শায়খ খালিদ বাতারফি
তৃতীয় মূলনীতিঃ বিদআতি ও তার অনুসারীরা যে বিদআতে লিপ্ত হয়েছেন, তার সমর্থন ও স্বীকৃতি না দেয়া। বরং যে বিদআতে পতিত হয়েছে, তা কঠোর ও হালকা যাই হোক না কেন – বিদআত ও ব্যক্তির অবস্থা অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করা।
অর্থাৎ যে বিদআত যত বড় হবে, তার প্রত্যাখ্যানও তত শক্ত হবে। আর বিদআত যদি হালকা হয়, তাহলে তার প্রত্যাখ্যানের বিষয়টিও হালকা হবে। অথচ বর্তমানে আমরা কখনো শক্ত বিদআতের ক্ষেত্রে নরম আচরণ করি, আবার যে ব্যক্তি কোনো মাসলাহাতের কারণে বিদআতে পতিত হয়েছে – তার সাথে কঠোর আচরণ করি।
এই ব্যাপারে আমরা আমাদের আগের দারসগুলোতে কিছু আলোচনা করেছি, কিন্তু স্পষ্ট করার জন্য আবারো আলোচনা করছি। আমাদের কথার অর্থ এই নয় যে – যে ব্যক্তি কোনো বিদআতে অথবা ভুলে পতিত হয়েছে, তাকে আমরা তাকফির করি না বা তাফসিক করি না বা গুনাহগার সাব্যস্ত করি না এবং তাকে অস্বীকৃতি জানাই না। বরং অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানকরণ তো আবশ্যক। এই উম্মতের এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, তারা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।
এই আলোচনাতে ব্যক্তির অবস্থা ও সে যেই ভুলে পতিত হয়েছে, সে অবস্থা অনুযায়ী তাকে অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের পদ্ধতি’র প্রসঙ্গ আসবে।
মুশকিল হল; সংকীর্ণমনা ও পক্ষপাতিত্বকারী লোকেরা ব্যক্তির ভুলের দিকে না তাকিয়ে ব্যক্তির দিকে তাকায়।
একটি উদাহরণ দেখুন। মনে করুন মুসলিমদের বড় একজন আলিম কোনো একটি ভুল করলেন বা কোনো বিদআতে লিপ্ত হলেন অথবা এমন কোন কথা বললেন, যার অনুসরণ করলে অনেক লোকের ক্ষতি হবে। অতঃপর একজন ব্যক্তি এসে এই আলিমের কথাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তখন আরেকজন আপত্তির সুরে বলল,“কে এই ব্যক্তি যে এই আলিমের কথাটি প্রত্যাখ্যান করছে!”
না (এমনটি বলা উচিত নয়!)। বরং আপনি দেখুন এই আলিম কি বলেছেন এবং তিনি কি ভুলে পতিত হয়েছেন কিনা। মনে রাখতে হবে যে – ভুল করলেও এই আলিম আমাদের চোখের শীতলতা ও মাথার মুকুট। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে – আমাদের কাছে ‘হক’ প্রত্যেক আলিমের চেয়েও বেশি প্রিয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত প্রত্যেকের কথাই (সত্যের মানদন্ডের ভিত্তিতে) গ্রহণ করা হবে এবং ভুল হলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল – এই জমানায় আমাদের সমালোচনাকারীরা কখনো এই মূলনীতি গ্রহণ করতে রাজি নয়। তাই যখন আপনি তাদের কারো কাছে যাবেন এবং শরীয়তের কোন অধ্যায়ের কোন মাসআলা নিয়ে তার সাথে আলোচনা, পর্যালোচনা করতে চাইবেন তখন তারা উপরোক্ত মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করবে।
এর দ্বারা জাহমিয়া ও মাদখালিদের অনেক অনুসারীর আসল রূপ প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। তারা এই মূলনীতিকে কঠোরভাবে বর্জন করে। কিন্তু বাস্তবতা হল-তারা অনুসরণীয় ব্যক্তিদের হকের চেয়ে অনেক বেশি সম্মান করে। তারা ব্যক্তির মানহাজকে দোষী সাব্যস্ত করে, কিন্তু ব্যক্তিকে নয়। আশ্চর্যের বিষয় হল – তারা তাদের এই চিন্তার আবশ্যকীয় ফলাফল তৈরি করে। অথচ আমরা তা তাদের জন্য আবশ্যক করি না। তাদের চিন্তার আবশ্যকীয় ফলাফল হল, তারা কিতাব সুন্নাহকেই ভুল সাব্যস্ত করে, কিন্তু ব্যক্তিকে নয়। এই বিষয়টি বাতিল। এগুলো বাতিল কথা। মানুষ মাত্রই ভুল করে। প্রত্যেক বনী আদম ভুল করে। কিন্তু কিতাব ও সুন্নাহ ভুল থেকে পবিত্র।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ
“অর্থঃ মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর”। (সূরা হুজুরাত ৪৯:১)
সুতরাং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথাকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। যেমন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
“যখন তাকে বলা হল–“আমরা মিনাতে কীভাবে নামাজ পড়বো”? তিনি বললেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনাতে কসর করতেন”। তারা বললেন, “কিন্তু আবু বকর ও উমর তো পূর্ণ পড়েন”।
এরপর তিনি বললেন, “তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ হোক! আমি তোমাদেরকে বলছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন, আর তোমরা আমাকে বলছ আবু বকর ও উমর করেছেন!”
