়!

এই উম্মাহকে যেন হেদায়েত ও কল্যাণের এমন একটি পরিবেশ দান করেন, যেখানে তার অবাধ্যরা অপমানিত হবে এবং তার অনুগত বান্দারা হবে সম্মানিত।

যে যুগে কল্যাণের আদেশ দেয়া হবে এবং অকল্যাণ ও মন্দ থেকে বাধা দেয়া হবে! নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

হে আল্লাহ! আমরা আপনার নিকট হেদায়েত, তাকওয়া এবং দুনিয়া থেকে অমুখাপেক্ষীতার ফরিয়াদ করছি!

হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন! আমীন

اللهم صل وسلم وبارك على سيدنا محمد، و على آله و صحبه أجمعين.

و آخر دعوانا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمِين.

****************

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ﴿آل‌عمران: ١٦٩﴾

আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। (৩: ১৬৯)

[1] সূরা আলে-ইমরান: ১০২

[2] সূরা তাওবা: ৮১

[3] সূরা তাওবা: ৮১

[4]  সুনানে তিরমিযী: ২৪৪০

[5] মুসলিম

[6] বুখারী

[7] বুখারী

[8] সূরা তাওবা: ৯০

[9] সূরা আল ফাতহ: ২৯

[10] মুসলিম

[11] বুখারী

[12] সূরা হুদ: ১১৩

[13] সূরা রুম – ২১

[14] কানযুল উম্মাল-১০৬০৯

[15] কানযুল উম্মাল: ১০৫১২

[16] সূরা তাওবা: ৮৬

[17] সূরা তাওবা: ৮৭

[18] সূরা তাওবা: ৮৭

[19] সূরা তাওবা: ৮৮

[20] সূরা তাওবা: ৮৮

[21] সূরা তাওবা: ৮৮

[22] সূরা আলে-ইমরান: ১৭৫

[23] সূরা আহযাব: ১৮

[24] সূরা তাওবা – ৯৫, ৯৬

[25] সুরা তাওবা: ৮৮

[26] সূরা হুজুরাত: ১৪

[27] সূরা হুজুরাত: ১৫

[28] সহীহুল মুসলিম; বাবুল বির্রি ওযাস সিলাত ওয়াল আদাব, ৪৭২১

[29] সুনানুত তিরমিযী; কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাতি. বাবু মাজাআ ফিল ইহসান ওয়াল আফও

[30] সূরা তাওবা – ৯৩

[31] সহীহুল বুখারী; কিতাবুল জিহাদ, মুসলিম; কিতাবুল ইমারাহ

[32] আল ফতওয়া আল কুবরা, কিতাবুল জিহাদ। খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪০

[33] আবু দাউদ

[34] সূরা নিসা: ৭৭

[35] সূরা নিসা: ৭৮

[36] মুসলিম

শিরকঃ চারটি মূলনীতি

শিরক সংক্রান্ত চারটি মূলনীতি

ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আত তামিমি রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

﴿القواعد الأربع﴾

« باللغة البنغالية »

شيخ الإسلام محمد بن عبد الوهاب رحمه الله
ترجمة: عبد الرقيب ومحمد عبد الهادي
অনুবাদ কৃতজ্ঞতাঃ ইসলাম হাউজ

 

শিরক সংক্রান্ত চারটি মূলনীতি

আরশে আযীমের রব মহান আল্লাহর নিকট দো‘আ করি, তিনি যেন আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন, আপনাকে বরকতময় করেন আপনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, আপনাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাকে কিছু প্রদান করা হলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, পরীক্ষায় পড়লে ধৈর্য ধারণ করে এবং গুনাহ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কারণ এ তিনটি বিষয় হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক।

জেনে নিন- আল্লাহ আপনাকে তাঁর আনুগত্যের পথ দেখাক- নিষ্ঠার উপর প্রতিষ্ঠিত দীন তথা মিল্লাতে ইব্রাহীম হচ্ছে, আপনি কেবলমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবেন তার জন্য আনুগত্যকে নির্ভেজাল করে। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে এরই আদেশ করেছেন এবং এর কারণে তাদের সৃষ্টি করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]

“আমি তো জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি” [সূরা আয-যারিয়াত/৫৬]

অতঃপর যখন জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তখন এটাও জেনে নিন যে, তাওহীদ ব্যতীত কোনো ইবাদতই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় না, যেমন পবিত্রতা ব্যতীত কোনো সালাতই সালাত হিসেবে গণ্য হয় না। সুতরাং ইবাদতে শির্ক প্রবেশ করলে তা তেমনি নষ্ট হয়ে যায় যেমনিভাবে পবিত্রতা অর্জনের পর বায়ু নির্গত হলে তা বিনষ্ট হয়।

অতঃপর যখন জানলেন যে, যখন ইবাদতে শির্কের সংমিশ্রণ হয় তখন শির্ক সে ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং যাবতীয় আমল ধ্বংস করে ফেলে এবং সে ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তখন আপনি বুঝতে পারলেন যে, এ বিষয়টির জানাই হচ্ছে আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যাতে করে আল্লাহ আপনাকে এ বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেন, আর তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা তথা শির্কের বেড়াজাল। যার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ ﴾ [النساء: ٤٨]

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করাকে ক্ষমা করবেন না, আর এর চেয়ে ছোট যা আছে তা তিনি যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [সূরা আন-নিসা/৪৮]

আর এটা (অর্থাৎ শির্কের বেড়াজাল থেকে মুক্তি) কেবল চারটি নীতি জানার মাধ্যমে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন,

প্রথম নীতি:  জানা প্রয়োজন যে, ঐ সমস্ত কাফের যাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করেছিলেন, তারা স্বীকার করত যে আল্লাহ তা‘আলাই সৃষ্টিকর্তা এবং সবকিছুর পরিচালক। তবুও এ স্বীকারোক্তি তাদেরকে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় নি। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী:

﴿ قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ ﴾ [يونس: ٣١]

“তুমি বল : তিনি কে, যিনি তোমাদেরকে আসমান ও জমিন হতে রিজিক দিয়ে থাকেন? অথবা কে তিনি, যিনি কর্ণ ও চক্ষুসমূহের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন? আর তিনি কে, যিনি জীবন্তকে প্রাণহীন হতে বের করেন, আর প্রাণহীনকে জীবন্ত হতে বের করেন? আর তিনি কে যিনি সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন? তখন অবশ্যই তারা বলবে যে, আল্লাহ। অতএব, তুমি বল: তবে কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?” (সূরা ইউনুস: ৩১)

দ্বিতীয় নীতি: আরবের মুশরিকরা বলত: আমরা তো তাদেরকে কেবল নৈকট্য এবং সুপারিশ পাওয়ার আশায় আহ্বান জানাই এবং তাদের স্মরণাপন্ন হই।

তারা যে (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের প্রত্যাশা করে তাদের (মা‘বুদদের) আহ্বান করত তার প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣ ﴾ [الزمر: ٣]

“আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, (তারা বলে) আমরা তো এদের ইবাদত এজন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন না।” [সূরা আয-যুমার/৩]

আর তারা যে (আল্লাহর কাছে এসব মা‘বুদদের) শাফা‘আত বা সুপারিশ প্রত্যাশা করে তাদের (মা‘বুদদের) আহ্বান করত তার প্রমাণ, আল্লাহর বাণী,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [يونس: ١٨]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুসমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোনো অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে: এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” [সূরা ইউনুস/১৮]

বস্তুত সুপারিশ বা শাফাআত দু প্রকার ক) অস্বীকৃত খ) স্বীকৃত।

ক- অস্বীকৃত শাফা‘আত বা সুপারিশ হচ্ছে, যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট চাওয়া হয়, যা করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নেই। যেমন আল্লাহ বলেন :

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡمٞ لَّا بَيۡعٞ فِيهِ وَلَا خُلَّةٞ وَلَا شَفَٰعَةٞۗ وَٱلۡكَٰفِرُونَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٥٤ ﴾ [البقرة: ٢٥٤]

“হে যারা ঈমান এনেছ! আমরা তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি, তা হতে সে দিন আসার পূর্বেই ব্যয় কর; যাতে থাকবে না কোনো ক্রয়-বিক্রয়, কিংবা বন্ধুত্ব অথবা সুপারিশ, আর কাফেররাই তো অত্যাচারী।” [সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৫৪]

খ- স্বীকৃত সুপারিশ হচ্ছে, যা কেবল আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়[1]। বস্তুত সুপারিশকারীর কাছে সুপারিশ চাওয়ার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হয়। আর যার জন্য সুপারিশ করা হবে সে তো হতে হবে এমন ব্যক্তি যার কথা ও কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট। আর তাও সংঘটিত হবে অনুমতির পরে। যেমন আল্লাহ তাআ’লা বলেন:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

“এমন কে আছে যে অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?”  [সূরা আল-বাক্বারাহ/২৫৫]

তৃতীয় নীতি: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমন ঘটে এমন লোকদের মাঝে যারা তাদের ইবাদতে শতধা বিভক্ত ছিল; তাদের মধ্যে কেউ ফেরেশতার ইবাদত করতো, কেউ নবী ও সৎ লোকদের ইবাদত করতো, কেউ গাছ-পালা ও পাথরের পূজা করতো এবং কেউ সূর্য ও চন্দ্রের ইবাদত করতো। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মধ্যে কোনো প্রকার তারতম্য বা পার্থক্য করা ছাড়াই এদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর প্রমাণে আল্লাহর বাণী:

﴿ وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ﴾ [الانفال: ٣٩]

“আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাক যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যেই হয়ে যায়।” [সূরা আল-আনফাল/৩৯]

  • তারা যে সূর্য ও চন্দ্রের ইবাদত করত, তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُۚ لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ٣٧ ﴾ [فصلت: ٣٧]

“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত কর।” [সূরা ফুসসিলাত/৩৭]

  • তারা যে ফেরেশতার ইবাদত করত তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًاۗ ﴾ [ال عمران: ٨٠]

“আর তিনি আদেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতাগণ ও নবীগণকে প্রতিপালকরূপে গ্রহণ কর।” [সূরা আলে ইমরান/৮০]

