শায়খ খালিদ বাতারফি
এ যুগে আমরা দেখছি – যে মুসলমানকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন, মুসলিম বানিয়ে অনুগ্রহ করলেন, পক্ষান্তরে সৃষ্টির অনেক জীবকে এই মহান দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন – সেই মুসলিম আজ গর্ব করছে দল, সংগঠন, গোত্র, জাতীয়তা বা ভূখণ্ড নিয়ে।
অথচ কথা, কাজ ও নামের ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে তাদের খুব কমই গর্ব করতে দেখা যায়।
কতগুলো আচরণ থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। যেমন:
১. নিজ দলের সদস্যদের প্রতি দয়াশীল হওয়া আর অন্য মুসলিমদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা।
২. মুসলমানদের পরাজয়ের মাধ্যমে হলেও নিজের দলের বিজয় কামনা করা।
৩. নাফরমান মুসলমান, ‘আহলে কিবলা’ তথা আমাদের কিবলার অনুসারী বিদআতি মুসলিম এবং যে সকল পথভ্রষ্ট মুসলমান ধর্ম থেকে বের হয়ে যায়নি – তাদের উপর অহংকার করা, তাদেরকে দাওয়াত না দেওয়া এবং তাদের হেদায়াত কামনা না করা।
৪. নিজ দলের উপকার ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তীব্র ব্যাকুলতা, কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমদের সেবার ব্যাকুলতা না থাকা।
মুসলমানদের কথা, কাজ ও নামের দিক থেকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে গর্ব করার মতো চিত্র খুব কম দেখা যায়। পরিতাপের বিষয়: উলামা, তালিবুল ইলম এবং মুজাহিদগণের মধ্যেও এটা বিদ্যমান। আপনি দেখবেন, উলামা ও তালিবুল ইলমগণ নিজেদের কোন একটি মাদরাসা নিয়ে গর্ব করে আর অন্যান্য ইসলামী মাদরাসাগুলোকে অবজ্ঞা করে ও একপাশে ফেলে দেয় । হ্যাঁ, কতিপয় মাদরাসা হক এবং কুরআন-সুন্নাহ গ্রহণের ক্ষেত্রে তুলনামূলক এগিয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে একেবারে মাসুম ও নিষ্কলুষ নয়। প্রত্যেকেরই কিছু কথা গ্রহণীয় ও কিছু বর্জনীয় আছে।
এই নির্দিষ্ট মাদরাসার সাথে সম্পৃক্ততা এবং অন্যান্য মাদরাসাগুলোর ব্যাপারে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ শুধুমাত্র মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে শত্রুতা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং পরিতাপের বিষয়, এটা ওই মাদরাসার সাথে সম্পর্ক রাখে এমন সাধারণ মুসলিমদের সাথে আচরণের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়।
উদহারণ স্বরূপ- একজন মুসলিম হয়তো হানাফি মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু সে শাফিঈ মাযহাব, বা হাম্বলী মাযহাব বা ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহর মাযহাবের সাথে সম্পর্কিত মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করে। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এমন আচরণ আমাদের মাদরাসা বা দলের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন সাধারণ মুসলিমের সাথেও করা হচ্ছে। তার সাথে শত্রুতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহই একমাত্র সাহায্য কারি।
তাই হে আমার মুসলিম ভাই,
আপনাকে এই মহান দ্বীন নিয়ে গর্ব করতে হবে। এই দ্বীনের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকের প্রতি নমনীয় হবেন, এমনকি যদিও সে বিরোধী দলের হয়। সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝের প্রতি দাওয়াত দিতে ব্যাকুল থাকবেন। প্রত্যেক মাদরাসার হকসম্মত বিষয়টি গ্রহণ করুন। কোন সাম্প্রদায়িকতা বা পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত যোগ্য ও মর্যাদাবানদের মূল্যায়ন করুন। সর্বদা মনে রাখবেন, আপনি একজন মুসলিম। আপনার গর্ব হবে ‘ইসলাম’ নিয়ে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ
“এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে (তাঁর দ্বীনের জন্য) মনোনীত করেছেন। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। নিজেদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। সে পূর্বেও তোমাদের নাম রেখেছিল মুসলিম এবং এ কিতাবেও (অর্থাৎ কুরআনেও), যাতে এই রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে আর তোমরা সাক্ষী হতে পার অন্যান্য মানুষের জন্য। সুতরাং নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর। তিনি তোমাদের অভিভাবক। দেখ কত উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।” (সূরা আল-হজ্জ ২২:৭৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
المُسْلِمُ أخُو المُسْلِمُ، لاَ يَخُونُهُ، وَلاَ يَكْذِبُهُ، وَلاَ يَخْذُلُهُ، كُلُّ المُسْلِمِ عَلَى المُسْلِم حَرَامٌ عِرْضُهُ وَمَالهُ وَدَمُهُ، التَّقْوى هاهُنَا، بحَسْب امْرىءٍ مِنَ الشَّرِّ أنْ يَحْقِرَ أخَاهُ المُسْلِم
“আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তাকে মিথ্যা বলবে না (বা মিথ্যাবাদী ভাববে না), তার সাহায্য না করে তাকে অসহায় ছেড়ে দেবে না। এক মুসলিমের মর্যাদা, মাল ও রক্ত অপর মুসলিমের জন্য হারাম। তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি এখানে (অন্তরে) রয়েছে। কোনো মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করাটাই একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’’ (মুসলিম ২৫৬৪, তিরমিযী ১৯২৭)
যেমন কবি বলেছেন:
ابي الاسلام لا اب لي سواه * إذا افتخروا بقيس او تميم
যখন তারা (তাদের পিতৃপুরুষ) কায়েস ও তামিমকে নিয়ে গর্ব করে, তখন আমি বলি, আমার পিতা হল ইসলাম, ইসলাম ব্যতীত আমার কোন পিতা নেই।(অর্থাৎ আমি একমাত্র ইসলাম নিয়েই গর্ব করি)।
আরেক কবি বলেন:
كما رفع الإسلام سلمان فارس *
فقد وضع الشرك النسيب أبا لهب
যেমনিভাবে ইসলাম সালমান ফার্সিকে উপরে উঠিয়েছে,
তেমনি শিরক আবু লাহাবকে নিচে নামিয়েছে।
আমাদের সর্বশেষ কথা: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।