আবু বকর ও উমরের উক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন তার কাছে একজন মহিলা এসে বলল, “যদি আমি (আগামী বছর) আবার আসি, এবং আপনাকে না পাই, (তখন কোথায় যাবো?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “তুমি আবু বকরের কাছে যাবে”। তাকে আবু বকরের হাওয়ালা করে দিলেন।
হাদিসে এমনটিই এসেছে। আমি এখানে পূর্ণ হাদিসটি উল্লেখ করছি না। কিন্তু (মূল বিষয়টি হল) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “তোমরা আবু বকর ও উমর এর কাছে যাবে”।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা ভবিষ্যতে ব্যাপক মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও আমার পর খুলাফায়ে রাশিদীনের পথ আঁকড়ে ধরবে”।
আবু বকর, উমর, উসমান ও আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুদের এতো এতো সম্মানের পরও তাদের কথাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উপর প্রাধান্য দেয়া হবে না। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোকাবেলায় তাদের কথাকেও প্রাধান্য দেয়া যাবে না; অথচ তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ হিদায়াত লাভ করতে পেরেছি। আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর সন্তুষ্ট হন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করে দিন। তাহলে ঐ সময়ের উলামা অথবা এই যুগ বা অন্য যুগের উলামাদের বেলায় কী নীতি হবে?
তাই আমাদের একটা মূলনীতি থাকা উচিৎ। এই যুগের যত বড়ই ব্যক্তিত্ব হোক না কেন, ভুল করলে আমরা বলতে পারব যে, তিনি ভুল করেছেন। এতে তার মর্যাদার কোনো কমতি হবে না। বরং এর বিপরীত হলে তার মর্যাদাহানি হবে। যে ভুল তাকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি যদি তার থেকে ফিরে আসেন তাহলে তার মর্যাদা ও সম্মান আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। আর যদি তিনি অবিচল থাকেন, তাহলে তার মান-মর্যাদা বাকি থাকবে কিন্তু তার ভুলের ক্ষতি তার উপর ফিরে আসবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যা আমার শরিয়তে নেই তা প্রত্যাখ্যান করা হবে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ তার ‘ইসতিকামাহ’ গ্রন্থে বলেন, “যার থেকে এই ধরণের বিষয় প্রকাশ পায় (অর্থাৎ মূলনীতিবিহীন বিরোধিতা), আর এটা যদি ইজতিহাদের অক্ষমতা কিংবা জ্ঞানের স্বল্পতার ওজরের কারণে হয়, তাহলে তার অনুসারীদেরকে সঠিক বিষয়টি স্পষ্ট থাকা অবস্থায় মাজুর মনে করা হবে না। যদিও এই মুজতাহিদের এই ত্রুটি ক্ষমাযোগ্য; কেননা তার উদ্দেশ্য সৎ ছিল। তাই এ ক্ষেত্রে সঠিক-বেঠিক জানিয়ে দিতে হবে যাতে করে সে হক ও বাতিল মিলিয়ে না ফেলে”।
তিনি ‘ফাতওয়াতে’ আরও উল্লেখ করে বলেন,
“এ ধরণের মানুষ এবং তাদের মত যারা শরিয়তের বিরোধী মত পোষণ করেন এবং তাদেরকে সঠিকটা ধরিয়ে দেয়া হলে, সেটা গ্রহণ করেন না, এমন মানুষদের বিরুদ্ধাচরণ করা আবশ্যক। তবে এটা শরিয়তের মূলনীতি অনুসারে করতে হবে। অর্থাৎ- প্রথমত হাত দিয়ে, তা না হলে মুখ দিয়ে, সবশেষে অন্তত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে”।