  • মক্কার কাফেররা যে নবীগণের ইবাদতও করত তার দলীল হচ্ছে আল্লাহর বাণী,

﴿ وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنۡ أَقُولَ مَا لَيۡسَ لِي بِحَقٍّۚ إِن كُنتُ قُلۡتُهُۥ فَقَدۡ عَلِمۡتَهُۥۚ تَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِي وَلَآ أَعۡلَمُ مَا فِي نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ١١٦ ﴾ [المائ‍دة: ١١٦]

“আর যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে মা’বূদ বানিয়ে নাও? ঈসা নিবেদন করবেন আমি তো আপনাকে পবিত্র মনে করি; আমার পক্ষে কোনক্রমেই শোভনীয় ছিল না যে, আমি এমন কথা বলি যা বলবার আমার কোনই অধিকার নেই; যদি আমি বলে থাকি, তবে অবশ্যই আপনার জানা থাকবে; আপনি তো আমার অন্তরের কথাও জানেন, পক্ষান্তরে আপনার অন্তরে যা রয়েছে আমি তা জানি না; সমস্ত গায়েবের বিষয় আপনিই জ্ঞাত।” [সূরা আল-মায়েদা/১১৬]

  • মক্কার লোকরা যে নেককার লোকদের ইবাদতও করত তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণী :

﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ﴾ [الاسراء: ٥٧]

“তারা যাদের আহ্বান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে বেড়ায় যে তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।” [সূলা আল-ইসরা/৫৭]

  • তৎকালীন মক্কার লোকেরা যে গাছ-পালা ও পাথরের ইবাদতও করত তার প্রমাণ আল্লাহর বাণী,

﴿ أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ ﴾ [النجم: ١٩،  ٢٠]

“তোমরা আমাকে জানাও লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?” [সূরা আন-নাজম/১৯-২০]

অনুরূপভাবে আবু ওয়াকিদ আল-লায়সী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসও এর প্রমাণ, তিনি বলেন:

«خرجنا مع النبي صلى الله عليه وسلم إلى حنين ونحن حدثاء عهد بكفر، وللمشركين سدرة يعكفون عندها وينوطون بها أسلحتهم يقال لها ذات أنواط. فمررنا بسدرة فقلنا: يا رسول الله اجعل لنا ذات أنواط، كما لهم ذات أنواط». الحديث.

আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে হুনাইনের যুদ্ধে বের হলাম, আমরা তখন নূতন মুসলিম ছিলাম। সেকালে মুশরিকদের একটি কুল-বৃক্ষ ছিল, যার পার্শ্বে তারা অবস্থান করতো এবং তাতে তাদের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। ওটাকে বলা হত ‘যাতু আন্ওয়াত্’ (বরকতের গাছ)। আমরা এই ধরনের এক কুল-গাছের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। আমরা আল্লাহর রাসূলকে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের জন্যও একটি ঝুলিয়ে রাখার বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন যেমন তাদের রয়েছে ..[2]। আল-হাদীস[3]

চতুর্থ নীতিঃ আমাদের যুগের শির্ককারীদের শির্ক পূর্বের যুগের শির্ককারীদের থেকে অধিক কঠোর। কারণ পূর্বের লোকেরা সুখ-সচ্ছলতার সময় শির্ক করতো আর দুঃখের সময় একান্তভাবে আল্লাহকেই ডাকতো। কিন্তু আমাদের যুগের শির্ককারীরা সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে শির্ক করে।

এর দলীল, আল্লাহর বাণী,

﴿ فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥ ﴾ [العنكبوت: ٦٥]

“অতঃপর তারা যখন নৌকায় আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধ চিত্তে খাঁটিভাবে আল্লাহকে ডাকে; অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদের উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।” [সূরা আল-আনকাবূত/৬৫]

সমাপ্ত

আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম পেশ করুন মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকলসাথীদের প্রতি।

[1] কোনো সৃষ্টির কাছে চাওয়া হয় না। যেমন বলা হয়, হে আল্লাহ আপনি আমার ব্যাপারে আপনার নবীকে সুপারিশকারী বানিয়ে দিন। অথবা হে আল্লাহ আপনি আমার জন্য আপনার বন্ধুদেরকে সুপারিশকারী বানিয়ে দিন। এভাবে সরাসরি আল্লাহর কাছে চাওয়া। [সম্পাদক]

[2] হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, কাফেররা গাছ পূজা করত। [সম্পাদক]

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ২১৮০।

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা – শায়খ আতিয়াতুল্লাহ রহঃ

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা

শায়খ আতিয়াতুল্লাহ রহঃ

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

বন্ধুত্ব

শত্রুতা

শায়খ আতয়িাতুল্লাহ রহঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের উপর এবং তার পরিবারবর্গ, সাহাবা ও যারা তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে তাদের উপর। তারপর:

এই আসরে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। এর সম্পর্ক রয়েছে কুফর, ঈমান ও রিদ্দার মাসআলার সাথে এবং পূর্বে যে তাওহিদ ও তার বিপরীত বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করেছি তার সাথেও। তা হচ্ছে মুওয়ালাত (বন্ধুত্ব) ও মুআদাত’র (শত্রুতার) বিষয়। এটাকে ‘আলওয়ালা ওয়ালবারা’ বলেও ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ একই জিনিসের দুই রকম প্রকাশ।

সবার জানা আছে, আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে একক ও শরীকহীনভাবে তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। এই দুনিয়াতে অস্তিত্ত্ব দান করেছেন। ইবাদতের স্থানে। যাতে আমরা তার ইবাদত করি। তিনি এই ইবাদাতসমূহের মাধ্যমে ও অন্যান্য পরীক্ষাসমূহের মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করছেন-আমরা কি তার ইবাদত ও আনুগত্যে কৃতকার্য হই, তার সঠিক পথে চলি, না অকৃতকার্য হই। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, আল্লাহ আমাদেরকে ও আপনাদেরকে কৃতকার্যদের অন্তর্ভূক্ত করুন!

আল্লাহ সুবহানাহুর একটি রহমত ও অনুগ্রহ হল, তিনি আমাদের নিকট রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন কিতাব, যা আমাদের নিকট আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে আর রাসূলগণ আমাদের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যাবলী বর্ণনা করে দেন- তথা আমরা কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করব? আমাদের প্রতি তো আল্লাহর নির্দেশ একমাত্র তাঁর ইবাদত করার, যার সাথে কোনও শরীক নেই- এখন আমরা কিভাবে তার ইবাদত করব? তারা আমাদেরকে ইবাদতের বিশদ বিবরণ, আদেশ, নিষেধ ও দায়িত্বসমূহ বলে দিয়েছেন।

রাসূলগণ সব পৌঁছে দিয়েছেন (আল্লাহ তাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!), তারা আমানত পৌঁছে দিয়েছেন, রিসালাতের দায়িত্ব আদায় করেছেন। আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন!

যখনই আল্লাহ রাসূল ও নবী পাঠালেন, তখনই মানুষ বিভক্ত হয়ে গেছে এবং পরস্পরে মতবিরোধ করেছে, যেমন আল্লাহ সুবহানাহু বলছেন:

﴿فَمِنْهُمْ مَنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾

“ফলে তাদের কতক ঈমান আনল আর কতক কুফর অবলম্বন করল। আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

এমনটা হয়েছে, যখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলদেরকে প্রেরণ করলেন, যা আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন। এই আয়াত সূরায়ে বাকারায়, আর ওটাও সুরায়ে বাকারায়ই তার পূর্বে। উক্ত আয়াতটি হল:

﴿كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً﴾

“(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই জাতি ছিল”

এক জাতি কি কুফরের উপর, না তাওহীদের উপর? মুফাসসিরীনের দুই মত রয়েছে। বিশুদ্ধ মত হল, যেটা হাদিসেও বর্ণিত আছে এবং ইবনে আব্বাস রা: এর তাফসীরে এসেছে: একজাতি ছিল তাওহীদের উপর। আদম আ: থেকে সব মানুষ একজাতি ছিল তাওহীদের উপর। তারপর নূহ আ: এর কওমে সর্বপ্রথম শিরকের উদ্ভব হয়েছে- যার বর্ণনা আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন এবং কুরআনে তার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তখন শিরকের উদ্ভব হয়েছে এবং মূর্তিপূজার সূচনা হয়েছে।

তারা কিভাবে মূর্তিপূজা শুরু করল, তার রূপটা প্রসিদ্ধ। শয়তানের প্ররোচনায় তারা তাদের নেককার লোকদের চিত্রাংকন করল এবং তাদের ফটো বানালো। কেউ বলল, তোমাদের তো এই সকল নেককারদেরকে সম্মান করা উচিত। শয়তান বুদ্ধি দিল: তাদের চিত্রাংকন করে এবং তাদের মূর্তি বানিয়ে তাদেরকে সম্মান কর। তাহলে তোমরা তাদেরকে স্মরণ করতে পারবে, এতে তাদের নসীহত ও উপদেশগুলো স্মরণ হবে, তারা যে জীবনাদর্শের উপর চলেছেন, তা স্মরণ হবে। এতে তোমরা আরো সংশোধিত হবে। শয়তান তাদের মাঝে প্রবেশ করল এই দরজা দিয়ে। তাই তারা ঐ সকল লোকের চিত্রাংকন করল এবং তাদের মূর্তি বানালো।

প্রথম প্রজন্ম বুঝত, হয়ত তৃতীয় চতুর্থ প্রজন্মও বুঝত, কিন্তু যখন সময় দীর্ঘ হল, তখন অজ্ঞতা নেমে আসল, যেমন ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন: অত:পর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করতে শুরু করল। তাদের কথাই আল্লাহ তা’আলা সূরা নূহে উল্লেখ করেছেন:

﴿وَقالُوا لا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلا سُواعًا وَلا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا﴾

“এবং তারা (নিজেদের লোকদেরকে) বলেছে, তোমরা নিজেদের উপাস্যদেরকে কিছুতেই পরিত্যাগ করো না। কিছুতেই পরিত্যাগ করো না ‘ওয়াদ্দ’, ও ‘সুওয়া’কে এবং না ‘ইয়াগুছ’, ‘ইয়াউক’ ও ‘নাসর’কে”।

পাঁচটি। ‘ওয়াদ’, আরেক কেরাতে ‘ওয়িদ’। এবং তোমরা পরিত্যাগ করো না ‘ওয়াদ’কে, পরিত্যাগ করো না ‘সওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর’কে। পাঁচটি। তারা ছিল নূহ সম্প্রদায়ের নেককার লোক। অত:পর তাদের কওম তাদের মূর্তি অংকন করে। এভাবে পরবর্তীতে তাদের ইবাদত করা হতে থাকে। যখন অজ্ঞতা নেমে আসল, তখন থেকে তাদের ইবাদত করা শুরু হল। ফলে শিরক ও কুফরের আবির্ভাব হল।

এটাই এই আয়াতের অর্থ- “(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই জাতি ছিল”। অত:পর উম্মতের মধ্যে- মানবজাতির মধ্যে- মানুষের মধ্যে- শিরকের উদ্ভব হয় এবং কুফর সৃষ্টি হয়।

অত:পর আল্লাহ নবীদেরকে পাঠান সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে। যে আল্লাহর আনুগত্য করে তার জন্য সওয়াবের ও কল্যাণের সুসংবাদাদতারূপে আর যে কুফরী করে, অবাধ্যতা করে এবং শিরক করে তার জন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ক্রোধ ও আযাব সম্পর্কে সতর্ককারীরূপে-

﴿فبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلَّا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ العلم..

“তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল, তখন) আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তাদের সাথে সত্য সম্বলিত কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মাঝে সে সব বিষয়ে ফায়সালা করে দেন, যাতে তারা মতবিরোধ করছিল। আর যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারাই তাদের নিকট সমুজ্জল নিদর্শনাবলী আসার পরও তাতে মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছিল”।

অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলদেরকে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করলেন তখন মানুষ বিভক্ত হয়ে গেল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ﴾

“এসকল রাসূলগণ, যাদের কতককে আমি কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে, যার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি বহু উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর আমি মারয়ামের পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দিয়েছি ও রূহুল-কুদসের মাধ্যমে তার সাহায্য করেছি। আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও আত্মকলহে লিপ্ত হত না।

অর্থাৎ তাদের রিসালাতের পর তাদের পরবর্তীরা-

﴿وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِن بَعْدِهِم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَٰكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُم مَّنْ آمَنَ وَمِنْهُم مَّن كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾

“আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু তারা নিজেরাই বিরোধ সৃষ্টি করল। ফলে তাদের কতক ঈমান আনল আর কতক কুফর অবলম্বন করল। আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

তাহলে সূরা বাকারার এই পবিত্র আয়াতটি বুঝালো যে, রাসূলদের প্রেরণের পর মানুষ মুমিন ও কাফের দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যারা রাসূলদের অনুসরণ করল, তাদেরকে বিশ্বাস করল এবং আল্লাহ সুবহানাহুর আনুগত্য করল, তারাই হল মুমিন, যারা একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত করে। আর যারা রাসূলদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তাদেরকে অবিশ্বাস করল, তাদের সাথে ঠাট্টা করল, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করল, অস্বীকার করল, তাদের অনুসরণ করল না, বরং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করল, তারাই কাফের, যারা আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লার ইবাদত করে না অথবা তার ইবাদত করে, কিন্তু তার সাথে অন্যেরও ইবাদত করে। তারা মূলত: আল্লাহর ইবাদতই করে না, কেননা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ইবাদত হল একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। আর এর বিপরীতে যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহরও ইবাদত করে এবং অন্যেরও ইবাদত করে, সে যেন আল্লাহর ইবাদতই করল না। প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর ইবাদত করে নি; কেননা সে তার ইবাদতের যে অংশটা আল্লাহর জন্য নিবেদন করেছে, শরীয়তে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর নিকট এটা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য হচ্ছে তাওহীদ তথা এককভাবে করা। অর্থাৎ শুধুই আল্লাহর জন্য ইবাদত করা, তার সাথে কাউকে শরীক না করা।

ফলে মানুষ মুমিন ও কাফেরে বিভক্ত হয়ে পড়ল, ফলে তাদের মাঝে পরস্পরে যুদ্ধের সূত্রপাত হল, যেমন আল্লাহ তা’আলা বলছেন: “আল্লাহ চাইলে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হত না। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করেন, যা তিনি চান”।

তাই আয়াতটি প্রমাণ করল, মুমিন ও কাফেরদের মাঝে যুদ্ধ, এটি আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা, আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্য, আল্লাহ সুবহানাহুই এটা চান। এ বিষয়টি আরো অনেক আয়াত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অনেক আয়াত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে যে, আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টিজীবের কতকের দ্বারা কতককে পরীক্ষা করেন এবং এক পক্ষকে অপর পক্ষের উপর চাপিয়ে দেন, উভয় পক্ষকে পরীক্ষা করার জন্য, যাচাই করার জন্য, নিরীক্ষা করার জন্য, ফেৎনার সম্মুখীন করার জন্য। এছাড়া আরো অনেক উদ্দেশ্যের জন্য: যেমন: আল্লাহ সুবহানাহু এর মাধ্যমে তার বন্ধু, একনিষ্ঠ, ও প্রিয়দেরকে বেছে নেন, শহীদদেরকে বেছে নেন এবং ঐ সকল লোকদেরকে বাছাই করেন ,যারা তাকেই অবলম্বন করেছে, তাকে প্রাধান্য দিয়েছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করেছে, তাকে ভালবেসেছে, তার ভালবাসাকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বেছে নেন এবং তাদের মর্যাদা সুউচ্চ করেন। তাই এটা আল্লাহ সুবহানাহুরই ইচ্ছা।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

﴿وَكَذَٰلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لِّيَقُولُوا أَهَٰؤُلَاءِ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ﴾

“এভাবেই আমি তাদের কতক লোক দ্বারা কতক লোককে পরীক্ষায় ফেলেছি, যাতে তারা (তাদের সম্পর্কে) বলে, এরাই কি সেই লোক, আমাদের সকলকে রেখে আল্লাহ যাদেরকে অনুগ্রহ করার জন্য বেঁছে নিয়েছেন? আল্লাহ কি তার কৃতজ্ঞ বান্দাদের সম্পর্কে অন্যদের থেকে বেশি জানেন না?” (সূরা আল আনআম)

আল্লাহ তা’আলা সূরা ফুরকানে বলেন:

﴿وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا﴾

“আমি তোমাদের কতককে কতকের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ বানিয়েছি। বল, তোমরা কি সবর করবে? তোমাদের প্রতিপালক সবকিছুই দেখছেন”।

তাই আল্লাহ তা’আলাই মানুষের একদলকে আরেক দলের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের একদলকে আরেক দলের দ্বারা পরীক্ষা করছেন।

এটা আল্লাহ তা’আলারই অভিপ্রায়।  আল্লাহ তা’আলা এটা চান। এটাই আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা। সুউচ্চ, মহান, মর্যাদাময়, পূত-পবিত্র ইলাহী ইচ্ছা। তিনি পবিত্র ও মহান। তিনিই এই জিনিসটা চান। এজন্যই তিনি রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন, এজন্যই আমাদেরকে এত দায়িত্বাবলী দিয়েছেন। যাতে আল্লাহ সুবহানাহু তার বন্ধুদেরকে বাছাই করে নিতে পারেন এবং যাতে ঐ সকল উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত হয়, যার কয়েকটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করলাম।

আল্লাহ তা’আলা সূরা মুহাম্মদে বলেন:

﴿الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَن سَبِيلِ اللَّهِ أَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ* وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَهُوَ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ* ذَٰلِكَ بِأَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا اتَّبَعُوا الْبَاطِلَ وَأَنَّ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّبَعُوا الْحَقَّ مِن رَّبِّهِمْ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ لِلنَّاسِ أَمْثَالَهُمْ﴾

“যারা কুফর অবলম্বন করেছে এবং অন্যদেরকে আল্লাহর পথে বাঁধা দান করেছে, আল্লাহ তাদের কর্ম নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র প্রতি যা-কিছু অবতীর্ণ হয়েছে- আর সেটাই তো তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত সত্য- তা আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে, আল্লাহ তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদের অবস্থা সংশোধন করে দিয়েছেন। এটা এজন্য যে, যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা মিথ্যার অনুগামী হয়েছে এবং যারা ঈমান এনেছে, তারা সত্যের অনুসরণ করেছে, যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। এভাবেই আল্লাহ মানুষকে তাদের অবস্থাদী সম্পর্কে অবহিত করেন”।

‘এভাবেই আল্লাহ…’ অর্থাৎ এর মত এবং পূর্বের  বর্ণনার মত। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের গুণাবলী ও তাদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেন এবং কাফেরদেরও গুণাবলী ও তাদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন- “এভাবেই আল্লাহ মানুষকে তাদের অবস্থাদী সম্পর্কে অবহিত করেন”।

অত:পর আল্লাহ বলেন:

﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ﴾

“যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তাদের সাথে যখন তোমদের মোকাবেলা হয়, তখন তাদের গর্দানে আঘাত করবে”।

তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার এবং তাদের সাথে যুদ্ধ ও জিহাদ করার আদেশ করলেন। {فضرب الرقاب} এখানে فعل (ক্রিয়া)র স্থলাভিষিক্ত مصدر (ক্রিয়ামূল) দ্বারা আদেশ করা হয়েছে-

﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ﴾

অর্থাৎ যখন তাদেরকে অধিক হারে হত্যা ও আহত করে ফেলতে পারবে-

﴿حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ﴾

“অবশেষে তোমরা যখন তাদের শক্তি চূর্ণ করবে, তখন তাদেরকে শক্তভাবে গ্রেফতার করবে”। অর্থাৎ বন্দী করবে-

﴿فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّىٰ تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ﴾

“তারপর (চাইলে) তাদেরকে মুক্তি দিবে অনুকম্পা দেখিয়ে অথবা মুক্তিপণ নিয়ে। তোমাদের প্রতি এটাই নির্দেশ, যাবৎ না যুদ্ধ তার অস্ত্র রেখে দেয় (অর্থাৎ শেষ হয়ে যায়)। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান”।

এটা হচ্ছে দলিলের পর্যায়ে। আর এর পূর্বে প্রথম অংশটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর দলিলের অংশটুকু হচ্ছে-

﴿ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ﴾

“এটাই নির্দেশ। আল্লাহ চাইলে নিজেই তাদেরকে শাস্তি দিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান”।

অর্থাৎ তোমাদের একদলের দ্বারা সৃষ্টিজীবকে। তোমাদের মুমিন অংশের দ্বারা তোমাদের কাফের অংশকে। আল্লাহ তা’আলা চাইলে কাফেরদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। আল্লাহ পারেন, তার ক্ষমতা আছে, তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি পবিত্র মহান সত্তা। তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারতেন-

﴿كن فيكون﴾

“হও, অমনি তা হয়ে যায়”।

কিন্তু তিনি তাদেরকে বাচিয়ে রেখেছেন এবং আমাদেরকে তাদের দ্বারা পরীক্ষা করছেন। আমাদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, যেমনিভাবে তাদেরকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহুর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ, আমাদেরকে ও তাদেরকে তথা কাফেরদেরকে-

﴿وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ﴾

“কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তিনি কখনো তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না”।

তাই এসকল আয়াতগুলোতে আমাদের উল্লেখিত ও আলোচিত বিষয়গুলোর বর্ণনা পাওয়া গেল। হায় যদি ভাইয়েরা তাফসীরের কিতাবসমূহে এগুলো নিয়ে চিন্তা করত, যাতে বিষয়গুলো ভালভাবে বুঝতে পারত।

এখানে আমরা কয়েকটি পয়েন্ট লিপিবদ্ধ করতে পারি, যাতে ভাইয়েরা রাসূল প্রেরণ বিষয়ক ইলমগুলোর একটি ধারাবাহিকতা তৈরী করতে পারে:

মানুষ দু’দলে বিভক্ত হল: মুমিনের দল ও কাফেরের দল। আল্লাহ তা’আলা তাদের একদলকে আরেক দলের উপর চাপিয়ে দিলেন। আমরা বলতে পরি আল্লাহ তা’আলা তাদের একদলকে আরেক দলের মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেললেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে উভয় দলকে পরীক্ষা করার জন্য এবং আল্লাহর উদ্দিষ্ট কয়েকটি হিকমত বাস্তবায়নের জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহর রয়েছে উন্নত প্রমাণ ও পরিপূর্ণ হিকমত।

অধিক পরীক্ষা, অধিক যাচাই, অধিক সুযোগ আল্লাহ সুবহানাহু তাদেরকে দিলেন, হয়ত তাদের কতক ফিরে আসবে, সতর্ক হবে, মৃত্যু আসার পূর্বে, নিশ্চিত বিষয় আসার পূর্বে। এটা তাদের জন্য পরীক্ষা।

এখন এসকল আমেরিকানরা আমাদের উপর চেপে আছে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে পরীক্ষা। আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করছেন। এটাই পরীক্ষা করার অর্থ। তাদেরকে দেখছেন, অধিক পরীক্ষা নিচ্ছেন, অধিক যাচাই করছেন এবং অধিক ফিৎনায় নিপতিত করছেন।

এটা তার পক্ষ থেকে অনুগ্রহই বটে যে, তিনি তাদেরকে অধিক সুযোগ দিচ্ছেন। হয়ত তারা চিন্তা করবে, হয়ত ভেবে দেখবে, হয়ত ফিরে আসবে।

তাই আল্লাহ পবিত্র, তিনি মহান। কাফেররা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে দলিল প্রতিষ্ঠা করছে আর আল্লাহ তাদেরকে তাদের সকল প্রকার ওযরের জন্য সুযোগ দিচ্ছেন। এভাবে আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও উচ্চ গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটছে। তার নামের মধ্যে রয়েছে: তিনি ‘সাব্বার’ (অধিক ধৈর্য্যশীল), সাবুর (চির ধৈর্য্যশীল), ‘হালীম’ (সহনশীল)। আর তার সহনশীল নামের কারণেই তিনি তাদেরকে নগদ শাস্তি দিচ্ছেন না, তাদেরকে সুযোগের পর সুযোগ দিচ্ছেন।

তাই এটা উভয়দলের জন্যই পরীক্ষা। এর ফলে হক ও বাতিলের মাঝে, ঈমান ও কুফরের মাঝে দ্বন্ধের সূত্রপাত হয়। দ্বন্ধ, তথা হক ও বাতিলের মাঝে লড়াই, যুদ্ধ। কেননা এই দুই দল, মুমিন ও কাফের কখনোই সমঝোতায় আসা সম্ভব নয়, পরস্পরে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। কখনোই সম্ভব নয়।

অবশ্যই দু’দল পরস্পরের শত্রু হবে। একদল আরেক দলের শত্রু। সম্ভব নয় দুই দলের মাঝে ভালবাসা ও সম্প্রীতি হওয়া, সহবস্থান ও দীর্ঘ সমঝোতা হওয়া।

সাময়িক সন্ধি, আমি সন্ধি বলে সাময়িক সন্ধির কথা বুঝাইনি। এব্যাপারে শরীয়তের বিধান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সমঝোতা, সহবস্থান, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি সম্ভব নয়। এই বিভক্তির দাবির কারণে এটা কখনোই সম্ভব নয়। এই ঈমান ও এই কুফরের দাবির কারণে এটা সম্ভব নয়। আর আল্লাহও এমনটাই (না হওয়াকেই) চান, এটাই আদেশ করেন।

অবশ্যই তারা পরস্পরের শত্রু, প্রতিপক্ষ ও পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইকারী হবে। এটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার কাম্য, তার উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা। আল্লাহই চান, আমরা পরস্পরের শত্রু হই, তবে স্বভাবতই তারা আমাদের সাথে শত্রুতা করুক এটা তিনি চান না। বরং এটা আল্লাহ তা’আলার নিকট ঘৃণিত, অপছন্দনীয়। কিন্তু এটা আল্লাহর তাকদীর হিসাবে হয়েই যাবে। এখানেই তাকদিরী ইচ্ছা ও শরয়ী ইচ্ছার মাঝে ভিন্নতা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে, আমরা তাদেরকে ঘৃণা করব, তাদের সাথে শত্রুতা করব, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এটা আল্লাহ চান, তিনি ভালবাসেন। তাকদিরীভাবেও চান, শরয়ীভাবেও চান এবং আমাদেরকে এরই নির্দেশ দেন।

এছাড়া এর মাঝে অনেক বড় কল্যাণও রয়েছে। এটা পৃথিবী সুশৃংখল থাকার জন্য শর্ত। পৃথিবী বলে উদ্দেশ্য হল, পৃথিবী ও তার মধ্যে যত মানুষ আছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الْأَرْضُ﴾

“যদি আল্লাহ তাদের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত”।

এই আয়াতটি বর্ণনা করছে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলার একটি হিকমত ও একটি ইচ্ছা হল একজনকে আরেকজন দ্বারা প্রতিহত করা, যার দ্বারা পৃথিবী সুসংহত থাকবে। কেননা আল্লাহ যদি মুমিনদের দ্বারা কাফেরদেরকে এবং তাদের কুফর, অবাধ্যতা ও জুলুমকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত- “যদি আল্লাহ তাদের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন”, যদি এই লড়াই না থাকত এবং বহু অনিষ্ট কল্যাণের দ্বারা প্রতিহত না হয়ে যেত, জিহাদ ও কিতালের দ্বারা, এ সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লড়াইয়ের দ্বারা প্রতিহত না হত, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত।

পৃথিবী কিভাবে বিপর্যস্ত হবে? কাফেরদের আধিপত্যের মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হল, পৃথিবীতে কাফেরদের আধিপত্য বিস্তার করা। যখন পৃথিবীতে কাফেররা প্রতাপশালী হয়ে যায়, তারা তাতে শাসন করে- আল্লাহ হেফাজত করুনÑ ব্যাস, তখনই পৃথিবীময় মহা বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। কুফর, শিরক, অন্যায়, পাপাচার, আল্লাহর অবাধ্যতা, শয়তানদের প্রভাব, শয়তানদের দাওয়াত, শয়তান-প্রেমী ও প্রবৃত্তি-প্রেমীদের প্রভাব। পৃথিবীতে কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াই মহা বিপর্যয়। এর চেয়ে বড় ফ্যাসাদ আর কিছু নেই।

এর দ্বারা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়: মুমিনদের বন্ধুত্ব কেবল আল্লাহর সাথে, তার দ্বীনের সাথে, তার রাসূলদের সাথে এবং এক মুমিনের আরেক মুমিনের সাথে। এই বন্ধুত্বই আল্লাহ তা’আলার কাম্য, আল্লাহর উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি আমাদেরকে এর প্রতিই আদেশ করেন এবং এটা অবশ্যই থাকতে হবে, ঈমান ও কুফরের দাবির কারণে এবং এই দাবির কারণে যে, আমরা আল্লাহর নগন্য বান্দা।

সুতরাং ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য। তার সাথে কাউকে শরীক করা হবে না। তাওহিদ, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে আত্মসমর্পণই দাবি করে, অনিবার্যভাবে চায়- যা একেবারে নিকটবর্তী দাবি- যেটাকে ভাষাবিদগণ, এমনকি মানতিক শাস্ত্রেও ‘নিকটবর্তী দাবি ও দূরবর্তী দাবি বলে নামকরণ করা হয়- এটাই দাবি করে, মুমিনগণ বন্ধুত্ব করবে কেবল আল্লাহর সাথে, তার রাসূলের সাথে, তার দ্বীনের সাথে এবং মুমিনদের সাথে আর কুফর, কুফ্ফার ও তৎসংশ্লিষ্ট যা কিছু আছে-অর্থাৎ কুফরের যত ফলাফল রয়েছে- যেমন: গুনাহ, পাপাচার, হঠকারীতা ও আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা- ইত্যাদির সাথে এবং শয়তান, তার দল, তার নিকটজন ও যারা তার দলভূক্ত তাদের সাথে শত্রুতা ও সম্পর্কোচ্ছেদ করবে। তাই তারা হচ্ছে দু’টি দল।

অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্ব, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আল্লাহকে একক সাব্যস্থ করাই এটা দাবি করে এবং তাকে স্পষ্ট ও নিকটবর্তী ফলাফল হিসাবে আবশ্যক করে। অর্থাৎ মুমিনদের অবশ্যই আল্লাহ, তার রাসূল, তার দ্বীন ও মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এবং কুফ্ফার, কুফর, শয়তান, তার দল ও তৎসংশ্লিষ্ট সবকিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, দূরত্ব ও কাঠিন্য বজায় রাখতে হবে, শত্রুতা ও বিদ্বেষ রাখতে হবে, তাদের থেকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ মুক্ত।