অনুরূপভাবে যারা পূর্বের মাজুর আলিমদের ঐ সকল কথা ও কাজের অনুসরণ করে যা শরীয়ত বিরোধী, তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। কেননা ঐ সকল আলিমদের ওজরটি অনুসারীদের মাঝে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং তাদের এই ভুলের অনুসরণ করার কোন যৌক্তিকতা নাই।
আর যে অনুসারীর কাছে মুজতাহিদের বিষয়টা কোন প্রকারের (ওজরের না ভুলের) তা অস্পষ্ট থাকবে, সে আমল করার ক্ষেত্রে বিষয়টি স্থগিত রাখবে। কেননা মূলনীতি হলো; কোন মাসআলায় মুজতাহিদের ক্ষমাসুলভ সিদ্ধান্ত, শাস্তিসুলভ সিদ্ধান্তের ভুলের চেয়ে উত্তম।
তবে কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত মত খণ্ডনের বেলায় কোনো ইতস্তত করা যাবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد
“যে এমন আমল করল যা আমার শরিয়তে নেই তা প্রত্যাখ্যান করা হবে”।
অতঃপর তিনি ব্যাখ্যা সাপেক্ষে ভুলকারী এবং সৎ ব্যক্তিদের ভুল বর্জনের বিষয়ে শিষ্টাচার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন; “মুজতাহিদ যদি ভুল করে তাহলে তার ভুল ক্ষমাযোগ্য এবং ইজতিহাদের কারণে তিনি সাওয়াবপ্রাপ্ত হবেন। তার যে কথা ও কাজ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হবে তা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। যদিও তা মুজতাহিদের ব্যক্তিগত মতামত ও আমলের বিপরীত হয়। কারো থেকে যদি ভুল ইজতিহাদ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে নিন্দাজ্ঞাপন ও গুনাহগার বলে সমালোচনা করা যাবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার ভুলকে ক্ষমা করে দিবেন। বরং এক্ষেত্রে কর্তব্য হলো – তার সাথে মুহাব্বত রাখা, তাকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ তার যে হক আদায় করতে আমাদের আদেশ করেছেন তা আদায় করা। যেমন তার প্রশংসা করা, তার জন্য দোয়া করা ইত্যাদি…”।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো আলিম বা অন্য কেউ ভুল করল। তাহলে আমাদের উচিৎ হল – তার মর্যাদা, অগ্রগামীতা ও ইসলামে তার খিদমতের কথা স্মরণ রেখে তারপর এই ভুল নিয়ে আলোচনা করা। এই বিষয়ে কেউ কাউকে নিন্দা করবে না। নিন্দা তো তাকে করা হবে – যে ভুল করেছে। কিন্তু সেইসাথে তার অগ্রগামীতা, তার মর্যাদা ও ইসলামের জন্য তার খেদমতগুলোর স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু যার মাঝে স্বজনপ্রীতি ও মূর্খতা রয়েছে সে শুধুই নিন্দা করে। কিন্তু আহলে ইলম, মুত্তাকী এবং ইনসাফকারীগণ শুধু শুধু নিন্দা করেন না (বরং ভালো দিকগুলো তুলে ধরেন)। ভুলের বিষয়টি যদি পরিষ্কার হয় তাহলে এই হুকুম।
আর যদি মাসআলাটি ইখতিলাফি বিষয় হয়ে থাকে তাহলে এখানে চুপ থাকাটাই শ্রেয়। আর যদি সঠিক না ভুল – তা নিশ্চিত হওয়া যায় না এমন ধরণের মাসআলা হয় তবে সেক্ষেত্রে চুপ থাকাই অধিক উত্তম।
অর্থাৎ আমরা ভুলের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। ভুল পরিষ্কার করব আর ব্যক্তিকে মাজুর মনে করব। মন্তব্য করা হবে – তার ভুল, বিদআত ও সে যে কাজে লিপ্ত আছে তা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। আর এই হল বিদআতিদের সাথে আচরণবিধির তৃতীয় মূলনীতি।