আমরা এটাকে সংক্ষেপে বলতে পারি: ঈমান, ইসলাম, তাওহিদ তথা একক ও শরীকহীনভাবে আল্লাহর দাসত্ব করাই দাবি করে ও আবশ্যক করে যে, মুমিনগণ আল্লাহ, তার রাসূল ও তার দ্বীনের সাথে এবং অন্যান্য মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। তাদের বন্ধু হবে মুমিনগণ। আর আল্লাহর শত্রু তথা কাফের ও তাদের কুফরী থেকে সম্পর্কমুক্ত হবে, তাদের সাথে শত্রুতা করবে।

এখান থেকে আমরা বলতে পারি, সম্পর্ক জোড়া ও সম্পর্ক ছাড়া এবং বন্ধুত্ব ও শত্রুতা এটা আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের দাবি, তাওহিদের দাবি, ইসলামের দাবি, ঈমানের দাবি। ঈমান এটা দাবি করে, ঈমানের জন্য এটা আবশ্যক এক’শতে এক’শ। ঈমান থেকে এটা আলাদা হতে পারে না। তাই এটা অসম্ভব যে, একজন মানুষ মুসলিম হবে, মুমিন হবে, তাওহীদবাদী হবে- যে শুধু আল্লাহরই ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, আল্লাহকে ভালবাসবে, তার আনুগত্য করবে আবার একই সময়ে শয়তানকে ভালবাসবে, কুফরীকে ও কাফেরদের ভালবাসবে বা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তাদের নৈকট্য অর্জন করবে, তাদের সাথে প্রশান্ত ও স্বস্তিময় জীবন যাপন করবে, যাতে কোন পেরেশানী নেই, এটা সম্ভব নয়। এটা অকল্পনীয়। কেননা দাসত্বের ভিত্তিটিই হচ্ছে ভালবাসার উপর। উলামাগণ বলেন: ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে ভালবাসা ও আনুগত্যের মধ্যে। সুতরাং কোন আবিদ পরিপূর্ণ আল্লাহর ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য আনুগত্যকে সপে দেওয়া- যার দাবি হচ্ছে আল্লাহর জন্য বিনীত হওয়া, আল্লাহর আদেশের জন্য নিবেদিত হওয়া এবং আল্লাহর অনুগত হওয়া- ব্যতীত আল্লাহর ইবাদতকারী হতে পারে না। দাসত্বের প্রকৃত ভিত্তিই হচ্ছে ভালবাসা ও বিনীত হওয়ার উপর। সুতরাং বান্দা এটা ব্যতীত আবিদ হতে পারবে না। আর আল্লাহকেও ভালবাসা, তার শত্রুদেরকেও ভালবাসা এটা সম্ভব নয়। এটা অসম্ভব।

এমনকি মানুষের মাঝে চিরাচরিত ভালবাসার মাঝেও এটা সম্ভব নয় যে, আপনি কাউকে ভালবাসবেন আবার তার শত্রুকেও ভালবাসবেন। এটা সম্ভব নয়। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ তার শত্রুকে ভালবাসা তার ভালবাসার সম্পূর্ণ বিরোধী ও বিপরীত।

আর কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের আল্লাহর দাসত্বও আমাদের থেকে দাবি করে: আমরা আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লাহকে ভালবাসব এবং তার রাসূল, তার দ্বীন, তার বন্ধু ও যারা তার কাতারে থাকে তাদেরকে ভালবাসব আর যারাই তার সাথে শত্রুতা রাখে তাদেরকে ঘৃণা করব, তাদের সাথে বিদ্বেষ রাখব এবং তাদের সাথে শত্রুতা করব। যদি এটা আল্লাহ আমাদেরকে নাও বলতেন আমাদের উপর ওয়াজিব নাও করে দিতেন, তথাপি এটা ইসলাম, ঈমান, তাওহিদ ও দাসত্বের দাবিতে ওয়াজিব হত। আর বস্তবতা তো হচ্ছে শরীয়তই আল্লাহ, তার রাসূল ও তার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করেছে এবং কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে, তাদের নিকটবর্তী হতে ও তাদের সাথে অবস্থান করতে নিষেধ করেছে, যা সামনে উল্লেখ করব ইংশাআল্লাহ।

এতদসত্তেও আল্লাহ সুবহানাহু স্বীয় অনুগ্রহ ও দয়ায় আমাদেরকে আরো স্পষ্ট ও পরিস্কারভাবে বলে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমলতার অধিকারী, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আল্লাহ প্রেমময়, মহানুভব-

﴿يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ﴾

“আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সহজটাই চান, তিনি তোমাদের ব্যাপারে কঠিনটা চান না”

আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের উপর সহজকরণের একটি দিক হল, তিনি আমাদের জন্য অধিক স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তার কুরআনের আয়াতসমূহে বর্ণনা করেছেন, তার নবী তার পবিত্র হাদিসসমূহে পরিস্কার করে গেছেন যে, আমাদের উপর ওয়াজিব হল, আমরা মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করব, আল্লাহর সাথে, তার রাসূলের সাথে ও তার দ্বীনের সাথে বন্ধুত্ব করব। আমরা মুমিনদের সাথে পরস্পরে বন্ধু হিসাবে থাকব, তাদেরকে ভালবাসব, তাদের সাথে থাকব, তাদের কাতারে থাকব, তাদের নৈকট্য অর্জন করব, তাদের সাথে জীবন যাপন করব এবং সর্বদা তাদের সাথেই থাকব।

আমরা মুমিনদের সাথে একে অপরের বন্ধু বা সাহায্যকারী রূপে থাকব আর কাফেরদেরকে ঘৃণা করব, তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব, তাদের থেকে দূরে থাকব ও বেঁচে থাকব, তাদের সাথে বসবাস করব না, এক আবাসস্থলে বা এক শহরে তাদের সাথে থাকব না- “তারা যেন একে অপরের আগুন না দেখে”  নবী সা: বলেছেন তাদের থেকে দূরে থাক, এমনকি যাতে দূর থেকে তাদের আগুনও দেখতে না পাও এবং তারাও তোমাদের আগুন দেখতে না পায়। তাদের থেকে দূরে থাক, পৃথক থাক, বেচে থাক, এক দেশে তাদের সাথে থেকো না, তাদের মাঝে বসবাস করো না, তাদের সাথে মেলামেশা করো না….তাদের সাথে কিছুই করো না…।

এসগুলোই কাফেরদের থেকে দূরে থাকা ও বেচে থাকা, সম্পর্ক ছিন্ন করা, শত্রুতা করা ও বিদ্বেষ পোষণ করার নির্দেশ। আল্লাহ আমাদের মাঝে তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছেন, বলেছেন: কিভাবে এদেরকে ভালবাসবে? এদেরকে ঘৃণা করবে, কারণ এরা আল্লাহর দুশমন, এরা আল্লাহর প্রতি কুফরী করেছে, আল্লাহর রাসূলদের প্রতি কুফরী করেছে, আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে, আল্লাহর আনুগত্যের উপর সীমালঙ্ঘন করেছে। এরা তোমাদের শত্রু।

এগুলো আমাদের জন্য কুরআন ও সুন্নায় বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, আমাদেরকে অবশ্যই মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে, আমাদের একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হবে এবং অবশ্যই আমাদেরকে কাফেরদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, তাদের সাথে শত্রুতা করতে হবে, তাদেরকে ঘৃণা করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করতে হবে, জিহাদ করতে হবে এবং আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে হবে।

এটা কুরআনে স্পষ্টভাবে সর্বোত্তমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করছি একটু পরেই সেগুলো তিলাওয়াত করব ইংশাআল্লাহ। এখানে এখন কিছু আয়াত তিলাওয়াত করব; কারণ সবগুলো উল্লেখ করলে এবং তার ব্যাখ্যা ও তাফসীর করলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাই আমরা কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হব।

আল্লাহ আয্যা ওয়াজাল্লাহও আমাদের মাঝে তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছেন এবং অনেক আয়াতে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের উপর ওয়াজিব তাদেরকে ঘৃণা করা, কারণ তারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছে, আল্লাহর আনুগত্যের উপর সীমালঙ্ঘন করেছে। তাই এটা কুরআনে সর্বোত্তমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

অনেক আয়াতে কাফেরদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দু’চারটি উল্লেখ করা হল:

﴿هَا أَنتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ﴾

“দেখ, এই তোমরা তাদেরকে মহব্বত করছ, অথচ তারা তোমাদেরকে মহব্বত করে না। আর তোমরা তো সমস্ত (আসমানী) কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান রাখ, কিন্তু (তাদের অবস্থা এই যে,) তারা যখন তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা (কুরআনের উপর) ঈমান এনেছি আর যখন নিভৃতে চলে যায়, তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে নিজেদের আঙ্গুল কামড়ায়”।

এটা পূরোটাই কাফেরদের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতা সৃষ্টির ব্যাপারে।

﴿أَلَا تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نَّكَثُوا أَيْمَانَهُمْ وَهَمُّوا بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُم بَدَءُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ

“তোমরা কি এমন কওমের সাথে যুদ্ধ করবে না, যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রাসূলকে বহিস্কারের ইচ্ছা করেছে আর তারাই তো প্রথমবার তোমাদের বিরুদ্ধে (উস্কানীমূলক কর্মকান্ড) শুরু করেছে। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? তাহলে (জেনে রেখ,) আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত”।

এরূপ আরো আয়াত রয়েছে।

তাহলে কুরআনের মধ্যে অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদেরকে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করে এবং তাতে আল্লাহ সুবহানাহু আমাদেরকে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে ও তাদেরকে সাহায্যকারী রূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেন।  সূরা মুমতাহিনা, যার অধিকাংশটা এবং বড় অংশটাই এব্যাপারে, তার মধ্যে রয়েছে-

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُم مِّنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَن تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِن كُنتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنتُمْ وَمَن يَفْعَلْهُ مِنكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ* إِن يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً

“হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমার পথে জিহাদের জন্য (ঘর থেকে) বের হয়ে থাক, তবে আমার শত্রু ও তোমাদের নিজেদের শত্রুকে এমন বন্ধু বানিও না যে, তাদের কাছে ভালবাসার বার্তা পৌঁছাতে শুরু করবে, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে, তারা তা এমনই প্রত্যাখ্যান করেছে যে, তারা রাসূলকে এবং তোমাদেরকেও কেবল এই কারণে (মক্কা হতে) বের করে দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব কর, অথচ তোমরা যা-কিছু গোপনে কর ও যা-কিছু প্রকাশ্যে কর, আমি তা ভালভাবে জানি। তোমাদের মধ্যে কেউ এমন করলে সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হল। তোমাদেরকে ভাগে পেলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের হাত ও মুখ বিস্তার করে তোমাদেরকে কষ্ট দিবে। তাদের কামনা এটাই যে, তোমরা কাফের হয়ে যাও”।

তাহলে কিভাবে তাদেরকে ভালবাসবে? এখানেও তাদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। إِن يَثْقَفُوكُمْ অর্থাৎ যদি তারা তোমাদেরকে কোনস্থানে পায়-

﴿إِن يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً وَيَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ وَأَلْسِنَتَهُم بِالسُّوءِ وَوَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ﴾

“তোমাদেরকে ভাগে পেলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের হাত ও মুখ বিস্তার করে তোমাদেরকে কষ্ট দিবে। তাদের কামনা এটাই যে, তোমরা কাফের হয়ে যাও”।

অর্থাৎ তারা তোমাদের থেকে কুফরী কামনা করে এবং চায়, তোমরাও আল্লাহর সাথে কুফরী কর।

অত:পর আল্লাহ তা’আলা আমাদের জন্য  ইবরাহীম আ:  এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন-

﴿قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ

“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাদের সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ আছে, যখন সে নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা করছ, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকীদা-বিশ্বাস) অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে গেছে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।

এখানে স্পষ্টভাবে শত্রুতা ও বিদ্বেষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ﴿وَبَدَا﴾ ‘এবং স্পষ্ট হয়েছে, প্রকাশ হয়েছে’-

﴿وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে গেছে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”

তবে তোমরা যদি একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আন, তবেই কেবল তোমাদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ শেষ হবে। এর পূর্বে কখনোই না-

﴿أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“চিরকাল চলবে, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”।

এখানে একেবারে স্পষ্ট, পরিপূর্ণ স্পষ্ট বর্ণনা। তাই পুরো কুরআন এর দ্বারা পরিপূর্ণ। সূরা আলে ইমরানে রয়েছে, মায়েদায় রয়েছে, বাকারায় রয়েছে। এছাড়াও কুরআনের অনেক সূরায় এটা স্পষ্টভাবে রয়েছে, সর্বোত্তমভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তাহলে সারসংক্ষেপে কথাটি বলি, যাতে ভাইয়েরা বুঝতে পারে:

এ সত্তেও, অর্থাৎ দাসত্ব, ইসলাম, ঈমান ও তাওহিদ স্বত্তাগতভাবেই এটা দাবি করা সত্তেও- যা পূর্বে আমরা উল্লেখ করলাম, এটা মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব ও কাফেরদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষের দাবি করে- তা সত্তেও আল্লাহ সুবহানাহু তার কিতাবে এবং তার নবীর সুন্নায় আরো স্পষ্ট ও আরো পরিস্কারভাবে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার আবশ্যকীয়তা ও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার নিষেধাজজ্ঞা বর্ণনা করে দিয়েছেন। এ বিষয়টিই আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, কিন্তু এখন আপনাদের জন্য সংক্ষেপে এককথায় বলার প্রয়াস পেলাম।

এখন আমরা ইংশাআল্লাহ কিছু আয়াত উল্লেখ করব, যা কুরআনে এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলো উল্লেখ করব, যেগুলোতে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের ব্যাপারে কঠিন হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলো উল্লেখ করব।

আমরা পূর্বে সূরা মুমতাহিনার আয়াতটি উল্লেখ করেছি-

﴿يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ

“হে ঈমানদারগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না”

এ ধরণের আয়াত কুরআনের মধ্যে আরো অনেক রয়েছে। এখন বিভিন্ন সূরার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আয়াত উল্লেখ করব। একটি সূরা আলে ইমরানে, দু’টি সুরা মায়িদায়। এই তিনটি হল কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের হুকুমের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত।

আমরা বলেছি, কুরআন কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করে এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আদেশ করে আর কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে শক্ত গুনাহ ও পাপ বলে উল্লেখ করে, বরং কোন কোন আয়াতে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, এটা এর থেকেও আরো কঠিন ও জঘন্য। যা আমরা সামনের আয়াতগুলোতে দেখব:

আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে ইমরানে বলেন:

﴿لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ﴾

“মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন কর, সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন। আর তারই দিকে (সকলের) প্রত্যাবর্তন”।

আরেকটি আয়াত হল-

﴿وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ﴾

“আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন। আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি দয়াশীল”।

এই আয়াতটি হল সূরা আলে ইমরানে। আল্লাহ তা’আলা বলছেন: “মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়”।

বর্ণনা ভঙ্গিটি সংবাদমূলক, কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন করে বলা, আদেশ করা।

“মুমিনগণ যেন না বানায়”, অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা বানিও না। এটা হচ্ছে তার অর্থ। “মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছাড়া কাফেরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়” এতে মুমিনদেরকে নিষেধ করা হচ্ছে, মুমিনদের ছাড়া কাফেরদের সাথে সাথে বন্ধুত্ব করতে।

এটা পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট বয়ান। আপনি শুধু মুমিনদেরকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করবেন, কাফেরদেরকে বন্ধু বানাবেন না।

এরপর বলেন: ‘যে এটা করে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’। এরকম ভাবপ্রকাশ আরবী ভাষায় কোন ব্যক্তি বা বস্তু থেকে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলে থাকে- ‘যে এমনটা করে সে আমার থেকে  নয়; আমি তার থেকে নই’ ‘অথবা সে কোন বিষয়ে আমার থেকে নয়’।

রাসূলুল্লাহ সা: এর কথায় অনেক স্থানে এরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

) من غشنا فليس منا(

যে আমাদেরকে (মুসলমানদেরকে) ধোঁকা দেয় সে আমাদের মধ্য থেকে নয়”। অর্থাৎ আমি অমুক জিনিস থেকে সম্পর্কমুক্ত।

‘যে এটা করে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’ অর্থাৎ আল্লাহ তার থেকে সম্পর্কমুক্ত, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, সে আল্লাহর নৈকট্য পাবে না এবং আল্লাহর সাথে সম্বন্ধিত হতে পারবে না। এটাই হচ্ছে- “আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই” এর অর্থ।

তারপর পূবের্র হুকুম থেকে পৃথক করে বলেন: ‘তবে…..’। সেই ভিন্ন অবস্থাটি হল আত্মরক্ষামূলক ব্যবহারের অবস্থা। অর্থাৎ যখন তোমরা তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত ও পরাজিত হও, তাদের থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা কর, ফলে বাহ্যিকভাবে তাদের সামনে প্রকাশ কর যে, তোমরা তাদের সাথে শত্রুতা কর না, তাদের থেকে বাচার উদ্দেশ্যে। এটা হল অপারগতার অবস্থা। অপরাগতা ও আশঙ্কার অবস্থাটি শুধু ভিন্ন। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এটা চলবে না। এটাই হল প্রকৃত হুকুম- কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা নিষেধ। আর এখানে এটি এত স্পষ্টভাবে রয়েছে, যা অন্যসব আয়াতে নেই। এখানে বলা হয়েছে, যে এমনটা করে এবং মুমিনদের ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, আল্লাহ তার থেকে মুক্ত- ‘আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’

এই সম্পর্কমুক্তির অর্থ কি, এটা কি কুফর? ‘আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই’ এর অর্থ কি সে আল্লাহর দ্বীন থেকে একেবারেই বের হয়ে গেছে? এর অর্থ কি কুফর? না এর অর্থ পাপাচার ও গুনাহ? সবগুলোরই সম্ভাবনা রয়েছে, আল্লাহই ভাল জানেন এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কিন্তু এটা হচ্ছে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বকারীর কুফরের সম্ভাবনার ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিশালী আয়াত। এই বিষয়টিকে আরেকটু স্পষ্ট করব ইংশাআল্লাহ। এ হচ্ছে প্রথম আয়াত, যা সূরা আলে ইমরানের, যাতে আল্লাহ তা’আলা বললেন, তিনি ঐ সকল লোকদের থেকে সম্পর্কমুক্ত, যারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে।

আর দ্বিতীয় আয়াত, যা সূরা মায়িদায় রয়েছে তা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্য থেকে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই দলভূক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না”।

আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে সম্ভোধন করছেন-‘হে ঈমানদারগণ!’ তাদেরকে ডেকে বলছেন, তোমরা এই কথাটি শোন- ‘তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না’। নিষেধ করা হল-

﴿لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ﴾

আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি, তোমারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।

এই বাক্যটি একটি মধ্যবর্তী বাক্যের (জুমলা মু’তারিযার) মত। যেন এটা কথার মাঝে ভিন্ন প্রসঙ্গ। জুমলা মু’তারিযা হল, যে বাক্য আনা হয়, উদ্দিষ্ট কথার পূর্বে ভিন্ন একটি বিষয় বুঝানোর জন্য।

অত:পর আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾

অর্থাৎ বাস্তব অবস্থা হল, ইহুদী-নাসারারা একে অন্যের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তাই তোমরা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। অত:পর বলেন: ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে’ অর্থাৎ আর যারা এই কাজ করবে, যা থেকে আমি নিষেধ করলাম এবং তাদেরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করবে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। তোমরা হে মুমিনগ!﴿وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ﴾  তোমাদের মধ্য হতে যে এটা করবে। অত:পর তার ফলাফল উল্লেখ করেন।

এখানে مَن (যে) শব্দটি শর্তমূলক। ফলাফলটি হল-‘সে তাদেরই দলভূক্ত’। যে কুফ্ফার তথা ইহুদী-নাসারা ও তাদের মত যেকোন প্রকার কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তার কুফরীর ব্যাপারে এটা সবচেয়ে স্পষ্ট আয়াত।

সবচেয়ে স্পষ্ট আয়াত, আল্লাহ তা’আলা এখানে পরিস্কারভাবে বলেছেন, যে ইহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করে সে তাদের মধ্য থেকে। অর্থাৎ সে তাদের মত, তাদের অন্তর্ভূক্ত, তাদের মধ্যে গণ্য এবং তাদের মত কাফের। অত:পর বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না”। এটা হচ্ছে বঞ্চনা, যার মধ্যে শাস্তিবাণী ও ধমকি রয়েছে। অর্থাৎ যখন তোমরা জুলুম করবে, তোমরা হয়ে যাবে জালেম, তখন জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দিবেন না। কারণ আল্লাহ তা’আলা জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না। এখানে নিষেধাজ্ঞা ও  হুকুম উল্লেখ করার পর কঠিন শাস্তিবাণী ও ধমকি শোনানো হল।

﴿فَإِنَّهُ مِنْهُمْ﴾ কতক উলামা স্পষ্টভাবে বলেছেন: এর অর্থ হল, সে তাদের মত কাফের। অন্য আলেমগণ বলেছেন, সে গুনাহের মধ্যে তাদের মত।

কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট ও পরিস্কার, যা বুঝে আসে এবং প্রথমেই মাথায় উদয় হয়, যা আরবী কথার অর্থের সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ, তা হচ্ছে সে কুফরীর মধ্যে তাদের মত, ‘সে তাদের মধ্য থেকে’ মানে তাদের মত কাফের। আল্লাহই ভাল জানেন। এটাই ব্যাখ্যা হিসাবে অগ্রগণ্য।

তৃতীয় আয়াতটিও সূরা মায়িদায় এবং তারপরের আয়াতও সূরা মায়িদার, পূর্বের আয়াতের কিছু পরে। তা হল:

﴿وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ

“তারা যদি আল্লাহ, নবী ও তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না”।

এই আয়াতের পূর্বের কয়েকটি আয়াত আমরা তিলাওয়াত করবো, যা দীর্ঘ, সবগুলোই বন্ধুত্বের ব্যাপারে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ* كَانُوا

“বনী ইসরাঈলের মধ্য হতে যারা কুফরী অবলম্বন করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে অভিশম্পাত বর্ষিত হয়েছিল। তা একারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং সীমালঙ্ঘন করেছিল”।

অর্থাৎ ইহুদীরা-

﴿كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ﴾

“তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ”।

একজন আরেকজনকে অন্যায় থেকে নিষেধ করত না-

﴿كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ* تَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾

“তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ। তুমি তাদের অনেককেই দেখবে, তারা কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে”।

ইহুদীরা। আল্লাহ সুবহানাহু তাদের নিন্দা করছেন এবং তাদের অপরাধ বর্ণনা করছেন যে, তারা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখত, তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করত না-

﴿تَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ أَن سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونُ* وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَٰكِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ﴾

তুমি তাদের অনেককেই দেখবে, তারা কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে, তা অতি মন্দ। কেননা-(তার কারণে) আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা শস্তির ভেতর থাকবে। তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু (প্রকৃত ব্যাপার হল,) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।

উক্ত “তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না” উদ্ধৃতিটি আয়াতের একটি অংশ। সূরার পূর্বাপর আয়াতসমূহের সাথে তার স্থান হল এটি, যা পড়ে শোনা হল।

আল্লাহ সুবহানাহু এই আয়াতে যারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে সে সকল ইহুদীদের ব্যাপারে বলেছেন। আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পূর্ণ আলোচনা ইহুদীদের ব্যাপারে।

আল্লাহ সুবহানাহু ইহুদীদের ব্যাপারে আলোচনা করছেন, তাদের নিন্দা করছেন, তাদের দোষ বর্ণনা করছেন যে, তারা যে অন্যায় করত, তাতে একে অপরকে বারণ করত না এবং তাদের অনেকে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখত। তারপর বলেন: “তারা যদি আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি ঈমান রাখত তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না”। এর অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহ, তার রাসূল ও তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনেনি।

উক্ত আয়াতে لو (যদি) শব্দটি শর্তবোধক অব্যয়। এটা বুঝায়, একটি জিনিস না থাকার কারণে আরেকটি জিনিসও থাকবে না। তাই তাদের আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি ও তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান নেই। এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটু ব্যাখ্যা করতে হয়, কারণ বাক্যটি নেতিবাচক বাক্য। এ হিসাবে উক্ত আয়াতের অর্থ হয়ে যায়, “তাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার কারণে তাদের ঈমান নেই”। কারণ বাক্যটি নেতিবাচক। তাই ‘না হওয়া’ বা ‘না থাকা’ শব্দ উহ্য মেনে ব্যাখ্যা করতে হবে।

তখন অর্থ হবে: আল্লাহ, নবী ও তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার প্রতি তাদের ঈমান নেই, এই জিনিসটি না থাকার কারণে, না পাওয়া যাওয়ার কারণে। আর সেই জিনিসটি হল: কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা।

তাই এই ব্যাখ্যাটি করতে হয়।  কারণ বাক্যটি এসেছে না বোধক আলোচনার সাথে। অন্যথায় لو শব্দটি আরবী মূলনীতিতে প্রকৃতার্থে ‘কোন জিনিস না থাকার কারণে অন্য কোন জিনিস না থাকা’ বুঝায়। আপনি বললেন: ‘তুমি যদি আমার কাছে আসতে, তাহলে আমি তোমার একরাম করতাম’। কিন্তু তুমি না আসার কারণে আমার তোমাকে একরাম করা হয়নি। কিন্তু এই আয়াতে না বোধক শব্দ থাকার কারণে বাক্যটিকে ব্যাখ্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল, বাক্যটির অর্থ হচ্ছে: তারা যদি আল্লাহ ও তার নবীর প্রতি ঈমান আনত, তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। তাই যখন তারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করল, এটাই প্রমাণ করে, তারা মুমিন ছিল না।

“لو” বর্ণকে ভাষাবিদগণ নামকরণ করেন, ‘একটি না থাকার কারণে আরেকটি না থাকার অর্থজ্ঞাপক বর্ণ’ বলে। তার শর্তটি না পাওয়ার কারণে শর্তকৃত বস্তুটিও পাওয়া যাবে না।

আর এখানে দুই অংশের এক অংশ নেতিবাচক-﴿مَا اتَّخَذُوهُمْ﴾ “তারা তাদেরকে গ্রহণ করত না”। তাই তার মধ্যে ‘না থাকা’ বা না ‘হওয়া’ শব্দ উহ্য মানতে হবে। তখন মূল কথাটি এরূপ হবে: “আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি ও তার উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার প্রতি তাদের ঈমান নেই, তাদের থেকে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা না পাওয়া যাওয়ার কারণে”।

‘না করা’ না পাওয়া যাওয়া মানে হচ্ছে ‘না’ এর ‘না’। অর্থাৎ ‘হ্যা’। অর্থাৎ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা।  (এত বেশি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এককথাকে….)

তাই যে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তার হুকুমের ব্যাপারে এটা হল কুরআনের বর্ণিত তিনটি আয়াতের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ও পরিস্কার যে, আল্লাহ তার থেকে মুক্ত এবং সে ঈমানদার নয়; বরং সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।

একারণেই উলামায়ে কেরাম কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে এবং অন্যান্য সাধারণ আয়াতগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বন্ধুত্ব করার অনেকগুলো স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর হল কুফর। আর তার নিচে পাপ ও গুনাহের অনেক স্তর রয়েছে। অনেক স্তর, যা কেবল আল্লাহই জানেন।

কারণ আল্লাহ সুবহানাহু একস্থানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে তিনি তার থেকে সম্পর্কহীন এবং আরেক স্থানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘সে তাদের মধ্য থেকেই’, আরেক স্থানে বলেছেন, সে ঈমানদার নয়। তাই এসকল উদ্ধিৃতিগুলো থেকে তারা এ গবেষণা করেছেন যে, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার কোন স্তর রয়েছে, যা কুফর। আর নিশ্চয়ই এটিই হল সর্বোচ্চ স্তর। একারণে আলেমগণ বলেন, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার সর্বোচ্চ স্তর হল তা কুফর। এটা হল সর্বোচ্চ স্তর, সর্বাধিক স্পষ্ট। এটার সম্বন্ধেই এখন আমরা কথা বলছি। আর যে স্তরগুলো এ স্তরের নিচে, সেগুলো হচ্ছে গুনাহ। আর সেগুলো বিভিন্ন রকমের হয়: কিছু বড় গুনাহ, কিছু ছোট গুনাহ।

কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার সেই সর্বোচ্চ স্তর ও পর্যায় কোন্টি, যেটা আমরা কল্পনা করতে পারি, কে আমাদেরকে এর উত্তর বলবে?

আলেমগণ বলেন: কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করার (অর্থাৎ মুসলমান তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে) সর্বোচ্চ স্তর হল: তাদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এই স্তরকে ‘মুযাহারাহ’ বলেন, অর্থাৎ লড়াই বা যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে সাহায্য করা।

অর্থাৎ যখন এদিকে লড়াই, যুদ্ধ, রক্তপাত হচ্ছে, তখন সে কাফেরদের কাতারে থাকবে, তাদেরকে সাহায্য করবে, সহযোগীতা করবে, তাদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এটা হচ্ছে বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তর। এই স্তর কুফর।

যে কাফেরদের সাথে তাদের কাতারে, তাদের পক্ষে, তাদের সীমানায়, তাদের পার্শ্বে ও তাদের সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদেরকে সহযোগীতা করে, মদদ দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে, এটা বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তর, সবচেয়ে পরিস্কার অবস্থা এবং এটা বন্ধুত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট অবস্থা, যার উপর আল্লাহ তাআলার একথাগুলো প্রযোজ্য: আল্লাহ তার থেকে সম্পর্কহীন’, ‘সে তাদের দলভূক্ত’, ‘সে ঈমানদার নয়এই ব্যক্তি কখনোই মুমিন নয়। এটা ঈমান ভঙ্গকারী জিনিসসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম ভঙ্গকারী। এর থেকে আল্লাহর পানাহ। আমরা এর থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও মুক্তি কামনা করছি।

তার নিচে অনেক স্তর রয়েছে, যার কোনটা কুফরের সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু এটার ব্যাপারে আমরা দৃঢ়ভাবে বলি, এটা কুফর।

পরিশেষে: শুরুতে-শেষে, প্রকাশ্যে-গোপনে সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।  রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক তার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সা: এর উপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সমস্ত সাহাবাদের উপর।

************

তাফসিরনীতি – ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ

ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কারের ইতিহাসে ইবনু তাইমিয়াহ্ খুব পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই। ‘How Tafsir is Performed?’-র বাঙলানুবাদ হচ্ছে ‘তাফসিরনীতি’।

পিডিএফ ডাউনলোড করুন

ওয়ার্ড ডাউনলোড করুন

তাফসির নীতি

(How Tafsir is Performed?-র বাঙলানুবাদ)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ্

 

কথামুখ

بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কারের ইতিহাসে ইবনু তাইমিয়াহ খুব পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব, তাঁকে নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই।

Islamhouse.com থেকে প্রকাশিত ‘How Tafsir is Performed?’-র বাঙলানুবাদ হচ্ছে তাফসিরনীতি

 

তাফসির নীতি

 

তাফসির করার সবচে বিশুদ্ধ পদ্ধতিটি কী তা যদি তুমি জানতে চাও, তবে এর উত্তর হলো- সবচে বিশুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআনের মাধ্যমে কুরআনকে ব্যাখ্যা করা। কারণ, কুরআন কোনো এক স্থানে যা ইঙ্গিত করে, অন্যস্থানে তা ব্যাখ্যা করা থাকে এবং কোনো এক নির্দিষ্ট ঘটনার ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা অন্যস্থানে বিস্তারিত বিবৃত থাকে। কিন্তু এটি যদি কোনো ক্ষেত্রে তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে তোমার উচিত সুন্নাহর দিকে মনোনিবেশ করা, আর সুন্নাহই কুরআনকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইদ্রিস আশ্শাফিয়ি বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ যা কিছু বলেছেন, তা কুরআন থেকেই আহরিত।’

আল্লাহ বলেন–

إِنَّآ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ بِٱلْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُۚ وَلَا تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا

‘নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসংবলিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে উপলব্ধি দিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করতে পারো। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে তর্ক করো না।’[1]

وَأَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

‘আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে সেই সব বিষয়ের ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।’[2]

وَمَآ أَنزَلْنَا عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِى ٱخْتَلَفُوا۟ فِيهِۙ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

‘আপনার কাছে তো গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এজন্য যে, তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে তাদের জন্য তা স্পষ্ট করবেন এবং যাতে এটি ইমানদারদের জন্য হিদায়াত ও রহমতের অবলম্বন হয়।’[3]

এ কারণেই নবি বলেন,

‘জেনে রেখো, আমাকে কুরআন ও এর মতো কিছু দেয়া হয়েছে।’[4]

অর্থাৎ সুন্নাহ। প্রকৃতপক্ষে, কুরআনের মতো সুন্নাহও ওয়াহির মাধ্যমে তাঁকে দেয়া হয়েছে। পার্থক্য এতোটুকুই- তা কুরআনের মতো করে তাঁর সামনে তিলাওয়াত করা হয়নি। ইমাম আশ্ শাফিয়ি ও অন্যান্য আলিমগণ এর সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তি ও আলোচনা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এগুলো উদ্ধৃত করার স্থান এটি নয়।[5]

কুরআন বুঝার জন্য তোমার উচিত প্রথমে স্বয়ং কুরআনকে দেখা, যদি তা তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। নবি মুয়াজ (رضي الله عنه)-কে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কীভাবে বিচার করবে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি কিতাবুল্লাহ অনুযায়ী বিচার করবো।’ নবি প্রশ্ন করলেন, ‘যদি তুমি তাতে কিছু না পাও, তখন কী করবে?’ তিনি বললেন, ‘আমি নবি – র সুন্নাহর সহায়তা নেবো।’ নবি আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘যদি তুমি এতেও তা না পাও, তখন কী করবে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি ইজতিহাদ করবো।’ এ কথা শুনে নবি মুয়াজ-র কাঁধে মৃদু আঘাত করলেন এবং বললেন, ‘প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর রাসুলের দূতকে পথপ্রদর্শন করেছেন, যা তাঁর রাসুলকে সন্তুষ্ট করলো।’[6]

যদি কোনো ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ তোমার জন্য যথেষ্ট না হয়, তখন সাহাবিদের কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করো। এজন্য যে, তাঁরা কুরআন বেশি জানেন, তাঁরা এর নাযিল হওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর নাযিল হবার পরিস্থিতি পার করেছেন। কেন ও কোন্ পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছে। তারা জানেন এবং সম্পূর্ণভাবে বুঝেন। বিশেষভাবে এটি আলিমগণ ও আমিরদের ক্ষেত্রে সত্য, যেমন পূণ্যবান চার খলিফা ও আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনু জারির আত্ তাবারি বলেন, ‘আবু কুরাইব আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে, ‘জাবির ইবনু নুহ্ আমাদের জানিয়েছেন,

‘মারসুক থেকে আবু দুহা, আবু দুহা থেকে আল্আমাশ আমাদের জানিয়েছেন যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ বলেছেন, ‘যিনি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, তাঁর শপথ করে বলছি, কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই, যে আমি জানি না তা কোন প্রেক্ষিতে কোন্ স্থানে নাযিল হয়েছিল। কুরআন সম্পর্কে আমার চে’ বেশি জানে এবং আমি তার কাছে পৌঁছুতে পারি- এমন কেউ আছে যদি আমি জানতে পারতাম, তবে নিশ্চয়ই আমি তাকে দেখতে যেতাম।”[7]

আবু ওয়ালি থেকে আল্আমাশ আরও বর্ণনা করেন- ইবনু মাস্ য়ুদ বলেছেন, ‘আমাদের মাঝে কেউ যদি কুরআনের দশ আয়াত শিখতেন, তিনি এ আয়াতগুলোর অর্থ ও বিধান না জানা পর্যন্ত সামনে বাড়তেন না।’ আরেকজন বড় আলিম হলেন আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস رضي الله عنه, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর রাসুলের ভাতিজা এবং কুরআনের মুফাসির। আল্লাহর রাসুলের দুয়ার কারণে তিনি এই মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আল্লাহর রাসুল দুয়া করেন, ‘ও আল্লাহ! তাকে ইসলামের জ্ঞান দান করুন এবং কুরআনের মর্মার্থ শিক্ষা দিন।[8]

মুহাম্মাদ ইবনু বাশার আমাদের বর্ণনা করেন- ওয়াকি জানিয়েছেন যে, মারসুক থেকে মুসলিম (ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা), মুসলিম থেকে আমাশ, আমাশ থেকে সুয়িয়ান আমাদের জানিয়েছেন, আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাস্ য়ুদ وما أنزلنا عليك বলেছেন, ‘কুরআনের অতুলনীয় একজন ব্যাখ্যাদাতা ইবনু আব্বাস!’ আল্ মাসরুক থেকে মুসলিম ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা, মুসলিম ইবনু সাবিহ্ আবি দুহা থেকে আল্আমাশ, আল্আমাশ থেকে সুফ্য়িয়ান, সুফ্য়িয়ান থেকে ইসহাক আল্আজরাক, ইসহাক আল্আজরাক থেকে ইয়াহ্য়িয়ার মাধ্যমে ইবনু জারিফও এই হাদিসটি সামান্য ভিন্ন শব্দে- ‘ইবনু আব্বাস কুরআনের অতুলনীয় একজন ব্যাখ্যাদাতা!’-বর্ণনা করেন। আল্আমাশ থেকে জাফার ইবনু আওন, জাফার ইবনু আওন থেকে বুন্ দারের মাধ্যমেও তিনি এই হাদিসটি একই শব্দে বর্ণনা করেন। সুতরাং, ইবনু আব্বাস رضي الله عنه সম্পর্কে বলা কথাগুলো প্রকৃতপক্ষেই ইবনু মাস্ য়ুদ رضي الله عنه-র নিজের বলা কথা। ইবনু মাস্ য়ুদ رضي الله عنه মারা যান খুব সম্ভবত ৩৩ হিজরিতে। ইবনু আব্বাস رضي الله عنه তাঁর মৃত্যুর পর ছত্রিশটি বছর বেঁচে ছিলেন এবং ইসলামি জ্ঞান-কোষাগারে প্রচুর অবদান রেখে গেছেন তিনি।

আল্আমাশ আবু ওয়ালি থেকে বর্ণনা করেন- ইবনু আব্বাস رضي الله عنه আলি رضي الله عنه দ্বারা হাজ্জের আমির নিযুক্ত হন। তিনি একটি ভাষণ দেন এবং সূরা বাকারাহ্ থেকে পাঠ করেন, অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি সূরা নুহ থেকে পাঠ করেন। তিনি এই পাঠকৃত আয়াত এমনভাবে ব্যাখ্যা করলেন, যদি রুমান, তুর্কি ও দালামিরা তা শুনতো, তবে তারা ইসলাম গ্রহণ করে ফেলতো। এই কারণেই ইসমায়িল ইবনু আব্দির রহমান সুদ্দি তাঁর লিখিত তাফসিরের অধিকাংশ ব্যাখ্যাই এই দুজন আলিম- ইবনু মাস্ য়ুদ ও ইবনু আব্বাস رضي الله عنهم-এর থেকে নিয়েছেন।

——————————————————————

[1] সূরা আন্ নিসা ৪: ১০৫

[2] সূরা নাহ্ ল ১৬:৪৪

[3] সূরা নাহ্ ল-১৬: ৬৪

[4] আহমাদ, মুসনাদ, খন্ড:৪, ১৩১; আবু দায়ুদ, সুনান, সুন্নাহ্,

[5] আলোচনার জন্য দেখুন আশ্ শাফিয়ি, আর্ রিসালাহ

[6] এ হাদিসটি মুসনাদ ও সুনান সংগ্রহের হাদিসে ভালো সনদে বর্ণিত হয়েছে। (আহমাদ, মুসনাদ: দারিমি, সুনান, মুকাদ্দিমাহ, ৩০; তিরমিজি, সুনান, আহকাম, ; আবু দায়ুদ, সুনান, আক্ দিয়াহ্, ১১)

[7] ইবনুল কাসির, জামিয়ুল উসুল ফি আহাদিসির্ রসুল- ১৩৯২/১৯৭২, খন্ড: ৯, পৃ: ৪৮

[8] আহ্ মাদ, মুসনাদ খন্ড ১: ২৬৬, ৩১৪, ৩২৮, ৩৩৫